বেলা কতো বড়ো – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
গ্যাসলাইটের ঠিক নিচেই এককাঁড়ি আবর্জনা। ছাইপাঁশ মরা ফুল আনারসের খোসা ছেঁড়া ন্যাকড়া কাগজকুচি। গলির ঠিক ভেতরটা না হলে এ-জঞ্জালের কিছু কিছু উড়তে-পুড়তে পারতো। এই আবর্জনাস্তূপ এত খুঁটিয়ে অপরেশের লক্ষ করার কারণ, গলির বাদবাকিটা তকতকে। জঞ্জাল গোচ্ছার এখানেই, বাঁকের মুখে। তবে লক্ষের প্রধান কারণ, এই মৃত্যুস্তূপের বাতিলের মাঝখানে মুমূর্ষু এক বেড়াল। শুয়ে আছে, চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে আছে, তবু আছে বেঁচে। গলিতে গাড়িঘোড়া চাপা পড়েনি। এমনি কোনো হলুদ অসুখে বেড়ালটি পীড়িত। অসুখের রঙ হলুদ, এটা অপরেশের বিশ্বাস। অপরেশ কবি, অপরেশ চিত্রশিল্পী। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অপরেশ এখন মাস্টারমশাই। স্কুলের পঞ্চাশ-ছোঁয়া মাঝারি স্বাস্থ্যের অপরেশ এই গলির একটি বাড়িতে বিশেষ কাজে এসেছে। তাকে ডেকে আনানো হয়েছে। একজন, যে ডেকেছে, সেও অসুস্থ। অসুখের রঙ-বর্ণ অপরেশের কাছে গভীর হলুদ।
আমাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে সে ভিতরে গেল। বাইরের ঘরটি তেকোনা। একটি জানলা। মাঝের টেবিলের একদিকে সোফা, অন্যদিকে দুটো চেয়ার। পাখা আছে, কিন্তু ঘুরছে না। উঠে চালাবার চেষ্টা করলাম। চললো না। আমি বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে চা নিয়ে এলো অপরেশ, সঙ্গে একটি বছর আঠারোর মেয়ে। বললো, আমিই নিয়ে এলুম। ও যদি ফেলে দেয়।
তোমার নাম?
অনীতা।
কী পড়ো?
আসছে বছর মাধ্যমিক⋯
কোথায়?
ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন ও উত্তর। কিছুটা সময় গেলো। অনীতা ভিতরে। অপরেশ বললো, এক অসুস্থ আত্মীয়াকে দেখতে এসেছি। এবার যাবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই। তোমার তাড়া নেই তো তেমন? বলেছি, ও ভুলে গেছে; আজ কোনো কাজ রাখিনি। সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো। ওরও কোনো কাজ নেই। কিন্তু, হঠাৎই সবকিছু ভুলে গেছে।
এখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। রোদ্দুরের তাপ কম। চিনেবাদামঅলা হেঁকে যাচ্ছে। বললুম, আমি ঠিকই আছি। তুমি তোমার কাজ সেরে নাও। অসুবিধে, পাখা নেই। কী করা যাবে?
অনীতা আমার কাছে এসে বসেছে। একা ছিলুম খুব ভালো ছিলুম। এখন কিছু অবান্তর প্রশ্ন করতে হবে বেচারাকে।
ও হঠাৎ উঠে গিয়ে একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস শুরু করলো।
সত্যিই দরদরিয়ে ঘামছিলুম। মুখে বললুম, আমায় দাও। তুমি কষ্ট করছো কেন? তোমার স্কুল ছিল না আজ?
ছিল?
যাওনি?
এমনিই যাইনি। মা বলেছিলো না যেতে।
তোমার মা-ই অসুস্থ? না কি অন্য কেউ?
প্রশ্নটা বিদঘুটে হয়ে গেলো। কিন্তু, কিছুই করার উপায় নেই এখন।
না, মা-ই অসুস্থ। আর তো কেউ নেই আমাদের। আমি আর মা থাকি এই ফ্ল্যাটে।
গলির মুখে গিয়ে অপরেশ এক কাণ্ডই করলো। আমায় বললো, দাঁড়াও এটাকে এককোষ জল দিই।
সামনের টিউবওয়েল থেকে এককোষ জল এনে বেড়ালটার মুখে দিল। বললো, এ ছাড়া কিছু করার নেই। মরবেই। এই কথাক’টি উচ্চারণের সময় অপরেশের গলা একটু অন্যরকম শোনালো মনে হলো। প্রকৃত তা না হতেও পারে। গরমে বসে আমার ইন্দ্রিয়েরই বিকার ঘটে থাকবে।
অপরেশ উঠেছে হিন্দ সিনেমার কাছে কোন এক প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউসে। কাজে এসেছে। স্কুলের কাজ। আজকাল এলে ও এখানেই ওঠে। শহরের মাঝখানে অবস্থান এই গেস্ট হাউসের। মধ্য কলকাতা। এখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারো। যাওয়া সহজ। খাবার ব্যবস্থা নেই। চা-পানির ব্যবস্থা আছে। খাওয়ার জন্যে অপরেশ বঙ্গলক্ষ্মীতে দুপুরে যায়। সন্ধ্যায় যেখানে ইচ্ছে সেখানে।
একটা ঘরে দুটি বেড। অপরেশের সঙ্গে স্কুলের অন্য এক মাস্টারমশাইও এসেছেন। তবে তাঁর বেড নামকোয়াস্তে নেওয়া। তিনি এখানে থাকেন না। রূপচাঁদ মুকুজ্জে লেনে ভায়রার বাড়ি ওঠেন। যে ক’দিন কলকাতা থাকেন, তা ওখানেই।
ফেরার দিন সকালে গেস্ট হাউসে চলে আসেন। দু’জনে ফেরেন আসানসোল। বিকেলের গাড়িতে। কর্মস্থল ওখানেই। বাইরে অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। বড় রাস্তায় জলে-চাকায় কাপড়ছেঁড়া আওয়াজ হচ্ছে অনবরত। অপরেশ শুয়ে আছে। মুখ ওদিকপানে ফেরা। আড্ডার সন্ধ্যা এমনই চুপচাপ কাটছে। বেশ কিছুক্ষণ দুই আড্ডাধারীর বিশ্রাম। অপরেশকে হঠাৎ বদলে যেতে দেখছি।
কেমন আত্মীয় উনি তোমার। কী হয়েছে?
বিদায় নেবার আগে সামান্য পরিচয় হয়েছিলো।
মহিলা কাঁদছিলেন কেন?
কাঁদছিলেন নাকি? তুমি শুনেছো?
দেখেছি। তখনও চোখের কোলে জল ছিলো।
হয়েছে ক্যান্সার। বাঁচবে না। বেঁচেও ছিলো না আমার কাছে। আমার কাছে ও বিশ বছর হলো মারা গেছিলো।
তাহলে?
তাহলে আর কী? হঠাৎই বেঁচে উঠেছে। বাঁচতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার মৃত্যু সামনে নিরুপম। আমি দেখতে পাচ্ছি।
বেলার বুবুনের কী হবে আমি ভেবে পাচ্ছি না।
কেন? ওদের আবার কী হবে?
বেলা অপরেশের স্ত্রী। বুবুন ছেলে। সাঁকতোরিয়ায় ওদের কোয়ার্টারে আমি দু-তিনবার বেড়াতে গেছি। সুন্দর সংসার। ছোট্ট ছিমছাম। বাড়ির দুদিকের দুটুকরো বাগানের একদিকে সজিনা, অন্যদিকে শেফালি জুঁই রজনীগন্ধার ঝাড়। বারান্দা ভর্তি টবে ক্যাকটাস। একটা গ্যালভানাইজড তার বারান্দার এমুড়া থেকে ওমুড়ো।
অপরেশের ঘুম ভাঙে দেরিতে। তাছাড়াও রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে অন্যদিনের তুলনায় উঠতে দেরি হয়েছে আজ। কাজ আছে। দুপুরের দিকে। স্কুল-সংক্রান্ত কাজ। বোর্ড আপিসে যেতে হবে। মুখ ধুয়ে চায়ের প্রতীক্ষা করছে সে, এমন সময় একটি অল্পবয়সী মেয়ে ঘরের দরজায়।
এখানে অপরেশ রায় থাকেন?
কেন, আমিই অপরেশ।
মা আপনাকে এই চিঠিটা দিতে বললেন।
মা, চিঠি, অপরেশ রায়—এসব নিয়ে ক’মুহূর্ত বিহ্বল বোবা হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। মুখ তুলে তাকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না। তন্দ্রা ভেঙে দৌড়ে নিচে গেলাম। নাঃ, সে নেই। বুঝলাম সবই। তপতী ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। মেয়েকেও পাঠিয়েছিলো। নিজের মেয়েকে একটুক্ষণ ভিতরেও ডাকলাম না। চলে গেলো। আমার অবস্থাটা এখন বুঝতে পারছে নিরুপম? আমি কী করবো বলতে পারো?
তপতীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো বিশ-বাইশ বছর আগে। তখন কলকাতায় থাকতুম। এই মলঙ্গা লেনে। সরকারি চাকরি করতুম। বিয়ের পর কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিলো, সম্পর্ক টানা যাবে না। তপতী সিনেমা থিয়েটার ভালোবাসে, জীবনের হই হই অংশটা ভালোবাসে। আর আমি ঠিক উলটো। তবু চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে অনীতার আসার কথা টের পেলাম। ভাবলাম, এবার তপতী বদলে যাবে নিশ্চয়। কিন্তু তপতী বদলালো না। সিনেমা থিয়েটারের নেশা আরো ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেলো। নিজেও চাকরি করতো একটা, ভালোই চাকরি। প্রাইভেট ফার্মে ম্যানেজারের পি এ। মেয়ে হওয়ার সবটুকু দায়িত্বই আমাকে পোয়াতে হলো। তার খাওয়ানো, স্নান করানো, ঘুম পাড়ানো সব কিছু আমার উপর। সত্যি বলতে কী, আমার খারাপ লাগতো না। বাড়িতে একটা কাজের লোক ছিলো অনীতা তার কাছে ঘণ্টা দু-আড়াই থাকতো। আমি আপিস চলে আসতাম। আমার কাজের কোনো চাপ ছিলো না। কিন্তু, তপতী খুব রাত করে ফিরতে শুরু করলো। একদিন ওর মুখে মদের কটু গন্ধ পেলুম। সেদিন প্রচণ্ড চড়চাপড় মারলুম ওকে। সকালেবেলা উঠে বললো, আমি আলাদা থাকবো। ফ্ল্যাট দেখেছি। তুমি অনীতাকে নিয়ে নিতে পারো।
অনীতাকে নিয়ে আমি একটা পুরুষমানুষ কী করবো! অনীতা তার মার সঙ্গেই গেলো। মনে মনে মেয়ের বেঁচে না থাকার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে পড়ে রইলুম মলঙ্গা লেনের সেই একটা ঘরে। তপতী চলে গেলো। আমার সঙ্গে এতকাল কোনো সম্পর্কই ছিলো না তার। এমন কি জানতুমও না কোথায় থাকে। কী করে? মেয়েটার জন্যে মাঝেমধ্যেই কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু, কীভাবে আর দেখতে পাবো? জীবনের এই অধ্যায়টা ধীরে ধীরে এতগুলো বছরের ব্যবধানে ভুলেই গিয়েছিলুম। হঠাৎ কোথা থেকে কী হলো? আমি মারাত্মক দোটানার মধ্যে পড়ে গেলুম। ও তো আজ নয় কাল চললো। মেয়েটার অপরাধ কী? অপরাধ কোথায়? আমি বেঁচে থাকতেও কীভাবে অনাথ করে দিতে পারি।
তুমি জানো গত সপ্তাহে কেষ্টপুরের ওখানে যে জমিটা কিনলুম, সে অনীতার কথা ভেবেই। এখনি দরকার পড়ছে না, কিন্তু পরে তো পড়বেই। এখন ওর মার ফ্ল্যাটটা আছে। নিজের ফ্ল্যাট। কিন্তু মার অবর্তমানে ও একা কীভাবে থাকবে?
তুমি বেলাকে জানিয়েছো?
জানিয়েছি নিশ্চয়। কিন্তু, বেলা একদম ভালোভাবে নিতে পারেনি। বেলা বড় ভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। হয়তো মেয়েরা এরকম বিপদে পারে না। কিন্তু, আমার বিশ্বাস ছিলো বেলা পারবে। তাই ওকে খোলাখুলি সমস্তই লিখেছিলুম।
সে সপ্তায় বাড়ি গেছি, বেলা আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। আমার ব্যাগ ঘেঁটে অনীতার একটা ছবি পায়। ছবিটাকে কুটিকুটি করে আমার সামনে ছেঁড়ে। বিয়ের আগে আভাসে জানিয়েছিলুম, পুরনো অধ্যায় জীবনের। ও বলেছিলো, তাতে কী হয়েছে? দিদি না ফিরলেও মেয়েটা তো আমাদের। ও আমাদের কাছে থাকবে। ও যাবে কোথায়? ওকে ফেলে দেবো কী করে?
তখনো বুবুন হয়নি। সবে আমাদের বিয়ে হয়েছে।
লিখেছিলুম, তপতীকে আমি দেখে এসেছি। ও বেশিদিন নেই। অনীতাকে তুমি কোলের কাছে ঠাঁই দেবে বলেছিলে। ওকে তো আর ভাসিয়ে দিতে পারা যাবে না। কী ভাবে কী করবে, তুমি ভাবো। আমি আর ভাবতে পারছি না।
কিন্তু বেলা কোনো ভাবনার দায়িত্ব নিলো না। পাথরের মতো মূক হয়ে সংসার করে যেতে থাকলো। ওর অভিযোগ: আমি আজকাল কলকাতায় বেশি যাই শুধুমাত্র এ-কারণেই সাঁকতোরিয়ায় আসি না। এলেও, ঘণ্টা কয়েক থাকি। আমার মন কলকাতায় পড়ে রয়েছে। পুরনো সংসার নতুন করে করার ইচ্ছা জাগছে।
এ-অভিযোগের কোনো উত্তর হয় না। আমি কী উত্তর দেব?
আমি এমনকি বুবুনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বেলা বুবুনকে ডেকে নেয়। এক অসহ্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সাঁকতোরিয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, চেনাজানা বন্ধুবান্ধব একথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
এরপর দু সপ্তা কেটে গেছে। শনিবার রাতে সাঁকতোরিয়ায় ফিরে অনীতাকে বাড়িতে দেখে নিজের চোখকে কেমন বিশ্বাস করতে পারছি না।
বেলা জামা ছাড়িয়ে দিতে এলো আগের মতন। এসে বললো, দিদি মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। আমি তো তোমায় চিঠিতে জানিয়েছি। চিঠি পাওনি? তো আমি মেয়েকে রেখে দিলাম। ওকে ছাড়বো না। শুধু একদিন তোমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে। গিয়ে বইপত্র জামাকাপড় সব নিয়ে আসবে। এখান থেকেই, আমার স্কুল থেকেই পরীক্ষা দেবে। স্কুলেও যাচ্ছে। আমি ওকে ভর্তি করে নিয়েছি। রোজ বুবুনের সঙ্গে স্কুলে যায়। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।
অপরেশের বুক থেকে পাথরের ভার সরে যায়।
ঘটনাটা এরকম ঘটেছিলো। সেদিন সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। একটা গাড়ি এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। বেলা সবে উঠে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। যথেষ্ট সকাল হয়নি। এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে বলেন, তুমি বেলা, আমি তোমার মেয়েকে তোমার হাতে দিতে এলুম।
বেলা সবই বুঝল এবং বদলে গেলো। এ-ব্যাপারে যাবতীয় বিরোধিতার পাহাড় ভেঙে গেলো। জড়িয়ে নিলো কোলে অনীতাকে। বললো, আপনি বিশ্রাম করে, দুপুরে খেয়েদেয়ে যাবেন। না বেলা, আমার সময় নেই। এ গাড়ি কলকাতা থেকে ভাড়া করে এসেছি। এখনি ফিরতে হবে। তুমি একগ্লাস জল দাও। ভারি পিপাসা পেয়েছে।
তারপর?
তারপরের ব্যাপারটা আমার কাছে অলৌকিক ঠেকে। বেলা ভুল করছে বলেই মনে হয়। যেদিন ওদের আসার কথা বলছে বেলা, হিসেব কষে দেখছি, তার দু’দিন আগে তপতী মারা গেছে।
১৩৯১ (১৯৮৪)