বাঘের দেশে বাঘের গল্প
আমি হাসতে হাসতে বললুম, যদি বলি, আমার বুকে বাঘের পায়ের ছাপ আছে, কেউ বিশ্বাস করবেন?
সত্যিই কেউ বিশ্বাস করল না, সবাই এমনভাবে চক্ষু অবনত করল যেন এই নিস্তব্ধ, নিমীল সন্ধ্যায় আমি কোনও অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি। এখানে এসব কথা মানায় না।
আমি আবার বললুম, সত্যিই বলছি কিন্তু, ইয়ার্কি নয়। একবার একটা বাঘ দু’পা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমার বুকে।
এবার শ্রোতারা চক্ষু তুলল। চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স্ক কিশোর মাঝিটি জিগ্যেস করল, সার্কেসের বাঘ, বাবু?
কথা হচ্ছিল সুন্দরবন অঞ্চলে এক বিশাল চওড়া নদী বক্ষে একটি খোলা নৌকোর ওপর। বেরিয়েছিলুম সারাদিনের জন্যে, এই নৌকোর ওপরেই খিচুড়ি ভোগ হল, রান্না করলুম নিজেরাই। আর এমন খিচুড়ি জীবনে খাইনি, কী অমৃতের মতন স্বাদ! আমার সঙ্গে আমার এক কলকাতার বন্ধু, তার এক স্থানীয় বন্ধু, একজন স্কুল শিক্ষক। আমি ছাড়া নাকি এই তিনজনেরই সুন্দরবনের সঙ্গে সংযোগ দীর্ঘদিনের, এই অঞ্চলের অনেক কিছুর খবরাখবর রাখেন। মাঝিদের মধ্যে একজনের বয়েস তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে যে কোনও জায়গায়, রোদ-বৃষ্টিতে পোড়া-ভেজা লোহার মতন গড়াপেটা শরীর, মুখে অনেক অভিজ্ঞতার ছাপ। আর একজন ওই পূর্বোক্ত কিশোর।
সুন্দরবনে এলেই বাঘের কথা মনে পড়ে। এর আগে কয়েকবার লঞ্চে চড়ে সুন্দরবন ঘুরে গেছি, কিন্তু সে শুধু প্রকৃতি দেখা। এযারে এসে আশ্রয় নিয়েছি একটি গ্রামে। যার পাশের গ্রামেই একটি ছটকে আসা বাঘ ধরা পড়েছে কিছুদিন আগে। সে বাঘটিকে রাখা হয়েছে কলকাতার চিড়িয়াখানায়, তার নাম দয়ারাম। আমি এখানে এসে পৌঁছবার পরের দিনই নদী সাঁতরে মোল্লাখালিতে এসে উঠেছিল একটা বাঘিনী, গ্রামের লোকজন সেটাকে ঘিরে রেঘেছিল, ভেবেছিলাম সেটাকে দেখতে যাব, বিকেলেই খবর পেলুম ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নীতির তোয়াক্কা না করে সেটিকে মেরে ফেলেছে। সুন্দরবনে ভগবানের চেয়েও বাঘের কথাই বেশি স্থান পায় আলাপচারিতে।
এবারে নৌকোয় বেরিয়ে বুঝলুম, লঞ্চ-ভ্রমণের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই হয় না। নৌকোয় বসে নদীকে অনেক কাছে পাওয়া যায়, দুপাশের জঙ্গলকে আমরাই শুধু দেখি না, জঙ্গলও আমাদের দেখে।
বাঘ সম্পর্কে আমাদের এক ধরনের শহুরে কৌতূহল আছে। সেইজন্য আমি বারবার সবাইকে জিগ্যেস করেছিলুম, আপনারা কেউ বাঘ দেখেননি? নিজের চোখে?
আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার নৌকোর সহযাত্রীরা সবাই নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়ল। এরা সবাই সুন্দরবনের নাড়ি নক্ষত্র জানে, এতদিন এখানে রয়েছে, অথচ কখনও বাঘ দেখেনি! আমি বাঘ সম্পর্কে রোমাঞ্চকর একাধিক গল্প শুনব আশা করেছিলুম। বেশ নিরাশ-নিরাশ লাগল। তখন আমি শুরু করলুম এক লোমহর্ষক কাহিনি।
কিশোর মাঝিটির প্রশ্ন শুনে আমি পালটা প্রশ্ন করলুম, ধরো যদি সার্কাসের বাঘই হয়। একটা সার্কাসের বাঘ যদি তোমাকে বুকে পা তুলে দাঁড়ায়, তুমি ভয় পাবে না?
ছেলেটি হেহে করে হাসতে লাগল। ইস্কুল মাস্টার এযার জিগ্যেস করলেন আপনি সত্যিই সার্কাসের বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছিলেন নাকি?
আমি বললুম, না। বাঘের থেকেও আমি শত হস্ত দূরেই থাকাই ভালো মনে করব। পাকে চক্রে একবার আমি সত্যিই একটা মস্ত বড় কেঁদো বাঘের খপ্পরে পড়েছিলুম। ব্যাপারটা হয়েছিল উড়িষ্যার যোশীপুরে।
আমার কলকাতায় বন্ধুটি যার নাম শিবাজি, সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ও খৈরি? নৌকোর অন্যান্য সুন্দরবনবাসী সঙ্গীরা কেউ খৈরির নাম শোনেনি। এদিকের লোকের সঙ্গে খবরের কাগজের বিশেষ সম্পর্ক নেই। বড়-মাঝি জিগ্যেস করল, খৈরি কী দাদা?
রায়মঙ্গল নদী ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি সমুদ্রের দিকে। ডান দিকে দত্ত ফরেস্ট, সেখানে বাঘ নেই খুব সম্ভবত। বাঁ-দিকের জঙ্গলটা বাঘের এলাকা বলে নির্দিষ্ট, আমরা চলেছি সেই ধার ঘেঁষেই। একটা জায়গায় নদীর জল খানিকটা খাঁড়ির মতন ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে, সেখানটার নাম কালীর চর, সেখানে হাজার-হাজার হাঁস এসে বসে। আমাদের গন্তব্য সেইদিকেই। সেখানে বাঘের উপদ্রবের ভয় আছে, আমরা কেউ শিকারি নই। সঙ্গে অস্ত্রও নেই, দূর থেকে পাখিগুলি দেখে আসাই উদ্দেশ্য।
এই পরিবেশে আমি জমিয়ে বাঘের গল্প শুরু করলুম।
অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে সুখকর ছিল না মোটেই, খানিকটা হাস্যকর হলেও হতে পারে।
সেবারে যাওয়ার কথা ছিল সিমলিপাল জঙ্গলে। কলকাতা থেকে ট্রেনে বারিপদা, সেখান থেকে আবার একটা গাড়ি কোনও ক্রমে জোগাড় করে যোশীপুর। অবশ্য সিমলিপাল যাওয়ার জন্য এত ঘুরপথে যাওয়ার কোনও দরকার হয় না, কিন্তু আমাদের ভ্রমণটাই উলটোপালটা। যোশীপুরে রাতটা কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা আমরা জিপ নিয়ে ঢুকব জঙ্গলে, সেই অনুযায়ী যোশীপুরে বাংলো বুক করা ছিল। কিন্তু তখন খৈরির কথা মনেই পড়েনি।
যোশীপুর বাংলোর কম্পাউন্ডও মস্ত বড়, মনে হয় যেন বাংলোর পেছন থেকেই জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। ঘরগুলোর সামনে বেশ বড় একটি ঢাকা বারান্দা। লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢোকার পরই দেখলুম, একটু দূরে গাছপালার মধ্যে ঘুরছে একটা হলুদ-কালো ডোরাকাটা কী যেন! সত্যিই একটা বাঘ! আমরা এসে গেলে বারান্দাটায় বসতে না বসতেই বাঘটা ঢলে এল সেখানে। ডি এফ–এ শ্ৰীযুক্ত চৌধুরীও সেখানে বসে বন কর্মচারীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন, সংক্ষেপে আমাদের জানালেন ভয় পাবেন না। ও কিছু করে না!
বাঘটা আমাদের প্রত্যেকের কাছে এসে গন্ধ শুকতে লাগল। আমাদের মধ্যে কারুকে তার পছন্দ হবে কি হবে না, কে জানে! আমি বড় সাইজের কুকুরও সহ্য করতে পারি না। কারুর বাড়িতে অ্যালসেশিয়ান কুকুর থাকলে সে বাড়িতে পারত পক্ষে যাই না। আমি লক্ষ করেছি, যাদের অ্যালসেশিয়ান থাকে, তারাও ঠিক ওই ভাবেই বলে, ‘‘ভয় পাবেন না! ও কিছু করে না!’ কিছু করে না মানে কী, কাছে এসে গন্ধ শুকবেই বা কেন?
একটু বাদে বাঘটা আবার বাগানে চলে গেল। আমরা চলে এলুম আমাদের নির্দিষ্ট ঘরে। জামাকাপড় ছাড়ব কি না ভাবছি, হঠাৎ শুনি জানালার কাছে মৃদু গর্জন। এবং বাঘের মুখ। বাঘটা জানলা দিয়ে আমাদের একটুক্ষণ দেখল, তারপরই ঢুকে এল আমাদের ঘরে। তার আগেই আমরা দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু একজন মহিলা (পরে জেনেছি, তাঁর নাম নীহার চৌধুরী) বলে উঠলেন, দরজা বন্ধ করবেন না! ও বন্ধ-দরজা দেখলে রেগে যায়! একটা বাঘকে খুশি করার জন্য আমাদের দরজা খোলা রাখতে হবে। কিন্তু ঘরের মধ্যে বাঘ এসে ঘোরাঘুরি করবে, এটাই বা কেমন কথা! সারা ঘরে বাঘ-বাঘ গন্ধ! আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম তাড়াতাড়ি। আবার এসে বসলুম বারান্দায়। যোশীপুরের এই বাঘটি সাধারণ বনের বাঘের চেয়েও আয়তনে অনেক বড়। একে রোজ আট কেজি মাংস ও এক টিন আমূল গুঁড়ো দুধ খাওয়ানো হয়। বনের বাঘ রোজ এত খাবার পাবে কোথায়? এর পেটে চর্বি থলথল করছে। বারান্দায় বসে শ্ৰীমতী চোধুরী তাঁর পালিতা কন্যা এই খৈরির বিষয়ে নানান কাহিনি শোনাতে লাগলেন। আমরা গল্প শুনছি বটে, কিন্তু আমাদের সকলের চোখ লক্ষ রাখছে বাঘটা কত দূরে। আমাদের পাঁচজন বন্ধুর দলের মধ্যে রয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সে ওই খৈরির বিষয়ে ইতিমধ্যেই একটি ছোটদের বই লিখে ফেলেছে। সুতরাং তার ভয় পেলে চলে না। শ্রীমতী চৌধুরীর সঙ্গেও তার আগে থেকে চেনা, সুতরাং ওই সব গল্প সে-ই উপভোগ করতে লাগল বেশি।
এরপর শুরু হল বাঘের ভোজন পর্ব। বাগানে এক জায়গায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল খৈরি, আর মা যেমন নিজের শিশুর মুখে খাদ্য তুলে দেয়, সেই ভাবে শ্রীমতী চৌধুরী ওর মুখে মাংস পুরে দিতে লাগলেন। কিন্তু বাঘ একজায়গায় বেশিক্ষণ বসে খায় না। এক এক গেরাস মুখে দিয়েই সে উঠে পড়ছে, ঢলে যাচ্ছে বাগানের দিকে, অনেক সাধ্য সাধনা করে ডেকে আনা হচ্ছে তাকে।
এক সময় বাঘটা হঠাৎ উঠে এল বারান্দায়, এবং নিমাই নামে আমাদের এক বন্ধুর বাঁ-হাতের কনুই শুদু অনেকখানি মুখে ভরে নিল। এবার একটু চাপ দিলেই নিমাইয়ের বাঁ-হাতখানা চিরতরে বাঘের পেটে চলে যাবে। বাঘটার হঠাৎ এরকম অদ্ভুত মতিগতির কারণ কী? ওর কি মোষের মাংস পছন্দ হয়নি বলে ও টাটকা মাংসের সন্ধানে এসেছে? ডি এফ ও শ্রীযুক্ত চৌধুরী যথারীতি বললেন, ভয় পাবেন না, ও কামড়াবে না!
ভয়ে মানুষের চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা শুধু বইতেই পড়েছিলুম, এর স্বচক্ষে দেখলুম। নিমাইয়ের মাথার সবকটা চুল সত্যিই খাড়া হয়ে গেছে, কাঁপা-কাঁপা গলায় সে বলল, ওকে সরিয়ে নিন, নইলে আমরা অজ্ঞান হয়ে যাব! ভয়ের চোটে নিমাই আমির বদলে আমরা বলে ফেলেছে। আমরা সশঙ্ক চিত্তে অথচ খানিকটা হাসতে-হাসতেও, দেখতে লাগলুম ওকে। এই হাসির শাস্তি আমি পেলুম সঙ্গে সঙ্গেই!
বাঘটা নিমাইকে ছেড়ে এদিক-ওদিক চেয়ে গজরাতে লাগল। বাঘের ডাকের সঙ্গে মানুষের জন্ম জন্মান্তরের ভয়ের সম্পর্ক। পোষা বাঘ হোক আর যাই হোক, এরকম ডাক শুনলে বুক আপনিই কেঁপে ওঠে।
বাঘটা এযার চলে এল সোজা আমার দিকে। তারপর সে আমার ডান দিকের বগলের মধ্যে ঢু মানতে লাগল। যেন সে আমার বগলের মধ্যে অতবড় মাথাটা ঢুকিয়ে দিতে চায়। আমি অসহায়ভাবে তাকালুম শ্রীমতী নীহার চৌধুরীর দিকে। তিনি স্নেহের হাসি দিয়ে বললেন, ও কিছু না। ও ঘামের গন্ধ শুকতে ভালোবাসে। তখন ঘাম মানে কী। আমার সারা শরীর দিয়ে কুলকুল করে ঘামের নদী বইছে!
বাঘটা আর একবার ঢু মারতেই আমি অটোমেটিক্যালি উঠে দাঁড়ালুম। সঙ্গে-সঙ্গে বাঘটাও দাঁড়িয়ে দুটো থাবা রাখল আমার বুকে। সেই কয়েকটি মুহূর্ত অমি জীবনে কখনও ভুলব না। আমার শরীরের ওপরে একটা বিরাট কেঁদো বাঘ, আমার চোখের সামনে ওর জ্বলন্ত চোখ, সেই অবস্থায় বাঘটা ফ-র-র-র করে থুতু ছেটাল, সেই থুতুতে ভিজে গেল আমার মুখ ও জামা। ওরই মধ্যে আমি ভাবলুম, বাঘটা যদি আমায় না-ও কামড়ায়, আমি যদি বাঘটাকে শুক্কু মাটিতে পড়ে যাই, তাহলে ওর অতবড় দেহের ভারেই আমি ছাতু হয়ে যাব। শ্ৰীমতী চৌধুরী বারবার বলতে লাগলেন, ভয় পাবেন না, নড়বেন, ওর গায়ে হাত ঝুলিয়ে দিন। কিন্তু হাত তোলার সাধ্য আমার নেই, আমার সারা শরীর অসাড়। আমারও মাথার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল কি না তা তো আমি নিজের চোখে দেখিনি, তবে ওই অবস্থায় আর একটুক্ষণ থাকলে আমি নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যেতুম!
ইতিমধ্যে ‘খৈরি, আমার খৈরি’ গ্রন্থের প্রণেতা শক্তি আমার পাশ থেকে সুট করে উঠে গিয়ে সোজা চলে গেছে গেটের দিকে। নিমাই বাংলোর বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সারারাত এই মাঠে শুয়ে থাকব, তবু ওর মধ্যে আর যাব না। আমাদের দলনেতা পার্থসারথি চৌধুরী বলল, নাঃ, ওই বাঘের সঙ্গে রাত্রিবাস করা মোটেই কাজের কথা নয়। চলো, এক্ষুনি জঙ্গলে চলে যাই! তাই হল, আমরা রওনা দিলুম সেই দণ্ডেই! গল্প বলা শেষ করে আমি আমার বুকে হাত বুলিয়ে বললুম, এই যে ঠিক এই জায়গায় বাঘটা তার থাবা রেখেছিল।
শ্রোতারা সবাই চুপ। একটু পরে বড় মাঝিটি শুধু খানিকটা বিস্ময় খানিকটা বিরক্তি মিশিয়ে বলল, শখ করে কেউ বাঘ পোষে? থুঃ! ওটাকে মেরে ফেলে না কেন?
আমি বললুম, মারবে কী? ওই বাঘটা খুব বিখ্যাত, সারা পৃথিবীর অনেক পত্রপত্রিকায় ওর ছবি ছাপা হয়েছে।
বড়-মাঝি আবার নদীর জলে থুতু ফেলল। টাইগার প্রজেক্টের জন্য সুন্দরবনে বহু টাকা খরচ করে কতরকম বন্দোবস্ত হচ্ছে, কিন্তু সুন্দরবন এলাকার যতজনের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা সকলেই বাঘকে শত্রু বলে মনে করে, এবং তাদের মতে বাঘ নামক প্রাণী জাতিটাকে বাঁচিয়ে রাখবার কোনও প্রয়োজন নেই।
আস্তে-আস্তে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কালীর চরের বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা। খাড়ির মধ্যে অনেক হাঁসের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি বটে, কিন্তু আলো কমে আসায় আর ঠিক মতন দেখা যাচ্ছে না। আমি আর একটু ভেতরে যাওয়ার কথা বললুম, কিন্তু মাঝি বা অন্য কেউ রাজি হল না। একটু পরেই ভাটা শুরু হলে ফেরা মুশকিল হবে। তা ছাড়া জায়গাটা ভালো নয়। এই বনে বাঘ আছে তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় ডাকাতের। আমি বললুম, আমাদের কাছে তো টাকাপয়সা কিছু নেই, ডাকাত আমাদের কী করবে? মাস্টারমশাই বললেন, এখানকার ডাকাতদের ব্যাপার আপনারা জানেন না। কিছু না পেলে ওরা জামাকাপড় খুলে নেয়। আপনি যে প্যান্ট-শার্ট পরে আছেন, তার দামও তো কিছু না হোক সত্তর আশি টাকা। আর এই নৌকাটা, এরও তো দাম আছে। জামা-প্যান্ট খুলে নিয়ে ওরা লোককে এই জঙ্গলের পাশে নামিয়ে দিয়ে যায়।
আমি পাশের জঙ্গলের দিকে তাকালুম। দিনের বেলা দেখতে চমৎকার লাগছিল। এখন অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সেই জঙ্গলের দিকে তাকাতেই গা ছমছম করছে। নগ্ন অবস্থায় রাত্রিরবেলা এই জঙ্গলের পাশে পড়ে থাকা মোটেই উপাদেয় চিন্তা নয়।
সকলেরই মত হল, তা হলে এর ফেরা যাক। কিন্তু খুব নির্বিঘ্নে ফেরা গেল না। একটুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ভাটার টান, এখন উলটো দিকে যাওয়া যাবে না। আমাদের নৌকো একটা চরে আটকে গেল। জোয়ার আসবে ঘণ্টাদেড়েক বাদে।
আমাদের নৌকোটা অবশ্য জঙ্গলের খুব কাছে নয়। কোনও বাঘ হঠাৎ এক লাফে নৌকোর ওপর পড়তে পারবে না, সাঁতরে আসতে হবে। এই নদীর জলেও খুব কামঠের। উপদ্রব, এবং কুমীর প্রকল্পের উদ্যোগে কিছুদিন আগেই এই নদীতে চল্লিশটি কুমিরের বাচ্চা ছাড়া হয়েছে।
চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। জঙ্গলের দিকে তাকাতেই মনে হয়, একটা বাঘ বুঝি আমাদের একদৃষ্টে দেখছে। খুবই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এ জঙ্গলে জোনাকিও জ্বলে না। কিন্তু বাঘের চেয়ে ডাকাতের কথাই আমার মনে পড়তে লাগল বেশি।
বড়-মাঝিকে আমি আবার জিগ্যেস করলুম, আপনি এতদিন সুন্দবনের নদীতে নৌকো চালাচ্ছেন, সত্যিই কখনও বাঘ দেখেননি?
বড়-মাঝি বললেন, না!
তারপর যেন একটু ধমকের সুরেই আমায় আবার বলল, বাবু একটু চুপ করেন তো! অথবা এই সময়টা আপনি একটু ঘুমিয়ে লিন বরং।
আমি একটু ক্ষুণ্ণ হলুম। এই ভর সন্ধেতে হঠাৎ আমি ঘুমোতে যাব কেন? তবে নৌকোর অন্য-অন্য আরোহীদের মধ্যে যেন একটা ঝিমুনির ভাব এসে গেছে। কেউ কোনও কথা বলছে না। অগত্যা আমিও চুপ করে গেলুম।
এক সময় নৌকোর তলায় জলের কলকল শব্দেই টের পাওয়া গেল জোয়ার এসেছে। সঙ্গে-সঙ্গে সবাই যেন এক সঙ্গে জেগে উঠল। নৌকো চলল আবার। রাত সাড়ে দশটায় আমরা ফিরে এলুম আমাদের গ্রামের কাছে।
জেটিতে নৌকো বেঁধে ওপরে উঠে আসার পর বড়-মাঝি বলল, দাদা, আপনি বাঘের কথা জিগ্যেস কচ্ছিলেন না? এই দ্যাখেন। টর্চটা মেরে দ্যাখেন।
এই বলে সে জামাটা তুলে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল। টর্চের আলোয় দেখলুম, তার পিঠে গভীর ক্ষত। খুব বেশি পুরোনোও মনে হল না।
মাস্টারমশাই বললেন, ওর কী কড়া জান, বাঘ কামড়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারপরও বেঁচে উঠেছে।
বড়-মাঝি দম্ভ করে বলল, আমারে খাবে, এমন বাপের ব্যাটা বাঘ আজও জন্মায়নি, বোঝলেন! মাস্টারমশাই বলল, ও বাঘের গুনিন। সবাই ভাবে, সেই জন্যই বাঘে ধরার পরও বেঁচে উঠেছে। ওদের মুখ থেকে আরও শুনলুম, এই মাঝি তার এই নৌকো নিয়ে প্রায়ই জঙ্গলে যায় বেআইনি কাঠ কাটতে। সুন্দরবনের অনেকেরই জীবিকার সঙ্গে কাঠ জড়িত। একবার নয়, মোট পাঁচবার, ওই মাঝি দলবল নিয়ে বাঘের সামনে পড়েছে, তবু আবার যায়। ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে অনেক যার। অন্য বন্ধুটিও বলল, দীনেশ নামে একটি ছেলে তার বাড়িতে কাজ করত, মাত্র মাসখানেক আগে সে এইরকম একটি কাটার দলের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে আর ফেরেনি।
এদের সকলেরই বাঘ বা ডাকাত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু নৌকোর ওপর বসে আমি যখন এদের কাছ থেকে দু-একটা ঘটনা শুনতে চাইছিলুম, তখন সবাই চুপ করেছিল কেন?
মাস্টারমশাই আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন, জঙ্গলের কাছে বাঘের এলাকার মধ্যে গিয়ে বাঘের গল্প করা তো দূরের কথা, কেউ বাঘের নামও উচ্চারণ করে না। ওই প্রসঙ্গ তুলে আমিই ভুল করেছিলুম।
সত্যিই আমার ভুল হয়েছিল।