2 of 3

বদরক্ত

বদরক্ত

দিনরাত ঝুপঝুপ বৃষ্টি তবু মানুষের আসা বন্ধ হচ্ছে না। সাক্ষাৎ পাওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, ভক্তরা সেকথা জানেন, তবু অসময়েও আসা চাই।

দোতলার বারান্দা থেকে ওদের আসতে দেখেছিলেন রমলা। নিচের বারান্দা ভরতি হয়ে গিয়েছে, সামনের মাঠের ত্রিপলের তলায় এতক্ষণে নিশ্চয়ই জায়গা নেই। এত মানুষ আসছে শুধু মাকে একবার চোখে দেখবে বলে। ভারতবর্ষের যেখানেই মা যান সেখানেই এই দৃশ্য। অথচ প্রত্যেকেই তো একটা আশা নিয়ে আসে। তাদের পার্থিব কোনও দুঃখ দূর করতে মায়ের আশীর্বাদ চায় ওরা। কোনও মানুষকে অকারণে দু-বার আসতে দ্যাখেননি রমলা। ঠিক ত্রিশবছর মায়ের সঙ্গে ঘুরছেন তিনি। কানপুরের আশ্রমে আর কটা দিন থাকা হয়! টইটই করে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াতে ওই আশি বছরের মহিলার কোনও ক্লান্তি নেই।

এইসময় একজন এসে খবর দিল, মা ডাকছেন।

রমলা দ্রুতপায়ে ঘর পেরিয়ে মায়ের কাছে এলেন। মা তখন পা ছড়িয়ে বসে অন্নদাকে কিছু। বলছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ না তুলে বললেন, কোথায় থাকিস? তোকে না দেখলে কিছু ভালো লাগে না!

রমলা থমকে গেলেন। ত্রিশ বছরের সাহচর্য বলে দেয় এ সবই ভণিতা। আসল কথা আসবার আগে মা এইরকম বলেন। রমলা বললেন, তোমার ভক্তদের দেখছিলাম।

কী দেখলি?

বৃষ্টি উপেক্ষা করেও সব আসছে তোমাকে দেখবে বলে।

তাই?

হ্যাঁ। কেউ অবশ্য স্বার্থ ছাড়া আসে না।

ওমা, তা হবে কেন? তুই কি স্বার্থ নিয়ে এসেছিস? ত্রিশ বছর ধরে তোকে দেখছি, কই কিছু চাইতে তো শুনলাম না! মা হাসলেন।

রমলা এইসব মুহূর্তে অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু তবু প্রাণপণে নিজেকে শক্ত করলেন, চাইনা মাকে? প্রতি মুহূর্তেই তো চাইছি। তোমার সঙ্গে থাকতে চাওয়াটাই কি কম! এইরকম কথা একমাত্র রমলাই বলতে পারেন। আশ্রমের পুরুষ এবং নারীরা কেউ মায়ের কাছে রমলার মতো স্বাধীনতা পাননি। মায়ের মুখের ওপর অপ্রিয় কথা বলার ক্ষমতা একমাত্র রমলারই আছে।

মা বললেন, তুই আমার ছবি আঁকলি না?

রমলা মাথা নাড়লেন, পারব না। তোমার ছবি আঁকার ক্ষমতা আমার নেই।

পাগল! আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ, রোগজরায় ভুগছি। আসলে আমার ছবি আঁকলে সেটা সুন্দর হবে না, তাই আঁকছিস না। ঠিক আছে, তাহলে তোর নিজের ছবি আঁক, এঁকে দেখা। মা ধীরে-ধীরে উঠে পড়লেন। বেঁটেখাটো বৃদ্ধা রমলার চিবুকের কাছাকাছি। কিন্তু ওঁর চোখের দিকে তাকালেই দৃষ্টি নামাতে হয়। সারা শরীরের চামড়া এখন মালার মতো জড়িয়ে আছে হাড়ে অথচ গায়ের রং এখনও ভোরের আলোর মতো। বয়সের দাঁত মুখেও ছাপ ফেলেছে কিন্তু চুল কুচকুচে কালো। তাকালেই বুক ভরে যায়।

রমলা বিস্মিত, আমার ছবি?

হুঁ। তোরটা আঁকতে পারলেই আমারটা আঁকা হয়ে যাবে।

কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই সমস্ত শরীরে শিহরণ এল। রমলা বুঝতে পারছিলেন তাঁর দু-গাল। বেয়ে পলকেই জলের ধারা নেমেছে। অথচ মায়ের হাত শরীরে এলেই পৃথিবীটা শান্ত, দ্যাখো পাগলির কাণ্ড! চোখের জল খুব সস্তা, নারে! তারপরই গলা পালটে বললেন, এয়োস্ত্রীর চোখের জল স্বামীর অকল্যাণ করে। মুছে ফেল।

মা চলে গেলেন। আজ সারাটা সকাল ভক্তদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে ওঁকে। প্রথম-প্রথম এই সময় মায়ের সঙ্গে থাকতেন রমলা। আর মায়ের ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে যেতেন। মা আমার। স্বামীর অসুখ সারিয়ে দাও, মা আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও, অমুক যেন চাকরি পায় তুমি দেখো–এইরকম হাজারটা বায়না। মায়ের জবাব, ভালো ডাক্তার দেখাও রোগ সেরে যাবে, মন দিয়ে খোঁজ তাহলে নিশ্চয়ই কাজ জুটবে। ভক্তরা এতে সন্তুষ্ট হয় না। তাদের নিশ্চয় করে বলতে হবে। মা মুখ ফুটে যদি বলে সেরে যাবে তো ডাক্তার না দেখালেও সারবে। এই নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি। একথা শুনে মা একদিন বলেছিলেন, ওকথা বলছিস কেন? মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমি যে কিছুই করতে পারি না এও তো ওরা বুঝবে না। তাই বলি, যাঁকে ডাকলে সব হবে তাঁকে ডাকো, তিনিই সব। আমি কে?

রমলা জিজ্ঞাসা করেছিল, তবু আবার আসে কেন?

মা মিটিমিটি হেসেছিলেন, মজুররা তো মালিকের দেখা পায় না তাই সর্দারকে এসে ধরে। আমাকে বোধহয় সর্দার ঠাউরেছে।

না, মা কোনও ম্যাজিক করেন না। গায়ে হাত বুলিয়ে রোগ সারান না, গরিবকে বড়লোক করে দেন না। তবু রিক্সাওয়ালা থেকে অধ্যাপক কেউ না এসে পারে না মায়ের কাছে। রমলা নিজেও তো একই বাঁধনে বাঁধা। মায়ের কাছে এলে, মাকে চোখে দেখলে বুক ভরে যায়। যেন অফুরন্ত শক্তির উৎস মা, যারা আসে তারা সেই শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করে ফিরে যায়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে মানুষের ব্যবহার পালটে যাচ্ছে। এই যেমন আজ হল।

মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দর্শনের জন্যে। বিশেষ একটা মঞ্চ করা হয়েছিল যাতে ভক্তরা দেখতে পায় মাকে। স্বেচ্ছাসেবীরা মাকে ঘিরে রেখেছিল যাতে ভিড়ের ঢেউ গায়ে না লাগে। মাকে দেখা মাত্র এক মুহূর্তে সবাই পাথর। তারপরই একজন কেঁদে উঠল, মাগো, ওঁর ক্যান্সার হয়েছে, তুমি সারিয়ে দাও।

সঙ্গে-সঙ্গে হাজার-হাজার বিভিন্ন চাওয়া সোচ্চার হল। চিঙ্কারে কান পাতা দায়।

সবাই এবার মায়ের কাছে আসতে চাইছে। স্বেচ্ছাসেবীরা প্রাণপণে সেই চাপ সামলাতে চেষ্ট করছে। মা সবাইকে শান্ত হতে বলছেন, কিন্তু কে শোনে কার কথা। কেউ যেন ফুল ছুঁড়ল মায়ের। উদ্দেশ্যে। তাই দেখে যারা ফুল এনেছিল মাকে দেওয়ার জন্যে তারা সেগুলোকে সজোরে ছুঁড়তে লাগল মায়ের গায়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রমলা দেখলেন মায়ের শরীরে সেগুলো এসে আঘাত করছে। ফুলের আঘাত যে এত তীব্র হয় ধারণা ছিল না। মা দুহাতে মুখে ঢাকছেন। রমলা ছুটে নিচে নেমে এলেন। স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, আপনারা কী করছেন, মাকে ভেতরে নিয়ে আসুন।

ততক্ষণে ফুল বোধহয় ফুরিয়ে গেছে কিন্তু কিছু একটা ছুঁড়তে হবে বলেই ঢিল ফুলের জায়গা নিল। স্বেচ্ছাসেবকরা কোনওরকমে মাকে যখন ভেতরে নিয়ে এল তখন মায়ের কপাল বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে। রমলা ছুটে কাছে এসে নিজের আঁচল চেপে ধরলেন কপালে। না, ক্ষত তেমন বড় নয়।

ওষুধ লাগিয়ে যখন মাকে ওপরের ঘরে শুইয়ে দেওয়া হল তখন পুলিশ এসে গিয়েছে। তারা জোর করে সরিয়ে দিয়েছে উগ্র ভক্তদের। একটু শান্ত হলে রমলা মায়ের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কখনও আসবে এখানে?

মা বললেন, বাঃ, কেন আসব না। ও, ওরা ওরকম করল বলে বলছিস। তা সবাই তো করেনি, কেউ-কেউ করেছে। তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আজকের চিঠিগুলো পড়।

হ্যাঁ, এটাই এখন রমলার অন্যতম কাজ। সারা পৃথিবীর ভক্তরা মাকে প্রতিদিন চিঠি লেখেন। রমলা সেগুলো মাকে পড়ে শোনায়। যাকে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন, তাকে কী লিখতে হবে মা বলে দেন।

চিঠির ঝাঁপি নিয়ে আসা হলে রমলার চোখ স্থির হল। ওরে ব্বাস, আজ বোধহয় শদুই হবে! অভ্যস্ত হাতে একটার পর একটা চিঠি পড়ে যাচ্ছেন রমলা। প্রত্যেকেই দুঃখের কথা জানিয়েছে। মাঝেমধ্যে এক আধজনের ভালো খবর। একজনের পেটের অসুখ সারছে না জেনে মা বললেন, লিখে দে ভেলোরে গিয়ে দেখাতে। আর একজন মৃত্যুকামনা করে লিখেছে যে এই পৃথিবীর জ্বালা দূর করে ঈশ্বরের কাছে মা যেন যেতে তাকে সাহায্য করেন। শুনে মা বললেন, ওকে বল। আর যেন আমাকে চিঠি না লেখে। যারা কাজ ফেলে পালিয়ে যেতে চায় তাদের আমি পছন্দ করি না।

এইরকম একটার পর একটা চিঠি, যাতে জাগতিক দুঃখ-বেদনা মাখামাখি–মাকে পড়ে শোনাতে হয় এবং মায়ের জবাব তাদের লিখে পাঠাতে হয়। রমলা জানেন এইরকম দু-তিন লাইনের উত্তর পেলেই ভক্তরা কৃতার্থ হন। আজকের চিঠি শেষ হওয়ার মুখে একটা খাম খুলে থমকে পড়লেন। রমলা। মাঝেমধ্যে এই খামটি আসে। আর সেটা হাতে নিলেই বুকের মধ্যে কেমন নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। খুবই নির্লিপ্ত হওয়ার ভান করে চিঠিটি পড়তে হয় তাঁকে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয় মায়ের কানে যেন তাঁর গলা অন্যরকম না শোনায়। তারপর অনেক রাত্তিরে যখন একা থাকেন নিজের এই পরিবর্তনটার কথা ভাবলেই তাঁর হাসি পায়।

আজ চিঠিটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পুরোটা পড়ব?

মা শুয়েছিলেন চোখ বুজে, বললেন, কে লিখেছে?

ভবানীপুরের চাটার্জিদের বাড়ি থেকে।

এক মুহূর্ত সময় লাগল বোধহয় চিনে নিতে, মা বললেন, পড়।

রমলা পড়ে গেলেন। প্রথমেই একটা সুখবর। বড়মেয়ে শোভা ডাক্তারি পাশ করেছে। মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া তা সম্ভব হত না। শোভা বিদেশে যেতে চায় উচ্চশিক্ষার্থে, এ ব্যাপারে মায়ের কী মত? মা যদি অনুমতি দেন তাহলে সামনের মাসে স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের নিয়ে কাশীতে তিনি যেতে চান প্রণাম করতে।

রমলা দেখলেন চিঠিটি কাশীর ঠিকানায় লেখা, সেখান থেকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পঁচিশ বছর ধরে মানুষটার হাতের লেখা একই রকম রয়ে গেছে। পঁচিশ বছরের প্রতিটি মাস। নিয়মিত মোটা টাকা পাঠান উনি, প্রতিমাসে নিজের সংসারের খবরাখবর দেন। না, আজ অবধি কোনও খারাপ খবর ওর চিঠিতে পাননি রমলা। কিন্তু এত অনুরক্ত তবু পঁচিশ বছরে একবারও মাকে দর্শন করতে আসেননি। মায়েরই নির্দেশ মেনে। সেই মানুষ আজ হঠাৎ দর্শনপ্রার্থী হয়েছেন কেন?

মা তেমনি চোখ বুজে শুয়ে শুধোলেন, কত বছর হল?

রমলাবুঝতে পারছিলেন ওঁর মাথা নেমে আসছে, পঁচিশ।

লিখে দে, এবার আসতে পারে। সবাইকে নিয়ে আসতে হবে। তবে কানপুরে নয়, এখানেই। মায়ের কণ্ঠে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই।

চিঠি পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা বোধহয় এখানে থাকব না মা!

ও। তাই তো। তাহলে কাউকে দিয়ে খবর পাঠা। মায়ের কথা শেষ হওয়ামাত্র ডাক্তারবাবু এসে পড়লেন। ইনিও ভক্ত, মা আহত হয়েছেন জেনে ছুটে এসেছেন।

নিচে ততক্ষণে পুলিশের বড়কর্তারা এসে গেছে। মাকে ঢিল ছুঁড়ে মারা হয়েছে, এ খবর পৌঁছে গেছে মন্ত্রিমহলে। বড়-বড় অফিসাররা এসে গেছেন মায়ের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্যে। এখন আশ্রমের কর্তারা এঁদের সামলাবেন। রমলা উঠে এলেন বাইরে। ভিড় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি এখনও টিপটিপিয়ে পড়ছে। আকাশ ঘষা শ্লেটের মতো মন খারাপ করা। রমলা ধীরপায়ে নিচের অফিসঘরে এলেন। সেখানেও জটলা, সকালের ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে। রমলাকে দেখে সবাই চুপ করে গেল। ইদানীং এই হয়েছে। অহর্নিশ মায়ের সঙ্গে থাকার ফলে এদেরও বোধহয় ধারণা হয়েছে ইনিও শক্তিময়ী। রমলা একজনকে ডেকে বললেন, এখনই ভবানীপুরের এই ঠিকানায় চলে যাও। গিয়ে বলবে মা এঁদের সবাইকে আজ সন্ধেবেলায় আসতে বলেছেন।

ছেলেটি খুব তৎপরতায় সঙ্গে ঠিকানাটা লিখে নিল খামের ওপর থেকে। রমলা বললেন, যাওয়ার সময় ভাড়াটা চেয়ে নিয়ে যেও।

ওপরে গিয়ে চিঠির জবাব লিখতে বসে বারে বারে আনমনা হয়ে যাচ্ছিলেন রমলা। অথচ এই পঁচিশ বছর মা তাঁকে দিব্যি ভুলিয়ে রেখেছিলেন। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? মানুষটা সশরীরে আসছেন বলেই? অস্বীকার করবেন না, পঁচিশ বছর আগের প্রথম কদিন ব্যাপারটা ভাবলেই। বেশ হাসি পেত। মায়ের আদেশ পালন করেছি এই বোধটাই তখন বড় ছিল। কিন্তু এখন এই পঞ্চাশ বছর বয়সে পৌঁছে গত কয়েকমাস ধরে ওই চিঠিটা খুলতে গেলেই শরীরে কাঁপুনি। আসছে। প্রথম প্রথম মনে হত মাকে বলবেন এই অনুভূতির কথা। কিন্তু বলতে লজ্জা করত। অথচ আজ তাঁর জীবনে মা ছাড়া আর কে আছে? ইংরেজিতে বি এ পাশ করে ধনী বাবার কাছ থেকে এক কথায় চলে এসেছিলেন মায়ের কাছে তিরিশ বছর আগে। বাবা বাধা দেননি! মা-মরা মেয়েটি যদি এতেই শান্তি পায় তো পাক, এইরকম ইচ্ছে ছিল তাঁর। বাবা বেঁচে থাকতে প্রতিবছর দিন পনেরোর জন্যে গিয়ে থাকতেন তাঁর কাছে। তিনি চলে যাওয়ার পর সে পাটও চুকেছে।

সেবার কানপুরেই ঘটল ব্যাপারটা। মায়ের শরীর একটু খারাপ ছিল কদিন থেকে। রমলারা তখন মায়ের কাছে সর্বক্ষণ থাকার অনুমতি পেতেন না। মাঝে মাঝে মা ডেকে পাঠাতেন, দু একটা কথা বলতেন, তাই যথেষ্ট ছিল। অসুস্থ মাকে দিদিরাই সেবাযত্ন করতেন। রমলার খুব ইচ্ছে হত মায়ের পাশে থাকতে। এবং সেই ইচ্ছেটা মা একদিন টের পেয়ে গেলেন। তখন রমলাকে পায় কে! এক আত্মীয়ের অনুনয়ে মা ওদের এক মিনিটের জন্য দর্শন দিতে রাজি হয়েছেন অসুস্থ অবস্থায়। ছেলেটি অল্প কদিনের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি চলে যাবে, এও একটা কারণ ছিল।

ওরা এল। এত সুন্দর জুটি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ছেলেটির স্বাস্থ্যের সঙ্গে লাবণ্য মিশে তাকে আরও সুন্দর করেছে। মেয়েটিকে দেখেই মনে হয় বড় শান্ত। গায়ের রং একটু চাপা কিন্তু চোখদুটো বড় লক্ষ্মীময়ী। ওদের দেখে মা উঠে বসলেন। রমলা মায়ের পেছনে দুটো বালিশ সাজিয়ে দিলেন একটু আরাম দেওয়ার জন্যে। ওরা প্রণাম করতে এগোতে মা দু-হাত বাড়িয়ে বাধা দিলেন, না, না, পায়ে হাত দিতে হবে না।

সচরাচর মা কাউকে পায়ে হাত দিতে দেন না। ওরা দূর থেকে প্রণাম করে মাটিতে বসল পাশাপাশি। রমলার খুব সুন্দর লাগছিল ওদের দেখতে। মা কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কদ্দিন বিয়ে হয়েছে?

ওরা চকিতে নিজেদের দেখে নিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল মুখে রক্ত জমেছে ওদের।

নিচু গলায় ছেলেটি জবাব দিল, দশ দিন।

কবে বিদেশ যাচ্ছ?

সামনের মাসের তিন তারিখ।

রমলা দেখলেন মায়ের চোখ অসম্ভব স্থির হয়ে গেছে। সমাধি হওয়ার আগে মায়ের এমন অবস্থা হয়। কয়েকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে রমলার। তখন মায়ের কোনও বাহ্যজ্ঞান থাকে না। মা মেয়েটিকে ডাকলেন, তুমি একটু আমার কাছে এসো তো!

মেয়েটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে এল। এসে মুখ নিচু করে দাঁড়াল। মা ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার ঠিকুজিকুষ্ঠি নেই?

নীরবে ঘাড় নাড়ল মেয়েটি, না।

মা তার গায়ে হাত বোলালেন, তারপর বললেন, এবার যাও। কিন্তু কাল সকালে আবার এসো। খুব জরুরি।

ওরা চলে যাওয়ার পর মা অস্থির হয়ে পড়লেন যেন। প্রশ্ন করলেও কিছু বলেন না। বারংবার তাঁর এক কথা, আহা কী সুন্দর ছেলেটি! সন্ধেবেলায় ওদের সেই আত্মীয়াটি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁকে দেখেই মায়ের মুখ গম্ভীর। এক ঘর লোকের সামনে বলে বসলেন, তোমরা কী, অ্যাঁ? ছেলের বিয়ে দিয়েছ আর কুষ্ঠি মিলিয়ে দ্যাখোনি?

আত্মীয়াটি বিব্রত গলায় বললেন, না, মানে ওসব এরা কেউ–।

মেয়েটির ভাগ্যে বৈধব্যযোগ আছে। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই সে বিধবা হবে। আহা, অমন ছেলেটি চলে যাবে ভাবলেই মন কেমন করে উঠছে। মা তখন বেশ উত্তেজিত।

আত্মীয়াটি কথাটা শুনে খুব ঘাবড়ে গেলেন। দুহাত জোড়া করে মায়ের সামনে প্রায় লুটিয়ে পড়লেন, মা তুমি বাঁচাও।

আমি বাঁচাবার কে? যিনি পারবেন তাঁকে ডাকো। আমি কি ম্যাজিক জানি? যা কপালে লেখা আছে, তা মানতেই হবে। শুধু ওই ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে–। মায়ের গলার স্বর অন্যরকম শোনাচ্ছিল।

কথাটা শুনে রমলার বুকের ভেতরটা ডুকরে উঠেছিল। অত সুন্দর, সপ্রতিভ ছেলেটির আয়ু নেই? মা কখনও কাউকে এমন কথা বলেন না। ভবিষ্যতের কথা মায়ের মুখ থেকে অনেক চেষ্টা করেও কেউ বের করতে পারে না! কিন্তু এই ছেলেটিকে দেখার পর থেকেই মা ছটফট করছেন। সারাদিন সুস্থির হতে পারেননি।

রমলার তখন পঁচিশও হয়নি। গুণ বলতে ওইটুকু, সেতার বাজাতে পারেন। রাত্তিরে সব যখন চুপচাপ তখন সেতার নিয়ে বসতেন তিনি। সে রাত্রে মায়ের পায়ের কাছে বসে রইল। মা বললেন, কিরে, ভগবানকে ডাকবি না?

আজ ইচ্ছে করছেনা মা।

তা কি হয়! রোজ রাত্রে ডাকিস আর আজ বাদ যাবে কেন?

অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁর সেতার বাজানোর কথা জানতে পেরে মা বলেছিলেন, সুর হচ্ছে এমন একটা সিঁড়ি যা দিয়ে তাঁর কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যায়। আর যে বাজায় সে যেমন তাঁর আশীর্বাদ পায় যারা সেই বাজনা শোনে তাদের মনও পবিত্র হয়ে যায়।

আমার আজ বাজাতে ভালো লাগছে না। তুমিও তো ভালো নেই মা।

মায়ের একজন প্রিয় শিষ্যা মাথার কাছে বসে হাওয়া করছিলেন।

মা বললেন, রাখ তো পাখা, তোরা আমায় খামোকা রোগি বানাচ্ছিস।

তুমি সত্যিই অত ভাবছ মা ওদের জন্যে?

মা তাঁর দিকে তাকালেন, দ্যাখ, ছেলেটির কোনও দোষ নেই। মেয়েটিরও নয়। অথচ মেয়েটির কপালে বৈধব্যের যোগ এত প্রবল যে ছেলেটিকে যেতে হচ্ছে। সেই যে বলে না দুধও ভালো, লেবুও ভালো, কিন্তু যেই এক করো অমনি ছানা হয়ে যাবে। এসব দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন করে। সবই তাঁর ইচ্ছে বলে মানতে চায় না মন।

রমলা বললেন, কিছু করা যায় না মা?

মা বললেন, যায়, কিন্তু কে রাজি হবে?

রমলা জিজ্ঞাসা করলেন, কী করতে হবে?

ছেলেটিকে এমন কারও সঙ্গে বিবাহ দেওয়া দরকার যার বৈধব্যযোগ নেই আমৃত্যু। শুধু তার ভাগ্যের জোরে এই বিধিলিপি খণ্ডাতে পারে। যা তোরা যা, আমাকে একটু ঘুমুতে দে।

কিন্তু রমলা জানেন মা সেই রাত্রে ঘুমুতে পারেননি। আর কি আশ্চর্য, রমলাও চেষ্টা করে দুচোখের পাতা জুড়তে পারেননি। ভোরবেলায় মা তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ছাদে দাঁড়িয়ে গঙ্গার দিকে চেয়েছিলেন মা, রমলা গিয়ে প্রণাম করে দাঁড়াতেই হাসলেন, হ্যাঁরে, তোর সংসারী হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করার ইচ্ছে আছে? রমলা অবাক হয়ে গেলেন! একি প্রশ্ন! তিনি তো সব ছেড়ে এসেছেন মায়ের কাছে। কারও প্রতি কোনও অভিমান নয়, কোনও দুঃখ বা জ্বালা তাঁকে এখানে নিয়ে আসেনি। স্বাভাবিক গার্হস্থ্য জীবন চাইলেই তো তিনি পেতে পারতেন। কিন্তু তার। চেয়ে এই জীবন তাঁকে টেনেছে বেশি। দুবেলা উপাসনা আর মায়ের সান্নিধ্যের চেয়ে কাম্য তাঁর কাছে কিছু নেই। আর এসব কথা তো মা জানেন। তাহলে? রমলা বললেন, তুমি তো জানো, তাহলে এই প্রশ্ন কেন করছ?

মা বললেন, ভেবে দ্যাখ, পরে যদি আপশোস হয়?

রমলা বললেন, আমার আপশোস হবে কিনা তা তুমি জানো না?

মা বললেন, মন না মতি! কেউ কি কখনও তার গতি বুঝতে পারে?

পারে। অন্তত তুমি পারো। মা, আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

মা ভোরের আকাশের দিকে তাকালেন, কিন্তু আমি যদি তোকে বিয়ে করতে বলি?

মা! এবার চমকে উঠলেন রমলা।

কাউকে জীবন দেওয়ার মতো বড় কাজ আর কি আছে। কেউ যদি হিমালয়ে পঞ্চাশ বছর সাধনা করে, তার থেকে যে প্রতিদিন অসুস্থ মানুষের মুখে ওষুধ তুলে দিয়ে বাঁচায় সে বেশি পুণ্যবান। তুই না হয় সেই ওষুধটাই দিলি! ততক্ষণে রমলা বুঝতে পেরেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে ঝরঝর করে জল নামল গালে। মা হাসলেন, বোকা মেয়ে, কাঁদছিস কেন? কাউকে জীবন দিতে পারলে তুই খুশি হবি না?

রমলা বললেন, কিন্তু আমার কী হবে?

কিছুই হবে না। যেমন আছিস আমার কাছে তেমন থাকবি। ধর্মের অনুষ্ঠানটা হয়ে গেলেই সে চলে যাবে। তুই ভাববি একটা উপোস করলি মাত্র। সারাজীবন সিঁদুর পরতে হবে, শাঁখা থাকবে হাতে। এটুকুই যা ভার। তাছাড়া তুই যেমন আছিস তেমন থাকবি।

সন্ধেবেলায় বিয়েটা হয়ে গেল। বাইরের কেউ ছিল না। আশ্রমের সবাই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করলেন। ওরা এসেছিল সকালে। আত্মীয়ের মুখে গতরাত্রেই খবর পেয়ে এখন উন্মাদের মতো অবস্থা। মেয়েটি এসে পাগলের মতো স্বামীর জীবন ভিক্ষে চাইছিল। ছেলেটি থম ধরে বসে। কোনও কথা বলছে না অথচ বোঝা যাচ্ছে ওর ভেতরে ঝড় চলছে। মা যখন বললেন, যদি একজনের বৈধ্যবযোগ আর একজনের অভিশাপ হয়, তাহলে আর একজনের দীর্ঘ সধবা জীবন তার কাছে বর হয়ে দাঁড়াবে! তোমাকে পুনর্বিবাহ করতে হবে। সেই মেয়ের ভাগ্যে এই দুর্ভাগ্য। কাটবে। তবে শর্ত হল একটাই, তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তুমি আজীবন কোনও সম্পর্ক রাখতে পারবে না, কোনও যোগাযোগ যেন না থাকে। কারণ একটি সংসারী নয় এমন একটি মেয়ের। সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে, তাকে জড়িও না। আর মা, তুমি দুখ পেয়ো না। সতীন নিয়ে তোমাকে কোনওদিন ঘর করতে হবে না।

ওরা রাজি হয়ে গেল। এসব কথা পরে শুনেছেন রমলা। সে সময় তিনি অন্যঘরে বসে কাজকর্ম করছিলেন। এমন সময় সেই বউটি এসে দাঁড়াল সামনে। তারপর হঠাৎ তার পায়ের কাছে মাথা রেখে ডুকরে উঠল, আপনি আমার স্বামীর জীবন দিলেন, আমি–আমি–। বোধহয় কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না মেয়েটি। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন রমলা, কেন তা তিনি জানেন না।

বিয়ের সময় বা পরে একটিও কথা হয়নি। সব কাজ চুকিয়ে সন্ধেনাগাদ ওরা চলে গেলে মা রমলাকে কাছে ডাকলেন, তুই আজ থেকে এয়োতি। ওই সিঁদুর আর শাঁখার অমর্যাদা করিস না কখনও। আর যদি পারিস আজকের কথা ভুলে যা।

এখন মনে হয়, সত্যি কি ভুলতে পেরেছিলেন তিনি? প্রথম দিকে কি বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করত না? এমনকী আজ মনে পড়ে, মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে মায়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ হত। একজনের জীবন বাঁচাতে আর একজনের জীবন কেন উৎসর্গ করতে বললেন? কিন্তু পরদিন সকালে মায়ের দিকে তাকাতেই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল। জীবন তো একবারেই উৎসর্গ করেছেন মায়ের কাছে। সেদিন যে ঘটনা ঘটল তাতে তাঁর কি! মা যা ভালো বুঝেছেন তাই। করেছেন। তাঁর তো অন্য কোনও কামনা ছিল না যে তা হচ্ছে না বলে আপশোস করতে হবে! তিনি যেমন আছেন তেমনি আছেন। হয়তো মা তাঁকে একসময় ভুলিয়ে দেবেন সব। ধীরে-ধীরে বয়স বাড়ল। এখন ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া জীবনে আর কোনও কামনা নেই। মায়ের কাছে। গেলে অথবা পুজোয় বসলে রমলা সেই স্বাদ পান। এখন একটাই বোধ, এই রক্তমাংসের শরীরটাকে বয়ে বেড়াতে হয় বলেই বহন করতে হচ্ছে, কিন্তু আমার সমস্ত হৃদয় তাঁর পায়ে। প্রতিদিন একটু-একটু করে মা তাঁকে এই শান্তি দিয়েছেন, এই আনন্দ।

তাহলে আজ এই অস্থিরতা কেন? এতবছর ধরে ওঁদের কাউকে তিনি চোখে দেখেননি। চিঠি আসত, ওঁরা ভালো আছেন–জেনে কোনও প্রতিক্রিয়া হত না। মায়ের আদেশ পালন করেছেন ভদ্রলোক। একবারের জন্যেও এখানে আসেননি, কোনও চিঠিতে বিবাহ সম্পর্কিত কোনও ইঙ্গিতও থাকত না। অথচ প্রথম কদিন কি তাঁর এই আশঙ্কা হয়নি যে যদি লোকটি এসে দাবির হাত বাড়ায় তাহলে কোন আইনে তিনি তা ঠেকাবেন! এখন লজ্জা হয়। ভদ্রলোক প্রায় পঁচিশ বছর নীরবে থেকে গেলেন। এইসব ভাবনা আজ হচ্ছে কেন? এখন তো তাঁর শরীরে যৌবন নেই, চুলের রং সাদাটে, মুখে হাঁসের পায়ের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের প্রৌঢ়ত্বের কাল শেষ হতে চলেছে। এখন কোনওরকম আশঙ্কার কাল নেই। তবে? এক সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ। পাশাপাশি বসে থাকা ছাড়া তো সত্যিকারের কোনও সম্পর্ক নেই। তাহলে?

রমলা নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করলেন। অথচ জিভ যেন ঘুরেফিরে সেই ক্ষতেই ফিরে আসে। সেই ঘটনার পর অনেক কথাই কানে আসত। আড়ালে আবডালে মেয়েরা কম বলেনি। মা এটা কী করলেন! একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করা হল! ইত্যাদি। তখন হাসি পেত এসব শুনলে। মায়ের ইচ্ছায় ওই একটি সন্ধ্যা যে তাঁর জীবনে কোনও ঢেউ তোলেনি এটা সূর্যের মতো সত্য ছিল। নাহলে জীবনের বাকি পাঁচিশটা বছর এত স্বচ্ছন্দে পার হয়ে যেত না। কিন্তু এতদিন বাদে

ওদের কেন আসবার ইচ্ছে হল আর মা-ই বা কেন অনুমতি দিলেন এটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না রমলা। রমলার হাসি পেল, আশ্চর্য, এতসব মাথামুণ্ডু তিনি ভাবছেনই বা কেন? ভদ্রলোকের মুখটাও তাঁর স্মরণে নেই। শুভদৃষ্টির সময় যে এক পলক দেখা তা হাজার মুখের ছাপে কখন চাপা পড়ে গেছে।

সেদিনের চিঠি পড়ে এবং মায়ের জবান জেনে নিয়ে যখন উঠতে যাচ্ছেন তখন মা বললেন, আমার শরীর ভালো লাগছে না।

রমলা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কী হয়েছে?

এমনি, এমন কিছু নয়!

মা বললেন বটে, কিন্তু রমলার বুকের ভিতরটা নড়ে উঠল। সচরাচর মা এমন কথা বলেন না। খুব কঠিন অসুখও মা একবার চেপে ছিলেন অনেকদিন। মা অসুস্থ হয়ে পড়লে দিশেহারা হয়ে পড়েন রমলা।

ভারতবর্ষের এত জায়গায় জড়িয়ে থাকা আশ্রমগুলো চলছে মায়ের মুখ চেয়ে। যতই মায়ের বাণী এবং নির্দেশ তাঁদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করুক না কেন, মায়ের অনুপস্থিতিতে সব এলোমেলো হয়ে যেতে পারেই। রমলা জানেন মা চলে গেলে তাঁর দাঁড়াবার জায়গাও চলে যাবে। তিনি নিচু গলায় বললেন, ডাক্তারকে খবর দেব?

না, না।

শোনো, তুমি আজ বিশ্রাম নাও, কারও সঙ্গে দেখা করো না।

পাগল! কি বাড়াবাড়ি করছিস!

কিন্তু মায়ের কাছ থেকে উঠে এসেও মনের ভার নামল না। ঠাকুরের সামনে গিয়ে চোখ বুজে বসলেন। বারংবার প্রার্থনা করতে লাগলেন, মা যেন অসুস্থ না হন। জরা কিংবা রোগ যেন মাকে দখল না করতে পারে। মায়ের বেঁচে থাকা দরকার আমাদের সবার প্রয়োজনে। আর এইসব। ভাবতে-ভাবতে অন্য চিন্তা-ভাবনা কখন মাথা থেকে সরে গেল রমলা জানেন না। মা বলেন, মনটাকে স্থির কর, মনটাকে শূন্য কর, দেখবি তার চেয়ে শান্তি আর কিছুই নেই। পঁচিশ বছরে একটু-একটু করে রমলা ওই চেষ্টাটাকে ফলবতী করেছেন, এখন প্রার্থনায় বসলে চিত্ত শূন্য হয়ে যায়।

আজও সারাদিন মানুষের অবিরাম আনাগোনা। একবার সবাই মায়ের দর্শন চায়। মাকে মাঝে মাঝেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে। খুব প্রয়োজন এবং মায়ের অনুমতি ছাড়া কাউকে ওপরে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। রমলা লক্ষ রাখছিলেন মায়ের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা। কিন্তু নিজেই যিনি অনন্ত রহস্য তাঁর কিনারা করতে পারবেন রমলার এমন সাধ্য কি! এইসময় সিঁড়িতে সামান্য গোলমাল হল। একজন কর্মী উঠে এসে বললেন, দিদি, এক ভদ্রলোক ওপরে আসতে চাইছেন, মাকে জিজ্ঞাসা করুন।

রমলা বললেন, অন্যদিন আসতে বলো ভাই।

বলেছি, কিন্তু শুনছেন না।

কী দরকার?

বলছেন না। শুধু বললেন, মা জানেন।

এবং এতক্ষণে রমলার মনে পড়ল। জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কি একা এসেছেন?

না, পুরো ফ্যামিলি।

ও। হ্যাঁ, মা ওঁদের আসতে বলেছেন। নিয়ে এসো।

নিজের অজান্তেই পাদুটো ভারী হয়ে গেল রমলার। তিনি কি সরে যাবেন–অন্যঘরে, অন্য কোথাও? কিন্তু তাঁর যে এখন মায়ের কাছে থাকার কথা। হঠাৎ ওঁর খেয়াল হল কেন উনি খামোকা লজ্জা পাচ্ছেন? কারণ লজ্জা তাঁর একার পাওয়ার কথা নয়। দ্রুত পা চালিয়ে মায়ের ঘরে বসলেন। সেখানে মায়ের সামনে বেশ কয়েকজন বসে। মা খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, দু-একটা কথা শুনছেন। ওঁকে দেখে বললেন, কোথায় ছিলি?

উত্তর না দিয়ে ওপাশে গিয়ে বসলেন রমলা। মায়ের চোখ ঘুরে ফিরে তাঁর ওপর পড়ছে। একটু আড়ালে আবডালে রাখবেন নিজেকে এমন ভেবেছিলেন, হল না।

একটু বাদেই ওঁরা এলেন। দরজার কাছে এসেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন যে ভদ্রলোক তিনি বেশ স্থূলকায়, মাথায় বিশাল টাক কিন্তু মুখে একটা শ্ৰী আছে। ওঁর পাশে যিনি হাঁটু গেড়ে প্রণাম করছেন তাঁর শরীর খুব ক্ষীণা, কিন্তু মুখচোখে সুখের মোহর বসানো। কিছুটা অবাক হয়ে রমলা এঁদের দেখছিলেন। সেই অল্পবয়সি দম্পতিটিকে সময় আজ কী করে দিয়েছে। ওঁদের পেছনে যারা দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন তিনি। মেয়েটি হুবহু মায়ের অল্প-বয়সটার প্রতিচ্ছবি আর ছেলেটি বোধহয় বাবার। ওরা বেশ অবাক দৃষ্টিতে ঘরের মাঝখানে বসা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের মা নিচু গলায় কিছু বলতে ওরা এবার দূর থেকে প্রণাম করল।

রমলা দেখলেন মা ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, আমি সুবোধ।

বুঝেছি। কেমন আছ তোমরা?

আপনার আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে। এই আমার মেয়ে, কমলা। ও বিদেশ যেতে চাইছে পড়াশুনার জন্যে। আপনি যদি–রমলা দেখলেন কথা শেষ না করে ভদ্রলোকের চোখ চকিতে ঘরের চারপাশে ঘুরে গেল। একটু শক্ত হলেন রমলা; না, চোখ স্থির হল না। পঁচিশ বছরে তিনি নিজে কতটা পালটেছেন? প্রতিদিন আয়নায় মুখ দেখলে কি তা বোঝা যায়? কিন্তু চুলগুলো তো রং। পালটে ফেলছে; শাড়ি পরার ধরনও তো বদলে গেছে। দ্রুত ওঠানামা করলে বুকে হাঁপ ধরে।

মা বললেন, বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো! তুমি এসো আমার কাছে। মেয়েটি নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে এল, এসে সোজাসুজি তাকাল। মা হাসলেন, বেশ মেয়ে। খুব ভালো। বড় ডাক্তার হয়। মানুষের বড় কষ্ট, তুমি তাদের আরাম দিও।

মেয়েটি ঝুঁকে মাকে প্রণাম করতে গেলে মা চকিতে সরে বসলেন, না, না, পায়ে হাত দিতে হবে না। এমনি করেছ তাই ভালো।

মেয়েটি ফিরে গেলে ভদ্রলোক বললেন, মা, আমার আর একটা প্রার্থনা আছে।

প্রার্থনা করবে তাঁর কাছে। কী বলতে চাইছ বলো!

আমরা দীক্ষা নিতে চাই।

বেশ তো নেবে, ভালো গুরু পেলে নেবে।

মা, আপনি ছাড়া আমি কিছু জানি না।

মা হাসলেন, আমার কাছে তোমার দীক্ষা অনেক আগেই তো হয়ে গেছে। নতুন করে আর কী নেবে বাবা!

তবু–।

রোজ একবার ভগবানকে ডাকো, তাহলেই হবে। তুমি অশেষ ভাগ্যবান। আর ভাগ্যবানের বোঝা তো ভগবানই বয়।

কিছুক্ষণ মাকে দর্শনের পর ওঁরা প্রণাম করে উঠলেন। রমলার চোখ বারংবার ছেলেটির মুখের ওপর আটকে যাচ্ছিল। চুপচাপ ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখলেন। তিনি এ ঘরে আছেন একথা ওঁরা জানলেন না। মা যে প্রসঙ্গটি তোলেননি এই জন্যে কৃতজ্ঞ। মা অকারণে কাউকে লজ্জায় ফেলেন না।

একটু বাদে আশ্রমেরই একটি মেয়ে নিঃশব্দে এসে রমলার কানের কাছে কিছু বলল। সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর মেরুদণ্ড সোজা। কী করবেন এখন? মায়ের দিকে তাকালেন। মা নির্বিকার মুখে আর। একজনের কথা শুনছেন। এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন তিনি। সাক্ষাৎ করতে চাইছেন ওঁরা। কেন? মায়ের অনুমতি ছাড়া তিনি এ কাজ করতে পারেন? কেন পারেন না? কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তিনি কি বোঝেন না? এতদিন মায়ের কাছে থেকেও যদি তা না বুঝতে পারেন তাহলে বৃথাই তাঁর শিক্ষা।

রমলা ধীরপায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক নেই। ওঁকে দেখা মাত্র মহিলা এগিয়ে এসে নত হতে গেলেন, ঝট করে দু-পা সরে গেলেন রমলা, একী। করছেন আপনি?

আপনি আমার প্রণাম নেওয়ার যোগ্য, তাই–।

কেন?

আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?

হ্যাঁ, চিনেছি। আপনি খুব রোগা হয়ে গেছেন। এরা বুঝি ছেলেমেয়ে? বাঃ, বেশ ভালো। রমলা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

মহিলা ছেলেমেয়েদের বললেন, প্রণাম কর।

রমলা বাধা দিলেন, না, এখানে আমরা একজনকেই প্রণাম করি।

মহিলা বললেন, আমার খুব ইচ্ছে হত আপনার সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি। উনি নিষেধ করতেন। বলতেন, এতে আপনাকে যন্ত্রণা দেওয়া হবে।

রমলার গলার স্বর কি কেঁপে গেল, কেন?

হঠাৎ মহিলা কেঁদে উঠলেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুলে-ফুলে উঠছিলেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে শক্ত হয়ে গেলেন রমলা। খুব শান্ত গলায় বললেন, কাঁদছেন কেন?

আমি তো সব পেয়েছি, সব। কিন্তু আপনি না থাকলে তো কিছুই পেতাম না। অথচ আপনি–। মহিলার গলা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

আপনি অযথা উতলা হচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, এদের কথা ভাবুন এখন। উনি কোথায়? রমলা জানেন না কী করে তিনি এত স্বাভাবিক হলেন।

উনি এলেন না, বললেন আপনার সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই।

ছিঃ। পঁচিশ বছর ধরে তিনি আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তা কজন দিতে পারে। আচ্ছা এবার

আপানারা আসুন, আমাকে যেতে হবে।

ওরা নিচে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মাকে কিছু বলে সটান তাঁর কাছে চলে এল, আমার একটা প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা করতে পারি?

বলো।

আপনি কি বিশ্বাস করেন, কারও জন্যে কারও আয়ু ফুরিয়ে যায় এবং সেই আয়ু আর একজন ফিরিয়ে দিতে পারে?

রমলা হাসলেন, তুমি বিশ্বাস শব্দটা উচ্চারণ করলে, বিশ্বাসের কাছে সমস্ত যুক্তি হার মানে, তাই না?

কিন্তু আমি মানি না। বিজ্ঞান মানবে না।

হয়তো। তাতে কী এসে যায়!

কিন্তু ওদের এই অন্ধবিশ্বাসের কাছে নিজেকে বলি দিলেন কেন আপনি?

খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন রমলা। তারপর কঠিন গলায় বললেন, তুমি তো ডাক্তারি পড়েছ, মৃতদেহ কাটা ছেঁড়া করো, মৃত মানুষের বুকে ছুরি বসাও যখন, তখন কি সেটাকে খুন। করা বলে? সেই কাটা ছেঁড়া কি জীবিত মানুষের কাজে লাগে না? আমি মায়ের কাছে উৎসর্গিত, তাই ওসবে আমার কিছু এসে যায় না। তোমার মা দাঁড়িয়ে আছেন যাও।

রমলা বিস্মিত মেয়েটির চোখের সামনে থেকে নিজেই সরে এলেন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন তিনি, মৃতদেহ–এই শরীর মন যদি তাঁর পায়ে সমর্পিত হয় তাহলে স্থূল ভাবনা আর শরীরটা তো মৃতই হয়ে যায়।

নিজের অজান্তেই যে তিনি বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল ছিল না। রমলা দেখলেন ওরা চারজন হেঁটে যাচ্ছে। একটি সুখী পরিবার। কর্তা আগে আগে, ছেলেমেয়েরা মাঝখানে, গিন্নি পেছনে।

হঠাৎ রমলার মনে হল ওদের এই হেঁটে যাওয়া, ওই গাড়িতে ওঠা, পৃথিবীতে বেঁচে-বর্তে সুখ। ভোগ করা এসবই তাঁর জন্যে। ওই মহিলা শুধু শরীর দিয়েছেন ভদ্রলোককে, শরীর তো সবাই দিতে পারে, কিন্তু সেইসঙ্গে পঁচিশটা বছর আতঙ্কের সুচের ডগায় থাকতে হয়েছে তাঁকে। যদি ভাগীদার হাত বাড়ায়! তাই আজ কেঁদে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন। ওই পুরুষ বিবেকে জ্বলছেন নিয়ত, তাই আজ মুখোমুখি হতে ভয় পান।

আর তিনি, শরীরের স্থূলতায় নয়, ওদের হাঁটতে চলতে ফিরতে দিচ্ছেন নিজের জীবনের শক্তিতে। ওই পুরুষটির প্রতিটি মুহূর্ত তাই তাঁর কাছে ঋণগ্রস্ত, ওই সংসারের প্রতিটি সুখ তাঁর হাত থেকে পাওয়া। যা কোনওদিন ওই ভদ্রমহিলা দিতে পারবেন না। বিজ্ঞানের যুক্তি তুলে ওই অল্পবয়সি মেয়েটি তা গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে, আহাম্মক! দ্রুত মায়ের কাছে চললেন রমলা। অন্যমনস্ক পা চৌকাঠে আঘাত করতেই মুখ থেকে বেদনার স্বর বের হল। সবাই চকিত এদিকে তাকিয়ে। রমলা দেখলেন বুড়ো আঙুল কেটে রক্ত পড়ছে টনটন করে। একজন ছুটে যাচ্ছিল ব্যান্ডেজ ওষুধ আনতে। মা বাধা দিলেন। বললেন, থাক, আনতে হবে না। রক্তটা বেরিয়ে যাক। বরক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *