1 of 2

বাবুর জমি

বাবুর জমি

এবছরে বৃষ্টি যখন হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি হয়নি। এখন সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে অবশ্য প্রায় রোজই বৃষ্টি হচ্ছে। এ-অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা বোঝা যায়, হাওড়া থেকে ট্রেনটা গুসকরা স্টেশনের কাছাকাছি এলেই।

খালটাতে এত জল হয় যে, পুরো এলাকাই প্লাবিত হয়ে যায়। মনে হয়, বন্যা হয়েছে। চাষের মাঠ-টাঠ কিছুই আর গোচরে আসে না। কিন্তু এবছরে খালটা এখনও ভরেনি অথচ প্রায় মহালয়া এসে গেল। এই মহালয়াতেই নাকি তর্পণও করতে হয়। তার মানে, শরৎকাল এসে গেল অথচ লেটলতিফ বৃষ্টির এখন টনক নড়ল।

গাদুবাবুদের নানারকম ব্যাবসা। মস্ত বড়োলোক তাঁরা। এবং প্রতিদিনই আরও বড়োলোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ওঁদের লাইনে ওঁরা প্রায় মনোপলিস্ট। আর অন্য কেউ মাথা তুলতে গেলেই মাথায় ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেন। প্রতিযোগীর ইউনিয়নকে টাকা খাইয়ে স্ট্রাইক করিয়ে দেন, দামে আণ্ডারকাট করেন। মানে নিজেদের একাধিপত্য বজায় রাখতে সব কিছুই করেন। ওর বাবা নাদুবাবু ওকে বলে গেছিলেন একটি সারকথা : Lack of expansion means decay কথাটাকে লাখকথার এককথা মনে করে ব্যাবসা করে যাচ্ছেন গাদুবাবুরা পাঁচ ভাই।

ওঁর বাবা আরও বলতেন, সুস্থ প্রতিযোগিতা বলে কোনো কথা নেই। প্রতিযোগিতা সবসময়েই অসুস্থ।

গাদুবাবু মেজোকর্তা। পশ্চিমবঙ্গীয় বড়ো ব্যবসায়ীদের পরিবারে সচরাচর দেখা যায় যে, মেজোকর্তারাই পরিবারের লিডার। দু-একটা পরিবারে যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়। কোথাও বড়োকর্তা বা ছোটোকর্তাই লিডার। তবে সব ব্যবসায়েই একজন লিডার অবশ্যই দরকার। যে-প্রতিষ্ঠানে কোনো লিডার নেই, সে-প্রতিষ্ঠান লাটে উঠে যায়। গাদুবাবুদের পরিবারে তেমন কোনো দুর্বিপাকের সম্ভাবনা নেই। নাদুবাবুর মৃত্যুর পরে গাদুবাবু শক্তহাতে হাল ধরেছেন এবং বাবার ব্যাবসা যত বড়ো ছিল এই দু-যুগের মধ্যে ব্যাবসা তার দশগুণ বড়ো করেছেন।

ট্রেনটা গতি কমাল। সামনে সম্ভবত অন্য কোনো ট্রেন যাচ্ছে তাই আজ শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস টিকির টিকির করে যাচ্ছে। পিচকুড়ির ঢাল-এ এসে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। বিরক্তি বাড়ছিল গাদুবাবুর। নানা কারণে বিরক্তি। প্রথমত ট্রেনে করে শান্তিনিকেতনে যাওয়া-আসা একেবারেই পছন্দ করেন না তিনি। কালেভদ্রে এলে, গাড়িতেই আসেন। সময় পান কোথায় আসার? সময় কোথা, সময় নষ্ট করবার? তা ছাড়া, এই এসি চেয়ারকারে কলকাতার যত উঠতি বড়োলোক সব মাছির মতো থিকথিক করে। বনেদি বড়োলোক বলে গাদুবাবুর মনে এক চাপা গর্ব আছে। তাঁরা সব কিছু পুরোনো ব্যাপারেরই ধারক ও বাহক। তবে নিন্দুকেরা বলে যে, গাদুবাবুদের ‘বনেদিয়ানা’র বয়েস পঞ্চাশ বছরও নয়। নাদুবাবু ছিলেন হ্যারি কিংসটনের স্টেনোগ্রাফার। কাছাখোলা স্বভাবের কিংসটন সাহেবের অসুস্থতার সময় কাগজপত্রে কারচুপি করে অত বড়ো সায়েবকোম্পানির মালিক বনে যান। কিন্তু সেসব কথা জানেন অতিঅল্প লোকে এবং সেই অতীত এখন তামাদি হয়ে গেছে। তা ছাড়া ‘নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস’। কী করে যে সেই সাকসেস এল, সেকথা কেউ সাকসেসফুল হওয়ার পরে অন্যেরা কনভিনিয়েন্টলি ভুলে যান।

গাদুবাবু সাধারণের সঙ্গে মেশাটা একেবারেই পছন্দ করেন না বলেই, এই সেকেণ্ড ক্লাস এসি কম্পার্টমেন্টে ট্রাভেল করতে তাঁর ইজ্জতে লাগে। তা ছাড়া, রাজ্যের মানুষে আমড়াগাছি করতে আসে তাঁকে দেখতে পেলেই। অসহ্য লাগে গাদুবাবুর।

তাঁর বিরক্তি বাড়ছে, আরও নানা কারণে। ট্রেনটা সাড়ে বারোটা নাগাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছোবার কথা। আড়াইটের সময় তাঁর ছোটোছেলে আমেরিকা থেকে ফোন করবে। সে একটি আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। আর তাই যদি করে, তাহলে সে তো আর বাগবাজারেরর গলির সাবেক বাড়িতে থাকবে না। দেশের পারিবারিক ব্যাবসাতেও আসবে না। বড়োছেলে তো অস্ট্রেলিয়াতে চলেই গেছে এক জাপানি মেয়ে বিয়ে করে। বছরে একবার আসে। তাও অনিয়মিত। ভরসা ছিল ছোটোটারই ওপর। সেও তো এখন খরচের খাতাতে। প্রয়োজনে তাকে দু-ঘণ্টা ধরে বোঝাবেন গাদুবাবু যদি ভবি ভোলে। আসলে, বিদেশে পড়তে পাঠানোটাই ভুল হয়েছে। ‘যতীন আঢ্য হায়ার সেকেণ্ডারি’ স্কুলে পড়িয়েই ব্যাবসাতে বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। মেধা, বিদেশের ডিগ্রি এসব যাদের আছে ব্যাবসায়ীরা তাদের চাকর রাখে, তাদের নিজেদের মেধা আর ডিগ্রির দরকার কী?

ব্যারিস্টার বাপি সেন বাথরুম থেকে ফেরার সময়ে পাক্কা পাঁচ মিনিট কথা বলে গেলেন গাদুবাবুর সঙ্গে। ক্যালকাটা ক্লাবে যান না কেন গাদু রায়? বেঙ্গল ক্লাবেও কেন দেখা যায় না তাঁকে? এইসব বোকার মতো সব কথা। আসলে এসব কোচসুদ্ধু মানুষকে শোনানোর জন্যে যে, গাদু রায়ের সঙ্গে বাপি সেনের কীরকম ঘন পরিচয়। ফু: ব্রিফলেস ব্যরিস্টার। শান্তিনিকেতনে বাড়ি করে জাতে উঠেছে।

আজকাল এই এক হয়েছে। শান্তিনিকেতনে বাড়ি না করলে স্ট্যাটাস থাকছে না কারোরই। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের ছেলে না শালা তা না জানলেও, কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের মেজোপিসিমা না ছোটোপিসিমা, তা না জানলেও শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি করাটা বিশেষই দরকার। রবীন্দ্রনাথকে সবরকম অপমান অসম্মান যাঁরা করেন তাঁদেরও দরকার, নইলে বসন্তোৎসবে আর পৌষোৎসবে টিভির ক্যামেরার সামনে হিরো হবেন কী করে? বসন্তোৎসবে ধুমসো ধুমসো বুড়ির হাঁটুর ওপরে শাড়ি তুলে বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে’ অথবা ‘বসন্তে ফুল গাঁথল’ নেচে নচে মেদিনী কাঁপিয়ে না দিলে আর নিজেদের ‘‘কেলচার’’ ফোটানো হয় না।

গাদুবাবু মনে মনে হাসেন। ভারতবর্ষের সব শহরে, আমেরিকাতে এবং সুইজারল্যাণ্ডেও যে তাঁর বাড়ি আছে একথা এই পাতিদের কাছে জানিয়ে কী আর হবে? ওঁর, ওঁদের লেভেলই আলাদা!

না: গাদুবাবুর চিন্তা বড়ো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনটা সময়ে না গেলে কেতো হয়তো বসে থেকে থেকে চলে যাবে। সিউড়ি থেকে বাসে চেপে আসবে সে। ইদানীং সি পি এম করে, খুব তেল বেড়েছে। ইলেকশনের পরে আরও রংবাজ হয়েছে। যদিও সব পার্টির সব দাদাকেই গাদুবাবু ইলেকশনের আগে তোলা দেন কিন্তু ছোটো ছোটো তোলাবাজদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন না। তবে কেতো অবশ্য আজকে আসবে অন্য ব্যাপারে। গাদুবাবুদের বাড়ি আছে পূর্বপল্লিতে। গাদুবাবুর দু-বিঘাতে চলে না। দু-বিঘা জমি তো রবিঠাকুরের উপেনেরও ছিল। উনি তাঁর ডান পাশে বাঁ-পাশে যত বাড়ি আছে সবই একে একে কিনে নিতে চান। তিনটি বাড়ি ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছেন। চতুর্থটি সম্বন্ধেই কথা বলতে আসবে কেতো। জমি-বাড়ির দালালি করে গত পনেরো বছরে কেতো লাখ বিশেক কামিয়ে নিয়েছে। শান্তিনিকেতনে সে তার শালা মদনার মাধ্যমে অপারেট করে। এই বাড়িটি হয়ে গেলেই একলপ্তে দশ বিঘা জমি হয়ে যায় গাদুবাবুর। ভবিষ্যতে তিনি তাঁর বাড়ির আম্রকুঞ্জেই বসন্তোৎসব করবেন। খেতে হলকর্ষণ উৎসব করবেন আর পৌষমেলাও করবেন। কলকাতার যত নামি ডাক্তার, মোক্তার, ব্যারিস্টার, সলিসিটর সকলকে এক করে দেবেন স্কচ-এর ফোয়ারা ফুটিয়ে আর সঙ্গে থাকবে কিছু স্থানীয় রিটায়ার্ড বুড়ো-হাবড়ারা, যাদের চোখ জুলজুল করে স্কচের নামেই। আরও ডাকবেন কিছু দুর্বুদ্ধিজীবীদের। পশ্চিমবঙ্গীয় দুর্বুদ্ধিজীবী। তাঁর বাবা নাদুবাবু বলতেন, ‘দ্য ওনলি স্পেসিস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ইউনিক ইন দেয়ার অপারচুনিজম অ্যাণ্ড মিননেস।’

দু-বিঘা জমিওয়ালা চতুর্থ বাড়িটা আজই কিনে ফেলতে পারলে গাদুবাবু নিশ্চিন্ত হন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি তাঁর পছন্দ নয় বলেই তিনি একটু Breathing space চান। এই ডিলটা হয়ে গেলেই সেটা সম্ভব হবে। তার পরে আর্কিটেক্ট, গার্ডেন প্ল্যানার, হর্টিকালচারিস্ট সকলকে পাঠাবেন একে একে এবং তাঁর সুন্দরী সফিসটিকেটেড স্ত্রী মৃত্তিকা দেবী সব অ্যাপ্রুভ করে দিলেই তিনি ফাণ্ড-এর বন্দোবস্ত করে দেবেন।

অবশেষে ট্রেনটা ইন করল শান্তিনিকেতন স্টেশনে। বাড়ির ম্যানেজার রাধু এসেছিল ড্রাইভারকে নিয়ে। আজকাল শান্তিনিকেতন কলকাতা হয়ে উঠেছে। গাড়ির ভিড়ে নড়াচড়া করা যায় না। আগে সাইকেল-রিকশাই বেশি ছিল। নাদুবাবু তখন কতিপয় বাবুদের সঙ্গে গাড়িচড়ার বিলাসিতা উপভোগ করতেন। গাড়ি-চড়া মানুষকে পথচারী,সাইকেল-রিকশাওয়ালা, দোকানদারেরা সমীহ করত। আজকাল শান্তিনিকেতনে শান্তিও নেই, শ্রদ্ধাও নেই। হেঁজিপেঁজি সকলেরই এখন গাড়ি আছে। আর কীসব ছারপোকার মতো গাড়ি বেরিয়েছে গুচ্ছের। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ।

পূর্বপল্লি, স্টেশান থেকে কাছেই। বড়ো রাস্তাটাতেই যা-গ্যাঞ্জাম। তার পরে ফাঁকাতে পড়ে বাড়ি পৌঁছে গেলেন।

মস্ত বড়ো লোহার ফটক। চারখানা হাতি অথবা মার্সিডিজ ট্রাক পাশাপাশি ঢুকে যেতে পারে। পাগড়ি-পরা দারোয়ান গেট খুলে সেলাম করল। তার বাবাও গাদুবাবুর বাবার আমলে দারোয়ানি করে গেছে। বিহারের মধুবনি জেলার লোক, এরা সব বংশপরম্পরায় কর্মচারী। গাড়ি গিয়ে পর্চ-এ দাঁড়াল। দশথাক সিঁড়ি উঠে প্রকান্ড ল্যাণ্ডিং, ইটালিয়ান মার্বেল-এর। ড্রইং রুমে ঢুকতেই নাদুবাবুর একটি প্রকান্ড পোট্রেট। থ্রি পিস পিন-স্ট্রাইপ স্যুট পরা। মাথায় বাউলার হ্যাট। কোটের বুকপকেটে ‘ডু পঁ’ কলম। যদিও চেকবই আর দু-নম্বর টাকার হিসেব রাখা ছাড়া, যে-কলম দিয়ে আর কোনো কর্মই ইহজগতে করেননি তিনি। সোনার চেন লাগানো রোলেক্স পকেট-ঘড়ি।

গাদুবাবু ভক্তিভরে বাবার ছবিতে প্রণাম করে তবে বাড়িতে ঢুকলেন। এই একটা ব্যাপারে সাধু, বিদ্বান, চোর, ডাকাত, খুনি বা পকেটমারের মধ্যে কোনোই তফাত নেই। সকলেই যার যার বাবাকে ভক্তি করে। বাবাকে ভক্তি করার অধিকার সকলেরই আছে কিন্তু ছেলে তাকে ভক্তি করলেই চোর বা ডাকাত বা ফোরটোয়েন্টি কিছু সাধু হয়ে যান না।—এইকথাটা তাঁর পুরোনো ক্যাশিয়ার একদিন বলেছিলেন গাদুবাবুকে। তার পর থেকে নাদুবাবুর ছবিতে প্রণাম করার সময়ে প্রতিবারই সেই কথাটা মনে পড়ে। মনে মনে বললেন, বাবা, ও বাবা। তুমি কি সাধু ছিলে? না অসাধু? বলাবাহুল্য নাদুবাবুর অয়েল পেন্টিং উত্তর দেয় না। রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে সেই তেল-রঙের তিনি দুষ্টুমিষ্টিB চাউনিতে মেজোছেলে গাদুর দিকে নীরবে চেয়ে থাকেন।

কেতো এসে বসেছিল টাইমমতোই কিন্তু ছোটোছেলে ঝিন্টু আমেরিকা থেকে ফোন করল না। অগ্যতা তিনিই ফোন করলেন ছেলের মোবাইলে। মোবাইলও অফ করা আছে। তখন ল্যাণ্ড-লাইনে ফোন করে ভয়েসমেইল-এ মেসেজ দিলেন, ঝিন্টু, আমি শান্তিনিকেতনে এসেছি। কাল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে ফিরে যাব। তুমি পারলে আমায় ফোন কোরো।

আর কীই বা বলবেন। এ তো আর তাঁদের সময় নয়, যে, এম এ পাস ছেলেও বাবা বললেই দেওয়ালে হাত দিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। সেইসব স্বর্ণযুগ চলে গেছে।

কেতোর সঙ্গে কথা হল। ডিল হল বটে কিন্তু দামটা অনেকই বেশি পড়ে গেল। ব্যাটা সেনগুপ্ত একটা বাজে লোক। সে জানত যে, গাদুবাবুর ইচ্ছে বলে কথা! নেবেন যখন বলেছেন তখন নেবেনই। দামের ভয়ে পিছপা হওয়ার মানুষ তিনি নন। আসলে এই নতুন বড়োলোকরা শান্তিনিকেতনে হামলে পড়াতেই জমি-বাড়ির দাম এমন চড়চড় করে বেড়ে গেল। যাকগে। গাদু রায় যা জেদ করে, তাই করে। এবার সব জমি একসঙ্গে হয়ে গেল। একটা আলাদা এলাকাই হয়ে যাবে। রায় পরিবারের। সত্যিকারের শান্তিনিকেতন। দু-এক বিঘা জমিতে কি গাদু রায়কে মানায়? সবই ভালো কিন্তু ঝিন্ট যদি দেশে না ফিরতে চায়? ব্যাবসাতে না আসতে চায়? কিছুই ভালো লাগে না গাদুবাবুর। বয়েস বাষট্টি হল। বুকের কাছটা প্রায়ই চিনচিন করে ওঠে। মৃত্তিকা প্রায়ই বলে, লেটস গো নাউ টু হুস্টন। ইউ শুড হ্যাভ আ থরো চেক আপ বাই ডা. ডেন্টন কুলি। কিন্তু কী করে বোঝাবেন গাদুবাবু মৃত্তিকাকে? জীবনে যখন আর সব কিছুই হাতের মুঠোতে চলে আসে তখন সময় হাতের বাইরে চলে যায়, নিজের থেকেই, এমনই ম্যানেজমেন্ট তাঁর, ঘানিতে যে-শব্দ ওঠে সেই শব্দটাও ওঠে না তাঁর ব্যাবসাতে, কিন্তু তবুও ব্যাবসা যেন আঠা। তা ছাড়া বড়োকর্তা সেজোকর্তা ছোটোকর্তারাও আছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে কে কোন কাঠি করে দেয় কে জানে!

কিছু ঘটে গেলে, মানে তিনি হঠাৎ দেহ রাখলে কী হবে? তাঁর বাবা নাদুবাবুর বডি পিসহ্যাভেনে রাখা ছিল।

ঝিন্টু স্টেটস থেকে আসবে আজ। রিন্টু আসবে অস্ট্রেলিয়া থেকে। তবে রিন্টু সম্ভবত আসতে পারবে না। সে আর তার জাপানি স্ত্রী আলাস্কাতে গেছে সি-ক্রুজ-এ।

গতকাল শান্তিনিকেতন থেকে বিকেলে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে এসে স্টেশান থেকে বাড়িতে ফেরার পথেই গাড়িতেই হার্ট অ্যাটাক হয়। গাদুবাবুর পার্সোনাল ড্রাইভার স্মার্ট সর্দারজি টারলোচন সিং সোজা বেলভিউতে নিয়ে যায়। গাড়ি থেকেই মোবাইলে খবর দিয়ে দেয় বাড়িতে আর গাদুবাবুর পি এ মিসেস লালওয়ানিকে।

তার পর তো ইতিহাস। ডাক্তারেরা আই সি সি ইউতে গাদুবাবুর অতিকায় একটি সাদা ব্যাডির মতো শরীরটাকে উলঙ্গ করে সবরকম চেষ্টাই করলেন, রেসপিরেটর দিয়েও। তার পর ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন—ডেথ বাই লেফট ভেন্ট্রাকুলার ফেইলিয়োর।—ব্রট ডেড টু আই সি সি ইউ। ঝিন্টু এল আজ স্টেটস থেকে বম্বে হয়ে রাতের ফ্লাইটে। বাড়ি আসতে আসতে রাত ন-টা।

বাড়ির অন্যান্যরা চেয়েছিলেন মেজোবাবুকে সেগুন কাঠের নতুন পালঙ্কে শুইয়ে কীর্তন গাইতে গাইতে খই-এর সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে বন্দোবস্ত করে আনানো চকচকে নতুন পাঁচ টাকার কয়েন ছড়াতে ছড়াতে কাশী মিত্র ঘাটে নিয়ে যাবেন। কিন্তু মেজোমা মৃত্তিকা দেবী বলেছেন, হিন্দু সৎকার সমিতির কাচের গাড়িতে করেই নিয়ে যাওয়া হবে। ওসব প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার-স্যাপার চলবে না। অতএব তাই করা হল।

আজ কাশী মিত্র ঘাটে খুবই ভিড়। কাচের গাড়ি থেকে নামিয়ে গাদুবাবুকে শোয়ানো হয়েছে একটি বাঁশের চালির ওপরে। উলঙ্গ শরীরের ওপর কোরা চাদর ফেলা। চালিটি চওড়াতে তিন ফিট, লম্বাতে-ছ-ফিট। গাদুবাবুর পা দুটি বেরিয়ে আছে বাইরে। সকলের জন্যেই ওই মাপ। নইলে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকবে না। বড়োলোক-গরিব, কমিউনিস্ট-ক্যাপিটালিস্ট, মালিক-কর্মচারীতে কোনো তফাত নেই। ‘পেরকিতো’ সোশ্যালিজম এদেশে শুধুমাত্র শ্মশানেই আছে।

সাত নম্বর বডি। প্রবল প্রতাপান্বিত গাদুবাবুর এই এখন পরিচয় ‘বডি নম্বর সাত’ তাঁর ঠিক আগেই পাড়ার মুচি দুখু সিং-এর বডি। তারও আগে পোস্ট অফিসের জুনিয়র কেরানি নবীন সুরের বডি। তারও আগে অচেনা সব ডেডবডি।

শ্মশান ভরে গেছে গাদুবাবুর কুকুর-মেকুরে। দুঃখ হোক আর নাই হোক দুঃখ দুঃখ মুখ করে তাঁরা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রায় শ-খানেক গাড়িই এসেছে। দুঃখের বিষয় গাদুবাবু জানতেও পারছেন না, তাঁর কোন কোন কর্মচারী তাঁকে শেষবিদায় জানাতে এসেছে। তাঁরা সকলেই এসেছে নাম প্রেজেন্ট করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টার নেই সেখানে। নেই কোনো টাইম মেশিন যে, কে কখন এলেন বা গেলেন তা পাঞ্চ করবে। একটা পাগল চুল্লু খেয়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে—

গোবু, তুমি মনে মনে ভাবো, তোমার মতোবাবু নাই।একদিন না হয় দু-দিন বাদে চড়বেচার বেহারার কাঁধেবাবু, তুমি মনে মনে ভাবো, তোমার মতোবাবু নাই।

তিন ফিট বাই ছ-ফিট ইকুয়ালটু আঠেরো বর্গফিট। মাত্র এইটুকু জমির মালিকানা নিয়ে রাত দেড়টার সময়ে গাদুবাবু ইলেকট্রিক চুল্লির গনগনে আগুনের মধ্যে বাঁশের চালিতে চড়ে গড়গড়িয়ে চুল্লির মধ্যে ঢুকে গেলেন। সমস্ত টাকাপয়সা, বৈভব, সম্পত্তি, একনম্বর, দু-নম্বর টাকা, মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা, অযোগ্য ও অসৎকে তোল্লাই দেওয়ার ক্ষমতা এবং শান্তিনিকেতনের দশ বিঘা জমি সবই পড়ে রইল এখানে। শেষপর্যন্ত সাধারণের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষিও ঠেকাতে পারলেন না গাদুবাবু।

যাঁরাই কর্তা তাঁরা সবাই সব কতৃত্ব নিয়ে একদিন, এমনি করেই ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে যাবেন নাদুবাবু-গাদুবাবুদেরই মতন। সকলেরই শুধু প্রয়োজন একটি বাঁশের চালি, একটা কোরা থান আর শুধুমাত্র আঠেরো বর্গফুট জমি। তাও ঘন্টা-দু-ঘণ্টারই জন্যে, যতক্ষণ-না ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। আর সবই বাহুল্য।

এই সারকথাটাই দেশ-বিদেশের নাদুবাবু-গাদুবাবুর মতো অগণ্য দন্ডমুন্ডের কর্তারা জীবদ্দশাতে বুঝতে পারেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *