বাঁকা পথে – অমিত চট্টোপাধ্যায়
‘তাকিয়ো না, তাকিয়ো না, চাঁদু। চোখ ঠিকরে যাবে। এই এক, এই দুই, এই তিন… টেক্কা…’ হাতের তাস ফেলে দিয়ে সুশীল ঘোষ হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর টেবিলের ওপর থেকে বাজির টাকাগুলো চেঁছে তুলে নিয়ে পকেটে ভরল।
ওর এই গলা-ফাটানো হাসি এর আগে আর কোনওদিন এত বিশ্রী লাগেনি বিভাস রায়ের। বরং এ-যাবৎ তারিফই করে এসেছে। রেল অফিসে দুজনেই চাকরি করে, যদিও ডিপার্টমেন্ট আলাদা—তবু বারান্দা পার হওয়ার সময় বা অফিস-ক্যান্টিনে সুশীলের এরকম দরাজ গলার হাসি হরদমই শুনে থাকে সে। আর ভালোও লাগে। কারণ সে-হাসিতে খোলা মনের আর সহজ হৃদ্যতার আমেজ পায় বিভাস। আজ অবশ্য পেল না। কী করেই বা পাবে! সুশীলের পাল্লায় পড়ে সে তাস খেলতে বসেছিল, ধীরে-ধীরে সারা মাসের মাইনেটা ওর পকেটেই ঢুকে গেছে।
ফাঁকা মাঠের মতন শূন্য টেবিল। অন্য খেলুড়েদেরও কেমন একটু অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বিভাস মহা অনর্থটাকে ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য টেনে-টেনে হাসতে লাগল। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল, ‘আরে, টাকা তো শান্টিং ইঞ্জিন—আসবে-যাবে, আসবে-যাবে। মাইনে পাওয়ার দিন তো আবার সামনের মাসেও আসবে।’
ডেসপ্যাচের অনাদি জোয়ারদার একটা বিড়ি ধরিয়ে ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘দোষ্টা আমাদেরই। ভাই-ব্রাদারের মধ্যে খেলা। অত মোটা-মোটা টাকা বাজি না রাখাই উচিত ছিল।’
তাস ভাঁজতে-ভাঁজতে সুশীল বলল, ‘নইলে রক্তে এই সুড়সুড়িটুকু লাগবে কেন? আর মাধুর্য তো সেইটুকুই।’
‘কিন্তু মধুর লাগছে কই? ক্যাশ নশো টাকা আমারই গেছে…।’
‘কেটে পড়বে নাকি তাহলে?’
অনাদি জোয়ারদার বাঁকা সুরে বলল, ‘কেটে পড়ার কথা বলছি না, সুশীল। আমরা সব আইবুড়ো কার্ত্তিক, এ-চোট সইবে। কিন্তু বিভাস হালফিল বিয়ে করেছে, ঘরে নতুন বউ হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে…।’
বিভাসের আত্মসম্মানে বোধ করি ঘা লাগল। তাই আরক্ত মুখে প্রতিবাদ করল, ‘বসে থাকবে ঠিকই, তবে আমার মাইনের টাকার জন্যে নয়, আমার পথ চেয়ে। অতএব কাটলুম আমি। এদিকেও এগারোটা বাজে।’
উঠে পড়ে সে সুশীলের আলনা থেকে হাওয়াই শার্টটা তুলে নিয়ে গায়ে গলাল। বিদায় নেওয়ার জন্য ফিরে তাকিয়ে দেখল, ততক্ষণে সবাই হাতের তাসে তন্ময় হয়ে গেছে। অগত্যা বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে সুশীল উঁচু গলায় বলল, ‘শ্রীমতীকে আমার শুভেচ্ছা জানিও হে।’
বিভাস ফিরে তাকিয়ে নীরস কণ্ঠে বলল, ‘যদি অবসর পাই।’
‘পাবে, পাবে…সুন্দরী বউয়ের মিষ্টি একটু সোহাগ…হা-হা-হা…’ নিজের রসিকতায় হেসে উঠল সুশীল ‘আচ্ছা, কাল আবার অফিসে দেখা হবে।’
বিভাস দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। সুশীলের মুখের দিকে আর তাকাতে প্রবৃত্তি হল না তার। পথে এসে পড়তেই রাজ্যের দুর্ভাবনা তার কাঁধে চেপে বসল। অতঃ কিম? সারা মাসের মাইনে খুইয়ে শূন্য পকেটে বাড়ি ফেরার কী কৈফিয়ত দেবে সে? হালকাভাবে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে? অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করবে? বলবে, পকেট থেকে কোথাও পড়ে গেল, না কেউ মেরেই দিলে, ঠিক…। না, শ্রীমতী জানে, তার স্বামী এতটা ন্যালাখ্যাপা নয়। স্বামীর মিথ্যে কৈফিয়তটা শুনে ধীরে-ধীরে মুখখানা তার বিবর্ণ হয়ে উঠবে, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসবে ফোঁটা-ফোঁটা জল। স্বামীর মাইনের প্রতিটি পয়সা যে তার গায়ের এক-এক ফোঁটা রক্ত! বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে একখানা শাড়িও কেনেনি, কোনও সিনেমা-থিয়েটার দেখেনি। তিলে-তিলে শুধু সঞ্চয় করেছে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে। সেক্ষেত্রে এত বড় নির্জলা মিথ্যে বিভাস শ্রীমতীকে বলবে কী করে? আপনমনে কৈফিয়তগুলো দু-চারবার উচ্চারণ করে দেখল, কিন্তু কোনওটাই নিজের পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াবার যোগ্য বলে মনে হল না। শ্রীমতী বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার মিথ্যেটুকু ধরে ফেলতে এতটুকুও দেরি হবে না। নিজেকে বিভাস বোকা বলে প্রতিপন্ন করবে। ফলে স্ত্রীর শ্রদ্ধা, সহানুভূতি চিরদিনের মতো সে হারাবে।
ভাবতে-ভাবতে বিভাস এক প্রায়ান্ধকার গলিপথে ঢুকে পড়ল। পাড়াটার সুনাম নেই। খুন, জখম, ছিনতাই প্রায়ই ঘটে থাকে।
চলতে-চলতে আচমকা থেমে পড়ল বিভাস। ঠিক হয়েছে। শ্রীমতীকে সে বলবে, এই জায়গায় আসতেই, অন্ধকারের ভেতর থেকে এক দুর্বৃত্ত ছোরা হাতে তাকে আক্রমণ করে টাকাটা ছিনিয়ে নিয়েছে। এরকম রাহাজানি যখন এ-পাড়ায় হামেশাই ঘটে থাকে, তখন শ্রীমতীর বিশ্বাস না করবার কোনও কারণ নেই।
বুক ঠেলে একটা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এল বিভাসের। ডান দিকে না বেঁকে, সে দ্রুত পায়ে আরও খানিকটা সোজা পথে এগিয়ে গেল। এবার পথের দু-পাশে দেখা গেল উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি সারি-সারি একতলা বাড়ি। এখনও অবশ্য অধিকৃত হয়নি—তাই জায়গাটা বেশ ফাঁকা আর গাঢ় অন্ধকার। সেখানে পৌঁছে বিভাস কাঁটা-ঝোপে নিজের হাত-পাগুলো ছড়া-ছড়া করে নিল, সর্বাঙ্গে ধুলো-কাদা মাখল, জামার কলার, হাতা সব ফালা-ফালা করে ছিঁড়ল। ধস্তাধস্তির রূপসজ্জা। তবু ভয়ে তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। হাজার হোক, আনাড়ি তো! মেক-আপে কোথাও গলদ থেকে গিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা না হাস্যকর হয়ে ওঠে। যাই হোক, শেষপর্যন্ত মনকে সান্ত্বনা দিয়ে সে আবার ফিরল। রাস্তার ধারের একটা পানের দোকানের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের আপাদমস্তকের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিটা বারকয়েক বুলিয়ে নিল। মনে-মনে খুশিই হল সে। না, শ্রীমতী কিছুই সন্দেহ করতে পারবে না।
আর দুটো মোড় পার হলেই তার বাড়ির রাস্তা। এই দূরত্বটুকু দ্রুত পায়ে পার হয়েই সে অকস্মাৎ গতি শ্লথ, মন্থর করে দিল। যেন অতি শ্রান্ত, ক্লান্ত—কোনওক্রমে পা—দুটো টেনে-টেনে নিয়ে চলেছে।
সদর দরজার সামনে পৌঁছে সে হাঁফাতে-হাঁফাতে কড়া নাড়ল।
দরজা খুলল শ্রীমতীই। স্বামীকে দেখে খুশিভরা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওঃ! তুমি!’ কিন্তু সে-কণ্ঠ তার পরক্ষণে আর্তনাদে রূপান্তরিত হল, বিভাস যখন টলতে-টলতে একরকম ঠিকরে গিয়ে ঘরের মাঝখানে পড়ল।
পক্ষীমাতার মতন দু-ডানা বাড়িয়ে শ্রীমতী যেন তাকে যেন বুকের মাঝে টেনে নিল। উদ্বেগ ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কী হয়েছে, ওগো, কী হয়েছে তোমার? ও রকম করছ কেন? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠের অভিনয়ে বিভাস বলে উঠল, ‘মাস্তানের পাল্লায় পড়েছিলুম, শ্রীমতী। হেঁটেই বাড়ি ফিরছিলুম। এই সময় অন্ধকার কানাগলি থেকে একটা অল্পবয়েসি ছেলে ছোরা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।’
শিউরে উঠল শ্রীমতী। তাকে ধরে রেখেই অস্ফুট আর্তনাদে বলে উঠল, ‘সর্বনাশ! কোথাও লাগেনি তো তোমার? ছোরা-টোরা বসাতে পারেনি তো…।’
‘নাঃ! প্রাণে বেঁচে গেছি এ-যাত্রা। কিন্তু…’ ভগ্ন কণ্ঠে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল বিভাস, ‘কিন্তু আমার সব টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে…সারা মাসের মাইনে…’ ধপ করে একখানা চেয়ারের ওপর বসে পড়ল সে।
তার অবস্থা দেখে শ্রীমতীর চোখে জল এসে গেল। দেখতে ছিপছিপে হলেও দেহে তার শক্তি বড় কম ছিল না। স্বামীকে টেনে তুলতে-তুলতে সহজ কণ্ঠেই বলল, ‘যা যাওয়ার তা গেছে। তুমি এখন বাথরুমে গিয়ে জামাপ্যান্ট ছেড়ে চান করে নাও তো!’
‘না, না, না, একটু বসতে দাও। মাথায় আমার আগুন জ্বলে যাচ্ছে, শ্রীমতী। অতগুলো টাকা! সারা মাস আমাদের চলবে কী করে?’
‘টাকার জন্যে তুমি চিন্তা কোরো না। প্রাণে যে বেঁচে এসেছ…’ জোর করে বিভাসকে তুলে বাথরুমে নিয়ে যেতে-যেতে শ্রীমতী বলল, ‘আমাদের পাড়াটাও হয়েছে তেমনি। যত চোর-ডাকাতের আড্ডা। পুলিশ তো ভুলেও এ-রাস্তা মাড়ায় না।’
বিভাস কোঁত পাড়তে-পাড়তে বলল, ‘ঘটনার সময়টিতে ওদের টিকি দেখা যায় না, শ্রীমতী। ওরা আসে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর।’ বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
গ্যাস জ্বেলে দুধটা চট করে গরম করে ফেলল শ্রীমতী। হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে বিভাস বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দুধটা স্বামীর সামনে ধরে দিয়ে সে বলল, ‘দুধটা খেয়ে নাও। আজ রাত্তিরে আর কিছু দেব না। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়োগে, আমি কাটাগুলোয় মলম লাগিয়ে দিই…।’
‘কিছু করতে হবে না। সকালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ উঠে দাঁড়াল বিভাস। যেন নিজেকে সম্বোধন করেই বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি শুধু ভাবছি, সারা মাস চালাব কী করে! কার কাছে গিয়ে হাত পাতব!’
শ্রীমতী মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘দু-চার টাকা করে যা বাঁচিয়েছি, তাতে এ-মাসটা চলে যাবে। তুমি বরং শুয়ে পড়বার আগে থানায় একটা ফোন করে দাও।’
বিভাস একেবারে আঁতকে উঠল : ‘থানায়!’
‘হ্যাঁ, থানা।’ রুষ্ট কণ্ঠে শ্রীমতী বলল, ‘ছোরা নিয়ে তোমার ওপর চড়াও হল, অতগুলো টাকা ছিনিয়ে নিল, আর মুখ বুজে থাকবে? পুলিশকে কিছু জানাবে না?’
‘লাভ নেই, শ্রীমতী, কিছু লাভ নেই। চেনোই তো আমাদের দেশের পুলিশকে। তা ছাড়া যে চড়াও হয়েছিল, অন্ধকারে তাকে তো আমি দেখতেই পাইনি। শনাক্তই বা করব কী করে?’
জেদের সুরে শ্রীমতী বলল, ‘তাতে কিছু যায়-আসে না। পুলিশে জানানো উচিত বলেই জানাবে। তুমি কি চাও, জামাই-আদরে মাস্তানদের হাতে টাকাগুলো তুলে দিই?’
বিভাস কোনও জবাব দিল না। নীরবে দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগল।
স্বামীর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শ্রীমতী সন্ধিগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি যদি না চাও, তাহলে আমিই ফোন করে দিই।’
সশব্দে গ্লাসটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বিভাস উষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘না, না। টেলিফোন তুমিও করবে না, আমিও করব না। অপরাধীকে তো পুলিশ ধরতে পারবেই না, মাঝখান থেকে ছুটোছুটি করতে-করতে আমার প্রাণ যাবে।’
শ্রীমতী সহজ কণ্ঠেই বলল, ‘এখনও মেজাজ তোমার বিগড়ে আছে। যাও, গিয়ে শুয়ে পড়োগে। আমি হাতের কাজ মিটিয়ে যাচ্ছি। তখন এ নিয়ে কথাবার্তা বলা যাবে।’
শোওয়ার ঘরে এসে বিভাস ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে দাঁড়াতেই শিউরে উঠল। মুখের পরতে-পরতে অপরাধ-কুণ্ঠিতের ছবি। স্ত্রীর সঙ্গে এ কী জঘন্য প্রতারণা! তবু এই প্রতারণাকেই সত্যের মুখোশ পরিয়ে জিইয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু শ্রীমতী যদি সত্যিই পুলিশে ফোন করে, তাহলে? পুলিশের জেরার মুখে প্রকৃত ঘটনাটা প্রকাশ হয়ে পড়তে বাকি থাকবে না। তার চেয়ে শ্রীমতীর বদলে সে-ই পুলিশে ফোন করবে। মিথ্যের জাল বুনে সত্যিটুকু হয়তো তাদের কাছে সে গোপন করে রাখতে পারবে। কিন্তু শ্রীমতীর ওই বুদ্ধিদীপ্ত দু-চোখ হয়তো তার অন্তরের গহনতম প্রদেশে পৌঁছে সত্যটুকু টেনে আনবে বাইরের আলোয়।
শুতে পারল না বিভাস। অস্থির চরণে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল।
হাতের কাজ মিটিয়ে শ্রীমতী সবেমাত্র ওপরে যাবে বলে সিঁড়ির গোড়ার এসেছে, স্বামীকে নামতে দেখে জিগ্যেস করল, ‘কোথায় যাবে? পুলিশে ফোন করতে নাকি?’
ঘাড় নেড়ে বিভাস সহজ কণ্ঠেই জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। ভেবে দেখলুম, না করাটা ভুল হবে।’
বসবার ঘরে ঢুকে সে রিসিভারটা তুলে নিল। একটু ইতস্তত করে টালিগঞ্জ থানাতেই ফোন করল। ফোন ধরলেন ও. সি. স্বয়ং। খবর শুনে তিনি একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলেন। কতক্ষণ আগে ঘটনাটা ঘটেছে, আততায়ীর চেহারার সঠিক বর্ণনা দিতে পারেন কি না, পকেটে কত টাকা ছিল ইত্যাদি।
একটার পর একটা কাল্পনিক জবাব দিতে-দিতে বিভাসের একসময় মনে হতে লাগল, হয়তো ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছিল সে দুর্বৃত্তের হাতে, মাইনের টাকাটা জুয়া খেলে সে হারেনি, প্রকৃতই ছিনতাই হয়েছে তার কাছ থেকে।
মনে দেখা দিল একটা নিশ্চিন্ত প্রফুল্ল ভাব। এই সময় ও. সি. জীবনলাল ধর বেশ কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি এখুনি একবার থানায় চলে আসতে পারেন, মিস্টার রায়? মনে হয় কালপ্রিটকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি।’
‘কাকে? কালপ্রিট…মানে আমার টাকা যে…।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—তাই তো মনে হচ্ছে। যেখানে আপনার টাকাটা খোয়া গেছে, তার কাছাকাছি জায়গা থেকেই আমরা মাস্তানটাকে পাকড়াও করেছি। কাজেই আপনার আসাটা বিশেষ দরকার।’
বিভাস যেন জমে পাথর হয়ে গেছে। কোনও সাড়াশব্দ দিতে পারল না।
‘কই, কথা বলছেন না কেন, মিস্টার রায়?’
জড়িত কণ্ঠে এবার বিভাস কোনওরকমে উত্তর দিল, ‘আচ্ছা…আমি যাচ্ছি…যাচ্ছি।’
না গিয়েই বা ও কী করে পরিত্রাণ পাবে?
‘ঠিক আছে’, ও. সি. বললেন, ‘আপনি তৈরি হয়ে থাকুন। দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের গাড়ি গিয়ে আপনাকে তুলে নিয়ে আসছে।’
শিথিল হাতে বিভাস রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। ঘুরতেই দেখল, শ্রীমতী বড়-বড় দুই চোখের সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
বিভাসের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল। একেই ইংরিজিতে বোধহয় বলে গরম চাটু থেকে আগুনে। ঢোক গিলে সে বলল, ‘ও. সি. বললেন, ছিনতাইকারীকে ওঁরা বোধ হয় গ্রেপ্তার করতে পেরেছেন। এখুনি আমায় থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়ি পাঠাচ্ছেন।’
‘দেখলে তো!’ আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল শ্রীমতী : ‘আর তুমি কিছুতেই ফোন করতে চাইছিলে না।’
হেসে বিভাস বলল, ‘অত সহজ নয়, শ্রীমতী। সন্দেহজনক অনেককেই তো পুলিশ হাজতে পোরে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধোপে টিকবে কি না…।’
‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ, টিকবে। আমি বলছি।’ কণ্ঠে জোর দিয়ে শ্রীমতী বলে উঠল, ‘তুমি তৈরি হয়ে নাও দিকিনি।’
কার কবিতায় যেন বিভাস পড়েছিল, ‘খেঁদি আর সে খেঁদি নেই, মিস রমলা রায়।’ টালিগঞ্জ থানার সামনে এসে জিপ থেকে নামতেই তার সেই লাইনটা মনে পড়ে গেল। রং-চং হওয়ার পর পোড়ো বাড়ির চেহারায় রূপের চটক লেগেছে। তবু ভেতরে পা দেওয়ার সময় বিভাসের মনে হল, সে বুঝি অভিযোগকারী নয়, আসামী।
তার পদার্পণে পাহারাদার থেকে বড়বাবু সকলের ভেতরই একটা সাড়া পড়ে গেল। ও. সি. জীবন ধর সাদর অভ্যর্থনা করলেন তাকে ‘আসুন, আসুন, মিস্টার রায়। বাধ্য হয়েই রাতদুপুরে আপনাকে টেনে আনতে হল।’
ঠোঁটের ডগায় জোর করে একটু ক্ষীণ হাসি টেনে এনে বিভাস টেবিলের অপরদিকের চেয়ারখানার বসে পড়ল, ভদ্রতা জানাতে বলল, ‘আপনাদের কৃতিত্বের কথা ভেবে আমার নিজের কোনও অসুবিধের কথা মনেই আসছে না…।’
‘অনেকটা কাকতালীয় ব্যাপার, মিস্টার রায়।’ হাসলেন জীবন ধর : ‘যে-জায়গায় আপনার ওপর আক্রমণ হয়েছিল, প্রায় সেই জায়গা থেকেই ক্রিমিনালটাকে গ্রেপ্তার করেছি। দুজনে যে একই লোক সে-বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহই নেই। তবু আপনি একবার তাকে চোখে দেখুন, যদি শনাক্ত করতে পারেন।’
কিছু বলতে গিয়েও বিভাস পারল না। ঠোঁট দুটো শুধু কাঁপল।
হাজতঘরের এক কোণে অল্পবয়েসি একটি যুবক বসে-বসে ঝিমোচ্ছিল। দরজা থেকে প্রহরারত কনস্টেবল হেঁকে উঠল, ‘খাড়া হো যাইয়ে, ছোকরে।’
ছোকরা চোখ মেলে একবার তাকাল বটে, কিন্তু উঠে দাঁড়াল না। বিভাসকে সঙ্গে নিয়ে ও. সি. জীবন ধর ভারী-ভারী পা পেলে ঘরে ঢুকলেন, যুবকটির দিকে আঙুল বাগিয়ে বললেন, ‘এই হচ্ছে আপনার আসামী, বঙ্কিম। বয়েস অল্প বটে, কিন্তু এর মধ্যেই বেশ হাত পাকিয়েছে।’
বঙ্কিম মুখে-চোখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফোটাবার চেষ্টা করলেও, সে যে ভেতরে-ভেতরে বেশ ভয় পেয়েছে, সেটা একেবারে গোপন করতে পারেনি।
জীবন ধর হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘উঠে দাঁড়াও হে, ছোকরা। হ্যাঁ, সোজা হয়ে। এঁকে নিশ্চয় ভালোভাবেই চেনো?’
বঙ্কিম ঠোঁট উলটে বলল, ‘জীবনে ওঁকে আমি কোনওদিন দেখিইনি।’
লজ্জায় বিভাস তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না।
জীবন ধর জিগ্যেস করলেন, ‘কী, চিনতে পারলেন মিস্টার রায়?’
বিভাস চট করে একবার বঙ্কিমের দিকে তাকিয়ে নিল। ও. সি.-কে এড়িয়ে যাওয়ার সুরে বলল, ‘আমি তো ফোনেই আপনাকে বলেছি, জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার ছিল। ভালোভাবে ঠাহর করতে পারিনি।’
জীবন ধর বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘তার জন্যে আপনাকে এতটুকুও আপশোস করতে হবে না, মিস্টার রায়। আরও অনেক-অনেক প্রমাণই আমাদের হাতে আছে, তাই না হে বঙ্কিমচন্দ্র?’
নাক দিয়ে একটা জান্তব শব্দ করে উঠল বঙ্কিম।
এবার প্রকরণে চলে গেলেন ও. সি.। বিভাসকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার পকেটে ঠিক কত টাকা ছিল, মিস্টার রায়?’
জবাব দিতে দেরি হল না বিভাসের : ‘সতেরোশো ছিয়াশি টাকা।’
নিজের পকেটে হাত ভরিয়ে জীবন ধর বড় সাইজের একখানা লেফাফা বার করে আনলেন। তার মুখটা খুলতে-খুলতে বললেন, ‘গ্রেপ্তারের পর আমরা উদ্ধার করেছি সতেরোশো বাহাত্তর। গুণে দেখুন আপনি। ছিনতাই করবার পর বাকি টাকাটা মাস্তানসাহেব হয় খরচা করেছেন, না হয় কোথাও পড়ে-টড়ে গেছে। ধরা পড়বার সময় ব্যাটাচ্ছেলে খরগোশের মতন ছুটছিল তো। সেটাও তো ওর বিরুদ্ধে একটা মস্ত প্রমাণ—ছুটে পালাবার চেষ্টাটা।’
বিভাস খামের টাকা গুনে-গুনে দেখল—সতেরোশো বাহাত্তরই আছে। কিন্তু অতঃপর কী করবে ভেবে পেল না সে।
জীবন ধর তাকে হাজতঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। বঙ্কিম না শুনতে পায়, এমনই চাপা গলায় বললেন, ‘দেখুন মিস্টার রায়, কাজটা আমার বেআইনি তা জানি, তবু আপনাকে অনুরোধটা না করে পারছি না।’
‘অনুরোধ?’ রীতিমতো বিস্মিত হল বিভাস।
‘হ্যাঁ। ওই বঙ্কিম ছোকরার কথা বলছি। আমাদের পাড়াতেই থাকত। আমি ওকে সেই ইজের-পরা অবস্থা থেকেই দেখে আসছি। বড়জোর পনেরো-ষোলো বছর বয়েস। মানছি, এই বয়েসে আর পাঁচটা মাস্তানের মতো অনেক বদরোগই ওর হয়েছে। তবে হাতেকলমে এই প্রথম ও এ-কাজ করল, বুঝলেন না?’
বিভাস নির্বোধের মতন তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আজ্ঞে না, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
মুখখানা কালো করে জীবন ধর বলে উঠলেন, ‘আমি পাঠশালার পণ্ডিত নই মশাই যে, মাথায় মুগুর মেরে বুদ্ধির খোঁটা পুঁতে দেব। ও যে ধোয়া তুলসীপাতাটি, আমি তা বলছি না। তবে কিনা এ-বয়েসে শোধরাবার সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে হয়তো সম্পূর্ণ শুধরে যাবে। তবে সে-সুযোগ দেওয়ার অধিকার একমাত্র আপনারই আছে।’
আরও যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বিভাসের। অস্ফুট কণ্ঠে সে টেনে-টেনে বলল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’
‘ওকে বাঁচাতে হলে আজ রাত্তিরের ঘটনাটা আপনাকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে। আপনার টাকার প্রায় সবটাই যখন উদ্ধার হয়েছে, তখন ওটা নিয়ে বাড়ি চলে যান। পুলিশের খাতায় আর ডায়েরি লেখাবেন না। আমি বঙ্কিমকে রীতিমতো ধাতানি দিয়ে দু-এক ঘণ্টা পরে খালাস করে দেবো।’
বিভাস তখনও সহজ হতে পারেনি। অনুযোগের সুরে বলল, ‘কিন্তু ইংরিজিতে বলে, ”মেকারস’ মাস্ট নট বি ব্রেকারস”, ‘এভাবে আপনি যদি আইন ভাঙেন…।’
‘কী হবে ওকে জেলে পচিয়ে?’ ঘোঁত-ঘোঁত করে উঠলেন জীবন ধর : ‘ঘানি টেনে ক’জন শোধরায়, মশায়? চাকরিজীবনে অনেক তো দেখলুম। তবে এটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত মত। আপনি অবশ্য ইচ্ছে করলে ডায়েরি লেখাতে পারেন। সে-অধিকার আপনার আছে।’
সমস্ত দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা ঘুচে গিয়ে বিভাসের বুকের ভেতরটা আচম্বিতে এমন হালকা হয়ে গেল যে, আর-একটু হলেই সে হেসে ফেলেছিল আর কী। ব্যগ্রকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘না, না, কক্ষনও না। ছেলেটির কোনওরকম ক্ষতি হয়, আমি তা মোটেই চাই না। তা ছাড়া বলেইছি তো, ও-ই যে নিয়েছে, সে-সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। আপনি যা ভালো মনে করবেন, তাই হবে।’
‘ধন্যবাদ মিস্টার রায়। নিশ্চিন্ত করলেন আমায়।’ কৃতিত্বের হাসি হাসলেন জীবন ধর। পকেট থেকে প্রকাণ্ড খামখানা বার করে বিভাসের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘নিন, আপনার টাকাটা ধরুন।’
কম্পিত হাতে বিভাস টাকাটা নিয়ে পকেটে ভরল। আনন্দে সর্বাঙ্গ তখন তার থরথর করে কাঁপছে। কোনওরকমে বিদায় নিয়ে সে গিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ পুলিশের গাড়িতে চেপে বসল। বাড়িতে পৌঁছে সে ঘরে ঢুকেই শ্রীমতীকে বুকে টেনে নিয়ে এমন প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলল যে, ফুলশয্যার রাতের পর আর কখনও তা করেনি।
সকালে উঠে কিন্তু বিভাসের মনের এ-প্রফুল্ল ভাব রইল না। বঙ্কিমের মুখখানা বিঁধে থাকা কাঁটার মতনই নিরন্তর তাকে পীড়া দিতে লাগল। শ্রীমতী বারেবারেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে গো? শরীর কি ভালো নেই?’
বারেবারেই সে আমতা-আমতা করে এড়িয়ে গেল এবং পাছে ধরা পড়ে যায়, তাই নাকে-মুখে চারটি গুঁজেই অফিসে রওনা হয়ে পড়ল।
সেই গলিপথটা পার হওয়ার সময় নতুন করে যেন ধাক্কা খেল বিভাস। নেহাত অল্পবয়েসেই বঙ্কিম ছেলেটি অসৎ পথে গেছে বটে, কিন্তু টাকাটা তো আসলে তার—তা সে যেমন করেই উপার্জন করে থাকুক না কেন। বিভাস নিজেকে ক্ষমা করবে কী করে? হয়তো গরিবের সংসারের হাজাররকম তাগিদ মেটাতেই সে এ-কাজটা করেছিল। হয়তো বাড়িভাড়া না দিলেই নয়, হয়তো রেশন আনতে হবে, কী বাপ-মা-ভাই-বোন কারও জন্যে ডাক্তার ডাকতে হবে।
মনে-মনে শিউরে উঠল বিভাস। বঙ্কিমকে দুর্বৃত্ত ভাবার কী অধিকার আছে তার? আদালত তো তাকে দণ্ড দেয়নি। জেল-হাজতও খাটেনি সে। তবে?
নিজের টেবিলের কাছে এসে শ্রান্ত দেহে সে চেয়ারে বসে পড়ল।
নিত্যকার মতন জল দিতে এসে পুরোনো বেয়ারা রামতরুই তার মুখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে, রায়বাবু? শরীর খুব খারাপ?’
‘রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়নি তো, তাই…’ ইচ্ছে না থাকলেও ফাইলপত্রগুলো টেনে নিল বিভাস। কিন্তু একেবারে মন দিতে পারল না। কানে যেন অনবরত বঙ্কিমের কণ্ঠটা ভেসে আসতে লাগল, ‘সংসারে সাধু সাজবার কোনও দাম নেই। শেষপর্যন্ত সেই তো হাতে বেড়ি, কোমরে দড়ি…।’
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল বিভাসের। টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে টালিগঞ্জ থানার নম্বরটা ডায়াল করল।
ওপার থেকে ক্রমাগত কোঁ-কোঁ শব্দ আসতে লাগল। মনে হচ্ছে এনগেজড। রিসিভারটা সবেমাত্র নামিয়ে রাখতে যাচ্ছে, এই সময় সুশীল ঢুকল। নিজের চেয়ারের দিকে যাচ্ছিল সে। কপালে, গালে স্টিকিং প্লাস্টারের পটি লাগানো। ঠোঁটদুটো ফুলো-ফুলো।
বিস্মিত বিভাস জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে সুশীল? কপালে, গালে তাপ্পি কেন?’
‘আর বোলো না, ব্রাদার। কাল যা রাত্তির গেছে!’ তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল সুশীল ‘তুমি চলে যাওয়ার পরে-পরেই আমাদের খেলা ভেঙে গেল। শুতে যাব, দেখি প্যাকেট খালি। অপরাধের ভেতরে রে ভাই সিগারেট কিনতে বেরিয়েছিলুম। সঙ্গে-সঙ্গে অন্ধকারের ভেতর থেকে এক মাস্তান ছেলে লাফিয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে…।’
বিস্ফারিত চোখে বিভাস একরকম চিৎকারই করে উঠল, ‘সত্যি বলছ তুমি? যা বললে, তা…।’
‘মিথ্যে বলে আর লাভটা কী? কাল তোমার কাছ থেকে যা জিতেছিলুম, তার পাই-পয়সাটি পর্যন্ত…।’
‘পুলিশে জানাওনি?’
‘দুর, দুর! কাকে ধরবে পুলিশ! শহরে কি ওই একটিই উঠতি গুণ্ডা? তার চেয়ে ব্রাদার, পকেটে থাকে তো দশ-বিশটা টাকা ধার দাও তো। দিন-দুয়েক পরেই শোধ দিয়ে দেব’খন।’
বিভাস স্মিত হাসি হেসে বলল, ‘আপত্তি ছিল না ভাই। তবে জানোই তো, আমি আবার বিবাহিত।’
পুলিশে ফোন আর সে করল না।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮০