ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

বিলিতি বাঁশ

বিলিতি বাঁশ

হাজার পাঁচেক টাকায় আমি একটা বাঁশ কিনেছি।

সে কি মশাই, একটা বাঁশের দাম পাঁচ হাজার টাকা! কী বাঁশ?

বিলিতি বাঁশ। বাঁশের নাম রেফ্রিজারেটার। বাঁশ ভেবে কিনিনি। কিন্তু এখন বাঁশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে জানত আমি খাল কেটে কুমির এনেছি। তিন দিনের বাজার একদিনে ঘাড়ে করে এনে ঢুকিয়ে দেব। সকালের খাবার রাতে ফ্রিজ থেকে বেরিয়ে আসবে। আগুনে একটু নেড়েচেড়ে পাতে ফেল। ওদিকে টিভি চলছে। এদিকে চশমা চোখে গৃহিণী ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে ম্যাগাজিন পড়ছেন। পাপোশে সাদা মতো গোল বেড়াল। পাঁচ হাজার টাকায় তুমি সন্ধ্যার অফুরন্ত অবসর কিনে এনেছ। তুমি তো মার্টিন লুথার কিং হে। তিনি আমেরিকার নিগ্রো সম্প্রদায়ের মুক্তির জন্যে জীবন দান করেছিলেন, তুমি তোমার হার্ড-আর্নড পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে সংসারের এতকালের কৃতদাসত্বের অন্তত একবেলার জন্যে হাতা-খুন্তি-বেড়ির হাত থেকে মুক্ত করেছ। সকালে রাঁধো বিকেলে খাও। এবং কত কি খাও। বোতল-বোতল ঠান্ডা জল খেয়ে গালগলা ফুলিয়ে আট রকম সুরে স্টিরিও গলায় কথা বলো। ফাটা গলা কত বড় স্ট্যাটাস সিম্বল। কথায়-কথায় কেমন বলা যায়—আর বলো কেন ভাই, ঠান্ডা জল, না খেয়েও পারি না, খেলেও গলা নেয় না। হে হে মডার্ন ভাইস। তারপর ওই আইসক্রিম আর পুডিং। খেতে ভালো; কিন্তু পেট গরম হয়। ফ্রিজের ভাই ওই একটাই সুবিধে, রোজ সকালে ইডিয়েটের মতো বাজারে ছুটতে হয় না। অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় বেশ ওলট পালট খাওয়া যায় শুশুকের মতো। মাখম! নো মাখম প্রবলেম। ফ্রিজে ব্যাটা মহাজব্দ। গলে ঘি হবার উপায় নেই। সদাসর্বদাই টাইট যৌবন। সকালে ছুরি দিয়ে সেই হালকা হলুদ স্নেহ রুটির ওপর পুরু করে প্রলেপ দিয়ে, জ্যামের অঙ্গরাগে আরও মধুর করে মুখে ভরে ফ্যালো। ভুঁড়ি! নেভার মাইন্ড। বেল্ট আছে! হার্ট! ও তো এমনিও যাবে অমনিও যাবে! ফ্রিজে তিনদিন চমচম ফেলে রেখে ফোর্থডেতে বের করে খেয়ে দেখেছ! উ: সে এক একসপিরিয়েন্স মাইরি। কোথায় লাগে সুন্দরী রমণীর মুখ চুম্বন! এক এক টুকরো কেটে-কেটে মুখে পুরবে মনে হবে কে যে পটাপট তোমার মুখে কাথবার্টসন হার্পারের জুতো মারছে! ক্ষীরমোহন রাখতে পারো। রাখতে পারো বেশ বড় সাইজের রসগোল্লা। খেতে-খেতে মনে হবে তুমি প্যারাডাইসে ঊর্বশীর কোলে বসে-বসে নরম উল দিয়ে সোয়েটার বুনছ!

যাঁদের ফ্রিজ নেই তাঁদের কাছে এইসব কথা বললে মনটা বেশ হালকা হয় ঠিকই। পাঁচ হাজার উসুল হয় তিলে-তিলে। তবে কে জানত ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মতো ফ্রিজেরও একটা লোয়েস্ট ব্যালেন্স আছে। ফ্রিজকেও সাজিয়ে রাখতে হয়। লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে সেই কড়ি, একটা আয়না, লালচেলি, একটু সোনা রুপোর টুকরো রাখার মতো। বোতল-বোতল জল। তেমন খরচ নেই। যে লোকটি রোজ সকালে কাঁধে একটা বস্তা ফেলে শিশি আছে বোতল আছে হেঁকে যায় তাকে ডেকে একডজন সমান মাপের বোতল কিনে একটু স্টেরিলাইজ করে জল ভরো আর রাখো। খাও আর ভরো। ভরো আর খাও। সামান্য কায়িক পরিশ্রমেই কার্যোদ্ধার। কিন্তু তারপর আর যা-যা রাখতে হবে, যেন মেয়ের বাড়িতে জামাই ষষ্ঠীর তত্ব! আহা, ফ্রিজের লোয়েস্ট ব্যালেন্স ঠিক রাখতে গিয়ে ব্যাংকের লোয়েস্ট ব্যালেন্স ধরে টানাটানি।

এক ডজন ডিম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখতে হবে। ফ্রিজের ডিম। হাত দেওয়া চলবে না। দু বোতল স্কোয়াশ। ফ্রিজের স্কোয়াশ! খাওয়া চলবে না। আপেলের সময় আপেল, কমলালেবুর সময় কমলালেবু, সারি-সারি সাজিয়ে রাখতে হবে। কনডেনসড মিল্ক, মাখম, চিজ। দুটো মুরগির ঠ্যাং। এক চাকা মাটন। একটু মাছের টুকরো। প্রথামত ফ্রিজে, ফ্রিজের দাবি অনুযায়ী যা-যা রাখার রাখতেই হবে। যখন দরজাটি খুলবে টুক করে আলো জ্বলে উঠবে। সেই আলোতে ফ্রিজের জগৎ যেন পরিপূর্ণ দেখায়। ঠান্ডা হিমেল ধোঁয়া। সাদা বোতল, রঙিন বোতল, গোল-গোল ডিমের শুভ্রতা। নিহত মুরগির জমাট ঠ্যাং। কাশ্মীরি রমণীর গালের রঙ চুরি করা হিমসিক্ত আপেল। পয়সা নেই বললে চলবে না। ধার করে মেয়ের বিয়ে দেবার মত ফ্রিজও সাজাতে হবে। ও সব চালাকি চলবে না! অনেকে বাড়ি তৈরি করার পর কৌপিন পরে ঘুরে বেড়ান। রাতে জলপথ্যের ব্যবস্থা। কী করব ভাই বাড়ি করে পেনিলেস। সে পেনি আর ফিরে আসেও না। ওই ভাবেই ইনকমপ্টি বাড়ি থেকে সোজা চিতায়। সে তবু ক্ষমা করা যায়। তা বলে গড়ের মাঠ ফ্রিজ ঘরের কোণে শুভ্র মাহাত্ম্যে গড়ড় গড়ড় শব্দ করবে আর নির্ভেজাল জল পরিবেশন করবে তা তো হতে পারে না। খুললেই নানারকম মাল বেরোনো উচিত। এবং একটু বিলিতি-বিলিতি হওয়া চাই। পান্তা ভাত বেরোলে চলবে না। তবে ওই মালেরই বিলিতি সংস্করণ হুইস্কি বেরোলে, হ্যাঁ তুমি রিয়েলি ফ্রিজের মানুষ।

যাক যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বিয়ে করে বউকে যেমন ফেলা যায় না তেমনি পয়সা খরচ করে কেনা এই বিলিতি বাঁশকে তো আর ফেলা যাবে না। তিনি এখন গর্ভে নানারকম জিনিস ধারণ করে বসে আছেন। হলুদবাটা, সরষে বাটা, পাকা পটল, ঢেঁড়স। ন্যাবালাগা পাকা পেঁপে। উদ্বৃত্ত সেদ্ধ ডাল। আছে থাক। তবে একটা সমীক্ষা করে ফ্রিজ কেনা উচিত ছিল। যে পাড়ায় বাস সে পাড়ায় আর মাত্র দুটি বাড়িতে এই যন্ত্র আছে। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ একটু উগ্র মেজাজের। মাঝে মধ্যে ছুরি ছোরা চালিয়ে অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি তৈরি করে রেখেছেন। দ্বিতীয়টি আছে জনৈকা এয়ার হোস্টেসের ঘরে। ফলে মরেছি আমি। এর তার কাছে ফ্রিজের গর্ব ফলাতে গিয়ে স্বখাত সলিলে হাবুডুবু খাচ্ছি।

একদিন সকালে নিত্যানন্দ চার বোতল জল এনে হাজির।

কী খবর নিতু? সাত সকালেই জলের বোতল বগলে। সাপখোপ বেরোল বুঝি?

আজ্ঞে না কাকাবাবু। বাবার হার্টের অসুখ তো!

ও সেই হোমিওপ্যাথিক ওষুধ মিশিয়ে দিতে হবে বেলিসপেরিস!

আজ্ঞে না। এই চারটে বোতল আপনার ফ্রিজে রেখে যাব। একটু ঠান্ডা জল খেলে শরীর শীতল হবে। হার্টের ঝটরপটর ভাবটা ডাক্তার বলেছেন কমতে পারে। দুপুরে দু বোতল নিয়ে যাব, সন্ধেবেলা এক বোতল আর রাতে এক বোতল। আবার সকালে চারটে বোতল রেখে যাব। সামান্য ব্যাপার কাকাবাবু। অসন্তুষ্ট হচ্ছেন না তো! অসন্তুষ্ট হবার কী আছে বলুন? একজন হার্টের রুগি, একটু যদি ভালো থাকেন, কী বলেন? আচ্ছা আসি। বোতল চারটে রইল, কেমন। ঠিক করে রাখবেন, যেন বেশ ঠান্ডা হয়।

হরিদা এলেন। হাতে একটা মাখমের থান ইট।

বিমান ভায়া!

বলুন দাদা।

এটিকে যে তোমার ঠান্ডা মেশিনে আশ্রয় দিতে হবে। তোমার কৃপায় এইবার আমার ব্রেকফাস্ট প্রবলেমটা মিটল। ব্রেড অ্যান্ড বাটার এর চেয়ে ভালো খাবার এই বাজারে আর কী আছে বলো। সেই শীতকাল ছাড়া মাখম খাবার উপায় ছিল না। তুমি যে দেশের দশের কী উপকার করলে ভাই। তোমার কাছে কোথায় লাগে সেই আহম্মক পলিটিশ্যানরা। আসতে -আসতেই একটু নরম হয়ে এসেছে। কী পোড়া দেশে আমরা বাস করি দেখেছ! সাতটা মাসই গরম, হোয়্যার এজ ইউরোপ! ভাবতে পারো সাইবেরিয়া এখন সাতফুট বরফের তলায়। যাদের ভালো হয় তাদের সবই ভালো। ফুড, ওয়েদার, লিভিং। নাও এটাকে একটা ভালো জায়গায় রাখো। এবাজারে কটা লোক মাখম খেতে পারে। নেহাত তোমার পিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহের আশীর্বাদে চাকরিটা ভালো করি, তা ছাড়া তেমন অসংযমী নই। প্ল্যানড ফ্যামিলি। হ্যাঁ শোনো, পাছে তোমার মাখমের সঙ্গে আমারটা গুলিয়ে ফেলতে পারো ভেবে আমি এই র‌্যাপারের ওপর স্কেল ফেলে ফেল্ট পেন দিয়ে এক ইঞ্চি অন্তর লাইন টেনে রেখেছি। রোজ এক ইঞ্চি করে কেটে নিয়ে যাব। ছদিন চলবে। হিসেবের কড়ি বাঘে খাবার উপায় নেই। হে: হে: ব্বাবা।

কাকিমা!

কে রে!

আমি অর্চনা!

তোমার হাতে ওটা কীসের হাঁড়ি।

রসগোল্লা।

কী হবে? তোমার জন্মদিন। ও না, সেই পরীক্ষা পাশের আনন্দ। বাবা কতদিন পরে! ঠিক মনে আছে। না খাইয়ে ছাড়বে না। গন্ডারের গোঁ।

না কাকাবাবু। বাবা পাঠালেন ফ্রিজে রাখতে। কাল গোবরডাঙায় গিয়েছিলেন। মিষ্টি দেখলে তো আর জ্ঞান থাকে না, তার ওপর সস্তা দেখেছেন। চল্লিশটা আছে। রোজ দশটা করে বের করে নিয়ে যাব।

সেই রসগোল্লা। তৃতীয় দিন সকালে অর্চনার মা এলেন। দশট বের করার পরই গম্ভীর মুখে বললেন, কেমন হল?

আমার স্ত্রী বললেন, কী আবার হল?

আরও দশটা থাকার কথা, ছটা রয়েছে কেন? এই তো আমার হাতে দশ হাঁড়িতে ছয়। ষোলো কেন হবে, হবে তো কুড়ি। চারটে শর্ট।

তোমার হিসেব ভুল হচ্ছে হয়তো।

না, আমার হিসেব ঠিক আছে। হিসেবের কড়ি, বাঘে খেলেই বুঝতে পারব।

তার মানে তুমি বলছ আমরা খেয়েছি।

কিছু বলতে চাই না, তবে চারটে কম। এ বাজারে কাউকে বিশ্বাস নেই। সবকটাই নিয়ে যাই বাবা।

স্ত্রী জিগ্যেস করলেন আমাকে, তুমি খেয়েছ?

আমি? আমার না হাই সুগার। গোবরডাঙার ওই মাল-খেয়ে মরব নাকি। স্ত্রীর জেরা চলল। ছেলে খায়নি, মেয়ে খায়নি, যে কাজ করে শঙ্করী, সেও খায়নি। অর্চনার মা যেতে-যেতে বলল, তাহলে পিঁপড়ে খেয়েছে।

স্ত্রী আমার ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, এ তোমারই কাজ। মিষ্টি খাওয়া বন্ধ। সারাদিন ছোঁক-ছোঁক করো। মাঝরাতে উঠে মেরে দিয়েছ। ছি ছি লজ্জা করে না।

একেই বলে সব শালাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে শালাকে ধর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *