1 of 2

বীরভোগ্যা – শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

বীরভোগ্যা – শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কথাটা হিমাংশু আগেই শুনেছিল, বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এখন—“গত সাতুই মার্চ—”

সাতুই মার্চ? তার মানে—মাস দেড়েক? হ্যাঁ, তা হবে! সুরেশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মার্চের শেষাশেষি। সে-ই প্রথম বলে, মনে পড়ছে, প্রথমে সুরেশ, তারপব চিন্ময়ী, তারপর—

“—সুরেশবাবু, চিনুদি, এমনকী বড়কাকাও—”

অখিলবাবুও? সুরেশ যেতে পারে, চিন্ময়ী সোমের যাওয়াও কিছু বিচিত্র নয়, কি অখিলবাবু কী বলে—

“অনেকক্ষণ ছিলেন। ওঁর সাথে কত গল্প করলেন। আমার সৎসাহসকে বাহবা দিলেন। সুরেশবাবু চিনুদি বারবার অভিনন্দন জানালেন, শুভেচ্ছা জানালেন। বড়কাকা মাথায় হাত দিয়ে—”

বেহায়া! নির্লজ্জ বেহায়া! সুরেশ, চিন্ময়ী, অখিল—তিনটেই। শুধুই বেহায়া নয়, ভণ্ডও। প্রচণ্ড ভণ্ড। আত্মসম্মান দূরে থাকে, সাধারণ চক্ষুলজ্জার বালাইটুকুও নেই। নইলে—

“—অথচ তোমার অভিনন্দন, তোমার শুভেচ্ছা, তোমার আশীর্বাদই সকলের আগে আমি আশা করেছিলাম। আশা করেছিলাম—”

আশা! আশা করেছিল হিমাংশুর অভিনন্দন! আশা করেছিল—সুরেশ দত্ত, চিন্ময়ী সোম, অখিল মুখুজ্জের মতো হিমাংশু মজুমদার বাড়ি বয়ে গিয়ে অভিনন্দন জানাবে, শুভেচ্ছা জানাবে, আশীর্বাদ জানাবে!

প্রাণপণে চিঠিটা দলা পাকাতে পাকাতে অকথ্য রাগে দিশা হারাচ্ছিল, হঠাৎ হিমাংশুর হুঁশ হয়— এমন আশাকে লাই দেওয়া নেহাত হয়তো অস্বাভাবিক নয়, সুরেশ চিন্ময়ী অখিলের অমন বেহায়াপনার পর।

প্রিয়লালের বন্ধু সুরেশ, বান্ধবী চিন্ময়ী। আর নিজের বাপের সহোদর ছোট ভাই অখিল। সুরেশ-চিন্ময়ী প্রকাশ্যে শত্রুতা করেছে, “তা হলে তোমার সাথে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না” বলে সাফ জবাব দিয়ে দিয়েছে অখিল।

সাফ জবাবের আগে অবশ্য অখিল মুখুজ্জে অনেক করে বুঝিয়েছে, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনের মিল হচ্ছে না? সে আর কটা হয়। যোলো আনা মনের মিল না হলেও—”

“ও একটা—।”

“শোনা কথায় কেন—”

“শোনা কথা নয়, প্রমাণ আছে। চিঠিপত্র, ফটো—”

“তা পুরুষ মানুষের এক-আধটু ইয়ে থাকেই। সংসার করতে হলে অনেক কিছু জেনেও না জানার—”

“অন্যায়ের সাথে আপস?”

“নেহাত অসহ্য লাগে, দিনকতক আলাদা থাকুক, সংশোধনের সুযোগ দিক। প্রিয়লাল তো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি? স্ত্রীর ওপর কোনও দুর্ব্যবহার তো করছে না?”

“না, স্ত্রীকে ধরে মারপিট করছেন না, খেতে-পরতেও দিচ্ছেন। আপনি হয়তো এ থেকেই ওকে আদর্শ স্বামী মনে করতে পারেন, কিন্তু ও করে না। না কি বলো?”

স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। হিমাংশুর কথায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলিয়ে সায় দিতে কিন্তু ভুল হয়নি।

“আমি স্বীকার করছি মাস্টার, আমার ভাইঝি হলেও পুঁটুকে আমার চেয়ে তুমি ভাল চেন। তুমি ওর হিতাকাঙ্ক্ষী, তাও মানি। ওর জন্যে তুমি অনেক করেছ। কিন্তু—এবার কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এই বিয়ে নিয়েও একবার—”

“তখন প্রিয়বাবু এমন ছিলেন না। তা ছাড়া—”

“ছিল।” মুখ না ফিরিয়েই আস্তে আস্তে বলেছিল, “ও বরাবর এমন আগে বুঝিনি।”

“মাস্টার! শুনলে তো মাস্টার? অথচ ভাল করে খোঁজখবর নিয়েই তুমি কোমর বেঁধে লেগেছিলে। সেদিনও তুমি আদর্শের দোহাই দিয়েছিলে। আমি পই পই করে—”

“ভুল করেছিলাম। কিন্তু একবার ভুল করেছি বলেই জীবনভর তার জের টেনে চলতে হবে? মানুষ মাত্রেই—”

“হুম!” গুম হয়ে গিয়েছিল অখিল মুখুজ্জে। ঘাড় হেঁট করে শুনে গিয়েছিল হিমাংশুর কথাগুলি। হিমাংশু থামলে মুখ তুলেছিল, “তা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ভাবা হয়েছে কি?”

“চাকরি করবে?”

“অ!” গুম হয়েছিল আরেক কিস্তি। তামাক টানা মুলতুবি রেখে। তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, “তোমারও নিশ্চয় এই কথা? ভাল! তবে আমার কথাটাও শুনে যাও—এসব কেলেঙ্কারি যদি সত্যিই কর তা হলে”—বলতে বলতে সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েছিল, দরজার আড়ালে গিয়ে উপসংহারটা ছুড়ে মেরেছিল।

তারই বৈঠকখানার দরজার আড়ালে গিয়ে। সুতরাং এর পরেও বসে থাকা মানে গলাধাক্কা খাওয়ার প্রতীক্ষা করা।

“আমার জন্যে তুমি অপমানিত হলে। তার চেয়ে আমি বলি কি—”

কথা কেড়ে নিয়েছিল হিমাংশু: অপমান? তার প্রজ্ঞাশ্রী একে অপমান ভাবে? আদর্শের কাছে মান-অপমানের প্রশ্ন? লোকলজ্জার ভয়? সংস্কারের পিছটান? না-না, সে হয় না—কক্ষনও হতে পারে না। হিমাংশুই হতে দেবে না। ও কি জানে না—পাঠক জনতার মনোরঞ্জনে নায়ক-নায়িকাদের দিয়ে যা কিছুই করাক, মানুষ হিসেবে হিমাংশু মজুমদার সৎ-সচ্চরিত্র আদর্শবাদী? নিজে সে প্রায় তপস্বীর জীবনযাপন করে?

সুরেশ-চিন্ময়ীর শত্রুতার, অখিলের হুমকিতে ও কিছুটা দমে গেলেও হিমাংশু পিছপা হয়নি। একদিকে সে ওকে উৎসাহ দিয়েছে, অন্যদিকে করেছে মামলার তদবির, খবরের কাগজে নিয়মিত মামলার খবর ছাপার ব্যবস্থা: এতদিন তাদের দুজনের নাম একসঙ্গে জড়িয়ে যারা কানাঘুষা করত, এবার তারা সরব হোক, ক্ষতি নেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও জানুক, হিমাংশু মজুমদার জনপ্রিয় লেখক হলেও আদর্শবাদী মানুষ। লেখক হিমাংশু মজুমদারের প্রতি বিমুখ পাঠকরা, সমালোচকরা, প্রকাশকরা সম্পাদকরা মানুষ হিমাংশু মজুমদারকে অন্তত শ্রদ্ধা করুক।

জিতিয়েও দিয়েছিল মামলায়।

“এখন কোথায় যাবে?”

“ভয় নেই, তোমার ঘরে গিয়ে উঠব না।”

“আমার ঘর! ওদিকে নোটিশ ঝুলছে—তিন মাসের বিল বাকি।”

“নিজের খরচটাও জোটাতে পার না?”

চমক লেগেছিল—কোথায় সহানুভূতি জানাবে, তা নয়, খোঁচা দিল? তিন মাসের বিল বাকির জন্যে তার অক্ষমতাই কি শুধু দায়ী? মামলায় কম টাকা খরচ হয়েছে? বলবে সেকথা?

আচ্ছা, এখন থাক।

“তুমি তো জানো, দেশে আমার বিরাট সংসার—মা, বাবা, একপাল ভাইবোন—”

“তোমার বইয়ের অত বিক্রি!”

“পাবলিশারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যে কী ব্যাপার—“

তোমার সেই লেখকবন্ধুর মতো একটা রোজগেরে বউ জুটিয়ে নাওনা কেন?”

“ছি, অমন করে বলো না। তুমি তো জানো, মেয়েদের আমি কত শ্রদ্ধা করি। নিজে সংসার করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমিও আর সকলের মতো—রাম শ্যাম যদুর মতো—”

“মহাপুরুষরা অবশ্য—”

“প্রজ্ঞাশ্রী!”

“এই দ্যাখ, ঠাট্টাও বোঝ না? এমন একটা জয়ের পর একটু হাসি-মস্করাও করতে পারব না! আর এই জয়ের যোলো আনা তো তোমারই প্রাপ্য। তোমার উকিলবন্ধু আর কতটুকু করেছেন, তুমি যা সাক্ষী দিলে! কেমন দিব্যি গড়গড় করে—”

“একটা আদর্শের জন্যে—”

“তা অবিশ্যি। আদর্শের জন্যে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া চলে।”

কথার ধরনটা কেমন বেসুরো। হিমাংশুর ধাঁধা লাগে; একদা ছাত্রী ক্ৰমে বান্ধবী হয়ে উঠেছে, প্রজ্ঞাশ্রীতে পরিণত হয়েছে, রস-রসিকতাও চলেছে, কিন্তু আজকের মতো এমন গতানুগতিক ঠাট্টা-তামাশা এমন বাঁকাসুরে কথা বলা? কই, মনে তো পড়ে না।

“আপাতত হরিতকী বাগানের হস্টেলেই উঠি, কী বলো?”

“আপাতত কেন, স্থায়ীভাবেই ওখানে থাক না। আমার মেসের কাছাকাছি হবে!”

“তোমার তো আবার নোটিশ পিরিয়ড।” ট্রামের মধ্যেই সশব্দে হেসে উঠেছিল। আড়চোখে হাসিহাসি মুখে তাকিয়েছিল। তাকিয়েছিল।

সেই হাসি, হাসিমুখ সহজে হিমাংশু ভুলতে পারেনি।

আজ, এখন নতুন করে ফের মনে পড়ে।

দলা-পাকানো চিঠিটা খুলে ধরে হিমাংশু—

“আশা করি রবিবার সকালে তুমি আসবে। অবশ্য আসবে। ওঁর সঙ্গেও তা হলে দেখা হবে। শতকোটি প্রণামাত্তে, ইতি—”

শতকোটি প্রণামান্তে!

মাস দুয়েক পরেই হরিতকীবাগানের হস্টেল থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেও, নতুন ঠিকানা না জানালেও—দেড় বছর ধরে নিয়মিত চিঠি দিয়েছে। প্রতি চিঠিতেই প্রণাম জানিয়েছে। আর কোনও কথা নয়, কোনও খবরাখবর নয়, শুধু ‘তুমি আমার প্রণাম নিও।’ প্রথমে চিঠি আসত পনেরো দিন পরপর, কমতে কমতে দাঁড়িয়েছিল তিন দিন। সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হয়েছিল চিঠিও: ‘তুমি আমার প্রণাম নিও।’ আমার প্রণাম নিও। প্রণাম নিও।’ ‘প্রণাম।’ শেষ অবধি নিছক প্রণামে এসে ঠেকেছিল। প্রকাণ্ড একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্নওলা প্রণামে। তলায় নামটা পর্যন্ত থাকত না।

প্রণাম! প্রণাম প্রণাম! প্রণাম প্রণাম প্রণাম!

ব্যবহারে ব্যবহারে কী অশ্লীল কী কদর্য কী জঘন্য হয়ে গিয়েছিল মহৎ এই শব্দটা! আস্তে আস্তে নরম সুরে মনে মনে উচ্চারণ করলেও কী কুৎসিত শোনাত! ছ ফুট বাই আট ফুট ঘর, চুনবালি-খসা ঝুলে-ভরা দেওয়াল, পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি, গায়ে তেলচিটে গেঞ্জি, মুখে নিভন্ত বিড়ি, নড়বড়ে তক্তপোশে নোংরার বেহদ্দ বিছানায় উবু হয়ে পড়ে হিমাংশু মজুমদার জনপ্রিয় সাহিত্য রচনায় মশগুল, আর তার পায়ের কাছে ঢিপ ঢিপ করে হরদম প্রণাম ঠুকছে অদৃশ্য একটি মেয়ে, তার প্রজ্ঞাশ্রী, দৃশ্যটা কল্পনা করতেও মাথায় রক্ত উঠে যেত।

অথচ, অনাত্মীয় অন্তত একটি মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তিরই কাঙাল ছিল হিমাংশু মজুমদার। লেখক হিসেবে সে জনপ্রিয় সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রিয় লেখক আর প্রিয় সিনেমার তারকাকে কি জনতা একই চোখে দেখে না? রকেরেস্তরাঁয় প্রিয়তমদের তারিফে গলা ফাটানো ও হাতের নাগালে পেলে সিটি দিয়ে, গায়ে হুমড়ি খেয়ে, কাপড় টানাটানি করে, এমনকী, স্মৃতি হিসেবে বুক পকেটে পুষে রাখার জন্যে মুঠোখানেক চুল ছিঁড়ে নেবারও মওকা খোঁজে না? “বেড়ে লিকেচে মাইরি!” অতিবিখ্যাত নিজের একটি বই সম্পর্কে বাসে একদিন আড়ি পেতে এই মন্তব্যই কি শোনেনি হিমাংশু? শোনা মাত্র কি প্রতিজ্ঞা করে বসেনি—এর চেয়ে অনেক অনেক ভাল টিউশনি—টিউশনির উঞ্ছবৃত্তি? তা হলে গুষ্টিসমেত তিলে তিলে হয়তো মরতে হবে, কিন্তু চোখ ওল্টানোর আগে পর্যন্ত কয়েকটি ছেলেমেয়ের শ্রদ্ধাভক্তির পরিচয় পেয়ে যাবে। তার প্রজ্ঞাশ্রীর মতো কয়েকটি ছেলেমেয়ের। প্রতিজ্ঞা করেছিল—

হায়রে প্রতিজ্ঞা! অত বড় সংসার ঘাড়ে নিয়ে প্রতিজ্ঞা।

হাজার হাজার এম এ যখন পথে ঘাটে ফ্যা ফ্যা করছে, টিউশনি জোটান অতই সহজ!

“জান প্রজ্ঞাশ্রী, আমারও কত সাধ ছিল, স্বপ্ন ছিল।”

“হবে, সব সফল হবে।”

“তুমি বলছ।”

“বলছি। তুমি হতাশ হয়ো না, ভেঙে পড়ো না। দিনকাল নিশ্চয় বদলাবে। একদিন তুমি মাথা উঁচু করে—”

“প্রজ্ঞাশ্রী! সত্যিই তুমি প্রজ্ঞাশ্রী! আমার প্রেরণা তুমি। তুমি—”

“অতি সাধারণ মেয়ে আমি।”

“সে আর সকলের কাছে। আমার কাছে তুমি—”

অসাধারণ। কেন ও বুঝেও বোঝে না অতিসাধারণ একটি মেয়েকে আশ্রয় করেই অসাধারণের তপস্যা হিমাংশুর। বঞ্চিত-বানচাল তার সমস্ত সাধ-স্বপ্ন দিয়ে গড়েছে এই অনন্যাকে। পাঠকের মুখ চেয়ে সাহিত্যে যা করতে পারেনি, এই মেয়েটিকে নিয়ে বাস্তবে তাই করেছে সমস্ত অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই, সমস্ত সংস্কারের উপরে ব্যক্তিমানুষের দাবি। প্রিয়লালের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে অখিল মুখুজ্জে এক কথায় রাজি হয়ে গেলে, কে জানে, হিমাংশু হয়তো একটা আশীর্বাণী পাঠিয়েই দূরে থাকত। (বস্তুত, তার প্রজ্ঞাশ্রী কারও প্রেমে পড়েছে, নিজের মুখে সে-কথা এসে জানাচ্ছে, যখন-তখন তার গুণপনায় গদগদ হয়ে উঠেছে—হিমাংশুর কেমন ভাল লাগেনি।) কিন্তু অখিল মুখুজ্জে জাত-ধর্মের প্রশ্ন তুলতেই না সে-ও গোঁ ধরেছিল, প্রজ্ঞাশ্রী শেষের দিকে বেঁকে বসলেও দমেনি, তার কান্নায় কান দেয়নি। (ভয় পাচ্ছে? এই বিয়েতে কাকার আপত্তি বলে ভয়?), এক রকম জোর করেই তাকে রেজিস্টারের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রিয়লালের হাতে সঁপে দিয়েছিল।

একটি সংসার রচনা করে দেওয়াও কি কম কাজ! আদর্শের জন্যে লড়াই করার সুযোগ পাওয়াও কি কম সৌভাগ্য।

এবং অসচ্চরিত্র স্বামীর কবল থেকে স্ত্রীকে মুক্ত করে দেওয়াও কম বাহাদুরি নয়। মামলা জেতাবার মতো মিথ্যে সাক্ষী দিতেও বুকের পাটা চাই।

আর সেই মেয়ে কিনা এমন নিমকহারাম?

প্রণাম! প্রণাম! দেড় বছরে সাতবার ঠিকানা বদলেছে, কিন্তু মুক্তি মেলেনি ওই প্রণামের হাত থেকে। চিঠি এসেছে পাবলিশারের ঠিকানায়। ঠিক তিন দিনের মাথায় একখানা। প্রণাম! প্রণাম! প্রণাম!

এক ক্ষ্যাপা কুকুরের তাড়া যেন। লেখাটেখা মাথায় উঠেছে, নাওয়াখাওয়া চুলোয় গিয়েছে—দেশ ছেড়ে পালাবার কথাও, একেবারে বেপাত্তা হয়ে যাবার কথাও ভেবেছে হিমাংশু।

কিন্তু সাধ্য কি হিমাংশু মজুমদারের মোটা মাইনের চাকরি না নিয়ে কলকাতা ছেড়ে বাইরে যায়? এই ক্ষ্যাপা কুকুরের হাত থেকে রেহাই পেলেও সংসারের অক্টোপাশ থেকে মুক্তি কোথায়?

“পুনশ্চ—আমার বিয়ের খবর বিজ্ঞাপন করে কাগজে ছাপলুম, তবু এলে না? তবে কি তুমি আমার ওপরে রাগ করেছ? প্রজ্ঞাশ্রীর ওপর রাগ? ছি!”

চিঠিখানা হিমাংশু মজুমদার কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে।

প্রথমে হকচকিয়ে যায়। তারপরেই কলকলিয়ে ওঠে।

“একী! কী সৌভাগ্য! একদিন আগেই—”

“অসময়ে এসে থাকলে বলো, চলো যাই।”

“পাগল।” খপ করে পাঞ্জাবির খুট চেপে ধরে, এক মুখ হেসে বলে, “এমন ছেলেমানুষি তো তোমার ছিল না। এস ভেতরে এস।”

সদ্য-পাটভাঙা হলেও পুরনো পাঞ্জাবি। জোরজারি করলে পাছে ছিঁড়ে যায়, গুটি গুটি ভিতরে ঢোকে হিমাংশু।

চমৎকার ঘর। দামি আসবাবে সাজানো। মেঝেয় কার্পেট, ডিস্টেম্পার করা দেওয়াল। জানালায়-দরজায় চোখ জুড়োনো পর্দা, চারকোণে টাটকা ফুলে ভরা চারটে ফ্লাওয়ার ভাস।

বড় অস্বস্তি বোধ করে হিমাংশু। নিজেকে তার বড় বেমানান মনে হয়। বেমানান শুধু ঘরের জন্যে নয়, আরেকজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও: বাড়িতেও সিল্কের শাড়ি, সাটিনের ব্লাউজ পরে থাকে নাকি? সিনেমার নায়িকার মতো সব সময় সেজেগুজে থাকে? এসেস্নের রানি হয়ে থাকে? অনেক রোগা হয়ে গিয়েছে, লাবণ্য ঝরে গিয়েছে, কিন্তু তবু—

“কই, বস।”

কী অসহ্য ন্যাকামিভরা সুরেলা স্বর!

“বসার জন্যে আমি আসিনি।” টানটান হয়ে দাঁড়ায় হিমাংশু।

“ঝগড়া করতে এসেছ, জানি—”

“না, আমি শুধু একটি কথা জানতে চাই।”

‘মাত্র একটি।”

মুখ টিপে হাসছে! সারা শরীর হিমাংশুর রি রি করে ওঠে। আজও হাসলে গালে টোল খায়— আশ্চর্য! তাড়াতাড়ি সে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

“একটি কেন, তোমার সব কথার জবাব দেব। আগে বস দেখি। ইস, একেবারে ঘেমে নেয়ে গিয়েছ! দাঁড়াও ফ্যানটা খুলেদি।”

ফ্যান খুলতে চলেছে, না নাচের মহড়া দিচ্ছে? দুই চোখ হিমাংশুর ‘জ্বালা জ্বালা করে। আর সে কিনা সারাটা পথ ভাবতে ভাবতে এসেছে, কথায় কথায় কী করে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠবে, হঠাৎ উত্তেজনায় দিশা হারিয়ে ফেলবে, দিশা হারিয়ে ফেলে আচমকা দুই কাঁধ খামচে ধরবে, কাঁধ খামচে ধরে কৈফিয়ত তলব করবে?

কাঁধ খামচে ধরে কৈফিয়ত তলব দূরস্থান, ওকে ছোঁওয়ার কথাও কি সে এখন ভাবতে পারে! তার এই ঘরে, এই পরিবেশে—

“কী দেখছ, ভারী সুন্দর ড্রয়িংরুম না?”

হিমাংশু শূন্যদৃষ্টি মেলে ধরে।

“সুন্দর হয়েছে সাজানোর গুণে। আমি নিজের হাতে সাজিয়েছি। প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনেছি। নইলে আগে যা ঘরের ছিরি ছিল!”

নিজের হাতে সাজিয়েছে বলে গর্ব? প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনেছে বলে? এমন ঘরের মালিক হলে ঘর সাজানোর শখ জাগা যেন অসম্ভব ব্যাপার! বেস্তর জোর থাকলে পছন্দমাফিক জিনিস কেনা যেন দুষ্কর ব্যাপার।

“দাঁড়াও, চায়ের কথা বলে আসি।”

গলা চিরে প্রতিবাদ করতে যায় হিমাংশু, ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ বেরোয় শুধু।

“চা খাবে না? অবিশ্যি এই গরমে চা না খাওয়াই ভাল। শরবত খাও বরং, কেমন? আমিই করে নিয়ে আসছি। আচ্ছা, এক কাজ কর না—তুমিও সঙ্গে এস, আমার ঘর-গেরস্থালিও দেখবে। চিনুদি কত তারিফ করে গেলেন। হাত জড়িয়ে ধরে বললেন—”

“আমি খেতে আসিনি।” বাধা দেয় হিমাংশু, চিন্ময়ী সোমের নাম শোনা মাত্র আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। কঠিন স্বরে বলে, “তোমার সুরেশবাবু, তোমার চিনুদি, তোমার বড়কাকার মতো শুভেচ্ছাটুভেচ্ছা জানাতেও আসিনি আমি। তুমি জান, আমি আর যাই হই ভণ্ড নই—ভণ্ডামি আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।”

“আমিও।”

“আগে আমার তাই ধারণা ছিল।”

“বদলাল কেন?”

“তোমার কাজে। আচ্ছা, প্রিয়বাবুকে তুমি ডাইভোর্স করেছিলে, কেন? না, তিনি ডিবচ। আর সেই তুমি কিনা এই ভদ্রলোককে—”

“যেচে বিয়ে করেছি। দস্তুরমাফিক প্রেম করে।”

“কিন্তু এর মত মানুষ—”

“থামলে কেন, বল। পতিনিন্দেয় দেহত্যাগ করব তেমন সতী তো নই। আমি জানি লেখক মশায় আমার স্বামী ডাকসাইটে দুশ্চরিত্র, মাতাল। এর আগের স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। দেশশুদ্ধ লোকে জানে, আমি জানব না?”

“জেনেশুনেও তুমি—”

“হ্যাঁ, জেনেশুনেই আমি। কারণ ইনিও ভণ্ড নন। কোনও রকম ভণ্ডামি এঁর নেই। সততার ভণ্ডামি, আপসহীনতার ভণ্ডামি, আদর্শের ভণ্ডামি, ব্যক্তিমানুষের দাবির ভণ্ডামি—”

“প্রজ্ঞাশ্রী।” চাপা আর্তনাদ করে ওঠে হিমাংশু।

“পেজ্ঞাশ্রী!” খিলখিল করে হেসে ওঠে তার প্রজ্ঞাশ্রী। ঠোঁট উল্টে বলে, “না, সত্যি তুমি তেমনি আহাম্মক রয়ে গেছ। কাকে কী বলছ গো—আমি প্রভা—পঁটু—রক্তমাংসের জ্যান্ত একটা মেয়ে।” বলতে বলতে এগিয়ে আসে—শরীরে পাক দিয়ে, আঁচল লুটিয়ে, উগ্র এসেন্সের গন্ধ ছড়িয়ে।

হিমাংশু মজুমদারের গলা কাঠ, বুক ঢিপঢিপ, দম বন্ধ, চোখ বন্ধ—এই বুঝি একটা রক্তমাংসের বেপরোয়া কামনা তার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আততায়ী হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরে।

এই বুঝি! এই বুঝি!

১ মার্চ ১৯৫৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *