1 of 2

বিষবাষ্প – অশোক বিশ্বাস

বিষবাষ্প – অশোক বিশ্বাস

‘না, না, হিমাদ্রিবাবু, অজিত ভট্টাচার্য লোকটা মরল আমার উপস্থিতিতেই। পুলিশের লোক বলে মনটা আমার সন্দেহপ্রবণ। তাই পোস্টমর্টেম করালাম। সার্জেন স্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট দিলেন। লোকটা প্রেশারে ভুগছিল—একটা স্ট্রোক আগে হয়ে গেছে। ফুসফুসের কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে সে মারা গেছে। সবই বুঝছি, কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। মৃত্যুর মুহূর্তে সে আড়ষ্টভাবে কী যেন বলেছিল, ”তুল” এইটুকু কথা তার ঠোঁটে বিড়বিড় করে উঠেছিল। তারপর ব্যস, সব শেষ। না, না, মিস্টার সেন, কোথায় যেন একটা গরমিল রয়ে গেছে। আমার মন বলছে, আমি ভুল করছি, ঠিক হিসেব মেলাতে পারছি না…।’

‘আচ্ছা, অজিতবাবুর কি এমন কোনও পরিচিত কেউ আছেন, যাঁর নামের সঙ্গে ওই ভাঙা কথাটার মিল থাকতে পারে?’

‘আছে, একটি পুরুষ, একটি নারী—একজনের নাম অতুলকৃষ্ণ দাশ, অন্যজনের নাম পুতুল চৌধুরী। অজিতবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন ওই অনুষ্ঠানে অতুলেরও আসার কথা। কিন্তু সে কখন এসেছিল, তা কেউ বলতে পারেনি। তার বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সে সন্ধের আগেই হাতে সুটকেস ঝুলিয়ে বেরিয়েছে—কোথায় গেছে কেউ হদিশ দিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এই দু-দিন হয়ে গেল সে ফিরে আসেনি। অতুল দাশ অজিতবাবুর বন্ধু।’

‘আর পুতুল চৌধুরী?’

‘আজ থেকে বছর দশ-বারো আগে সে নিহত হয়েছে…।’

‘নিহত!’

‘সে আর-এক কাহিনি। আচ্ছা, আগে সিগারেট ধরিয়ে নিন। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, পুতুল চৌধুরী—আঠেরো বছরের একটি যুবতী। রূপ তার ছিল কি না জানি না, তবে চটক ছিল—আর তাতেই সে আকৃষ্ট করেছিল দুটি তরুণকে। পুতুলের প্রফেশন ছিল যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করা। অতুল এবং অজিতও শখের অভিনয় করত। ওদের সঙ্গে পুতুলের আলাপ হল। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা। পুতুল দুজনকেই পাগল করে তুলল। দুই বন্ধুর মধ্যে মেয়েটিকে আপন করে পাওয়ার জন্যে শুরু হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রেষারেষি। মাঝখান থেকে লাভ হল পুতুলের। কায়দা করে সে একের অনুপস্থিতিতে অন্যকে আমন্ত্রণ করত। কিন্তু এই বাঁদর-নাচানো খেলা বেশিদিন চলল না। একদিন সে ধরা পড়ে গেল। আর তখনই তার কোমল বুকে নেমে এল একটি তীক্ষ্ন ছোরার আঘাত। অতুল দাশ রক্তমাখা পোশাকে ধরা পড়ল পুতুলের ঘরের বাইরে আসতেই। আদালতে সে বলল, সে খুন করেনি। পুতুলের ঘরে গিয়ে সে দেখেছিল, অন্ধকারে পুতুল শুয়ে আছে। ঘরের জানলা দিয়ে স্বল্প চাঁদের আলো আসছিল। পুতুল জানলার দিকে মুখ করে চৌকিতে শুয়েছিল। অতুল আলো জ্বালেনি। বিছানায় গিয়ে বসে পুতুলের গায়ে হাত দিয়েছিল। পুতুলকে কাছে টানতে গিয়েই দেখেছিল, তার বুকে গভীর ক্ষত। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। রক্ত ওইসময় জামাকাপড়ে লেগে থাকবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার যুক্তি আদালতে টিকল না। তার দশ বছরের জেল হয়ে গেল। তারপর এই মাসকয়েক হল অতুল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।’

‘জেল থেকে ফিরে আসার পর অজিতের সঙ্গে অতুলের ব্যবহার কেমন দাঁড়িয়েছিল?’

‘প্রফেসর ডক্টর বরুণ ব্যানার্জি, অর্থাৎ যিনি বিবাহ-বার্ষিকীর অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং যাঁর বাড়িতে ওই অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম এবং অজিত ভট্টাচার্য মারা গিয়েছিলেন, সেই বরুণবাবু এঁদের বন্ধু। তিনি বলেছিলেন, অতুল এবং অজিত ওরা পরস্পরকে এড়িয়ে চলত। অতুলের জীবনের অনেকগুলো মূল্যবান বছর অজিতের নিপুণ কারসাজিতে নষ্ট হয়ে গেছে। অজিত পুতুলকে হত্যা করে বা করিয়ে মিথ্যে করে অতুলকে সেই হত্যার দায়ে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে নির্দোষ হয়ে সমাজে আর-পাঁচজনের মতো মাথা উঁচু করে সুখে-স্বচ্ছন্দে বেঁচে আছে—এরকম একটা ধারণা তার মনের মধ্যে দৃঢ় হয়ে গিয়েছিল। তাই বলছি মিস্টার সেন, অজিত ভট্টাচার্যের মৃত্যুটা মামুলি মৃত্যু নয়, এর মধ্যে এক নিখুঁত রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু সে-রহস্যের চাবিকাঠি আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘হ্যাঁ, এই ড্রইংরুমের মধ্যে বাঁদিকের দরজাটার পাশের ওই সোফাটায় বসে মারা গিয়েছেন অজিতবাবু।’

‘আপনি এসে তাঁকে কী অবস্থায় দেখেছিলেন?’

‘বরুণবাবুর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ভেতরের ঘরে বসে আমি গল্পগুজব করছিলাম। সঙ্গে বরুণবাবু, তাঁর স্ত্রী প্রমীলা এবং তাঁর বান্ধবীরাও ছিলেন। বাইরের দিক থেকে কাউকে আসতে হলে এই ড্রইংরুম পার হয়ে যেতে হয়। আমরা হাসি-গল্পে মেতে ছিলাম। বরুণবাবু চাকর-বাকরদের সঙ্গে তদারক করছিলেন, সেজন্যে তিনি দীর্ঘক্ষণ বসতে পারছিলেন না, মাঝে-মাঝে তদারকির জন্যে তাঁকে উঠে যেতে হচ্ছিল, আবার এসে বসছিলেন। আমাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দিচ্ছিলেন। বরুণবাবুই প্রথম শুনতে পান একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ। ওইসময় তিনি ড্রইংরুম থেকে বসবার ঘরে আসবার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চাকরকে আর-একদফা লস্যি দেওয়ার কথা বলছিলেন। ”কী হল!”—বলে তিনিই প্রথম ড্রইংরুমের দিকে ছুটে গেলেন। আমরা উপস্থিত-সকলে তাঁর পেছনে-পেছনে গেলাম।’

‘গিয়ে কী দেখলেন, ইন্সপেক্টর?’

‘দেখলাম, ওই সোফাটায় বসা বা এলিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে রয়েছেন অজিতবাবু। চোখ দুটো উলটে যাচ্ছে, শরীর আড়ষ্ট, হাত-পা শক্তভাবে বেঁকে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করছে, যেন অনেক কিছু বলতে চেয়ে বলতে পারছেন না। শুধু একটা কথার অপভ্রংশ শুনতে পেলাম, ”—তুল।” ব্যস, ওই পর্যন্ত।’

‘তারপর?’

‘অজিতবাবুকে আমরা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেলাম। কারণ, শোনা গেল, এর আগে একবার তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল, তাই শুশ্রূষার প্রয়োজন। আমরা সবাই ড্রইংরুম থেকে চলে এলাম বরুণবাবুর শয়নকক্ষে। অজিতবাবুকে খাটে শুইয়ে দিলাম। বরুণবাবু এই আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে একজন ভালো ডাক্তার ডাকতে বললাম। বরুণবাবুর পারিবারিক চিকিৎসক হলেন ডাক্তার বি. কে. মিত্র। অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বরুণবাবু ড্রইংরুমে চলে গেলেন ডাক্তারকে ফোন করতে। কিন্তু অজিতবাবুর মৃত্যু রোধ করা গেল না। নাক দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরোল। ব্যস, অজিত ভট্টাচার্য এক্সপায়ার্ড।’

‘আসুন ইন্সপেক্টর, সিগারেট নিন। ও, আপনার কাছেই দেশলাই আছে! ওয়েল, ধরিয়ে নিন। আচ্ছা, এবার খুব ভালো করে চিন্তা করে দেখুন তো—ড্রইংরুমে, এই যে আমরা এখানে বসে রয়েছি, এই ড্রইংরুমে কোনও কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল? উঁহু, অত তাড়াতাড়ি করবেন না বন্ধু, খুব ভালো করে ভেবে দেখুন সেদিনের সন্ধের কথা। আপনি এলেন, গেলেন বসবার ঘরে, গল্পে মেতে গেলেন, বরুণবাবু আপনাদের মর্যাদা রক্ষার জন্যে নিজে ব্যস্তসমস্তভাবে কাজকর্ম দেখাশোনা করতে লাগলেন। তারপর সব আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে দিল এক আকস্মিক মৃত্যু।’

‘একটা জিনিস আমার খটকা লেগেছিল। আমি যখন এলাম তখন ড্রইংরুমের ডানদিকের দরজাটা খোলা ছিল। ওখান দিয়েই সকলে আসছে-যাচ্ছে দেখলাম। আগেই আপনাকে তো বলেছি মিস্টার সেন, বাইরে থেকে ড্রইংরুমে আসতে দু-পাশে দুটো দরজা পড়ে, একটা ডাইনে একটা বাঁয়ে। যখন অজিতবাবুকে ওই অবস্থায় পাওয়া গেল, সেসময় ডানদিকের দরজা বন্ধ ছিল, তার বদলে বাঁদিকের দরজাটা খোলা ছিল। বাইরের লোক এসে হয়তো ভিড় করতে পারে, এইজন্যে সেইসময় দরজাটা বরুণবাবু নিজের হাতেই বন্ধ করে দিলেন। তারপর সকলকে তাঁর শোওয়ার ঘরের দিকে এগোতে বলে আমার সাহায্যে বরুণবাবু অজিতবাবুকে সোফা থেকে তুলে নিলেন। একজন ভদ্রলোক বরুণবাবুকে সাহায্য করতে এলেন। বরুণবাবু তখন অজিতবাবুকে সেই ভদ্রলোক এবং আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে সকলের পেছনে-পেছনে এলেন।’

‘খটকা লাগার কথা কী যেন বলছিলেন…?’

‘ওই দরজার ব্যাপারটা।’

‘হুঁ। আচ্ছা, ভালো করে একবার এই ড্রইংরুমটা দেখতে চাই—কেউ যেন এখানে না আসে, বলে আসুন।—বলে এসেছেন তো, ওয়েল, ওঁদের সকলকে আমার আর-কিছুক্ষণ পরে প্রয়োজন হবে, ওঁরা অপেক্ষা করুন। ওঁরা অর্থে সেদিন ওইসময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন। এই দরজাটা খোলা ছিল তো, দরজায় দেখছি বেশ ভারী মোটা পাপোশ। হুঁ, আশ্চর্য, এটা কী? মেঝের ওপর এই চাকার মতো ধূসর দাগটা কীসের? মনে হচ্ছে, এখানে দীর্ঘদিন কিছু রাখা ছিল, সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে…।’

‘পেয়েছি হিমাদ্রিবাবু, এই যে, কোণের দিকে নটরাজের এই স্ট্যাচুটা, এটাই ওখানে বসানো ছিল দেখেছিলাম।’

‘আই সি, এই মূর্তিটা! বেশ বড় মূর্তি দেখছি, প্রায় আমার মাথার সমান, নাচের ভঙ্গিতে মহাদেব। মাথায় জটার মধ্যে থেকে ফণা তুলে রয়েছে একটা বিরাট সাপ। সাপের মুখটায় একটা গর্ত! দেখুন, দেখুন ইন্সপেক্টর, মূর্তিটা কিন্তু ফাঁপা—এই সাপটা পর্যন্ত! স্ট্রেঞ্জ!’

‘এটা তো পোর্সিলিনের মূর্তি। এগুলো ছাঁচে গড়া হয়। তাই ফাঁপা।’

‘মূর্তিটা ফাঁপা! মূর্তিটা ফাঁপা! সাপটা পর্যন্ত! আশ্চর্য! এই পাপোশ থেকে মাত্র হাতচারেক দূরে ধূসর দাগ। অর্থাৎ, মূর্তিটা দরজার পাপোশ থেকে মাত্র হাতচারেক দূরে ছিল, না ইন্সপেক্টর?… দেশলাইটা দিন, একটা সিগারেট ধরাই। থ্যাঙ্কস।’

‘ও কী মিস্টার সেন, হাত দিয়ে পাপোশটা তুলছেন কেন? ওটার তলায় তারের জালতি আছে, হাতে ফুটতে পারে, ধুলো আছে…।’

‘কিন্তু ধুলোর মধ্যে তারের আঁকড়ির সঙ্গে এটা কী বলতে পারেন, ইন্সপেক্টর?’

‘না। কিন্তু কী ওটা?’

‘তার আগে বলুন, এ-ঘরে কবে আপনি তালা লাগিয়েছেন?’

‘ঘটনার পরদিন সকালে।’

‘তাই এইটুকু প্রমাণ পেলাম, না হলে…।’

‘কিন্তু এটা দিয়ে কী হবে?’

‘এটার মধ্যেই সব লুকিয়ে আছে। কিন্তু আমি ভাবছি, আপনি কেমন সার্চ করলেন—এত বড় জিনিসটা রয়েছে, অথচ আপনার চোখে পড়ল না! হ্যাঁ, ইউ আর রাইট, এটা একটা রবারের নলের একমুখ ছেঁড়া অংশ। ড্রপারের পেছন দিকের মতো মোটা এর শেষাংশ এবং জোড়া—তারপর দেখুন কেমন সরু হয়ে গেছে, এই সরু দিকটা কেউ টেনে ছিঁড়েছে। কিন্তু আর নয়, এবার ওঁদের একে-একে ডাকুন।’

‘স্টেটমেন্ট নিয়ে কী সিদ্ধান্তে এলেন, মিস্টার সেন?’

‘বুঝলাম, মৃত অজিতবাবু অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন, অর্থও ছিল, মেয়েদের মন অক্লেশে জয় করার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল। আর বুঝলাম, এঁরা সবাই অজিতবাবুর বন্ধু হলেও তাঁর মৃত্যুতে কিন্তু কেউ আঘাত পাননি।’

‘আর কিছু?’

‘অতুল ফেরার নয়, সে খামখেয়ালি। হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, বেরিয়ে পড়েছে, বা তাকে কায়দা করে কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাওয়ায় সাহায্য ও অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে।’

‘তারপর?’

‘নিপুণ পরিকল্পনায় অজিতবাবুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু অতুল এ-কাজ করেনি।’

‘এ ছাড়া?’

‘এ-বাড়িতে অজিত প্রায়ই আসতেন, বরুণবাবুর বন্ধু। এ ছাড়াও আর-একটি সম্বন্ধ ছিল এঁদের মধ্যে। অজিতবাবু প্রমীলা দেবীর সঙ্গে বরুণের বিয়ে দিয়েছিলেন—প্রমীলা অজিতের আত্মীয়া।’

‘তারপর?’

‘এবার ইন্সপেক্টর, আপনার হাতকড়া বরুণ ব্যানার্জির হাতে পরিয়ে দিতে পারেন। অজিতকে বরুণবাবু হত্যা করেছেন।’

‘বিয়ের আগে থেকেই প্রমীলার সঙ্গে অজিতের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি যখন প্রমীলাকে প্রশ্ন করলাম অজিতের সম্পর্কে, তখন সে তাঁর রূপ, ব্যবহার, কৌলিন্য—সবকিছুরই ভূয়সী প্রশংসা করল। চোখে তার জল টলটল করে উঠল। প্রমীলার কাছে আসতেন অজিত। প্রমীলা তাঁর সব দিয়ে বসেছিল ওঁকে। বরুণের পৌরুষ এ-অন্যায় বরদাস্ত করল না। অতঃপর এই পরিণতি।’

‘ও, তাই সেদিন জাল পেতে বরুণবাবু ছটফট করছিলেন, সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। সেদিনের ওই ব্যস্ততার কারণ যে অন্য, বুঝতে পারিনি।’

‘এবার বুঝলেন তো, ”—তুল” অর্থে পুতুল চৌধুরী বা অতুল দাশ নয়। ওই পুতুল—নটরাজ। ওরই মধ্যে ফাঁদ পাতা ছিল। আগেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন বরুণবাবু। নিজের হাতে ডানদিকের দরজা বন্ধ করে পাহারায় রইলেন। অভ্যাগতরা সকলে ভেতরে বসবার ঘরে, যাতে কেউ ভুল না করে, সেদিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে অজিতের আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন বরুণবাবু। লন পার হয়ে অজিতকে আসতে দেখে সাবধানে বাঁদিকের দরজাটা খুলে সরে গেল সে। অজিত ঘরে ঢুকে পাপোশে পা দিলেন। পায়ের চাপ পাপোশে পড়তেই সেই চাপ রবারের সরু নল বেয়ে গিয়ে ধাক্কা দিল ওই পুতুলটার ভেতরে যে-বিষাক্ত গ্যাস সিলিন্ডার ছিল তার অভ্যন্তরে। অমনি এক ঝলক গ্যাস নলের অন্য মুখ দিয়ে ফোঁস করে বেরিয়ে এল। নটরাজের সাপের মুখ দিয়ে সোজা অজিতের মুখে গিয়ে পড়ল। সেকেন্ডের মধ্যে কাজ হয়ে গেল। বিষাক্ত গ্যাস তাঁর নাক দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে তাঁকে চিরদিনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিল।’

‘সত্যি, আশ্চর্য যন্ত্রটা! কৌশলটাও! মৃত্যুর সময়ও তিনি আমাদের সামনে, সুতরাং তাঁকে সন্দেহ করতেও সঙ্কোচ হচ্ছিল।’

‘যন্ত্রটায় আশ্চর্যের কিছু নেই। সেলুনে যেভাবে চুলে জল স্প্রে করে দেয়, যন্ত্রটা সেই ধরনের। এমনভাবে পেতেছিল যাতে পা পাপোশে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ।’

‘কিন্তু ওগুলো সরাল কখন?’

‘ফোন করতে গিয়ে। পুতুলটা সরিয়ে দিয়ে যন্ত্রটা ভেতর থেকে বের করে নিল। রবারের যে-নলটা পাপোশের তলা থেকে মেঝের ওপর দিয়ে গিয়ে পুতুলের মধ্যে ঢুকেছিল, সেটা টেনে পাপোশ থেকে বের করার সময় ছিঁড়ে যায়—খেয়াল করেননি বরুণ।’

‘ছোট্ট একটি ভুল!’

‘ও-ভুলটা যে ওঁকে করতেই হবে—না হলে যে অপরাধী কোনওদিন সাজা পেত না, ইন্সপেক্টর।’

‘রাইট ইউ আর। আই ডু রিয়ালাইজ, হিমাদ্রিবাবু।’

মাসিক রোমাঞ্চ

মার্চ, ১৯৭০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *