1 of 2

বোবা – বনফুল

বোবা – বনফুল

মা-মরা মেয়ে মিনু। বাবা জন্মের আগেই মারা গেছে। সে মানুষ হচ্ছে এক দুর সম্পর্কীয় পিসিমার বাড়িতে। বয়স মাত্র দশ, কিন্তু এই বয়সেই সব রকম কাজ করতে পারে সে। সব রকম কাজই করতে হয়। লোকে অবশ্য বলে যোগেন বসাক মহৎ লোক বলেই অনাথা বোবা মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছেন। মহৎ হয়ে সুবিধাই হয়েছে যোগেন বসাকের। পেটভাতায় এমন সর্বগুণান্বিতা চব্বিশঘণ্টার চাকরানী পাওয়া শক্ত হত তাঁর পক্ষে। বোবা হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে, নীরবে কাজ করে। মিনু শুধু বোবা নয়, ঈষৎ কালাও। অনেক চেঁচিয়ে বললে তবে শুনতে পায়, সব কথা শোনার দরকার হয় না তার। ঠোঁট-নাড়া আর মুখের ভাব দেখেই সব বুঝতে পারে। এছাড়া তার আর একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে যার সাহায্যে সে এমন সব জিনিস বুঝতে পারে, এমন সব জিনিস মনে মনে সৃষ্টি করে, সাধারণ বুদ্ধিতে যার মানে হয় না। মিনুর জগৎ চোখের জগৎ, দৃষ্টির ভিতর দিয়েই সৃষ্টিকে গ্রহণ করেছে সে, শুধু গ্রহণ করেনি, নূতন রূপ, নূতন রং আরোপ করেছে তাতে।

খুব ভোরে ওঠে সে। ভোর চারটের সময়। উঠেই দেখতে পায় পূব আকাশে দপ দপ করে জ্বলছে শুকতারা। পরিচিত বন্ধুকে দেখলে মুখে যেমন মৃদুহাসি ফুটে ওঠে তেমনি হাসি ফুটে ওঠে মিনুর মুখেও। মিনু মনে মনে বলে—সই ঠিক সময়ে উঠেছ দেখছি। বৈজ্ঞানিকের চোখে শুকতারা বিরাট বিশাল বাষ্পমণ্ডিত একান্ত গ্রহ, কবির চোখে নিশাবসানের আলোক দূত, কিন্তু মিনুর চোখে সে সই। মিনুর বিশ্বাস সে-ও তার মতো কয়লা ভাঙতে উঠেছে ভোরবেলায়, আকাশবাসী তার কোন পিসেমশায়ের গৃহস্থালিতে উনুন ধরাবার জন্যে। আকাশের পিসেমশাইও হয়তো ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে তার নিজের পিসেমশাইয়ের মতো। শুকতারার আশেপাশে কালো মেঘের টুকবো যখন দেখতে পায়, তখন ভাবে ওই যে কয়লা। কি বিচ্ছিরি করে ছড়িয়ে রেখেছে আজ। মাঝে মাঝে এমন নুংরুট্টি হয় ও । বলে আর মুচকি মুচকি হাসে। তারপর নিজে যায় সে কয়লা ভাঙতে। কয়লাগুলো ওর শত্রু, শত্রুর উপর হাতুড়ি চালিয়ে ভারি তৃপ্তি হয় ওর। হাতুড়িটার নাম রেখেছে গদাই, আর যে পাথরটার উপর রেখে কয়লা ভাঙে তার নাম দিয়েছে শানু। শানের সঙ্গে মিল আছে বলে বোধহয়। কয়লা-গাদার কাছে গিয়ে রোজ সে ওদের মনে মনে ডাকে—ও গদাই ও শানু, ওঠ এবার, রাত যে পুইয়ে গেছে। সই এসে কয়লা ভাঙছে। তোমরাও ওঠ। কয়লা ভাঙতে ভাঙতে সে অস্পষ্ট হিস্ হিস্ শব্দ করে একটা। মনের ঝাল মিটিয়ে শত্রুর মাথা ভাঙছে যেন। কয়লা ভেঙে তারপর যায় সে ঘুঁটের কাছে। ঘুঁটে তার কাছে ঘুঁটে নয়, তরকারি। উনুনের নাম রাক্ষসী। উনুন রাক্ষসী কেরোসিন তেল-দেওয়া ঘুঁটের তরকারি দিয়ে শত্রুদের, মানে, কয়লাদের খাবে। আঁচটা যখন গনগন করে ধরে ওঠে তখন ভারি আনন্দ হয় মিনুর। জ্বলন্ত কয়লাগুলোকে তার মনে হয় রক্তাক্ত মাংস, আর আগুনের লাল আভাকে মনে হয় রাক্ষসীর তৃপ্তি। বিস্ফারিত-নয়নে সে চেয়ে থাকে। তারপর ছুটে চলে যায় উঠোনে, আকাশের দিকে চেয়ে দেখে সেখানে উষার লাল আভা ফুটেছে কি না, উষার লাল আভা যেদিন ভাল করে ফোটে সেদিন সে ভাবে সইয়ের উনুনে চমৎকার আঁচ এসেছে। যেদিন আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে সেদিন ভাবে, ছাই পরিষ্কার করেনি, তাই আঁচ ওঠেনি আজ। এই ভাবে নিজের একটা অভিনব জগৎ সৃষ্টি করেছে সে মনে মনে। সে জগতের সঙ্গে বাইরের জগতের মিল নেই। সে জগতে তার শত্রু মিত্র সব আছে। আগেই বলেছি কয়লা তার শত্রু। তার আর একদল শত্রু আছে, বোলতা ভীমরুলরা। একবার কামড়েছিল তাকে। সে যন্ত্রণা সে ভোলেনি। প্রতিশোধ নিতেও ছাড়ে না। দুপুরে যখন পিসিমা ঘুমোয় তখন সে ঘুরে বেড়ায় কোমরে কাপড় জড়িয়ে আর গামছায় একটা প্রকাণ্ড গেরো বেঁধে। বোলতা বা ভীমরুল দেখতে পেলেই সোঁ করে গামছাটা ঘুরিয়ে মারে। অব্যর্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় মাটিতে। অনেক সময় মরে যায়, অনেক সময় মরে না। না মরলে ঝাঁটা-পেটা করে মারে তাকে। আর হিস হিস শব্দ করে। বোলতা বা ভীমরুল মেরে সে খেতে দেয় পিঁপড়েদের। পিঁপড়েরা তার বন্ধু। মরা বোলতাটাকে নিয়ে যাবার জন্যে শত শত পিঁপড়ে ভিড় করে আসে। তারা কেমন করে খবর পায় কে জানে। বোলতাটাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় যখন তারা তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে মিনু। কুঁই কুঁই কুঁই কুঁই শব্দ বেরোয় তার মুখ থেকে। এটা তার উচ্ছ্বসিত আনন্দের অভিব্যক্তি।… পিঁপড়েরা ছাড়া আরও অনেক বন্ধু আছে তার। রান্নাঘরের বাসনগুলি সব তার বন্ধু। তাদের নাম রেখেছে সে আলাদা আলাদা। ঘটিটার নাম পুঁটি। ঘটিটা একদিন হাত থেকে পড়ে গিয়ে তুবড়ে গেল। মিনুর সে কি কান্না। তোবড়ানো জায়গাটায় রোজ হাত বুলিয়ে দেয়। গেলাস চারটের নাম হারু, বারু, তারু আর কারু। চারটে গেলাসই একরকম। কিন্তু মিনুর চোখে তাদের পার্থক্য ধরা পড়ে। গেলাসগুলোকে যখন মাজে বা ধোয় তখন মনে হয় সে যেন ছোট ছেলেদের স্নান করাচ্ছে। মীটসেটা ওর শত্রু। ওটার নাম দিয়েছে গপগপা। গপগপ করে সব জিনিস পেটে পুরে নেয়। মাঝে মাঝে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মীটসেফের চকচকে তালাটার দিকে, আর মনে মনে বলে—আ মর, মুখপোড়া, সব জিনিস পেটে পুরে বসে আছে। মিনুর আর একটি দৈনন্দিন কর্তব্য আছে। যখন অবসর পায় টুক্ করে চলে যায় ছাতে। ছাত থেকে একটা বড় কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। কাঁঠাল গাছের মাথার দিক থেকে একটা সরু শুকনো ডাল বেরিয়ে আছে। সেই ডালটার দিকে সাগ্রহে চেয়ে থাকে মিনু। মনে হয় তার সমস্ত অন্তব যেন তার দৃষ্টিপথে বেরিয়ে গিয়ে আশ্রয় করেছে ওই ডালটাকে। এর কারণ আছে। তার জন্মের পূর্বেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছিল। বাবাকে সে দেখেনি। অনেকদিন আগে তার মাসিমা তার কানের কাছে চিৎকার করে একটা বিস্ময়ের খবর বলেছিল তাকে। তার বাবা না কি বিদেশ গেছে, অনেক দূর বিদেশ, মিনু বড় হলে তার কাছে ফিরে আসবে, হয়তো তার কোলেই আসবে। মিনু বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা ভাল করে। একটা জিনিস কেবল তার মনে গাঁথা হয়ে ছিল—বাবা ফিরে আসবে। কবে আসবে? মিনু কত বড় হলে আসবে? কথাটা মাঝে মাঝে ভাবত সে। এমন সময় একদিন একটা ঘটনা ঘটল। সে সেদিনও ছাতে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে পেল পাশের বাড়ির টুনুর বাবা এল বিদেশ থেকে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে, আর ঠিক সেই সময়ে তার নজরে পড়ল ওই সরু ডালটায় একটা হলদে পাখিও এসে বসল। সেইদিন থেকে তার বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছে ওই সরু ডালে যেদিন হলদে পাখি এসে আবার বসবে সেইদিনই তার বাবা আসবে বিদেশ থেকে। তাই ফাঁক পেলেই সে ছাতে উঠে কাঁঠাল গাছের ওই সরু ডালটার দিকে চেয়ে থাকে। হলদে পাখি কিন্তু আর এসে বসে না। তবু রোজ একবার ছাতে ওঠে মিনু। এটা তার দৈনন্দিন কর্তব্যের মধ্যে একটা। ছাতে উঠে আর একটা জিনিস চোখে পড়ল তার। রাস্তার কালো কুকুরটার পায়ের থাবার উপরে ঘা হয়েছিল একটা, মিনু দেখত কুকুরটা রোজ সেটাকে চাটে। নিবিষ্ট মনে চেটে যায় খালি। তারপর মিনু সবিস্ময়ে একদিন লক্ষ করল ঘা-টা সেরে গেছে। কেবল চেটে চেটে ঘা-টাকে সারিয়ে ফেলেছে কুকুরটা। অবাক হয়ে গেল মিনু। তার মনে হল ঘা-টা বোধহয় আমসত্ত্বের মতো। তাই চাটতে পেরেছে। তাক লেগে গেল ওর ডাক্তারি দেখে। আর একটা জিনিসও বসে গেল ওর মনে—ঘা নিশ্চয়ই আমসত্ত্ব, তা না হলে চাটতে পারে কেউ?… দিন কয়েক পরে পিসিমার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা ছেঁচে গেল শিল পড়ে। পিসেমশাই কি একটা ওষুধ দিলেন। বোধহয় হোমিওপ্যাথিক। বললেন সাতদিন পরে আর এক দাগ দেবেন। এই সাতদিনে ঘা কিন্তু খুব বেড়ে গেল। যন্ত্রণায় পিসিমার চোখে জল পড়তে লাগল। পাড়ার হারু ডাক্তার সকালে এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে পিসিমা ঘুমুচ্ছেন, পায়ের পটিটা আলগা হয়ে সরে গেছে, ঘা-টা দেখা যাচ্ছে। মিনুর মনে হল আমসত্ত্ব, আমসত্ত্বের মতোই তো কালচে দেখতে। তার ইচ্ছে হল চেটে দিই একটু, হয়তো সেরে যাবে, কুকুরটা তো চেটে চেটেই সারিয়েছে ঘাটা। মিনু জিব বার করে চেটে দিলে ঘা-টা। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল পিসিমার। আঁৎকে চিৎকার করে উঠলেন তিনি—কি করলি পোড়ারমুখী। পাখাটা ছুঁড়ে পারলেন তিনি মিনুকে। মিনু পালিয়ে গেল। লুকিয়ে রইল সমস্ত দিন। সেইদিনই রাত্রে কম্প দিয়ে জ্বর এল তার। কাউকে কিছু বললে না। মনে হল জ্বর হওয়াটাও বুঝি অপরাধ একটা।…ভোরে ঘুম ভেঙে গেল, রোজ যেমন কয়লা ভাঙতে যায় সেদিনও তেমনি গেল, সেদিনও চোখে পড়ল কতারাটা দপদপ করে জ্বলছে। মনে মনে বলল—সই এসেছিস। আমার শরীরটা আজ ভাল নেই ভাই। তুই ভাল আছিস তো? উনুনে আঁচ দিয়ে কিন্তু সে আর জল ভরতে পারলে না সেদিন। শরীরটা বড্ড বেশি খারাপ হতে লাগল। আস্তে আস্তে গিয়ে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। কেমন যেন ঘোর ঘোর মনে হতে লাগল।…চাটবার পর থেকে পিসিমার ঘা-টাও বেড়ে গিয়েছিল খুব। মিনু টের পায়নি, কারণ পিসিমার কাছে আর সে ঘেঁষেনি। এ-ও জানত না যে পিসেমশায় পাশের গাঁয়ে তাঁর শালাকে খবর পাঠিয়েছিলেন পিসিমাকে দেখে যাবার জন্য। পাশের গাঁয়ে পিসিমার যে ভাই আছে একথাও মিনু জানত না। নিজের ছোট্ট ঘরটিতে মিনু জ্বরের ঘোরে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। জ্বরের ঘোরেই হঠাৎ তার মনে হল একটা দরকারি কাজ করা হয়নি কিন্তু। আস্তে আস্তে উঠল সে বিছানা থেকে, তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে দাঁড়াল ছাতের সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠে গেল ছাতে। কেউ দেখতে পেল না। পিসিমা পিসেমশাই তখনও ঘুমুচ্ছেন। ছাতে উঠেই চোখে পড়ল লালে লাল হয়ে গেছে পূর্বাকাশ। বাঃ চমৎকার আঁচ উঠেছে তো সইয়ের। একটু হাসল সে। তারপর চাইল সেই সরু ডালটার দিকে। সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল তার। একটা হলুদ পাখি এসে বসেছে। তাহলে তো বাবা নিশ্চয় এসেছে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না ছাতে, যদিও পা টলছিল তবু সে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। এসেই দেখতে পেল বাইরের বারান্দায় একটি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ছুটে গিয়ে তাঁর পা দুটো জড়িয়ে ধরল, তার মুখ থেকে কুঁই কঁই কুঁই কুঁই শব্দ বেরুতে লাগল। ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গে পিসেমশাই বেরিয়ে এলেন কপাট খুলে।

“কে এই মেয়েটা আমার পায়ে মুখ ঘষছে এমন করে।”

“তোমার পায়েও মুখ ঘষছে। তোমার দিদির পায়ে কাল কামড়ে দিয়েছে ও! পাগল হয়ে গেছে বোধহয়!”

চুলের ঝুঁটি ধরে হিড় হিড় করে সরিয়ে দিলেন তিনি মিনুকে।

সাতদিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হল মিনুর। তার সমস্ত মুখ ঘা-য়ে ভরে গিয়েছিল। সেপ্‌টিসিমিয়া হয়েছিল, ডাক্তাররা বললেন, সমস্তক্ষণই সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে ছিল। মৃত্যুর খানিকক্ষণ আগে জ্ঞান হল কয়েক মিনিটের জন্য। চোখ খুলে দেখল সামনে একটা খোলা জানলা দিয়ে আকাশের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। দপদপ করে জ্বলছে শুকতারাটা। মুখে মৃদু হাসি ফুটল মিনুর। মনে মনে বলল—সই এবার তোর কাছে যাচ্ছি।

কে জানে শুকতারার দেশের লোকেরা বোবা মিনুর মনের কথা বুঝতে পেরেছে কি না।

১ মে ১৯৬০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *