1 of 2

বুনোহাঁসের মাংস – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

বুনোহাঁসের মাংস – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

দিব্য ছবিতে গরিলা দেখেছে। এই গরিলাটার কুচকুচে কালো রঙ। বড় বড় দুটো হাত হাঁটু অবধি ঝুলিয়ে সামনে ঝুঁকে হাঁটছে। হাতের তালু ও পায়ের পাতায় বছরের পর বছর প্রচণ্ড জলস্রোতের হাজামজা ক্ষয়াটে বিবর্ণতা। সে মোক্তারবাড়ি অর্থাৎ সুকুমারদের জল তোলে।

সুকুমার—সুকুর হঠাৎ জ্বর কাল থেকে। ঘুষঘুষে কাশি। ফ্যামিলির ট্র্যাডিশান কালচার-প্রসঙ্গে ওই গরিলার কথা ও তুলেছে।—আমাদের দমকল। কাজ বলতে ওর ওই একটাই। তবে মাঝে মাঝে তোদের মতো কেউ এসে পড়লে তার সার্ভিস দেয়। এখন ওকে তুই স্বচ্ছন্দে কাজে লাগাতে পারিস!

—কী কাজে?

সুকু একটু হেসে বলেছিল—ও ভাল ট্র্যাকার। কপালীর জলজঙ্গল ওর নখের ডগায়।

কপালীতলায় এই প্রথম এসেছে দিব্য। ছুটির দুটো দিন কাটাবে। সেই ভোর পাঁচটায় হাওড়ায় চেপেছে, পৌঁছেছে দশটায়। সুকু বরাবর লোভ দেখিয়েছে বুনোহাঁসের। শেষ চিঠিতে লিখেছিল—শীত শেষ হয়ে গেছে। কপালীর বিল-বাঁওড় থেকে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে চলেছে হিমালয়ের ডেরায়। আর কবে আসবি?

গরিলাটাকে নেবে না বলেছিল। কিন্তু গেট পেরিয়ে রাস্তায় যেতেই রবিঠাকুরের সেই পুরাতন ভৃত্যের মতো সে হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে! না, হুঁকো নেই, তবে তেমনি মনে হয়েছে। আর, সুকু যা বলেছিল, তাই। কথাই বলে না। পিছন থেকে হঠাৎ পাশে এসে ট্রাফিক সিগন্যাল দেয়। গাঁয়ের শেষ বাড়িটার পরে কিছু সবজিক্ষেত। ভুঁইশশার হলদে ফুলে সাদা প্রজাপতি উড়ছে। ছাগলের গলার দড়ি হাতে থমকে দাঁড়িয়ে ঘোমটা টেনেছে বউঝি। দিব্য জানে, তাকেই দেখছে। নদীর খাড়া পাড় বেয়ে নামতে নামতে ছাগলের গলার ঘুণ্টিতে হয়তো মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসের কনক্লুডিং লাইন বাজতে বাজতে পিছনে ফুরিয়ে গেল। এখন সামনে শুধু প্রকৃতি—ভেতরে বাইরে এখনও একই রকম। শীতের শেষে নদীর তলায় বালির রঙ, ভাঁজ, টুকরো পালক, কলসীর কানার পাশে গভীর পায়ের দাগ এবং ওই অল্প-স্বল্প কালো স্রোতের মাথা কুটে-কুটে পথ করে ছোটা একই রকম। হাজার বছর আগেরই মতো। ওই সব সাঁইবাবলার ঝাড় যা ছিল, তাই। ক্ষয়ার্খবুটে শেওড়া কুঁচফলের ঝোপ ভাঁড়ুলে গাছও বৌদ্ধযুগ থেকে একই চেহারা ও চরিত্র। সুকু বলেছিল, কপালীতে বৌদ্ধদের রবরবা ছিল। এখনও এখানকার লোকে প্রাণী হত্যায় বিমুখ। মাংসটাংস বিশেষ খায় না। হনুমানের পাল এসে আগে কী জ্বালান না জ্বালাত। কেউ ঢিলও ছুড়ত না পাছে ব্যথা পায়। শুধু বাবা—বাবাই প্রথম বন্দুক কিনে হনুমান মেরেছিলেন। তারপর সে কী কাণ্ড! পঞ্চগ্রামী হয়েছিল। তারপর তো সব দিনে দিনে টপাটপ অন্য রকম হয়ে গেল। বাবা এলাকার টপ ম্যান। কিন্তু সংস্কার কেমন কাজ করে দ্যাখ, বাবা যে অত পাখি মারতেন, একবার একটা বুনো হাঁসের ব্যাপারে অদ্ভুত কী সব হল, বন্দুক ছাড়লেন। সেই শেষ।

—এই নদীটা, কপালী।… হঠাৎ বোবা গরিলাটাকে মুখ খুলতে দেখে দিব্য অবাক। ও এমনভাবে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে গেল, যেন নদনদী সম্পর্কে অনেক কিছু জানা এবং বলবে। দিব্য জুতোসুদ্ধ নামবে কিনা ভাবতে সময় নিচ্ছিল। তাই বলে ওঠে—ওপারে জঙ্গলে নাকি একটা ভাঙা মন্দির আছে, সেও তো কপালীর। সুকু বলছিল।

—আছে। তিনিও কপালী, ইনিও কপালী। বুঝুন তাহলে! লোকটা বড় বড় দাঁত বের করে। আর সঙ্গে সঙ্গে দিব্যের মনে হয়, সামনের এই দেশে রাত পুইয়ে সকাল হল। পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে সব খুঁটিনাটি। প্রজাপতির ডিম, লাল পোকা নীল পোকার প্রেম ভালবাসা, কয়েক ফোঁটা সবুজ রক্তও।…চলুন, দেখবেন। মন্দির খালি। ফেটেফুটে গাছ উঠেছে। ওই যে! আর আগাছাও আছে। আপনি পা তুললেই তো তাই হয়।

—কী?

—ঘাস, আগাছা, গাছগাছালি, পোকামাকড়। সবাই ওঁৎ পেতে আছে। খালি পেলেই চলে আসে।

বাঃ! বেশ বলেছে। থপথপ করে হাঁটছে। আস্তে আস্তে একটা ব্যস্ততার লক্ষণ ফুটেছে ওর উদোম গায়ে। সাদা ছোট ছোট চুলগুলো ঢাকা তুলে নিলে ফ্যাকাসে ঘাস যেমন রঙ ফিরে পায়, শিগগির সবুজ হয়ে যাবে, দিব্যের এমন লাগে। সে বলে—নাম কী তোমার?

—ভৈরব।

যেভাবে সে পাড়ে উঠে যায়, দিব্যের মনে হয় সারাদিন খেটেখুটে নিজের বাড়ি ঢুকছে। ওপরে বাঁধ। বাঁধে দাঁড়িয়ে সে বিশাল আকাশটা কুক্ষিগত করে। পিছনে নীচে থেকে তাকে দেখতে দেখতে ওঠে দিব্য। যেন ফটকের সামনে দু হাত ছড়িয়ে এবার তাকে বলছে—এই যে হুজুর, গলিবের মাথা গোঁজার ঠাঁই। মন্দিরটা ভাঙা। ফলক ছিল হয়তো, সেখানটা খালি—সুতরাং কোনও যাদুঘরে গেছে। মানুষ তো কেড়ে নিতেই ওস্তাদ। চত্বরে, মানুতে মাটির ঘোড়া, সিঁদুরের ডগমগ, পিদিমের ছড়াছড়ি। ফাটলের বট ডালপালা ছড়িয়ে গরগর করছে। তার উথালপাতাল লোভকে রুখতে কবে আচমকা বাজের কালো লম্বালম্বি ঘা।

চলুন।… বলে ভৈরব পা বাড়ায়। আগাছা ঠেলে কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কিছু দেখে। তারপর আচমকা এসে দিব্যের বাহুটা খামচে ধরে। বন্দুক টালমাটাল। সেফটি ক্যাচ খোলা, ট্রিগারে আঙুল ছিল, ছুটে যেতে পারত। যদিও নেহাত ছররা, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তাইই মরট্যাল ডোজ।—বাবু, বাবু। হরিয়াল! দুটো হরিয়াল!

দিব্য রেগেছে। ধমক দিয়ে বলে—তুমি আর যাই করো, লাফ দিয়ে গায়ে পড়ো না। মারা পড়বে।

দাঁত বের করে আবার।—বাবু, আমার মরণ নাই।

দিব্য তেঁতো হয়ে বলে—হরিয়াল মারা বেআইনি।

নির্বোধ গরিলাটা ঘড়ঘড় করতে থাকে। ওকে বন্য পশুপক্ষী সংরক্ষণ আইনের কথাটা বলা যেত। কী হবে? দিব্য হাল ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ধরায়। সেই সময় দেখে, ভৈরব আবার লাফ দিল। —যাঃ, উড়ে গেল! তারপর সে ঘোরে, পাখি দুটোর গতির দিকে নজর রেখে ঘুরতে থাকে। পুরোটা ঘুরেই সে কন্ধকাটা গাছের মতো দাঁড়ায়।

দিব্য বলে—কী?

ভৈরব আপনমনে গজগজ করে।—হুঁ, এসে গেছে। ঠিক টনক নড়েছে। ফেউ—ফেউ কিনা! দিব্যও ঘোরে। কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। ছোট বড় গাছপালা ঝোপঝাড় নিয়ে চাপ চাপ থরেবিথরে সাজানো এই সবুজ বাজারে কোথায় কে এল নীলাম হাঁকতে—প্রতিদ্বন্দ্বী, সে বুঝতে পারে না। ফের বলে— কী?

—চিনি।

—চিনি? সে আবার কী?

—এসো। তোমায় মজা দেখাচ্ছি! বলে ভৈরব ফের ঘুরে পা বাড়ায়। দিব্য তখনও খুঁজছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে যায় খানিকটা দূরে, মন্দিরের আড়ালে কে দাঁড়িয়ে ছিল, সবে সরে গেল—সে মেয়েই বটে, আঁচলটুকু দেখা গেল শুধু।

দিব্য এগোল। কল্কিফুলের ঝোপ সরিয়ে ভৈরব প্রচণ্ড গম্ভীর।—আজ্ঞে, বাউরীদের।

—নাম বুঝি চিনি?

ভৈরব মাথা দোলায়। ঝোপঝাড় ঠেলে এগোয় এবং সন্দিগ্ধভাবে ঘোরে কখনও। দিব্য বলে— কেন? চিনির মতো মিষ্টি নাকি? দিব্য খুক খুক করে হাসে। ভৈরব চুপ। তারপর দিব্য একবার ঘুরেই দেখতে পায় চিনির পুরোটা। ঠিক ফেউয়ের মতো অনুসরণ করছে যেন দূর থেকে। ব্যাপারটা কী! দিব্য আবার হেঁটে আবার তাকায়। আরও স্পষ্ট দেখতে পায়। সানগ্লাস খুলে চোখাচোখি হতেই দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু লুকোল না। হালকা ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা, কাঁধে ভেঙে পড়ছে রুক্ষ খোঁপা—একটা লাল ফিতে ভুরু কুঁচকে নিস্পলক তাকিয়ে কলকাতার বাবুকে দেখছে। বিস্ময়বিহীন। দিব্য নিজের অজান্তে বয়স মাপতে থাকে—সতের? উনিশ? মাঝামাঝি হতে পারে। ম্যালনিউট্রিশন শরীরের বয়স নিয়ে গোলমালে ফেলে দেয় অনেক সময়। তবে কলকাতার ফুটপাতে দেখা সেই সব নিকৃষ্ট মরচে ধরা বা নোংরা জিনিস নয়, কারণ এখনও কপালীতলার জল আলো হাওয়ায় আদি বিশুদ্ধতা সুপ্রচুর। সেই বিশুদ্ধতা আঁজলা ভরে তোলা যায়। দিব্যকে ফেলে ভৈরব যেন পালাচ্ছে। দিব্য লম্বা পা ফেলে গিয়ে ধমকায়—ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? তোমাদের হাঁসফাঁসই বা কোথায়? সব গুল—অ্যাঁ?

কলকাতার বাবু কেন রেগেছেন, ভৈরব বুঝল না। ভাবল চিনির গল্পটা না বলাই কি কারণ? সুতরাং সে একটু হাসে। —হুঁ চিনি হাঁস কুড়োয় লুকিয়ে। বুঝলেন? শিকারি বন্দুক ছুড়লেন তো পাখি গিয়ে পড়ল কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে। জঙ্গুলে খাল বিলের অবস্থা। শিকারি খুঁজে খুঁজে নাকাল। পেলেন—নয় তো পেলেন না। তখন হাপিত্যেশ করে চলে এলেন। আর অমনি চিনি গিয়ে হাজির হল। ওর চোখের দৃষ্টি শকুনের।

দিব্য গাছপালার ফাঁক দিয়ে নদীর বাঁকের মুখে বিশাল জলা দেখতে পেয়েছে। তাহলে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে লোকটা। সে আনমনে বলে—কে ওর মা?

—আজ্ঞে, কাজল বাউরিনী। এখন অন্ধ। কিন্তু পাখপাখালির মাংসের লোভ প্রচণ্ড। …দম নিয়ে ভৈরব ফের বলে—প্রচণ্ড। সেই লোভেই পেটের মেয়েটাকে এমনি করে পাঠায়। বাঁওরে বন্দুকের আওয়াজ হোক না হোক, বারুদের গন্ধ পাবেই। মাগীর লোভ গেল না। শেষে মেয়েটারও—

থামতে দেখে দিব্য বলে—কী?

ভৈরব আকাশে মুখ তুলে হঠাৎ ফোঁস-ফোঁস করে দম টানে। তারপর মুখ নামিয়ে বলে—আঃ!

বিরক্ত দিব্য বলে—কী হল আবার?

—কিছু না, চলুন। দেখি, ছুটকো-ছাটকা দু’একটা আছে নাকি বাঁওড়ে।

—ছুটকোছাটকা কী?

ভৈরব বলে যায়। সেই পুজোর আগেতে ওনাদের আসার শুরু। ধানকাটার পরও দুটো মাস কপালীর বিলবাঁওড়ে দু’একটা ঝাঁক আলস্যি করে পড়ে থাকে—যাচ্ছি যাব, এইরকম হাবভাব। তারপর ওই বাঁকের মুখে শিমুল গাছটায় যখন তুলোর রোঁয়া উড়ে উড়ে গিয়ে গায়ে পড়ে, তখন শাঁই শাঁই শনশন দিন-রাত্তির মাথার ওপর আওয়াজ। বাবা মহাদেবের ডাক এসেছে। ছানাপোনা উড়ে চলল কৈলেসে।

—কৈলাস! তুমি কেমন করে জানলে? দিব্যেন্দু অবাক।

—মোক্তারবাবু বলতেন। …ভৈরবের এই এক স্বভাব। কথা বললেই দাঁড়ায়। এখন মাথার ওপর সূর্য—ফাঁকা জায়গা ফ্যাকাসে ঘাসে ঢাকা। উলুকাশের ঝোপ-ঝাড়। কোথাও একলা বাবলা। টি…টি…টি দূরে পাখির ডাক। সেই গা জ্বলা-রোদে দাঁড়িয়ে তার ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে ভাল লাগে না। দিব্য ওরিনথোলজির বই পড়েছে। অথচ এই নির্বোধ জ্ঞানদাতা তাকে জ্ঞান দেবেই।—কিন্তু এটাই বড় অবাক লাগে, বাবু। কোনও-কোনও বছর কী যে হয়! দল চলে গেল, দেখতে দেখতে কপালীর মাঠে লু বইতে লাগল। বিল-খাল শুকিয়ে এল। হঠাৎ দেখা গেল দুটো একটা ছুটকোছাটকা বুনো হাঁস থেকে গিয়েছে। এদিকে সব শুকিয়ে আসছে। অবস্থাটা বুঝুন।

দিব্য বিলের দিকে তাকিয়ে বলে—হুঁ।

—হতভাগা পড়ে গেল বিপদে। সেবার ভাল বর্ষা হয়নি। বিল শুকোল ঝটপট। লোকে মাছ মারতে নামল চারদিকের গাঁ থেকে। তখন সে উড়ল। ডাকতে ডাকতে প্রথমে গেল মাঠের পুকুরে। জংলা পুকুর। তলানিটুকু ছিল। বোরোধানে চাষারা সেটুকু শুষে নিল। তখন গেল গাঁয়ের একটা পুকুরে। সেটা শুকোল তো আরেকটায়। এমনি করে যখন সব খটখটে হয়েছে, বেচারার বরাত—মোক্তারবাবুদের দীঘির জল জম্মে শুকোতে দেখেনি কেউ—বাড়ির পেছনে দেখবেন, চোখ জুড়িয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে ঝপাং করে পড়ল। খবর পেয়ে মোক্তারবাবু বন্দুক নিয়ে খিড়কি দিয়ে বেরোলেন। এর আগে উনি হাঁসটা মারবার অনেক চেষ্টা করেছেন। পারেননি। ছুটকো হাঁসের খবর তখন সবাই পেয়েছে কিনা।

দিব্য ওকে আবার আকাশে মুখ তুলে দম নিতে দেখে। হাঁপানি আছে নাকি? সে এই সময় একবার ঘুরে চিনিকে খুঁজে নেয়। দেখতে পায় না। অবশ্য উলুকাশের জঙ্গলে আছে। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এগোলে দেখা যাবে না। কিন্তু নিশ্চয় অনিশ্চিত ব্যাপারের ঝোঁকে মেয়েটা হামাগুড়ি দেবার মতো কষ্ট করছে না। দিব্য পা বাড়িয়ে ফের আনমনে বলে—হ্যাঁ, তারপর?

কলকাতার বাবু শুনছেন, এতে ভৈরব খুশি। বলতে থাকে—মোক্তারবাবু বন্দুক তুলে নিশানা করলেন। কিন্তু এবারে হাঁসটা উড়ল না। দামে লুকোল না। পাখনা ঝাপটে নখের আঁচড়ে জল কেটে কেটে দিব্যি ভেসে থাকল। শিকারির মনে কী হল, নল নামালেন না। মায়া জন্মাল। নাকি সুলক্ষণ ভাবলেন। উনি হাসলেন।

—হাসলেন? দিব্য অবিকল দেখতে পায় সুকুর বাবা হাসছেন। খটখটে বুড়ো, লম্বা, ফর্সা, খাড়া নাক, কানে পাকা চুল, পায়ে চটি।

—আজ্ঞে হ্যাঁ। মোক্তারবাবু হাসলেন। এলাকার মাথা উনি। দাপট আছে। সাংঘাতিক সব ফৌজদারী মামলার আসামীকে সদরের বড় আদালতে যেতে দিতেন না—এমন ঘুঘু আইনবাজ মানুষ। সেই বেলা ঢ্যাঁড়রা পিটিয়ে দিলেন—এই হাঁসের গায়ে যে হাত তুলবে, তার মাথা যাবে। রতনা ঢুলি পাঁচখানা গাঁ ঘুরে এল। খবর রটল। তখন গাঁয়ের মানুষ এমন ছিল না, বাবু। হাঁসটা পুজো পেতে লাগল। ঢাকি পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজায়। ন্যাড়া ঠাকুর টিকিতে ফুল গুঁজে ঘণ্টা নেড়ে অং বং করে। বউঝিরা উলু দেয়, শাঁখ বাজায়।

দিব্য হেসে বলে—বলো কী!

—দুষ্টু ছেলেরা ঢিলঢাল ছোড়ে। কিন্তু বড়রা দেখলে তাদের তাড়া করে। চান করতে নেমে হাঁসটার দিকে চোখ বুজে প্রণামও করে কেউ কেউ। বউঝিরা তো এক বুক জলে দাঁড়িয়ে ভিজে কাপড়ে চুল ঢেকে হাত জোড় করবেই করবে। ওদিকে হাঁস আপন মনে খেলা করে। দিন যায়। তারপরে দিন যায়। দিন যায়। চলে যায় দিন। আঃ!

ভৈরব ফের আঃ বলে মুখ নামায়। দিব্য বলে—তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?

মাথা নেড়ে লোকটা আবার বলে—হঠাৎ এক সকালে হাঁস নাই। দীঘি খালি। দলপিঁপি পানকৌড়ি ভোরবেলা থেকেই সেদিন শুধু ডেকে-ডেকে উঠছে। হাঁসের পাত্তা নেই। হাহাকার পড়ে গেল। মোক্তারবাবু ক্ষেপে গেলেন। বললেন—নিশ্চয় এ হাঁস কেউ খেয়েছে। যে খেয়েছে তার বুকে গুলি না মেরে আমি আর এই বন্দুক ছোঁব না। মহাপিতিজ্ঞা।

সুকু বলছিল বটে, এরকম একটা কিছুর জন্যে তার বাবা আর বন্দুক ছোঁন না। তার মানে, হাঁসটা কে খেয়েছিল, জানা যায়নি। দিব্য জানতে চেয়ে বলে—তারপর?

—খুব খোঁজাখুঁজি হল অবশ্যি। এ গাঁ ও গাঁ সব পুকুর-জলা। জষ্টি মাস। জল কোথায়? তারপর পাওয়া গেল মাঠের মধ্যে ডানা পাখনাগুলো। বারোয়ারিতলায় সভা বসল। গাঁয়ের ছানাপোনা কেউ বাদ গেল না—প্রত্যেককে জিগ্যেসপত্তর করা হল। কিন্তু কোনও পাত্তা হল না।

বিলের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। দিব্য দামে ঢাকা বিলের জল খোঁজে। ভৈরব কপালে হাত ঢেকে সূর্য আড়াল করেছে। সেও খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠে। দিব্য বলে— হাসছ যে?

—চিনির মা এক দুপুরবেলা কপালীর জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে এসেছে। ভরপুর যৈবন থম থম করছে। সামনে দাঁড়িয়ে বললুম, হাঁসটা খেতে কেমন লাগল? অমনি মুখ শুকিয়ে গেল মেয়ের। হাতে পায়ে ধরতে লাগল। প্রাণের ভয়, বিষম ভয়। পা দুটো ধরে কাঁদে। বলে দিও না ভৈরবদা, যা চাও দেব।…

দিব্য ভুরু কুঁচকে বলে, ব্ল্যাকমেল! ভৈরব বুঝতে পারে না। অনবরত হাসে। যৌবনের বিশাল গুপ্ত কথা বুড়ো বয়স পর্যন্ত চাপা রেখেছিল। দম আটকা ভাব নিয়ে ঘুরছে এতকাল। সুকু বলেছিল, ঘণ্টায় একটা কথা বলে। দিব্য এখন সব বুঝেছে। ভারমুক্ত ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে শেষ চৈত্রের গনগনে রোদে একজন হালকা মানুষ—দুটো হাত আর হাঁটু ছুঁতেই পারছে না। কিন্তু তাহলেও ও একজন ব্ল্যাকমেলার! একটি মেয়ে প্রাণের ভয়ে পা ধরেছে, আর ও…জঘন্য।

—তারপর চিনির মা…

দিব্য অসহ্য রাগে ফেটে পড়ে—রাখো বাবা তোমার চিনিফিনি। হাঁস কোথায়? ভৈরব গ্রাহ্য করে না কলকাতার বাবুর রাগ। পা বাড়িয়ে বলে—আসুন, আপনার বরাত।…

কাশ বনে হামাগুড়ি দিয়ে দিব্য যেই জলের ধারে গেছে, ঝাঁকটা উড়ল। উড়তে উড়তে তার বাঁ দিকে ঘুরে যাচ্ছে। ঘুরেই দিব্য ট্রিগারে চাপ দেয়—পর পর দুবার। ধুন্দুমার উপদ্রব শুরু। চার দিকে সাড়া পড়ে যায়। কো-আ-ক-কো-আ-ক্‌—পড়েছে! পড়েছে! বুড়ো ব্ল্যাকমেলার চেঁচিয়ে ওঠে। দৌড়ে যায়। উঁচু কাশ-ঝোপে সে মিশে যায়। দিব্য উঠে দাঁড়ায় চটপট। নলখাগড়ার ঝোপের মাথা থেকে ঝটপট করতে করতে পড়ে গেল একটা। আন্দাজ বিশ পঁচিশ মিটার দূরে। দিব্য কাশবন ভেঙে দৌড়ে যায়। নলখাগড়ার চার পাশে উঁচু নীচু কাশ ব্যানা কাঁটা ঝোপ। ডানা ঝাপটে হাঁসটা ব্যানা ঝোপে ঢুকল। দিব্য ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত বাড়ায়। একই সঙ্গে আরেকটা হাত ব্যানা ঝোপের ফাঁক গলিয়ে উল্টো দিক থেকে এসে পড়েছে। দিব্য হাঁসটা নয়—সেই হাতটা ধরে ফেলে। কয়েক গাছা কাচের লাল নীল চুড়ি মট মট করে ভেঙে যায়। চাপা কাতরানি ওঠে—উঃ।

দিব্য এক টানে রক্তের ফোঁটা লাগা হাতের বাকি অংশ বুকের দিকে টানে। টানা ভাসা-ভাসা দুটো নীলচে চোখ—নাকছাবির লাল পাথরে হু হু আগুন, দেখতে দেখতে দিব্য জ্বলে যায়। বন্দুক নিজের গতিতেই শিকারির শরীর থেকে পিছলে পালিয়ে যেতে থাকে। ডোরাকাটা ময়লা ফাটাফুটো শাড়িও নিজের টানে পালাচ্ছে। ভাঁটার চরের মতো জাগছে সোনালি দুটি মাংসের চড়া—ওইখানে প্রকৃতির আদিম প্রবাহ, দিব্যর চার পাশ থেকে সভ্যতা সময় মুছে যেতে থাকে। নদী পেরিয়ে আসার সময় ঠিক এমনই ভেবেছিল, সামনে প্রকৃতি—যা ছিল তাই চিরকাল।

লালচে টার্গেটের দিকে দিব্যের ঠোঁট এগিয়ে যেতে থাকে। এবং সামনে প্রকৃতি—বরাবর বাকশূন্য, তার ভাষা মানুষের ভাষা নয়।

তখনও আকাশ বাতাস জুড়ে বারুদের গন্ধ। দিব্য বলে—তুমি চিনি?

তারপর…তার গায়ের ওপর একটা ছায়া পড়তেই সে ঘোরে। বুড়ো গরিলার দু হাতে দুটো হাঁস ঝুলছে। মুখটা…দিব্য চমকায়। মুখটা সত্যিকার গরিলার মতো হিংস্র। ঘড় ঘড় আওয়াজ করে বলে— বাবু, ওকে ছেড়ে দিন।

দিব্য একটু নার্ভাস হয়েছিল। সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চিনি হাঁসটা নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। ভৈরবের গলার ঘড়ঘড়ে আওয়াজটা তখনও কানে ভাসছে। একটু পরেই সন্দেহে সে ঘুরে দাঁড়ায় মুখোমুখি। নাঃ, গরিলাটা গর্জায়নি। কুতকুতে দুটো চোখে জল। হাঁসসুদ্ধ এক হাতের চেটোয় চোখ দুটো মুছে সে বলে—চলুন বাবু, আর কী!

২৯ জুন ১৯৭৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *