বারমেসে অমাবস্যার কথা
এক গরিব ব্রাহ্মণের একটি ছেলে। ছেলেটি ষোলো বছরের হতেই ব্রাহ্মণ তার বিয়ে দিলেন। তারপর ছেলেটি একদিন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেল। তার বাপ, মা ও বউ সব কেঁদে-কেটে পাড়া মাথায় করলে। কিছুদিন পরে ব্রাহ্মণেরও মৃত্যু হল। ব্রাহ্মণী বউটিকে নিয়ে দুঃখ-কষ্টে কাল কাটাতে লাগলেন। একদিন একজন অতিথি এসে বললেন, ‘মাগো, আমায় চারটি ভাত দিবি মা।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘আমার এমন কি কপাল বাবা। যে, অতিথির সেবা করব? শাক-ভাত আমার যা আছে চারটি খেয়ে যাও।’ বউ তেল এনে দিলেন, অতিথি তেল মেখে স্নান করে এলেন।
তারপর অতিথি বললেন, ‘মা! তোমার ছেলের কাপড়খানি আমায় দাও না, আমি পরি; আর তোমার ছেলের খড়ম দুখানিও দাও।’ ব্রাহ্মণী কাঁদতে কাঁদতে খড়ম এনে দিয়ে বললেন, ‘এই বাবা বুকে করে রেখেছি, তুমিই পরো।’ ভাত দিতে গেলে অতিথি বললেন, ‘আমায় তোমার ছেলের থালে ভাত দাও, আর সেই গেলাসে জল দাও, তা না হলে আমি ভাত খাব না।’ বউ তখন রাগ করে বলতে লাগলেন, ‘অতিথির এত আবদার কেন? না খাবে নাই খাবে, চলে যাক।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘দাও বউমা, থালা গেলাস বার করে দাও মা! ও থালায় আর কে খাবে? তবু অতিথির সেবা হলেও সার্থক হবে।’ বউ রাগে গরগর করতে করতে থালা গেলাস বার করে দিলেন। অতিথি ভাত খেয়ে ঘরে বিছানায় শুয়ে বললেন, ‘মা! তোমার বউকে পাঠিয়ে দাও, আমার একটু পা টিপে দেবে।’ বউ রাগ করতে লাগলেন। শাশুড়ি বললেন, ‘যাও মা, অতিথির সেবা করলে পরকালে ভালো হবে।’ বউ যেমন ঘরের ভেতর গেলেন, অমনি আপনি কপাট বন্ধ হয়ে গেল। গিন্নি দরজা ঠেলাঠেলি করতে লাগলেন, বউ অনেক চেষ্টা করলেন, কিছুতেই খোলা গেল না। বউকে দুঃখিত দেখে অতিথি বললেন, ‘তুমি কি আমায় চিন্তে পাচ্ছ না? আমি যে তোমার স্বামী!’ ব্রাহ্মণের ছেলেটির নাম ছিল সূর্য। বউ তখন পদসেবা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে বউকে সান্ত্বনা করে অতিথি চলে গেলেন। বউ বাহিরে এসে সব কথা শাশুড়িকে বললেন; আরও বললেন, ‘মা, তিনি মধ্যে মধ্যে আসবেন।’
ব্রাহ্মণী তখন কর্তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। পাড়ার লোক সব জড় হল, ঘটনা জানতে পেরে কেউ বা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল, কেউ কেউ বা বিশ্বাস করে বলতে লাগল, ‘আহা! সে যেখানে থাক বেঁচে থাক। আবার আসবে, কাঁদিসনি।’ এই বলে সবাই বাড়ি চলে গেল। তারপর শাশুড়ি-বউয়ে ভাত খেয়ে ওই সকল কথাই কইতে লাগলেন। দিন-রাত সেই সূর্যের কথা। আবার এক দিন সূর্য এসেছেন। যাবার সময় যখন চলে যান, তখন ব্রাহ্মণী চুপি চুপি পেছনে পেছন যেতে লাগলেন।
সূর্য পিছন ফিরে দেখে বললেন, ‘মা! তুমি কোথায় আসছো? যাও মা, ঘরে ফিরে যাও।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘বাবা! আজ আমি তোর সঙ্গে যাব, তুই কোথায় থাকিস আমি দেখো আসব। আমি খেতে পাই না, পরের মেয়ে বিয়ে করেছিস, তাকে নিয়ে আমি কি করব?’ সূর্য তখন এক সের আন্দাজ বড়ো বড়ো মুক্তা মায়ের কাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, ঘরে যাও, এতে তোমাদের অনেকদিন চলবে।’ ব্রাহ্মণী তাই নিয়ে ঘরে গেলেন। তার পরদিন, বউ উনুন জ্বেলে মুক্তাগুলি সিদ্ধ করতে লাগলেন। এক বোঝা কাঠ পুড়ে গেল, মুক্তা সিদ্ধ হল না। তখন শাশুড়িকে ডেকে বললেন, ‘ওমা! এ কি কড়াই মা! কিছুতেই সিদ্ধ হচ্ছে না।’ শাশুড়ি বললেন, ‘তবে এক কাজ করো, কড়াইগুলি ছেঁকে নিয়ে বেশ করে খোলায় ভাজ; তাহলে খাওয়া যাবে।’ বউ তাই করলেন, তাতেও খেতে পারলেন না।
তখন হামানদিস্তাতে কুটে খেতে গেলেন, তাও খাওয়া গেল না। তখন সবগুলি নিয়ে সারকুড়েতে ফেলে দিলেন। সেদিন আর তাঁদের খাওয়া হল না। আবার কিছুদিন পরে সূর্য এসে দেখেন—তাঁদের যে কষ্ট সেই কষ্ট। সূর্য বললেন, ‘মা! তোমাকে যে ধন দিয়ে গেলাম, এর মধ্যে সব ফুরিয়ে গেল?’ ব্রাহ্মণী সেদিনকার সব ঘটনা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। সূর্য বললেন, ‘মা! সেগুলি কী করলে? কোথায় ফেলে দিয়েছ?’ গিন্নি বললেন, ‘সারকুড়ে।’ তখন তিনজনে গিয়ে দেখেন—সেখানে কতকগুলি গাছ হয়েছে, তাতে রাশি রাশি মুক্তা ফলে আছে। সে সমস্ত গুলি তুলে এনে মাকে বললেন, ‘দেখো! এর এক একটি বাজারে বেচলে তোমাদের ছমাসের খোরাক হবে। এ জিনিস সিদ্ধ করেও খাবার নয়, কুটে ছাতু করেও খাবার নয়।’ এই বলে সূর্য চলে গেলেন। তারপর ব্রাহ্মণী মুক্তা বেচে বেচে বাড়ি করলেন, মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন, পুকুর প্রতিষ্ঠা করলেন। বাগান, বাড়ি, পুকুর যা কিছু সব সূর্যকুমারের নামে হল। বলেন, ‘আমার সূর্যকুমার যদি কখনও ঘরবাসী হয়, তো এই সকল ভোগ করবে।’ একদিন সূর্য এসে যেমন ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছেন, অমনি ব্রাহ্মণী এসে একেবারে চাবি বন্ধ করে দিলেন। সূর্য কত মিনতি করে বললেন, তবুও দরজা খুলে দিলেন না। তিন চার দিন বন্ধ করে রাখলেন। এদিকে পৃথিবীশুদ্ধ হাহাকার পড়ে গেল। আকাশে সূর্য উদয় হয় না, পৃথিবী অন্ধকার। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘আকাশে মেঘ নাই, রোদও নাই, এ কী হল?’ সূর্য বললেন, ‘মা! আমাকে ছেড়ে দাও, এখনি রোদ হবে।’ ব্রাহ্মণী বললেন, ‘না বাবা! আমার রৌদ্রে কাজ নেই। তুমি আমার ঘরে থাকো। চিরকালটা কি অমনি করে বেড়াবে বাবা! আমার এসব কে ভোগ করবে! তোমায় আর কোথাও যেতে দেবনা।’ বলতে বলতে এমন সময়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এসে উপস্থিত। ব্রাহ্মণী থতমত খেয়ে বললেন, ‘তোমরা কে বাপু! কোথা হতে এসেছ?’ তাঁরা বললেন, ‘আমাদের তুমি চিনতে পারবে না। তোমার ছেলেকে ডেকে দাও।’
ব্রাহ্মণী বললেন, ‘তা ডেকে দিচ্ছি; কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আর যেতে দেব না। বোধ হচ্ছে, তোমরাই আমার ছেলেটির পরকাল খেয়েছ।’ দরজা খুলে দিতেই সূর্য করলেন, ‘মা! আমাকে ছেড়ে দাও, ওই দেখো, স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আমাকে নিতে এসেছেন। আমি শাপে তোমার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলুম। আমি আবদ্ধ থাকলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। ব্রাহ্মণী ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমার এসব কে ভোগ করবে?’ দেবতারা বললেন, ‘তোমার ছেলের ঐশ্বর্য কী তোমরা দেখতে চাও? তবে চল।’ সূর্যকে বললেন, ‘তোমার মাকে আর তোমার স্ত্রীকে নিয়ে চল। তোমার এভাবে মর্ত্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না।’ সূর্য তাতে সম্মত হলেন। স্বর্গ থেকে পুষ্পরথ এল, চুয়া চন্দনের ছড়া পড়তে লাগল। ধন-দৌলৎ যা কিছু ছিল ব্রাহ্মণকে দান করে, দেবগণের সঙ্গে ব্রাহ্মণী সূর্যের হাত ধরে অমাবস্যার দিন বউকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। তাই দেখে পাড়াশুদ্ধ লোক ধনি ধন্যি করতে লাগল। তারাও অমাবস্যার দিন সূর্যের পূজো করে উপবাস করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে চতুর্দিকে অমাবস্যার কথা প্রচার হল। সেই থেকে পৃথিবীর লোক বারমেসে অমাবস্যার ব্রত করতে লাগল।
বারমেসে অমাবস্যার কথা সমাপ্ত।