বৃষ্টিতে নিশিকান্ত
কেচ্ছাকেলেঙ্কারির মতো বৃষ্টি হচ্ছে কদিন। জলের ফোঁটা লক্ষ অবুদ গুড়ুলের মতো ছুটে আসে আকাশ থেকে, মাটি খুঁড়ে বসে যায় ভিতরে। গায়ে লাগলে ফটাস করে ফাটে। ব্যথা পায় নিশিকান্ত। আদিঅন্ত সাদা হয়ে আছে, শীতের কুয়াশার মতো, কিছু নজর চলে না। আর সেই সাদাটে ভাবের আবডালে কী যে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড হচ্ছে কে জানে! উলটে পালটে যাচ্ছে জগৎসংসার। সেই কেচ্ছাকেলেঙ্কারির কথাই বৃষ্টির শব্দে ছড়িয়ে যাচ্ছে, ফিস ফাস গু জ্বর গুজুর। ওই বৃষ্টির আবডালে আবার জগৎসংসার যে থেমে আছে এমনও নয়। বেলপুকুরের বাজারে মহেন্দ্রর দর্জির দোকানে মেশিন চলছে খরখর শব্দে। মুদির দোকানে দু-চারজন কাকভেজা লোক সওদা করছে। আলু পেঁয়াজ নিয়ে ভূপেন বসেছে ভুষিওয়ালার বারান্দায়। দোকান সব একটু আধটু ফাঁক করে কাজকর্ম চলছে ঠিকই। কিন্তু সেটা বোঝা যায় না। বৃষ্টির রকম দেখে মনে হয় মানুষজন বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব। দুনিয়ায় আর মানুষ মাটির চিহ্ন রাখবে না।
বাগনানের বাস কখন বন্ধ হয়ে যায় কে জানে। এখনও চলছে। নিশিকান্ত অন্ধকার বিকেলবেলায় বেলপুকুরে নেমে পড়ে বাস থেকে। গায়ে ফতুয়া, পরনের ধুতিখানা উরুত পর্যন্ত তোলা। ছাতাখানা বগলদাবা করেই নামে। এই বাতাস বৃষ্টিতে ছাতা খুলতে ভয় করে তার। ফটাস করে উলটে গিয়ে পুরোনো ছাতার শিকটা ছরকুটে যাবে। অবশ্য ছাতা খুলতে তাকে কখনও দেখেওনি কেউ।
রাস্তাঘাট কিছু দেখা যায় না। ঝুপুস করে জলে পা দেয় নিশিকান্ত। দোলের দিনে যেমন ছোঁড়ারা রঙের বেলুন ছুঁড়ে মারে আর সেটা ফটাস করে ফাটে, তেমনি আকাশঠাকুর ছুড়ছে তার বিদঘুঁটে বেলুন সব। নিশিকান্তের শরীরে অ্যাই বড়-বড় ফোঁটা ফাটছে। নামতে না নামতেই ভিজিয়ে একশা করে দিল। দৌড়ে গিয়ে সামনের দোকানটায় উঠে দাঁড়ায় সে। বৃষ্টির রকমটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাসটা তাকে ফেলে ইস্টিমারের মতো চলে গেল। কোমরের কাপড়ের মধ্যে শতপাল্লার ভাঁজে সাবধানে বিড়ি আর দেশলাই মুড়ে রেখেছে। দোকান ঘরের বেঞ্চটায় বসে কোমরের কাপড় আলগা দিয়ে নিশিকান্ত বিড়ি দেশলাই বের করে আনে। চায়ের দোকানদার তার দিকে বিরক্তির চোখে চায়। তার গা বেয়ে জল নেমে বেঞ্চ ভিজছে। নিশিকান্ত যে খদ্দের নয় একথা দোকানি জানে।
বিড়িটা জখম হয়ে গেছে। নিশিকান্ত দুধারে ফুঁ দিয়ে টিপেটুপে দেখে তারপর নিরাসক্ত গলায় বলে–আগুনটা দাও তো।
সামনে উনুন জ্বলছে, খামোকা দেশলাইয়ের একটা কাঠি নষ্ট করে কোন বুরবাক। দোকানদার অবশ্য গা করে না। তাই নিশিকান্ত উঠে বিড়িটা কেটলির পাশ দিয়ে উনুনে খুঁজে দেয়। ধরিয়ে আবার জুত করে বসে। তাড়া নেই। মহেন্দ্র দর্জির দোকানে আধবোতল চুয়া রাখা আছে, গতকাল মহেন্দ্র কলকাতা থেকে এনে রেখেছে, আজ নিয়ে যাওয়ার কথা। এই বৃষ্টি বাদলায় সে কাজটা নিশিকান্তকে দিয়ে না করালেই চলছিল না বউমণির। নিশিকান্ত বসে থাকে–এটা তার সহ্য হয় না। আজ দুপুরের কথাই ধরা যাক। এমন বাদলায় কার যে ডাব খেতে ইচ্ছে করে তা জন্মে জানে না নিশিকান্ত, কিন্তু বউমণির করল। তিনদিন রাতে খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে নাকি ধাত গরম হয়েছে। বৃষ্টি মাথায় সাঁই–সাঁই বাতাসের মধ্যে নিশিকান্তকে উঠতে হল গাছে। ভিজে–ভিজে পিছল হয়ে ছিল গাছ। পা হড়কে কয়েক হাত নীচে পড়েছিল সে। ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গেছে খানিক। এখনও জ্বালা করছে। দুটো বোঁটা আলগা ঝানু ডাব খসে পড়েছিল। লুকিয়ে নিশিকান্ত সে দুটোর মুখ কেটে ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে লেইটাকে জলের সঙ্গে মিশিয়ে। দিয়েছিল। লেই মেশানো ডাবের জল মিষ্টি ঘোলাটে একটা শরবতের মতো হয়ে যায়, তার ভারী স্বাদ। সেই শরবত খেয়ে খোলা দুটো ছুঁড়ে পুকুরে ফেলেছিল সে। তারপর বাবলা তলায় দাঁড়িয়ে দেখে পুকুরের ছাপানো জলে ভেসে-ভেসে ডুবন্ত মানুষের দুটো মাথার মতো কোন দেশান্তরে চলে গেল। এই ঝাঁপসা বৃষ্টির বেলায় পৃথিবীটা কত ছোট্টটি হয়ে এসেছে, তবু কালো মেঘের ছায়ায় এখনও কত নিরুদ্দেশ হওয়ার মতো জায়গা আছে। জল থেকে খুদে মাছ উঠে আসছিল, বাবলাতলায় কই মাছ বেয়ে উঠে এসেছে, ভেজা গাছের ডালে বসে কাক খাখা করে। নিশিকান্তর। তখন কত কী মনে পড়ি–পড়ি করে। কিন্তু আদতে কিছু তেমন মনে পড়ে না তার। নিশিকান্তর ওই হচ্ছে রোগ।
অন্ধকারে টর্চ বাতি জ্বেলে চলার মতো নিশিকান্তর অবস্থা। টর্চ বাতির যেটুকু আলো হয় সেটুকু গোলপানা আলোয় একটুখানি দেখা যায় মাত্র। সামনেও হাঁ করা অন্ধকার পিছনেও হাঁ করা অন্ধকার। অর্থাৎ নজর চলে না নিশিকান্তর হাতেও তেমনি এক টর্চ বাতি ধরিয়ে অন্ধকার দুনিয়ার দিগদারিতে পাঠিয়ে দিয়েছে কে। যেমন তার বিস্মরণ তেমনি তার ভবিষ্যৎ চিন্তা। ভাবতে বসলেই নিশিকান্তর কাছে তার জীবনটা এক ঝাঁপসা বাদলদিনের মতো লাগে, পৃথিবীটা ছোট্টটি হয়ে যায়। নজর চলে না বহুদূর পর্যন্ত। কে তার বাপঠাকুরদা, কোথায় তার বাড়ি ঘর, কী তার জাত গোত্র এ নিশিকান্তর জানা নেই। লোকে বলে সে হল হাবাগোবা মানুষ। তাই হবে। তবু নিশিকান্ত খুব ভাবতে ভালোবাসে। যেমন সেই ডাবের খোলা দুটো কোথায় হারিয়ে গেল, কোন বিশাল বিশ্বসংসারে চলে গেল ডুবন্ত মানুষের মতো ডাব দুটো তা নিশিকান্ত ভাবতে বসে।
ট্যাঁকে চুরি করা দুচার পয়সা তার থাকেই। হঠাৎ চায়ের একটা দমকা গন্ধ আর সেই সঙ্গে হাওয়ায় উনুনের একটু তাপ উড়ে এসে গায়ে লাগতেই নিশিকান্ত নড়েচড়ে বসে। তারপর তাচ্ছিল্যের গলায় বলে দাও তো এক ভাঁড় তোমার চা। খেয়ে দেখি।
দোকানদার উনুনটা খুঁচিয়ে একটু আঁচ তুলছিল। একটা ডেকচিতে আলু পেঁয়াজ কুঁচিয়ে রেখেছে, বোধহয় এক্ষুনি কেটলি নামিয়ে রাতের রান্নাটা সেরে রাখত। নিশিকান্তর কথা শুনে ফিরে তাকাল, তারপর চায়ের গুঁড়ো ঢালতে লাগল খয়েরি ন্যাকড়া–দেওয়া ছাঁকনিতে।
নিশিকান্ত বেঞ্চ থেকে উনুনের ধারটিতে আগুনের তাপে তেতে–ওঠা চৌহদ্দির মধ্যে এসে উবু হয়ে বসে। অল্প অল্প করে চায়ে চুমুক মারে, গরম ভাঁড়টা মাঝে-মাঝে চেপে ধরে ঠান্ডা গালে। কিছুই মনে পড়ে না, তবু কত কী যে মনে পড়ি–পড়ি করে তার। আধবোতল চুয়ার জন্য পলতাবেড়ে থেকে মাইল দেড় হেঁটে শিবগঞ্জ বাগনানের বাস ধরে সে যে এতটা পথ এসেছে এই বাদলায়, তাতে তার ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। এ সময়টায় ঘরে থাকলে তাকে বউমণি টোকার সঙ্গে হয়। মাছ ধরতে পাঠাত, নয়ত সাঁজাল দিতে। কিছু একটা করাতই। কিন্তু বাদলায় দোক্তা ফুরিয়েছে। বিকেলের আগে তামাক পাতা সেঁকা হয়েছে, ভাজা হয়েছে ধনে আর মৌরি। বিপিনবিহারী হামানদিস্তা নিয়ে বসেছে, দুমদাম শব্দে গুড়ো করছে সব। চুয়া মিশিয়ে বউমণি খাবে। ভাজা মশলার মাতাল মিঠে গন্ধে বর্ষার ছাতকুড়োপড়া গন্ধটা চাপা পড়েছে। কিছু গন্ধ আছে ভালোবাসার, যেমন গন্ধ গোলাপে, বক–ফুলের ভাজা বড়ায়, সোঁদা–স্যাঁতা মাটিতে। আবার কিছু নেশাডু গন্ধ। যেমন গন্ধ কেয়াফুলে, কিশোরীর ঘেমো শরীরে, ভাজা দোক্তাপাতায়। এমন কত গন্ধ যে হঠাৎ উড়ে আসে। তুলসীতে আর চন্দনে এক রকম ভগবানের গন্ধ আছে। পুরোনো পুঁথির পাতায় পাওয়া যায় কতকালের মন কেমন করা গন্ধ। সব গন্ধ ঠিক ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এই বর্ষার গন্ধটা যেমন। বড্ড মন খারাপ করে দেয়।
এই বর্ষায় ঘরের বার হওয়া মানুষের বড় তাড়া। একজন ছাতা–মাথায় গেরস্ত লোক ওপাশের দোকানে দৌড়ে এল কোলকুঁজো হয়ে, এক ঠোঙা মুড়ি কিনে আবার কোলকুঁজো হয়ে রাস্তা পেরোয়। ভাবগতিক দেখে মনে হয় ঘরে ঢুকেই হড়াস করে দরজা দিয়ে ঘড়াক করে হুড়কো তুলে দেবে। নিশিকান্ত একটুখানি হাসে। জগৎসংসারে মানুষের কত তাড়া থাকে। নিশিকান্তর নেই, তাই বউমণি বকে–বকে হয়রান। সারাদিন কোথাও বসে নিশিকান্ত একটু যে ভাববে তার উপায় নেই! কানে পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিলে নিশিকান্তর ভালো সব ভাবনাচিন্তা আসে। মাদার গাছটার তলায় বসে শুকনো উদাস দিনে নিশিকান্ত নিরিবিলি কানে পালক দিয়ে যখনই ভাবতে বসে তখনই বউমণির হাতে একটা লাটাইয়ে সুতোয় ঠিক টান পড়ে। ডাকে–নিশি…ই। নিশি অমনি চিন্তার শূন্যে উড়তে–উড়তে টান খেয়ে চমকে ওঠে। ভাবনা-চিন্তা সব লাট খেয়ে যায়।
সওদা করতে গিয়ে নিশিকান্ত ঠিকঠাক হিসাব মেলাতে পারে না। বউমণি নিয়ম করেছে অঙ্ক শিখতে হবে। বিপিনবিহারীর তাই আজকাল রাতের দিকে তাকে হিসাব শেখানোর ঝোঁক চাপে। বলে–বল দেখি দু টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সা থেকে এক টাকা আশি পয়সা বাদ দিলে কত থাকে? তখন তার দুনিয়াটাই কেমন ঝাঁপসা হয়ে যায় এই বাদলা দিনের মতো। কত থাকে! তাই তো! কত থাকে! দু-টাকা পঁয়তাল্লিশ থেকে এক টাকা আশি বাদ দিলে অনেক থেকে যায় মনে হয়। নাকি কিছুই থাকে না! দশটা বিড়ির দাম যদি হয় পাঁচ পয়সা, একটা ম্যাচিস দশ…তাহলে…কত যে থাকে। বাদ দিতে গিয়ে জান কাঠকয়লা হয়ে যায়। আর তখন গাঁট্টা মারে বিপিন। বলে–তোর কত বয়স খেয়াল আছে।
–হুঁ-উ! নিশিকান্ত বলে–দেড় কুড়ি।
–দূর ভূত, এক কুড়ি তো টোকারই বয়স। তুই তো আমার চেয়েও বড়। পঞ্চাশের কাছাকাছি তো হবিই।
তাই হবে! বয়েসের হদিস জানলে এ দশা হবে কেন তার!
আবার কিছু খারাপও সে নেই। বিস্মরণ হওয়াটা যে মন্দ সে টের পায় না। বেশ আছে। টর্চ বাতির আলোয় যেটুকু দেখা যায় সেটুকু দেখে-দেখে সে চলেছে ঠিক। আজ যা ঘটে তা বড়জোর এক হপ্তা সে মনে করতে পারে, তার ওপারে সাদা বৃষ্টি সব ঢেকে রাখে। বিস্মরণ হচ্ছে ঠিক টর্চ বাতির আলোর চৌহদ্দির বাইরের অন্ধকারের মতো, বাদলা দিনের মতো। চা–টা খেয়ে উঠে পড়ে নিশিকান্ত। সবাই জানে সে হচ্ছে একটু মাঠো লোক–ধীরস্থির, ঢিলাঢালা। কিন্তু তা বলে যে ইচ্ছেমতো কোথাও বসে থাকবে তার উপায় নেই। লাটাই বউমণির হাতে, সে হচ্ছে এক লাতন ঘুড়ি। যত দূরেই যায় নিশিকান্ত হঠাৎ হঠাৎ চমকা টান টের পায় সুতোর। লাট খায়। ঠিক যেন বউমণি ডাকে–নিশি–ই।
ছাতাটা না খুলেই সে বৃষ্টির জলে ছপাৎ পা ফেলল। যা বাতাস! ছাতা খুললে রক্ষে আছে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে হাত থেকে।
এখানকার মাটি বেলে, তাই তেমন পিছল নয়। তবু দু-একবার পা হড়কায় নিশিকান্তর। চবাস চবাস করে বৃষ্টি চাবকাচ্ছে, মাথা মুখ ফুটো করে দিয়ে যাচ্ছে রে বাবা! জলে ঝাঁপসা হয়ে আসে চোখের দৃষ্টি, কান বন্ধ। আবছা–আবছা দোকানঘর, মানুষজন দু-একটা দেখা যায়। জগৎসংসার যেন বা থেমে গেছে দম ফুরানো ঘড়ির মতো।
মহেন্দ্র তার অবস্থাটা চোখ তুলে দেখে। দর্জিঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিশিকান্ত কাপড় নিঙড়ে নেয়, পিরানটা খুলে জল চিপে মাথা গা মুছতে থাকে। ছাতাটা আগাগোড়া খোলেনি সারা রাস্তা, তবু ছাতাটা ভিজে গেছে। মহেন্দ্র হেঁকে বলে–ছাতা বাইরে রাখ, তুমিও বাপু ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে গায়ের জলে ঝরিয়ে এসো। এ বাদলায় ঘর যদি ভেজে তো শুকোবে না।
তাই করে নিশিকান্ত। দাঁড়িয়ে থাকে।
মহেন্দ্র কল চালাতে-চালাতে বলে–ছাতাটা তো সারা জীবন বগলেই দেখলাম। কোনওদিন খুলেছ?
–খুলি মাঝে-মাঝে, রোদে শুকোতে যখন দিই।
মহেন্দ্র হাসে। বলে নিশি, ছাতাটা তো ভোগে লাগালে না। তবে কেন বয়ে বেড়াও হে?
–কাজে লাগে। নিশিকান্তর উদাস উত্তর।
মহেন্দ্রর শাগরেদ গুপে পাটির ওপর বসে একটা জামার কলার ঠিকঠাক করছিল। সে দাঁতে কামড়ানো উঁচটা বেরে করে হাসল, বলল –কাজটা কী?
–সঙ্গে-সঙ্গে থাকে। তাতেই কাজে লাগে।
গুপে আর মহেন্দ্র নিজেদের মধ্যে একটা চোখ ঠারাঠারি করে।
নিশিকান্ত দাঁড়িয়েই থাকে। ওই তার স্বভাব বলা যায়। সময়ের জ্ঞান থাকে না, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা দরকার তা বিচার করতে পারে না। একটা বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করে। বর্ষায় ম্যাচিসের কাঠি সব ম্যাদা মেরে গেছে, ঠুকলেই বারুদ খসে যায়। অনেক কষ্টে অবশেষে ধরে ওঠে বিড়িটা। মিয়ানো গলায় বলে–জিনিসটা দিয়ে দাও, বেলাবেলি চলে যাই।
মহেন্দ্র সেলাই করতে-করতে বলে–যাবে যাবে। একটু বসে যাও। জলটা ধরে যেতেও তো পারে?
বসতে বলায় নিশিকান্ত বসে। চৌকাঠের কাছে মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে বলে–আর ধরেছে।
এইটুকু বলেই তার কথা ফুরোয়। আর কিছু ভেবে পায় না। মানুষে–মানুষে যে কত কথা বলাবলি হয়! বাসে আসতে সামনের সিটে দুই হাটুরে বসে তাদের বিকিকিনি, লাভালাভ, বাজার এবং ভগবান নিয়ে কত কথা বলে গেল। মানুষের মাথায় কথাও আসে বাবা, যেন শেষ নেই। নিশিকান্তর মাথায় আসে না। আবার এও ঠিক যদিই বা দু-চারটে কথা তার প্রাণে আসে তো তা শোনারও লোক নেই। কথা বলার জন্য, প্রাণ ঢেলে কথায় বাদলা নামিয়ে দেওয়ার জন্য এক একবার তার বিয়ের বাই চাপে। সুন্দরপানা মেয়েছেলের সঙ্গে ফুলের মালা বদল করে হ্যাজাকের আলোয় বিয়ে–সে ভারী একটা রহস্যময় আমুদে ব্যাপারও বটে। তার ছাতাটার সঙ্গে এমনি এক বিয়ে পাগলামির গল্প জুড়ে আছে। মায়াচরের কাছে সেবার ভীমপুজো দেখতে গিয়ে নিশিকান্তর আলাপ এক জোচ্চোরের সঙ্গে। অনেক কথা বিস্মরণ হয়ে হয়েও যে দু-চারটে তার মনে আতরের তুলোর মতো গন্ধমাখা হয়ে থাকে বহুদিন বাদেও, তেমনি কোনও কোনও কথা মনে থেকে যায়। জোচ্চোরটা নিশিকান্তকে প্রথম নজরেই জরিপ করে নিয়েছিল। ভীমের বিশাল মূর্তি জরাসন্ধকে পেড়ে ফেলে ঠ্যাং ফাঁক করে চিরে ফেলে বধ করছে, এ দৃশ্য দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল সে। জোচ্চোরটা তার ভাবসাব দেখে ধরে নিয়ে গিয়ে চা সিগারেট খাওয়ায়। দু চার কথার পর নিশিকান্তর বিয়ের ইচ্ছেটা জানতে পেরে বলে–পুরুষমানুষের আবার বিয়ের ভাবনা, চাকর–বাকর মুনিশ–মুটে ভিখিরি যাই হও বউ ঠিক জোটে।
ভীম পুজোর মণ্ডপ থেকে পুরোপাক্কা তিন ক্রোশটাক হটিয়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিল মেয়ে দেখাবে বলে। আর ততক্ষণে নিশিকান্তর চুরি করে জমানো পয়সা ফাঁক করেছিল বিস্তর। বিয়ের আশায় নিশিকান্ত ‘না’ করেনি। লোকটা ফুলুরির দোকানে দাঁড়িয়ে যায়, সিগারেট কেনে, দু-চারটে বাজারহাট সারে, নিশিকান্ত সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে হয়রান। তার ওপর ধার বলে পয়সা নিয়ে–নিয়ে নিশিকান্তের ট্যাঁক ফাঁক করেছিল লোকটা। একটা অচিন গাঁয়ে নিয়ে গিয়ে একটা কোটাবাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে বলল –এই হচ্ছে আমার বাড়ি। নিজের বাড়ি বলে মনে করে নাও। যাও ওই বাইরের ঘরে গিয়ে বোসো, আমি আটু বাজার ঘুরে সেরটাক মাংস নিয়ে আসি, মস্ত একটা খাসি কেটেছে শুনলাম। খাসির তেলের বড়া খাও তো?
খুব খায় নিশিকান্ত। তাই ঘাড় নেড়েছিল। তখন বেশ দুপুর হয়ে গেছে। লোকটা বলে–আজ এবেলা থেকেই যেতে হবে তোমাকে, ওবেলা মেয়ে দেখিয়ে দেব, তারপর পাকা কথা বলে যেও।
নিশিকান্ত খুব রাজি। লোকটা চলে যেতে সে দিব্যি কোঠাবাড়ির বাইরের ঘরে গিয়ে বসল। চেয়ার–টেয়ার পাতা ভালো বন্দোবস্ত। বসে থাকতে কিছু বাদে সেখানে এক খিটকেলে বুড়ো এসে হাজির। কি চাই, কাকে চাই প্রশ্নে বিরক্ত করে তুলল। খ্যাঁচাকল আর বলে কাকে। জোচ্চোরটার নামও মনে রাখেনি নিশিকান্ত, কেবল বলে–এ বাড়ির কর্তাই আমাকে বসতে বলে গেছে গো! বুড়োটা খ্যাঁকশিয়ালের মতো হুয়া-হুয়া শব্দ করে বলে বাড়ির কর্তা তো আমি, নিত্যহরি গোঁসাই। নিশিকান্ত তখন গম্ভীর হয়ে বলে–তাহলে তোমার ছেলেই হবে, আমাকে বসিয়ে রেখে বাজারে গেল মাংস আনতে, খাসির তেলের বড়াও খাওয়াবে বলেছে দুপুরে। বুড়ো তখন তেড়ে মারতে আসে-বৈষ্ণবের বাড়িতে খাসির মাংস! বেরোও, বেরিয়ে যাও।
কোথায় একটা ধন্ধ থেকে গিয়েছিল, তাই সবটা না বুঝেই বেরিয়ে এসেছিল নিশিকান্ত। কোঠাবাড়ির বারান্দায় ছাতাখানা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। কার ছাতা, কোথা থেকে এসেছে এতসব জানার দরকার মনে হয়নি তার। হাতটানের স্বভাবের দরুন অভ্যাসমতোই নিশিকান্ত ছাতা বগলে করে বেরিয়ে এসেছিল।
জগৎসংসারে এই ছাতাখানার বাবুগিরি ছাড়া তার আর বেশি কিছু নেই। যক্ষীর মতো সে ছাতা আগলে থাকে। রোদে জলে খোলবার জন্য নয়, কেবলমাত্র বাবুগিরিরই জন্যই বয়ে বেড়ায়। ছাতার ইজ্জতই আলাদা।
–শুনতে পাই, তোমার ছাতার সঙ্গে নাকি তোমার কথাবার্তা হয় নিশি! মহেন্দ্র একখানা পায়জামার পা টানা সেলাই করতে-করতে বলে।
নিশিকান্ত লজ্জা পেয়ে যায়। মুখে বলে–দূর, বিপিনদার যতো বানানো কথা।
–না গো, বানানো হবে কেন। বিপিন নিজে কানে শুনেছে, নিশুতরাতে উঠে বসে তুমি নাকি ছাতাকে তোমার দুঃখের কথা বলো, আর নাকি ছাতাও তোমার কথার সব জাবাব–টবাব দেয়! ছাতার গলার স্বর নাকি একটু খোনা-খোনা, কিন্তু কথা ভারি পরিষ্কার!
গুপে ছুঁচ হাতে চেপে কলারটা পাট করতে-করতে বলে–হ্যাঁগো, নিশিদা, তোমার ছাতাটা মেয়ে না ছেলে!
–আমি ওসব জানি না বাবু। তোমরা বড় দিক করো। জিনিসটা দিয়ে দাও চলে যাই।
–কথাটা চেপে যাচ্ছ নিশিদা, কিন্তু সেই পলতাবেড়ে থেকে বাগনান তক সবাই জানে যে তোমার ছাতাটা মেয়েছেলে।
–যাঃ।
–মাইরি। গুহ্য কথা আমাদের না হয় না বললে, কিন্তু ভাব ভালোবাসার কথা হচ্ছে আতর এসেন্সের মতো, চেপে রাখা যায় না। ছড়াবেই।
মহেন্দ্র পায়জামার পাখানা সরিয়ে রেখে আর একখানা পায়ের পট্টি মারতে লাগে, বলে–কথা আরও আছে। শুনি ওই ছাতাখানার সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে।
–যদি হয় তো নেমন্তন্নটা কোরো বাপু। বলে গুপে।
নিশিকান্ত তেতে উঠে বলে–পেছুতে লাগবে তো চ লোম বলছি। গিয়ে বিপিনদাকেই পাঠিয়ে দেবখন।
মহেন্দ্র গুপেকে একটা ধমক দেয়–তোর যত ইয়ার্কি কথা। বসো নিশি, রাগ করো না।
নিশিকান্ত বসে। দেরি হচ্ছে। একটা হাই তোলে সে। মহেন্দ্রর কলখানা দেখতে তার বড় ভালো লাগে। কলকবজা এক আশ্চর্য জিনিস। কোথাও কিছু না, পায়ের নীচে একখানা পাটা নড়ছে আর ওপর খাপে চুঁচখানা বৃষ্টির ফোঁটার মতো কপাকপ নেমে এসে সেলাই ফেলে যাচ্ছে।
বড় আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা! কলখানা যতবার দেখে ততবারই তার ভিতর একটা কী যেন মনে পড়ি–পড়ি করে। পড়ে না অবিশ্যি। ওটাই তো তার রোগ। বড় বিস্মরণ। তার মনখানা বাদলা দিনের মতো, টর্চ বাতির আলোর মতো। কতকটা দেখা যায়, বাদবাকি সব বিস্মরণের বাদলায়, কালিঢালা অন্ধকারে ঢাকা।
বসে থাকতে–থাকতে ঢুলুনি এসে গিয়েছিল তার। গুপে ডেকে তোলে তাকে। চুয়ার বোতলটা হাতে দিয়ে বলে–দিনক্ষণ দেখে বিয়েটা সেরে ফ্যালো বাপু। আইবুড়ো মেয়েছেলে নিয়ে রাত বিরোতে বসে থাকো, এ ভালো কথায়। ছাতারও তো সমাজ অছে।
বোতল নিয়ে নিশিকান্ত উঠে পড়ে। দরজার কোণে ছাতাটার জন্যে হাত বাড়িয়ে দেখে, নেই।
–ইকী! নিশিকান্ত বলে ওঠে।
মহেন্দ্র গম্ভীর মুখ তুলে বলে–কী হল!
–ছাতাখানা!
–নেই?
–না। তোমরা লুকিয়েছ।
–আমরা! গুপে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে–পরের মেয়েছেলে লুকোব আমাদের তেমন ভাব নাকি!
–ছাতাটা কী হল রে গুপে? মহেন্দ্র নিরীহ মুখে জিগ্যেস করে।
–হবে আর কী! একটু আগে কতগুলো লোধা মেয়েছেলে বৃষ্টির মধ্যে হুড়মুড়িয়ে এসে উঠেছিল। এ ঠিক তাদের কাজ। নিশিদা চুলছিল তখন খেয়াল করেনি।
নিশিকান্ত ক্ষেপে গিয়ে বলে–দিয়ে দাও বলছি।
গুপে বলে–তোমার ছাতারও স্বভাবের বলিহারি। কোন আক্কেলে তোমার মতো ভালো মানুষটাকে ছেড়ে না বলে কয়ে চলে গেল!
ভারী রেগে যায় নিশিকান্ত। ডাক হাঁক করে গাল পাড়ে তোমরা দুটো চোরের ব্যাটা, গর্ভস্রাব…
গুপে গম্ভীর মুখে বলে–তা মুখ খারাপ করলে কী হবে! লোকে যে বলে তুমি ছাতা চোর। আমি অতশত জানি না বটে, কিন্তু শুনেছি ওই ছাতা মেয়েছেলেটাকে তুমি মায়াচরের কোনও গেরস্তর ঘর থেকে ভাগিয়ে এনেছ!
নিশিকান্তর মাথার মধ্যেটা ভারী বেসামাল হয়ে যায়, বলে, কোন রাঁড়ির ব্যাটা বলে, কোন…ইত্যাদি।
মহেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলে–মুখ খারাপ করবে না বলছি। দিয়ে দে গুপে ওর ছাতাখানা। খিস্তির চোটে জল গরম করে দিল।
রেগে গেলে নিশিকান্ত এরকম। হাট মাঠ ঘুরে যা গাল শোনে তার কিছু মনে রাখে সে। কারণ, ওই হচ্ছে তার অস্ত্রশস্ত্র। লোকে তাকে দিক করলে তাকেও তো কিছু করতে হয় তখন!
গুপে উঠে চৌকির তলা থেকে ছাতা বের করে দিল। তারপর আচমকা পিছনে একটা লাথি দিয়ে বলল –বেরো শালা!
লাথিটা খেয়ে দরজাটা ধরে সামলে নেয় নিশিকান্ত।
–এ-ই-ই…বলে মহেন্দ্র চেঁচিয়ে ওঠে–মারিস না। আর একটু হলে বোতলটা হাত থেকে পড়ে ভাঙত।
–শালার বড় মুখ। গুপে বলে রেগে।
নিশিকান্ত তখন গুপের মা বাবা তুলে নোংরা খিস্তি দিয়ে বেরিয়ে আসে। গুপে অবশ্য ছাড়ে না। দৌড়ে এসে ঠাঁই করে মাথায় একটা কী দিয়ে মারে। ঝিমঝিম করে ওঠে নিশিকান্তর মাথা। সে বোতলটা অবশ্য চেপে রাখে বুকে। ভাঙলে বউমণি আর বিপিন তো আর গুপের সঙ্গে বো ঝাঁপড়া করতে আসবে না। মেরে তারই গা–গতর ব্যথা করে দেবে। নিশিকান্ত রাগে অন্ধকার হয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে চেঁচায়–গু খা, গু খা রাঁড়ির ছেলে…
গুপে আবার বেরিয়ে আসে। দূর থেকে একটা মাটির ভাঁড়ই বুঝি ছুঁড়ে মারে তাকে।
নিশিকান্তর বুকে এসে লাগে সেটা। নিশিকান্ত দাঁড়িয়ে–দাঁড়িয়ে গাল দিতেই থাকে আমার পা খা, বাঁ-হাত খাঁ, হেগো খা….
অনেকক্ষণ ধরে বকে–বকে নিশিকান্তর মাথা ফরসা হয়ে গেল। আসলে কাকে বকছে সেটাই ভুলে গেল সে। কী হয়েছিল তাও মনে পড়ে না আর। তখন নিশিকান্ত ভারী অবাক হয়ে চুপ করে যায়। কার ওপর রেগে গিয়েছিল, কেন গাল দিচ্ছিল কিছুই তেমন মনে পড়ে না।
এদিকে বৃষ্টি থেমে চাঁদ উঠে গেছে কখন। দোকানে দোকানে ঝাঁপ পড়ে যাচ্ছে। অবাক নিশিকান্তর ভিতরে একটা সুতোর টান লাগে। লাটাই বউমণির হাতে। নিশিকান্ত ঘুড়ি তাই চমকে ওঠে, লাট খায়। বউমণি নিশ্চয়ই ডাকছে–নিশি-ই!
খাডুবেড়ের মোড়ে যখন নামল নিশিকান্ত তখন পৃথিবীটা বড্ড অদ্ভুত হয়ে আছে। কী এক ভুতুড়ে চাঁদ উঠেছে আজ আকাশে। চারধারে মেঘের কালি তার মাঝখানে ফ্যাকাসে একটা ডুম। বারবার মেঘ ডাকছে পাথর ঘষা শব্দে। তিনদিন বাদে বৃষ্টি এই ধরল। জাড়ের মাস নয়, তবু কেমন শীত ঝরিয়ে দিচ্ছে আকাশঠাকুর। জলে জলময় পৃথিবীটা সাদাটে হয়ে পড়ে আছে অলক্ষুণে জোছনায়।
যেমন ভয় ভূত প্রেত বেহ্মদৈত্যকে, তেমনি ভয় বিপিনবিহারী আর বউমণিকে। খালধারে পিছল মাটি ধরে প্রাণপণে হাঁটে নিশিকান্ত। মাথায় একটা টাটানো ব্যথা! মাজায় ব্যথা। কখন কোথায় লাগল ঠিক খেয়াল করতে পারে না সে।
তিনদিন ধরে লক্ষ হাত দিয়ে মাটিকে মেখেছে আকাশ। মাখাজোখা হয়ে তাই ভুতুড়ে জোছনায় সিটোনো পৃথিবীটা পড়ে আছে। মেখেছিল বিপিনবিহারীও বউমণিকে। বর্ষা বাদলায় কাজকর্মে বড় সংক্ষেপ। হাঁড়িকুড়ি ছাড়া আর কিছু সকড়ি করেনি বউমণি। কলাপাতা কেটে হড়হড়ে খিচুড়ি ঢেলে খাওয়া। ঘাটলার কাজ ছিল না, কাঁচাকুচি ছিল না, রোদে দেওয়া জিনিস টানাটানি করা ছিল না। ঘরমোছা ছিল না। বউমণি তেপহর বিছানায় পড়ে থাকত। বিপিন মাঠে একটু চাষের কাজ দেখে এসেই দরজায় হুড়কো তুলে দিত। ভিতরে কী হত তা কি আর বোঝে নিশিকান্ত। সেও ওই মাখামাখিরই ব্যাপার। বিকেলে আমতেল দিয়ে মাখা মুড়ি কাঁচালঙ্কা কামড়ে খেয়ে বিপিন যেত বাজানিদের বাড়িতে, ধর্মকথা শুনতে।
কিন্তু ধর্মকথার আগেও কথা থাকে পরেও কথা থাকে। বৃষ্টি বাদলায় সেইসব কথাই কলঙ্কের কথার মতো ছড়িয়ে গেল। চারধার ফিসফাস গুজগুজ। নিশিকান্ত একা-একা হাসে।
খালধারে একটা আগুন জ্বলছে বিশাল। আগুনের ধারে কালো-কালো লোকজন। বাবলাগাছের আড়ালে বড়-বড় সব ছায়া নড়াচড়া করছে! নিশিকান্ত থমকে দাঁড়িয়ে যায়। দূর থেকে কাণ্ডটা দেখে আর তখন একটা পোড়াঘিয়ের বদ গন্ধ উড়ে আসে। আর আসে চামড়া পোড়া চিমসে মতো গন্ধ।
নিশিকান্ত মাথা নেড়ে আবার হাঁটে। নেতাইয়ের ঠাকুমাটা মরল বোধহয়। জোর কদমে হেঁটে চলে আসে আগুনটার কাছে। বাঁধা শ্মশান বলতে কিছু নেই এখানে, যে যেখানে পারে মড়া পোড়ায়। বাবলাতলায় একটু উঁচু জমি পেয়ে ওরা ওখানেই কাজ সেরে নিচ্ছে।
নেতাই মাল খেয়ে চেল্লাচ্ছিল। স্যাঙাৎদের মধ্যে কে যেন চিতা থেকে চ্যালাকাঠ টেনে বিড়ি ধরিয়েছে, তাতে অপমান হয়েছে নেতাইয়ের। চোঁচিয়ে বলে–কোনও শালা চিতা থেকে বিড়ি ধরাবে না বলে দিচ্ছি। আমার ঠাকুরমার চিতা শালা, কারও বাপের নয় বলে দিচ্ছি।
স্যাঙাৎদের একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলে–বিড়ি নয় রে, সিগারেট…
–কেন ধরাবে? ওর বাপের চিতা শা…?
বলতে-বলতে নেতাই বাবলাতলা থেকে উঠে খালের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে। আর বলে–আমার ঠাকুমার শালা পুণ্যি দেখ, চিতা নিভে যাবে ভয়ে বৃষ্টি থেমে গেছে। দেখেছিস কখনও অমনধারা শালা? বিড়ি ধরাচ্ছিস চিতা থেকে। আমার ঠাকুমার সম্মান নেই?
স্যাঙাত্রা খি–খি করে হাসছে।
নিশিকান্ত দেখে, নেতাইয়ের ঠাকুমার মুখখানা দেখা যাচ্ছে। এখনও সেখানে আগুনটা পৌঁছয়নি। চোখের পাতায় চন্দন, তাতে তুলসিপাতা সাঁটা। পোড়ার সময়টায় মানুষের কেমন লাগে তা বড় জানতে ইচ্ছে করে নিশিকান্তর। দু-কদম এগিয়ে এসে সে ছাতা আর বোতল হাতে দাঁড়িয়ে–দাঁড়িয়ে দেখে। কেউ কিছু বলে না। সব ব্যাটা বোতল টেনে যাচ্ছে। বেসামাল।
আর হঠাৎ যেন কেউ দেখছে না দেখে, ফাঁক বুঝে নেতাইয়ের ঠাকুমা টক করে চোখ চাইল। নিশিকান্তর কিছু মনে থাকে না। বড় বিস্মরণ। কিন্তু নেতাইয়ের ঠাকুমা চোখ খুলে ভালোমানুষের মতো তার দিকে তাকাতেই নিশিকান্তর ঝড়াক করে মনে পড়ে গেল, বহুকাল আগে, পেটব্যথায় বুড়ি কাতরাচ্ছিল একা ঘরে। তখন নিশিকান্ত বাবলার কচিপাতা থেঁতো করে রস খাইয়ে সারিয়ে ছিল ব্যথা। সেই বাবলা গাছের তলায় নিশিকান্ত দাঁড়িয়ে, আর চিতার আগুনের মধ্যে আধপোড়া নেতাইয়ের ঠাকুমা। চোখে চোখ পড়তেই যেন বলে ওঠে, কী বাবা মনে পড়ে?
মনে পড়ে? মনে পড়ে? বাদলা কেটে মনের মধ্যে একটা জোছনা যেন ভেসে ওঠে হঠাৎ। পড়ে বইকি! কত কী মনে পড়তে থাকে হঠাৎ। নিশিকান্ত টের পায় মনে পড়ার বেনো জল হঠাৎ বাঁধ ফাটিয়ে ধেয়ে আসে যে! নিশিকান্ত ছাতাটা সাপটে ধরে বোতল চেপে ধরে বুকে। একটা ‘আঁক’ চিৎকার পেড়ে আবার খালধারের রাস্তায় উঠে আসে।
কিন্তু তবু মনে পড়া কি ছাড়ে। আকাশ থেকে হঠাৎ টাপুর–টুপুর খসে পড়ে অতীতের জল। পড়তেই থাকে। নেতাইয়ের স্যাঙাৎ দু-পা এগিয়ে এসে তাকে ধরে–কী বাবা বোতলে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বাবা নিশি!
–ছেড়ে দাও। বলে নিশিকান্ত একটা ঝটকা মারে। আর ওই ঝটকাতেই টর্চ বাতির আলোর মতো তার বর্তমানটা ছিটকে যায়। বাদলা দিনে ছোট পৃথিবীটা হঠাৎ যেন আদিগন্ত দেখা যায়। মনে পড়ে। মনে পড়ে।
তার নাম নিশিকান্ত নয়। সে নয় এদেশের লোক। নীলকুঠির ধারে একটা ছোট কুঠিবাড়ি ছিল। তাদের। মা ছিল মনোরমা, বাবা চন্দ্রনাথ। সুখের ছিল সংসার। জায়গাটা কী যেন! কী যেন! মনে পড়ে, বেঁটে লিচু গাছের বন ছিল সেখানে, থোকা থোকা ফল ধরত, পাকা সড়কের ওপর ছিল ইস্কুল বাড়ি, তার ঘণ্টা বাজত ঢং–ঢং, নিশিকান্তকে ডাকত।…মনে পড়ে, মনে পড়ে…
কিন্তু কী যে যন্ত্রণার ঝড় ওঠে বুকের মধ্যে! হাহাকার এক বাতাস বয়ে যায়। কী হয়েছিল তারপর? অতীতের বৃষ্টি মাতালের মতো টলে টলে পড়ে, দোল খায়, মারদাঙ্গা আগুন কী সব হয়েছিল, দাড়িওলা, কালি–মাখা মশাল হাতে কিছু লোক…তারা পায়খানার তলায় নোরায়। লুকিয়ে কাঁপছে! মনে পড়ে…রেল লাইন ইস্টিশান…লঙ্গরখানা…
নিশিকান্ত চিৎকার করে পিছলে পড়ে যায়। রাস্তা বেভুল। কোথায় যাচ্ছে সে? কার কাছে? জোছনায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে চারধারে চায় নিশিকান্ত? এ সে কোথায়?
মাঠের মাঝখানে ছাতা আর বোতল হাতে সে দাঁড়িয়ে আকাশ–জোড়া পৃথিবীটা দেখে। কী প্রকাণ্ড! সে একা! হারিয়ে গেছে!
ভূতুড়ে জোছনার হাহাকার চারদিকে। তার ঘর নেই, বাড়ি নেই, কেউ নেই।
–আঁ—আঁ–আঁ বাক্যহারা চিৎকার দিতে থাকে নিশিকান্ত। চোখে জল আসে। সে উপুড় হয়ে পড়ে মাঠের কাদায় জলে। কোমর সমান ডুবে যায়। মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলতে থাকে–ভুলিয়ে দাও, ভুলিয়ে দাও…
ঠিক সময়ে একটা সুতো কে যে গুটিয়ে নেয় লাটাইয়ে, হাত্তা মারে। টান লাগে। ঘুড়ি টাল খায়। বউমণি বুঝি ডাকে–নিশি–ই…
যাই। বলে কাদাজল থেকে ওঠে নিশিকান্ত। ছাতাটা আর বোতলটা চেপে ধরে বুকে। পিরানের হাতায় চোখ মুছে নেয়। ঘুড়ির সুতো গুটিয়ে নিচ্ছে বউমণি। বড় টান। চাকর বলো চাকর, জন বলোজন, টান একটা আছেই।
বেশ আছি বাবা, বেশ আছি। বিড়বিড় করে বলে নিশিকান্ত। পৃথিবীটা আবার বাদলা দিনের মতো ছোট হয়ে এসেছে। টর্চ বাতির আলোর চৌহদ্দিতে বাঁধা জীবন। আগুপিছু আর কিছুই দেখা যায় না। এই বেশ আছে নিশিকান্ত। এবার নিশ্চিন্তে সে হাঁটে।