বার্ড অব প্যারাডাইজ
পান্নালাল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, বুঝলি প্যালা, দারুণ পাখি জোগাড় করেছি একখানা; যাকে বলে-রামপাখি।
রামপাখি? শুনেই আমার রোমাঞ্চ হল।
তা ছাড়া কী। এখনও কারও কাছে ফাঁস করিনি–পরে তাক লাগিয়ে দেব সবাইকে। দেখবি পাখিটা!
বললুম, রামপাখি দেখে আর লাভ কী–চেখেই আসব বরং। ওটা দেখার চাইতে চাখাই বেশি দরকার।
-শাট আপ ইউ পেটুক! পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পাখিটা কিনলুম–উনি সেটা চাখবেন। তোর যেরকম নোলা হয়েছে এর পর হাতি-টাতি খেতে চাইবি।
এবার আমি দারুণ আশ্চর্য হয়ে গেলুম।
–পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মুরগি কিনলি–বলিস কী রে!
মুরগি! মুরগি কে বলেছে তোকে? পাল্লালাল খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠল।
–বাঃ রামপাখি মানে কি মুরগি নয়?
–নো! নেভার! মানে সব পাখির সেরা। পান্নালাল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, বার্ড অফ প্যারাডাইজ।
এবার আমার চোখ কপালে উঠল।
–বার্ড অফ প্যারাডাইজ! স্বর্গের পাখি। তুই কি স্বর্গ থেকে কিনে আনলি? স্বর্গে কি এত সহজেই পাখি পাওয়া যায়। আর গেলেই কী কেউ ফিরে আসে? বলতে বলতে একটা গভীর সন্দেহ আমার মনে উঁকি দিতে লাগল। সন্ধে ঘোর-ঘোর হয়ে আসছে–দেশবন্ধু পার্কের এই কোণটা বেশ নির্জন, কাছাকাছি লোকজনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি করুণ সুরে বললুম, তুই ভূত-টু-ত হয়ে যাসনি তো? তা হলে কিন্তু ভাই আমি এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ব। ভূতকে আমি দারুণ ভয় পাই।
পান্নালাল বললে : ধ্যাত্তোর ভূত। ভূত হতে আমার বয়ে গেছে। তার মতো এমন বেকুব তো কোথাও দেখিনি। আরে বার্ড অফ প্যারাডাইজ পৃথিবীতেই পাওয়া যায়। খুব দামী পাখি। পাঁচ-সাত হাজার টাকা দাম হয় এক-একটার। তোর মাথা ভর্তি গোবর, তুই কিছু জানিসনে।
–পাঁচ-সাত হাজার টাকা দাম। আমার চোখ এবার কপালে নয়, চাঁদিতে গিয়ে উঠল।
হুঁ–। মেজদা বলেছে। মেজদা প্রাণী নিয়ে বই লেখে–জানিস তো?
–বিলক্ষণ! পাল্লালালের মেজদা মোহনলালকে কে না জানে। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করবে বলো তো, বাংলা দেশে কত রকম পাখি আছে, আফ্রিকায় কী কী বক আছে, চামচিকের সঙ্গে বাদুড়ের তফাত কোথায়? মোহনলালকে রাস্তায় দেখলেই পাড়ার ছেলেপুলে দৌড়ে পালায়। তার কথা অবিশ্বাস করবে এমন বুকের পাটা কার আছে!
–সেই পাখি তুই পঞ্চাশ টাকায় পেয়ে গেলি! তোর মেজদা কী বললে?
–এখনও দেখেনি! দুপুরবেলায় কিনে দারোয়ানের ঘরে লুকিয়ে রেখেছি। দেখলে তো নাচতে আরম্ভ করে দেবে। হুঁ হুঁ।
–এমন সস্তায় পাখিটা পেলি–কোথায়?
–আরে, তাই তো তোকে বলতে যাচ্ছি। অমন ভ্যাবলার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস ওই বেঞ্চিটায়। সব খুলে বলি।
.
পাল্লালাল তার রামপাখির রহস্য যা বললে সেটা এই। পাল্লালালের যে বড়দি পাঞ্জাবে থাকে, সে কলকাতায় এসেছে কিছুদিন হল। পান্নালাল বলেছিল, বড়দি, আমার ফাউনটেন পেন ভেঙে গেছে, একটা কলম কিনে দাও। বড়দির মেজাজটা খুব ভালো। ওকে পঞ্চাশটাকা দিয়ে বলেছে, তোর পছন্দমতো একটা কিনে নিস গে। পান্নালাল কলম কিনতে যাচ্ছিল, রথের মেলার ভিড়ে ট্রামটা শেয়ালদা ছাড়িয়েই আটকে গেল। দুত্তোর বলে নেমে পড়েই দেখলে, সামনে রঙ-বেরঙের পাখি বিক্রি হচ্ছে। ভাবল, ওদের মুনিয়াগুলো মরে গেছে। এক-খাঁচা মুনিয়া নিয়ে গেলে মেজদা খুব খুশি হবে। পাখির দর করতে যাচ্ছে–এমন সময় এক সন্ন্যাসী এসে হাজির। মাথায় মস্ত জট–হাতে ইয়া এক চিমটে। সাধু বললেন, শোনোখোকা, ওসব পাখি কিনো না। ওগুলো চড়ইপাখি, রং মাখিয়ে রেখেছে।
দোকানদার তো রেগে চেঁচিয়েই উঠল একেবারে মিথ্যে বদনাম দিয়ে খদ্দের তাড়িওনি সাধুবাবা। ভালো হবেনি বুলছি।
সাধু তখন এমন ঝঙ্কার ছাড়লেন যে পাখিওয়ালা ভয়ে কাঠ। সাধু বললে, চোপরাও। রে-রে নারকী, এই অবোধ বালককে প্রতারণা। এখুনি এই চিমটের ঘায়ে মাথা একেবারে ভেঙে দেব।
পাখিওয়ালা তখন হাতটাত কচলে বললে–মাইরি সাধুবাবা, সবগুলো চড়ুই নয়। মুনিয়াই রেখেছিলুম, কিন্তু দোর খোলা পেয়ে কখন দু-চারটে চড়ুই রং মেখে এসে ঢুকে পড়েছে। চড়ুইগুলো কেমন ধড়িবাজ হয় জানেন তো?
সাধু বললে–জানি বই কি! চড়ুইগুলো দোকানে গিয়ে রং কিনেছে, আয়নার সামনে বসে সেরং গায়ে মেখেছে, তারপর ভালো মানুষের মতো তোমার খাঁচায় এসে ঢুকে পড়েছে। পাষণ্ড বর্বর নরাধম! তোমার নরকেও জায়গা হবে না।
পাখিওয়ালা তখন সাধুর পায়ে লম্বা একটা পেন্নাম ঠুকল। তারপর বললে ঘাট হয়েছে বাবা, তোমায় চিনতে পারিনি। মুনিয়া বিক্রির তো বারোটা বাজালে–তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে দুটো-একটা টিয়া-ময়নাও বেচতে পারব না। এই নাও পাঁচসিকে পেন্নামী–এখন থেকে কেটে পড়ে আমায় রেহাই দাও।
সাধু বললেন, তোমার মতো প্রবঞ্চকের পাঁচসিকেয় আমি ফুৎকার নিক্ষেপ করি। চলে এসো খোকা, আমি তোমায় পাখি বেছে দিচ্ছি।
সাধুকে পেয়ে পান্নালাল তো মহাখুশি। বলে, ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, নইলে এখুনি আমায় ঠকিয়ে দিত।
সাধু হঠাৎ পান্নালালের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, তোমাকে আমি একটা পাখি দিতে পারি। হাজার-হাজার টাকা তার দাম। চাও তো এখুনি দিতে পারি।
শুনে পালালের তো মাথা ঘুরে গেল। হাজার হাজার টাকা দামের পাখি। সাধুবাবার কাছে! পাল্লালাল এইবারে বুঝল পাগলের পাল্লায় পড়েছে। বললে, হাজার টাকা তো আমার কাছে নেই সাধুবাবা-সে-পাখি কিনব কী করে? চলি তা হলে–টা-টা।
কিন্তু তার আগেই সাধুবাবা তার হাত চেপে ধরেছেন। বলেন, ভাবছ পরিহাস করছি–না? টাকা তোমার দিতে হবে না–সন্ন্যাসী আমি, টাকার কোনও প্রয়োজন নেই। এমনিই ওটা তোমায় দিয়ে দেব। বিশ্বাস হচ্ছে না? এসো আমার সঙ্গে।
মনে খটকা ছিলই, তবু পান্নালাল গুটি গুটি সাধুর সঙ্গে এগোল। খানিকদুর এগিয়ে একটা কানাগলির মধ্যে ঢুকল দুজনে। এইবারে পান্নালাল আরও ভয় পেয়ে গেল। এই নির্জন কানাগলিতে সাধু যদি গালে থাবড়া দিয়ে পকেটের টাকাকড়ি সব কেড়ে নেয়–তা হলে
সাধু বললেন, বৎস, মাভৈঃ, ওই দেখো আমার শিষ্য জনার্দন পাখি নিয়ে বসে আছে।
একটা রোয়াকের ওপর রোগা আর বেঁটে জনার্দন ছোট একটা বাঁশের খাঁচা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে বসে আছে।
পান্নালাল সামনে যেতেই একমুখ দাঁত বের করে সে কাপড় তুলে খাঁচাটা দেখাল।
ওফ! সে কি পাখি একখানা! ময়ূরের পেখমের মতো সাতরঙা ল্যাজ-হলদে, সোনালি, কালো, বেগুনী কত রকমের রঙ। দেখে পান্নালাল একেবারে হাঁ।
সাধু মিটমিট করে হেসে বললে, দেখছ কী, বার্ড অফ প্যারাডাইজ। যাকে বলে, স্বর্গের পাখি। প্রশান্ত মহাসাগরের একটা নির্জন দ্বীপে থাকে; তোমাদের চিড়িয়াখানায় দুএকটা আছে বটে, কিন্তু এ-জিনিস তারা চোখেও দেখেনি।
জনার্দন ঝট করে খাঁচাটা ঢেকে ফেলেছে।
পানালাল বললে : আপনি কোথায় পেলেন?
সাধু হাসলেন : যোগবলে।
পান্নালাল তিনটে ঢোক গিললে, আপনি আমায় পাখিটা দেবেন?
–দেবই তো!
–দাম নেবেন না?
–এর দাম রাজা-মহারাজারাও দিতে পারেন না। তবে কালী করালবদনীর পুজোর জন্যে কিছু দিতে চাও-দাও। তোমার যা ইচ্ছে।
বার্ড অফ প্যারাডাইজের কথা মেজদার মুখে শুনেছে পান্নালাল। এই পাখি দেখলে-ওঃ, মেজদা তো নাচতে আরম্ভ করে দেবে। পান্নালাল তক্ষুনি খালি ট্রামভাড়া রেখে পঞ্চাশটা টাকা সাধুর দিকে এগিয়ে দিলে।
সাধু বললেন, টাকা আমি স্পর্শ করি না–জনার্দনকে দাও।
এর পরে আর অবিশ্বাসের কিছু থাকে? জনার্দনকে টাকাটা দিয়ে, সাধুকে পেন্নাম ঠুকে পান্নালাল খাঁচা নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে এল। জনার্দন খিকখিক করে হেসে বললে, খুব দাঁও মেরে নিলে খোকাবাবু-হেঁ-হেঁ-হেঁ।
.
গল্প শেষ করে পান্নালাল বললে, সেই পাখি লুকিয়ে রেখেছি দারোয়ানের ঘরে। ভজুলাল দেশে গেছে, ঘরটা খালিই আছে এখন। তুই আমার পরম বন্ধু, তোকেই আগে দেখাব। তারপর মেজদাকে চমক লাগিয়ে দেব, মেজদা বলে, আমি একটা ইডিয়ট। আমার মগজে নাকি কিছু নেই। আজ মগজটা দেখিয়ে দিচ্ছি। হুঁ–হুঁ।
পান্নালালের বাড়ির কাছাকাছি গেছি, দেখি ওর মেজদা একটা লোকের সঙ্গে কী যেন কথাবার্তা বলছে। দেখেই পান্নালাল থমকে গেল। বললে :প্যালা–কুক।
কী দেখব?
–ওই যে লোকটা মেজদার সঙ্গে কথা কইছে–দেখছিস? ওই ঝোল্লা মতন গোঁফ, মাথায় টাক? ওই তো আমাকে রং করা চড়ুই বেচতে চেয়েছিল? নিশ্চয়ই মেজদাকে ঠকাতে এসেছে। হারি আপ।
পান্নালাল প্রায় দৌড়ে মেজদার কাছে গিয়ে হাজির। আমিও
–মেজদা, ওর পাখি কিনো না। ভারি জোচ্চোর। ভীষণ ঠক। হাঁউমাউ করে চেঁচাতে লাগল পান্নালাল।
মেজদা আর সেই লোকটা একসঙ্গে চমকে উঠল।
-কী বলছিস আবোল-তাবোল? জোচ্চোর হবে কেন? এ তো রামলাল–বরাবর আমায় পাখি এনে দেয়।
রামলাল না ছাই। এই তো দুপুর বেলায় মুনিয়া পাখি বলে আমাকে রং করা চড়ুই গছাতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস সাধুবাবা ছিল, নইলে
মেজদা বললে–তাই নাকি রামলাল! লোক ঠকানো ব্যবসা ধরেছ নাকি আজকাল?
ঝোল্লা গোঁফ আর টাক নিয়ে তো লোকটা একেবারেই কাঁচুমাচু। হাত-টাত কচলে লোকটা বললে : নানা বাবু। না–মানে এই একটু ইয়ে মানে আপনার ভাই বোলে তো জানতুম না। কিন্তু রামলাল হঠাৎ যেন চমকে উঠল।–খোকাবাবু, তুমি বার্ড অফ প্যারাডাইজ কেনোনি তো?
এবার পান্নালাল তাক করে একটা লাফ মারলতু-তু-তুমি জানলে কী করে?
রামলাল একগাল হাসল। আমি জানব না? পাখি রংকরা বিদ্যের উনিই তো আমাদের গুরুদেব। অমনি করে সাধু সেজে খদ্দেরকে ভোলান–তারপর নিরিবিলিতে কোথাও নিয়ে গিয়ে পঁচিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ-একশোয় একটা রং করা কাক বিক্রি করে দেন। তার পিঠের সঙ্গে সরু কালো সুতো দিয়ে কয়েকটা ময়ূরের পালক বাঁধা থাকে আর গায়ে মাখানো খানিকটা লাল-হলদে-সোনালি রং। দুদিন পরেই রং উঠে যায়, ময়ূর পাখা ঝরে যায় ব্যস।
মেজদা বললে, কী সর্বনাশ! এ যে দারুণ জোচ্চোর। পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত।
রামলাল বললে, পুলিশে পাত্তা পেলে তো। গুরুজী আজ কলকাতায় থাকেন, কাল কাঠমাণ্ডু। সেখানে হয়তো কাউকে একটা শকুন দুশো টাকায় বেচে দিলেন।-বলবেন–এটা ফুজিয়ামার ঈগল।
-তা খোকাবাবু, গুরুজীর হাতে তো পড়েছিলে দেখেছি-ওইরকম একটা ফুজিয়ামার ঈগল কিংবা বার্ড অফ প্যারাডাইজ কিনে বসোনি তো? জানতুম না তুমি বাবুর ভাই, তা হলে তোমায়
পান্নালালের মুখের রং তখন বার্ড অফ প্যারাডাইজের মত ঘন ঘন বদলে যাচ্ছে। এবার সেটা কাকের মতো কালো হয়ে গেল।
পান্নালাল তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠতে গিয়ে চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠল।–কক্ষনো না–আমায় কখনও ঠকাতে পারেনি। এত বোকা পেয়েছে নাকি আমায়? বলেই বাড়ির ভেতর টেনে দৌড়।
মেজদা আর রামলাল বোকার মতো হাঁ করে চেয়ে রইল। আমিও কি আর দাঁড়াই, বেচারা পান্নালাল-হাজার হোক, বন্ধু তো বটে।