বনেদি চালচিত্র

বনেদি চালচিত্র

 ‘পাজামা অনেক চেষ্টা করেও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। অনেকটা ওপরে সিটিয়ে আছে। কড়া মাড় করা ইস্ত্রি। ফলে গোটাটাই একটা খেঁচোর মেঁচোর ব্যাপার। গৃহিনীর সঙ্গে কলহ হলে কর্তার মুখের চেহারা যেমন হয়। ঊর্ধ্বে হাফ-হাতা ফতুয়া পাঞ্জাবি। সাদা ধবধবে। ফিনফিনে আদ্দি। বুকের বোতাম খোলা। সোনার সরু হার দৃশ্যমান। কবজিতে গোল্ড প্লেটে ড ঘড়ি। পায়ে তালতলার চটি। পুরুষদের অধিকাংশেরই এই সাজ। কয়েকজন এরই মধ্যে বিশিষ্ট। তাঁরা পরেছেন ধাক্কাপাড় কোরা ধুতি, হাতওলা কোরা গেঞ্জি। সিল্ক সিল্ক দেখতে। এই গেঞ্জির বৈশিষ্ট্য, যত কাচা হবে, তত লম্বা হবে, শেষে শেমিজ। একটি যুবককে বারে বারেই দেখা যাচ্ছে। বেশ গোলগাল। লম্বা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির গায়ে অনেক ভজকট। মেয়েরা মৌসুমি মেঘের মতো মাঝেমাঝেই ঘিরে ধরেছে, আবার ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। খানিক হাসিবৃষ্টি।

 যেসব পুরুষের মুখ একটু লম্বাটে ধরনের তাঁদের মাথায় সামান্য চুল অবশিষ্ট আছে। মাঝখানে টেরি। আর যাঁদের মুখ থমথমে ভারী, তাঁদের মাথার মাঝখানে চুলের বর্ডার দেওয়া ‘সানকি’ টাক। নাটমন্দির বা চণ্ডীমণ্ডপে মা এসেছেন সপরিবারে। একচালা প্রতিমা। ছোট হলেও গঠনেও কোনও ফাঁকি নেই। সিংহের বীরত্ব, অসুরের আসুরিক ‘স্টাইল’ বাবরি। মা লক্ষ্মীর পায়ের কাছে খুদে একটি গিন্নির মতো লক্ষ্মী পেঁচা। গণেশ ঠাকুরের সিঁদুরে ভুঁড়ির তলায় তাঁর আপাত নিরীহ ইঁদুরটি। শিল্পীর প্রতিভা ইঁদুর গঠনে তেমন মনোযোগী হয়নি। যা হোক-তা হোক একটা হয়েছে। মা কালীর শৃগালেও একই ফাঁকি ধরা পড়ে। আর মায়ের পিছন দিকে মহাদেবের পদযুগল। অনেক সময় থাকেই না। থাকলেও শিশুর পায়ের মতো। মহাদেব যদি মাকে বলেন, ‘ওগো শুনছ! একটু নেমে দাঁড়াও তো, একবার টয়লেট থেকে ঘুরে আসি।’ মা নামলেন, বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বাবার হাইট!

মা সরস্বতীর হাঁসটি সুন্দর। মায়ের মুখ খুব গম্ভীর। রেজাল্ট নিয়ে নানা কেচ্ছাকেলেঙ্কারির জন্যে মা মনে হয় অখুশি। দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাধ্যমিকের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনা জানাবার রেওয়াজ এসেছে। এখন যা দেওয়ার দিয়ে বলতে হবে, ‘বাবা এটা রাখো, খুলো না, ব্যবহার করো না। কোর্টে দুশো কেস ঝুলে আছে, তুমি যদি ‘লিস্ট থেকে স্লিপ’ করে যাও, তাহলে এসব তোমাকে রিটার্ন করে দিতে হবে।’ আর একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে খেলার জগতে। আজ স্বর্ণপদক পেয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম। কাল ডোপটেস্টে বদনাম।

ঠাকুর দালানে আজ সেই সব রমণীরা প্রকাশিত হয়েছে সারা বছর যাঁরা অপ্রকাশিত থাকেন। নকশাপাড় শাড়ি। দুধে-আলতা গায়ের রং, মাখনের মতো শরীর। চকচকে মুখে লাল টিপ। হাতভরতি গয়না। পিঠ ছাপানো এলো চুল। এ-পাশে, ও-পাশে মুখ ঘোরানো কানের অলংকারে পেন্ডুলামের দোল। কয়েকজন নেত্রীস্থানীয়া প্রবীণা। এলাহাবাদের পাকা পেয়ারার মতো গাত্রবর্ণ। একজনের চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। চুলের রং সিংহের কেশরের মতো।

একদিকে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে ফল কাটা চলেছে। আর একদিকে অবিরাম চন্দন ঘর্ষণ। অন্যদিকে চলেছে বেলপাতা বাছাই। মালার জট খোলা। প্যাকেট থেকে বের করা হচ্ছে মায়ের বিবিধ অস্ত্র। বহুক্ষণ ধরে একটা মাছি সিংহের থ্যাবড়া নাকে বসে আছে। বৃদ্ধ পুরোহিত। পাতলা কাঁচা পাকা চুল। তেল চুকচুকে। ব্যাকব্রাশ করা। মাথায় সেঁটে আছে। খাঁড়া মতো নাক। চোখে রুপোলি গোল চশমা। তিনি মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। কাজটা খুব সহজে হচ্ছে না। প্রথমে ধনুক, তারপর একটু একটু করে সোজা হওয়ার চেষ্টা। তিনি যা চাইছেন, সেইটাই পাওয়া যাচ্ছে না। চারিদিকে থই থই, থালা, ঘটঘটি কুলো বরণডালা, শ্রী, ধামা, চুবড়ি, ফুল, ফল। পুরোহিতমশাই একটি পা তুলে জায়গা খুঁজছেন, কোথায় রাখবেন। পৃথুলা এক প্রবীণা খুব ‘মনোযোগ সহকারে’ আরতির সলতে পাকাচ্ছেন, ফুলো, ফুলো মন্দিরের চুড়ো চুড়ো। কোণ থেকে এক সুন্দরী বললেন, ‘মা, ওপাশ থেকে বঁটিটা দাও তো। তোমার ডানপাশে হাত বাড়ালেই পাবে। ওই যে কলাপাতা চাপা।’ তিনি ডানদিকে শরীর মোচড়াবার চেষ্টা করছেন। কঠিন প্রয়াস। কোমর-সমস্যা। মেয়ে উৎসাহ দিচ্ছে—’আর একটু, আর একটু, প্রায় পৌঁছে গেছ। ঠ্যাংটা ধরে টানো।’ উৎসাহে তিনি এতটাই উৎসাহিত হলেন, বেদিচ্যুত ‘স্ট্যাচু’র মতো সমূলে উলটে পড়লেন ডানদিকে, ভিজে আলো চালের নৈবেদ্যের ওপর। আর ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে পুরোহিতমহাশয়ের উত্তোলিত দক্ষিণ পদ নেমে এল একছড়া কাঁঠালি কলার ওপর। প্যাচ করে একটা শব্দ হল। এরপর ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’-এর ‘ওপনিং শট।’ মাধুরী দীক্ষিত যেভাবে ‘স্কেট’ করে দৃশ্য ঢুকেছিলেন, পুরোহিতমশাই ঠিক সেইভাবে হড়কাতে হড়কাতে মহিষাসুরের দিকে চলেছেন। মা দুর্গার আগেই তিনি না বধ করে বসেন। উঠোনে কর্তারা সমস্বরে চিৎকার করছেন, ‘ওরে! মাকে সোজা করে দে, মাকে সোজা করে দে।’ পুরোহিতমশাই কলা-বউকে জাপটে ধরেছেন। তাঁর হলুদ রঙের উত্তরীয় খুলে পড়েছে। ক্যাসেটে বাজছে, ‘ধুম্রনেত্র বধে দেবি…..।’

শামিয়ানার ভেতরে একটি পায়রা ঢুকে পড়েছে। বেরোবার চেষ্টা করছে। উড়ে এদিকে যাচ্ছে, ওদিকে যাচ্ছে। ফট ফট ডানার শব্দ। অনেকটা দূরে জড়-সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক দরিদ্র মা। বুকের কাছে ফুলের স্তবকের মতো ধরে আছেন তাঁর শীর্ণ শিশুটিকে।

বড়ো কর্তা সি. এ.। তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার আবার কী চাই?’

‘একটা জামা। মা বলেছিলেন।’ করুণ কণ্ঠ।

ওই যে দালানের জ্বলজ্বলে মা, আর এই অনাদৃতা মায়ের মধ্যে ব্যবধান মাত্র পঞ্চশ হাত। তারই মাঝখানে যত আয়োজন। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি…..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *