বানরের কাণ্ডজ্ঞান
এক সার্কাসের দলে একটা বানরের বাচ্চা চমৎকার সব খেলা দেখাচ্ছিল, এই একটা বিরাট কুকুরের পিঠে চড়ে মুখে লাগাম টেনে কুকুরটাকে ঘোড়ার মতো চালাচ্ছে, আবার আগুনের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ট্রাপিজের লোহার রিংয়ের মধ্য দিয়ে গলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বানর বালকের ক্রীড়াকৌশল দেখছিল। এমন সময় কোথা থেকে একটা বেরসিক গোদা বানর অতর্কিতে সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে এসে বাচ্চা বানরটাকে কানে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। দর্শকবৃন্দ এই অভাবিত দৃশ্য দেখে মহা হইচই বাধিয়ে দিলেন। তখন সার্কাসের ম্যানেজার সাহেব হাত জোড় করে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখুন মশাইরা, এ ব্যাপারে আমার কিংবা আমার কোম্পানির কোনও দোষ নেই। ওই যে ছোট বানরটা খেলা দেখাচ্ছিল, বড় বানরটা হল তার বাবা। বাবার ইচ্ছে নয় যে ছেলে সার্কাসে খেলা দেখায়, এতে নাকি তার সম্মানহানি হয়। তাই ছেলেকে কানে ধরে নিয়ে চলে গেল। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। বাপ না চাইলে কি আমরা নাবালক ছেলেকে দিয়ে খেলা দেখাতে পারি? বলুন, আপনারাই বলুন।’
বানর নিয়ে ভালই আরম্ভ করেছিলাম আজকের কাণ্ডজ্ঞান। সহসা আমার বাঙাল কর্ণকুহরে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করেছে, বানর না বাঁদর?
যতদূর মনে পড়ছে ছোটবেলায় রামায়ণে পড়েছিলাম,
ছোট ছোট বানরের
বড় বড় পেট।
পার হইতে লঙ্কা
মাথা হইল হেঁট ॥
কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ আঁতিপাঁতি করে খুঁজে ‘বানর’ শব্দটি কয়েক সহস্রবার পেয়ে গেলাম, এই পঙক্তি দুটি কোথাও পেলাম না। পঙক্তি দুটি কোথায় গেল? হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? নাকি অন্য কোথাও আছে?
বরং কবি মনীশ ঘটকের সেই খ্যাতনান্নী কুড়ানি বাঙালিনীকে অনেক সহজে হাতের কাছে পেয়ে গেলাম—
গলিতাশ্রু, হাস্যমুখী, কহে হাত ধরি,
‘তরে বুঝি কই নাই? আমিও বান্দরী।’
দুটি বিখ্যাত বাংলা অভিধান খুলে দেখলাম, বানর মানে বাঁদর, এবং বাঁদর মানে বানর। সংস্কৃত বানর শব্দটি বাংলায় বাঁদর হয়ে গেছে, ব্যাকরণের ভাষায় তৎসম থেকে তদ্ভব। তারপর বাঁদর থেকে বাঁদুরে, বাঁদরামি। এইখানে প্রসঙ্গ সূত্রে একটা ছোট জিনিস লিখে রাখা ভাল। পূর্ববঙ্গের কথ্যভাষায় বাঁদর নেই, আছে বানর, বান্দর, বান্দরামি।
এ অবশ্য আমার বিষয় নয়। তবু সপ্তাহান্তে সাতশো শব্দ লিখতে গিয়ে এমন সমস্ত শব্দের মুখোমুখি হই, যার ব্যবহার জানি কিন্তু ব্যবহার করা উচিত কি-না জানি না। আশা করি শিক্ষিত ভদ্রজন দোষ নেবেন না, কখনও কদাচিৎ আমার এই বিপথগামিতায়।
ভো সাধারণ পাঠক, হে তরলমতি পাঠিকা, আসুন আমরা হাস্যকর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। প্রসঙ্গটি সিংহ-চৰ্মাবৃত গর্দভের কাহিনীর কাছাকাছি।
সুন্দরবনের একটি তরুণ বাঘ খাদ্যের অভাবে এবং যৌবনের উত্তেজনায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়ে। জঙ্গলে শিকার করে খাওয়া তার পোযাচ্ছে না। তা ছাড়া তার হইহল্লা, লোকজন, মেলা-বাজার এই সব খুব পছন্দ। আর একটা চাকরিওতার দরকার, কতকাল আর বিদ্যাধরীর খালে চুননামাছ খেয়ে কাটাবে। মা-বাবাও বুড়ো হয়েছে, তাদের সামর্থ্য নেই বড় বড় জন্তু মেরে এনে খাওয়ায়, সুন্দরবনে বড় জন্তুই বা কোথায়? গৃহস্থ বা গৃহস্থের গোরু-ছাগল ধরে খাওয়া যায়, কিন্তু সে বড় বিপজ্জনক পেশা।
সুতরাং আমাদের এই তরুণ বাঘটি অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করল যে একটা চাকরি তার জোগাড় করতে হবে। নামখানায় এক বড় সার্কাসের দল এসেছে, সে দলে অনেক বাঘ-সিংহ, হাতি-ঘোড়া, কুকুর-বানর। একদিন রাতে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তরুণ বাঘটি হঠাৎ বহু দূর থেকে সার্কাসের আলো দেখে কৌতূহলবশত এগিয়ে এসে সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ে। ম্যানেজার সাহেব তখন ঘরে বসে কাজ করছিলেন, বাঘটি তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। সার্কাসের ম্যানেজার, সারা জীবন হিংস্র জীবজন্তু নিয়ে তাঁর কারবার। নতুন বাঘ দেখে তিনি ভয় পাননি। বরং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাই?’ বাঘটি নিবেদন করল, সে সার্কাসে একটি কাজ চায়। অনেক রকম লাফ-ঝাঁপ, ডিগবাজি-গর্জন করে সে তার যোগ্যতা প্রমাণ করার অশেষ চেষ্টা করল।
কিন্তু ম্যানেজারবাবু তাকে কাজ দিলেন না। বললেন, ‘আমার এখানে কোনও বাঘের কাজ খালি নেই। এ সার্কাসে চারটে পুরনো বাঘ আছে। তোমাকে নিলে তাদের একজনকে ছাড়াতে হবে। তারা অনেক দিন আছে, এই বুড়ো বয়েসে যাবে কোথায়?’
ম্যানেজারবাবু অবশ্য নির্দয় নন। তরুণ বাঘটিকে পরামর্শ দিলেন, নদী পার হয়ে সামনের বাসরাস্তা বরাবর সোজা উত্তরে গেলে এক রাতে কলকাতা চিড়িয়াখানায় পৌঁছে যাবে। সেখানে এলাহি ব্যাপার, বহু জন্তু, বহু খাঁচা, বহু বাঘ। গিয়ে একটু কাঁদাকাটি করো, তোমার যা হোক একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
উপদেশ মতো বাঘটি একদিন সাতসকালে কলকাতা চিড়িয়াখানায় এসে পৌঁছাল। কিন্তু, দুঃখের কথা, সেখানেও কোনও কাজ খালি নেই। শার্দুল যুবকটি অনেক রকম অনুনয়-বিনয়, কাকুতি-মিনতি করল কিন্তু বাঘের সমস্ত খাঁচাই ভর্তি। এমনকী একেকটা খাঁচায় একাধিক বাঘ রাখতে হয়েছে, কোনও জায়গাই খালি নেই। শেষে বাঘটি যখন বলল, “ঠিক আছে, সৎভাবে যখন হল না, এখন থেকে আমি মানুষ মেরে খাব’, তখন কর্তৃপক্ষ ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন, বললেন, ‘আচ্ছা ওই এক পাশে একটা ছোট খাঁচা আপাতত খালি আছে, তুমি ওর মধ্যে থাকো।’
বাঘ খাঁচার মধ্যে ঢুকল। দর্শকেরা নতুন বাঘ দেখে খুব খুশি। বাঘ বেচারিও নতুন কাজের আনন্দে হম্বিতম্বি, তর্জন গর্জন করে দর্শকদের অতিশয় মনোরঞ্জন করল। সন্ধ্যাবেলা কিন্তু যখন অন্যান্য পুরনো বাঘদের দেওয়া হল বড় বড় মাংসের খণ্ড, এই নতুন বাঘটিকে দেওয়া হল দুটো কলা আর এক মুঠো ছোলা। এই বৈষম্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাল বাঘটি, সারাদিন কঠোর পরিশ্রম এবং জনতার সুপ্রশংসার পরে এই খোরাকি! সে গর্জে উঠল। কর্তৃপক্ষ বললেন, ‘রাগারাগি করে কোনও লাভ নেই। তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বাঘের খাঁচা খালি নেই। তোমাকে বানরের খাঁচায় রাখা হয়েছে, বানরের খাবারই তোমার ন্যায্য বরাদ্দ।’
সেই বাঘটি এর পরে কী করেছিল তার কোনও খবর নেই। কিন্তু বানরেরা শুনেছি একটা বাঘকে তাদের খাঁচায় রাখার প্রতিবাদে একদিন হরতাল করেছিল।
বানরদের মনের জোর সত্যিই খুব বেশি। সেই বিখ্যাত তিন বানরের ছবি বা মূর্তি সবাই দেখেছে। তাদের মধ্যে একজন হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে—সে কোনও খারাপ দৃশ্য দেখবে না; একজন দু’হাত দিয়ে দু’কান চাপা দিয়েছে—কোনও কুবাক্য শুনবে না; আর তৃতীয় বানরটি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে—সে কিছুতেই কোনও খারাপ কথা বলবে না।
কিন্তু অনুসন্ধিৎসু, ধীমান পাঠক, যদি আপনার হাতের কাছে ওই ছবি বা মূর্তি একটি থাকে দয়া করে আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে দেখুন।
ওই যে প্রথমটি হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে, তার কিন্তু হাতের আঙুলের মধ্যে মধ্যে একটু ফাঁক আছে। সেই ফাঁক দিয়ে সে কিছু দেখছে না এমন কথা হলফ করে আপনি বলতে পারবেন না
আর দ্বিতীয়টি, সে হাত দিয়ে কান ঢাকা দিয়েছে কিন্তু হাতের তালুর ফাঁক দিয়ে মনে হচ্ছে সে সব কিছুই শুনছে। শুনতে পাচ্ছে না এটা তার ভান মাত্র।
সর্বশেষ, পিছনের ওই হাত দিয়ে মুখ চাপা দেওয়া বানরটি, হাঁ, একথা ঠিক সে কিছুই বলছে না।কিন্তু একবার তার মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, সে কিন্তু অনেক কিছুই ভাবছে, আর কখনও কখনও কোনও কথা বলার চেয়ে কোনও কিছু ভাবাও কম খারাপ নয়, আপনারাই ভেবে বলুন।