প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

বিচার

বিচার

আমার ভেতরে আর একটা আমি আছি। সেই আমি যে আমার ভীষণ শত্রু। প্রবল তার প্রতাপ। বেশিরভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। তবে মাঝেমধ্যে যখন জেগে ওঠে তখন তার আসন বিচারকের আসনে। মাথায় সে যেন পরচুলা পরেছে। গায়ে তার আলখাল্লা।

সেই আমি তখন কী ভীষণ চেহারা?

রাত যখন গভীর হয়ে আছে। পৃথিবী নিস্তব্ধ। অক্ষপথে পৃথিবীর ঘর্ষণের শব্দ যখন ঘড়িতে স্পষ্ট, শরীর যখন দিনান্তের ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে চাইছে সেই সময় কোথায় একটা দরজা খুলে যাওয়ার ক্ষীণ শব্দ হয়। শুনতে পাই পদধ্বনি। ক্রমশই এগিয়ে আসছে দূর থেকে কাছে—আরও কাছে। শুনতে পাই, তিনি বসলেন বিচারকের উচ্চ আসনে, গাউনের খসখস শব্দ। বেলিফ আমার নাম ধরে হাঁক পাড়ল। হাজির। হাজির। সবাই যখন নিদ্রিত, নিদ্রামগ্ন সেই মধ্যরাত্রে শুরু হয় বিচারের পালা। আমার হাতে আমার বিচার। সে বিচার বড় অদ্ভুত। ধারালো ছুরির মতো চোখে সে শুধু তাকিয়ে থাকবে, যখনই চোখ বুজব তখনই দেখতে পাব সেই দুটো চোখ। ভয়ে আমি চোখ খুলব, ক্লান্তিতে যেই আমার চোখ বুজে আসতে চাইবে, অমনি সেই চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে আমাকে আবার চোখ খুলতে হবে। আমার বয়স হল অনেক।

এইভাবে দিনের পর দিন সেই চোখের ভয়ে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে-করতে আমার ঘুম চলে গেছে। আমার বিনিদ্র রাতে ধীরে-ধীরে দিনের মালা গেঁথে গেঁথে জীবনের কুঁড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর মহাপ্রান্তরের দিকে। কী করছি আমি?

এমন কিছু, মানুষের আদালতে যা কোনওদিন বিচারের জন্য উঠবে না। তাহলে?

আচ্ছা আজ সকালে যে লোকটি তার ছেলের চাকরির জন্য তোমার কাছে এসে বিনীত ভাবে নিবেদন জানাল, তাকে তুমি অমন রুক্ষভাবে বললে কেন, না না, চাকরি-বাকরি আমার হাতে নেই।

সত্যিই নেই।

কথাটা কি ঠিক? তোমার সঙ্গে এমন একজনের পরিচয় আছে, যাকে তুমি অনুরোধ করলে ভদ্রলোকের ছেলেটির এই বাজারে একটা চাকরি হতে পারে।

আমি কারুর কাছে ছোট হতে পারব না। বললে হয়তো হয়ে যায়, যদি ‘না’ বলে, সে ভীষণ অপমান।

অপমান? তুমি তো জানো ভদ্রলোক সামান্য চাকরি করতেন। এখন প্রায় অনাহারে দিন চলছে। ছেলেটি যে-কোনও একটা চাকরি পেলে সংসারটা বেঁচে যেত।

ঠিকই, বললে হয়তো হয়ে যেত শুধু মান-অপমানের প্রশ্নে বলা হল না, তা নয়। পেছনে গভীর একটা ব্যাপার ছিল, আমি ভেবেছিলুম, বললে আমার কোনও নিকট আত্মীয়-স্বজনের জন্য বলব, একটা উটকো ছেলের জন্য বলে নিজের আখের নষ্ট করি কেন?’

রাত যত বাড়তে থাকে, আমার আদালত ততই জমে ওঠে।

বিচারক আমি প্রশ্ন করি, তুমি আজ অফিসে শঙ্করবাবুর নামে ওপরতলায় নালিশ করতে গেলে কেন। অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ। কোনওরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে চালিয়ে যাচ্ছেন।

উপায় ছিল না, মাইলর্ড। কাজ আগে না সহানুভূতি আগে।

ঠিক কি তাই?

উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। শঙ্করবাবুকে তুমি সরাতে চাও! স্টেনোগ্রাফার ওই মহিলাটির ভাইয়ের চাকরির জন্যে তুমি বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। কেন? এর উত্তর আমার জানা নেই। আমার বিচারক আমি।

শাস্তি দেয় না।

বাধা দেয় না। শুধু প্রশ্ন করে…কেন?

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *