বিজ্ঞাপন বিভ্রাট
১
নবীন ব্যারিস্টার নন্দলাল তাহার আমর্হাস্ট স্ট্রীটের ক্ষুদ্র বাসাবাড়ির সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিল এবং সিগারের প্রভূত ধূমে ঘরটি প্রায়ই অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছিল। বেলা প্রায় সাড়ে সাতটা, এমন সময় বন্ধু প্রমথনাথ ঘরে ঢুকিয়াই অতি কষ্টে কাশি চাপিতে চাপিতে বলিল, “পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ। তুমি ঘরে আছ, ধোঁয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঃ, ঘরটা এমন অগ্নিকুণ্ড করে বসে আছ কি করে?’
নন্দ হাতের কাগজখানা ফেলিয়া প্রফুল্লস্বরে কহিল, ‘আমি তোমার মতো বিলেত ফেরত সন্ন্যাসী নই যে, চুরুটটা পর্যন্ত ত্যাগ করতে হবে।’
প্রমথ একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বলিল, ‘তুমিই সন্ন্যাসী নামের বেশী উপযুক্ত। গাঁজার মতো চুরুটগুলো খেয়ে খেয়ে ইহকাল পরকাল দুই নষ্ট করলে।’
নন্দ হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘রাগ করলে ভাই? আমি কিন্তু তোমাকে গাঁজাখোর সন্ন্যাসীর সঙ্গে তুলনা করিনি।’
নন্দ এবং প্রমথর বন্ধুত্ব আশৈশব দীর্ঘ না হইলেও ঘটনাচক্রে পরস্পরের প্রতি গাঢ় স্নেহবন্ধন অটুট হইয়া পড়িয়াছিল। নন্দ দোহারা, খুব বলবান্, চোখে চশমা। রং ময়লা। মুখে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দৃঢ়তার এমন একটি সুন্দর সমাবেশ ছিল যে, খুব সুশ্রী না হইলেও তাহাকে সুপুরুষ বলিয়া বোধ হইত। প্রমথনাথ ফর্সা ছিপছিপে যুবক, মুখে লালিত্যের বেশ একটা দীপ্তি আছে। তার স্বভাবটি বড় নরম—দুর্বল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কাহারও কোনও অনুরোধে ‘না’ বলিবার ক্ষমতা তাহার একেবারেই নাই।
বহু ধনদৌলতের একমাত্র উত্তরাধিকারী প্রমথ বিলাত গিয়া ব্যারিস্টারি পাস করিয়া আসিয়াছিল। বিলাত পৌঁছিয়া সে প্রথম বাঙালীর মুখ দেখিল নন্দর। নন্দর বিলাত যাওয়ার ইতিহাসটা কিছু জটিল। সে গরিবের ছেলে, প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করিবার পর দেখিল, কলেজে পড়িবার মতো সংস্থান নাই। আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হইবার প্রবৃত্তি ছিল না। অথচ বিলাতে গিয়া উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র অভিলাষ ছিল।
এক দিন সে এক বিলাতযাত্রী জাহাজে খালাসী হইয়া বিলাত পলায়ন করিল। সেখানে পৌঁছিয়া পেটের দায়ে কুলির কাজ আরম্ভ করিয়াছিল। ভাগ্যদেবী নবাগত প্রমথর মালগুলা নন্দর ঘাড়ে চাপাইতে গিয়া নন্দকেই প্রমথর ঘাড়ে চাপাইয়া দিলেন। প্রমথ ও নন্দ উভয়েই তখন নিতান্ত ছেলেমানুষ। নির্বান্ধব বিদেশে পরস্পরকে পাইয়া তাহারা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইল। প্রমথর টাকায় নন্দও আইন পড়িতে আরম্ভ করিল।
তারপর দুই জনে ব্যারিস্টারি পাস করিয়া দেশে ফিরিয়াছে। নন্দ ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছে, বেশ দুই পয়সা উপার্জনও করিতেছে। প্রমথ প্রায় নিষ্কর্মা; খবরের কাগজ পড়িয়া, দেশনীতি আলোচনা করিয়া এবং সময়ে অসময়ে বন্দুক ঘাড়ে বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইয়া যৌবনকালটা অপব্যয় করিয়া ফেলিতেছিল।
প্রমথ আবার আরম্ভ করিল, ‘তুমি ঐ সিগার খাওয়া কবে ছাড়বে বল দিকি?’
নন্দ বলিল, ‘যমরাজা বেশী জিদ করলে কি করব বলতে পারি না, তবে তার আগে তো নয়।’
প্রমথ বলিল, ‘তার আগে ছাড় কি না দেখা যাবে। এক ব্যক্তির শুভাগমন হলেই তখন ছাড়তে পথ পাবে না।’
নন্দ বলিল, ‘ইঙ্গিতটা বোধ হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ গৃহিণীর সম্বন্ধে। তা তিনি কি যমরাজের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবেন না কি?’
প্রমথ বলিল, ‘অন্তত যমরাজের চেয়ে তাঁদের ক্ষমতা বেশী, তার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে।’
নন্দ কহিল, ‘সেইজন্যই তো আমি এই ক্ষমতাশালিনীদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করবার বাসনা মোটেই নেই।’
প্রমথ ভ্রূ তুলিয়া বলিল, ‘অর্থাৎ বিয়ে কর্চ্ছ না?’
নন্দ উৎফুল্ল তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল, ‘নাঃ।’
প্রমথ কহিল, ‘এটা তো নতুন শুনছি। কারণ জানতে পারি কি?’
নন্দ বলিল, ‘বিয়ে জিনিসটা একদম পুরোনো হয়ে গেছে। ওতে আর রোমান্সের গন্ধটি পর্যন্ত নেই।’ বলিয়া প্রসঙ্গটা উড়াইয়া দিবার মানসে খবরের কাগজখানা আবার তুলিয়া লইল।
প্রমথ বলিল, ‘নন্দ ভাই, ওইখানেই তোমার সঙ্গে আমার গরমিল। বিয়েটাই এ পৃথিবীতে নববর্ষের পাঁজির মতো একমাত্র নতুন জিনিস—আর যা কিছু, সব দাগী, পুরোনো, বস্তাপচা।’
নন্দ প্রত্যুত্তরে কাগজখানা প্রমথর গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, ‘তার প্রমাণ এই দেখ না। বিয়ে জিনিসটা এতই খেলো হয়ে গেছে যে, কাগজে পর্যন্ত তার বিজ্ঞাপন!’
প্রমথ নিক্ষিপ্ত কাগজখানা তুলিয়া লইয়া মনোনিবেশপূর্বক পড়িতে লাগিল।
নন্দ বলিল, ‘তর্ক করে হাঁপিয়ে উঠেছ, এক পেয়ালা চা খাও। এখনও আটটা বাজেনি। বাড়ি গিয়ে নাইতে খেতে তোমার তো সেই একটা।’
প্রমথ কোনও জবাব দিল না, নিবিষ্ট-মনে পড়িতে লাগিল। নন্দ বেয়ারাকে ডাকিয়া বলিল, ‘দিদিকো দো পেয়ালা চা বানানে বোলো।’
এইখানে বলিয়া রাখা ভাল যে, প্রমথ পূর্বে চা খাইত না, কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি অভিনব আকর্ষণে সে চা ধরিয়াছে।
খবরের কাগজখানা পড়িতে পড়িতে প্রমথ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল, তারপর সেখানা জানুর উপর পাতিয়া বলিল, ‘ওহে, শোনো একটা বিজ্ঞাপন’, বলিয়া পড়িতে লাগিল, ‘Wanted a young Barrister bridegroom for a rich beautiful and accomplished Baidya girl. Girl’s age sixteen. Apply with photograph to Box 1526.’ পাঠ শেষ করিয়া কাগজখানা দ্বারা নন্দর জানুর উপর আঘাত করিয়া বলিল, ‘ব্যস, বুঝলে হে ব্যারিস্টার ব্রাইডগ্রুম, একটা দরখাস্ত করে দাও, খুব রোমান্টিক হবে।’
নন্দ বলিল, ‘আমি এখানে একমাত্র ব্রাইডগ্রুম নই। শ্রীমান প্রমথনাথ সেন মহাশয়ই এই ষোড়শীর উপযুক্ত পাত্র বলে মনে হচ্ছে।’
প্রমথ হাসিয়া প্রতিবাদ করিল, ‘কিছুতেই না। নন্দলাল সেনগুপ্ত থাকতে প্রমথনাথ সে দিকে কোনমতেই দৃষ্টিপাত করতে পারেন না।’
নন্দ একটা কপট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘তবে থাক্, কারুর দৃষ্টিপাত করে কাজ নেই। আর কোনও ভাগ্যবান্ ব্যারিস্টার এই তরুণীকে লাভ করুক।’
প্রমথ জিদ ধরিয়া বলিল, ‘না না, এসো না, একটু মজাই করা যাক! তারপর তোমার দরখাস্ত যে মঞ্জুর হবে, তারই বা ঠিক কি?’
নন্দ বলিল, ‘বেশ, যদি দরখাস্ত করবারই ইচ্ছে হয়ে থাকে, নিজেই কর।’
প্রমথ একটু চকিত হইয়া বলিল, ‘না, তা কি হয়? তুমি কর।’
নন্দ বলিল, ‘বাঃ, এ তোমার বেশ বিচার! মজা করবে তুমি, আর ফ্যাসাদে পড়ব আমি?—আচ্ছা, এস, এক কাজ করা যাক—লটারি কর, যার নাম ওঠে।’
মজা করিবার ইচ্ছা আর প্রমথর বেশী ছিল না; কিন্তু সেই প্রথমে আগ্রহে দেখাইয়াছে, অতএব অনিচ্ছার সহিত সম্মত হইল। তখন দু’ টুকরো কাগজে দু’জনের নাম লিখিয়া একটা হ্যাটের তলায় চাপা দেওয়া হইল। নন্দ হ্যাটের তলায় হাত ঢুকাইয়া একটা কাগজ বাহির করিয়া নাম পড়িয়াই উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া সপদদাপে বলিল, ‘ভাগঃ ফলতি সর্বত্রং ন বিদ্যাং ন চ পৌরুষং—হে ভাগ্যবান্, এই দেখ’ বলিয়া কাগজখানা তুলিয়া ধরিয়া নামটা দেখাইল।
প্রমথ বিকলভাবে একটু হাসিয়া বলিল, ‘নিজের নাম না ওঠায় এতদূর বিমর্ষ হয়ে পড়েছ যে, সংস্কৃত ভাষাটার উপরও তোমার কিছুমাত্র মমতা নেই দেখছি।’
এবার নন্দ উৎসাহের তাড়নায় কাগজ-কলম লইয়া বলিল, ‘আর দেরি নয়, দরখাস্ত লিখে ফেলা যাক। বাঙলায় না ইংরিজিতে?’
প্রমথর উদ্যম একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, সে ম্রিয়মাণভাবে বলিল, ‘না, ইংরিজিতে কাজ নেই, আবার humble petition…Most respectfully shewenth লিখে ফেলবে। বাঙলাই ভাল।’
নন্দ তাহার যৎকিঞ্চিৎ বাঙলার সাহায্যেই দরখাস্ত লিখিয়া ফেলিল,—
‘মহাশয়,
আমি ব্যারিস্টার, বিজ্ঞাপনে বর্ণিত কন্যাকে বিবাহ করিতে চাহি।
ইতি।
শ্রীপ্রমথনাথ সেন।’
দরখাস্ত শুনিয়া প্রমথ বলিল, ‘এক কাজ করলে হয় না? নামটা উপস্থিত বদলে দেয়া যাক, তাহলে রোমান্স জমবে ভাল।’ কোনও উপায়ে এই বিজ্ঞাপনের হাত হইতে আত্মরক্ষা করিতে পারিলে এখন সে বাঁচে।
নন্দ রাজি হইয়া বলিল, ‘বেশ, কি নাম বল?’
প্রমথ বলিল, ‘ঐ অর্থেরই অন্য কোনও নাম।’
নন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ‘প্রমথ কথাটার মানে কি হে?’
এমন সময় দুই হাতে দু’ পেয়ালা চা সাবধানে ধরিয়া একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকিল। পাতলা ছিপ্ছিপে, সুশ্রী সুগঠন দেহ; একবার দেখিলেই বেশ বোঝা যায়,—নন্দর বোন। নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি-শেমিজ পরা—পায়ে জুতা নাই। অমিয়া এখনও অবিবাহিতা। নন্দ বিলাত হইতে ফিরিবার অনতিকাল পরে তাহার বাপ-মা দু’জনেই মারা গিয়াছিলেন—এখন অমিয়াই তাহার একমাত্র রক্তের বন্ধন।
উপস্থিত প্রসঙ্গটার মাঝখানে অমিয়া আসিয়া পড়ায় প্রমথ মনে মনে বিব্রত ও লজ্জিত হইয়া উঠিল। নন্দ পূর্ববৎ স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করিল, ‘প্রমথ কি প্রেমসংক্রান্ত কোনও কথা না কি?’
অমিয়া চায়ের পেয়ালাদুটি সবেমাত্র টেবিলের উপর রাখিয়াছিল। ভাষা সম্বন্ধে দাদার প্রগাঢ় অজ্ঞতা দেখিয়া সে হাসি সামলাইতে পারিল না। কিন্তু হাসিয়া ফেলিয়াই অপ্রস্তুতভাবে বলিয়া উঠিল, ‘বাঃ দাদা—’
নন্দ অর্বাচিীনের মতো ভণিনীকে প্রশ্ন করিল, ‘অমিয়া, তুই জানিস, প্রমথ কথার মানে?’
অমিয়া আড়চোখে একবার প্রমথর মুখখানা দেখিয়া লইয়া মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতে লাগিল।
প্রমথ লজ্জার সঙ্কটে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, ‘প্রমথনাথের বদলে ভূতনাথ হতে পারে।’
শব্দটির প্রকৃত অর্থ বুঝিতে পারিয়া নন্দ কিছুক্ষণ উচ্চরবে হাসিয়া লইল। তারপর দরখাস্ত হইতে প্রমথনাথ কাটিয়া ভূতনাথ বসাইয়া দিল।
ব্যাপার কি বুঝিতে না পারিয়া অমিয়া কৌতূহলের সহিত দরখাস্তখানা নিরীক্ষণ করিতেছিল। প্রমথ বেচারা এতই বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিল যে, এক চুমুক গরম চা খাইয়া মুখ পুড়াইয়া ‘উঃ’ করিয়া উঠিল। চকিতে ফিরিয়া অমিয়া বলিল, ‘বড্ড গরম বুঝি—?’
অধিকতর লজ্জায় ঘাড় নাড়িয়া প্রতিবাদস্বরূপ প্রমথ আর এক চুমুক চা খাইয়া ফেলিল এবং এবার মুখের দাহটাকে কোনও মতেই উর্ধস্বরে প্রকাশ করিল না।
নন্দ বলিল, ‘ফটোর কি করা যায়? তোমার ফটো একখানা আছে বটে আমার কাছে—’ বলিয়া ঘরের কোণের একটি ছোট টিপাই-এর উপর হইতে অ্যালবামখানা তুলিয়া লইল। অমিয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল এবং দরজা পার হইয়াই তাহার দ্রুত পলায়নের পদশব্দ ফটো-অনুসন্ধাননিরত নন্দর কানে গেল না।
নন্দ অ্যালবাম ভাল করিয়া খুঁজিয়া বলিল, ‘কৈ, তোমার ছবিখানা দেখতে পাচ্ছি না! গেল কোথায়?’
পলাতকার পদধ্বনি যে শুনিয়েছিল, সে আরক্ত কর্ণমূলে বলিল, ‘আছে কোথাও—ওইখানেই—’
নন্দ বলিল, ‘না হে, এই দেখ না, জায়াগাটা খালি—’ তারপর গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘অমিয়া—অমিয়া—’
প্রমথ তাড়াতাড়ি ব্যাকুলভাবে বলিল, ‘দরকার কি নন্দ, তোমার একখানা ছবিই দিয়ে দাও না!’
নন্দ কিছুক্ষণ প্রমথর মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া সহাস্যে বলিল, ‘তোমার মতলব কি বলতো? এ যে আগাগোড়াই জুচ্চুরি! শেষে আমার ঠ্যাং-এ দড়ি পড়বে না তো?’
প্রমথ বলিল, ‘না না, কোনও ভয় নেই। এখন ফটোখানা দিয়ে দাও, তারপর বিয়ে না হয় না কোরো।’
নন্দ নিজের একখানা ফটো খামের মধ্যে পুরিয়া বলিল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত হতে পার, বরকর্তার পদটা আমিই গ্রহণ করলুম। যা কিছু কথাবার্তা আমিই করব।’ বলিয়া চিঠিতে নিজের ঠিকানা দিয়া খাম বন্ধ করিয়া চা-পানে মনোনিবেশ করিল।
২
দিন পনেরো পরে প্রমথ নন্দর বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল।
‘কি হে, কি খবর?’
নন্দ একরাশি ধূম উদিগরণ করিয়া বলিল, ‘খবর সব ভাল। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে?’
প্রমথ বলিল, ‘ময়ূরভঞ্জে গিয়েছিলুম ভাল্লুক শিকার করতে।’
নন্দ বলিল, ‘আমাকে একটা খবর দিয়ে গেলেই ভাল করতে। তা সে যাক্, এদিকে সব ঠিক।’
প্রমথ জিজ্ঞাসা করিল, ‘সব ঠিক? কিসের?’
নন্দ প্রমথর নির্দোষ স্কন্ধের উপর এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিল, ‘কিসের আবার? তোমার বিয়ের।’
প্রমথ আকাশ হইতে পড়িল, ‘আমার বিয়ের? সে আবার কি?’
বস্তুত সেদিনকার বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা প্রমথর বিন্দুবিসর্গও মনে ছিল না। বিস্মৃতির আনন্দে সে এই কটা দিন ময়ূরভঞ্জের জঙ্গলে দিব্য নিশ্চিন্তমনে কাটাইয়া দিয়াছে। তাই নন্দ যখন নিতান্ত ভাবলেশহীন বৈজ্ঞানিকের মতো তাহার মধ্যাকাশে মস্ত একটা ধূমকেতু দেখাইয়া দিল, তখন প্রমথ ভয়ব্যাকুলের মতো বসিয়া পড়িল। নন্দ স্বচ্ছন্দে বলিতে লাগিল, ‘সবই ঠিক করে ফেলা গেছে। মেয়ে দেখা, এমন কি, আশীবাদ পর্যন্ত। মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী হে; এবং শিক্ষিতা, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। মেয়ের বাপ বেশ আলোকপ্রাপ্ত লোক। কোনও রকম কুসংস্কারের বালাই নেই। মেয়েটির নাম সুকুমারী।’
প্রমথ অস্থির হইয়া বলিল, ‘আমি এই ক’দিন ছিলুম না, আর তুমি সব গোল পাকিয়ে বসে আছ?’
নন্দ বলিল, ‘তুমি না থাকায় বড় অসুবিধায় পড়া গিয়েছিল। অগত্যা তোমার হয়ে আশীর্বাদটাও আমি গ্রহণ করেছি। কন্যাপক্ষের এখনও ধারণা যে, আমিই বর। সে ভুল ভাঙবে একেবারে বিয়ের রাত্রে।’
প্রমথ ব্যাকুলস্বরে বলিল, ‘ভাই, সবই যখন তুমি করলে, তখন বিয়েটাও কর। আমায় রেহাই দাও।’
নন্দ ফিরিয়া বলিল, ‘কি রকম? তখন নিজে কথা দিয়ে এখন পেছুচ্ছ? কিন্তু তা তো হতে পারে না। সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে—এই ৭ই বিয়ের দিন।’
প্রমথ রাগ করিয়া বলিল, ‘কেন তুমি আমায় না জানিয়ে সব ঠিক করে বস্লে?’
নন্দ বলিল, ‘এ তোমার অন্যায় কথা। তখনই আমি তোমায় বলে দিয়েছিলুম।’
প্রমথ বলিল, ‘বেশ, যা হয়ে গেছে যাক, এখন তুমিই বিয়ে কর।’
দৃঢ়স্বরে নন্দ বলিল, ‘কখনই না। তোমার জন্যে পাত্রী স্থির করে তাকে নিজে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
প্রমথ বলিল, ‘তাহলে আমিও নিরুপায়।’
নন্দ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ আমি এখন বিয়ে করতে পারব না।’
‘তুমি চাও চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমি জেলে যাই?’
প্রমথ রাগিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘জেলে যাওয়াই তোমার উচিত। তাহলে যদি একটু কাণ্ডজ্ঞান হয়।’ বলিয়া হন্-হন্ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
নন্দ চেঁচাইয়া বলিল, ‘মনে থাকে যেন, ৭ই বিয়ে—গোধূলি লগ্নে। নিমন্ত্রণপত্র আজই আমি ইসু করে দিচ্ছি।’
প্রমথ যতই রাগ করিয়া চলিয়া আসুক না, দোষ যে নন্দর অপেক্ষা তাহারই বেশী, তাহা সে মর্মে মর্মে অনুভব করিতে লাগিল এবং এই গুরুতর দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে অশেষভাবে লাঞ্ছিত করিতেও ত্রুটি করিল না। এক ধরনের লোক আছে—যদিও খুব বিরল—যাহারা নিজের দোষ সবচেয়ে বড় করিয়া দেখে এবং নিজের লঘু পাপের উপর গুরুদণ্ড চাপাইয়া দেয়, যাহার হয়তো কোনই প্রয়োজন ছিল না। আত্মলাঞ্ছনা শেষ করিয়া প্রমথ নিজের উপর এই কঠিন দন্ডবিধান করিল যে, মন তাহার এ বিবাহের যতই বিপক্ষে হউক না কেন, বিবাহ তাহাকে করিতেই হইবে। ইহাই তাহার মূঢ়তার উপযুক্ত দণ্ড। তাছাড়া নন্দ যখন একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, তখন তাহাকে পাঁচজনের সম্মুখে অপদস্থ করা যাইতে পারে না। না—কোনও কারণেই নহে।
বিবাহের দিন যথাসময়ে আসিতে বিলম্ব করিল না, এবং সে দিন সন্ধ্যাবেলা প্রমথকে বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবৃত করিয়া বরকর্তা নন্দলাল মোটর আরোহণে বিবাহস্থলে উপস্থিত হইতেও বিলম্ব করিল না। প্রমথ ইচ্ছা করিয়াই কোনও রকম সাজসজ্জা করে নাই—মুখ ভারি করিয়া বসিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া বর বলিয়া মনেই হয় না। বরং নন্দ বরকর্তা বলিয়া বেশের বিশেষ পরিপাট্যসাধন করিয়া আসিয়াছিল। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে সেই বর বলিয়া প্রতীয়মান হইল।
কন্যার পিতা ল্যান্সডাউন রোডে বাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। সেইখানেই বিবাহ। বরপক্ষ সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। চিৎকার, হাঁকাহাঁকি, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মধ্যে কন্যাকর্তা তাড়াতাড়ি বরকে নামাইয়া লইতে ছুটিয়া আসিলেন। নন্দ তখন নামিয়া পড়িয়াছে—প্রমথ গোঁজ হইয়া গাড়ির মধ্যে বসিয়া আছে। সে মনে মনে ভাবিতেছে, যাঁহার কন্যাকে সে বিবাহ করিতেছে, তাঁহার নামটা পর্যন্ত সে জানে না—জানিবার দরকারও নাই। কোনও রকমে এই পাপ-রাত্রি কাটিলে বাঁচা যায়। তারপর, পরের কথা পরে ভাবিলেই চলিবে।
হঠাৎ অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বরে সচকিত হইয়া প্রমথ তাকাইয়া দেখিল, তাহারই মাতুল প্রমদাবাবু সাদরে নন্দর বাহু ধরিয়া বলিতেছেন, ‘এস বাবা, এস।’
প্রমথর মনের মধ্যে সন্দেহের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘এ কি মামা, তুমি?’
প্রমদাবাবু ফিরিয়া প্রমথকে দেখিয়া বলিলেন, ‘এ কি প্রমথ, তুইও বরযাত্রী না কি? কোথায় ছিলি এত দিন? খুঁজে খুঁজে হয়রান, কোথাও সন্ধান না পেয়ে শেষে চিঠি লিখে রেখে এলুম। চিঠি পেয়েছিলি তো?’
প্রমথ উত্তেজিত স্বরে বলিল, ‘কোন্ চিঠি?’
‘সুকুর বিয়ের নেমন্তন্ন চিঠি।’
হায় হায়! ময়ূরভঞ্জ হইতে ফিরিবার পর প্রমথ একখানা চিঠিও খুলিয়া দেখে নাই।
এই সময়টার জন্যই নন্দ অপেক্ষা করিতেছিল। সে সহাস্যমুখে সকলের দিকে ফিরিয়া বলিতে আরম্ভ করিল, ‘দেখুন, একটা ভুল গোড়া থেকেই হয়ে এসেছে, এখন তার সংশোধন হওয়া দরকার। আজ বিবাহের বর—’
প্রমথ মোটর হইতে লাফাইয়া নন্দর হাত সজোরে চাপিয়া ধরিল; বলিল, ‘নন্দ, চুপ কর। একটা কথা আছে, শুনে যাও।’ বলিয়া তাহাকে টানিতে টানিতে অন্তরালে লইয়া গেল। কন্যাপক্ষীয় এবং বরপক্ষীয় সকলেই অবাক্ হইয়া রহিল।
প্রমথ বলিল, ‘তুমি একটা আস্ত গাধা। করেছ কি! সুকু যে আমার বোন হয়! প্রমদাবাবু আমার সাক্ষাৎ মামা।’
নন্দ হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। প্রমথ হাসিয়া বলিল, ‘হাঁ করলে কি হবে? এখন চল, ভগিনীকে উদ্ধার কর। কেলেঙ্কারী যা করবার, তা তো করেছ। এখন মামার জাতটাও মারবে?’
নন্দ এমনই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল যে, বিবাহ শেষ না হইয়া যাওয়া পর্যন্ত একটি কথাও বলিতে পারে নাই। সম্প্রদানের সময় বরের নাম লইয়া একটু গোলমাল হইয়াছিল, কিন্তু তাহা সহজেই কাটিয়া গেল। প্রমথ বুঝাইয়া দিল যে, নন্দর ডাকনাম ভূতো।
বিবাহ চুকিয়া গেলে প্রমথ নন্দকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হে, বিয়েটা রোমান্টিক বোধ হচ্ছে তো?’
নন্দ বলিল,‘হুঁ। কিন্তু তোমাকে বঞ্চিত করে ভাল করিনি, এখন বোধ হচ্ছে।’
‘বটে—কেন?’
‘কি জানি যদি আবার পরে দাবি করে বস!’
প্রমথ কৃত্রিম কোপে ঘুষি তুলিয়া বলিল, ‘চোপরও।’
নন্দ বলিল, ‘সে যেন হল। কিন্তু তোমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিলুম। তোমার একটা হিল্লে করে দিতে হবে তো?’
প্রমথ নিরীহ ভালমানুষের মতো বলিল, ‘হিল্লে তো তোমার হাতেই আছে।’
নন্দ বলিল, ‘কি রকম?’
প্রমথ অসহিষ্ণু হইয়া বলিল, ‘থাক গে। নন্দ, আমাকে আজ ছুটি দাও ভাই—আমার একটু কাজ আছে।’
নন্দ বলিল, ‘কি কাজ না বললে ছুটি পাচ্ছ না।’
‘আমাকে একবার—একবার অমিয়াকে খবর দিতে হবে।’
‘অমিয়াকে খবর কাল দিলেই হবে। এই রাত্রে তার ঘুম ভাঙিয়ে আমার বিয়ের খবর দেবার দরকার নেই।’
‘কিন্তু আমার পরিত্রাণের খবরটা তো দেওয়া দরকার।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে, তুমি একটি গাধা, তার চেয়েও বড়—একটি উট। এখনও বুঝতে পারনি?’
সহসা প্রমথর আগা-গোড়া সমস্ত ব্যবহারটা স্মরণ করিয়া নন্দর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে প্রমথর হাতখানা ধরিয়া তিন চারবার জোরে ঝাঁকানি দিয়া বলিল, ‘অ্যাঁ, অমিয়া তোমার মাথাটি খেয়েছে? তাই বুঝি এ বিয়েতে এত আপত্তি? ওঃ, what a fool I have been! ফটোখানা তাহলে অমিয়া হস্তগত করেছিল—আর আমি বেয়ারাটিকে মিছিমিছি বাপান্ত করলুম! কিন্তু এত কাণ্ড করবার কি দরকার ছিল? আমাকে একবার বললেই তো সব গোল চুকে যেত।’
প্রমথ লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘না না, বলবার মতো কিছু হয়নি—শুধু মনে মনে—। তাহলে তোমার অমত নেই তো?’
নন্দ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘প্রমথ ভাই, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের অপমান করতে চাইনে। কিন্তু অমিয়ার যে এ ভাগ্য হবে, তা আমার আশার অতীত।’
প্রমথ তাড়াতাড়ি নন্দকে বাহুবেষ্টনে বদ্ধ করিয়া বলিল, ‘থাক্, হয়েছে হয়েছে! আমি তাহলে তাকে গিয়ে খবর দিয়ে আসি যে, আমার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।’
১৯১৭