1 of 2

বিউটি কনটেস্ট – শংকর

বিউটি কনটেস্ট – শংকর

লেখক হবার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য নানা মানুষের সঙ্গে জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরিচিত হবার সুযোগ পাওয়া যায়। তা যদি না হবে, তাহলে আমার সঙ্গে মিস্টার অডিক্যারির পরিচয় হবে কেন?

কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমরা প্রত্যেকটা শহুরে মানুষ এক-একটা গ্রহের মতো নিজের কক্ষপথে সারাক্ষণ পাক খাচ্ছি—রুটিন বাঁধা সেই পথে কোনো বৈচিত্র্য নেই, নাটক নেই, নতুনত্বের স্বাদ নেই। বাড়িতে, বাজারে, অফিসে, ক্লাবে, চায়ের দোকানে একই লোকের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখা হবার জন্যেই যেন আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। লেখক হবার সুবিধে এই একঘেয়েমির বেড়া ভেঙে মাঝে মাঝে ছিটকে বেরিয়ে আসার সুযোগ হয়। অনেক অজানা, অচেনা মানুষের সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হয়ে যায়। তখন আবিষ্কার করি, যাঁকে এতটা অপরিচিত মনে হচ্ছিল, তিনি ততটা অচেনা নন।

এই মিস্টার অডিক্যারির কথাই ধরুন না। আমরা দু’জনেই যে যে কক্ষপথে ঘুরে বেড়াই, তার মধ্যে এতই দূরত্ব যে সাধারণভাবে আমাদের কখনও মুখোমুখি হবার কথা নয়। মিস্টার অডিক্যারি থাকেন মুলেন স্ট্রিটে। আমি থাকি শিবপুর, হাওড়ায়। মিস্টার অডিক্যারি মেলামেশা করেন সমাজের হাই সোসাইটিতে—আমি ঘোরাঘুরি করি কাসুন্দে এবং কলেজ স্ট্রিটে। আমি ও মিস্টার অডিক্যারি দু’জনেই বাজার করতে ভালবাসি—কিন্তু আমি যাই শিবপুর বাজারে; মিস্টার অডিক্যারি মুলেন স্ট্রিট থেকে ড্রাইভ করে হগ মার্কেটে আসেন। আমার ধারণা হগ মার্কেটে দাম বেশি। মিস্টার অডিক্যারির ধারণা কলকাতার অন্য বাজারগুলো এত নোংরা যে ঢোকা যায় না। সারা জীবন কালীবাবুর বাজারের মাছ-তরকারিতে প্রতিপালিত হয়ে আমার পক্ষে এখন হগ মার্কেটে যাওয়া সম্ভব নয় ; এবং দু’চারটে পয়সা বাঁচানোর লোভে মিস্টার অডিক্যারির পক্ষেও দিশি বাজারে ঢোকা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যা বলতে যাচ্ছিলাম, আমার সঙ্গে মিস্টার অডিক্যারির কোনোদিনই পরিচয় হত না, যদি সাহিত্যিক হিসেবে রোটারি ক্লাবের মিটিঙে না যেতাম।

মিটিঙে বক্তৃতার পরে চায়ের ব্যবস্থা ছিল। সেখানেই আমার বিশেষ পরিচিত এবং সভার উদ্যোক্তা মিস্টার মুখার্জি বললেন, “শংকরবাবু, আপনার সঙ্গে মিস্টার অডিক্যারির আলাপ করিয়ে দিই।”

মিস্টার অডিক্যারি নীল রঙের চমৎকার একটা দামী সুট পরেছেন। ভিতরের সাদা শার্টটা যে এ-দেশী নয়, তা কলারের ছাঁট দেখলেই বোঝা যায়। মুখে একটা দামী সিগার, ভারী গোল মুখে বেশ মানিয়েছে। মিস্টার অডিক্যারির চুলগুলো একটু যেন কেমন ধরনের, জুলপি গালের তলা পর্যন্ত নেমে এসেছে। মিস্টার অডিক্যারির বয়স আন্দাজ করা মুশকিল, তবে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে কোথাও রয়েছেন।

মিস্টার অডিক্যারি আন্তরিকভাবে আমার ডান হাতখানা চেপে ধরলেন। “কিছু মনে করবেন না স্যার, যে-হাত দিয়ে অমন লেখা বেরোয় সেটা একটু টাচ্ করে নিচ্ছি।”

আমি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। মিস্টার অডিক্যারি জিজ্ঞেস করলেন, “কী করে আপনারা লেখেন স্যার? আমরা তো তাজ্জব বনে যাই!”

“প্রত্যেক মানুষকেই তো একটা কিছু কাজ করতে হবে ; আমাদের কপালে লেখার কাজ জুটেছে।”

“ওসব বিনয় রাখুন স্যার,” সস্নেহ হুঙ্কার ছাড়লেন মিস্টার অডিক্যারি। “এই গল্প লেখার ব্যাপারটা আমার কাছে একটা বিরাট রহস্য, কী করে এসব করেন, একটু শোনবার লোভ আছে।”

“আসবেন একদিন গল্প করা যাবে। তবে রহস্য কিছুই নেই। আপনি বোধ হয় শুনে থাকবেন, দু’রকমের লেখক আছেন—মাকড়সা টাইপ এবং তাঁতি টাইপ।”

“তাই নাকি! এই দেখুন, একটা সেনটেন্সে আপনি আমাকে ফাঁদে ফেলে দিলেন। সাসপেন্সের বঁড়শি আমাকে গেঁথে ফেলেছে। এখন যদি আপনি মাকড়সা এবং তাঁতির রহস্যটা প্রকাশ না করেন তাহলে আমার ঘুম আসবে না।”

বললুম, “কথাটা কিছু আমার নিজের নয়। একধরনের লেখক আছেন যাঁরা মাকড়সার মতো নিজের লালা থেকেই সুতো তৈরি করে জাল বোনেন। অথাৎ তাঁরা অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ধার ধারেন না, নিজের খেয়াল অনুযায়ী অপরূপ কাজ করে যান। এঁরা জাত শিল্পী। আর তাঁতিরা বাজার থেকে সুতো কিনে নিয়ে এসে শুধু নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাপড় বোনে। আমরা এই শ্রেণীর লেখক। সংসারের হাট থেকে লেখার উপাদান সংগ্রহ করি—ভাল সুতো না পেলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকবে না। জীবনে যা ঘটছে তার খবর আমাদের নিতেই হবে।”

মিস্টার অডিক্যারি খুব সাহেবী ধরনের লোক হলেও, আনন্দে আমার হাত দুটোতে আবার চাপ দিলেন। বললেন, “এখানে সবাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়, আমি আপনাকে আর ধরে রাখব না। কিন্তু মনে রাখবেন, একদিন একটু গল্প করবেন বলে কথা দিয়েছেন।”

মিস্টার অডিক্যারি তাঁর একটা ভিজিটিং কার্ড আমাকে দিচ্ছেন তা মিস্টার মুখার্জি বোধ হয় লক্ষ করেছিলেন। কেননা গাড়িতে ফেরার পথে একটু উদ্বিগ্নভাবেই বললেন,“শংকরবাবু, আপনার সঙ্গে অডিক্যারির আলাপ করিয়ে দিয়েছি বলেই, আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত, লোকটার বাজারে সুনাম নেই। ওর আসল নাম, গোবিন্দ অধিকারী—কিন্তু কেমন সাহেবী নাম করে নিয়েছে।”

“সুনাম নেই বলছেন কেন?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“কী একটা কমার্সিয়াল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেকটর বলে চালায়। সেটা কিন্তু বাজে—চিঠির প্যাড ছাড়া কোম্পানির আর কিছুই নেই। এখন ‘দি চিয়ারফুল’ নামে কি একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছে—সেই সুবাদে সমস্ত ক্যালকাটায় খুব নামডাক।”

“সেটা আবার কী জিনিস?” আমি প্রশ্ন করি।

“ভগবান জানেন। লণ্ডনে, বাল্টিমোরে এবং লা-ভেগাতে নাকি এই নামের প্রতিষ্ঠানের খুব নামডাক! ‘দি চিয়ারফুল’ নাকি কলকাতাতেও বেশ নাম করে ফেলেছে।”

“হবেও বা,” আমি বলি। “এত বড় শহর। এখানে কত জায়গায় কত জিনিসের নাম হচ্ছে, আমাদের পক্ষে খবর রাখা সম্ভব নয়।”

মিস্টার মুখার্জি বললেন, “ভদ্রলোক এক নম্বরের টানেস্কা।”

“সেটা আবার কী?” আমাকে প্রশ্ন করতে হয়।

“মানে হুইস্কি টানতে এক্সপার্ট—পেটের মধ্যে একটি টালার ট্যাঙ্ক আছে।”

আমি হেসে ফেলি। মিস্টার মুখার্জি বললেন, “টানেস্কা হোক, আমার তাতে আপত্তি নেই—কিন্তু লোকজনকে নাকি বিপদে ফেলতে পারে।”

মিস্টার মুখার্জির সাবধানবাণী সত্ত্বেও, মিস্টার অডিক্যারি সম্বন্ধে আমার কৌতূহল কমেনি। ভদ্রলোকের মধ্যে একটা আকর্ষণী শক্তি আছে। তাই ওঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছে।

একটা দু’দরজার স্ট্যাণ্ডার্ড গাড়ি চড়ে মিস্টার অডিক্যারি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চষে বেড়ান। কলকাতার বড় বড় রেস্তোরাঁয় তাঁকে প্রায় দেখা যায়। আর চেনেন না, এমন লোক কলকাতায় নেই।

মিস্টার অডিক্যারি বলেন, “তা আপনার আশীর্বাদে ইণ্ডিয়ার কেষ্টবিষ্টরা অধমের সঙ্গে ভাব রাখে। পাবলিক সেকটর বলুন, প্রাইভেট সেকটর বলুন—সর্বত্র অধমের অবাধ গতায়াত।”

আমি মিস্টার অডিক্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মিস্টার অডিক্যারি ড্রিংকের গেলাসটা নেড়ে বললেন, “একটা অ্যাডভাইস আপনাকে দিয়ে রাখি—ইণ্ডিয়াতে কখনও লোয়ার লেবেলে অ্যাপ্রোচ করবেন না। পৃথিবীর সর্বত্র নিচু থেকে ওপরে উঠতে হয়। ইণ্ডিয়াতে ঠিক উল্টো। এখানে কাজ আদায় করতে হলে একেবারে ওপরের কর্তাকে ধরুন—তখন নিচের কর্তারা মাখনের মতো নরম হয়ে যাবেন। আমাদের দেশে, লোককে জানাটাই মস্ত এক অ্যাসেট। এটা না হলে কিছুই হবে না।”

মিস্টার অডিক্যারিকে ক্রমশ আমি পছন্দ করে ফেলেছিলাম। মাঝে মাঝে এসে হাজির হন। একটা। সিগার ধরিয়ে গল্প আরম্ভ করেন। বলেন, “আপনাদের কাছে এসে বড় আনন্দ পাই। সারাদিন হাই লেভেলে ঘুরে মেজাজটা যখন খিঁচিয়ে ওঠে তখন মনটা একটু শান্তির আশ্রয় চায়, বুঝলেন শংকরবাবু।”

“আমরা অর্ডিনারি লোক, গল্প উপন্যাস নিয়ে পড়ে থাকি, আমরা আপনাকে আর কি শান্তি দিতে পারি?”

মিস্টার অডিক্যারি তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন। “ও-সব কথায় ভুলছি না স্যার। আপনারা সমাজের সবচেয়ে পাওয়ারফুল এলিমেন্ট। আপনাদের হাতে কলমের মতো স্মল আর্মস রয়েছে; যা রিভলবার থেকে হাজারগুণ শক্তি রাখে। আমার তো মনে হয় স্যার, এটা গভরমেন্টের বোকামি। রিভলবারের জন্যে লাইসেন্স লাগে, অথচ কলমের জন্যে লাইসেন্স নিতে হয় না।”

মিস্টার অডিক্যারির কথার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেলি। উনি গভীরভাবে বলেন, “হাসবেন না স্যার, একেবারে এডওয়ার্ড কেভেন্টারের দুধের মতো খাঁটি কথা বলছি। আপনি হিস্ট্রির দিকে তাকিয়ে দেখুন, রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে গিয়েছিল। লেখকরা ইচ্ছে করলে, ভবিষ্যৎকে অ্যারেস্ট করে বর্তমানের সামনে হাজির করাতে পারে। তাতে মানুষের চৈতন্যোদয় হবে কি না, সেটা অবশ্য আলাদা কথা।”

মিস্টার অডিক্যারি ফারপোতে লাঞ্চ, ফ্লুরিতে চা, ব্লু ফক্সে ডিনার করেন। কলকাতার ইয়া বড় বড় কোম্পানির ডিরেকটরদের তিনি প্রথম নাম ধরে ডাকেন; জাদরেল জাদরেল সরকারী অফিসারদের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট দহরমমহরম, তবু এই দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে ভদ্রলোকের। নভেল পড়তে ভালবাসেন।

মিস্টার অডিক্যারি একদিন বললেন, “ভগবানের আশীর্বাদে পয়সাকড়ির তেমন অভাব নেই, তবু মন ভরে না। দুঃখ হয়, কেন লেখকদের মতো লিখতে পারি না।”

“লিখতে ইচ্ছে হয় কেন?” আমি প্রশ্ন করি।

ভদ্রলোক বললেন, “সত্যি কথা বলতে কি, যে-জীবন চোখের সামনে দেখি, তা লেখার যোগ্য বলে মনে হয়, কিন্তু যেই কলম নিয়ে বসি, সব গুলিয়ে যায়। আমার মশাই, তাই একটা কথা জানতে ইচ্ছে হয়—আপনিও জীবন থেকে লেখেন। তাই না?”

“এতদিন তো তাই করে আসছি। জীবনে এত জিনিস পড়ে রয়েছে, যে কল্পনার ওপর ধকল করবার প্রয়োজন হয় না।”

মিস্টার অডিক্যারি এবার জানতে চাইলেন, “আপনি দয়া করে একটা কথা বলুন—ঘটনা ও গল্প কি এক জিনিস?”

আমি বললাম, “আপনি আমাকে বিপদে ফেলে দিলেন। এর উত্তর খুব শক্ত। তবে আমার এক শ্রদ্ধেয় লেখক সুন্দর একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন। এক দেশে এক রাজা ছিল। তাঁর এক পরমাসুন্দরী রানী ছিল। হঠাৎ একদিন রাজা মরে গেলেন এবং কিছুদিন পরে রানীও মারা গেলেন। এইটা হলো ঘটনা। কিন্তু যেমনি লিখলাম এক দেশে এক রাজা ছিলেন, তঁর এক পরমাসুন্দরী পতিব্রতা রানী ছিলেন। রাজা মারা গেলেন। বেচারা রানী, স্বামীর বিরহ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়লেন। অবশেষে মৃত্যু এসে তাঁকে সমস্ত যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিল। এইটা হলো গল্প।”

“অতি চমৎকার বলেছেন।সমস্ত জিনিসটা আমার কাছে জলের মতো সোজা হয়ে যাচ্ছে,” মিটার অডিক্যারি সিগারের ধোঁয়া ছাড়লেন।

একটু থেমে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “অনেকদিন থেকে আপনাকে একটা প্রশ্ন করবার ইচ্ছে ছিল। আপনার চৌরঙ্গী উপন্যাসের চরিত্রগুলো সত্য কি না? কয়েকজন পুরুষ এবং একদল মহিলাকে মুখ চেনা চেনা মনে হয়—হাজার হোক, হাই সোসাইটিতে দিনরাত ঘুরছি তো। কিন্তু আপনি যা বললেন, তারপর আপনাকে বোধ হয় প্রশ্ন করা আমার উচিত হবে না।”

মিস্টার অডিক্যারির কাজটা কি বুঝি না। মাঝে মাঝে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একদম পাত্তা থাকে না। তারপর আবার হাজির হন। বলেন, “আমাদের ওই যে প্রতিষ্ঠানটা রয়েছে—দি চিয়ারফুল—এই নিয়ে আজকাল বড় ব্যস্ত থাকতে হয়। অ্যাকটিভিটি ক্রমশই বাড়ছে। ওই যে নাটাহারিবাবু একবার বলেছিলেন—পলাশীর যুদ্ধ নয়, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ইংরেজরা ইণ্ডিয়া জয় করলে—সমস্ত দেশটাই রাতারাতি সায়েব হয়ে গেল, এটা একেবারে নির্ভেজাল সত্যি স্যার। সেই জন্যেই আমাদের মতো কিছু লোক করে খাচ্ছে।”

“দি চিয়ারফুল! নামটা সুন্দর,” আমি বলি।

“অনেক ভেবেচিন্তে নামটা দিয়েছি। দুনিয়ায় গণ্ডগোল তো লেগে থাকবেই—এরই মধ্যে হাসিখুশি থাকো, এই হচ্ছে আমার প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র।”

“খুব ভাল মন্ত্র খুঁজে বার করেছেন, মিস্টার অডিক্যারি,” আমি ওঁর সঙ্গে একমত হই।

“আপনারা তো আর্টিস্ট লোক, বলুন তো গোমড়ামুখো হয়ে বসে থেকে কোনো লাভ আছে? পৃথিবীতে কত রকমের প্রবলেম—কিন্তু রবার সল্যুশন ছাড়া আর কিছু সল্যুশনই হাতের গোড়ায় পাবেন না। এইভাবে সিরিয়াস হতে হতে, একদিন শুনবেন পৃথিবীর সমস্ত লোকের একসঙ্গে করোনারি অ্যাটাক হয়েছে। তখন মশায় কাউকে দোষ দিতে পারবেন না!”

মিস্টার অডিক্যারির কথাবার্তার ধরন আমার খুব ভাল লাগে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার প্রতিষ্ঠানে আর কে কে আছে?”

“আপনাকে বলতে লজ্জা নেই, পৃষ্ঠপোষক শুভার্থীর মধ্যে কয়েকটা বড় বড় নাম রেখেছি—ডোমজুড়ের যুবরাজ বণিক সমিতির প্রেসিডেন্ট, সমাজসেবী গিনী দেবী। তবে ভিতরে তেমন কিছু রাখিনি। আসল কমিটিতে আছি—আমি, আমার ওয়াইফ, আমার মেয়ে, আমাদের বাড়ির রাতদিনের ঝি প্রমীলা।”

“রাতদিনের ঝিকে কমিটিতে রেখেছেন?” আমি আঁতকে উঠি।

“খুব বিশ্বস্ত, মশায়। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে এসেছিল। এই সব পোস্টে বিশ্বাসযোগ্য লোক ছাড়া রাখা যায় না। দিনকালটা কিরকম পড়েছে, বুঝতেই তো পারছেন।”

“কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে না?”

“গভরমেন্ট থেকে কিছু টাকা পাবার কথা হয়েছিল। সেই সময় একজন বাগড়া দিয়েছিল—প্রমীলা যে ঝি সেটা কেমন করে লিক হয়ে গিয়েছিল। শেষে মিনিস্টার পঞ্চুদাকে ধরতে হলো। পঞ্চুদা বললেন, কিছু চিন্তা কোরো না। আমি সব ঠিক করে দেবো। উনি নোট দিয়ে দিলেন, মিস্টার অডিক্যারির প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়—ওয়াকার্স পার্টিসিপেশন ইন ম্যানেজমেন্ট। কর্মীদের মধ্যে থেকে উনি পরিচালক নিয়েছেন, প্রগ্রেসিভ মিস্টার অডিক্যারি।”

একটু থেমে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “পঞ্চুদার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না। পঞ্চুদা একটা পয়সা নিলেন না, শুধু বলেছেন সুবিধেমতো দেশসেবা সমিতির কাণ্ডে কিছু টাকা তুলে দিতে। আমি তো বলেছি, লাগান না একটা হোল-নাইট-বল বা কোনো কনটেস্ট, দেখুন কত টাকা তুলে দিই। পঞ্চুদা তখন সাহস পেলেন না, তারপর বেচারা ভোটেই হেরে গেলেন।”

মিস্টার অডিক্যারি বোধ হয় আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন, ওঁর প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে আমার আরও জানবার ইচ্ছে। উনি হাসতে হাসতে বললেন, “এসব হাইলি কনফিডেনশিয়াল। কিন্তু আপনি কোনোদিন এ-লাইনে আসতে পারবেন না, সুতরাং আপনাকে বলতে আপত্তি নেই!”

একটু থেমে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “জানেন তো স্যার, ইণ্ডিয়াতে পয়সা রোজগারের সুযোগ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। যারা বড়লোক আছে আছে, কিন্তু নতুন করে বড়লোক হওয়া গভরমেন্টের কল্যাণে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি-বা আপনি দুটো পয়সা কামালেন, তা মেরে নেবার কতরকমের ফাঁদ পেতে রেখেছেন সরকারী কর্তারা। যত না রোজগার তার থেকে বেশি ট্যাক্স। শুনেছেন, শুধু ট্যাক্স বাড়িয়ে কোনো দেশে সোস্যালিজম এসেছে? তা মশাই, এখন ভাল লাইন এই একটাই ভোলা আছে। এই আর্ট কালচারের লাইনটা। কেউ প্রাইভেট ইস্কুল খুলছে, কেউ ফাংশন করছে। আমি দুটোরই ব্যবস্থা রেখেছি। তবে ক্ল্যাসিক্যাল এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইনে এখনো কমপিটিশন বড্ড বেশি বলে আমি তাই একেবারে নতুন লাইন বেছে নিয়েছি। ওয়েস্টার্ন স্টাইল ফাংশানে হাঙ্গামা একটু বেশি, কিন্তু রিটার্ন খুব ভাল।”

“মানে,” আমি জানতে চাই।

অবাক হয়ে গেলেন মিস্টার অডিক্যারি। “বলেন কি, আপনি এতদিন কলকাতায় রয়েছেন, আর আমাদের কোনো বিউটি কমপিটিশনে আসেন নি।”

আমাকে স্বীকার করতে হলো, কাগজে মাঝে মাঝে রিপোর্ট পড়েছি, ছবি দেখেছি, কিন্তু কখনও দেখা হয়ে ওঠে নি।

“হোল ইণ্ডিয়াতে, এইটেই তো লেটেস্ট ফ্যাশন! আমরা গত মাসেই তো ফ্যাশন শো তিনটে অর্গানাইজ করলাম। তবে সবই চ্যারিটি প্রোগ্রাম।”

“তাতে আপনার তো কোনো লাভ হলো না,” আমি মন্তব্য করি।

জিভ কেটে মিস্টার অডিক্যারি উত্তর দিলেন, “অন্যদের যাই বলি, আপনার কাছে মিথ্যুক হবো না—চ্যারিটি প্রোগ্রামে লাভ ভালই হয়। আজকের যুগে চ্যারিটি মানে চ্যারিটি নয়। বিয়ের কার্ডে, কত লোকই তো লেখে লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়—কিন্তু তার মানে কি সত্যিই উপহার নেওয়া হবে না?”

বিউটি কনটেস্ট সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই শুনে মিস্টার অডিক্যারি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, “আমার পক্ষে এটা লজ্জার কথা। আপনাকে এবার চান্স পেলেই পাকড়াও করে নিয়ে যাবো। অনেক চিন্তার খোরাক পাবেন।”

মিস্টার অডিক্যারি সত্যিই নিজের প্রতিশ্রুতি ভুলে যান নি। একদিন টিকিট নিয়ে হাজির। মার্কনি রেস্তোরাঁয় নাইটলি ডান্স ও মিস বিউটি প্রতিযোগিতা। “শনিবার তাহলে সোজা চলে আসবেন মার্কনির তিনতলায়।”

আমি একটু কিন্তু-কিন্তু করছিলাম। “জামাকাপড়ের রেসট্রিকশন আছে নিশ্চয়?” আমি জানতে চাই। “আমার ডিনার জ্যাকেট নেই।”

“আমাকে আর কষ্ট দেবেন না। আপনি জেনে রাখুন, আজকাল আর কোনো পার্টিতেই আমরা ডিনার স্যুট রেকমেণ্ড করি না। লাউঞ্জ স্যুট অথবা ন্যাশনাল ড্রেস। যা দিনকাল পড়েছে, আজকাল লোকে লাউঞ্জ স্যুটের মানেও বোঝে না। কতবার যে বলতে হয়, ওরে বাবা, লাউঞ্জ মানে যে-কোনো একরঙের কোট প্যান্ট। তাও যদি না থাকে, স্রেফ ধুতি চাদর।”

আমি মিস্টার অডিক্যারির কথা শুনে যাচ্ছি। উনি বললেন, “আপনি শুধু শাজাহান হোটেলের ইতিবৃত্ত লিখলেন। মার্কনি রেস্তোরাঁর টমাসকে নিয়ে একটা মহাভারত লিখতে পারেন। টমাসের মশায় বড় দুঃখ—দিনকাল ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। টমাস সেদিন বললে, ধুতি পাঞ্জাবি ন্যাশনাল ড্রেস নয়। ন্যাশনাল ড্রেস মানে চুড়িদার এবং গলাবন্ধ কোট। আমি বললাম—বাছাধন, ওসব গ্রামার-টামার ছাড়। জমানা পাল্টে গিয়েছে। ধুতি পাঞ্জাবি বেঙ্গলের ন্যাশনাল ড্রেস না বললে, মারকনির মার পড়ে থাকবে এবং কনি বিদায় নেবে।”

মিস্টার অডিক্যারি আমার হাতে টিকিটটা দিয়ে বললেন, “আসবেন কিন্তু তাহলে। একেবারে হাউস ফুল—টিকিটের জন্যে হই চই চলেছে।”

বললাম, “নিশ্চয় আসবো।”

মিস্টার অডিক্যারি লোভ দেখালেন, “আপনারা এর থেকে অনেক উপাদান সংগ্রহ করতে পারবেন, যা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হবে না। কোথায় যেন পড়লাম, এক ভদ্রলোক লিখেছেন—ইতিহাস এবং উপন্যাসের মধ্যে তফাত কী? ইতিহাসে চরিত্রগুলো সত্য, কিন্তু ঘটনাগুলো নিজের খেয়ালখুশিমতো সাজানো। আর উপন্যাসে চরিত্রগুলো মিথ্যে, কিন্তু ঘটনাগুলো নির্ভেজাল সত্য। তাই সত্য জানতে হলে উপন্যাসের ওপর নির্ভর করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

মিস্টার অডিক্যারির নিমন্ত্রণটা হাতছাড়া করিনি। হালফ্যাশানের কলকাতার এই নতুন দিক সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের সুযোগ ছাড়া যায় না।

শনিবার সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে মার্কনি রেস্তোরাঁয় হাজির হয়েছি। রেস্তোরাঁয় গেটের সামনে বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। কাঁচের দরজার সামনে নোটিস ঝুলছে—হাউস ফুল।

ঢোকবার সময় হয়ে গিয়েছে কি না ভাবছিলাম। এরই মধ্যে দু-একটি চোঙা প্যান্ট পরা ছোঁড়া এসে খোঁজ করলে স্পেয়ার টিকিট আছে কি না। এরা সেই আশাতেই তীর্থকাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যদি কেউ শেষ মুহূর্তে টিকিট বিক্রি করে যায়।

গেটের ভিতর দু’জন ভদ্রলোক কালো স্যুট পরে অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। টিকিট দেখাতেই, জিজ্ঞেস করলে, ইওর নেম প্লিজ। নাম বলতেই মন্ত্রের মতো কাজ হল। “আপনি তো মিস্টার অডিক্যারির গেস্ট? উনি বলে রেখেছেন, আপনি আসা মাত্রই ওঁকে খবর দিতে।”

টেবিলের নম্বর বলে দিলেন ওঁরা। আমি তিনতলায় উঠে গেলাম। মার্কনি হোটেলের কার্পেট খোদ বোখারায় তৈরি। এত লম্বা ওয়ান পিস কার্পেট নাকি ইণ্ডিয়াতে আর কোথাও নেই।

হলের মধ্যে বেশ কিছু লোক ইতিমধ্যে এসে গিয়েছেন। মিস্টার অডিক্যারি এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, “আপনাকে এমন টেবিল দিয়েছি যে সবার ওপর নজর রাখতে পারবেন!”

মিস্টার অডিক্যারিকে আজ চেনা দায়। কালো ডিনার জ্যাকেট পরেছেন, সঙ্গে প্রজাপতির মতো বো-টাই। কোটের পকেট থেকে একটুকরো ধবধবে সাদা রুমাল উঁকি মারছে। গায়ে আবার বিলিতি সেন্ট স্প্রে করেছেন, তার গন্ধ ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ছে। মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “এই একটা পুরনো অভ্যাস, স্যার। সন্ধ্যাবেলায় কোথাও বেরোতে গেলে একটু ফরাসি মিস্ট স্প্রে না করলে থাকতে পারি না।”

মুখের সিগারে একটা টান দিয়ে বললেন, “এখন কী ড্রিংকস নেবেন বলুন। মদটদ এমনি তো আপনার চলে না জানি, কিন্তু আজ স্পেশাল অকেশন, নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন।”

বললাম, “এখন একটা নরম পানীয় হোক, মদের কথা পরে দেখা যাবে।”

“ভেরি গুড। বেয়ারা, আমাকে একটা স্কচ উইথ গরম সোডা উইদাইট আইস দাও। আর সায়েবকে কী দেবে? আপনি স্যার এখানকার লোকদের লজ্জায় ফেলে দেবেন, ড্রিংকস ছাড়া কি আর বিউটি কমপিটিশন জমে। ঠিক হ্যায়, বেয়ারা, সায়েবকে একটা জিন অ্যাণ্ড লাইম উইদাউট জিন দাও।”

“আবার জিন কেন?” আমি প্রতিবাদ করি।

হা-হা করে হেসে উঠলেন মিস্টার অডিক্যারি। “কিছু ভয় করবেন না, এটা আমার একটা স্পেশাল আবিষ্কার ফর লেম্বুপানি বাবুজ। জিন উইদাউট জিন, মানে শুধু লেবুর জল কিন্তু ওপরে এক টুকরো লেবু ভাসবে।”

বেয়ারা আসতেই মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “এই টেবিলকে কোনো বিল দেবে না। ওটা আমাদের বড় টেবিলের সঙ্গে জুড়ে দেবে।” তারপর গেলাসটা তুলে বললেন, “প্রথম পেগের বউনিটা আপনার সঙ্গেই হলো—চিয়ারস।”

গেলাসটা নামিয়ে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “আমার দুঃখ আপনার সঙ্গে সব সময় বসতে পারবো।। শালা নগেন সাধু এলেই আমাকে গিয়ে ওই বড় টেবিলে বসতে হবে।”

নগেন সাধু কে তা জানি না। মিস্টার অডিক্যারি নিজেই ব্যাখ্যা করলেন, “দেশজননী কেমিক্যালসের মালিক। আমাদের আজকের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার স্পনসর—মানে আর কি খরচাপাতি সব দিচ্ছেন। দেখুন না দেওয়ালে ব্যানার দিয়ে দিয়েছি—দেশজননী কেমিক্যালস, আর ওদের সেন্ট, পাউডার, সালসার নাম লেখা রয়েছে।”

“এই যে প্রতিযোগিতা, এতে ওঁদের কী লাভ হয়?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“বলছেন কি মশায়? লাভ বলে লাভ! সাধে কি আর পৃথিবীর সর্বত্র এই কনটেস্টে লাখে লাখ ডলার খরচ করছে? দেখছেন না, বাঘা বাঘা কোম্পানিরা স্পেশাল লোক রেখেছে শুধু এই কমপিটিশন করানোর জন্যে। এতে আপনার মালগুলোর নাম প্রচারিত হলো। দশটা লোক সারারাত ধরে দেখলো আপনার জিনিসটা। যাবার সময় একটা করে নমুনা নিয়ে গেল। তারপর যে-সুন্দরী ফার্স্ট হলো, তার নামে বিজ্ঞাপন বেরুলো, আমার এই যে সৌন্দর্য এর পিছনে রয়েছে, দেশজননী কেমিক্যালসের পাউডার, নেল পালিশ, আলতা, সালসা, এটসেটা এটসেটরা।”

আর এক ঢোক হুইস্কিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে অডিক্যারি বললেন, “সংক্ষেপে আপনাকে বলে রাখি, বেঙ্গলীরা মশায় ব্যবসার কিছুই বোঝে না। বাপ-পিতামহ কেউ কিছু একটা করে গিয়েছে, সেইটাই গয়ং গচ্ছ করে চালায়। আর বাইরের কোম্পানিরা এসে আমাদের মেরে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি মশাই, বিউটি কনটেস্ট অর্গানাইজ করি, আমার কি? কোম্পানি যেখানকারই হোক না কেন। কিন্তু হাজার হোক লোক্যাল বয় তো, মাঝে মাঝে সন অফ দি সয়েলের জন্যে মনটা খচখচ করে ওঠে। জুতোর মধ্যে কোথায় একটা পেরেক বেঁধে। সেই জন্যেই তো মশাই, আমি গিয়ে নগেন সাধুকে ধরলাম।”

“আচ্ছা?” আমি শুনে যাই।

“যা বলছিলাম, দেশজননীর জিনিসপত্র খারাপ নয়। স্বদেশী যুগে বিরাট নামডাক ছিল। কিন্তু এখন ঢিমে-তেতালে চলছে।”

“কেন?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“মালিক যে বেশ বড়লোক হয়ে গিয়েছে।” মিঃ অডিক্যারি উত্তর দিলেন।

“সে তো ভাল কথা, লক্ষ্মীর সাধনায় বাঙালী উন্নতি করছে।”

“আপনারা ওই লিখে মরুন স্যার। আপনাদের দ্বারা প্রোডাকটিভ কিছু হবে না। আপনি ব্যাপারটা বুঝছেন না। ননবেঙ্গলীরা বড়লোক হলেও থেমে যায় না, আরও বাড়াতে চায়। এই যে মশাই, বড় বড় মারওয়াড়িরা। টাকা ভগবানের দয়ায় কি কমতি আছে? কিস্‌সু না করলেও, কামিং ফোর্টিন জেনারেশন ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ দিয়ে বসে বসে খেতে পারে। কিন্তু তবু ওঁরা দিনরাত খেটে চলেছেন এবং বাড়াবার চেষ্টা করছেন। অল ওভার ওয়ার্লড-এ তাই হয়, একমাত্র এই রবি ঠাকুর বিবেকানন্দের বার্থ প্লেস ছাড়া। এখানে রুল অন্য।”

“এখানে কী রুল?” আমি জানতে চাই।

“এখানে রুল অফ থ্রি। এক পুরুষ তৈরি করেন, দ্বিতীয় পুরুষ কোনরকমে রক্ষে করেন, এবং তৃতীয় পুরুষ মা লক্ষ্মীকে খিদিরপুরের ডকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন,” মিস্টার অডিক্যারি বললেন।

“তবে যা বলছিলাম,” মিস্টার অডিক্যারি পেগটা শেষ করেই ফেললেন। “আমাদের নগেন সাধু বিরাট বড়লোক। কলকাতায় অনেকগুলো বাড়ি, তাছাড়া লোহার কারবার, ছাপাখানার কারবার, পাটের কলের অর্ধেক—এসব আছে। টাকার উপর শুয়ে থাকে বলতে পারেন।”

এবার একটা পুরো বোতলের অর্ডার দিলেন মিস্টার অডিক্যারি। বললেন, “ওইটেই ভাল, অনেক রাত পর্যন্ত চলবে, থাক আপনার টেবিলে। দু-একজন চেনা-জানা বেরিয়ে পড়লে আপনিও অফার করতে পারবেন। হ্যাঁ, আমি মশাই গিয়ে নগেন সাধুকে ধরবার চেষ্টা করলাম। কার্ড দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি, কিন্তু দেখা হয় না। হয় বেরিয়ে গিয়েছেন, না হলে অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে গোপন কথা বলছেন। না হয় বিশ্রাম করছেন—ডিসটার্ব করা বারণ।

“তা আমিও গোবিন্দ অধিকারী। গোঁ যখন ধরেছি, ছাড়বার ছেলে নই। শেষে একদিন ওঁকে পাকড়াও করলাম। স্কিমটা বললাম, আপনার যত কমপিটিটর তারা হুড়হুড় করে বিজনেস বাড়িয়ে ফেলেছে। তাছাড়া প্রেস্টিজ পাবেন। এককালে হাই ফ্যামিলির মেয়েরাও আপনাদের কোম্পানির জিনিস ব্যবহার করতো, এখন কেবল মফস্বলের মেয়েরা কিনছে।

“খরচাপাতি কেমন পড়বে জানতে চাইলে নগেন সাধু। বললুম, হাজার দশেক টাকা। এর মধ্যেই মিস বিউটি যিনি হবেন তার পাঁচ’শ টাকা পুরস্কার, বিজ্ঞাপনের খরচ, মার্কনি হোটেল ভাড়া নেওয়ার খরচ, আমাদের ‘দি চিয়ারফুলে’র টেকনিক্যাল ফি।

“পকেট থেকে ছোট এলাচ বার করে নগেন সাধু চিবোতে লাগল। এই ছোট এলাচ চিবনোর একটা ইনটারেস্টিং হিস্ট্রি আছে, আমি শুনেছি।”

“তাই নাকি?” আমি বলি।

“বার বছর বয়সে নগেন সাধু সিগ্রেট খেতে শেখে। ধরা পড়বি তো পড় একদিন বাপের কাছে ধরা পড়ে গেল। আর অমন বাপ! জানেন তো বাপের কথা। প্রতি বছর ওঁর তিরোধান দিবসে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোয় দেশজননী কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীবরেন্দ্রনাথ সাধু। সাধু তো সাধু মশাই। একেবারে সাত্ত্বিক পুরুষ। এম এস-সি’তে ফার্স্ট হয়েছিলেন। মোটা খদ্দর পরতেন। পি সি রায়ের পাল্লায় পড়ে চা পর্যন্ত খেতেন না। দোষের মধ্যে মাঝে মাঝে ছোট এলাচ চিবোতেন। তা, বরেন সাধু যখন ছেলের কীর্তি ধরলে, তখন গান্ধীর ছবির সামনে এনে দাঁড় করালে ছেলেকে। বললে, যা দোষ করেছ করেছ। আর সিগ্রেট খেয়ো না। সিগ্রেট খেতে ইচ্ছে করলে, এই ছোট এলাচ মুখে দেবে।”

“তাতে ফল হলো?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“ফল কি মশাই! সেই থেকে নগেন সাধু এলাচও খায়, সিগ্রেটও খায়। বিশেষ করে মাথায় যখন কোনো ফন্দি আঁটছে তখন মুখে একটা গোটা ছোট-এলাচ পুরে দেয়।”

“যা বলছিলাম, নগেন সাধু তো মুখে এলাচ পুরে দিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ফাংশনে কী কী হবে? আমি লিস্টি দিয়ে দিলাম। ‘মার্কনি হোটেলে সাড়ে আটটায় প্রোগ্রাম শুরু হবে। ডিনার এবং ক্যাবারে। তার সঙ্গে একটু অতিথিদের ডান্স। তারপর আসল প্রোগ্রাম। মিস বিউটি নির্বাচন। তারপর মিস বিউটির মাথায় মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে—খেলা খতম। রাত আড়াইটের পর যে-যার ঘরে ফিরে যাবে।’

“আমার কথা শুনে নগেন সাধু হেসে ফেললে। হাসলে আবার লোকটার গলায় তিন-চারটে ভাঁজ পড়ে যায়। বললেন, ‘অত বোকা আমি নই। হলসুদ্ধ লোককে আমি গাঁটের পয়সায় গান্ডেপিণ্ডে খাইয়ে আবার নাচ দেখাতে পারব না।’

“আমি তখন বুঝিয়ে দিলাম, সবাইকে আপনি খাওয়াবেন কোন দুঃখে? টিকিট বিক্রি হবে। চল্লিশ টাকা করে টিকিট, তার মধ্যে ডিনার রয়েছে। মদের দাম একস্ট্রা। আমরা শুধু কিছু বিশিষ্ট লোককে নেমন্তন্ন করব, তাঁদের খরচ আমাদের। আর আপনি যদি চান যেক’টি সুন্দরী আমাদের প্রতিযোগিতায় নামবে, তাদের এবং একজন করে দেহরক্ষী ফ্রি।’

“নগেন সাধু জানতে চাইলেন দেহরক্ষী ফ্রি কেন? বললুম, ‘ভদ্রঘরের মেয়েরা আজকাল প্রতিযোগিতায় নাম দেয়, রাত আড়াইটের সময় তারা কী করে বাড়ি ফিরবে বলুন?

“কিন্তু হিসেব-টিসেব করে নগেন সাধু রাজি হলো না। বললে, ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা না করেই তো আমার বাবা বরেন সাধু এত বড় ফার্ম করেছিলেন, সুতরাং ওসব দরকার নেই।’

“আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বললাম, “যে-যুগের যা মন্ত্র, নগেনবাবু। আপনার বাবার যুগের মন্ত্র ছিল স্বদেশীয়ানা। অমন ফ্যাশনেবল ব্যারিস্টার সুধাসিন্ধু রায়ের স্ত্রী, প্যারিসের তৈরি প্রসাধন নর্দমায় ফেলে দিয়ে দেশজননী সেন্ট এবং দেশজননী পাউডার ব্যবহার আরম্ভ করেছিলেন। তখন লোকে বলত, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। এখন আর বলে না, স্যার। স্বাধীন দেশের লোকের এখন স্বদেশীতে আগ্রহ নেই। তাই এখন এইসব বিউটি কনটেস্ট। সেই জন্যেই তো, ভগবানের আশীর্বাদে আমার নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। পাটনা, দার্জিলিং, গৌহাটি, ক্যালকাটা চষে বেড়াচ্ছি। লোককে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, ফ্যাশন শো, বিউটি শো, চ্যারিটি শো, ফিল্মস্টার নাইট, হোল নাইট্ বল, এসব অর্গানাইজ করতে আমাদের এই দি চিয়ারফুলের জুড়ি নেই।”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “কিন্তু মশাই কিছু ফল হলো না। লোকটা রাজি হলো না। আর আমারও রোখ চেপে গেল। প্রতিজ্ঞা করলাম, তুমি সাধুসদাগর আর আমিও গোবিন্দ অধিকারী—ছাড়বো না। উইলিয়ম টেলরের মতো চেষ্টা করে যাবো।”

“উইলিয়ম টেলার না রবার্ট ব্রুস?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“ওই হলো স্যার। দুটো নাম আমার গুলিয়ে যায়। একজন ছেলের মাথায় তীর মেরে আপেল তুলেছিল, আর একজন মাকড়সার জাল দেখে আইডিয়া পেয়েছিল। আমাদের দেশেও তো বলেছে, একবারে না পারিলে দেখ শতবার।”

“তারপর কী করে রাজি করালেন?” জিজ্ঞেস করি অডিক্যারিকে। “সে বিরাট এক হিষ্ট্রি। এইটুকু শুনে রাখুন, ওর ম্যানেজার সত্যেন হালদারকে কিছু দিয়েছিলাম। উনিই টিপস্‌টা দিয়ে দিলেন। ‘সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। বাবুর রক্ষিতা পুঁটুকে পাকড়াও করুন।’ সেও এক বিরাট গল্প মশাই। যাই হোক, আপনাদের আশীর্বাদে, কাজ হয়েছে বুঝতেই পারছেন। না হলে আজকের ফ্যাংশন হচ্ছে কী করে?”

আমাদের কথায় বাধা পড়ে গেল। এক ভদ্রলোক ছুটে এলেন। মিস্টার অডিক্যারি পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনিই সত্যেন হালদার, মিস্টার সাধুর রাইট হ্যাণ্ড।”

সত্যেনবাবু বললেন, “বাবুর গাড়ি এসে গিয়েছে। চলুন রিসিভ করতে।”

মার্কনি হোটেলের বাজনা এবার শুরু হয়ে গেল। একটু পরেই গেটের কাছে যাঁকে দেখা গেল তিনিই যে নগেন সাধু তা বুঝতে কষ্ট হলো না। ভদ্রলোকের একদিকে হালদার মশায়, অন্যদিকে মিস্টার অডিক্যারি। বিরাট মোটা নগেন সাধু। কোঁচানো দিশি ধুতি পরেছেন ভদ্রলোক। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি। কাঁধের উপরে রেখেছেন একখানা ভাঁজকরা চাদর। হাতে বিরাট একটা সোনার ঘড়ি, সেটা আবার পরেছেন পাঞ্জাবির হাতার ওপর। ব্যাণ্ডটাও সোনার। পিছনেই এক মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখা গেল। বেশি সাজগোজ করেননি মহিলা—লালপাড় সাদা শাড়ি পরেছেন। সাধারণ একটা ব্লাউজ। তবে হাতে চুড়ি আছে অনেক। সঙ্গে একটি কমবয়সী বিবাহিতা মহিলা। প্রচণ্ড সেজেছেন তিনি। ভারী সিল্কের ওপর বড় বড় সোনালী কাজের বহর দেখেই বোঝা যায়, বেজায় দামী শাড়ি। তেমনি সুন্দরী মহিলা—যেমন গায়ের রঙ, তেমনি ফিগার। কিন্তু অতিমাত্রায় সোনার অলঙ্কার এবং প্রসাধনে সৌন্দর্য বাধা পেয়েছে। পিছনে এক যুবক কোট প্যান্ট পরা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারাটা এখনও বেশ রোগার ওপর আছে।

নাচের ফ্লোরের সামনে বড় টেবিলটায় বিশিষ্ট অতিথিদের বসিয়ে, মিস্টার অডিক্যারি আমার কাছে এসে বললেন, “চলুন, আলাপ করিয়ে দিই।”

আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে মিঃ অডিক্যারি বললেন, “ইনিই হচ্ছেন বিখ্যাত শিল্পপতি নগেন সাধু। বুঝতেই পারছেন, ইনি ওঁর স্ত্রী শ্রীমতী সাধু।”

মিসেস সাধু নমস্কার করে বললেন, “এই হচ্ছে আমার ছেলের বউ, পারমিতা। আর ওই আমার বড় ছেলে নরেন্দ্রনাথ সাধু।”

“আপনারা হয়তো বুঝতে পারছেন না ইনি কে। ওযেল-নোন রাইটার শংকর। এঁর চৌরঙ্গী বই।”

নগেন সাধু আমার মুখের দিকে তাকালেন। তেমন উৎসাহিত বোধ করলেন না। শুধু বললেন, “আপনাদের রাইটার শরৎ চাটুজ্জের সঙ্গে আমার একবার আলাপ হয়েছিল। তখন কলেজে পড়ি। তারপর কোনো বইটই পড়িনি। কখন পড়বো বলুন?”

শ্ৰীমতী সাধু বললেন, “ওঁর কথা ছাড়ুন। আমরা আপনার বই পড়ি। চৌরঙ্গীটা খুব ভাল লেগেছে। যা ঠুকেছেন হাই সোসাইটিকে!”

“ওইটেই তো রাইটারদের ব্যবসা। শরৎ চাটুজ্জেও ওই করতেন—বড়দের ঠুকতেন আর ছোটদের তোলবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বাওয়া কী হলো? ছোটরা ছোটই রয়ে গেল, বড়রা বড়ই থেকে গেল, মাঝখান থেকে শরৎ চাটুজ্যে বালিগঞ্জে বাড়ি করে ফেলল।” বললেন শিল্পপতি নগেন সাধু।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নগেন সাধু বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না।” তারপর শুরু করলেন, “আমার বাবা খুব গল্প কবিতা পড়তে ভালবাসতেন।”

ওই সূত্র ধরেই মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “শংকরবাবু, সামনে বলে বলছি না, এঁদের কত বড় বংশ। বরেনবাবু ছিলেন বৈজ্ঞানিক, স্বদেশপ্রেমিক এবং রসিক। নিজের চেষ্টায় বাঘা বাঘা ইংরেজকে ব্যবসার পাঞ্জায় হারিয়ে দিয়ে এই দেশজননী কেমিক্যালস করেছিলেন। এখন তাঁরই সুযোগ্য বংশধর নগেনবাবু—বাঙালীর একটা গর্ব বলতে পারেন। কত লোকের অন্ন দিচ্ছেন।”

নগেন সাধু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “এমন আর কি—সাত-আট শ’। বাড়ির চাকর-বাকর যদি ধরেন তাহলে আরও কুড়ি-পঁচিশটি।”

“আট শ’ লোক ধরলে ঠিক হবে না। আট শ’ ফ্যামিলি অন্ন পাচ্ছে—তার মানে আট শ’ ইনটু পাঁচ অথাৎ কিনা চার হাজার লোক।” টীকা দিলেন ম্যানেজার সত্যেনবাবু।

আমি ফিরে এসে নিজের টেবিলে বসে পড়লাম। দেখলুম সাধুপরিবারের টেবিলে দুটো বিলিতি বোতল থাকা সত্ত্বেও, বেয়ারা লেম্বুপানি আনছে। মিস্টার অডিক্যারি আমাকে ফিসফিস করে বলে গেলেন, “অদ্ভুত লোক মশাই। বাগানবাড়িতে টানেস্কা নাম্বার ওয়ান, আর বউ-এর সামনে রামকেষ্ট মিশনের সাধু।”

দেখলাম মার্কনি হোটেলের হলটা ভরে উঠেছে। সায়েব মেম থেকে আরম্ভ করে, সর্ব জাতের লোক হাজির হয়েছেন।

টিকিটের চাপ খুব বেশি ছিল নিশ্চয়, কারণ এত ঘেঁষাঘেষি টেবিল লাগানো হয়েছে যে, নড়া-চড়া করতেও অসুবিধে হচ্ছে। আমার অদূরে বসেছেন এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক। সস্ত্রীক এসেছেন কয়েকজন পূর্ব ইউরোপীয় অতিথি নিয়ে। এঁরা হয়তো কোনো নতুন কারখানার সঙ্গে যুক্ত, কিংবা ট্রেড ডেলিগেশনে কলকাতায় এসেছেন। এঁদের পানশক্তি সম্পর্কে গল্প শুনেছিলাম, কিন্তু এই প্রথম চোখে দেখছি।

পাশের টেবিলেই এক বাঙালী পরিবার বসেছেন। ভদ্রলোক তাঁর গৃহিণীকে ফিসফিস করে বলছেন, “এসব সায়েব যা-তা জিনিস! এক-একটি পেট্রলের ট্যাঙ্ক! যতই ঢালুক, ওদের কিছু হবে না।”

ভদ্রমহিলা এবার স্বামীকে বললেন, “ওরা যাই করুক, তুমি বেশি খেও না। একটা পেগ নিয়ে চুপচাপ বসে থাক। আমাকে একটা শেরি দিতে বল।” ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশের মত। নিখুঁত ব্লু স্যুট পরেছেন। আর স্ত্রীও খুব স্মার্ট। পাশেই একটি মেয়ে আঁটসাঁট জিন প্যান্ট পরে বসে আছে। ভারি মিষ্টি দেখতে। ভদ্রলোক বললেন, “মিতা, তুমি কী খাবে?”

“আমিও একটা শেরি খাই মা। বড্ড নার্ভাস লাগছে,” মেয়েটি বললে।

“এখন তো নার্ভাস লাগলে চলবে না। তুমি শেরি খেও না, বরং একটা অ্যাপল জুস নাও,” মেয়ের মা বললেন।

“তা হলে একটা সাইডার খাই মা?” মেয়েটা আবদার করলে।

“না।” উত্তর দিলেন মহিলা।

“সাইডার আর অ্যাপল জুস তো একই,” মেয়ে বলে।

“এক নয়। সাইডারে একটু অ্যালকহল আছে। তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে।”

মাথা ঘুরে যাবার ভয়ে মেয়ে আপেল জুসেই রাজি হলো।

“লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টালমেন,” মাইকে এবার মিস্টার অডিক্যারির গলা শোনা গেল। “আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘দি চিয়ারফুল’-এর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। আপনারা জানেন, আজকের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা দেশজননী কেমিক্যালস, যাঁদের সালসা এবং প্রসাধন সামগ্রী কয়েক যুগ ধরে আমাদের মহিলাদের আরও সুন্দর হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। আপনারা জানেন, দেশকে ভালবাসার এক ব্রাহ্মমুহূর্তে বিদেশী শক্তির হাত থেকে মুক্তির আন্দোলনের সময় দেশের সর্বত্যাগী কয়েক জন মহান জননেতার পরামর্শে দেশকে সেবার জন্যে স্বর্গীয় বরেন্দ্র সাধু এম এসসি এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এখন এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তাঁর সুযোগ্য পুত্র নগেন্দ্রনাথ সাধুর ওপর। তিনি আজ এখানে উপস্থিত আছেন, এবং আপনাদের সকলকে নমস্কার জানাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন, কেন আমরা এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা করছি? শ্ৰীযুক্ত নগেন সাধু মনে করেন, যে-দেশের মেয়েরা সৌন্দর্যচচা অবহেলা করে সে দেশ কখনও বড় হতে পারে না। আমাদের প্রাচীন যুগ দেখুন—অমন একটা সাধারণ আশ্রমের অর্ডিনারি মেয়ে শকুন্তলা তিনিও সৌন্দর্যচর্চা করতেন। তবেই না তিনি রাজা দুষ্মন্তের নজরে আসতে পারলেন! আপনাদের প্রত্যেকের টেবিলে দেশজননী কেমিক্যালসের কয়েকটি নমুনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের অনুরোধ এগুলি আপনারা বাড়িতে নিয়ে যাবেন।”।

মিস্টার অডিক্যারি যে এমন সুবক্তা তা জানা ছিল না। তিনি বলে চললেন, “আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শ্রীযুক্ত সাধুর স্ত্রী শ্রীমতী সাবিত্রী সাধু। আরও দু-একটা কথা বলি। আমাদের মিস্ বিউটি প্রতিযোগিতায় আশাতিরিক্ত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের শর্ত ছিল প্রতিযোগীকে অবিবাহিতা হতে হবে, বয়স সতেরোর বেশি হওয়া চাই এবং সাধুপরিবারের জাতীয়তার কথা ভেবে আমরা আরও চেয়েছিলাম, প্রতিযোগীকে অবশ্যই ভারতীয় হতে হবে। আমাদের মোট প্রতিযোগী আসে ৮১ জন। কিন্তু আমরা প্রাথমিক নির্বাচনে ২১ জনকে বাছাই করি। তাঁদেরই আজকে আপনাদের সামনে দেখতে পাবেন—আপনাদেরই চোখের সামনে নির্বাচন করা হবে সেই সুন্দরী ভাগ্যবতীকে, আগামীকাল থেকে সারা পৃথিবীর কাছে যিনি মিস বিউটি বলে বিখ্যাত হবেন।”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “প্রতিযোগীদের সমস্ত বিবরণ পুস্তিকায় পাবেন। এই পুস্তিকা তিন টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের প্রোগ্রামের শেষ আইটেম এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা। তার আগে আছে নৃত্য। আপনারা আসুন এখানে নৃত্য করুন। নৃত্যের জন্যেও নানারকম প্রাইজ আছে। তারপর ডিনার। সঙ্গে আমাদের মার্কনি হোটেলের বিখ্যাত ক্যাবারে।

“নাউ কাম অন লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। ডান্স টু দি টিউন অব জলি অ্যাণ্ড হিজ অর্কেস্ট্রা। আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘দি চিয়ারফুল’ চান আপনারা সবাই চিয়ারফুল হন। পৃথিবীকে যারা নিরানন্দ করছে, তারা জানে না, কী অপরাধ করছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মটো: ড্রিংক, ডান্স, ডাইন, এগেন ড্রিংক অ্যাণ্ড ডান্স।”

মিস্টার অডিক্যারি মাইক ছেড়ে দিলেন। ওঁর হাত থেকে মাইক নিলেন মার্কনি হোটেলের টমাস। বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা টেবিল ছেড়ে ফ্লোরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাইকে টমাস আহ্বান জানালেন, “আরও আসুন। কাম অন্, ডান্স। ডান্স টু দি টিউন অব জলি অ্যাণ্ড হিজ বয়েজ।”।

চটুল নৃত্যের সুর বেজে উঠল। আলো কমিয়ে দেওয়া হলো। এবার অনেকেই নাচতে শুরু করলে। পাশের টেবিলের মেয়েটা বাবা-মাকে বললে, “তোমরা নাচবে না?”

মা রাজি হলেন না। “না বাপু এখন আর নাচতে পারি না। শুধু তোমার জন্যেই এসেছি।” সামনের টেবিলের পাঞ্জাবী মহিলাকে নিয়ে একজন বিদেশী অতিথি নাচতে শুরু করলেন।

মিস্টার অডিক্যারি এসে আমার টেবিলে বসলেন। বললেন, “একটু গলা ভিজিয়ে নেওয়া যাক।”

“আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?” জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার অডিক্যারি।

“মোটেই না। আমিই বরং আপনার অসুবিধে করছি।” “আরে মশাই, এই তো আমার জীবন। নিন একখানা প্রোগ্রামের বই, শুধু শুধু তিন টাকা নষ্ট করবেন কেন? দেখবেন বইটা, অনেক গল্পের মেটিরিয়াল পেয়ে যাবেন।”

বেশ তাড়াতাড়িই একটা পেগ শেষ করে ফেললেন মিস্টার অডিক্যারি।

বললেন, “নাচ শেষ হলেই আমাকে আবার যেতে হবে মেন টেবিলে। নাচের রেজাল্ট ঘোষণা করতে হবে।

“পুরস্কার কী দিচ্ছেন?”

“একখানা করে বেলুন আর একখানা করে পাউডারের বাক্স। আরে মশাই, বোতলের এমন গুণ, পেটে পড়লে সব কিছুই ভাল লাগে।”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “কেমন দেখলেন আমার নগেন সাধুকে?”।

আমি চুপ করে থাকি। মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “আপনাকে বলব ওঁর কীর্তির কথা। একদিন বালিগঞ্জে নিজের বাড়িতে থাকেন, পরের দিন বরানগর বাগানবাড়িতে রক্ষিতার কাছে যান। দেখুন স্যার, এই বরানগরে আপনাদের রামকৃষ্ণদেবও থাকতেন, আবার আমাদের নগেন সাধুও পায়ের ধুলো দেন।”

“ওঁর স্ত্রীর তা হলে তো মুশকিল। ছেলেপুলে ক’টি?”।

“বড় ছেলেকে তো দেখলেন, আরও দুটি আছে—বে-থা হয়েছে। মেয়েও তিনটি। অসুবিধা বলছেন? আপনি যে আবার হাসাতে পারেন তা জানতাম না। স্ত্রী, ছেলেপুলে, পুত্রবধূ সবাই বেশ সহ্য করছে, ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছে।”

আমার রাগ হয়ে গেল। বললাম, “এসব আগের দিনে চলত। এখন নয়। এখন হিন্দু আইনে ডাইভোর্স পর্যন্ত রয়েছে।”

“ডাইভোর্স!” হা-হা করে হাসলেন মিস্টার অডিক্যারি। ভাগ্যে খুব জোরে নাচের বাজনা বাজছে, হলে সবাই এ হাসি শুনতে পেত। “ডাইভোর্স এখন কে কাকে করে? ছেলেরাই তো সিটিয়ে আছে, কোনো ছুতো ধরে বাপ না মাকে ডাইভোর্স করে দেয়। আর স্যার, গরিবের বাড়িতে স্বামীর একটু পদস্খলন হলেই বউ চলে যায়। বড়লোকদের অন্য ব্যাপার। টাকা এমন জিনিস যে, বউ, ছেলে, মেয়ে, জামাই, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই সহ্য করবে।”

“বুড়ো বয়সে ভীমরতি একেই বলে,” আমি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম।

“প্রথম দিকে সাধুগিন্নী নাকি কান্নাকাটি করেছিলেন। অভিমানও হয়েছিল, যখন এই নতুন মেয়েটাকে কর্তা পাকাপাকিভাবে রাখলেন। তারপর সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন বিকেলে গিন্নী অফিসে ফোন করে খবর নেন, ‘আজ বাড়ি ফিরবে নাকি! না ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেব’?”

আর এক ঢোক খেয়ে অডিক্যারি বললেন, “দোষ দিতে পারেন না, স্যার। এই বিরাট বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি চাকরবাকর ছেড়ে ভদ্রমহিলা কোথায় যাবেন? চোরের ওপর রাগ করে আজকাল কেউই মাটিতে ভাত খেতে রাজি নয়।”

এবার বাজনার সুর নেমে আসছে। নাচ থেমে যাবার সময় হলো। মিস্টার অডিক্যারি উঠে গেলেন।

মিস্টার অডিক্যারি নাচের ফলাফল ঘোষণা করলেন। বিজয়ীরা জোড়ে জোড়ে এসে তাঁদের বেলুন ও পাউডার নিয়ে গেলেন। চারিদিকে হাসি ও আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গেল। মার্কনি হোটেলের লোকটা ঘোষণা করলে, “এবার ডিনার সার্ভ হবে।”

ডিনারের মেনু টেবিলের ওপরেই ছিল। মেনু দেখে পাশের টেবিলের মেয়েটি বললে, “আমি কিন্তু স্যুপ ছাড়া আর কিছুই খাব না।”

“কেন? অন্য খাবার কী দোষ করলে?” মা জানতে চান।

মেয়ে বললে, “যা বিরাট লিস্টি। তার ওপর মার্কনি হোটেলের খাওয়া। ওসব খেলেই আমার ঘুম এসে যাবে।”

“ঘুম আসে আসবে। বিউটি কম্পিটিশন আরম্ভ হতে এখনও অনেক দেরি,” মা আশ্বাস দিলেন।

“রক্ষে করো! ঘুম পেলেই আমার চোখ দুটো ফুলে ওঠে। সমস্ত চান্সটা নষ্ট হয়ে যাক আর কী!”

মা কিছুতেই রাজি করাতে পারলেন না। মেয়ে শুধু স্যুপের ওপরেই রইল। ডিনারের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ক্যাবারে নাচ। বিখ্যাত নাচিয়ে লোলাকে আজ স্পেশালি আনা হয়েছে। লোলার সঙ্গে আছে লোক্যাল ছেলে-নাচিয়ে সুলতান। দু’জনে মিলে ওরা নাচল—আবদুল্লা ও মর্জিনা। তারপর আর একটি মেয়ে—স্নেক ডান্স। তারপর হাওয়াই নৃত্য। হাওয়াইতে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কিন্তু ওখানে অমন নাচ তো দেখিনি। মিস্টার অডিক্যারি বড় টেবিলে বসে খাচ্ছেন। মিস্টার সাধু হুমড়ি খেয়ে অর্ধবিবসনা নৃত্য দেখছেন। পুত্রবধূটি মনে হলো একটু লজ্জায় পড়ে গিয়েছে। বড় টেবিলে আরও কয়েকজন আছেন। এরা কলকাতার কেষ্টবিষ্ট হবেন।

কিন্তু পরে ব্যাপারটা বুঝলাম। ডিনারের শেষে আর একটা শো আরম্ভ করে দিয়েই মিস্টার অডিক্যারি আমার কাছে ঘুরে গেলেন। বললেন, “ওখানে আমার বিচারকরা আছেন। আর আছেন কয়েকজন ফিউচার ক্লায়েন্ট। সাধুমশায় তো আজকের ফাংশন করেই শেষ। আমার হাজার চার-পাঁচেক থাকবে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে। কিন্তু তাতে আর ক’দিন? তারপর তো আমাকে আবার শো করতে হবে।”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “খুব বড় বড় কোম্পানিরা ঘাগী হয়ে গিয়েছে। তারা আমাদের কাছে আসতে চায় না। আমাদের তাই ছোটখাট পার্টি ধরতে হয়। আমার সামনে রয়েছে বেচু নাগ। ওর বাবা আগরপাড়ার ইজের ডজনদরে আপনাদের হাওড়া হাটে বিক্রি করত। তারপর যুদ্ধের সময় টু-পাইস করেছিল মিলিটারিদের প্যান্ট সাপ্লাই করে। এখন ছেলে উড়তে শিখেছে। মেয়েদের জামার কী সব ফ্যাক্টরি না কী করছে। ইচ্ছে একটা ফ্যাশন-শো লাগায়। তা আমি মশায় টাকা পেলে কেন ফ্যাশন-শো অর্গানাইজ করে দেবো না, তারপর তোমার কোম্পানির জামা বিক্রি হোক আর না হোক।”

“ভালই তো,” আমি বলি।

“ভালমন্দ জানি না, গোটা তিনেক বড়বাজারের মালও পাকড়াও করেছি। বাপেদের গদি ছিল, ছেলেরা এখন মডার্ন হবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। ওদের জন্যে একটা স্টিমার পার্টি করবো—সিনেমা স্টার বম্বে থেকে আসবে। স্টিমারে ফিল্মস্টার গান গাইবে, সবার খাতায় অটোগ্রাফ করে দেবে—ত্রিশ টাকা করে টিকিট হবে। একখানা স্টিমারে যদি না ধরে সঙ্গে গাধাৰোট জুড়ে দেবো।”

মিস্টার অডিক্যারি আবার উঠে গেলেন। অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশ ঘোষণা করলেন। অতিথিরা আবার নাচবেন।

বাজনার তালে তালে নাচ শুরু হলো। আলোগুলো নিবতে নিবতে প্রায় এক মিনিটের জন্যে পুরো অন্ধকার হয়ে গেল। সমস্ত হল-ঘরে একটা চাপা আনন্দের গুঞ্জন উঠলো—তারপর আবার আলো। মিস্টার অডিক্যারি আবার টেবিলে একপাত্র খেয়ে গেলেন। বললুম, “আসল আইটেম এত দেরিতে। দিয়েছেন কেন?”

“সাধে কি আর দিয়েছি।” দুঃখ করলেন মিস্টার অডিক্যারি। “ওই বেটা মার্কনি হোটেলের ম্যানেজার টমাসের পাল্লায় পড়ে। বলে তাড়াতাড়ি হয়ে গেলে ড্রিংকস বিক্রি হবে না। যত দেরি, তত বিক্রি, বুঝতে পারছেন তো? আমাকেও অবশ্য পাঁচ পার্সেন্ট দেবে, তবে সে আর ক’টা টাকা বলুন?”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “একটা শুভলক্ষণ, পাবলিক ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন। স্যার—ভদ্রঘরের এত মেয়ে-পুরুষ এসেছে তো আমাদের শো দেখতে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আধুনিকতাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে না পারলে, ইণ্ডিয়ার কিছু হবে না। যারা আমাদের প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে, তাদের দেখুন। ভাল ভাল ফ্যামিলির মেয়ে কারুর বাবা অফিসার, কারুর বাবা ডাক্তার, কারুর বাবা জজ। মেয়েরা কেউ লরোটোতে পড়ে, কেউ লেডি ব্রেবোর্ন, কেউ য়ুনিভার্সিটিতে। আমাদের পাশের যে টেবিল দেখছেন, ওই ভদ্রলোক তো প্রাইভেট ফার্মে মস্ত চাকরি করেন। মা বাবা দু’জনেই মেয়েকে উৎসাহ দিচ্ছেন। কিছু বলা যায় না—এইসব বিউটি প্রতিযোগিতায় রেজাল্ট করলে সিনেমায় চান্স আসতে পারে। আর নায়িকা যদি নাও হয়, মডার্ন সোসাইটিতে ভাল স্বামী পাওয়া যাবেই। আজকালকার ছেলেরা স্যার, বলতে প্রাউড ফিল করে যে, আমার ওয়াইফ ভূতপূর্ব মিস লাকনৌ, কিংবা একস্‌-মিস চণ্ডীগড়।”

আমি শুনে যাচ্ছি মিস্টার অডিক্যারির কথা। ভদ্রলোক বললেন, “ছোট মুখে বড় কথা শোনায়, একদিক দিয়ে রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমাকে তুলনা করতে পারেন। রবি ঠাকুর সমালোচনায় কান না দিয়ে ভদ্রঘরের মেয়েদের স্টেজে অভিনয় করিয়েছিলেন, নাচিয়েছিলেন। আমি সেই ট্রাডিশনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি।”

“সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আপনারা কী কী দেখেন?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“অনেক কিছু স্যার,” উত্তর দিলেন মিস্টার অডিক্যারি। “সৌন্দর্য এমন জিনিস যা ঠিক হাতের মুঠোয় ধরা যায় না। আমরা ফিগার দেখি, মুখচোখের গড়ন দেখি, চোখের চাহনি দেখি, হাঁটা-চলা দেখি, ব্যক্তিত্ব দেখি—সবের জন্যে পয়েন্ট আছে। ভাববেন না, শুধু ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ভাল হলেই রেজাল্ট ভাল হবে। এই তো একটা মেয়ের স্ট্যাটিসটিকস ছিল ৩১-২১-৩২। তবু তাকে ফাইনালে উঠতে দিলুম না। মেয়েটার গ্রেস, ছিল না।”

পাশের টেবিলের মেয়েটি উঠে গেল, সঙ্গে তার মা-ও গেলেন। আরও অনেকজনকে উঠে পড়তে দেখা গেল। মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “এবার মেয়েরা সব স্টেজের ভিতরে যাচ্ছে। ওখানেই সাজগোজ করবে। চ্যাঙ লিঙ থেকে চীনে মেয়েরাও এসে গিয়েছে। ওরাই সব হেয়ারস্টাইল ঠিক করে দেবে।”

“যাই এবার, নগেন সাধুকে সামলাই,” বললেন মিস্টার অডিক্যারি।

“আপনি বার বার উঠে আসছেন, সেটা ভাল দেখায় না।”

“সেটা কি আর শখ করে উঠে আসছি। ভদ্রলোকের পাশে বসা যায় না, মাঝে মাঝে এক-একটা যা চোঁয়া ঢেকুর তুলছেন।”

আরও ঘণ্টাখানেক ধরে নাচ, গান, ম্যাজিক এবং ক্যাবারে চলল। সঙ্গে পানীয়। দু’একটা বেয়ারাও দেখলাম টলমল করছে। বড় বড় পার্টিতে এমন হয়ে থাকে। বেচারারা লোভ সামলাতে পারে না, লুকিয়ে সায়েবদের জিনিস অর্ধেক খেয়ে জল ঢেলে নিয়ে আসে। আর তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলতে হয়। বলে নেশাটা একেবারে মাথায় উঠে যায়।

একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। মিস্টার অডিক্যারি ঘোষণা করলেন, “এবার মিস বিউটি প্রতিযোগিতা।” বিচারকরা এক-একটা লম্বা কাগজ নিয়ে মাইকটা নিল। মিস্টার অডিক্যারি জজদের একজন। মিস্টার নগেন সাধু গুম হয়ে বসে আছেন, মাঝে মাঝে চারদিকে তাকিয়ে দাঁত খুঁটছেন। মিসেস সাধুও জজদের মধ্যে একজন।

হলের সবাই প্রোগ্রামের যেখানে সুন্দরীদের নাম এবং অন্যান্য বিবরণ দেওয়া আছে তা খুলে বসলেন। নামের পাশে একটা করে নম্বর রয়েছে। আর তার পাশে স্ট্যাটিসটিকস—অর্থাৎ বুক, কোমর এবং নিতম্বের মাপ। এক নম্বর মেয়েটির নাম শীলা অরোরা। টমাস মাইকে ঘোষণা করলেন নাম্বার ওয়ান। অমনি ব্যাণ্ড বেজে উঠল। স্টেজের পিছনের পর্দা সরে গেল—বেরিয়ে এলেন অষ্টাদশী শীলা অরোরা। পরনে শালোয়ার কামিজ—বেশ লম্বা মেয়েটি। হাতে একটা হাতপাখার মতো, তারই দু’দিকে বড় বড় করে লেখা—১। শীলা অরোরা বেশ কায়দা করে সামনে এগিয়ে এল, ঠিক যেমনভাবে স্লো মোশন পিকচারে আসে। মিষ্টি মিষ্টি হাসছে শীলা, ফ্লাডলাইটের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ওঁর পিছনদিকটাও বিচারকদের দেখবার সুযোেগ দিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে আবার আস্তে আস্তে ফিরে গেল স্টেজের মধ্যে। হাততালি পড়ল। এবার দু’ নম্বর। তারপর তিন নম্বর। তিন নম্বরকে দেখে পাশের টেবিলের কে একজন বললে, “তুমি কেন বাওয়া এই কমপিটিশনে? বাসনমাজা ঠিকে-ঝিদের কমপিটিশনেও তুমি রেজাল্ট করতে পারবে না।”

আমাদের পাশের মেয়েটির নাম সুমিতা সেন—পনেরো নম্বর। শাড়ি পরে, সেজেগুজে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। সুমিতা সেনের মা তখনও গ্রীন রুমে রয়েছেন। সুমিতার বাবা বেশ আগ্রহের সঙ্গে দর্শকদের তাঁর কন্যা সম্বন্ধে রিঅ্যাকশন লক্ষ করছেন। হাততালিটা বেশ জোরেই পড়ল।

একে একে একুশ জনই স্টেজে দর্শন দিয়ে গেলেন। কাছাকাছি এক টেবিলের মন্তব্য, “দুর শালা, এই জন্যে চল্লিশ টাকার টিকিট কাটালাম। সুন্দরী তো তেমন দেখলাম না।” সঙ্গের বন্ধু বললেন, “এই চুপ কর। লোকে ভাববে মফস্বল থেকে এসেছিস। আসল সুন্দরীরা কখনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় আসে না।”

আর একটা টেবিলে দেখলাম বেশ ভিড়। বেশ কয়েকটি গুড়ের নাগরি টাইপের ছেলে নিজেদের টেবিল থেকে উঠে এসে ওই টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। কারণটা এবার বুঝলাম। ওখানে জুয়া চলেছে। কে মিস বিউটি হবে, কে দ্বিতীয় হবে তাই নিয়ে বেটিং। এক ছোকরা আমার কাছেও এসে। জিজ্ঞেস করে গেল, “কুছু খেলবেন নাকি?”

এবার দ্বিতীয় রাউণ্ড। আবার ডাক—পড়ল নাম্বার টু। এক নম্বর প্রথম রাউণ্ডেই হেরে গিয়েছে। দু নম্বর আবার ঠিক পুরনো কায়দায় হাতে নম্বরের কার্ডটা ধরে দর্শকদের সামনে এসে দাঁড়াল। এবার। বেশ সাহস বেড়ে গিয়েছে মেয়েটির। প্রথমবারের মতো ভীরু-ভীরু চোখে তাকাচ্ছে না।

এইভাবে একুশ জনের মধ্যে মাত্র দশ জন এসে বিচারকদের সামনে দাঁড়াল।

জুয়ার টেবিলে বুঝলাম পনেরো নম্বরই হট ফেভারিট। পনেরো নম্বরের সুমিতা সেনকে সত্যিই অন্যের তুলনায় ভাল দেখাচ্ছে।

এবার তৃতীয় রাউণ্ড। কিন্তু তার আগে, বিচারকরা কী সব লেখালিখি করে কাগজগুলো মিস্টার অডিক্যারির হাতে দিয়ে দিলেন। মিস্টার অডিক্যারি সেইগুলো নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে কী সব হিসেব করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে মার্কনি হোটেলের ব্যাণ্ড একটা চটুল বাজনা বাজিয়ে চলেছে।

দর্শকরাও অনেকে নিজেদের লিস্টিতে দাগ দিচ্ছেন—মন্তব্য লিখছেন। লিস্টিতে লেখা স্ট্যাটিসটিকস সম্বন্ধে কেউ কেউ চিৎকার করেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

এবার মৃদু গুঞ্জন উঠল। মিস্টার অডিক্যারি লিস্টিটা টমাসের হাতে দিয়ে দিলেন। টমাস ঘোষণা করলে, “লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, প্রতিযোগিতা এবার বেশ জমে উঠেছে। এবার পরের রাউণ্ড। আমি ডাকছি—নাম্বার টু।” দু’ নম্বর তাহলে তৃতীয় রাউণ্ডে উঠল।

“আমি ভাবছিলাম ছুঁড়ি পারবে না,” একজন কাছাকাছি টেবিল থেকে মন্তব্য করলে।

দু’নম্বর আবার এসে দাঁড়াল ফ্লাডলাইটের সামনে। দু’নম্বর এবার একটু ঘেমে উঠেছে। যদিও প্রতিবার ফিরে যাবার পরে মেক-আপ আবার তৈরি করা হচ্ছে। দু’ নম্বর এবারও হাততালি পেল। নাম ঝর্না রাহা।

দশ জনের মধ্যে এবার মাত্র পাঁচ জন। হট ফেভারিট পনেরো নম্বরের কোনো অসুবিধেই হয়নি পরের রাউণ্ডে উঠতে।

এমনি করে শেষ পর্যন্ত যখন ফাইনাল রাউণ্ড হলো এবং ফাইনাল রেজাল্ট বেরুলো, তখন সবাই একটু অবাক। পনেরো নম্বর সেকেণ্ড হয়েছে। ফার্স্ট আঠারো নম্বর—পাঞ্চালী দাস—যাকে কেউ আশাই করেনি। সেকেণ্ড রাউণ্ডে উঠবে কি না তাতেই সন্দেহ ছিল!

মিস্টার অডিক্যারি এবার মাইক ধরে বললেন, “লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, এবারের মিস বিউটি টাইটেল পেলেন মিস পাঞ্চালী দাস। এবার ওঁকে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন, দেশজননী কেমিক্যালসের কর্ণধার এবং আজকের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা মিস্টার নগেন সাধুর সহধর্মিণী শ্রীমতী সাবিত্রী সাধু। সেই সঙ্গে মিস পাঞ্চালী দাস পাচ্ছেন নগদ পাঁচ শ’ টাকা এবং একসেট কসমেটিকস্। অন্য সমস্ত প্রতিযোগীরাও একসেট দেশজননী কসমেটিকস্ পাবেন।

অনেকগুলো ফ্লাডলাইট এক সঙ্গে জ্বলে উঠল। ক্যামেরায় ফ্ল্যাশল্যাম্প ঝিলিক দিল। মিসেস সাধু এবার মিস পাঞ্চালী দাসের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিলেন। হাতে একটা রাজদণ্ডের মতো কী দিলেন। মিস বিউটির দু’পাশে এসে দাঁড়াল দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার বিজয়িনীরা।।

এবার মস্ত লম্বা একটা হাততালি পড়ল।

শো শেষ হয়ে গিয়েছে। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেন। আমি অপেক্ষা করছি মিস্টার অডিক্যারির জন্যে। এই রাত তিনটের সময় হাওড়া ফিরে যাওয়া বেশ সমস্যা।

ভি-আই-পি অতিথিদের বিদায় করে মিস্টার অডিক্যারি ফিরে এলেন। বললেন, “চলুন, আমার গাড়িতে আপনাকে তুলে দিয়ে আসি। ড্রাইভার আপনাকে হাওড়াতে নামিয়ে দিয়ে আসুক। ততক্ষণ আমার হিসেবপত্রগুলো টমাসের সঙ্গে মিটিয়ে ফেলতে পারবো।”

সিড়িতে নামতে নামতে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “কেমন বুঝলেন?”

“বেশ একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। তবে দেখলুম, আমরা অর্ডিনারি লোকরা এক্সপার্টদের মত সৌন্দর্য যাচাই করতে পারি না। আমি আশা করছিলাম পনেরো নম্বর ফার্স্ট হবে। আঠারো নম্বরের কথা ভাবিইনি।”

ফিসফিস করে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “আর লজ্জা দেবেন না, স্যার। ওই যে মিস পাঞ্চালী দাস, উনিই তো নগেন সাধুর রক্ষিতা। ওর আব্দারেই তো নগেনবাবু এই বিউটি কমপিটিশনে টাকা ঢাললেন। বড়লোকের খেয়াল, আমাকে দিয়ে কণ্ডিশন করিয়ে নিলেন ওঁর প্রাণেশ্বরীকেই মিস বিউটি করাতে হবে। আমার তখন বেজায় টাকার দরকার, রাজি হয়ে গেলাম।”

“কমপিটিশনে এমন হয় নাকি?”

“মোটেই না। নাইনটিনাইন পার্সেন্ট কেসে আমরা যোগ্যকেই পুরস্কার দিয়েছি”, উত্তর দিলেন। মিস্টার অডিক্যারি। “কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো উপায় ছিল না।”

মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “আজকে কিন্তু ভাগ্যে সব ক’টি জজ আমার নিজের লোক ছিল, একমাত্র মিসেস সাধু ছাড়া। আর যা ভয় করেছিলাম ঠিক তাই হলো। মিসেস সাধুর ভোট পাঞ্চালীর বিরুদ্ধে পড়ল। ফোর-ইজ টু-ওয়ানে পাঞ্চালী জিতল।”

আমি তখন গাড়িতে বসে পড়েছি। বিদায় জানিয়ে, গাড়ির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে মিস্টার অডিক্যারি বললেন, “আপনি অযথা চিন্তা করবেন না—কোনো কোনো বড়লোকের অমন এক-আধটা শখ মাঝে মাঝে হয়!”

১৩৭৭ (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *