বসন্দা – গৌরকিশোর ঘোষ
যে ছয় গোঁসাই আমায় সংসার-পথে হাঁটা শিখিয়েছেন, বসন্দা তাঁদের এক।
তখনো ইস্কুল ছাড়বার বয়স হয় নি, বসন্দার সঙ্গে ভিড়ে গেলুম। ঠিক কি করে আজ আর বলতে পারব না। তবে যদ্দুর মনে পড়ে দেদাই ছিলেন আড়কাঠি।
দেব্দা ইস্কুলের সিনিয়ার বয়। দু’ কেলাস উপরে পড়েন একে, তার উপরে চৌকস। খাতির আলাপ তাঁর সঙ্গে সেই জন্য সব্বার। উনিই একদিন যেন কি কথায় আমাকে দশের মাঝ থেকে বেছে নিয়ে গিয়ে একান্তে ফিসফিস করে বললেন, ‘দ্যাখ্, তোকে আজ যে কথা বলছি, কথা দে তা আর পাঁচ-কান করবিনে। তোকে সবচেয়ে বিশ্বাস করি। আশা করি, সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবি।
দেব্দা দশজনের মধ্যে শুধু আমাকেই বিশ্বাস করেন সে যে আমার কতখানি, সে কথা বোঝাব কি প্রকারে? তখন আমার বুক যদি ফোলবার মতো হত নিশ্চয়ই ফুলত। আর যদি কাবুলি বেড়াল হতুম তো তক্ষুনি সব্ব অঙ্গে রোঁয়া ফুলিয়ে দেদার পায়ে পায়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করে গা ঘষে বেড়াতুম। কিন্তু সেসব কিছুই করলুম না। আমি চিরকেলে নার্ভাস, আচমকা উত্তেজনা হলে বোদা মেরে যাই।
দেব্দা বললেন, ‘জানো তো আমি বিপ্লবী, আর বিপ্লবীদের বাপ-ভাই বলে কিছু নেই। সব অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত কিনা, ট্রেচারি করলে কটাস্ করে একটি পিস্তলের গুলি, টিপ করে একেবারে দুই ভুরুর মধ্যিখানে।
বলেই মর্তমান কলার মতো তর্জনীখানা দিয়ে আমার দুই ভ্রুর মধ্যে দিলেন এক খোঁচা। চমকে উঠলুম। মনে হল আমি আর নেই। অসাবধানে কি এক গুপ্ত কথা ফাঁস করে দিয়েছি আর তাই্ আমার চরম বিচার সমাধা হয়ে গেল। কটাস্ করে পিস্তলের গুলিটা কপাল ফুঁড়ে এই মাত্তর বেরিয়ে গেল। হাত দিয়ে কপালটা দেখব রক্ত পড়ছে কি না, সেটুকু ক্ষমতাও হল না।
দেব্দা বললেন, ‘মসার পিস্তলের পাল্লা জানো? একেবারে হাজার গজ। দৌড়ে পালিয়েও নিস্তার নেই। বসন্দার কাছে দুটো পিস্তল আছে। আর বসন্দা উড়ো মাছিকেও রেহাই দেন না, এমন হাতের টিপ, বুঝলে। কাজেই ট্রেচারি করতে যেও না। তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই কথাগুলো বললাম, নইলে এসব সিক্রেট আউট করবার নয়’
দেব্দা চলে গেলেন। যাবার সময় আর একবার ফিসফিস করে বললেন, ‘খবর্দার, এর একটি কথা আউট হয়েছে কি’—আর মুখে বললেন না, আঙুল দিয়ে পিস্তলের ট্রিগার ছোঁড়ার উদ্যোগ করেই হাঁটা দিলেন।
আমার বুকখানা যতটা ফুলেছিল প্রথম দিকে তার দ্বিগুণ চুব্সে গেল। ভয়ে কাঠ মেরে গেলুম। বিপ্লবী সিক্রেট পেটে করে ঘুরে বেড়ানো যে কি যন্ত্রণা তা আর বোঝাই কি করে? তার উপর সদা আশঙ্কা কোন্ ফাঁকে কি বেরিয়ে পড়ে। যে শিকল দিয়ে কথাগুলিকে জিভের সঙ্গে বেঁধেছি তার হিম্মত কত সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। রোদ লাগা পালং শাকের মতো ভয়ের তাতে চুব্সে উঠেছি এমন সময় দেব্দা পাকড়াও করলেন। আরেকদিন।
বাজারে যাচ্ছিলেন। আমাকে রাস্তার একপাশে টেনে নিয়ে চকিতে চারপাশ দেখে মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমাকে ফলো করো। যেন চেন না এইভাবে। জরুরি কথা আছে।’
আমি ঘেমে উঠলুম। সেদিনের পর থেকে তো রাতের ঘুম, দিনের আচ্ছা চুলোয় গেছে। রাতদিন কল্পনার চোখে দেখছি সরু সুতোয় ঝুলে আছি, একটু এদিক-ওদিক হলেই পপাত চ মমার চ। আবার আজকে। এত লোক থাকতে দেব্দা আমাকে কেন পাকড়াও করলেন বুঝলুম না।
যা হোক, আজ্ঞা যখন হয়েছে, তখন ফলো করা ছাড়া আর কি গতি! আমাদের পাড়া থেকে বাজার সিধে রাস্তায় বড় জোর সাত মিনিট। কিন্তু দেব্দা র কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেলুম। এ-পথে ও-পথে ঘোরাঘুরি করতে করতে ঘণ্টাখানেক কাটল তবু বাজারে পৌঁছুলাম না। হঠাৎ দেখি, দেব্দা আমার পাশে এসে গেছেন। সন্দিগ্ধভাবে ফিসফিস করে বললেন, ‘ব্যাপার সুবিধের নয়। দু’জনের আর একসঙ্গে যাওয়া চলবে না। ব্যাটা পেছু নিয়েছে। তুই পোড়ামা-তলা হয়ে যা, গিয়ে লক্ষ্মণ কাঁসারীর দোকানের ওখানে অন্যমনস্কতার ভান করে ঘোরাঘুরি করবি। আমি ব্যাটাকে নাকের জলে চোখের জলে করে তবে বাজারে যাব। যতক্ষণ না যাই দাঁড়িয়ে থাকবি। সুবিধে দেখলে কথা বলতেও পারি আবার নাও পারি। বড্ড বাঁকা পথ এটা, বুঝলি?’
বলেই দেব্দা চুপ মেরে গেল। ব্যাপারটা কি, জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলুম। দেব্দা তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলেন। পরমুহূর্তেই এক বৃদ্ধ আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন। দেব্দা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ওই!’ সে উত্তেজনা আমাতেও ভর করল। দেখি কোন সময়ে আমিও চাপাস্বরে জিগ্যেস করছি, ‘ও কে?’
দেব্দা বললেন, ‘স্পাই।’ বলেই সটকে পড়লেন।
আর কিছু জানি আর না জানি, ইংরেজি স্পাই কথাটার অর্থ জানতুম সুস্পষ্ট। দেব্দার মুখ থেকে শব্দটা শোনা ইস্তক গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠল। আর ধকাস ধকাস বুকের শব্দে কানে লাগল তালা। হাত-পা শরীরের থরথরানি কোন রকমে সামলে লক্ষ্মণ সিংগির দোকানমুখো পা বাড়িয়েছি, মনে হল পেছনে কে? চেয়েই—যা ভেবেছি—হাত-পা হিম হয়ে এল। ব্যাটা আমার পেছনেও লেগেছে। অবিশ্যি লোকটা উল্টো দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু ওইটেই যে স্পাইদের কায়দা। ধরা-ছোঁয়া দেবে না তো। আমিও তাই আর সিধে লক্ষ্মণ সিংগির দোকানে গেলুম না ; এ-পথে ও-পথে ঘণ্টা-দুয়েক ঘোরাঘুরি করে পা যখন টনটন করতে লাগল, তখন বাজার-পানে মুখ ফেরালুম। ব্যাটাকে আচ্ছামতো জব্দ যে করেছি, সেই সুখের অল্প আঁচেই মনের দুধ বল দিতে লাগল।
দেব্দার সঙ্গে দেখা হল সেদিন বাজারে নয়, পরদিন ইস্কুলে, টিফিন পিরিয়ডে।
বললেন, ‘ব্যাটা বড় শয়তান। বাজারই করতে দিলে না। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা তা জানিস তো, আর এই টিকটিকিতে ছুঁলে যে কত ঘা, তার ইয়ত্তা নেই। তবে আমরা রিভলিউশনারি, আমাদের কাছে ট্যাঁফোঁটি চলবে না। ওরা যদি বুনো ওল তো আমরা বাঘা তেঁতুল। নরেন গোঁসাই জেলের মধ্যে বিট্রে করে বললে, রাজসাক্ষী হব। ভাবলে জেলে যখন আছি, তখন খুবই সেফ, আরে বাবা তা কি হয়! সেই জেলের মধ্যেই বুঝলি, নরেন গোঁসাইকে খুটুস্।’
দেব্দা আবার আমার দিকে পিস্তল ছুঁড়ে দিলে। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললুম, ‘কিন্তু আমি তো কাউকে কিছু বলিনি।’
দেব্দা একমুখ হেসে বললে, ‘জানি রে জানি। বসন্দা কখনো লোক চিনতে ভুল করেন নি। তার দিকে তাঁর কড়া নজর আছে। তুই খুব লাকি। নইলে এত ছেলে থাকতে তোকেই বেছে বের করেন!’
বসন্দা কে? আমাকে চিনলেন কি করে? আবার একঝলক উত্তেজনা এল। শরীরের রক্ত বুড়বুড়ি ছেড়ে বেড়াতে লাগল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলুম, ‘বসন্দা কে?’
দেব্দা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনি তাই বেঁচে গেলে। কিন্তু খবর্দার আর কখনো এমন কৌতূহল প্রকাশ করো না। বিপ্লবীরা লাইক সোলজারস্। সব সময় নেতাদের কম্যাণ্ডে চলতে হয়। বসন্দা বলেছেন তাই তোমার সঙ্গে এতগুলো কথা বললাম। সময় হলে নিজেই সব জানতে পাবে। জানাবার হলে দাদাই তোমাকে জানাবেন। শুধু এটুকু শুনে রাখো, দাদার মাথার উপর সাতখানা ওয়ারেন্ট ঝুলছে। পুলিস, স্পাই, আই বি, ইনফর্মার চতুর্দিকে দাদাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তিনি ওদের মুখে কলা ঠেকিয়ে—এই চুপ।’
বলে দেব্দা তক্ষুনি সরে পড়লেন। দেখি, পণ্ডিতমশাই।
বললেন, ‘কিরে কুম্মাণ্ড, কি পরামর্শ করছিলি? অনড্ডানটাই বা পালাল কেন?’
ছ্যাঁক করে উঠল বুক। মুখ শুকিয়ে গেল। বললুম, ‘স্যার, আমাদের বাড়ি আজ দেব্দার নেমন্তন্ন কিনা, তাই সে কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলুম।’
বলেই চোঁ-চাঁ, দে পঁয়ষট্টি।
ছুটির পর দোর সঙ্গে দেখা।
জিগ্যেস করলেন, ‘কি বললে রে বুড়ো?’
বিস্তারিত সব বললুম। চটপট বানিয়ে বলার ক্ষমতা দেখে দেব্দা খুব তুষ্ট।
বললেন, ‘হবে তোর।’
আমি ফুলে উঠলুম। যে কথাটা বলবার ফুরসুত পাচ্ছিলুম না, না বলতে পেরে আই-ঢাই করছিলুম, দেব্দাকে কিঞ্চিৎ প্রসন্ন দেখে বলে ফেললুম।
রাস্তার একধারে দেব্দাকে টেনে নিয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করে বললুম, ‘কাল আমাকে ফলো করেছিল।’
দেব্দার মুখ উজ্জ্বল হল। বললেন, ‘জানতুম। আমার সঙ্গে যখনই তোকে দেখেছে, তখনই বুঝেছি তোর দফাও হয়ে এল। তা ঘাবড়াস নে। তুই এবার থেকে আমাদের নিজের লোক হয়ে যাবি।’
জিগ্যেস করলুম, ‘বসন্দার দেখা পাব তাহলে?’
বলেই জিভ কাটলুম। জিগ্যেস করাটা অন্যায় হল। কি জানি কেন সেদিন ধমক খেলুম না।
দেব্দা বললেন, ‘সময় হলেই পাবি। এখন যা। সাবধানে বাড়ি যাস।’
পাঁচ বছর ধরে যে-পথ দিয়ে নির্বিঘ্নে ইস্কুল আর বাড়ি করেছি, সে-পথ ছাড়তে বাধ্য হলুম। সোজা পথ ছেড়ে গলি-পথ ধরলুম। কারণ বিপ্লবীদের জন্য নাকি সোজা পথ নয়। আর আমার চোখে তখন বিপ্লবের রঙ ধরে-ধরে। রাস্তাঘাটে গিস-গিস স্পাই দেখছি, যে পায় সেই আমায় ফলো করে। আর আমি বিকেলে ইস্কুল থেকে বেরিয়ে নানা পথ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরি। সদর দিয়ে আর বাড়ি ঢুকিনে, খিড়কি করেছি সার।
সে এক সাংঘাতিক অবস্থা। দিনরাত্তির যেন উত্তেজনার এক ফুলহাতা পশমের সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে রেখেছি। ইতিমধ্যে বারকয়েক দেদার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেই রাস্তার পাশে সরে গেছি, সেই ফিসফিস আওয়াজ শুনেছি। বহু তথ্য জেনেছি। ব্রিটিশদের অত্যাচারের ভরা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাটাতনের নিচেটায় এখন একটা পেরেক দিয়ে টুকুস্ করে একটা ছেদা করার ওয়াস্তা শুধু, বাস্, তাহলেই বুড়-বুড় করে ব্যাটাদের সাম্রাজ্য তলিয়ে যাবে। বিপ্লবীদের উপরই এই পেরেক ঠোকবার ভার। কিন্তু ব্রিটিশরাও বড় হাড়-হুঁশিয়ার। বিপ্লবীদের মতলব কিছু আঁচ করেছে। তাই দেশময় ঘরময় স্পাই ছড়িয়ে রেখেছে। এই স্পাইরা বড় ধুরন্ধর, শয়তানের জাসু, ট্রেজারার, ছদ্মবেশ ধরতে অ্যায়সা ওস্তাদ যে একদিন হাতে হাতে প্রমাণ পেয়ে অবাক হয়ে গেলুম। প্রমাণ দেব্দাই দেখালেন।
দু’জনে বেড়াচ্ছি। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের দিকটায় বেশ নির্জন। হঠাৎ দেব্দা বলে উঠলেন, ‘আমার চোখে ধূলো দেওয়া অত সোজা নয়। বসন্দার খাস রিক্রুট আমি। নিজে হাতে ধরে ধরে স্পাই চেনা শিখিয়েছেন। ঘাড়টা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল করে হাসপাতালের বারান্দায় তাকা। ওই যে। সবুজ লুঙ্গি। দেখেছিস?’
ততদিনে কিছু কিছু তালিম রপ্ত হয়েছে। জিওমেট্রিক্যালি ঘাড় ঘোরানো বিপ্লবী বর্ণপরিচয়ের স্বরে-অ স্বরে-আ। দেব্দার সঙ্গে চারদিন ঘুরেই সেগুলো শিখে ফেলেছিলুম। কিন্তু তার পরই তিনি চুপ। হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ই আর কিছুতেই শেখান না। আমি ঔৎসুক্য মুখে প্রকাশ করিনে, বিপ্লবীদের করতে নেই, কিন্তু মনে মনে অস্থিরতায় ফেটে পড়ি। কবে বসন্দাকে দেখব? কবে পিস্তল ছোড়া শিখব? কতদিনে আমার নামে আটখানা ওয়ারেন্ট ঝুলবে? সেসব কিছুই হচ্ছে না, অথচ চার মাস ধরে ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দু পায়ে কড়া পড়ে গেল। সন্ধেয় বাড়ি ফিরলে যেদিন গার্জেনের গালমন্দ খাই, সেদিন তবু কিছু পুলক হয়, বিপ্লবের দিকে কিছুটা তবু এগুলাম। প্রকৃত বিপ্লবীদের নাকি অশেষ নির্যাতন সহ্য করতে হয়, তা বাপ-মায়ের গঞ্জনাও তো নির্যাতন। দেব্দা বলেন ধৈর্য চাই। এ-পথে ফুল বেছানো নেই, শুধুই কাঁটা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় জিগ্যেস করি, তবে সাধ করে ও-পথে হাঁটা কেন? ইচ্ছে হতেই শিউরে উঠি। কিছু জিগ্যেস করা চলবে না। ফক্কড় ইচ্ছেটার মাথায় দুই গাঁট্টা মেরে শায়েস্তা করি।
আজ হঠাৎ দেব্দার কথায় কিঞ্চিৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলুম। উৎসাহটা পোষা কুকুরের মতো পাপপাশের উপর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, এখন মনিবের শিস্ শুনে ঘুম ভেঙে সামনে দু পা এগিয়ে একটা ডন মেরে দাঁড়ালে।
দেব্দা বললেন, ‘দেখলি?’
দেখলুম সবুজ লুঙ্গি পরা একটা মড়ঞ্চে ঢ্যাঙা লোক সত্যি সত্যিই সেই হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কি কথা বলছে।
দেব্দা বললেন, ‘ডাক্তারটা ইনর্মার, ভাল করে চিনে বাখ। স্পাইটা ওর কাছ থেকে যাবতীয় খবর নিয়ে থানায় দিয়ে আসে। আজ তো ব্যাটাচ্ছলে লুঙ্গি পরেছে, সেদিন দেখি হাফপ্যান্ট পরে থানার সামনেকার খাবারের দোকানে বসে বসে তেলেভাজা খাচ্ছে। এই লোকটা ভেক ধরতে পয়লা নম্বর। সবচে বেশি খবর এই সাপ্লাই করে। কিন্তু যতই ভেক ধরো আমাদের চোখ এড়ানো তোমার বাপেরও কর্ম নয়। বসন্দাও এর উপর কড়া নজর রেখেছেন।’
তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ধীরে ভারী গলায় বললেন, ‘হু নোজ, হি মে বি আওয়ার ফাস্ট টার্গেট।’ (কে জানে, এই হয়ত আমাদের পয়লা বলি হবে।)
তারপর সুর পালটে, কি পকেটে পয়সা-টয়সা কিছু আছে?’
খাতা পেন্সিল কেনবার জন্য কয়েক আনা পকেটের তলে পড়ে ছিল। অঙ্কের খাতা ফুরিয়ে গেছে বেশ কদিন। বড় মণিবাবুর গাঁট্টা আর কানমলা খাচ্ছি সমানে। বাবার কাছে বিস্তর দরবার করে তবে আজ কয়েকখানা পয়সা আদায় করেছি। আমার বাবা গোঁড়া রিপাবলিকান। ছেলের লেখাপড়ার পিছনে অন্ প্রিন্সিপল্ গাঁটের পয়সা খরচ করতে চান না। বলেন, এসব স্টেটের দায়িত্ব ৷ স্টেট যদি না দেখে তবে তার সিটিজেন মুখ্খু হয়ে থাকবে, আমার কি?
অবশ্যিই বাবার কিছু না, কারণ বাবাকে বড় মণিবাবুর ক্ল্যাস অ্যাটেন্ড করতে হয় না। আর বড় মণিবাবু কট্টর আঙ্কিক। দুই আর দুই বিয়োগ করলে গোল্লা, যোগ করলে চাব, ভাগ করলে এক, গুণ করলে চার। এর ব্যতিক্রম পাটিগণিতে নেই। অঙ্কের খাতা না থাকলে হোম টাস্ক করা যায় না। হোম্ টাস্ক না দেখালে রেহাই পাওয়া বড় মণিবাবুর চাঁটিগণিতেও নেই। তাই কানের দায়ে তদ্বির করে যে পয়সা আদায় করেছি সে সম্পর্কে অন্যকে ওয়াকিবহাল করতে মন বড়ই বেজার হল। কিন্তু দেলা জিগ্যেস করেছেন, জবাব দেব না, বিপ্লবের এমন খেলাপ আমি নই।
বললুম, ‘আছে কিছু।’
দেব্দা বললেন, ‘গুড, চল, তাহলে তোকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাই।’
দু’জনে থানার সামনেকার দোকানে গেলুম। আমার চোখের উপর দিয়ে একটির পর একটি পয়সা তেলেভাজায় পরিণত হল আর কিছুটা দেব্দার কিছুটা আমার পেটে গিয়ে জায়গা নিলে। মনে করতে চেষ্টা করলুম, ইস্কুল বলে কোনো বস্তুর সঙ্গে কখনো আমার মোলাকাত হয়নি।
আধ ঘণ্টা কাটল। খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে বাইরের বেঞ্চিতে চুপ করে বসে আছি। সামনেই থানার গেট। গেটের ডানপাশে এক ঝাঁকড়া বটবৃক্ষ, তার নিচে জটাই শিবের মন্দির। সন্ধে হয়ে এল। চুপচাপ বসে আছি কেন কে জানে! এই নিশ্চুপ নিশ্চুপ মুহূর্তে এলোমেলো চিন্তাগুলো বাসায় ফেরা কাকের মতো ঝটপট ঝটপট করে যেন এ ও-কে ঠেলে দিয়ে আমার মনে জায়গা নিতে চায়। ভাঙা-ভাঙা কত চিন্তা যে আসে, মিলিয়ে যায় তার ঠিক নেই।
একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলুম, দেব্দা এক কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে সজাগ করিয়ে বললেন, ‘এসে গেছে।’
এদিক-ওদিক চাইছি। দেব্দা বললেন, ‘শিবমন্দিরে।’
দেখলুম এক মোটা বেঁটে আধবয়সী স্ত্রীলোক শিবকে প্রণাম করে একঘটি গঙ্গাজল রেখে বেরিয়ে গেল।
চাপা উত্তেজনায় বললুম, ‘ও কে?’
দেব্দা মৃদু মৃদু হাসলেন। আত্মকৃতিত্বের কড়া পাকে সে হাসি বাঁধা। বললেন, ‘সেই সবুজ লুঙ্গি। খবর রেখে গেল।’
আমাকে কে যেন দু’ হাতে তোল্লা করে হাই শট্ মেরে আকাশে ছুঁড়ে দিলে, সেখান থেকে রিটার্ন শটে আবার মাটিতে ফেললে। সে কী! সবুজ লুঙ্গি ছিল হিলহিলে রোগা, পাকা ছ’ফুট মাথায়। আর এই স্ত্রীলোকটি লম্বায় সাড়ে চারফুট হয় কি না সন্দেহ, কিন্তু সে ঘাটতি আড়ে পুষিয়ে নিয়েছে। দু’হাতেও বেড় পাব না নির্ঘাত। দেব্দা না থাকলে আমার সাধ্যও ছিল না শনাক্ত করি। বলিহারি চোখ, দেব্দার বড় সাফ নিরিখ, এ না হলে বিপ্লবী!
দেব্দা বললেন, ‘হাঁ হয়ে গেলি যে, ব্রিটিশ স্পাইদের এ ক্ষমতার তারিফ করতেই হয়। মেক-আপটা শিখেছিল বটে, তবে টেররিস্টদের মধ্যেও দু-একজন যা আছে না, সে আরও তাজ্জব। চিটাগাং আমারি রেডের এক নেতা, একবার ইওরোপীয়ান লেডির ছদ্মবেশে পালাচ্ছিলেন। ময়মনসিংহের এক পুলিস অফিসার সন্দেহ করে তাকে ধরলে, কিন্তু ভাই সে যা মেক-আপ একখানা করেছিলেন তিনি, ডাক্তারি পরীক্ষাতেও ধরা পড়লেন না। এসব ক্ষমতা বিপ্লবী ছাড়া আর কারো নেই। বসন্দাও দারুণ। মেক-আপ নিতে পারে। এখন বাড়ি যা। শনিবার ছুটির পরে আমার বাড়ি যাস, তোর রক্তমন্ত্রে দীক্ষা হবে
॥ ২ ॥
রক্তমন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। আমার ব্যাপটিজম হল বিপ্লবে। আর কি? বসন্দার দেখা এবারে পাবই। যার সম্পর্কে এক বছর ধরে নানা কথা শুনেও আসছি, সেই বিপ্লবী গুরুর সঙ্গে মুখোমুখি আমার দেখা হবে! শহরে এত ছেলে থাকতে শুধু আমারই সঙ্গে। এত ভাগ্য আমার! আবার দুরু দুরু ভয়ে হৃদয় কাঁপে। কি জানি কবে কি করে ফেলি আর বিপ্লবীর পিস্তলে নরেন গোঁসাই হয়ে যাই। আমার কপাল যে নিপাট ভাল নয় দীক্ষা নেবার দিনই টের পেলুম। নিয়ম হচ্ছে লাল কালিতে লেখা এক প্রতিজ্ঞাপত্রের নিচে আঙুলের রক্তে দস্তখত করতে হয়। প্রতিজ্ঞাপত্রে সই দেবার সময় আর আঙুল থেকে রক্ত বের হল না। কত টেপাটেপি, দেব্দা তো সুচ ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে তাবৎ আঙুল ঝাঁঝরা করে দিলেন। কিন্তু কোথায় রক্ত? গত বছর থেকে ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলুম, সব রক্ত তাতেই সাবাড় হয়ে গেছে। হাল ছেড়ে দেব্দা বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই, আমার ব্লাড প্রেসার, দেদার বাড়তি রক্ত আছে, আয় আমার রক্তেই তোর উজ্জীবন করি।’
তাই হল। তাজা বিপ্লবীর রক্ত দিয়েই গোটা গোটা অক্ষরে নাম লিখে দিলুম। প্রতিজ্ঞাপত্রে কি লেখা ছিল সেটা ইচ্ছে করেই চেপে যাচ্ছি। ও সিক্রেট আউট করবার নয়। বিপ্লবী দাদারা এখনো বেচে। কোন সময় ঝড়াক করে নরেন গোঁসাই করে বসেন, কি জানি!
দীক্ষা চুকলে দেব্দা বললেন, ‘ব্যস্, এবার তুইও পাক্কা রিভলিউশনারি। বি প্রাইড অব দ্যাট্। চল ‘আজ সন্ধেয় বসন্দার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই।’
ইস্টিমারে চড়েছেন? ইঞ্জিনঘর দেখেছেন? হঠাৎ সারেঙ ঘন্টি মারে আর খালাসি কি কল টিপে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে কলঘরে ধকড় ধাই ধকড় ধাই ইঞ্জিন চলতে শুরু করে আর গোটা ইস্টিমারখানা কাঁপতে থাকে থরথর। আমার অবস্থা হল তাই। দেদার মুখে কথাটা শুনেই বুক ইস্টিমারের কলঘর। হয়ে উঠল। বুকের পিটুনি কিছুতেই থামে না। বসন্দাকে দেখব? আজই?
গুটি গুটি দু’জনে বের হলাম। এ-পথ ও-পথ ঘুরে যথারীতি এক বাসার সামনে এসে দাঁড়ালুম। একতলা বাড়ি, অন্ধকার অন্ধকার। উঠোনটা রাস্তা থেকে নিচু। এর আগে বিপ্লবী বলতে এক দেব্দাকেই যা দেখেছি। দেব্দারা ডাকসাইটে জমিদার। বিরাট বাড়ি, বিরাট কম্পাউণ্ড। ভেবেছিলুম এই বোধ হয় বিপ্লবীদের নমুনা। দেব্দারই যদি এই হয় বসন্দার না জানি কত বড়ই বাড়ি হবে। আমাদের শহরে পোদ্দার বাড়িটাই সব থেকে বিরাট। ওরা সবাই আবার কমুনিস্ট। মনে মনে আঁচ করে নিয়েছিলুম বসন্দারটাও ওই কছমের কিছু একটা হবে। কিন্তু দেব্দা যখন ফিসফিস করে বললে, ‘এইটেই বসন্দার বাড়ি’ তখন মনে হতাশার একটা ধাক্কা লাগবে লাগবে, এমন সময় তার চেয়েও একটা বড় ধাক্কা খেলুম। দড়াম করে সদরটা খুলে গেল, আর ‘বাপ’ বলে এক চিৎকার দিয়ে একটা ছেলে হাত ডলতে ডলতে সিধে দিলে দৌড়।
ছেলেটিকে চিনলুম। ন্যাড়া সিংগি। কুস্তির আখড়া আছে। বেজায় গায়ে জোর। তবে সেই বা এখেনে কেন? আর ওভাবে বাপ বাপ বলে পালালই বা কেন? এইমতো ভাবছি, আরেকজন বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত হয়ে দেব্দাকে বলে উঠলেন, ‘দেখলি বসন্দার কাণ্ড। কত কষ্টে ছোঁড়াটাকে ভজালুম, আর দিলে ভাগিয়ে। কুস্তিটুস্তি করে শুনে খুশি হয়ে হ্যাণ্ডশেক্ করতে গেছেন, আর গেছে ছোঁড়াটার হাত ভেঙে। আর কোনদিন ও এ-পথে পা বাড়াবে ভেবেছ?
বুঝলুম আচমকা এই ব্যাপারে দো কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়েছেন। একান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে চাপাস্বরে লোকটাকে কি যেন বললেন। লোকটি জোরে জোরেই জবাব দিলে, ‘রেখে দে তোর নতুন রিক্রুট। ন্যায্য কথা বলতে শর্মা কখনো পেছপা নয়। তোমাদের মতো ভোঁতা বিপ্লবীদের গুজুর গুজুর আমি বরদাস্ত করতে পারিনে। দু-এক জনে কিস্সু করতে পারবে না, ম্যাস্ রিভলিউশন চাই। কাল কলকাতায় যাচ্ছি, পাটি ফর্ম করা যায় কি না দেখে আসি। বসন্দাও পলিসি চেঞ্জ করতে রাজি আছেন। মার্ক্স্ পড় বুঝলি, ফুসুর ফুসুর ছাড়।’
লোকটা কে রে বাবা! বলিহারি বুকের পাটা তো, এক বাঘা বিপ্লবীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পাড়া জানিয়ে কথা কইছে। খেলে বুঝি এক পিস্তলের গুলি। যা ভেবেছি তাই। দো পেট-কোঁচড়ে হাত ঢোকাচ্ছে। যদিও সঠিক জানতুম না, তবু আমার কেমন ধারণা ছিল ওইটেই পিস্তল রাখবার গুপ্ত জায়গা। পাঁচকড়ি দে’র বইতেই বোধ হয় পড়েছিলুম। ভয়ে তক্ষুনি চোখ বুজতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু আর বুজতে হল না। ফাঁড়া কাটল খুব জোর। পিস্তল নয়, দেব্দা পেট চুলকালেন। লোকটি গটগট করে চলে গেল। দেব্দা বললেন, ‘একেপিস্ট’।
দেব্দা আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বসন্দার কাছে দাঁড়ান অত সোজা নয়। কি রে, ঘাবড়ে যাসনি তো !’
সে কথা আর বলতে! তবু মুখে মুখে তেজ দেখিয়ে বললুম, ‘না না।’ কিন্তু দেব্দার আওয়াজে আর আগের মতো রহস্য খুঁজে পেলুম না! কেন জানিনে লোকটার মুখ থেকে ভোঁতা বিপ্লবী কথাটা শোনা ইস্তক অনেক ভয় অনেক দুর্ভাবনা আমার কেটে যাচ্ছিল। সব সময় এরা পিস্তল নিয়ে ঘোরে না, চট করে তা দম্ করে ছুঁড়েও দেয় না, এটা দেখেও আশ্বস্ত হলাম।
বসন্দার সঙ্গে মুখোমুখি হবার জন্য যখন তৈরি হলাম তখন আমি অনেক স্বাভাবিক, দেব্দার দেখান জুজুর ভয় অনেক কেটে গেছে।
আধো-আলো আধো-অন্ধকারে বসন্দাকে দেখলুম। কোনটা বেশি বিরাট, সামনে যে বসে আছে না দেওয়ালে যে ছায়াটা পড়েছে, ঠিক ঠাহর করতে পারলুম না। এই ছোট্ট স্বল্পপরিসর ঘরে তাঁর বিশাল শাল্মলীতরুবৎ চেহারাটা যেন ধরছিল না, এ যেন চায়ের পিরিচে রাখা রোস্ট করা এক রাজহাঁস।
ফিসফিস করে কার সঙ্গে কথা কইছিলেন। আমি থরথর করে কাঁপছিলুম। দরজার বাইরে খোলামেলায় যে ভয়টা হাতছাড়া হয়েছিল, এই রহস্যময় আলো-আঁধারের পুরীতে তা আবার ঘাড়ে চেপে বসল।
সমস্ত ঘরে একটামাত্র আলো। আলোটা বসন্দার মুখের কাছে। দেব্দা আলোর কাছে গিয়ে ঠোঁট নেড়ে কি যেন বললেন বসন্দা ফিসফিস করে কি জবাব দিলেন। দো আমায় ডাকলেন, ‘এগিয়ে এস, বসন্দা তোমায় ডাকছেন।
উত্তেজনায় আমি তখন ফেটে পড়ছি। নিজের উপর কোন শাসন আমার আর তখন নেই। আমি তখন বনবন করে ঘুরপাক খাচ্ছি। লাট্টু বনে গেছি। দেব্দার হাতে লেত্তি, আমাকে ইচ্ছেমতো ঘোরাচ্ছে।
বসন্দার কাছে এগিয়ে গেলুম। বললেন, ‘বোস’। গলার স্বর চাপা অথচ কর্কশ। তারপর আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, গর্দান ধরে, গুলো টিপে খানিকক্ষণ দেখলেন, খাসি পাঁটা কেনবার আগে যে কায়দায় দেখে নেয়। তারপর একটু যেন মনঃক্ষুণ্ণতা, একটু যেন করুণা মিশিয়ে নিলেন গলার স্বরে।
রায় দিলেন, ‘বড়ই নরম। বিপ্লব দেখবি এই হাত দ্যাখ।’ পদ্মপাতার মতো এক গব্দা ঢেলে আমার সামনে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘রাখ, হাত রাখ।’
হাতের মায়া ছেড়ে দিলুম। চোখের সামনে কুস্তিগির ন্যাড়ার যন্ত্রণাকাতর পলায়নপর চেহারাটা ভেসে উঠল। আলগোছে হাতখানা বসন্দার হাতে চিরদিনের মতো উইল করে দিলুম।
বসন্দা হেসে বললেন, ‘উহু, টেপ, টিপে দ্যাখ।’
হাতখানা ওঁর হাতের উপর দিয়ে একবার শুধু টেনে নিয়ে গেলুম। নতুন ছাদের মতো তাতে ধার। বসন্দা হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বিপ্লব করবি, শরীরটা এমনি কর।’ বলেই বসন্দা উঠে পড়লেন। দরজার পাশ থেকে দরজায় লাগাবার মোটা একটা শালকাঠের খিল তুলে আনলেন। এক হাতে তার এক কোনা ধরে আরেক হাতের এক কিল মেরে মড়াৎ করে সেখান ভেঙে ফেলে বললেন, ‘কি রে, পারবি বিপ্লব করতে!’ বলেই আবার দমকে দমকে হাসি। আমার আমপিত্তি ওখেনেই জমে গেল। কথা আর বলব কি?
॥ ৩ ॥
সেই থেকে আমি বসন্দার চেলা। নিজে হাতে ধরে ধরে আমাকে কাজ শিখিয়েছেন। কি করে যে তাঁর নেকনজরে পড়লুম তা জানিনে, তবে সেই নেকনজরের ধাক্কা সামাল দিয়েও যে টিঁকে আছি তা সেরেফ পাকা গাঁথুনির জোরে।
তবে একটা জিনিসের আর আস্বাদ পেলুম না। সেই মসার পিস্তল দুটোর। না সে দুটোর গায়ে হাত ঠেকালুম, না একটিবার চাক্ষুষ করলুম। আমিও চেলা বনলুম আর দাদারাও আণ্ডারগ্রাউণ্ড থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সেই লোকটিরই জয় হল। কলকাতা থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করবার এক দল বানালে। বসন্দা প্রেসিডেন্ট, তিনি সেক্রেটারি, দেব্দা টেব্দা সব এক্জিকূটিব আর আমরা অর্ডিনারি মেম্বর। ওঁরা হুকুম করবেন আর আমরা ‘জী কমরেড’ বলে তক্ষুনি তামিল করব—এ আইনটা এখনো রয়ে গেল। মাথা খাটাবার দায়টা দাদাদের হাতে বন্ধক দিয়ে প্রেমসে পলিটিক্সে নামলুম।
হুকুম হল ‘মাস কন্টাক্টের’ মানে জনসংযোগের। বসন্দা নিজেই নেতৃত্ব নিলেন। দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে লাগলুম। কিন্তু তারা কাজের লোক। শহরের বাবুদের কথা শোনবার মতো ফাল্তু সময় তাদের কোথায়? খুব মুশকিল। লোক না জুটলে বক্তৃতা হবে কি করে?
বসন্দা বললেন, ‘এভাবে হবে না। কুচকাওয়াজ করে যেতে হবে।’
ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়ে গেল। একটা বিউগল্, একটা কিট্ল্ ড্রাম যোগাড় হল। লাল শালু কেটে বড় পতাকা তৈরি হল। তারপর শুরু হল গ্রাম-অভিযান। শহরের সীমানার বাইরে গিয়েই বসন্দা কমাণ্ডার বনে যেতেন। তিনি একটা মোটা লাঠি হাতে সব্বার আগে, তারপর পতাকাবাহী। দেব্দা, তারপর সেক্রেটারি শিবুদা, তারপর আরো কারা কারা, তারপর বিউগ্ল্ হাতে একজন, আর সব্বার শেষে ড্রাম ঘাড়ে আমি।
দৃশ্যটা চোখ বুজলে এখনো ভেসে ওঠে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, আমরা লম্বা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বসন্দা হুকুম দিলেন, ‘বাদ্য’। অমনি ভোঁপ্পো ভোঁপ্পো বিউগল আর কুড়ু কুড়ু কুড়ু ড্রাম বেজে উঠল। আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠলুম। ফের বসন্দার হুকুম হল, ‘মার্চ, লেফ্ট রাইট্ লেফ্ট্।’ কদমে কদমে এগিয়ে যেতে লাগলুম। একটু এদিক-ওদিক হবার জো ছিল না। কে জানে, ওই মোটা লাঠি কার পিঠে টিপ করে পড়বে। মার্চ করা দেখে বসন্দা খুব খুশি। এবার তাঁর শেষ হুকুম, ‘সঙ্গীত’। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ‘মার্চিং সঙ’ গাইতে শুরু করলুম, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে (লেফ্ট রাইট্ লেফ্ট্, পা মিলিয়ে নেওয়াও হচ্ছে) মন্দ মধুর হাওয়া।’
একদিন পড়ন্ত বিকেলে মাঠের মধ্য দিয়ে সবাই চলেছি অপূর্ব কোরাসে ‘মার্চিং সঙ’খানা গাইতে গাইতে। মনের পুলক দু-পাখা মেলে উড়ে চলেছিল, ধীরে ধীরে সে পাখা গুটিয়ে আনতে লাগল। কি ব্যাপার? সামনে পড়েছে একপাল মহিষ। ইয়া তাগড়াই তাগড়াই শিঙ। দু-একটা আবার সন্দেহজনকভাবে চেয়ে চেয়ে দেখছেও। বসন্দার কি? কানেও শোনেন না, চোখেও ভাল দেখেন না, তিনি তো গট্গটিয়ে ওদের মধ্য দিয়েই দিব্যি পথ করে বেরিয়ে গেলেন। এখন আমরা? কখন না জানি দেব্দা লাল ফ্ল্যাগ গুটিয়ে পকেটে ফেলেছে। লাল দেখলেই মহিষের রাগ খামাকা চড়ে যায়। দেব্দা তো সেফ্সাইডে দাঁড়াবার বন্দোবস্ত করলেন। এখন আমি? আমার ড্রামের পেটটাও তো টকটকে লাল, ওটা তো আর ভাঁজ করে পকেটে পোরা যাবে না। এখন তার উপায় কি? মনের জাঁতায় এসব ভাবনা পিষছি। ওদিকে দাদাদের শলাপরামর্শ জোর চলেছে এগুনো উচিত কি না। আমাদের শিব্দা ছিলেন মোষোলজিস্ট, একবার দুধের ব্যবসা করেছিলেন কিছুদিন, তাইতে তিনি নাকি মহিষদের সাইকোলজি বিলক্ষণ স্টাডি করেছেন। তিনি আমায় বললেন, ‘দু পা এগিয়ে বেশ ঠাহর করে দ্যাখ দিকিনি মোষটা কোন্ চোখ দিয়ে চাইছে? যদি ডান চোখ, তো সেফ্, কোনো ভয় নেই। যদি বাঁ চোখ হয় তবেই মুশকিল।’
মহিষদের ডান-বাঁ ঠিক করা বড় গোলমেলে, হাত নেই কিনা। কিন্তু সে কথা খোলসা করে বলব, দাদাদের এমন তালিম পাইনি। অর্ডার ইজ অর্ডার। প্রাণটাকে আরেকজনের কাছে জিম্মা রেখে দু কদম এগিয়েছি এমন সময় হুঁ-উ-উ-স্। বাপ্রে কি গজরানি। পিছু ফিরে দেখি সেরেফ ফাঁকা ময়দান। জনপ্রাণী যে কোনদিন সে-পথে হেঁটেছিল তার কোনো প্রমাণই নেই। চোখ বুজে দিলুম একদিকে দৌড়। কিন্তু মহিষের সঙ্গে পারব কেন? বাঁদিকে দেখলুম একটা গর্ত মতন, পা দুটো সেদিকে বাড়িয়েছি কি, গর্তের ভেতর থেকে কে গর্জন করে উঠলে, ‘এদিকে নয় স্টুপিড্, একার জন্য সবাই মরবে দেখছি ; অন্যধারে যাও।’ বিনা বাক্যে তাই করলুম। তখন আমার এমন অবস্থা যে মহিষটা যদি বলত, ‘দাঁড়াও বাছা, তোমার পেটে একটা ঢুঁ মারব, আর ছুটতে পারছি নে’ তো নিশ্চয়ই তাই করতুম।
হঠাৎ দেখি বসন্দা। বাঘের মতো লাফিয়ে পড়লেন আমার আর মহিষটার মাঝখানে। তারপর চকিতে দুটো দৃশ্য দেখলুম, বসন্দার হাতের চিরসঙ্গী মোটা লাঠিটি উঠল আর তারপর মহিষটা মুখ গুঁজে সেই মাঠে গড়িয়ে পড়ল।
আমি তখন থরথর করে কাঁপছি। বসন্দা এগিয়ে এসে পিঠের উপর খসখসে হাতটা রাখতেই ড্রামসুদ্ধ তাঁকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলুম। হেসে বললেন, ‘ভয় পেয়েছিস? তুই না বিপ্লবী?’ সেই দুটি কথায় ভয় কোথায় পালালে, মুহূর্ত পরেই দু পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ালুম।
দাদারা একে একে এলেন। দেব্দা বললেন, ‘তোর এখনো নার্ভ শক্ত হয়নি। সহজেই পাজ্ল্ হয়ে যাস।’
পার্টি বেড়ে উঠল। দেব্দা, শিব্দা আর বসন্দা ‘হোল টাইম ওয়ার্কার’ হয়ে গেলেন। দেব্দার জমিদারি আছে, শিব্দার ট্যুইশানি। তাঁদের তত ভাবনা নেই। বসন্দা কখনো এখানে খান কখনো ওখানে। আমাদের শহর থেকে মাইল আষ্টেক দূরে সরে বসন্দার এক দাদা ছিলেন, উকিল, অন্য কোথাও খাওয়া না জুটলে সেখানে গিয়েই খেতেন। একদিন গল্পগুজব করছি, জ্যৈষ্ঠ মাসের দিন, বারোটা বেজে গেছে। বসন্দা বললেন, ‘গোরে, দ্যাখ্ তো তোর বাপ ফিরেছে নাকি? ফিরে থাকলে চট করে সাইকেলটা নিয়ে আসবি।’ বাড়ি গেলুম। সাইকেলটা বসন্দার হাতে এনে দিতেই বললেন, ‘এই আসছি, খেয়ে আসি, তোর বাপ ঘুম থেকে ওঠবার আগেই এনে দেব সাইকেল।’
বসন্দা সেই যে গেলেন, সন্ধে গড়িয়ে গেল, তবু ফিরলেন না। বাবা ডাক্তার। গ্রামেই তাঁর রোগী। সাইকেল ছাড়া একদণ্ডও তাঁর চলে না। সেদিন সাইকেল না পেয়ে রেগে কাঁই। বাবার অনেকদিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল, আমি খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছি, সেদিন তিনি একেবারে নিঃসন্দেহ হলেন। ভাবলেন হয়ত, তাঁর সাইকেল বেচে আমি বদকর্ম করেছি। বেধড়ক ঠ্যাঙানি দিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। চরিত্রশুদ্ধির এর থেকে বড় দাওয়াই আমাদের বাপেদের আয়ুর্বেদশাস্ত্রে আর কিছু নেই। আমার জ্বর এল কাঁপিয়ে। অনেক রাত্রে চারিদিক যখন থমথমে তখন আমার সমস্ত আচ্ছন্নতা ভেদ করে সাইকেলের ঘণ্টি বেজে উঠল। তারপর দরজায় পড়ল চিরপরিচিত টোকা। যে টোকা শুনে রাত্রে ঘর ছেড়ে কতদিন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছি বসন্দার সঙ্গে। রেল লাইন ধরে ধরে মাইলের পর মাইল নিঃশব্দে হেঁটেছি। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কোন প্রশ্ন কখনো করিনি। করলেও জবাব পেতুম না। বসন্দার সেই এক হুকুম, ‘চ, ওয়ার্ক করে আসি।’ শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, জল নেই, রোদ নেই, সেই একই কথা, ‘চ, ওয়ার্ক করে আসি।’ জানি, কোনো ওয়ার্কই হবে না, একটি লোকের সঙ্গে দেখা হবে না, কারো সঙ্গে একটি কথা হবে না, শুধু মাইলের পর মাইল হাঁটা, শুধু হয়রানি। তবু সেই ফ্যাসফেসে চাপা কর্কশ গলার অমোঘ আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করবার সাধ্য ছিল না।
হয়ত ইস্কুল থেকে বেরুচ্ছি, গেটের বাইরে দেখি বসন্দা। বুঝলুম বারটা বেজে গেল। নিয়তির মতো বসন্দার হাতে সঁপে দিলুম নিজেকে। বললেন, ‘গোরে, চ দিকি শান্তিপুর, একটা কন্টাক্ট করে আসি।’
মিনমিন করে বললুম, ‘একবার বাড়ি গেলে হত না, বই-টইগুলো রাখতুম, একটু জল-টল মুখে দিয়ে—’
বসন্দার দিকে চাইলুম। শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘বেশ, তবে এখন গেলে ট্রেনে করে যেতে পারতিস, তা না হয় হেঁটেই যাব’খন।’
শান্তিপুর বোল আঠারো মাইল, হাঁটতে হলেই হয়েছে। খাওয়া মাথায় উঠল। বললুম, ‘চলুন, আবার ট্রেন ফেল না করি।’ প্রাণের দায় বড় দায়।
শান্তিপুর পৌঁছলাম যখন, তখন সন্ধে। খেয়া ট্রেন সব ‘ফিরি’তে এসেছি। বসন্দার সব কিছুতেই ‘ফিরি পাস’। সঙ্গে থাকলে আমারও। স্টেশন থেকে শহর মাইল দেড়েক। হাঁটতে শুরু করলুম।
বসন্দা জিগ্যেস করলেন, ‘কি রে, খুব ক্ষিধে পেয়েছে?’
আমার মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠে গেল। সেই ন’টা সাড়ে ন’টায় দুটো নাকে-মুখে গুজে ইস্কুলে গিয়েছি। সারাদিন মাস্টারমশাইদের শারীরিক শক্তির পরীক্ষা নিয়ে এমনিতেই নেতিয়ে পড়ার অবস্থা, তার উপরে বসন্দার পাল্লায়। বাড়ির পাওনা তো আর মনে করতেই সাহস হচ্ছিল না।
জবাব দিলুম না। দিলেও শুনতে পেতেন না। যৌবনকালে জেলে জেলে কাটিয়েছেন। অকথ্য অত্যাচার তাঁর উপরে হয়েছে। ফলে চোখের জ্যোতি নিষ্প্রভ হয়েছে, আর বধিরতা কানের মধ্যে পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে। মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে হত। ঠোঁটের কম্পন দেখে কথা বুঝে নিতেন।
আমার সঙ্গে বসন্দার যখন ঘনিষ্ঠতা তখন তাঁর পঞ্চাশের উপর বয়েস। তবু কি স্বাস্থ্য, কি আসুরিক শক্তি! বসন্দার চেহারা যখনই মনে পড়ে, দেখতে পাই তাঁর সেই ঋজু দীর্ঘ দেহ, তাঁর মতোই মজবুত এক লাঠি হাতে, আর গায়ে রঙ-ওঠা এক গেরুয়া পাঞ্জাবি হাঁটু অবধি ঝোলা। সেই পাঞ্জাবির পকেট দুটো স্পেশাল ফরমায়েসে তৈরি। কোমর থেকে শুরু করে হাঁটু-বরাবর ছিল সে পকেট দুটোর খোল। ডবল বেডের তোশকটা শুধু ঢুকত না, তা ছাড়া আর সমুদয় দ্রব্যই সেখানে এঁটে যেত।
বসন্দা সেই পকেট হাতড়ে একখণ্ড হকি বের করে বললেন, ‘খা। তেস্টা পাবে না।’
তাই মুখে পুরলুম। ওটা না পেলে রাস্তার খোয়া তুলেই চুষতুম আমার এমন অবস্থা তখন।
বসন্দা বললেন, ‘লোকটা ভাল। খুব খাওয়াবে দেখিস।’
সেই আশাটুকুই প্রাণে জল এনে দিলে। তখন অন্ধকার ঘোর হয়েছে। হাঁটছি তো হাঁটছিই। শান্তিপুরে এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া বেশ দূর দূর। বারকয়েক ঘোরাঘুরি করলুম। বসন্দার মুখে কোনো কথা নেই। মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বেশ করে দেখেন, তারপর জিগ্যেস করেন, ‘গোরে, দ্যাখতো, এই বাড়িটা কি না?’ এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ! জীবনে এই প্রথম এলাম এখানে। কার বাড়িতে এসেছি তাও জানিনে। আমি কি করে বলব? এবার সত্যি সত্যি রাগ হতে লাগল। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে গিয়ে বসন্দা বললেন, ‘পেয়েছি।’
তারপরেই ডাক দিলেন, মানে হাঁক দিলেন, ‘নিবারণ বাড়ি আছ? নিবারণ!’ কেউ সাড়া দেয় না। বসন্দা বারকতক হাঁকাহাঁকি করে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘গোরে, একটু এগিয়ে দ্যাখ না।’ দরজার কাছে গিয়ে শিকল নেড়ে ডাক দিলুম, ‘নিবারণবাবু?’
এক ছোট্ট খুকি বেরিয়ে এল। জিগ্যেস করলুম, ‘নিবারণবাবু তোমার কে হন?’
বললে, ‘দাদু।’
বললুম, ‘যাও, তাঁকে পাঠিয়ে দাও।’
খুকি চলে গেল। খানিক বাদে বেরিয়ে এল এক বছর সতেরোর ছেলে।
জিগ্যেস করলে, ‘কাকে চাই?’
বললুম, ‘নিবারণবাবুকে, বলুন বসন্দা এসেছেন।’
ছেলেটি একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাইলে। তারপর বললে, ‘বাবা তো মারা গেছেন।’
যেন এক আছাড় খেলুম। বললুম, ‘সে কী! কবে?’
ছেলেটি অবাক হয়ে বললে, ‘জানেন না! সে তো বছর আষ্টেক হবে।’
লজ্জায় মরে যাই। ছেলেটির দিকে আর চাইতে পারলুম না। হনহন করে ঘাড় গুজে এগিয়ে চললুম। বসন্দা ‘কি রে, এই গোরে, কি বললে?’ বলতে বলতে আমার পিছনে আসতে লাগলেন।
রাস্তার একটা আলোর কাছে এগিয়ে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে বললুম, ‘মারা গেছেন নিবারণবাবু।’
বসন্দা হঠাৎ দেখি নিবারণবাবুর উপর খাপ্পা হয়ে গেলেন। রাগে গরগর করে উঠলেন, ‘মরে গেল! তা আমাকে একবার বললে না। রি-অ্যাক্শনারি কোথাকার। চ ফিরে যাই, এখানে জলস্পর্শ করব না বরং আয় জলত্যাগ করে যাই।’
বলেই রাস্তার পাশে বসে গেলেন।
স্টেশনে এসে শুনি শেষ ট্রেন ঘণ্টাখানেক আগে চলে গেছে। এবার সারারাত ধরে আঙুল চোষো আর মশা মারা। পরদিন পরীক্ষা। তা হয়ে গেল। বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছি, বাস্, জন্মের মতো বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকল। ক্ষিধে, দুশ্চিন্তা আর মশার যুগপৎ আক্রমণের মুখে আমি তখন অভিমন্যু। শেষ ঘা দিলেন বসন্দা।
বললেন, ‘চ, গোয়াড়ী যাই। এই তো কাছেই, ঘণ্টাখানেক লাগবে বড় জোর।’
কার মুখ দেখে আজ সকালে উঠেছিলুম রে! উপায় নেই। সেই অন্ধকাবেই হাঁটা দিলুম। কিছুদূর হাঁটতেই মনে হল এই অন্ধকারে ভুল করে আর কারো পা পরে বেরিয়ে এসেছি। নইলে এত ভারী পা আমার হয় কি করে? হাঁটছি তো হাঁটছিই। হঠাৎ পেটের মধ্যে এক জোর মোচড় মারল, সমস্ত দুনিয়া উপর-নিচ হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে মুখ গুঁজে পথের উপর পড়ে গেলুম। কোন এক তমিস্রার মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলুম ডুবতে ডুবতে মনে হল, ডুবছি না তো, হাওয়ায় ভাসছি, হাওয়া কেটে উড়ে চলেছি।
চোখ মেলতে দেখি স্বপ্ন নয়, সত্যিই শূন্য দিয়ে চলেছি। নড়তে-চড়তেই বসন্দা কাঁধ থেকে নামালেন। সস্নেহে বললেন, ‘ওই দ্যাখ্ গোয়াড়ীর আলো। চ, ওখানে আমরা খেয়ে নেব’খন। কি, এটুকু হাঁটতে পারবি?’ ছয় মাইল পথ বসন্দার কাঁধে কাঁধে পার হলাম! বিস্ময়ে বাক সরল না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গোয়াড়ী পৌঁছলাম। এক হোটেলে ধারে খেয়ে বাড়িমুখো রওনা যখন দিলুম, তখন রাত একটা। আর হেঁটে নয়, সেদিক পানে মালবোঝাই গরুর গাড়ি যাচ্ছিল একসাব। তারই একটায় দু’জনে উঠে শুয়ে পড়লুম।
আমার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে সস্নেহে বসন্দা বললেন, ‘খুব কষ্ট হয়েছে, না রে?’
সেই স্নেহকরস্পর্শে সমস্ত বেদনা, সব কষ্ট উপে গিয়ে দুটি বিন্দু অশ্রুর অর্ঘ নিঃশব্দে আমার চক্ষু বেয়ে বসন্দার উদ্দেশে ঝরে পড়ল।
বসন্দার সেই খসখসে চাপা কর্কশ স্বর অন্ধকারে গরুর গাড়ির ক্যাঁচক্যাঁচানিকে দু’হাতে সরিয়ে বেজে উঠল।
বললেন, ‘এমন করেই তো শক্ত হয়ে উঠবি। শক্ত না হলে বিপ্লব করবি কি করে? বালির বস্তা কাঁধে করে কাদার মধ্য দিয়ে আমাদের ছুটতে হত।
বসন্দার কাছে বিপ্লব মানে গায়ের জোরের প্রদর্শনী। হাল রাজনীতিতে তার স্থান কোথায়? প্রকাশ্য রাজনীতিতে বিপ্লবের অর্থ অন্য। গণ-আন্দোলন চাই। জনসাধারণ জাগ্রত হলে ওদের দিয়ে বিপ্লব করাতে হবে। হাতের জোরের স্থান নেই, এখানে শুধু মুখের জোর। গরম গরম বক্তৃতায় লোককে চাগিয়ে তুলতে হবে। এই পার্টিতে বসার জায়গা কই? যে বসন্দা হাতে ধরে ধরে এক একজনকে রিক্রুট করেছেন, আজ তারাই প্রধান, বসন্দা একপাশে। আজকের পার্টিতে বসন্দার মূল্য ছেড়া মাদুরের মতো।
বসন্দা এখনো প্রেসিডেন্ট। তবে শুধু নামে। দেব্দাই সর্বেসর্বা। কারণ দেব্দা খুব সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারেন। সে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনলে রোমাঞ্চ হয়, রক্তে বলক্ কাটতে থাকে, উন্মাদনা! সর্বশরীরে ভুরভুর করতে থাকে। যেমনটি হত অনেক অনেকদিন আগে, যখন সবাই শহরের বাইরে গিয়ে লাইন বেঁধে দাঁড়াতুম বসন্দার নেতৃত্বে, একটার পর একটা কড়া কর্কশ কণ্ঠের হুকুম শুনতুম, ‘বাদ্য। মার্চ, লেফ্ট রাইট লেফ্ট। সঙ্গীত।
সে রাজনীতি, এ রাজনীতি নয়। সেদিনের বীরত্ব আজ বোকামো। এখন ‘স্ট্রেংথ’ নয় ‘ট্যাক্ট’। শুধু বুদ্ধির অসৎ প্যাঁচ আর কুটিল কৌশল। পথ যাই হোক উদ্দেশ্য সিদ্ধিই চরম কাম্য।
এখান থেকে বসন্দা হটে যেতে বাধ্য, গেলেনও। এ তার ভাল লাগে না। পার্টি এক্জিকুটিভে শিব্দা প্রস্তাব আনলেন, বসন্দাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। দেব্দা দেখলেন শিব্দার মতলব খারাপ। বসন্দার পর শিব্দাই সিনিয়ার, তাঁরই প্রেসিডেন্ট হবার তাক।
দেব্দা বললেন, ‘থাক না বুড়োটা। ওর নামে তবু কিছু ছেলে জুটছে। বাদ তো যখন-তখন দিলেই হল।
কথাটা কি করে বসন্দার কানে গেল। তিনি দিনকয়েক গুম মেরে রইলেন।
একদিন অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। জেগেই বুঝলুম বসন্দা। সেই চাপা স্বরে ডাক, ‘গোরে।’
উঠলুম। দরজা খুলতেই বসন্দা বললেন, ‘জামা গায়ে দিয়ে আয়। কথা আছে।’
গঙ্গার ধারে এসে বসলুম। সেদিন পূর্ণিমা। রাত গড়িয়ে এসেছে। হাওয়া উঠেছে। মনে পড়ল অনেকদিন আগে এমনি গভীর রাতে গরুর গাড়িতে চড়ে বসন্দার সঙ্গে আসছিলুম।
বসন্দা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। কি একটা বলি-বলি করছেন। কিন্তু দুরন্ত এক চাপা অভিমান তা কিছুতেই প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর শেষে বললেন, ‘আমাকে এরা তাড়াতে চাইছে, শুনেছিস? বলেছে নাকি আমি কোন কাজের নয়। বক্তৃতা দিতে পারিনে কিনা, তাই কোন কাজের নয় বলে দিলে। শিবে এসে দেবার কথা লাগিয়ে গেল, আবার দেবা এসে শিবের কথা লাগালে। এই তো ওদের কাজ। অথচ ওই দুটোকেই আমি হাতে করে মানুষ করেছি। সে যাক, কিন্তু আমি বক্তৃতা দেব ঠিক করেছি। ওরা ভাবে আমি তা পারিনে। কিন্তু আমি পারি। পুলিসের গুলি খেয়ে পদ্মা সাঁতরে পার হয়েছি। এই দ্যাখ সে গুলির দাগ।’
বসন্দার সে কী উত্তেজনা! পড়পড় করে কাঁধের জামা ছিড়ে বুলেটের দাগ দেখালেন।
‘উরোতে গুলি খেয়েও পাঁচিল টপকে জেল পালিয়েছি, এই দ্যাখ্, সেই দাগ।’
একটানে কাপড় খুলে কুঁচকির পাশে চোটের চিহ্ন দেখালেন।
‘গোড়ালিতে এই দাগ দ্যাখ। দু’দিন হেঁটমুণ্ডে ঝুলিয়ে রেখেছিল। একটা কথা মুখ দিয়ে বের করে নিতে পারেনি। কটা চ্যাংড়া নাবালক আজ আমাকে বলে, কোনো কাজের নই। বক্তৃতাই যদি কাজ হয় বক্তৃতাই দেব।’
বসন্দাকে এত উত্তেজিত আর কখনো দেখিনি। বসন্দার এই রূপও আর কখনো দেখিনি। এ বসন্দা দৈনন্দিনের নন, খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, সেই পুরনো যুগের বসন্দা। লোকের মুখে মুখে উপকথার ঘোড়া দাবড়িয়ে যিনি ফেরেন, সেই বসন্দা।
বসন্দা আবার ঝিম মেরে রইলেন। তারপর অভ্যস্ত মৃদু শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তুই আমাকে গোটাকতক কথার মানে বলে দে দিকি। ওরা কথায় কথায় যেগুলো বক্তৃতায় লাগায়। রুশ, ম্যাস্, লেলিন, বল তো এগুলো কি? এরা কারা?’
সেই রাতে গঙ্গার চড়ায় বসে বসে বসন্দাকে আধুনিক রাজনীতির বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো কণ্ঠস্থ করিয়ে দিলুম।
এই প্রথম আমাদের পার্টির ‘স্ট্রেংথ মোবিলাইজ’ করা হবে প্রকাশ্যে। শহরের কেন্দ্রস্থলে বিরাট জনসমাবেশ হবে। ‘মে দিবসে’র জনসভা। আমি ছিলুম পার্টির ‘পোস্টার ইনচার্জ’। শহর পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে দিয়েছি। খুশি হয়ে পার্টি একজিকুটিভ আমাকে ‘অডার অব পপাস্টার’-এ ভূষিত করলে। আমার প্রমোশন হল। এবার হলুম ‘স্লোগান ইনচার্জ’। জিগিরের পয়লা আওয়াজ আমার, তারপর অন্য সবাই।
কারা যেন সমানে আমাদের পোস্টার ছিড়ে দিচ্ছে। অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে আমরা ঘায়েল হয়ে পড়লুম। পার্টি এক্জিকুটিভ দেব্দাকে সব পাওয়ার দিয়ে দিলে। জেনারেলিশিমো দেব্দা ‘মাশাল ল’ জারি করে দিলেন। প্রত্যেকটি সভ্য এক-একটা নির্দিষ্ট এলাকায় চব্বিশ ঘণ্টা পোস্টার পাহারা দেবে। দেব্দা নিজে ঘুরে ঘুরে তদারক করবেন। শহরের কেন্দ্রস্থলের পাহারা দেবার ভার পড়ল বসন্দার উপর।
যেদিন সভা তার আগের দিন বিকালে দেব্দা এসে ফেটে পড়লেন পার্টি অফিসে। শোনা গেল বসন্দা ট্রেচারি করেছেন। কি ব্যাপার? না বসন্দাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে মিটিং-এর জায়গার পোস্টার ফেস্টুন সব ছেঁড়া। এ লোকের কড়া শাস্তি দরকার। রাশিয়া হলে এ অপরাধে চরমদণ্ডই দেওয়া হত। সেটা পারা গেল না রাজ্যটা তখনো ইম্পিরিয়ালিস্টদের কব্জায় বলে। তবে এটা স্থির হল, এখন চুপচাপ থাকো, মিটিংটা চুকে যাক, তারপর অতর্কিতে একদিন জেনারেল মিটিং ডেকে বসন্দাকে দাও তাড়িয়ে।
কিন্তু বসন্দা গেলেন কোথায়? হঠাৎ আমার খেয়াল হল বাড়িতে নেই তো? ছুটলুম সেখানে। যা ভেবেছি তাই, বসন্দা ঘরে দরজা দিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অনেক কষ্টে দরজায় ধাক্কা মেরে বসন্দাকে বের করে আনলুম।
শিশুর মতো একগাল হেসে বললেন, ‘প্রায় হয়ে এসেছে, বুঝলি। কাল দেখবি, একেবারে ফাটিয়ে দেবো।’
বললুম, ‘এদিকে যে দফা শেষ। আপনার এলাকায় পোস্টার ফেস্টুন একটাও নেই, সব ছিঁড়ে দিয়েছে।’
বসন্দা গর্জন করে উঠলেন, ‘কে ছিড়েছে?’
বললুম, ‘তা কি জানি?’
বসন্দা বললেন, ‘তুই যা, আমি দেখছি।’
বসন্দা বেরিয়ে গেলেন। আমিও পার্টি অফিসে এসে বসলুম। ঘণ্টাখানেক বাদে দেখি কম্যুনিস্ট বলাই কুণ্ডু হন্তদন্ত হয়ে আসছে। মোটাসোটা মানুষটি এককালে বসন্দার শাগরেদ ছিলেন। কম্যুনিস্ট হওয়া ইস্তক ওর উপর তাঁর বেজায় আক্রোশ।
বলাই কুণ্ডু বললেন, হ্যাঁ ভাই, আমি তোমাদের পোস্টার কেন ছিঁড়ব?’
আমরা তো অবাক।
‘সে কথা কে বললে?’
বলাই কুণ্ডু বললেন, ‘বসন্দা। আমাকে বাজারে চেপে ধরে বললেন, তোরা কি ভেবেছিস আমি মরে গেছি। আমার পার্টির পোস্টার ছিঁড়িস, তোর এত বড় বুকের পাটা। এক আফশানে আলুর দম করে দেব জানিস। বল দিকি ভাই, পাঁচজনের সামনে কি অপমান!’
‘না না সে কী কথা। ছি ছি। বসন্দা ভুল করেছেন—’
বলতে না বলতেই বসন্দা হাজির। অফিসে ঢুকেই বললেন, ‘সব ঠিক করে দিয়েছি।’
দেব্দা বললেন, ‘আপনি বলাইদাকে খামাকা বকেছেন কেন? উনি তো ছেড়েননি পোস্টার।’
বলাই কুণ্ডুও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি ছিড়তে যাব কেন?’
বসন্দার নজর এতক্ষণে তাঁর উপর পড়ল। বললেন, ‘বলছিস তুই ছিঁড়িসনি!’
বলাই কুণ্ডু বললেন, ‘এই আপনার গা ছুঁয়ে বলতে পারি।’
বসন্দা কিছুক্ষণ গুম মেরে রইলেন। তারপর বললেন, ‘বেশ কথা। তবে তুই বসে বসে আমাদের পোস্টার পাহারা দে। যদি একটাও কেউ ছেঁড়ে তো আমি তোকে ছিঁড়ব।’ তারপর দেব্দাকে বললেন, ‘কাল আমিও বক্তৃতা দেব। এখন যাচ্ছি।’
॥ ৪ ॥
ওরা অনেক চেষ্টা করেও বসন্দাকে থামাতে পারলেন না! তাই ঠিক হল বসন্দাকে সভাপতির আসন দেওয়া হবে। তারপর যা বক্তব্য দেন্দা শিব্দা সব বলে যাবেন। সবার শেষে উঠে সভাপতির বক্তৃতায় বসন্দা যা খুশি তাই করুন।
সভায় লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। দেদা বললেনও বটে! ভাবের আবেগে অতগুলো লোককে কখনো উত্তেজিত, কখনো শান্ত করে, কখনো রাগিয়ে, কখনো হাসিয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ হল। হাততালিতে কান ফেটে গেল আমাদের। ওর পর ভাল জমবে না বলে শিব্দা নমো নমো করে গোটাকতক প্রস্তাব পেশ করেই ছেড়ে দিলে।
সব শেষে বসন্দা উঠলেন। দেখলুম তাঁর মুখ শুকনো, থরথর করে সর্ব দেহ কাঁপছে। দেখলুম কথা বলতে চেষ্টা করছেন, আওয়াজ বেরুচ্ছে না। একটা গোটা মিনিট যে অতক্ষণ সময়, তা আগে জানতুম না। যে সভা এতক্ষণ নিরেট সময়ের মতো স্তব্ধ ছিল, সুঁচ পড়লে আওয়াজ শোনা যেত, সে সভায় গুঞ্জন শুরু হল। অবশেষে দেখলুম বসন্দা সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। কী কর্কশ আওয়াজ!
‘কমরেস, বন্ধুগণ·····রুশ বলে এক দেশ আছে, সেখানে যত অত্যাচারিত নিপীড়িত নির্যাতিত শোষিত জনগণ ম্যাস্ যত কৃষক যত মজুর তারা সব·····তারা সব একত্র হয়ে সে যাক্·····কমরেস্, আজ আমাদের এই দুর্দিনে যখন খেতে পাইনে পরতে পাইনে তখন যত অত্যাচারী শোষণকারী নিপীড়নকারী পুঁজিপতি তারা সব সে যাক·····কমরেস, মহামতি লেলিন রুশদেশে এক প্রকাণ্ড বিপ্লব করে রেভলিউসন করে·····যা্····’
এমনি একটার পর একটা ‘সে যাকের চোটে মিটিং ভেঙে খানখান হয়ে গেল। গোলমাল হই চই চিৎকার শেয়াল কুকুরের ডাকে সভাস্থল ভরে উঠল। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বসন্দার কর্কশ অনুনয় আমার কানে এসে ঘুরে ঘুরে বাজতে লাগল।
‘কমরেস্, কেউ যাবেন না, আমার বক্তৃতা শেষ না হলে কেউ যাবেন না, আরো আছে, অনেক কথা বলবার আছে।
আবার দর্শকদের হুঁ-উ-উ হাঁ-আ-আ শব্দে সে কথা ডুবে যাচ্ছে। আবার বসন্দার চিৎকার উপরে উঠছে, ‘রুশ, লেলিন, ম্যাস, জনগণ এই তো, সবই তো বলছি, চুপ করুন, শুনুন।’
ভিড় ঠেলে বসন্দার কাছে এগিয়ে যেতে যেতেই ফাঁকা হয়ে গেল। বসন্দা একবার আমার দিকে চাইলেন। উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে তাঁর সমগ্র দেহ, গলগল করে ঘামছেন, মুখের দু কশে ফেনা। মনে হল যেন বৃদ্ধ উচ্চৈঃশ্রবা। প্রাণপণ চেষ্টা করেও কাদায় পড়া রথটাকে টেনে তুলতে পারলে না। অপমানে, গ্লানিতে, ব্যর্থতায়, হতাশায় মুখখানা কালো করে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে শ্লথ পায়ে বিপর্যস্ত বিরাট দেহটার অনাবশ্যক ভার টেনে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
পরদিন ভোরে আমার ঘরের দরজায় দেখি একটা খাম। বসন্দার নিজ হাতে লেখা পদত্যাগপত্র। বসন্দাকে আর কোনদিন আমাদের পার্টি অফিসে দেখিনি।
বসন্দা নেই, কিন্তু বসন্দার বক্তৃতাটি আমাদের পার্টি যতদিন ছিল রয়ে গিয়েছিল। দেব্দা সেটা চমৎকার ভেঙাতে পারতেন। যখনই আমাদের অবসর বিনোদনের দরকার হত দেলা সেই বক্তৃতা ভেঙিয়ে আমাদের আনন্দ দিতেন।
শুনে শুনে আমিও শিখেছিলুম, তবে অত ভাল পারিনে।
১৩৫৯ (১৯৫২)