বাসমতী
বসবার ঘরের জানালা দিয়ে ও চেয়েছিল।
ঠাকুরানি পাহাড়ের পটভূমিতে কতকগুলি শালগাছের নীচে অনেক নারী-পুরুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে। ওখানে যে কোনো হাট আছে তা জানত না রাহুল—কিন্তু অনেক লোকের ভিড় দেখতে পাচ্ছিল। জায়গাটা মালভূমির মতো। আদিবাসী মেয়েরা সেদিক থেকে ফিরে আসছিল—লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ খনির মজুরেরা হাঁড়িয়া খেয়ে টলতে টলতে পথ বেয়ে যাওয়া-আসা করছিল। বড়ো বিলের রবিবারটি ক্যালেণ্ডারের পাতার একটি লাল অক্ষরে সীমিত না থেকে একটি রঙিন চলন্ত জলছবির মতো এই বাসন্তী বিকেলে গড়িয়ে চলেছিল।
রাহুল বলল, চন্দ্রভান আর এককাপ চা খাওয়াও।
এমন সময়ে জয়তী বসবার ঘরে এল, বলল, সারাদিন তো জানলায় বসে কাটিয়ে দিলে, কাল যে যেতে হবে—গোছগাছ কিছু করেছ?
না। এইবার করব। মনটাকে একটু গুছিয়ে নিই—তার পর জিনিসপত্র সব গোছগাছ করব। দেখো।
জয়তী একবার বিরক্তির চোখে চাইল, তার পর বলল, মন গোছানো এত সহজ নয়। মনে অনেক ধুলো আছে। তোমার মনে।
রাহুল চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। বলল, ধুলো নয়, এখানে এমনি ধুলো নেই। ব্লু ডাস্ট—সকালে দেখলে না? ব্যানার্জিবাবু দেখালেন। সুন্দর নীল মিহি ধুলো।
ঈরে—!
ঈরে কী? আমার মনে যা ধুলো আছে তা এমনই ধুলো। লোহার খনিতে চৈত্রমাসে হাওয়া দিলে যেমন আবিরের মতো রঙিন ধুলোর ঝড় ওঠে—তেমনই ধুলো। আবিল নয়।
হ্যাঁ। তোমার তো সব কিছুই অনাবিল।
নয়?
জানি না। আমার ওসব কাব্যি করার সময় নেই। বিকেলে বাসমতী আসেনি। কাপড়-চোপড়গুলো তোলা হয়নি! এখন আমার অনেক কাজ।
কাজ তোমার চিরদিনই থাকবে। পরশু কলকাতায় পৌঁছে কাজ আরও বাড়বে—কিন্তু আজকের বিকেলের জানালা দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তা না দেখলে পরে আর দেখতে পাবে না।
জয়তী বলল, নাই বা পেলাম। কীই বা দেখার আছে! তুমি দেখো। আমার দরকার নেই। বলে, আঁচল উড়িয়ে আবার ভেতরের ঘরে চলে গেল।
এমন এমন মুহূর্তে রাহুলের কেবলই কৈলির কথা মনে পড়ে যায়। ভারি বেড়াতে ভালোবাসত কৈলি। ওর দেখার চোখ ছিল। এমন আনন্দিত অবকাশে শাড়ির হিসেব করে কি স্যুটকেস গুছিয়ে ও কখনোই ঘরে কাটাত না—এতক্ষণে কৈলি নিশ্চয়ই একটি সিল্ক-শাড়ি জড়িয়ে চুলে একটি গোলাপ গুঁজে নিয়ে বার্ড কোম্পানির বাংলোর দিকে হাঁটতে চলে যেত। মুরগা-বেরার ঝরনার মতো কলকলিয়ে হাসত। আর রাহুলের সমস্ত সত্তা খুশিতে হিস হিস করে উঠত।
চন্দ্রভান চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে রাহুল ভাবতে লাগল—কৈলি তার হৃদয়ের একটি বিশেষ অংশকে বরাবরের মতো অসাড় করে দিয়েছে। আর কেউই সে অংশে সাড়া জাগাতে পারবে না। ওর হৃদয়ের গাড়ির একটি ক্যুপে কৈলির জন্যে বরাবর খালি করে চাবি বন্ধ করে রেখেছে ও। যদি কোনোদিন কোনো শেষরাতে কোনো অচেনা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মিটমিটে গ্যাসের আলোয় কৈলি দাঁড়িয়ে থাকে, যদি ফিস ফিস করে ভোরের বাতাসের মতো শুধোয়—এখনও কি জায়গা আছে?
সেদিন রাহুল ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলবে, আছে জায়গা, তোমার জায়গা : জায়গা আছে। কত অসম্ভব স্বপ্নও তো সত্যি হয়—কে বলতে পারে যে, কোনো শীতের রাতে তার স্বপ্নও সত্যি হবে না?
জয়তী বলল, শাড়ি বদলে এলাম, যাবে তো চলো।
কোথায়?
কেন? ওই সেই বার্ডের বাংলোর কাছে। সেদিকে তাকিয়েই তো বসে আছ।
যাবে? খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাহুলের মুখ। চলো, তাহলে।
ওরা দুজনে বাড়ি ছেড়ে বেরোল।
জয়তী নিজের মনেই বলতে লাগল, বাসমতী এখনও আসেনি। ওকে ওর বর খুব মেরেছে আজ দুপুরে।
কেন?
তা আমি কী করে জানব? তবে ভাসস বলছিল, বাসমতী নাকি নোয়ামুন্ডির একটি আদিবাসী ছেলেকে ভালোবাসে—সে ছেলেটি রবিবার হলেই বাসে করে এখানে চলে আসে। বাসমতীর সঙ্গে তেমন মেলামেশার সুযোগ নেই—শুধু যখন বাসমতী হাটে যায়—তখন ও বাসমতীকে দেখে—সওদা করতে করতে দু-একটি কথাও বলে।
রাহুল বলল, ব্যাস, শুধু এই জন্যে এত দূর থেকে আসে?
জয়তী শাড়িটার সামনের দিকটা ঠিক করতে করতে বলল, হয়তো শুধু এইজন্যে নয়—বাসমতীর বর শক্ত পুরুষ না হলে হয়তো আরও অনেক কিছুর জন্যে আসত। নীচ হবার সুযোগ পায় না, তাই মহৎ হয়—সবাইকে দেখায়—প্রেম কী বৃহৎ ব্যাপার। তোমারই মতো—আরেকজন।
রাহুল জয়তীর চোখের দিকে চাইল। কোনো কথা বলল না।
যাবে? জয়তী অধৈর্য গলায় শুধোল।
চলো। বলে রাহুল উঠে দাঁড়াল। তারপর কুয়োতলা পেরিয়ে ওরা ঠাকুরানি পাহাড়ের দিকে মুখ-চাওয়া মালভূমির ওপরে ওঠতে লাগল।
তখনও রোদ ছিল। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। মার্চের প্রথম। দূরে মাথা উঁচু করা বোনাই রেঞ্জ মেঘের মতো দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার হলেই বোলানি, জোড্ডা ও কিরিবুরুর আলো জ্বলে উঠবে পাহাড়ের গায়ে—তখন দারুণ দেখাবে সমস্ত পাহাড়টা।
চড়াই উঠতে উঠতে রাহুল ভাবতে লাগল।
জয়তী বলল, এই, ওই দিকের হাটে যাবে? চলো না, কী পাওয়া যায় দেখি।
রাহুল বলল, চলো।
অনেকটা উঠে ছোটো গির্জাটির কাছাকাছি যে হাটের ভিড় ওরা ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছিল, সেখানে এসে পৌঁছোল। আশ্চর্য! সওদা কিছুই নেই। শুধু ছড়ানো-ছিটোনো কচি শালপাতায় ভরে রয়েছে সমস্ত অঞ্চলটি—তখনও কিছু ছেলে-মেয়ে বসে আছে। কিছু ভাজাভুজি ও মিষ্টি সামনে সাজিয়ে দু-একজন বসে আছে—আর প্রায় সকলের হাতেই একটি বা একাধিক শিশি। তাতে সাদা সিরাপের মতো ঘোলাটে হাঁড়িয়া। কেউ কেউ কচি শালপাতার ফানেল বানিয়ে তাতে ঢেলে খাচ্ছে। যারা হাট থেকে ফিরছে—তাদের অনেকেরই হাতে ঝোলানো মোরগ। প্রত্যেকেরই তূরীয় অবস্থা। কেউ কেউ ওদের দেখে নমস্কার করল। কেউ বলল গুড মর্নিং—সেই শেষবিকেলে। তখন মুরগি-লড়াই শেষ হয়ে গেছে। জোড়ায়-জোড়ায় বুঁদ হয়ে আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা বসে আছে। ছেলেদের অনেকেরই গা খালি—মেয়েরা বেশিই লাল শাড়িতে পলাশ ফুলের মতো ফুটে আছে।
জয়তী বলল, এখানে আসা উচিত হয়নি। লোকগুলোর চোখগুলো কেমন দেখছ না? যেন গিলে খাবে।
রাহুল বলল, মিছেই ভয় পাচ্ছ, তোমাকে গিলবে এমন অজগর রূপকথাতেও পাওয়া যায় না। যদি বা কেউ গেলার চেষ্টা করে তো গলায় বিঁধে মারা যাবে নির্ঘাত।
এমন সময়ে হাটের এককোনার একটি ঝাঁকড়া শালগাছের ছায়া থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল—বউদি—হেই বউদি!
ওরা দুজনে চমকে চাইল ওদিকে। দেখল বাসমতী ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
জয়তী বলল, দেখেছ কী খারাপ, কাজে না গিয়ে এখানে বসে আছে।
বাসমতীর কাছে যেতেই ওরা দেখল, একটি লাল শাড়ি পরে, গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বাসমতী বসে, পাশে দুটি খালি শিশি গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর একটি রক্তাক্ত অর্ধমৃত মোরগ।
বাসমতী বিষণ্ণ গলায় বলল, আমার জোয়ান মুরগাটা হেরে গেল বউদি—জিততে পারল না। ছুরিতে ফালাফালা হয়ে গেল।
জয়তীর মুখটা কঠিন হয়ে গেল, বলল, কীরে বাসমতী, তুই মেয়েমানুষ হয়ে নেশা করিস লজ্জা করে না?
বাসমতী যেন মজা পেল! বলল, তুই কী বলিস রে বউদি—লেশাটা দেখলি কোথায়—লেশা আমি করেছি বটে, কিন্তুক সে একটা অন্য লেশা—বড়ো লেশা। সেই লেশাটা কাটাবার জন্যেই তো দু-শিশি হাঁড়িয়া খেলাম রে বউদি। কিন্তু এ-লেশা কাটবার লয়। মারুক দেখি ও কত মারে আমাকে। আমার নোয়ামুন্ডির মুরগাটা মরে লাই গো—সেটা মরদের বাচ্চা, এখনও বেঁচে আছে; হাঁ।
রাহুল বলল, বাসমতী, আজ কাজে আসবে না?
বাসমতী রক্তমাখা হাতের তেলো দিয়ে হাঁড়িয়া-মাখা মুখ মুছে বলল, না গো দাদাবাবু—আজকে আমি চাকরি করব না। আজকে শুধু হাঁড়িয়া খাব আর আমার লাল মুরগাটার কথা ভাবব। তোরা পালা রে বউদি, ই জায়গাটা ভালো লাই। মেমসাহেবদের এখানে আসতে লাই।
জয়তী ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে চাইল, তার পর রাহুলের পাঞ্জাবির হাতা ধরে বলল, এখান থেকে পালাও। এখানের সব ক-টা লোক নেশা করেছে।
রাহুলেরও অস্বস্তি লাগছিল, বিশেষ করে জয়তী সঙ্গে থাকায়। ও বলল, চলো, বার্ডের বাংলোর কাছে যাই।
হাটের সীমানা ছাড়িয়ে বাঁ-দিকে মোড় ঘুরেই জয়তী বলল, ন্যাকা!
কে?
কে আবার? ওই বাসমতী ছুঁড়ি। ‘বসে বসে হাঁড়িয়া খাব আর লাল মুরগাটার কথা ভাবব!’ ব্যানার্জিবাবুর উচিত এসব সেয়ানা লোককে ছাড়িয়ে দেওয়া।
আহা! দোষ কী করল ও, ভালোবেসে ফেলেছে একজনকে—তা ও কী করবে? তুমি ওর মনের কথা কী করে বুঝবে? তুমি তো জীবনে কাউকে ভালোবাসোনি। একটা বিয়ে অনেকেই ঝপ করে করে ফেলতে পারে, কিন্তু ভালোবাসতে ক-জন পারে?
জয়তী ঝাঁঝালো গলায় বলল, তার মানে? তুমি কী বলতে চাও?
বলতে কিছুই চাই না, কিন্তু এ একটা অন্য ভালোবাসা। অফিসের বড়োবাবু আর তার অ্যাসিস্ট্যান্টের মধ্যে যেমন ভালোবাসা থাকে। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, বিয়ের পর ভালোবাসাটা, অফিস করার মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপার, শুধু দেনা-পাওনার সম্পর্ক। ঘড়ি ধরে ভালোবাসা, এ ভালোবাসা আবার ভালবাসা নাকি? ধুত।
জয়তী বলল, ভালোবাসার ওপর একটা থিসিস লিখে ফেলো। এত জ্ঞান একা আমার ওপর প্রয়োগ করলে আমার তো বাঁচা মুশকিল। তোমাকে পেতনিতে ধরেছে, ওঝা দিয়ে ঝাড়ানো দরকার।
তা ঝাড়াতে পারো, কিন্তু পেতনি যদি আমাকে ছেড়ে বাইরে আসেই, তবে হয়তো তোমারই ঘাড় মটকাবে।
ঘেন্না-মেশানো গলায় জয়তী বলল, জয়তী চ্যাটার্জির ঘাড় অত নরম নয়। অনেক অনেক দুর্দান্ত ভূতও চেষ্টা করে মটকাতে পারেনি, এ তো সামান্য একটি পেতনি।
রাহুল বলল, যাক, এসব রাগের কথা, অনুযোগের কথা শেষ হবে না; দুজনেরই। এখন, দোহাই তোমার, একটু চুপচাপ পথ হাঁটো—এখনই সন্ধে হয়ে যাবে। দোলের আর তিনদিন বাকি—দারুণ চাঁদ উঠবে। এই সময়টা প্লিজ একটু চুপচাপ থাকো।
ঠাকুরানি পাহাড়ে বার্ডের আয়রন মাইনে তখনও কাজ হচ্ছে বোধ হয়। গুম গুম গুমগুম করে আওয়াজ হচ্ছে। কীসের আওয়াজ তা জয়তী বুঝতে পারল না।
জায়গাটি ভারি নির্জন আর সুন্দর। চৈত্রের বিকেলের নরম আলো বাংলোর গাছপালায় আলতো করে আঙুল ছুঁইয়েছে।
গির্জাটি বন্ধ আছে। যে ক-দিন হল ওরা বড়ো বিলে এসেছে, একদিনও খুলতে দেখেনি ওরা গির্জাটিকে। একটি একলা টিয়া নি:শব্দে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে ঠাকুরানির দিকে চলে গেল। নীচের চাষের উপত্যকাকে, জমিগুলিকে নানারঙা গালচের মতো দেখাতে লাগল। সেই মুহূর্তটিতে ওরা দুজনেই দুজনের বুকের মধ্যে এক অসীম নির্জনতা অনুভব করল। অথচ ওরা স্বামী-স্ত্রী। ওদের মতো আপন সম্পর্ক আর কী আছে? রাহুলের হঠাৎ জয়তীর পাশ-ফেরানো মুখের দিকে চেয়ে মনে হল, যদিও জয়তীর সঙ্গে ও খায়, গল্প করে, রাতে শোয়, দিন-রাতের আঠেরো ঘণ্টা সময় কাটায়, অথচ তবু জয়তী রাহুলের কেউ নয়। ও-ই সব। অথচ ও কেউ নয়। ওর হৃদয়ের সমস্ত উষ্ণতা সবসময়ে অন্য একজনকে ও দিয়ে দিয়েছে—অনুক্ষণ একটি ছাইরঙা মুরগির মতো রাহুল সেই একটি ভাবনার ডিমে তা দিচ্ছে—যদি কোনোদিন, কোনোদিন তার স্বপ্ন সত্যি হয়, সত্যি না হলে ও নিরুপায়। কারণ ও যে সত্যি সত্যি কৈলিকে ভালোবেসে ফেলেছে, এ তো ভালোবাসার ভান নয়।
অনেকক্ষণ পর জয়তী শুধোল, ওই গুম গুম শব্দটা কীসের শব্দ? ডিনামাইটের?
না। ডাম্পারের। বড়ো-বড়ো বাওয়ার-শোভেল পাহাড় কেটে কেটে লোহার আকর ভরে দিচ্ছে ডাম্পারে। ডাম্পারগুলো কানায় কানায় ভরতি ভারী লোহা বয়ে এনে ডাম্পিং সাইটে এসে নীচে দাঁড়ানো ওয়াগনে সমস্ত ঢেলে দিচ্ছে। লোহার চাঁইগুলো ওয়াগনে পড়ছে, সেই শব্দ পাহাড়ে পাহাড়ে গুমগুমানি তুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে, এ তারই আওয়াজ।
জয়তী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তার পর বলল, নি:শেষে সব ঢেলে দিচ্ছে, বুক খালি করে?
রাহুল বলল, সব সব, এককণাও বাকি না রেখে।
জয়তী হঠাৎ ওর দিকে ফিরে দাঁড়াল। শুধোল সত্যি? এককণাও বাকি না রেখে?
সত্যি। এককণাও বাকি না রেখে।
জয়তী শেষবিকেলের আলোছড়ানো ঠাকুরানি পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রাহুলের হাতে চাপ দিয়ে কাকুতিভরা গলায় বলল, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
রাহুল খুব অবাক হল। বলল, কী?
এই সন্ধেবেলায় এই গির্জার পাশে দাঁড়িয়ে নীচের ওই নীচু উপত্যকার দিকে চেয়ে—তুমি একটি ডাম্পার হয়ে যাও।
রাহুল অবাক গলায় বলল, মানে? কী বলছ তুমি?
মানে, তুমি এতদিন এতবছর ধরে একজনের জন্যে যে বুক-ভরা ভারী-লোহার মতো বৃথা ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছ, তা এই শুভমুহূর্তে পাহাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে ঝর ঝর করে নি:শেষে ঢেলে দাও। একটুও বাকি না রেখে। তার পর একটা ডাম্পার যেমন ভারমুক্ত হয়ে ফিরে যায়, তেমন করে তোমার বুকের সব ভারমুক্ত হয়ে তুমি আমার সঙ্গে ফিরে চলো।
রাহুল চমকে উঠল। সেইমুহূর্তে নিজেকে তার সত্যি সত্যিই একটি ডাম্পার বলে মনে হতে লাগল—যার বুক-ভরা লোহার চেয়েও ভারী কিছু সবসময়ে জমে থাকে।
জয়তীর কাছে কোনো সময়েই ও ভারমুক্ত হয়ে যেতে পারেনি। সর্বক্ষণ কাছে থেকেছে, অথচ বহুদূরে। জয়তী আবার বলল, পারবে না রাহুল? চেষ্টা করো না। পারবে পারবে। চেষ্টা করলেই পারবে।
রাহুল বহুবছর পরে এখন ভালো করে জয়তীর চোখের দিকে চাইল—দেখল চোখের কোনায় দু-ফোঁটা জল চিক চিক করছে।
হঠাৎ জয়তীর জন্যে রাহুলের ভীষণ দুঃখ হল—এক নিরুপায় দুঃখ। রাহুল বলল, জয়তী, শোনো জয়তী, আমার বুকে যা বয়ে বেড়াচ্ছি তা জমা করা যায়—তিল তিল করে, বহুবছর ধরে জমা করা যায়, কিন্তু কখনো নি:শেষে ইচ্ছেমতো ঢেলে ফেলা যায় না। ভালোবাসা বড়োজোর মুলতুবি রাখা চলে। মুছে ফেলা চলে না।
জয়তীর গলা কান্নায় বুজে এল, বলল, পারবে না?
রাহুল বেশ কেটে কেটে বলল, না জয়তী, পারব না।
হঠাৎ জয়তী মুখ ফিরিয়ে নিল, মুখ ঘুরিয়েই যে পথে এসেছিল সে ঢালু পথে ছোটো ছোটো পা ফেলে ফেলে পাহাড়ে নামতে লাগল। রাহুলও মুখ ফেরাল—দেখল বোলানি আর জোড্ডা মাইনসের আলোগুলো সব জ্বলে উঠেছে—একটি চামেলি চাঁদ গুয়া-র পাহাড়ের পাশ দিয়ে উঁকি মারছে।
রাহুল ধীরে ধীরে জয়তীর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল রাহুল, ভাবতে ভাবতে পাহাড়ের গায়ে বোলানির আলোগুলোরমতো ওর মনে একটি একটি করে অনেকগুলি আলো জ্বলে উঠতে লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল, ওর সামনে বাসমতী হেঁটে যাচ্ছে। যে বাসমতী সবসময় ওর নোয়ামুন্ডির প্রেমিকের কথা ভাবে। জয়তীরও অমনই একজন প্রেমিক আছে, তাকে সে বাসমতীর মতো করেই ভালোবাসে, অথচ সেই প্রেমিক তাকে কোনোদিন তার ভালোবাসা এককণাও ফেরত দেয়নি।
জয়তীর সে প্রেমিকের নাম রাহুল, সে জয়তীর স্বামী।
হঠাৎ রাহুলের মনে হল, বাসমতীর যে বুড়ো স্বামী ওকে ভালোবাসার অপরাধে শক্ত হাতে মারে, তার সঙ্গে রাহুলের কোনো সত্যিকারের পার্থক্য নেই। জয়তীকেও তো রাহুল সবসময়ে যন্ত্রণাই দিয়েছে, মরমে মারছে, কারণ জয়তীর একমাত্র দোষ সে রাহুলকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারেনি।
রাহুল ডাকল, জয়তী।
জয়তী কথা বলল না, বেগে পথ বেয়ে নেমে চলল।
রাহুল বড়ো বড়ো পা ফেলে ওর পাশে গিয়ে পৌঁছোল—তার পর ওর পথ আগলে দাঁড়াল।
জয়তী কাঁদছিল, বলল, পথ ছাড়ো।
রাহুল বলল, জয়তী শোনো।
জয়তী মুখ ঘুরিয়ে কী একটা বলতে গেল, কিন্তু রাহুল কথা না বলতে দিয়ে দু-হাতের তেলোয় জয়তীর চোখের জল মুছোতে মুছোতে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, ইশ আমার বাসমতী, বেচারি বাসমতী।
একটা ট্রেন সাইডিংয়ের অন্ধকারে বহুদিন দাঁড়িয়েছিল।
ট্রেনটি হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে, আলো জ্বালিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে জয়তীর সমস্ত সত্তায় ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল।