কুন্তির কানীন (কুমারী অবস্থায় জাত) পুত্র । দুর্বাসা মুনি কুন্তিকে বর দিয়েছিলেন যে, কুন্তি যে কোনও দেবতাকে আহবান করে তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করতে পারবেন। এই বরের তাৎপর্য বুঝতে না পেরে কুন্তি কুমারী অবস্থাতেই সুর্যকে আহবান করেন। ফলে সূর্যের মত তেজস্বী কবচ-কুণ্ডল সহ এক পুত্র কুন্তি প্রসব করলেন। কলঙ্কের ভয়ে সদ্যোজাত পুত্রকে একটি পেটিকাতে পুরে কুন্তি সেটি নদীতে বিসর্জন দিলেন। সূত-বংশজাত অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী রাধা নদী থেকে সেই পুত্রকে উদ্ধার করে বসুষেণ নাম দিয়ে তাঁকে মানুষ করেন। পরে নিজে কুন্তি-পুত্র জানলেও, বসুষেণ আজীবন নিজেকে রাধেয় বলে পরিচয় দিতেন। বসুষেণ একাধিক সূতদুহিতাকে বিবাহ করেছিলেন। বৃষসেন, ভানুসেন ও সুষেণ নামে তাঁর তিন পুত্র ছিল। বসুষেণ পাণ্ডব ও কৌরবদের আচার্য দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেন। অস্ত্রবিদ্যায় অর্জুনের সঙ্গে বসুষেণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। অর্জুন ছিলেন দ্রোণের প্রিয় শিষ্য। তাই অর্জুনকে শেখালেও দ্রোণ বসুষেণকে ব্রহ্মাস্ত্র-বিদ্যা শেখাতে রাজি হলেন না এই যুক্তিতে যে, এই দিব্যাস্ত্র শুধু ব্রাহ্মণ আর সংযত ক্ষত্রিয়দের জন্য। বসুষেণ তখন পরশুরামের কাছে গেলেন। নিজেকে ব্রাহ্মণ-পুত্র বলে পরিচয় দিয়ে তাঁর শিষ্য হলেন। সেইখানে অস্ত্রাভ্যাসের সময় ভ্রমক্রমে এক ব্রাহ্মণের হোমধেনুকে বধ করায়, সেই ব্রাহ্মণ বসুষেণকে অভিশাপ দেন যে, যাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন বলে ওঁর এই অস্ত্রশিক্ষা, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধকালে ওঁর রথের চাকা মাটিতে ঢুকে যাবে,আর সেই সুযোগে প্রতিপক্ষ ওঁর শিরশ্ছেদ করবেন। শিষ্যকে ব্রহ্মাস্ত্র শেখানোর পর পরশুরাম একদিন বুঝতে পারলেন যে, বসুষেণ আসলে ব্রাহ্মণ নন। তখন পরশুরাম বসুষেণকে অভিশাপ দিলেন যে, মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তিনি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র স্মরণ করতে পারবেন না। হস্তিনাপুরে সভা করে যখন দ্রোণের শিষ্যরা তাঁদের অস্ত্রবিদ্যা সবাইকে প্রদর্শন করছিলেন, তখন বসুষেণ সেখানে এসে অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দযুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কৃপ সকলের সামনে তাঁর বংশপরিচয় জানতে চাইলেন, কারণ বিশেষ কৌলীন্য না থাকলে রাজকুমারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায় না। সূতপুত্র হিসেবে পরিচিত বসুষেণের সেই লজ্জাকর মুহূর্তে দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। দুর্যোধনের এই বদান্যতা বসুষেণ আজীবন মনে রেখেছেন। দ্রুপদ-দুহিতা কৃষ্ণার (দ্রৌপদী) স্বয়ংবর সভায় বসুষেণও গিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্য ভেদ করে কৃষ্ণাকে জয় করার সুযোগ পান নি – কারণ তার আগেই কৃষ্ণা বলে উঠেছেন যে, সূতপুত্রকে তিনি বরণ করবেন না। সেই কৃষ্ণার সঙ্গে যখন পঞ্চপাণ্ডবের বিবাহ হল, তখন শুধু অর্জুন নয়, কৃষ্ণা (দ্রৌপদী) সহ পঞ্চপাণ্ডবের প্রতিই ওঁর বৈরী মনোভাব ও নীচতা বারংবার প্রকাশ পেয়েছে। নীচতায় তিনি অনেক সময় দুর্যোধনকেও ছাড়িয়ে গেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে নানা ব্যাপারে তাঁর মহত্ব বাস্তবিকই অতুলনীয়। বসুষেণ দাতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। বসুষেণ জন্মেছিলেন স্বর্ণময় কবজ-কুণ্ডল নিয়ে,যার গুণে তিনি ছিলেন অপরাজেয়। ইন্দ্র এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বসুষেণের কাছে ঐ কবজ-কুণ্ডলটি ভিক্ষা চাইলেন। বসুষেণ ইন্দ্রকে চিনতে পারলেন এবং এও বুঝলেন যে, কেন ইন্দ্র এটি চাইছেন, তা সত্বেও উনি কবজটি কেটে ইন্দ্রকে দিলেন। এর পর থেকে বসুষেণের নাম বৈকর্তন ও কর্ণ হল। ইন্দ্র কর্ণের এই অসামান্য বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে ওঁকে একপুরুষ-ঘাতিনী অস্ত্র দেন যা দিয়ে একবার একজনকে হত্যা করা যাবে – সে দেব নর দানব যেই হোক। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর জন্ম-রহস্য জানিয়ে পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দিতে বলেছেন। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব হিসেবে বরবর্ণিনী দ্রৌপদীকেও যে ভার্যা হিসেবে তিনি পাবেন সেটা জানাতেও ভোলেন নি। কিন্তু কর্ণ কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মাতা কুন্তি কর্ণের কাছে এসেছেন। কর্ণ যে ওঁর পুত্র সেটা জানিয়ে ভ্রাতাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলেছেন। সুর্যদেবও অন্তরীক্ষ থেকে কুন্তির কথায় সায় দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণ দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করতে রাজি হন নি। শুধু কুন্তিকে বলেছেন যে, উনি অর্জুন ছাড়া আর কোনও পাণ্ডবকে বধ করবেন না। তারপর কিছুটা অভিমান ভরেই কুন্তিকে বলেছেন যে, কুন্তির পাঁচ পুত্রই জীবিত থাকবে – হয় অর্জুন অথবা কর্ণ হত হবেন। সেই কথা উনি রেখেছিলেন। ভীমকে পরাস্ত করে তাঁকে বধ করতে গিয়ে কুন্তিকে দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে উনি নিজেকে সম্বরণ করেন। কুরুক্ষেত্রে দ্রোণের মৃত্যুর পর কর্ণ কৌরবদের প্রধান সেনাপতি হন। অর্জুনের জন্য ইন্দ্র-প্রদত্ত যে এক পুরুষ-ঘাতিনী অস্ত্রটি তিনি সযত্নে রক্ষা করছিলেন,ভীম-পুত্র ঘটোৎকচের আক্রমণে কৌরব পর্যদুস্ত হওয়াতে সেটি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে উনি বাধ্য হন। পরে অর্জুনের সঙ্গে সন্মুখ সমরে ব্রাহ্মণের সেই অভিশাপে ওঁর রথের চাকা মাটিতে বসে গেল, পরশুরামের শাপে কোনও ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ পদ্ধতি আর স্মরণে এলো না। অর্জুনকে একটু থামতে বলে রথ থেকে নমে উনি রথের চাকা তুলতে যাচ্ছেন, তখন অর্জুন ওর শিরশ্ছেদ করলেন।