বোরোবুদুর

সেদিন প্রভাতে সূর্য এইমতো উঠেছে অম্বরে
                            অরণ্যের বন্দনমর্মরে;
                       নীলিম বাষ্পের স্পর্শ লভি
           শৈলশ্রেণী দেখা দেয় যেন ধরণীর স্বপ্নচ্ছবি।
           নারিকেল-বনপ্রান্তে নরপতি বসিল একাকী
                                ধ্যানমগ্ন-আঁখি।
           উচ্চে উচ্ছ্বসিল প্রাণ অন্তহীন আকাঙক্ষাতে,
                 কী সাহসে চাহিল পাঠাতে
                আপন পূজার মন্ত্র যুগযুগান্তরে।
                          অপরূপ অমৃত অক্ষরে
           লিখিল বিচিত্র লেখা; সাধকের ভক্তির পিপাসা
                          রচিল আপন মহাভাষা —
                       সর্বকাল সর্বজন
           আনন্দে পড়িতে পারে যে ভাষার লিপির লিখন।
           সে লিপি ধরিল দ্বীপ আপন বক্ষের মাঝখানে,
           সে লিপি তুলিল গিরি আকাশের পানে।
                 সে লিপির বাণী সনাতন
                       করেছে গ্রহণ
           প্রথম উদিত সূর্য শতাব্দীর প্রত্যহ প্রভাতে।
                       অদূরে নদীর কিনারাতে
                                আলবাঁধা মাঠে
           কত যুগ ধরে চাষী ধান বোনে আর ধান কাটে ,–
                       আঁধারে আলোয়
                 প্রত্যহের প্রাণলীলা সাদায় কালোয়
           ছায়ানাট্যে ক্ষণিকের নৃত্যচ্ছবি যায় লিখে লিখে,
                     লুপ্ত হয় নিমিখে নিমিখে।
        কালের সে-লুকাচুরি, তারি মাঝে সংকল্প সে কার
                     প্রতিদিন করে মন্ত্রোচ্চার,
                                বলে অবিশ্রাম ,–
                       “বুদ্ধের শরণ লইলাম।’
      প্রাণ যার দুদিনের, নাম যার মিলাল নিঃশেষে
                 সংখ্যাতীত বিস্মৃতের দেশে,
              পাষাণের ছন্দে ছন্দে বাঁধিয়া গেছে সে
                       আপনার অক্ষয় প্রণাম, —
                       “বুদ্ধের শরণ লইলাম।’
                 কত যাত্রী কতকাল ধরে
           নম্রশিরে দাঁড়ায়েছে হেথা করজোড়ে।
        পূজার গম্ভীর ভাষা খুঁজিতে এসেছে কতদিন,
                 তাদের আপনকণ্ঠ ক্ষীণ।
         ইঙ্গিতপুঞ্জিত তুঙ্গ পাষাণের সংগীতের তানে
                       আকাশের পানে
                     উঠেছে তাদের নাম,
           জেগেছে অনন্ত ধ্বনি, —  “বুদ্ধের শরণ লইলাম।’
           অর্থ আজ হারায়েছে সে যুগের লিখা,
                 নেমেছে বিস্মৃতিকুহেলিকা।
           অর্ঘ্যশূন্য কৌতূহলে দেখে যায় দলে দলে আসি
                       ভ্রমণবিলাসী, —
           বোধশূন্য দৃষ্টি তার নিরর্থক দৃশ্য চলে গ্রাসি।
           চিত্ত আজি শান্তিহীন লোভের বিকারে,
                 হৃদয় নীরস অহংকারে
           ক্ষিপ্রগতি বাসনার তাড়নায় তৃপ্তিহীন ত্বরা,
                 কম্পমান ধরা;
           বেগ শুধু বেড়ে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে মৃগয়া-উদ্দেশে,
          লক্ষ্য ছোটে পথে পথে, কোথাও পৌঁছে না পরিশেষে;
          অন্তহারা সঞ্চয়ের আহুতি মাগিয়া
           সর্বগ্রাসী ক্ষুধানল উঠেছে জাগিয়া;
                 তাই আসিয়াছে দিন,
                 পীড়িত মানুষ মুক্তিহীন,
                         আবার তাহারে
           আসিতে হবে যে তীর্থদ্বারে
                       শুনিবারে
      পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির —
           কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
                 আকাশে উঠিছে অবিরাম
      অমেয় প্রেমের মন্ত্র, — “বুদ্ধের শরণ লইলাম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *