বর্ষশেষ ও গাজন
বাঙালির আছে বারো মাসে তেরো পার্বণের ঘটা। এই তেরো পার্বণের নির্ঘণ্ট থেকে বছরের শেষ মাসটাও বাদ যায়নি। বৈশাখে মেষ রাশি থেকে শুরু করে বর্ষ রাশিচক্রের শেষ ঘর মীন রাশিতে গিয়ে পৌঁছয় চৈত্র মাসে। (‘মেষাদয়ো দ্বাদশৈতে মাসাস্তৈরেব বৎসরঃ’)। সুতরাং রাশিচক্র পরিক্রমণের দিক দিয়ে বর্ষ চৈত্র মাসে তার বার্ধক্যের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছয়। কিন্তু তা বলে বছরের শেষ মাসের নেই কোনও রূপ বার্ধক্যের জীর্ণতা। অন্যান্য মাসের মতো বর্ষশেষের শেষমাস চৈত্রেও (পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্ৰ চিত্ৰা বা সন্নিহিত কোনও নক্ষত্রে থাকে বলে এর নাম ‘চৈত্র’) বাঙালির জীবন মুখরিত হয়ে থাকে (বা এককালে থাকত) আনন্দ উৎসবের সমারোহে।
‘লক্ষ্মীছাড়া’র চেয়ে বড় গালাগাল, বাঙালির কাছে আর কিছু নেই। সেজন্য প্রতি বাঙালি লক্ষ্মীকে ঘরে বেঁধে রাখতে চায়। প্রতি বৃহস্পতিবার মেয়েরা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে। লক্ষ্মীর বড় পূজা করে বছরে তিনবার—ধানসমেত লক্ষ্মীর ঝাঁপি বসিয়ে। তার মধ্যে চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপূজা অন্যতম। তা ছাড়া, চৈত্র মাসের শুক্লা সপ্তমীতে হয় বাসন্তী পূজা তা দুর্গাপূজারই সামিল, কেননা প্রতিমা একই। দেবতাদের পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত বাসন্তী পূজাই হচ্ছে আসল দুর্গাপূজা। কেননা, এটাই হচ্ছে দেবতাদের জাগ্রত কালের মধ্যে অনুষ্ঠিত পূজা। রামচন্দ্র কর্তৃক অনুষ্ঠিত শারদীয় পূজা হচ্ছে ‘অকালবোধন’ বা অকালের পূজা। দেবতারা তখন নিদ্রিত থাকেন। এছাড়া চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে হয় অন্নপূর্ণা পূজা। দেবী তখন মর্ত্যে আবির্ভূতা হন অন্ন বিতরণের জন্য।
বাসন্তীই বলুন, আর অন্নপূর্ণাই বলুন, সবই হচ্ছে শিব ও শিবানীর পূজা। আবার লক্ষ্মী তাঁদের মেয়ে। সুতরাং চৈত্র মাসটা হচ্ছে শিবেরই পরিবারের পূজা। এটা আবার শিবের বিয়েরও মাস। বাঙালির ধারণা শিবের জন্ম হয়েছিল শ্রাবণ মাসে আর বিবাহ হয়েছিল চৈত্র মাসে—নীলচণ্ডিকা বা নীল পরমেশ্বরীর সঙ্গে।
এটা তো সকলের জানাই আছে যে শিব হচ্ছেন অনার্য দেবতা। শিব কত প্রাচীন দেবতা, তা আমাদের জানা নেই। তবে মহেঞ্জোদরোতে আমরা শিবের প্রতিরূপ মূর্তি পেয়েছি। তা থেকে বোঝা যায় যে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে আমরা শিবের পূজা করে আসছি।
বাসন্তী, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী প্রভৃতি পূজা হচ্ছে ব্রাহ্মণশাসিত পুরোহিত প্রধান পূজা। কিন্তু অনার্য সমাজের পূজাপার্বণে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কোনও স্থান নেই। চৈত্র মাসে ব্ৰাহ্মণ- পুরোহিত বর্জিত শিবের যে উৎসব হয়, তাকে ‘গাজন’ বলা হয়। মালদহে বলা হয় গম্ভীরা। গাজন আরম্ভ হয় চৈত্র মাসের শেষে, নীলের উপবাসের দিন থেকে। অবশ্য অনেক জায়গায় গাজন তার আগে থেকেও শুরু হয়। জাতিনির্বিশেষে সকল হিন্দুরমণীই নীলের উপবাস করেন। সেদিন তাঁরা গঙ্গাস্নান করে শিবের মাথায় জল ঢালেন ও শিবকে ফল উৎসর্গ করেন।
গাজনটা অনার্য সমাজ থেকেই এসেছে। প্রথম আসে হিন্দু সমাজের নিম্নকোটির লোকের মধ্যে, পরে প্রবেশ করে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে। একশো বছর আগে বাঙলার প্রতি গ্রামে গ্রামে গাজন হত। শহরেও হত। ঊনবিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্রসমূহ থেকে জানতে পারা যায় যে কলকাতায় তখন বহুসংখ্যক গাজন হত। এসকল গাজন ন সাধারণতঃ বড়-লোকের বাড়িতে হত। হুতোম তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র প্রথম নকশা ‘বাবুদের বাড়ির গাজন’-এ কলকাতার বড়লোকের বাড়ির গাজনকে অমর করে রেখে গেছেন। বাবুদের বাড়ির গাজনের মধ্যে সাতু-বাবু-লাটুবাবুদের বাড়ির গাজন ছিল প্রসিদ্ধ। সমকালীন সংবাদপত্রসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে কলকাতার গাজনসমূহের সন্ন্যাসীরা দলে দলে বাণ-ফোঁড়া অবস্থায় কালীঘাট থেকে শহরের বিভিন্ন পাড়ায় নিজ নিজ গাজনতলায় আসত
অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে গাজনের প্রভাব প্রসারিত হলেও, গাজন মুখ্যত ছিল গ্রামের উৎসব। জানি না, এটা গ্রাম-জনের উৎসব বলেই এটার নাম ‘গাজন’ হয়েছিল কিনা। তবে অভিধানকাররা বলেন ‘গাজন’, ‘গর্জন’ শব্দের অপভ্রংশ।
গাজনের ঘটা ও আনন্দ-উৎসবের সমারোহ অনেক হ্রাস পেলেও গাজন এখনও গ্রামের পাল-পার্বণের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। একজন বিদগ্ধ লেখক বলেছেন— শারদীয়-পূজা যেমন বাঙলার মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে ঘরে এক আনন্দের উচ্ছ্বাস আনয়ন করে, গাজনও সেই রূপ বাঙলার দরিদ্র অনতিপরিচিত সাধারণ লোকের মধ্যে একটা অপূর্ব উৎসাহ ও মাদকতার সৃষ্টি করে। সমস্ত বৎসর ধরিয়া, তাহারা এই উৎসবের অপেক্ষায় উদগ্রীব হইয়া থাকে— -সংসারের নানা আধিব্যাধি অভাব-অভিযোগ প্রপীড়িত ও জর্জরিত হইয়া তাহারা গাজন সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার জন্য দেহ বাণ ও বঁড়শির দ্বারা বিদ্ধ করিবার ও চড়কে ঘুরিবার জন্য মানত করে। তাহাদের আশা, এই রূপ অনুষ্ঠানের দ্বারা তাহারা পূর্ণ শান্তি লাভ করিতে পারিবে—সাংসারিক দুঃখ-দৈন্য অন্তত কিছুদিনের জন্য আর তাহাদিগকে বিব্রত করিয়া তুলিবে না। তাই চৈত্রের প্রারম্ভে যখন গ্রামপ্রান্তে কর্ণকঠোর ঢক্কানিনাদ এই উৎসবের শুভ সূচনা করে, তখন ইহাদের প্রাণে এক নূতন ভাবের সাড়া পড়িয়া যায়—নবীন ভাবের আবেগ ইহাদিগকে অভিভূত করিয়া ইহাদের মধ্যে অভিনব কর্মপ্রেরণা জাগরি করে।’
গাজনের সময় যাঁরা ব্রত গ্রহণ করে ‘সন্ন্যাসী’ বা ‘ভক্ত’ হন তাঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণ হতে চণ্ডাল বাউরি পর্যন্ত সকল জাতকেই দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ যাঁরা শিবের কাছে কিছু মানত করেন, তাঁরাই ‘সন্ন্যাস’ গ্রহণ করেন। তিনদিন থেকে পনেরো দিন পর্যন্ত ব্ৰত গ্রহণের নিয়ম। অনেকে আবার সমগ্র চৈত্র মাসটাই ব্রত পালন করেন। ব্রতধারীর পক্ষে দিনের বেলায় উপবাস ও স্নানান্তে সন্ধ্যার পর ফলমূল ভোজন। ব্রতধারীর চিহ্ন লটকানে রঞ্জিত ধুতি বা শাড়ি পরিধান, কাঁধে ‘উত্তরী’ ধারণ ও হাতে বেত্রদণ্ড। সমগ্র মাসই তাঁদের সংযমের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়। চৈত্র সংক্রান্তির কাছাকাছি সময় ব্রতধারীর দল যখন গাজনতলার দিকে অগ্রসর হন, তখন অঞ্চলভেদে তাঁরা উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে’, ‘মহাদেব’, ‘ব্যোম ব্যোম শিবশঙ্কর’, ‘শিবনাথ কি মহেশ’ ইত্যাদি।
গাজনের একটা প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মেলা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিশু’তে লিখেছেন ‘মেলা বসবে গাজনতলার হাটে’। এখন অনেক জায়গায় গাজন উঠে গেলেও মেলাটা বসে। যেমন সাতুবাবু-লাটুবাবুদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে এখনও চড়কের দিন মেলা বসে। কলকাতার উপকণ্ঠে সিঁথির গাজনও লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মেলা এখনও বসে। গাজনের আর একটা আনুষঙ্গিক অঙ্গ ছিল ব্যঙ্গাত্মক সঙের শোভাযাত্রা। ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি যে এ রকম সঙ গাজনের দিন চিৎপুরের রাস্তায় অসংখ্য ঢাকের মহাশব্দের সহিত বের হত। ওই বৎসরের এক সঙে দেখানো হয়েছিল যে একজন ইষ্টদেবতাকে সামনে রেখে মালা জপছে, আর রাস্তার দুধারে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েছেলের মুখ দেখছে। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পাদে এরূপ সঙ বৌবাজারের জেলেপাড়া থেকে বের করা হত। বছরের পর বছর এ সঙ আমি দেখেছি। যে যে ভূমিকায় আবির্ভূত হত, সে সেই ভূমিকার বেশভূষা পরত। সমসাময়িক সামাজিক, প্রশাসনিক ও পুরসংস্থা প্রভৃতির দুর্নীতি, ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের অনাচার ইত্যাদি অবলম্বন করেই সঙগুলি পরিকল্পিত হত। প্রতি সঙেই একটা করে গীত গাইত। ব্যঙ্গ করে গীতগুলির মাধ্যমে অনাচারীদের চাবুক মারা হত। উদাহরণ স্বরূপ একটা গীত এখানে বিধৃত করছি। এটা পুরসংস্থাকে উপলক্ষ করে রচিত। “হামরা নাম হরি মেথরাণী, মুনসিপালকো হোতা নানী। বেগর হামলোগকো কভি না চলবে কাম, হাম লোগকো ছোটা জবান যব কই বলে। কাম ছোড়দি সবকই মিলে, হামারা জাতকা এই সব মিল হোতা। লেকেন বাবু লোককো দুসরা বাত, উঠনে বহিটনে খাতা লাথ। বেসরমী বাবুলোক চাটতা ঝুটাপাত। ফিন বলে ছোঁ মাত মেথরাণী, হামলোগকি ছিটতা গোবর পানি, জিতা বাহাদূর প্যাটেল ঠাকুর, হাম সাদি করেগা পুরুত ঠাকুর, সেন বাবুকা লেড়কা সাথ, দে বাবুকা লেড়কীকা সাদি দেব।”
এরপর আরও কিছু অংশ ছিল, কিন্তু আমার তা মনে নেই।
গাজন এখন ম্রিয়মাণ হলেও কলকাতার কাছাকাছি দুটো জায়গার গাজন এখনও সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে হুগলী জেলার তারকেশ্বরে। গাজন উপলক্ষে এখানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় ও মেলা বসে। আর দ্বিতীয় জায়গাটা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার সীমান্তে চন্দনেশ্বর গ্রামে। চন্দনেশ্বর হচ্ছে দীঘার তিন-চার মাইল উত্তর-পশ্চিমে। এখানে চন্দনেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে গাজন উৎসব খুব জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি ও ওড়িয়ারা সমান উৎসাহের সঙ্গে এই উৎসবে যোগদান করে। কয়েক সহস্র লোকের সমাগম হয়।
গাজনের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক। এই উপলক্ষে একটা কাষ্ঠস্তম্ভের মাথায় আড়ভাবে একটা বাঁশ এমন করে বাঁধা হয় যে তাতে পাক খাওয়া যায়। পিঠে বঁড়শির মতো একটা লোহার শলাকা বিঁধিয়ে সন্ন্যাসীরা ওই আড়ের দিকের বাঁশের শেষ অংশ হতে ঝুলে চড়কগাছে পাক খেতেন। বোধ হয় হঠযোগের সাহায্যে তাঁরা এটা করতে সক্ষম হতেন। কলকাতার বাগবাজার পল্লীর চড়ক বিখ্যাত ছিল। এই চড়কটা হত সেই মাঠে, পরবর্তীকালে যেখানে নন্দলাল বসু ও পশুপতিনাথ বসু তাঁদের বিরাট বসতবাটী তৈরী করেছিলেন। এটার নাম ছিল রামধন ঘোষের চড়ক। একে ১৬ চড়কী বলা হত, কেননা ১৬ জন পিঠ ফুঁড়ে এখানে চড়ক গাছে ঘুরত। কিন্তু চড়ক প্রথাটাকে ‘অমানুষিক দাবি করে খ্রিষ্টান মিশনারিরা বাঙলা সরকারকে এ প্রথা রহিত করার অনুরোধ করে। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ছোটলাট বিডন এক ইস্তাহার জারি করে এই প্রথা আইন অনুসারে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করেন। তদবধি সন্ন্যাসীরা পিঠে গামছা বেঁধে তার সাহায্যে চড়ক গাছে পাক খায়।
উপরে বর্ষশেষে বাঙালি জীবনে পালপার্বণের একটা বর্ণনা দিলাম; কিন্তু আজ বাঙালি তার অতীতের এসব পালপার্বণ হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি বছরের শেষদিনে যবের ছাতু খাওয়া এবং জলপূর্ণ কলসীদান করে যে ‘সর্বপাপক্ষয়ফলম’ অর্জন করত, সেটাও সে ভুলে গিয়েছে। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাঙালির পালপাৰ্বণসমূহ মাত্ৰ তার জীবনকেই যে আনন্দময় করে তুলত তা নয়, তার গ্রামীণ অর্থনীতিকেও ক্রিয়াশীল রাখত।