উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

বিপাশায় দুই মামা

বিপাশায় দুই মামা

‘লেখ! বিপাশা নদীর তীরে আমার পর্ণ কুটীরে…’

বড়মামা লেখক হবেন। আমাকে নিয়ে বসেছেন। বড়মামা বলে যাবেন আমি লিখে যাব। বড়মামার হাতের লেখা ভালো নয়। বাংলাও পড়া যায় না, ইংরিজিও পড়া যায় না। নামজাদা ডাক্তার। সারা দিনে শ’তিনেক প্রেসক্রিপশান লেখেন। সে-লেখা ওষুধের দোকানেই পড়তে পারে। তাও মাঝে মাঝে ভুল পড়ে ভুল ওষুধ দিয়ে দেয়। একবার জ্বরের ওষুধের বদলে জোলাপ দিয়ে দিয়েছিল। রোগী তিন জ্বরে পড়েছিল বিছানায়, শেষে গিয়ে শুল বাথরুমে। আশ্চর্য এই কেউ যার জ্বর নামাতে পারছিলেন না, তিনি একদিনে চাঙ্গা। সেই রোগী আবার ভারী, ওজনদার রাজনৈতিক নেতা। পকেটে সবসময় মাল বোঝাই একটা মেশিন থাকে। এমন কি জ্বরের সময়েও ছিল। বড়মামা পেট টিপে লিভার পরীক্ষার সময় সেইটাকেই টিপতে টিপতে বসেছিলেন, কি করে বাঁচবে, লিভারটা তো লোহা হয়ে গেছে। রোগী হাসতে হাসতে বলেছিল, ওটা লিভার নয়, লোডেড রিভলভার। লিভারটা তলায় আছে। সেই নেতা সুস্থ হয়ে বড়মামার সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করলেন মাধ্যমিকের কৃতী ছাত্রদের নিয়ে। বড়মামা আবার বক্তৃতায় বললেন, ‘তোমরা সমাজসেবী নেতা, আমাদের সকলের প্রিয় নাদুকে, যার ভালো নাম সূর্যকান্ত, সেই উদীয়মান সূর্যকে জীবনের আদর্শ করো। দেশের দশের সেবা করো।’ আমরা বাড়িতে বড়মামাকে সবাই চেপে ধরলুম, এটা কী হল? বড়মামা বললেন, ‘ভুল ওষুধে মরে যেতেও পারত। তখন কি হত! আমাদেরও ওর সঙ্গে স্বর্গে যেতে হত। একটু পিঠ চাপড়ে দিলুম আর কি! বুঝতে পারলি ব্যাপারটা! আর আমার পাওয়ারও একটু বেড়ে গেল।’

বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘পর্ণকুটীর লিখবি, না চালাবাড়ি লিখবি।’

‘বিপাশা নদীর তীরে চালাবাড়ি থাকতে পারে না। পর্ণকুটীরই থাকে।’

‘পর্ণকুটীর কাকে বলে রে?’

‘সে এক অসাধারণ সুন্দর, লতায়-পাতায় ঢাকা ফ্যান্টাসটিক ব্যাপার।’

‘তুই দেখেছিস।’

‘আমি কি করে দেখব, তবে ইন্টারনেটে হয়ত দেখা যেতে পারে।’

‘বিপাশা নদীটা কোথায় রে?’

‘আপনি দেখেন নি?’

‘আমি গঙ্গা, দামোদর, রূপনারায়ণ, কংসাবতী আর সুবর্ণরেখা দেখেছি।’

‘তাহলে যে-নদী দেখেন নি, সেই নদীর ধারে, যে-কুটীর দেখেন নি সেইকুটীরের কথা লিখছেন কেন?’

‘মিথ্যে ছাড়া গল্প হয় না। সত্যই যদি হবে তো গল্প বলবে কেন? তুই যদি গল্পে মাছের ঝোল খাচ্ছে পড়িস, তাহলে জানবি সেই ঝোলের ঝোল, আলু, পটল, পেঁপে, মশলা, মাছ সব মিথ্যে। এই যেমন ধর ভূত। সবই গল্পে, একদিনও সত্যি ভূত দেখেছিস?’

মেজোমামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘আমি ছবার দেখেছি, এই বাড়িতেই তিন বার।’ মেজোমামা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন, বসে বললেন, ‘সেনসেশানাল। গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যাবে।’

বড়মামা বললেন, ‘কি করা যাবে মেজো, ভূত যে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস আসে না আমার। ডাক্তারি পড়ার সময় কঙ্কাল নিয়ে ঘর করেছি আর কত যে মড়া কেটেছি!’

‘ভূত আলাদা জিনিস বড়দা। সে না দেখলে তোমার কোনও ধারণাই হবে না। যাই হোক, তোমাকে জোর করে কিছু বিশ্বাস করাতে চাই না। ভূত যদি কৃপা করে তাহলে হবে। তা, কি করছ এখন?’

‘গল্প লিখছি।’

‘সে কী, প্রেসক্রিপশান লেখা ছেড়ে দিয়ে গল্প!’

‘অবাক হবার কী আছে? ডাক্তাররাই বড় লেখক হয়। কোনান ডয়েল, বনফুল।’

‘কতটা লিখলে?’

‘সবে পেতেছি, এইবার ধীরে ধীরে বিছবো।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নে, কলম ধর। ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম। শতদ্রু নদীর ধারে…’

‘বিপাশা বলেছিলেন।’

‘বেশ, বিপাশা নদীর তীরে আমার পর্ণকুটীর। পাশেই সঙ্কীর্ণ মুনির আশ্রম। সেখানে সাতটি মৃগ ঘাস খাচ্ছে।’

‘ঘাস খাচ্ছে বলবেন? মৃগর সঙ্গে ঘাস যায় না।’

‘কি যায়?’

‘শষ্প।’

‘তা, তাই লেখ, শষ্প খাচ্ছে।’

মেজোমামা বললেন, ‘ওঃ প্রতিভার বাষ্প বেরচ্ছে। শষ্প খাচ্ছে!’

বড়মামা বললেন, ‘কেন, তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে? হরিণ ঘাস খায় না?’

মেজোমামা বললেন, ‘হরিণ অবশ্যই ঘাস খায়, তব মৃগ শষ্প খায় না, ভোজন করে।’

বড়মামা বললেন, ‘কেন? শষ্প কি এমন জিনিস যা ভোজন করতে হবে?’

মেজোমামা মুচকি হেসে বললেন, ‘এই তো বড়বাবু, সাহিত্যিক হওয়া কি এতই সহজ! প্রতিভা থাকা চাই। ভাষার ওপর দখল থাকা চাই। তুমি তো আবার কিছু শিখতে চাও না, তা না হলে আমি একটু সাহায্য করতে পারতুম।’

‘পারতে, তো পারো, হাত লাগাও।’

মেজোমামা বললেন, ‘হাত নয় মুখ লাগাচ্ছি। নে লেখ; বিপাশা নদীর তীরে আমার স্বর্ণকুটীরের পাশে সঙ্কর্ষণ মুনির সুরম্য আশ্রম সংলগ্ন সবুজ তৃণভূমিতে প্রসন্ন রৌদ্রাদ্ভাসিত সকালে একদল অতিসুন্দর মৃগ শষ্প ভোজনে নিরত ছিল।’

মেজোমামা হাসি হাসি মুখে বড়মামাকে বললেন, ‘কি বুঝলে?’

বড়মামা বললেন, ‘মালগাড়ি।’

‘মালগাড়ি মানে?’

‘বিশাল লম্বা। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, কমাও নেই ফুলস্টপও নেই। লেভেল ক্রসিং-এ আটকালে তবেই বোঝা যায় মালগাড়ি কত লম্বা। তবে হ্যাঁ, নামিয়েছিস ভালো। আর একটু এগো।’

মেজোমামা উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘নে লেখ, ঋষিপুত্র নির্বাণ বেদপাঠ করতে করতে বিপাশার দিকে তাকিয়ে দেখলে, ভরাপালে একটি নৌকা মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে। নৌকার ছইয়ে বসে অপূর্ব সুন্দর এক যুবক বাঁশি বাজাচ্ছে। পক্ষীর কলতান বংশীর সুরধ্বনিতে প্রভাতের বাতাস যেন রবীন্দ্রনাথ!’

বড়মামা বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মানে?’

এই দ্যাখো, বেসিক জিনিসটাই জান না, সাহিত্য করছ! রবীন্দ্রনাথ মানে কবিতা। আকাশে, বাতাসে, পাহাড়ে, পর্বতে, অরণ্যে, সমুদ্রে, হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ। কবিতা মানেই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের মানেই কবিতা। রবীন্দ্রনাথ কিছু পড়েছ?’

বড়মামা বিষণ্ণ মুখে বললেন, ‘না রে, পড়িনি তেমন, তবে শুনেছি। সেদিন উত্তরপাড়ায় একটা সভায় নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে একটা মেয়ে আবৃত্তি করছিল, পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল। আর আমি নিজে মাঝে মাঝে গাই, আমার মাথা নত রে দাও হে তোমার…।’

মেজোমামা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওতে হবে না। আগে রবীন্দ্রনাথ পড় তারপর কলম ধর। তবেই সৃষ্টি করতে পারবে কালজয়ী সাহিত্য।’

মাসিমা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এ ঘরে কটা পাখা? তিনটে। প্রত্যেকটার তিনটে করে ব্লেড। তার মানে মোট নটা। বড়দা আর মেজদা, এক একজনের ভাগে পড়ছে সাড়ে চারখানা।’

মেজোমামা বললেন, ‘সাড়ে চারখানা কি?’

‘সাড়ে চারখানা ব্লেড।’

বড়মামা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন, নিজেকেই নিজে বলছেন, ‘ভীষণ ক্রিটিক্যাল কেস। বাঁচবে না, তবু শেষ চেষ্টা, যমের মুখ থেকে, যমের মুখ থেকে…’ দরজার দিকে গুটি গুটি এগোচ্ছেন।

মাসিমা খপ করে হাতটা চেপে ধরে বললেন, ‘পালাচ্ছ কোথায়? আমার এ হাত যম এলেও ছাড়াতে পারবে না।’

মেজোমামা দর্শনের অধ্যাপক। তিনিও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন, নিজেকেই নিজে বলছেন, ‘কিরকেগারের বইটা এখানে নেই, না? দেখি ছাতের ঘরে।’

মাসিমা খপ করে আর এক হাতে মেজোমামাকে ধরেছেন, ‘এটা আরও বেশি শয়তান। কিরকেগার, ছাদের ঘরে ধুলো ছাড়া কিছুই নেই।’

মাসিমা আমাকে বললেন, ‘যা, ঘড়াঞ্চিটা নিয়ে আয়। পুজো এসে গেল পাখার ছিরি দেখ।’

ঘড়াঞ্চি এল। সেটাকে ফিট করা হল একটা পাখার নীচে।

মাসিমা বললেন, ‘আগে বড়দা উঠবে, মেজদা ধরে থাকবে। ঘড়াঞ্চির ঠ্যাং যেন হড়কে না যায়। এরপর মেজদা উঠবে, বড়দা ধরবে। আর তুই থাকবি পাহারায়। ঘুষ খাবি না।’

মেজোমামা বললেন, ‘ও ডাক্তার, ঝাড়পোঁছ ওর আসে, কুসি! আমি যে দার্শনিক!’

মাসিমা বললেন, ‘শুধু দর্শন করলে হবে? ঝাড়পোঁছ কে করবে? পড়ো নি, ক্লিনলিনেস ইজ গডলিনেস। এই কাজ বেকার হবে না। গঙ্গার ইলিশ এসেছে এক জোড়া। প্রত্যেকে চারপিস। সঙ্গে ডিম। আমি রাঁধতে যাচ্ছি, একটু পরেই গন্ধ পাবে। সিলিং-এর কাছে আরও বেশি পাবে। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হয়। পরনির্ভর হলে চলে না।’

মাসিমা বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন আমাকে, ‘তুই পাহারায় থাকবি। ফাঁকি দিলেই আমাকে রিপোর্ট করবি।’

কিছু দূর গিয়ে মাসিমা আবার ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শোন পিন্টু। এরা দরজা বন্ধ করে তোকে দিয়ে কাজটা করাতে চাইবে। খুব সাবধান! দরজাটা খোলাই থাকবে। আমি এক একবার এসে দেখে যাব।’

মাসিমা চলে যেতেই মেজোমামা বললেন, ‘সাঙ্ঘাতিক মহিলা, মনের কথা টের পায়।’

বড়মামা বললেন, ‘কেন, তুই ওইরকম কিছু ভাবছিলিস বুঝি?’

মেজোমামা বললেন, ‘না, না, আমি ভাবব কেন! ভাবছিল আমাদের ভাগনে, আহা, মামারা কেন কষ্ট করবে! এ আর কি এমন ব্যাপার আমিই করে দি।’

বড়মামা বললেন, ‘আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস, বিপাশা নদীতে ডুব মারি।’

আমাদের পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ান বিশুদা সঙ্গে তাঁর অ্যাসিটেন্টকে নিয়ে ঢুকলেন, ‘ডাক্তারবাবু, নমস্কার। মেজদা নমস্কার। ঘরটা যে একটু ছাড়তে হবে। পাখার ব্লেড পরিষ্কার করবে।’

‘অ্যাঁ, এই যে বললে আমাদের করতে হবে।’

‘ওই তো! দিদির জবাব নেই। আমাকে বললেন, যাও দেখ গে যাও, দুটোর মাথায় পাখা ভেঙে পড়েছে। হে হে হে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *