1 of 2

বুদ্ধির বাইরে – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বুদ্ধির বাইরে – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বিজ্ঞানের চোখে ভূতের অস্তিত্ব অচল। পাড়াগাঁয়ের ভূতের ভয় থেকে প্লাঁসেৎ, মিডিয়ামতত্ত্ব, রাত-বিরেতে সম্ভব অসম্ভব ছায়ামূর্তি দেখে চমকে ওঠা—এসব অনেক কিছুই তর্কের উপাদান জোগায়। ভৌতিক অস্তিত্বও ঈশ্বরের মতই নানা মতবাদে বিড়ম্বিত—সেখানে আস্তিক, নাস্তিক, স্কেপটিক বা অ্যাগনস্টিক কারুরই অভাব নেই।

সোজা কথায়, যুক্তির জগতে ভূতের জায়গা নেই। ভূত মানতে গেলে চোখ বেঁধে পিছু হটতে হয় একেবারে প্যালিয়োলিথিক আদিম যুগে। অশরীরী তত্ত্বে যারা আস্তিক্যবাদী, তাদের সঙ্গে আজ আর তর্ক চলবে না—চরম নিষ্পত্তির জন্যে হাতাহাতি করতে হবে।

তবু সবুকিছু বৈজ্ঞানিক-তত্ত্ব তর্কের মধ্যেও একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। এমন কতকগুলো প্রশ্ন ওঠে—যাদের উত্তর মেলে না। তার মানে এই নয় যে কোনদিন তাদের উত্তর একেবারেই পাওয়া যাবে না। হয়তো বিজ্ঞানের ব্যাপ্তি একদা স্বকিছুর নিঃশেষ সমাধান করে দেবে। কিন্তু যতক্ষণ তা হচ্ছে, ততক্ষণ কতকগুলো বিচিত্র ঘটনা আমাদের মনকে নানাভাবে আন্দোলিত করতে থাকে।

এই রকম একটি ঘটনা আমি বলব। এটা ভূতের গল্প কিনা জানি না। চোখ কিম্বা মনের ভুল কিনা, সে সম্বন্ধেও কোন রায় দিতে আমি প্রস্তুত নই। শুধু যা ঘটেছে, সেইটুকুই আমি বলব। যাঁর যা খুশি, তিনি সেই ভাবেই এগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। মাত্র একটি কথা জানিয়ে রাখি—এগুলি ঘটেছে সম্পূর্ণ খোলা এবং অপ্রস্তুত চোখের সামনে—গঞ্জিকা বা মাধ্বীর কোন প্রভাব এসব ক্ষেত্রে ছিল না।

প্রায় বারো-তেরো বছর আগেকার কথা। তখন পশ্চিম বাংলার একটা ছোট গ্রাম থেকে আমি শহরে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতুম। সাইকেলে করে আসতে হত আট মাইল দূরের স্টেশনে। একটা ছোট দোকানে সাইকেল জমা রেখে আমরা ট্রেন ধরতুম, সন্ধের গাড়িতে ফিরে আবার সাইকেল নিয়ে গ্রামে চলে আসতুম।

‘আমরা’ বললুম এই জন্যে যে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতুম দুজনে। আমি আর প্রিয়নাথ। মুন্‌সেফ্‌ কোর্টে চাকরি সেরে পাঁচটা নাগাদ প্রিয়নাথের সাইকেল রিপেয়ারিং-শপে এসে আমি আড্ডা দিতুম, চা খেতুম। তারপর সাতটায় দোকান বন্ধ করে সাতটা বাইশের ট্রেন ধরতুম দুজনে। কোন একজনের বাড়ি ফেরবার খুব বেশি তাগিদ না থাকলে ছিল এই আমাদের দৈনন্দিন প্রোগ্রাম।

স্টেশন থেকে আমাদের গ্রামের প্রায় সীমানা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল একটা অনুর্বর কাঁকর মাটির মাঠ—যাকে বলে ব্ৰহ্মডাঙা। জেলা-বোর্ডের রাস্তাটা ঢেউ খেলানো মাঠের ভেতর দিয়ে চড়াই-উৎরাইয়ে চলে গেছে—কোথাও কোথাও কুড়ি-বাইশ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠেছে দু-ধারের ঢাল জমি ছাড়িয়ে। পথের পাশে দেড় মাইল দু-মাইলের মধ্যে কোন গ্রাম নেই; শুধু এলোমেলো ফণী মনসা আর আকন্দের ঝোপ ছড়িয়ে আছে।

এককালে মাঠটা ডাকাতির জন্যে বিখ্যাত ছিল। পাঁচশো বছরের ভেতরে ওসব উপদ্রব আর শোনা যায়নি। কিন্তু তবুও একা এ-পথে ফিরতে সন্ধের পরে গা ছমছম করত। দু-একটা ভূতের কাহিনীও যে মাঝে মাঝে কানে আসত না এমন নয়। কিন্তু ও-ভয়টা কোনদিন আমাদের মনে যে এতটুকু ছাপ ফেলেছে, তা নয়। অন্তত সচেতন ভাবে তো নয়ই।

সেদিন কোর্ট থেকে বেরিয়ে কতগুলো সরকারী কাজ সেরে নিতে আমার রাত হয়ে গেল। প্রিয়নাথের দোকানে আসতেই তার ছোকরা চাকরটা জানালে যে আমার জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে যথানিয়মে সাতটা বাইশের ট্রেনই ধরেছে প্রিয়নাথ।

আমার মনটা দমে গেল। শুধু একা ফিরতে হবে বলেই নয়, দিনটাও দুর্যোগের। একটু আগেই মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে—সেই সঙ্গে আকাশ-চেরা বাজের ডাক। বৃষ্টিটা আপাতত থেমেছে বটে, কিন্তু আকাশ এখনো ঘন-মেঘে একটা আলকাতরার আস্তর দিয়ে মোড়া। যে কোন সময়ে ঝমঝম করে নেমে পড়তে পারে। এরই মধ্যে রাত ন’টার পরে ওই সীমাহীন কালো মাঠটার ভেতর দিয়ে একা আট মাইল সাইকেলে করে আমায় ফিরতে হবে। কারণ, সন্ধের পরে স্বভাবতই নির্জন পধটাতে এই বৃষ্টি-বাদলের রাতে যে কোন সহযাত্রী মিলবে, এ আশা করাই বিড়ম্বনা।

কিন্তু উপায় নেই, আমাকে যেতেই হবে। ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললুম, তারপর স্টেশনে এসে আটটা আটাশের গাড়ি ধরলুম।

ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই বৃষ্টি নামল। এমন প্রবল বৃষ্টি সচরাচর দেখা যায় না। সারা আকাশটা যেন গলে গলে ঝরে পড়ছে—অন্ধকার সাদা হয়ে গেছে বৃষ্টির কুয়াশায়। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তাটা আরো থিতিয়ে বসতে লাগল। উঁচু কাঁকরের রাস্তায় জল দাঁড়াবে না, কিন্তু মাঠের ভেতরে বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া মিশলে অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা অনুমান করা শক্ত নয়।

বৃষ্টি অবশ্য বেশিক্ষণ রইল না। আধঘন্টার মধ্যে আমি স্টেশনে এসে নামতেই দেখি বৃষ্টিও ধরে গেছে। মেঘ হালকা হয়ে গেছে, শুধু অল্প অল্প ইলশেগুঁড়ি পড়ছে তিরতির করে।

যে মুদিখানায় সাইকেল জমা থাকে, সে লোকটা ঝাঁপ বন্ধ করবার উপক্রম করছিল। আমাকে দেখে হাই তুললে। হেসে বললে, ‘এই রাতে ফিরবেন? থেকে যান না আমার দোকানে?’

বললুম, ‘সে হয় না, বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তা করবে।’ আরেকটা কথা অবশ্য বলা গেল না—সে তাগিদটাই প্রবলতর। অর্থাৎ মাসখানেক আমি বিয়ে করেছি এবং মাত্র তিনদিন আগে স্ত্রী এসেছে বাপের বাড়ি থেকে।

দোকানদার সাইকেলটা বের করে দিলে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘প্রিয়নাথ চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ, উনি তো সাতটা পঞ্চান্নর গাড়িতেই নামলেন। ভেঙে বৃষ্টি আসছিল, বা চমকাচ্ছিল ঘনঘন। ওঁকেও দাঁড়িয়ে যেতে বলেছিলুম, রাজী হলেন না। বললেন, বোঁ বোঁ করে চলে যাবেন।’

বোঁ বোঁ করে চলে যাব—আমিও ভাবলুম। তারপর সেই ঘন কালো অন্ধকারে তিরতিরে বৃষ্টির ভেতরেই সাইকেল নিয়ে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়লুম।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই মাঠের রাস্তা এসে পড়ল। দু-ধারে নিবিড় কৃষ্ণতার ভেতরে ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আর ছোট-বড় নালায় বর্ষার জলের কলধ্বনি। ল্যাম্পের ছোট আলোটিতে সামনের পাঁচ-সাত হাত দূর পর্যন্ত বাঁকুড়ার রাঙামাটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেটুকুও আর রইল না। ল্যাম্পে তেল ছিল না—খেয়াল করিনি। ক্ষীণ হতে হতে দপ করে নিভে গেল সেটা।

এইবার আমার ভয় করতে লাগল। চেনা রাস্তা—যতই অন্ধকার থাক, ঠিক নির্ভুল ভাবেই চলে যাব। তবু—তবু অন্ধকার, এই নির্জনতা! একবার যদি অসাবধান হই, তাহলে সাইকেল নিয়ে একেবারে দশ-বারো হাত নিচে গড়িয়ে পড়ব!

দু-চোখকে যতদূর সম্ভব তীব্র করে আমি সাইকেল চালাতে লাগলুম। তাড়াতাড়ি যেতে ভরসা হচ্ছে না, তবু উত্তেজনায় আপনা থেকেই দ্রুতবেগে পা ঘুরছিল প্যাডেলে। সেকেলে বি-এস-এ বাইক—আমার মনের শাসন না মেনেই সে যেন শোঁ শোঁ করে উড়ে চলল।

‘থামো হে সেন, থামো!’

অন্ধকার ছিঁড়ে যেন তীরের মত স্বর উঠল একটা। প্যাডেলে আচমকা পা থেমে এল আমার। পেছন থেকে পরিষ্কার গলায় ডাকল প্রিয়নাথ: ‘অত তাড়া কিসের হে? আমি যে সেই এক ঘন্টা ধরে মাঠের ভেতরে তোমার জন্যে হা-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে আছি!’

বিস্ময়ে এবং আনন্দে আমি সাইকেল থেকে নেমে এলুম। অন্ধকারেও দেখা গেল, পেছন থেকে প্রিয়নাথ দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

‘ব্যাপার কি হে? সেই সাতটা পঞ্চান্নর ট্রেনে নেমে এতক্ষণ মাঠের ভেতরে কী করছিলে?’

প্রিয়নাথ বললে, ‘সে অনেক কথা। ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে একটা।’

‘এই বর্ষার রাতে মাঠের ভেতরে কী এমন মজার ব্যাপার হতে পারে? আর তোমার সাইকেলই বা গেল কোথায়?’

অন্ধকারে প্রিয়নাথ এবার অল্প একটু শব্দ করে হেসে উঠল। বললে, ‘বলছি তো, সে অনেক কথা। গ্রামে ফিরে শুনবে। আপাতত তোমার ক্যারিয়ারে আমায় তুলে নাও।’

‘বেশ, উঠে পড় চটপট।’

প্রিয়নাথ কাছে এল: ‘দেখেছ কাণ্ড! জলে-কাদায় একেবারে মাখামাখি হয়ে গেছি। হাড়ের ভেতরটা সুদ্ধ কাঁপছে ঠকঠক করে।’

‘পড়ে গিয়েছিলে নাকি?’

‘হুঁ, সে আর বল কেন! আছাড় বলে আছাড়! একেবারে অতল জলের ভেতর। কাদার মধ্যে প্রায় বসে গিয়েছিলুম। যাক, বাড়ি ফিরেই শুনবে সেসব কথা।’

আমি সাইকেলের প্যাডেল ঘোরালুম। তড়াক করে প্রিয়নাথ পেছনে উঠে বসল। একটা ঝাঁকুনি লাগল, টের পেলুম, সীটের আংটাটা প্রিয়নাথ আঁকড়ে রয়েছে।

এই ভিজে রাস্তায়, এমন অন্ধকারে আরেকটা মানুষকে ক্যারিয়ারে তুলে নেওয়া যে কী দুর্ভোগ, সে বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু অনুভব করলুম, হঠাৎ যেন আমার গায়ে দ্বিগুণ শক্তি বেড়ে গেছে। প্রিয়নাথের অতখানি ওজন আমাকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারল না। সেকেলে মজবুত বি-এস-এ সাইকেল শনশন করে চলতে লাগল। এমন কি, অন্ধকারের সম্ভাব্য বিপদটাও মুছে গেল মন থেকে।

প্রিয়নাথ কোন কথা বলছে না—আমিও না। নিঃশব্দে প্রায় পনেরো মিনিট চলবার পর হঠাৎ দূর থেকে জলের একটা উগ্র গর্জন শোনা গেল। আমি চমকে বললুম, ‘ওকি—খোয়াইতে বান এল নাকি?’

এইবার বিচিত্র ব্যাপার ঘটল একটা। প্রিয়নাথ আমার কথার জবাব দিলে। কিন্তু পেছনের ক্যারিয়ার থেকে নয়। পরম বিস্ময়ে দেখলুম, আমার সাইকেল থেকে প্রায় পনেরো হাত সম্মুখে দু-হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়নাথ। হ্যাঁ, অন্ধকারেও দেখতে পেলুম, প্রিয়নাথই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রিয়নাথ ডেকে বললে, ‘নামো সেন, নামো। বানের জলে খোয়াইয়ের পচা কাঠের পুলটা ভেসে গেছে। আর এগোলে খাড়া ত্রিশ হাত নিচে আছড়ে পড়বে।’

মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীরে আমার বিদ্যুৎ বয়ে গেল। কখন ক্যারিয়ার থেকে নামল প্রিয়নাথ, কখনই বা এমন করে পনেরো হাত দৌড়ে গেল সে? সাইকেলের গতি মন্দা করতে করতে আবার শুনলাম: ‘এখনো নামো সেন, এখনো নামো। নইলে আমার যা হয়েছে, সে-দশা তোমারও হবে।’

ক’ সেকেন্ডের মধ্যে সবটা ঘটল জানি না। দেখলুম, প্রিয়নাথের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। তারপর যেন করোটির কোটর ছেড়ে সে দুটো চোখ তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আলোর মত উড়ে আসতে লাগল আমার দিকে। যেন ফসফরাসের দুটো অতিকায় পতঙ্গ।

পরদিন সকালে আমাকে পাওয়া গেল রাস্তার ওপরে, সাইকেলটাকে জড়িয়ে ধরে আমি পড়েছিলুম। আর প্রিয়নাথকে পাওয়া গেল ভাঙা পুল থেকে তেইশ-চব্বিশ হাত নিচে, আরো তিন-চার ফুট জলকাদার তলায়। ওপর দিকে পা দুটো তুলে তার পেট পর্যন্ত কাদার মধ্যে গাঁথা। ভাঙা সাইকেলটা খানিক দূরে একখানা বড় পাথরের ওপরে ঝুলে রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *