বাঘিনী

বাঘিনী

একটা বাঘিনী শিকার করিয়াছিলাম।

আমি শিকারী, অনেকগুলা বাঘ ভালুক মারিয়াছি। কিন্তু এই বাঘিনীটাকে মারিবার পর তাহার সম্বন্ধে যে গল্প শুনিয়াছিলাম তাহা আমার মতো পুরানো শিকারীকেও অবাক করিয়া দিয়াছিল। সাধারণ পাঠক হয়তো গল্পটা বিশ্বাস করিবেন না, মনে করিবেন আমি ঈশপের নব সংস্করণ রচনা করিতেছি কিংবা বাঘিনীকে লইয়া একটু রঙ্গ-পরিহাস করিবার চেষ্টা করিতেছি। একথা সত্য, আমরা বাঙালী জাতি বাঘ-ভালুক লইয়া তামাসা করিতে ভালবাসি; কাতুকুতু দিয়া বাঘ মারা কিংবা ভালুকের দাড়ি কামাইয়া তাহাকে বধ করার গল্প আমাদের অনাবিল আনন্দ দান করিয়া থাকে। ইহাতে নিন্দারও কিছু দেখি না। আমি শুধু বলিতে চাই, এ কাহিনীটি সে-জাতীয় নয়। আমি ইহা অবিশ্বাস করিতে পারি নাই, এবং আমার পাঠকগণের মধ্যে বাঘের চরিত্রজ্ঞ প্রবীণ শিকারী যদি কেহ থাকেন তিনিও হয়তো ইহা হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিবেন না।

ভারতবর্ষের উত্তরদিকে বঙ্গ বিহারের সমতলভূমি যেখানে দেবতাত্মা হিমালয়ের পাদমূলে গিয়া মিশিয়াছে, সেই পাহাড় জঙ্গল ভরা দুর্গম কঠিন ভূভাগ এখনও মানুষের করায়ত্ত হয় নাই; এখনও সেখানে হরিণ শম্বর চমরী নীলগাই প্রভৃতি জন্তু এবং তাহাদের ভক্ষক বাঘ নেক্‌ড়ে চিতা হায়না স্বচ্ছন্দে বিচরণ করিয়া বেড়ায়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যে সব উপত্যকা আছে তাহাতে মানুষ জঙ্গল পরিষ্কার করিয়া গ্রাম রচনা করিয়া বাস করিতেছে বটে কিন্তু তাহা যেন নিতান্তই ভয়ে ভয়ে—সসঙ্কোচে। শ্বাপদের অধিকারই এখনও বলবৎ আছে।

শিকারের সন্ধানে একবার ঐদিক পানে গিয়া পড়িয়াছিলাম। জনপদ-বিরল উপল-কর্কশ তরাইয়ের সীমান্ত ধরিয়া স্থানে স্থানে ছোট ছোট সরকারী চৌকি আছে, এইরূপ একটি চৌকিতে উপস্থিত হইয়া শুনিলাম নিকটবর্তী একটি গ্রামে এক বাঘিনী বড় উৎপাত করিতেছে। গ্রামের দুইজন মাতব্বর চৌকিতে আসিয়াছিল; তাহাদের মুখে বাঘিনীর কাহিনী শুনিলাম।

মাতব্বর দুইজন জাতিতে পাহাড়ী; বেঁটে খাটো, চক্ষুর একটু বঙ্কিমতা আছে, মুখে দাড়ি গোঁফের বাহুল্য নাই। আমি শিকারী শুনিয়া তাহারা আমাকে ধরিয়া বসিল। তাহাদের গ্রামে কয়েক বছর ধরিয়া একটা বাঘিনী দারুণ উৎপীড়ন করিতেছে; কত যে স্ত্রীলোক আর গরু-মেষ মারিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। মাঝে তাহার হিংস্র অভিযান কিছুকালের জন্য বন্ধ ছিল, আবার সম্প্রতি আরম্ভ হইয়াছে। ভয়ে গাঁয়ের মেয়েরা ঘরের বাহির হইতে পারে না। বাঘিনীর বিশেষত্ব এই, সে পুরুষকে বড় একটা আক্রমণ করে না, কিন্তু সুযোগ পাইলেই স্ত্রীলোক মারে। ফলে মেয়েদের জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করা, ক্ষেতে কাজ করা প্রভৃতি বন্ধ হইয়াছে।

এই লইয়া গ্রামের লোকেরা বারবার সরকারের নিকট আবেদন করিয়াছে কিন্তু কোনও ফল পায় নাই। সরকার পঞ্চাশ টাকার একটি পুরস্কার ঘোষণা করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত আছেন। এখন আমি যদি বাঘিনীটাকে মারিয়া এই করাল বিভীষিকার হাত হইতে গ্রামটিকে উদ্ধার করি তবেই রক্ষা, নচেৎ গ্রামে আর মানুষ থাকিবে না।

ঘাঁটিদার মহাশয়কে প্রশ্ন করায় তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সহিত অনুমতি দিলেন; বাঘিনীটার নিদানকাল যে এতদিন আমার মতো একজন জাঁদরেল শিকারীর জন্য অপেক্ষা করিয়াছিল এবং পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার যে একমাত্র আমারই প্রাপ্য এ বিষয়ে তিনি নিঃসংশয় দৃঢ়বিশ্বাস জানাইলেন। তাঁহার এত উৎসাহের কারণ কিন্তু ঠিক বুঝিলাম না। তাঁহার নিজেরও বন্দুক আছে, তবে তিনি নিজেই বাঘিনীকে বধ করেন নাই কেন? আমার মতো ধুরন্ধর শিকারীর জন্য প্রতীক্ষা করার কী প্রয়োজন ছিল? পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার কি তাঁহার কাছে এতই তুচ্ছ?

যাহোক, পরদিন অতি প্রত্যুষে মাতব্বর দুইজনের সঙ্গে পদব্রজে যাত্রা করিলাম। গ্রাম মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে, শিকারীর পক্ষে পঁচিশ মাইল হাঁটা কিছুই নয়। সুতরাং দ্বিপ্রহরের মধ্যেই যে অকুস্থলে গিয়া পৌঁছিব তাহাতে সন্দেহ নাই। এমন কি, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইলে আজ রাত্রেই বাঘিনীকে মারিয়া কাল সন্ধ্যার মধ্যে ফিরিয়া আসিতে পারি।

পথের বিস্তারিত বিবরণ আর দিব না। দুইদিন পরে ক্ষতবিক্ষত চরণ ও ভাঙা ঢরঢরে শরীর লইয়া গ্রামে উপস্থিত হইলাম। দূরত্ব পঁচিশ মাইল বটে, ঘাঁটিদার মহাশয় মিথ্যা বলেন নাই। কাক-পক্ষীর পক্ষে এ গ্রামে আসা খুবই সহজ, কিন্তু দ্বিপদ মনুষ্যকে যে এখানে আসিতে হইলে তিনটি উঁচু উঁচু পাহাড়ের পৃষ্ঠ উত্তীর্ণ হইয়া কখনও গাছের ডাল ধরিয়া ঝুলিতে ঝুলিতে, কদাচিৎ ইদুরের গর্তের মতো সঙ্কীর্ণ রন্ধ্রপথে হামাগুড়ি দিয়া আসিতে হয়, এ কথার উল্লেখ করিতে তিনি ভুলিয়া গিয়াছিলেন এবং কেন যে তিনি পঞ্চাশ টাকার পুরস্কারের সৌভাগ্য নিজে না অর্জন করিয়া উদারভাবে আমাকে অর্পণ করিয়াছিলেন, তাহা এই পথ অতিক্রম করিবার পর অতি বড় জন্মনিরেটেরও অনুমান করিতে বিলম্ব হয় না।

গায়ের ব্যথা মরিতে পুরা একদিন গেল। গ্রামবাসীরা কিন্তু খুবই আদর যত্ন করিল। গ্রামের প্রান্তে একটি খড়ের ঘর পুরাপুরি আমাকে ছাড়িয়া দিল এবং দধি দুগ্ধ এত সরবরাহ করিল যে তাহার দ্বারা একটি কন্যার বিবাহ সহজেই নিষ্পন্ন হয়। তাছাড়া, ইহারা শজারুর মাংস হইতে এমন উৎকৃষ্ট শিক-কাবাব তৈয়ার করিতে জানে যে তাহার স্বাদ আর ভোলা যায় না এবং ইহাদের চোলাই করা মহুয়ার আরকও অবহেলার বস্তু নয়।

গ্রামের লোকসংখ্যা ছেলে বুড়ো মিলাইয়া প্রায় শ’দেড়েক হইবে। সকলেই পাহাড়ী। তাছাড়া গৃহপালিত গরু মোষ ছাগল আছে। গাঁয়ের চারিপাশে জঙ্গল কাটিয়া চারণভূমি ও গমের ক্ষেত তৈয়ার হইয়াছে। কাছে-পিঠে অন্য গ্রাম নাই; সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রামটি দশ মাইল দূরে—এদেশের দশ মাইল। এমনিভাবে পৃথিবীর কলকোলাহল হইতে একান্ত নির্বিবাদে দুর্গম গিরিসঙ্কটের মাঝখানে এই ক্ষুদ্র মনুষ্যগোষ্ঠী বাস করিতেছে। ইহাদের জীবনে মদান্ধসিন্ধুরঘটার ঘণ্টারণৎকার নাই, লব্ধস্তুতি ভূপতির উগ্র অহংকার নাই। কেবল সম্প্রতি একটা বাঘিনী আসিয়া তাহাদের নির্বিঘ্ন নিরস্ত্র জীবনযাত্রাকে শঙ্কা-সঙ্কুল করিয়া তুলিয়াছে।

পরদিন দ্বিপ্রহরের মিঠে কড়া রৌদ্রে খোলা জায়গায় বসিয়া বন্দুটিকে তৈলাক্ত করিতেছিলাম ও গ্রামবাসীদের গল্প শুনিতেছিলাম, তাহারা অনেকগুলি আমাকে ঘিরিয়া বসিয়াছিল। কেবল একটি ছোকরা অদুরে গাছের ডাল ধরিয়া দাঁড়াইয়া নীরবে আমার মুখের পান তাকাইয়া ছিল। পাহাড়ীদের বয়স অনুমান করা সহজ নয়, তবু তাহার বয়স যে কুড়ি-একুশের বেশী নয় তাহা বোঝা যায়। খর্ব দেহ, মুখখানি ভাবলেশহীন, কিন্তু কেন জানি না তাহার নিষ্পলক চক্ষুদুটি অস্বস্তিকর একাগ্রতায় আমার মুখের উপর স্থির হইয়া ছিল।

গ্রামবাসীদের কথাবার্তায় বাঘিনী সম্বন্ধে আরও কিছু খবর পাওয়া গেল। বাঘিনীটা অত্যন্ত নির্ভীক, দিনের বেলাতেও গ্রামের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়, পাহাড়তলীর জলাশয়ের কাছে ওৎ পাতিয়া থাকে। মেয়েদের জল আনিতে যাওয়া বন্ধ হইয়াছে, পুরুষেরা দলবদ্ধ হইয়া লাঠি-কাটারি-টাঙি লইয়া জল ভরিতে যায়। মেয়েদের কাজ পুরুষদের করিতে হয় এজন্য পুরুষেরা লজ্জিত। আর একটা আশ্চর্য কথা শুনিলাম, বাঘিনী এই গ্রামটিকেই বিশেষভাবে নিজের লক্ষ্যবস্তু করিয়া বাছিয়া লইয়াছে, অন্য কোনও গ্রামের প্রতি তাহার কোনও আক্রোশ নাই।

আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগিল। বাঘের চরিত্রে এরূপ পক্ষপাত দেখা যায় না। প্রথমত মানুষ বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়, নেহাৎ দায়ে পড়িয়া উহারা নরভুক হইয়া উঠে। শিকারীরা জানেন, কোনও কারণে বাঘের দাঁত ভাঙিয়া গেলে কিংবা পায়ে স্থায়ী জখম হইয়া গতিবেগ হ্রাস হইলে তাহারা স্বীয় ন্যায্য শিকার ধরিতে পারে না, তখন বাধ্য হইয়া নরভুক হইয়া পড়ে। সবল সুস্থ বাঘ কখনও মানুষ খায় না। এই বাঘিনীটা যদি শারীরিক কোনও অসামর্থ্যের জন্যই নরভুক হইয়া থাকে, তবে সে কেবল স্ত্রীলোক ধরিয়া খাইবে কেন? তাছাড়া, বিশ মাইল পরিধির মধ্যে আরও পাঁচখানা গ্রাম আছে, সেগুলি ছাড়িয়া একান্তভাবে এই গ্রামের উপরেই তাহার নজর কেন?

গ্রামের অনেকেই বাঘিনীকে চক্ষে দেখিয়াছে, কিন্তু কেহই তাহাকে খোঁড়াইতে দেখে নাই। বাঘিনী দিব্য হৃষ্টপুষ্ট ও স্বাস্থ্যবতী। সে কখনও মদগর্বে হেলিয়া দুলিয়া হাঁটিয়া যায়, কখনও বিদ্যুতের পীতবর্ণ রেখার ন্যায় নিমেষে এক ঝোপ হইতে অন্য ঝোপে অদৃশ্য হয়। সুতরাং সে যে বার্ধক্যে অথর্ব হইয়া পড়ে নাই, ইহাও নিঃসংশয়ে বলা যায়।

প্রশ্ন করিলাম, এটা বাঘিনী—বাঘ নয়—তাহা তোমারা কি করিয়া বুঝিলে? ইহার সদুত্তর কেহ দিতে পারিল না, কিন্তু কয়েকজন তরুণবয়স্ক ঘাড় ফিরাইয়া বৃক্ষতলস্থ ছোকরার পানে চাহিয়া হাসিল। আমিও চকিতে তাহার দিকে তাকাইলাম। তাহার মুখের কোনও ভাবান্তর নাই, সে তেমনি একাগ্র নির্নিমেষ চক্ষে আমার পানে চাহিয়া আছে। সমবয়স্কদের হাসির ইঙ্গিত তাহার কানে পৌঁছিল কি না সন্দেহ।

অপরাহ্নের দিকে গ্রামবাসীরা একে একে যে যার কাজে চলিয়া গেল, কেবল ছোকরাটি গাছের তলায় পূর্ববৎ দাঁড়াইয়া রহিল। স্থান একেবারে শূন্য হইয়া গেলে সে ধীরে ধীরে আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলিল, ‘সাহেব, বাঘিনীকে মারিয়া ফেলিবার প্রয়োজন আছে কি? উহাকে কোনও উপায়ে তাড়াইয়া দেওয়া যায় না?’

আমি বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘তাড়াইয়া দিলে আবার আসিবে। আমি তো চিরকাল এখানে থাকিয়া বাঘ তাড়াইতে পারিব না।’

সে আর কিছু বলিল না, খানিকক্ষণ অপ্রতিভভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল।

এ পর্যন্ত যাহা লিখিলাম, দেখিতেছি বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচির মতো তাহা বাঘ-মারার গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। পাঠক নিশ্চয় অধীর হইয়া উঠিয়াছেন, ভাবিতেছেন বাঘিনী কৈ? আমার দুর্ভাগ্য আমি লেখক নই, শিকারী মাত্র। বাঘ শিকারের উদ্যোগ আয়োজনই দীর্ঘ, আসল হত্যাকাণ্ডটা অতি অল্প সময়েই সংঘটিত হয়। তাই বোধ হয় আমার কাহিনীতেও উদ্যোগপর্বটাই লম্বা হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু আর নয়, এবার চট‌পট বাঘিনীকে সংহার করা প্রয়োজন।

মজার কথা এই যে, বাঘিনীকে সংহার করিতে আমাকে বিন্দুমাত্র বেগ পাইতে হয় নাই। গ্রাম হইতে আধ মাইল দূরে নিম্নভূমিতে গ্রামের জলাশয়, প্রথমে সেটিকে তদারক করিতে গেলাম। দেখিলাম জলের ধারে বড় বড় থাবার দাগ রহিয়াছে—বাঘিনী জল খাইতে আসে। সুতরাং তাহার খোঁজে ঘুরিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন নাই, এইখানেই তাহাকে পাওয়া যাইবে।

জলাশয়টি বেশী বড় নয়, দুই পাশের পাহাড়-ঝরা জল এখানে সঞ্চিত হইয়া একটি কুণ্ড রচনা করিয়াছে। জলাশয়ের একদিকের পাহাড়টা প্রায় খাড়া ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে। আমার ভারি সুবিধা হইল, মাচান বাঁধিবার প্রয়োজন হইল না; সন্ধ্যার পর ঐ পাহাড়ের গায়ে সমতল হইতে পঁচিশ হাত উঁচুতে একটা কুলুঙ্গির মতো স্থানে উঠিয়া পাহারা আরম্ভ করিলাম। এখানে বাঘিনী কোনও ক্রমে আমার নাগাল পাইবে না, অথচ সে জল খাইতে আসিলে আমি তাহাকে সম্মুখেই দেখিতে পাইব। আকাশে প্রায় পূণাকৃতি চাঁদ ছিল, সুতরাং শেষ রাত্রি পর্যন্ত আলো পাওয়া যাইবে।

শেষ রাত্রি পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিতে হইল না, দশটার মধ্যেই বাঘিনী আসিল। আমি জীবনে আটটা বাঘ মারিয়াছি কিন্তু এখনও অতর্কিতে বাঘ সম্মুখে উপস্থিত হইলে বুকের একটা স্পন্দন বাদ পড়িয়া যায়। দেখিলাম, জলাশয়ের ওপারে একটাকাঁটার ঝাড় নড়িয়া উঠিল, তারপরই বাঘিনী বাহির হইয়া আসিল। তাহার হলুদবর্ণ মসৃণ অঙ্গে চাঁদের আলো পিছলাইয়া পড়িতেছে—গতির কি অপূর্ব নির্ভীক সাবলীলতা! সুস্থ সবল বনের বাঘের মতো এমন উগ্র ভয়ানক লাবণ্য আর কোনও জন্তুর নাই।

বাঘিনী ডাহিনে বাঁয়ে ভ্রূক্ষেপ করিল না। সটান জলাশয়ের কিনারায় আসিয়া চক্‌চক্‌ করিয়া জলপান করিতে লাগিল। চাঁদ মধ্যগগনে উঠিয়াছে, দেখিবার কোনও অসুবিধা নাই, প্রায় দিনের মতোই আলো। আমি নিঃশব্দে বন্দুক তুলিয়া লইলাম। টোটা ভরাই ছিল, লক্ষ্য স্থির করিয়া সন্তর্পণে সেফ্‌টি-ক্যাচ্‌ টিপিলাম। খুট করিয়া শব্দ হইল। অমনি বাঘিনী মুখ তুলিয়া চাহিল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া টিপিলাম—কড়াৎ! বাঘিনী তীব্র একটা চিৎকার করিয়া শুন্যে লাফাইয়া উঠিল, তারপর মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিল। মিনিটখানেক পরে তাহার ছটফটানি শান্ত হইল।

আমি আরও দশ মিনিট বন্দুক বাগাইয়া কুলুঙ্গিতে বসিয়া রহিলাম, কিন্তু বাঘিনী আর নড়িল না। তখন ধীরে ধীরে নামিয়া আসিয়া গ্রামে ফিরিলাম। গ্রামের লোকেরা কান পাতিয়া ছিল, নিস্তব্ধ নৈশবাতাসে বন্দুকের আওয়াজও শুনিয়াছিল, কিন্তু ফলাফল সম্বন্ধে পাকা খবর না পাওয়া পর্যন্ত গ্রামের বাহির হইতে সাহস করিতেছিল না। এখন খবর পাইয়া তাহারা মহানন্দে নৃত্য শুরু করিয়া দিল। একদল যুবক তৎক্ষণাৎ বাঘিনীর মৃতদেহটা আনিতে ছুটিল। গ্রামের মেয়েরা, যাহারা এতকাল নিজ নিজ ঘরের চৌকাঠ পার হইতে সাহস করিত না, তাহারা দলে দলে বাহিরে আসিয়া কলকোলাহল করিতে লাগিল।

যুবকেরা বাঘিনীর মৃতদেহটা বাঁশে ঝুলাইয়া যখন লইয়া আসিল তখন আমার কুটিরের সম্মুখে প্রকাণ্ড ধুনি জ্বলিতেছে, গ্রামের লোকেরা পর্বতপ্রমাণ কাঠ জড় করিয়া তাহাতে আগুন দিয়াছে। বাঘিনীর দেহ আগুনের পাশে শোয়াইয়া দিতেই সকলে সেটাকে ঘিরিয়া ধরিল। জীবন্ত অবস্থায় যে জন্তুটা গ্রামের ত্রাসস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার মৃতদেহটাকে কেহই সম্ভ্রম দেখাইল না।

অতঃপর প্রায় সারারাত্রি ধরিয়া উৎসব চলিল। কয়েকটা আস্ত ছাগদেহ আগুনের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া শূল্য মাংস তৈয়ার হইতে লাগিল। ঘড়া ঘড়া মহুয়ার নির্যাস অতি দ্রুত সজীব আধারে স্থানান্তরিত হইয়া পাহাড়ীদের নৃত্যগীতানুরাগ অতিমাত্রায় বাড়াইয়া তুলিল।

গ্রামবাসীদের অপর্যাপ্ত কৃতজ্ঞতা, শূল্য মাংস এবং মহুয়ারস সেবন করিয়া আমি আগুনের পাশেই কম্বল বিছাইয়া শয়ন করিয়াছিলাম। উৎসবকারিদের ঢোল-খঞ্জনী প্রভৃতির শব্দের মধ্যেও ক্রমশ একটু তন্দ্রাবেশ হইয়াছিল। সত্য কথা বলিতে কি, আগুনের আতপ্ত প্রসাদে, সার্থকতার নিশ্চিন্ত তৃপ্তিতে এবং উদরস্থ খাদ্যপানীয়ের অলক্ষিত প্রভাবে বোধহয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।

হঠাৎ এক সময় চট্‌কা ভাঙিয়া দেখি, উৎসবকারিরা কখন চলিয়া গিয়াছে, ধুনীর আগুন জ্বলিয়া জ্বলিয়া প্রকাণ্ড অঙ্গারগোলকে পরিণত হইয়াছে। হাতঘড়িতে দেখিলাম রাত্রি তিনটা। আগুন সত্ত্বেও শেষ রাত্রির ঠাণ্ডায় একটু গা শীত-শীত করিতেছিল, ঘরের ভিতর গিয়া শুইব কি না মনে মনে একটু গবেষণা করিতেছি, চোখ পড়িল মৃত বাঘিনীটার উপর। দেখি, একটা মানুষ বাঘিনীর মুণ্ড কোলে লইয়া বসিয়া আছে এবং অত্যন্ত স্নেহভরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। ভাল করিয়া চক্ষুর জড়তা দূর করিয়া দেখিলাম, সেই ছোকরা! তাহার মুখ আর ভাবহীন নয়, চক্ষু দিয়া নিঃশব্দ অশ্রুর ধারা গড়াইয়া পড়িতেছে, প্রিয়জন বিয়োগের নিঃসংশয় বেদনা তাহার মুখে অঙ্কিত রহিয়াছে।

এই দৃশ্য একটা উৎকট হাস্যরসাত্মক স্বপ্ন বলিয়াই মনে করিতাম যদি না ছোকরার সহিত দ্বিপ্রহরের আলাপের কথা স্মরণ থাকিত। আমি গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বসিলাম। ইহার পিছনে একটা গল্প আছে সন্দেহ নাই।

আমি জাগিয়াছি দেখিয়া সে বাঘিনীর মাথা নামাইয়া রাখিয়া আমার কাছে আসিয়া বসিল। নিজের অশ্রুচিহ্নিত শোক লুকাইবার চেষ্টা করিল না, ভগ্নস্বরে বলিল, ‘ওর সঙ্গে আমার বড় ভালবাসা ছিল।’

বলিলাম, ‘গল্পটা গোড়া থেকে বল।’

অতঃপর, সে যে-কাহিনী বলিয়াছিল, তাহাই বাংলায় ভাষান্তরিত করিয়া লিখিতেছি। তাহার নাম রূপদমন, সম্ভবত রিপুদমনের অপভ্রংশ।

পাঁচ বছর আগে যখন রূপদমনের বয়স ষোল বছর ছিল, তখন সে কাটারি লইয়া বনে কাঠ কাটিতে যাইত। ঐ বয়সের ছেলেরা বনের গাছে উঠিয়া সরু সরু ডালগুলি কাটিয়া মাটিতে ফেলিয়া আসিবে, পরে সেই ডালগুলি শুকাইলে গ্রামের মেয়েরা গিয়া তাহা তুলিয়া আনিবে, ইহাই তাহাদের কাষ্ঠ আহরণের রীতি।

ছেলেরা দল বাঁধিয়া দুপুরবেলা কাঠ কাটিতে যাইত, তারপর এগাছ ওগাছ করিতে করিতে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িত। কখনও বা কাঠ কাটা শেষ হইলে তাহারা একত্র হইয়া বনের মধ্যে লুকোচুরি খেলিত, তারপর সকলে মিলিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিত। একটা মানুষ-খেকো বাঘ সম্প্রতি গ্রামে উৎপাত করিতেছে ইহা তাহারা জানিত। কিন্তু ও বয়সের ছেলেরা ডানপিটে হয়; বাঘের ভয় তাহাদের ছিল না। শিশুকাল হইতে তাহারা বনে বাঘ দেখিয়াছে, বাঘ কখনও তাহাদের অনিষ্ট করে নাই। বাঘ দেখিলেই স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হয়, তাহা হইলে বাঘ আর কিছু বলে না, ধীরে ধীরে আপন গন্তব্য স্থানে চলিয়া যায়। ইহাই তাহাদের শিক্ষা।

একদিন লুকোচুরি খেলিতে খেলিতে রূপদমন একটি ভারি সুন্দর লুকাইবার স্থান খুঁজিয়া পাইয়াছিল। কতকগুলা বড় বড় পাথরের চাঁই এক জায়গায় ঘাড়ে মুণ্ডে হইয়া পড়িয়া আছে, তাহাদের ফাঁকে ফাঁকে গুড়ি মারিয়া ভিতরে ঢোকা যায়। ভিতরে ছোট একটি কুঠুরীর মতো স্থান, উপরদিকে কয়েকটা ফোকর আছে কিন্তু তাহাদের চারিপাশে কাঁটার ঝাড় এত ঘন হইয়া জন্মিয়াছে যে, আকাশ দেখা যায় না। এইখানে সবুজ আলোয় ভরা নিভৃত আশ্রয়টিতে রূপদমন লুকাইয়াছিল। সেদিন তাহার খেলার সাথীরা তাহাকে খুঁজিয়া পায় নাই।

অনেকক্ষণ একলা বসিয়া রূপদমন শেষে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। তাহার সঙ্গীরা তাহাকে খুঁজিয়া না পাইয়া কখন চলিয়া গিয়াছে, সে জানিতে পারে নাই। যখন তাহার ঘুম ভাঙিল তখন সন্ধ্যা হয়-হয়।

ঘুম ভাঙিল মুখের উপর ঝাঁঝালো একটা নিশ্বাসের স্পর্শে এবং সেইসঙ্গে কানের কাছে মৃদু গম্ভীর গুরু গুরু শব্দে। রূপদমন একটা পাথরে হেলান দিয়া ঘুমাইয়াছিল, চোখ মেলিয়া দেখিল চোখের সামনেই প্রকাণ্ড বাঘের মাথা! মূঢ়ের মতো সে চাহিয়া রহিল। বাঘিনী ঠিক তাহার পাশে আসিয়া বসিয়াছে এবং হিংস্র-প্রখর দৃষ্টিতে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। তাহার গলা দিয়া একটা অবরুদ্ধ আওয়াজ বাহির হইতেছে—গর্‌র্‌—

বাঘের এতটা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য রূপদমন আর কখনও লাভ করে নাই। সে অসাড় হইয়া পড়িয়া রহিল। তাহার শরীরের স্নায়ুপেশী এমন পরিপূর্ণভাবে শিথিল হইয়া গেল যে মনে হইল সে আর কোনও কালেই হাত-পা নাড়িতে পারিবে না। তাহার পেটের ভিতরটা কেবল ক্ষীণভাবে ধুক্‌ধুক্‌ করিতে লাগিল।

তারপর ক্রমে ক্রমে তাহার শরীরের সাড় ফিরিয়া আসিল। নিজের অজ্ঞাতসারেই সে বোধহয় একটু নড়িয়াছিল, বিদ্যুদ্বেগে বাঘিনী থাবা তুলিল। সেই থাবার একটি থাবড়া খাইলে রূপদমনের মাথাটি বোধকরি পচা হাঁসের ডিমের মতো দ্রব হইয়া যাইত; কিন্তু থাবা শূন্যে উদ্যত হইয়াই রহিল, পড়িল না। রূপদমনও সম্মোহিতের মতো থাবার পানে তাকাইয়া রহিল।

থাবার কজির কাছে পুঁজ-রক্ত মাখানো রহিয়াছে। রূপদমন লক্ষ্য করিল, ক্ষতস্থানের পুঁজরক্তের ভিতর কয়েকটা বড় বড় শলার মতো কাঁটা এফোঁড় ওফোঁড় বিঁধিয়া আছে। দেখিতে দেখিতে রূপদমনের ভয় কাটিয়া গেল, সে বুঝিতে পারিল কেন বাঘিনী থাবা মারিয়া তাহার মাথাটি চূর্ণ করিয়া দেয় নাই—নিজের বেদনার ভয় তাহাকে নিরস্ত করিয়াছে।

কাহারও গায়ে কাঁটা বিঁধিয়া থাকিলে তাহা টানিয়া বাহির করিবার প্রবৃত্তি মানুষের স্বাভাবিক। মনস্তত্ত্ববিদেরা একথা জানেন কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু আমার শিকারী-জীবনে আমি ইহা অনেকবার লক্ষ্য করিয়াছি। কাহারও শরীরে কাঁটা বিঁধিয়া আছে দেখিলেই হাত নিস্‌পিস্‌ করিতে থাকে এবং সেটা টানিয়া বাহির না করা পর্যন্ত প্রাণে শান্তি থাকে না।

রূপদমন আস্তে আস্তে বাঘিনী থাবার দিকে হাত বাড়াইল। বাঘিনীর তাহাকে তীক্ষভাবে নিরীক্ষণ করিতেছিল, এবার তাহার নড়াচড়ায় বিশেষ আপত্তি করিল না। কেবল তাহার গলায় গুরুগুরু শব্দ একটু গাঢ় হইল এবং মুখখানা ব্যাদিত হইয়া ভয়ঙ্কর দাঁতগুলাকে প্রকট করিয়া দিল।

কিন্তু ক্ষতস্থানে হাত পড়িতেই বাঘিনীর কণ্ঠ হইতে এমন একটি রুদ্র গর্জন বাহির হইল যে মনে হইল বাঘিনী এখনি রূপদমনকে শতখণ্ডে ছিড়িয়া ফেলিবে। কিন্তু আশ্চর্য! বাঘিনী তাহাকে ছিঁড়িয়া ফেলিল না, যে থাবাটা চকিতের জন্য সরাইয়া লইয়াছিল তাহা আবার পূর্ববৎ তুলিয়া ধরিল। বাঘিনী মনে মনে কি বুঝিয়াছিল বাঘিনীই জানে কিন্তু আমি এই প্রহ্লাদ-মার্কা ছেলেটার দুর্জয় সাহস ও পরমায়ুর কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিলাম।

বাঘিনীর গাঁক্‌ শব্দে রূপদমন হাত টানিয়া লইয়াছিল, কিছুক্ষণ পরে আবার সন্তর্পণে হাত বাড়াইল। প্রথম কাঁটা বাহির করার যন্ত্রণায় বাঘিনী সংযম হারাইয়া রূপদমনকে মুখের এক ঝাপ্‌টায় কামড়াইতে গেল কিন্তু শেষ মুহূর্তে কামড়ের বদলে তাহার গাল চাটিয়া দিল। কর্‌করে উখার মতো জিভের ঘর্ষণে রূপদমনের গাল জ্বালা করিয়া উঠিল কিন্তু পাহাড়ী বালক টু শব্দ করিল না। অতঃপর বাঘিনী যেন নিজের সহজাত প্রবৃত্তিকে দমন করিয়া রাখিবার জন্যই রূপদমনের সর্বাঙ্গ চাটিতে আরম্ভ করিল। এই অবসরে রূপদমনও কাঁটাগুলি একে একে বাহির করিল। কাঁটাগুলি সাধারণ উদ্ভিদ-কাঁটা নয়, শজারুর কাঁটা। বাঘিনী বোধ হয় কোনও সময় থাবা মারিয়া শজারু বধ করিতে গিয়াছিল, ইহা সেই অবিমৃষ্যকারিতার ফল।

কাঁটাগুলি সব বাহির হইয়া গেলে, বাঘিনী খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে একটু সরিয়া গিয়া গলার মধ্যে গর্‌গর্‌ শব্দ করিতে করিতে ক্ষতস্থান চাটিতে লাগিল। এদিকে সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল, কোটরের আর বড় কিছু দেখা যাইতেছিল না, কেবল বাঘিনীর চোখদুটা জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। রূপদমন আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়া কোটর হইতে বাহিরের দিকে চলিল, বাঘিনী চোখ ঘুরাইয়া দেখিল কিন্তু বাধা দিল না। বাহিরে আসিয়া রূপদমন এক দৌড়ে গ্রামের দিকে রওনা হইল। ছুটিতে ছুটিতে একসময় পিছু ফিরিয়া দেখিল বাঘিনী কোটরের মুখের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং গলা উঁচু করিয়া তাহার পানে তাকাইয়া আছে। কিছুক্ষণ পরে সে আবার খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে রন্ধ্রের মধ্যে প্রবেশ করিল, রূপদমন বুঝিল ঐ কোটরটা বাঘিনীর বাসস্থান, লুকোচুরি খেলিতে গিয়া সে বাঘের ঘরে ঢুকিয়াছিল!

সেই রাত্রে রূপদমনের তাড়স দিয়া জ্বর আসিল। জ্বর তিন-চার দিন রহিল; তারপর সে সারিয়া উঠিল।

দিন দশেক পরে রূপদমন আবার কাঠ কাটিতে গেল। সঙ্গিসাথীদের বাঘিনীর কথা বলিয়াছিল, কেহ বিশ্বাস করিয়াছিল কেহ করে নাই। কিন্তু বনের ওদিকটাতে আর না যাওয়াই ভাল এবিষয়ে সকলেই একমত হইল। রূপদমনও প্রথম দিন অন্য সকলের সহিত রহিল, ওদিকে গেল না।

দ্বিতীয় দিন বনের ঐ দিকটা তাহাকে টানিতে লাগিল। সে সঙ্গীদের এড়াইয়া ঐ দিকে চলিল। আগুন লইয়া খেলা করিবার প্রবৃত্তি মানুষের চিরন্তন, যে বিপদের সহিত উত্তেজনা জড়িত আছে তাহার লোভ সে ছাড়িতে পারে না।

গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি পৌঁছিয়া কিন্তু তাহার গতি আপনিই হ্রাস পাইল, পা আর চলে না। তাহার অবস্থা অনেকটা নবীন অভিসারিকার মতো। আর অগ্রসর হইবে, না ফিরিয়া যাইবে তাহাই মনে মনে তোলপাড় করিতেছে এমন সময় পাশের একটা ঝোপের মধ্যে সর্‌সর্‌ শব্দ শুনিয়া চমকিয়া সেইদিকে ফিরিয়া দেখিল, কিছুই করিবার প্রয়োজন নাই, বাঘিনী নিজেই আসিতেছে। বাঘিনী আর খোঁড়াইতেছে না, স্বচ্ছন্দ সাবলীল শার্দুল বিক্রীড়িত ভঙ্গিতে তাহার দিকেই আসিতেছে।

রূপদমন কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, বাঘিনী ঠিক তাহার সম্মুখে আসিয়া লম্বা হইয়া বসিল। চারিচক্ষুর নিষ্পলক বিনিময় অনেকক্ষণ ধরিয়া চলিল। বাঘিনীর ল্যাজের ডগাটি একটু একটু নড়িতেছে, গলার মধ্যে গুর্‌গুর্‌ আওয়াজ হইতেছে, বাঘিনী এখনও রূপদমন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হইতে পারে নাই। রূপদমন আর পারিল না, হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া থপ্ করিয়া বসিয়া পড়িল।

বাঘিনী জিভ বাহির করিয়া সাদরে তাহার নাক চাটিয়া লইল, তারপর থাবাটি চিৎ করিয়া তাহার কোলের উপর রাখিল। রূপদমন দেখিল থাবার ঘা শুকাইয়া গিয়াছে, কব্জির চামড়ার উপর কয়েকটা দাগ আছে মাত্র।

এইরূপে বাঘিনীর সহিত রূপদমনের বন্ধুত্ব স্থাপিত হইল। ইহাকে বন্ধুত্ব বলিব কিংবা অন্য কিছু বলিব বুঝিতে পারিতেছি না। যাহোক, রূপদমনের মুখের কথাই খানিকটা তুলিয়া দিতেছি—

—‘সাহেব, মানুষে মানুষে ভালবাসা হয়, কিন্তু বাঘের মতো এমন ভালবাসতে কেউ পারে না। কুকুরের সঙ্গে মানুষের ভালবাসা হয়, সে অন্য রকম, সেখানে মানুষ প্রভু, কুকুর তার অধীন। এখানে কিন্তু তা নয়, মানুষ আর বাঘ সমান সমান, কেউ কারুর চেয়ে খাটো নয়।

‘তিনটি বছর আমি বাঘিনীর সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি জানি, এ তিন বছরের মধ্যে এমন খুব অল্প দিনই গিয়েছে যেদিন আমাদের দেখা হয়নি। আপনি শিকারী, অনেক বাঘ মেরেছেন কিন্তু বাঘের সত্যি পরিচয় আপনি জানেন না। অমন স্নেহশীল উচ্চমনা জন্তু আর নেই। পৃথিবীতে যদি ভদ্রলোক থাকে তো সে বাঘ।

‘আমরা দু’জনে দু’জনকে কি করে এত ভালবেসে ফেলেছিলুম তা জানি না, একদিন দেখা না হলে আমাদের মন মানত না। আমার সঙ্গে ভাব হবার পর থেকে সে গ্রামের মানুষ গরু ভেড়ার উপর উৎপাত করা ছেড়ে দিয়েছিল; গ্রামের দিকেই আর যেত না, বনের শম্বর পাহাড়ী ছাগল মেরে খেত। কিন্তু কোনও কারণে যদি আমি একদিন বনে না যেতে পারতুম তাহলে রাত্রে বাঘিনী গ্রামে আসত—গ্রামের চারিদিকে ঘুরে বেড়াত আর ডাকত। আমি ঠিক বুঝতে পারতুম আমাকে ডাকছে। এবার কয়েক দিনের জন্যে অসুখে পড়েছিলুম, সে রোজ রাত্রে এসে আমাকে ডাকত। গাঁয়ের লোকেরা আগুন জ্বেলে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তাকে তাড়াতে পারত না।

‘অসুখের পর যেদিন প্রথম বনে গেলুম সে তার কী আনন্দ! আমার গা চেটে চেটে গায়ের ছাল তুলে দিলে। আপনারা মনে করেন বাঘ হাসতে জানে না, সেটা আপনাদের ভুল। বাঘ হাসতে জানে। শুধু হাসতেই জানে না—ঠাট্টা করতে জানে, ঠাট্টা করলে বোঝে। আমার সঙ্গে ওর এক ঠাট্টা ছিল, আমাকে ভয় দেখানো। হঠাৎ গর্জন ছেড়ে প্রচণ্ড হাঁ করে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত। কিন্তু আশ্চর্য, ওর একটা নখের আঁচড় কখনও আমার গায়ে লাগেনি। প্রথম প্রথম আমার ভয় করত, তখন বাঘিনী আমাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে বসত, মিট্‌মিট্‌ করে আমার পানে চাইত আর হাসত।

‘দুপুরবেলা আমি বাঘিনীর গুহায় যেতুম। যেদিন সে থাকত সেদিন দু’জনে মিলে খেলা করতুম। কী খেলা? কত রকম খেলা; লাফালাফি হুড়োহুড়ি—লুকোচুরি! বাঘেরা লুকোচুরি খেলতে জানে। যেদিন সে থাকত না সেদিন আমি গুহায় শুয়ে ঘুমোতুম, বাঘিনী এসে আমার পাশে শুতো, আমার বুকের উপর থাবা তুলে দিয়ে ঘুমোত। এমনি ভাবে কতদিন যে আমরা ঘুমিয়েছি তার ঠিক নেই।

‘একদিন আমি ওর জন্যে একদলা ক্ষীরের মণ্ড নিয়ে গিয়েছিলুম, খেয়ে ভারি খুশি। তার পরদিনই আমার জন্যে প্রকাণ্ড এক পাহাড়ী ছাগল মেরে এনে হাজির। আমি প্রথমটা বুঝতে পারিনি যে ওটা আমার জন্যেই এনেছে। কিন্তু সে কিছুতেই ছাড়ল না; কাঁধে তুলে ছাগলটা গাঁয়ে নিয়ে গেলুম। গাঁসুদ্ধ লোক ভোজ খেলে।’—

এইভাবে তিন বৎসর কাটিয়াছিল। আরও কত বৎসর কাটিত বলা যায় না যদি না আর একটা ঘটনা ঘটিয়া বাঘিনীর চরিত্রের অন্য একটা দিক প্রকট করিয়া দিত। রূপদমনের বয়স যখন উনিশ বছর তখন তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইল। রূপদমনের মা-বাপ ছিল, এ কাহিনীতে তাহাদের কোনও অংশ নাই বলিয়া তাহাদের উল্লেখ করি নাই।

বিবাহ হইবে দশ মাইল দূরের একটি গ্রামে। বিবাহ সম্বন্ধে রূপদমনের মনের ভাব কিরূপ ছিল তাহা আমি জানিতে পারি নাই; সম্ভবত তাহার কোনও মতামতই ছিল না। এই বয়সে সকলেরই বিবাহ হয়, বাপ-মা সম্বন্ধ স্থির করিয়া বিবাহ দেয়, ছেলে বিবাহ করে। রূপদমনের বিবাহও তেমনি একটা পারিবারিক ঘটনা।

যথাসময় বরবেশ পরিয়া কাঁসি বাঁশী ও ঢোলের বাদ্যোদ্যম করিয়া গুটিদশ-বারো বরযাত্রী সহযোগে রূপদমন বিবাহ করিতে গেল। মেয়ের গ্রাম দশ মাইল দূরে হইলে কি হয়, যাইতে-আসিতে তিন দিন লাগে। হাঁটিয়াই বিবাহ করিতে যাইতে হয়; যান-বাহনের ব্যবস্থা নাই তাহা বলাই বাহুল্য।

এইখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। যে কয়দিন রূপদমন বিবাহ উপলক্ষে গ্রামের বাহিরে ছিল, সে কয়দিন রাত্রে বাঘিনী গ্রামে খোঁজ লইতে আসে নাই বা ডাকাডাকি করে নাই। ইহা হইতে অনুমান হয়, রূপদমনের যাত্রাকালেই বাঘিনী জানিতে পারিয়াছিল যে সে বাহিরে যাইতেছে——হয়তো বনের মধ্যে তাহাকে বাজনা বাজাইয়া সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া যাইতে দেখিয়াছিল—এবং অলক্ষিতে যাত্রীদলের পিছু লইয়াছিল। বাঘিনী রূপদমনের অনুসরণ করিয়া ও-গ্রামে গিয়াছিল এবং ফিরিবার পথেও সবধু রূপদমনকে লক্ষ্য করিতে করিতে আসিয়াছিল। ইহা অনুমান হইলেও পরবর্তী ঘটনায় তাহার সমর্থন পাওয়া যায়।

চতুর্থ দিন অপরাহ্রে রূপদমন নববধু লইয়া বাড়ি ফিরিল। গ্রামে পৌঁছিতে আর পোয়াটাক রাস্তা আছে, বাদ্যকরেরা মৃদু মৃদু বাজনা বাজাইতে আরম্ভ করিয়াছে, এমন সময় বিকট গর্জন ছাড়িয়া বাঘিনী কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বরযাত্রীদলের দশগজ সম্মুখে থাবা পাতিয়া বসিল। রূপদমন দেখিল বাঘিনীর হলুদবর্ণ দেহখানা আগুনের হল্কার মতো জ্বলিতেছে, তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া যেন বিদ্যুতের শিখা বাহির হইতেছে। বাঘিনীর এমন ভয়ঙ্কর চেহারা সে আগে কখনও দেখে নাই, তাহার পারার মতো উজ্জ্বল চোখদুটি একবার রূপদমন ও একবার তাহার বধুর উপর তড়িদ্বেগে যাতায়াত করিতেছে। সে আর একবার গর্জন ছাড়িল; মনে হইল, ক্রোধে হিংসায় সে এখনি ফাটিয়া পড়িবে।

তাহার আকস্মিক আবিভাবে সকলে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল; বাদ্যকরেরাও নীরব হইয়া ছিল। কিন্তু কেহ ভয় পাইয়া এদিক-ওদিক পলাইবার চেষ্টা করে নাই। এসময় দলবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকাই যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ তাহা তাহারা জানিত। রূপদমন সম্মুখেই ছিল, তাহার একবার ইচ্ছা হইল দল ছাড়িয়া বাঘিনীর কাছে গিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু বাঘিনীর মূর্তি দেখিয়া তাহার ভয় হইল, সে বুঝিল আজ বাঘিনী তাহাকে হাতের কাছে পাইলে মারিয়া ফেলিবে—তাহার সমস্ত ভালবাসা মারাত্মক হিংসায় পরিণত হইয়াছে। রূপদমন পা বাড়াইতে সাহস করিল না। পা না বাড়াইবার আর একটা কারণ ছিল, নববধূ ভয় পাইয়া তাহাকে সবলে জড়াইয়া ধরিয়াছিল।

বাঘিনী সেদিন বোধ হয় তাহাদের ছাড়িত না, দলের মধ্যে হইতেই ঘাড় ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইত। কিন্তু এই সময় বাধা পড়িল। গাঁয়ের লোকেরা বাজনার আওয়াজ শুনিতে পাইয়াছিল, তাহারা দল বাঁধিয়া হল্লা করিতে করিতে বরবধূকে আগাইয়া লইতে আসিয়াছিল। বাঘিনী পিছন দিকে মানুষের কলরব শুনিতে পাইয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল; সুযোগ বুঝিয়া বরযাত্রীদলের বাজন্দারেরাও সজোরে বাজনা বাজাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। বাঘিনী আর পারিল না, ব্যর্থ আক্রোশে দুইবার ল্যাজ আছড়াইয়া গরজাইতে গরজাইতে পাশের জঙ্গলে গিয়া ঢুকিল। যাইবার আগে নবদম্পতির প্রতি যে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেল তাহার সরল অর্থ বুঝিতে রূপদমনের কষ্ট হইল না।

পরদিন বাঘিনী বনে কাষ্ঠাহরণরতা একটি স্ত্রীলোককে মারিল। দ্বিতীয় দিন আর একটি। এইভাবে আরম্ভ হইয়া বাঘিনীর প্রতিহিংসা যেন গ্রামের সমস্ত নারিজাতির উপরেই সংক্রামিত হইল। মেয়েদের ঘরের বাহির হওয়া বন্ধ হইল।

এইভাবে দেড় বৎসর কাটিয়াছে। রূপদমনের স্ত্রীকে মারিবার চেষ্টাতেই হয়ত বাঘিনী সম্মুখে যে স্ত্রীলোককে পাইয়াছে তাহাকেই বধ করিয়াছে; কিন্তু তাহার ঈষাবিষাক্ত জিঘাংসা তৃপ্ত হয় নাই। রূপদমনের বিশ্বাস বাঘিনী যদি বাঁচিয়া থাকিত তাহা হইলে শেষ পর্যন্ত তাহার স্ত্রীকে না মারিয়া ছাড়িত না।

পরদিন দ্বিপ্রহরে ফিরিয়া চলিয়াছি।

প্রথম পাহাড়ের ডগায় উঠিয়া পিছু ফিরিয়া তাকাইলাম। নিম্নে উপত্যকার প্রান্তস্থিত ক্ষুদ্র গ্রামটি যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া নিশ্চিন্ত আলস্যে মাধ্যন্দিন রৌদ্র উপভোগ করিতেছে। আর তাহার ভয় নাই, এখন হইতে গ্রামের মেয়েরা নির্ভয়ে বনে কাঠ কুড়াইতে যাইবে, জলাশয়ে জলে আনিতে যাইবে। গ্রামের সহজ বৈচিত্রহীন জীবনযাত্রা আবার আরম্ভ হইবে। রূপদমনের বন্ধু বোধহয় স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া প্রথম মন খুলিয়া হসিবে। কিন্তু রূপদমনের মনের কাঁটা দূর হইবে কি?

এই গ্রামে, নরসমাজ হইতে একান্ত বিজনে, জঙ্গল ও পাহাড়ের আদিম বাতাবরণের মধ্যে, এক স্বভাব-হিংস্র পশুর সহিত একজন মানুষের প্রণয়ের সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল। সার্কাসের মাদক-বিমূঢ় জন্তুর সহিত কৌশলী মানুষের লোকদেখানো হৃদ্যতা নয়, সত্যকার অকৃত্রিম ভালবাসা। এবং অকৃত্রিম বলিয়াই বোধহয় শেষে উহা এমন ভয়ানক রূপধারণ করিয়াছিল।

অনেকে এ কাহিনী বিশ্বাস করিবেন না। মানি, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু এতই কি অসম্ভব? নিজের কথা বলিতে পারি, আমি রূপদমনের গল্প অবিশ্বাস করিতে পারি নাই।

২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *