বসে আছি
ঠিক আছে! স্বস্তি না পাই, অপরিসীম এই অস্বস্তিটা তো পেয়েছি ঠাকুর! ধরা দিলেন না, কৃপা করলেন না। হয়নি, হচ্ছে না। যেভাবে ডাকলে সাড়া দিতেন, সেভাবে ডাকতে পারিনি। ফাঁক থেকেছে, ফাঁকি দিয়েছি। আয়োজনের ত্রুটি ছিল না। পট, মালা, আসন, ঘণ্টা, ফুল, চন্দন, ধূপ, বাতি, গ্ৰন্থ! আসনে বসেছি, মালা জপেছি। তন্মনস্ক হতে পারিনি। মন বসেনি। চোখে জল আসেনি। হৃদয় কাঁপেনি। আসনে জোর করে নিজেকে বসিয়ে রেখেছি। জপের সংখ্যা কোনরকমে শেষ করে ছুটে পালিয়েছি। জপ হয়েছে শাস্তি! ধ্যান হয়েছে বিষয়-আশয়! স্বাদ পাইনি। আপনি বলেছিলেন, নিবাত, নিষ্কম্প দীপশিখায় মনকে আরোপ করতেন। আমিও করেছি, কিন্তু নিষ্কম্প করতে পারিনি; এলোমেলো বাতাসে কেঁপেছে, কেবলই কেঁপেছে, শেষে দপ করে নিভে গিয়ে শান্তি দিয়েছে! আপনাকে হৃদয়ে বসাব কি ভ্রমধ্যে—এই দোটানায় আপনি অবশেষে বসার আসন না পেয়ে বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।
মন যেন হড়হড়ে তালশাঁস। চেপে ধরতে গেলেই পিছলে পালায়। পদ্মপাতায় জলের মতো। যেই স্থির করতে যাই, টলমল করে শেষে ঝরেই যায়। মনকে শাসন করব কি, মনই আমাকে শাসন করে! ধ্যান মানে লড়াই। সবাই আসে, আপনি কিন্তু আসেন না। আপনাকে ভাবতে বসলেই অন্য সব ভাবনা ভিড় করে আসে। অথচ আকাঙ্ক্ষা কি বিরাট—স্বামীজীর মতো ধ্যানসিদ্ধ হব! তিন কথায় বিশ্ব কাঁপাব! দেহ থেকে জ্যোতি ঠিকরে বেরবে! ইষ্টের সঙ্গে সেলুলার ফোনে কথা হবে! বাকসিদ্ধ হব!
মালা ছিঁড়ে গেল, হাজার টাকার ধূপ পুড়ে গেল, গোটাকতক ফুলের বাগান শেষ হয়ে গেল। তবু আঁধার ঘরে আলো আর জ্বলল না। পাখি দাঁড়ে বসে ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলে, বেড়ালে ধরলেই ‘ক্যাঁ ক্যা”। জ্ঞানের ফুলঝুরি, আসলে অজ্ঞান। মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনাকে টপকে চলে গেছি! ভামির শেষ নেই!
দেখতে দেখতে দিন চলে গেল, বিষণ্নতার অন্ধকারে একা বসে আছি, পরাজিত। ছুঁচে সুতো পরাতে পারিনি। ভক্তির লালাতে মসৃণ করতে পারিনি ফেঁসো। নিজের গৌরব বাড়াতে আপনার শত কথা বলেছি, নিজের জীবনে অনুশীলন করিনি। মুখস্থ করেছি, মনস্থ করিনি। কী হবে আমার!
প্রশ্নের উত্তরে নিজেই বলি—কী আবার হবে, এবারটাও গেল! তিনি বলেছিলেন : “চৈতন্য হও।” শোনাই সার। ‘চৈতন্য’ কাকে বলে—সেইটাই পরিষ্কার হলো না। আমি কে? একটা নাম। দোকানের গায়ে ঝোলানো সাইনবোর্ডের মতো। লেনা আর দেনা। নিজেকে বাজারে বিকানো। তাকের ওপর লাল গণেশ। মোবাইল পূজারী গঙ্গাজল ছিটায়, ফুল ছুঁড়ে দেয়। মাসিক বরাদ্দ বাঁধা। কপালে টিপ পরায়। সন্ধ্যাবেলা টুনিলাইট জ্বলে। ধূপের ধোঁয়ার পাক মেরে ধূপাধারে গুঁজে দেওয়া। ‘চৈতন্য’ কে চায় প্রভু! শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই!
আপনি বলেছিলেন : “বিচার কর, টাকায় কি হয়!”
বিচারে বসে এই পেলাম—টাকাতেই সব হয়। টাকা হলো নেশা। যত পাই তত চাই। বেশ একটা ‘সুখ সুখ’ ভাব আসে মনে! শ্রেষ্ঠত্বের একটা অভিমান। অদ্ভুত একটা রাজসিকতা। বিত্ত-বৈভবে কি শান্তি আসে! আপনি চিলের উপমা দিয়েছিলেন—যতক্ষণ ঠোঁটে মাছ ততক্ষণ কাকের তাড়া। ফেলে দিলেই শান্তি। পড়েছি, কিন্তু সংস্কারে গ্রহণ করিনি। চিল হয়েই বসে আছি। কাকের অত্যাচারে অহঙ্কার স্ফীত হয়! আমি চিল। স্বভাবে চিল। অভাবে কাক। এখন কী করি ঠাকুর!
হাজার বছরের এই অন্ধকার ঘরে কবে হবে সেই দীপসংযোগ। কবে বয়ে যাবে মলয়ের বাতাস! বলেছিলেন : “রোখ চাই। ম্যাদামারা হলে হবে না।” ভিজে দেশলাইয়ে কাঠি ঘষছি। কোথায় স্ফুলিঙ্গ! একের পর এক কাঠিই নষ্ট। আপনার প্রখর কিরণে কবে আমার বারুদ শুকনো হবে! আমার অবস্থাটা আপনাকে আমি জানাচ্ছি। আমার ভবরোগের কথা। এইবার আপনি কি ব্যবস্থা করবেন সে আপনিই জানেন। আপনিই জানেন, আমি আপনার ঘরের লোক কিনা!
আমার ভক্তি কাঁচা ভক্তি। আপনি বলেছেন : “যার কাঁচা ভক্তি, সে ঈশ্বরের কথা, উপদেশ ধারণা করতে পারে না। পাকা ভক্তি হলে ধারণা করতে পারে। ফটোগ্রাফের ‘কাচে যদি কালি (Silver Nitrate) মাখানো থাকে, তাহলে যা ছবি পড়ে তা রয়ে যায়। কিন্তু শুধু কাঁচের ওপর হাজার ছবি পড়ুক একটাও থাকে না—একটু সরে গেলেই যেমন কাঁচ তেমনি কাঁচ। ঈশ্বরের ওপর ভালবাসা না থাকলে উপদেশ ধারণা হয় না।”
এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকা ভক্তি পাই কোথায়! আমার দোকানে নেই!
নেই যখন, তখন কাতর হচ্ছ কেন?
আমি যে আপনাকে ভালবাসি। যোগ্য নই, তবু মনে হয় চেষ্টা করে দেখি, যদি আপনার কৃপাকটাক্ষে মনের কাঁচে সিলভার নাইট্রেটের প্রলেপ লাগে!
তাহলে কর, যা বলছি তাই কর—মনের ময়লা চোখের জলে ধুয়ে ফেল। “কাম-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনে ময়লা পড়ে আছে। ছুঁচ কাদা দিয়ে ঢাকা থাকলে আর চুম্বক টানে না।” বল, “হে ঈশ্বর, আর অমন করব না।” অনুতাপে কাঁদ। ময়লাটা ধুয়ে যাক। তখন ঈশ্বররূপ চুম্বক মনরূপ ছুঁচকে টেনে নেবে। তখন লগ্ন হবে, মগ্ন হবে, আনন্দে আনন্দসাগর উথলিবে। বিষয় আলুনি লাগবে। স্বাদ আসবে। ‘টং’ হয়ে যাবে। কী ছার সংসার, ছিবড়ে কাম-কাঞ্চন! কৃপা! চিৎকার করলেই কৃপা? কৃপা কি সহজে হয়! কতকগুলো শর্ত আছে। ‘অহঙ্কার একেবারে ত্যাগ করতে হবে।’ ‘আমি কর্তা’—এ-বোধ থাকলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। ভাঁড়ারে একজন আছে, তখন বাড়ির কর্তাকে যদি কেউ বলে, ‘মহাশয়, আপনি এসে জিনিস বার করে দিন।’ তখন কর্তাটি বলে, ‘ভাঁড়ারে একজন রয়েছে, আমি আর গিয়ে কি করব!’ পারবে কি অহঙ্কার একেবারে ত্যাগ করতে? একেবারে পরিষ্কার কথা—”যে নিজে কর্তা হয়ে বসেছে তার হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর সহজে আসেন না!” কোন্ হাতুড়িতে অহঙ্কার ভাঙা যায়? “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল!”
লেংটি ইঁদুরের মতো ‘আমি’টাকে দূর করা যায় কেমনে? সে যে কুরে কুরে সব খেয়ে ফেললে। কোন্ কলে ধরব আমি তাকে?
এইখানেই গোল হলো, আমি দিয়ে কি ধরা যায় না। তাই “থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”
“ম্যায় গুলাম, তু দেওয়ান।” বসে থাকি ঠাকুর তোমার নাম নিয়ে। পাওয়ার স্বস্তি যদি নাই জোটে বরাতে, না পাওয়ার অস্বস্তিটাই বরং থাক।