বাড়ি ভাড়া
আজকাল আর কেউ হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না কিন্তু এই কলকাতা শহরেই একদা প্রায় বিনা আয়াসে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত। তখনকার শহরতলি ঢাকুরিয়া বা দমদমেই শুধু নয়। শ্যামবাজার এবং ভবানীপুরে, এমনকী নতুন গড়ে ওঠা বালিগঞ্জে বা নিউ আলিপুরে বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল না।
সুন্দর, খোলামেলা, দক্ষিণমুখী বাড়ির দোতলার রেলিংয়ে অথবা একতলার বারান্দায় নোটিশ বা সাইনবোর্ড লাগানো থাকত, ‘টু লেট’ (To let), অর্থাৎ ‘ভাড়া দেওয়া হবে’। বাড়িওলা অধীর প্রতীক্ষা করতেন ভাড়াটের জন্যে। হবু ভাড়াটেকে কনে দেখানোর মতো যত্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়ি, পাড়া ও প্রতিবেশীর গুণাবলি বর্ণনা করতেন বাড়ির মালিক।
সেই সব চমৎকার দিন কবে শেষ হয়ে গেছে। এখন এই শহরে একটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া অসম্ভব। বাড়ি, ফ্ল্যাট, এমনকী ছোট এক চিলতে ঘর, গ্যারেজের উপরে দমবন্ধ, অন্ধকার কুঠুরী— হাজার ছুটোছুটি, ধরাধরি করে মাথা গোঁজার সামান্য জায়গাও এখন আর পাওয়া যায় না।
সেই সব দিন নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। সেদিন আর ফিরে আসবে না।
শুধু ভাল বাড়ি বা বসবাসযোগ্য ফ্ল্যাটের যে এখন অভাব তাই নয়, ভাল ভাড়াটেও আজকাল আর পাওয়া যায় না। কলকাতার হাজার হাজার বাড়িতে এখন বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের অহর্নিশি সংগ্রাম চলেছে। সে সংগ্রাম কখনও থানা, কখনও আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো বাড়িওয়ালা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, ‘ভাড়াটে সমেত বাড়ি বিক্রয়’।
এই ‘ভাড়াটে সমেত বাড়ি বিক্রয়’ ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে এই রকম একটা ভাড়াটে সুদ্ধ বাড়ি এক ছিটগ্রস্ত ব্যক্তি ক্রয় করেছিলেন, সে বাড়িতে দু’-ঘর ভাড়াটে ছিল। ক্রেতা ভদ্রলোকের ধারণা হয়েছিল তিনি ভাড়াটে সমেত বাড়ির দাম দিয়েছেন, সুতরাং বাড়ির ভাড়াটেদেরও তিনি ক্রয় করেছেন। সবচেয়ে বিপদ হয় যখন এক ঘর ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে তখন তিনি তাতে খুশি না হয়ে সেই ভাড়াটেদের বাধা দিয়েছিলেন চলে যাওয়ায়, বলেছিলেন, ‘তোমাদের সুদ্ধু এই বাড়ি আমি কিনেছি। এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’
তবে সব বাড়িওয়ালা উপরের আখ্যানের ভদ্রলোকের মতো নন। তাঁদের অধিকাংশেরই বিচার-বিবেচনা প্রবল।
কথিত আছে, এক ভাড়াটে ভরা বর্ষার দিনে বাড়ির মালিকের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে ছাদ দিয়ে জল পড়ে। তাতে নাকি বাড়ির মালিক ভুরু কুঁচকিয়ে বলেছিলেন, ‘ছাদ দিয়ে জল পড়বে না কি লেমনেড পড়বে?’
আসল ঘটনা কিন্তু মোটেই সে রকম নয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। এমন একটি বাড়িতে আমাকে কিছুকাল বসবাস করতে হয়েছিল, যে বাড়িতে ছাদ দিয়ে জল পড়ে, কল দিয়ে জল পড়ে না। একদিন গৃহস্বামীকে সেকথা জানালাম। তিনি কলের জলের কথায় কান দিলেন না, কিন্তু ছাদ দিয়ে জল পড়ার কথায় একটি চমৎকার স্তোকবাক্য দিলেন, মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? সব সময় তো আর জল পড়ছে না। শুধু যখন বৃষ্টি হবে তখন ওই একটু আধটু পড়বে।’
উক্ত গৃহস্বামী অবশ্যই নমস্য ব্যক্তি। এবার একজন নমস্য ভাড়াটের কথাও বলি, এই ভদ্রলোকের কথা ইতিমধ্যে কোথায় যেন বলেছি, তবু তাঁকে বাদ দিয়ে এই প্রসঙ্গ লেখা যায় না
এই ভাড়াটে ভদ্রলোককে আমি দীর্ঘকাল ধরে চিনি। কয়েকদিন আগে বাজারে দেখা। দেখি তাঁর হাতে আট-দশটা ইঁদুর ধরার বাক্স। বাজার থেকে তিনি বেরচ্ছেন, আমি প্রবেশ করছি, তিনি আমাকে দেখে একটু দাঁড়ালেন, প্রশ্ন করলেন, ‘দাদা, আরশোলা কী করে ধরা যায়?’
আমি একটু অবাক হয়ে তাঁর হাতে ইঁদুর-ধরার বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
ভাড়াটে ভদ্রলোক বললেন, ‘দাদা আমি সল্টলেকে বাড়ি করেছি, সেখানে চলে যাচ্ছি, এই শনিবার।’
আমি নির্বোধের মতো জানতে চাইলাম, ‘সল্টলেকে আরশোলা দিয়ে কী করবেন?’ ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘সল্টলেকের ব্যাপার নয়। আপনাদের পাড়ার ব্যাপার। যখন এসেছিলাম সেই সাড়ে সাত বছর আগে, বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল আমার, ফ্ল্যাট যে অবস্থায় নিচ্ছি সেই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। কোনো অদল-বদল, ব্যতিক্রম চলবে না।’
এর পরেও আমি সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে না পারায় ভাড়াটেমশায় বললেন, ‘আমি ফ্ল্যাটে ঢুকে গোটা চল্লিশেক ইঁদুর আর শ দুয়েক আরশোলা পেয়েছিলাম। সেগুলো বহু কষ্ট করে তাড়িয়েছিলাম। কিন্তু এখন যাওয়ার সময়ে চুক্তি খেলাপ করতে পারি না। তাই ইঁদুর আর আরশোলা জোগাড় করছি, ফ্ল্যাটে রেখে যাওয়ার জন্যে।’
বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে ইঁদুর বা আরশোলা অবশ্য কোনও বিচিত্র ব্যাপার নয়। খোদ মার্কিন দেশে একটি রসিকতা আছে যে প্রথম প্রথম মহাকাশযানে যে ইঁদুর পাঠানো হত তার একমাত্র কারণ হল, যে মহাকাশ বিজ্ঞানী এই দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁর ফ্ল্যাট ভর্তি ছিল ইঁদুর এবং তিনি কৌশলে এইভাবে ইঁদুরগুলিকে তাঁর বাড়ি থেকে মহাকাশে পাচার করার প্রয়াস করেছিলেন।
বাড়ি ভাড়ার শেষতম কাহিনীটি সত্যঘটনা অবলম্বনে এবং সেই জন্যে কিঞ্চিৎ দুঃখের।
তরুণ চিত্রকর গগনচন্দ্র পাল একটি ছোট ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। তাঁর নিজের ধারণা তিনি খুব প্রতিভাবান, কিন্তু বোধহয় সেই জন্যেই তাঁর আঁকা ছবি-টবি তেমন বিক্রি হয় না। অন্য কোনও আয়ও বিশেষ নেই। ফলে যা হয়, বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে।
বাড়িওয়ালা তাগাদা দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠলেন। অবশেষে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললেন। একথায় গগনচন্দ্রের বড় রাগ হল, তিনি বললেন, ‘জানেন, আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে লোকে আপনার বাড়ি দেখিয়ে বলবে যে এ বাড়িতে বিখ্যাত শিল্পী গগন পাল থাকতেন।’
বাড়িওয়ালা গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন, ‘পঁচিশ বছর লাগবে না। আপনি যদি এখনই ভাড়া মিটিয়ে না দেন তবে আজ বিকেল থেকেই লোকে বলবে যে এখানে গগন পাল থাকতেন।’