বড় ঘরের কথা
নিম্নোক্ত কাহিনীটি আমি শুনিতে পাইতাম কি না সন্দেহ, যদি না সে-রাত্রে গ্রামের জমিদারবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকিত। আমি গ্রামে নবাগত, কিন্তু জমিদার মহাশয় তাঁহার কন্যার বিবাহে গ্রামসুদ্ধ লোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন, আমিও বাদ পড়ি নাই।
যিনি গল্প বলিলেন তাঁহার নাম ভুবন বিশ্বাস। রোগা চিম্সে চেহারার বৃদ্ধ, নস্য লইয়া সজল চকিত চক্ষে এদিক ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং অসংলগ্ন দুই-চারিটি কথা বলিয়া চুপ করিয়া যান। পূর্বে তিনি পাশের কোনও এক জমিদারীর সরকার কিংবা গোমস্তা ছিলেন। কয়েক বছর হইল অবসর লইয়াছেন। আমি গ্রামের বারোয়ারী গ্রন্থাগারের সমাবর্তন উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছি, দু’একদিন থাকিয়া চলিয়া যাইব। অন্যান্য গ্রামবাসীর মতো ভুবনবাবুর সহিতও সামান্য পরিচয় হইয়াছিল।
জমিদার বাড়ির বিস্তীর্ণ বারান্দায় নিমন্ত্রিতদের জন্য শতরঞ্জি পাতা হইয়াছিল। অতিথিদের মধ্যে একদল অন্দরের উঠানে খাইতে বসিয়াছেন। আমরা দ্বিতীয় ব্যাচ বাহিরে প্রতীক্ষা করিতেছি। চারিদিকে গ্যাস বাতি ও ডে-লাইট জ্বলিতেছে; লোকজনের ছুটাছুটি হাঁকডাক। মাঝে মাঝে সানাই তান ধরিতেছে। রাত্রি আন্দাজ ন’টা।
আমি এবং ভুবনবাবু বারান্দার এক কোণে বসিয়াছিলাম। এদিকটা একটু নিরিবিলি। ভুবনবাবু দুই-একটা অসংলগ্ন কথা বলিতেছিলেন। এই সময় ফটকের সামনে একটি জুড়ি গাড়ি আসিয়া থামিল। ভুবনবাবু একবার গলা বাড়াইয়া দেখিয়া চট করিয়া পিছনে ফিরিয়া বসিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘কারা এল?’
ভুবনবাবু ঘাড় ফিরাইলেন না, ঠোঁটের কোণ হইতে তেরছাভাবে বলিলেন—‘রামপুরের জমিদার আর তার মা।’
গৃহস্বামী ছুটিয়া আসিয়া নবাগতদের অভ্যর্থনা করিলেন। জুড়ি হইতে নামিলেন একটি বিধবা মহিলা এবং সিল্কের পাঞ্জাবি পরা এক যুবক। মহিলাটির বয়স অনুমান পঁয়তাল্লিশ, এককালে রূপসী ছিলেন, রাশভারী চেহারা, মুখে আভিজাত্যের দৃঢ়তা পরিস্ফুট। পুত্রটি কিন্তু অন্য প্রকার। চেহারা এমন কিছু কুদর্শন নয় কিন্তু মুখে আভিজাত্যের ছাপ নাই। সাজ-পোশাকের মহার্ঘর্তা এবং মুখের উন্নাসিক ঔদ্ধত্য দিয়া সহজাত কৌলীন্যের অভাব পূরণ করিবার চেষ্টা আছে, কিন্তু সে-চেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয় নাই।
গৃহস্বামী মাননীয় অতিথিদের লইয়া ভিতরে চলিয়া গেলেন। ভুবনবাবু এবার ফিরিয়া বসিলেন, দীর্ঘ এক টিপ্ নস্য লইয়া সজলচক্ষে এদিক ওদিক চাহিলেন, তারপর চাপা তিক্ত স্বরে বলিলেন—‘বড় ঘরের বড় কথা।’
এখানেই গল্পের সূত্রপাত। তারপর কয়েক কিস্তিতে ভাঙা ভাঙা ভাবে গল্পটি শুনিয়াছিলাম। ভুবনবাবু কয়েক বছর আগে পর্যন্ত রামপুর জমিদার বাড়িতে সরকার ছিলেন; কি কারণে তাঁহার চাকরি যায় তাহা জানিতে পারিনাই। তবে তিনি ভূতপূর্ব প্রভুগোষ্ঠীর উপর প্রসন্ন ছিলেন না তাহা তাঁহার গল্প বলিবার ভঙ্গি হইতে অনুমান করিয়াছিলাম। কাহিনীর সব ঘটনা ভুবনবাবুর প্রত্যক্ষদৃষ্ট নয়, ময়না নাম্নী দাসীর কাছে তিনি অনেকখানি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তার উপর আমি খানিকটা রঙ চড়াইয়াছি। সুতরাং কাহিনীটি ষোল আনা নির্ভরযোগ্য মনে করিলে অন্যায় হইবে। রবীন্দ্রনাথের মানবীর মতো ইহার অর্ধেক কল্পনা।
বর্তমান কালে বাংলাদেশের জমিদার শ্রেণীর যে দুরবস্থা হইয়াছে, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও ততটা হয় নাই। মারাত্মক রকম বদ্খেয়ালী না হইলে বেশ সম্ভ্রান্তভাবে চলিয়া যাইত, দোল দুর্গোৎসব বারো মাসে তেরো পার্বণ করিয়াও স্বচ্ছলতার অভাব ঘটিত না। রামপুরের ‘আদিত্যবাবু ছিলেন শুদ্ধ-সংযত চরিত্রের মানুষ, তাই জমিদারীটি মধ্যমাকৃতি হইলেও তিনি প্রজাদের উপর অযথা উৎপীড়ন না করিয়াও মর্যাদার সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে পারিয়াছিলেন। ছত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিপত্নীক হন এবং একমাত্র কন্যা প্রভাবতীর মুখ চাহিয়া পুন্নাম নরক হইতে ত্রাণ লাভের অজুহাতেও দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন নাই।
মাতার মৃত্যুকালে প্রভাবতীর বয়স ছিল নয় বছর। এ বয়সের মেয়েরা সাধারণত বেড়া-বিনুনি বাঁধিয়া খেলাঘরে পুতুল খেলায় মত্ত থাকে; কিন্তু প্রভাবতীর চরিত্র এই বয়সেই ছেলেমানুষী বর্জন করিয়া দৃঢ়ভাবে গঠিত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাকে লালন করিবার প্রয়োজন হয় নাই, সেই বরঞ্চ পরিবারস্থ সকলকে শাসন তাড়ন করিয়া বশীভূত করিয়াছিল। জমিদার পরিবারের অনিবার্য বিধবা পিসি-মাসিরা তাহাকে ভয় করিয়া চলিতেন, ঝি-চাকর নির্বিচারে তাহার আদেশ পালন করিত।
আদিত্যবাবু সগর্ব স্নেহে ভাবিতেন, আমার মেয়ে সাতটা ছেলের সমান। প্রভাবতীর ছেলেরাই হবে আমার বংশধর।
প্রভাবতীর বয়স যখন বারো বছর তখন আদিত্যবাবু তাহাকে জমিদারী সংক্রান্ত পরামর্শের আসরে ডাকিয়া পাঠাইলেন। দেখা গেল এদিকেও তাহার বুদ্ধির প্রাঞ্জলতা কাহারও অপেক্ষা কম নয়; নায়েব মোক্তার এই একফোঁটা মেয়ের বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন। আদিত্যবাবুর মুখ স্নেহগর্বে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নায়েব মোহিনীবাবু গদ্গদ স্বরে বলিলেন—‘মা আমাদের রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী।’
তারপর হইতে যখনই বিষয় সংক্রান্ত সলাপরামর্শের প্রয়োজন হইত আদিত্যবাবু নায়েবকে বলিতেন—‘আমাকে আর কেন? প্রভাকে জিগ্যেস কর গিয়ে।’
নায়েব অন্দরমহলে প্রবেশ করিতেন, ডাক দিয়া বলিতেন—‘কোথায় গো মা লক্ষ্মী, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে যে।’
ঠাকুরঘর হইতে হাসিমুখ বাড়াইয়া প্রভাবতী বলিত—‘কাকা! একটু বসতে হবে। ঠাকুরের প্রসাদ না পেয়ে যেতে পাবেন না। —ওরে ময়না, কাকার জন্যে আসন পেতে দে।’
ময়না প্রভাবতীর খাস চাকরানী, বয়স দু’জনের প্রায় সমান। ময়না কার্পেটের আসন পাতিয়া দিত, নায়েব উপবেশন করিতেন। তারপর যথাসময় পূজা শেষ হইলে ঠাকুরের প্রসাদ গ্রহণ করিয়া নবীনা প্রভুকন্যার সহিত মন্ত্রণা করিতে বসিতেন।
এইভাবে জমিদার পরিবারের বাহ্য এবং আভ্যন্তরিক ক্রিয়া ঘড়ির কাঁটার মতো চলিতে থাকিত।
প্রভাবতীর ষোল বছর বয়সে আদিত্যবাবু তাহার বিবাহ দিলেন। আগেই বিবাহ দিতেন, কিন্তু উপযুক্ত পাত্র খুঁজিয়া বাহির করিতে বিলম্ব হইল। পাত্রের নাম নবগোপাল; গোলগাল সুশ্রী চেহারা। গরিবের ছেলে, তিন কুলে কেহ নাই, লেখাপড়ায় ভাল, বৃত্তি পাইয়া বি. এ. পাস করিয়াছে। আদিত্যবাবু ঘরজামাই করিবেন; সুতরাং নবগোপাল সব দিক দিয়া সুপাত্র।
মহা ধুমধামের সহিত বিবাহ হইল। নহবৎ বাজিল, ব্যান্ড বাজিল; সাতদিন ধরিয়া যাত্রা পাঁচালি কীর্তন চলি, দীয়তাং ভুজ্যতাং হইল। না হইবেই বা কেন? জমিদারের একমাত্র কন্যা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। আদিত্যবাবু কোনও সাধই অপূর্ণ রাখিলেন না।
জামাই নবগোপাল শ্বশুরবাড়িতে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইল। নবগোপালের চেহারাটি যেমন মোলায়েম, স্বভাবও তেমনি মৃদু স্নিগ্ধ, মুখের কথা মুখে মিলাইয়া যায়। আদিত্যবাবু বাড়ির দ্বিতলের একটা মহল মেয়ে-জামাইয়ের জন্য আলাদা করিয়া দিলেন। নিভৃত নিরঙ্কুশ পরিবেশের মধ্যে প্রভাবতী ও নবগোপালের দাম্পত্য জীবন আরম্ভ হইল।
দাম্পত্য জীবনের প্রভাত। শীত রাত্রির অবসানে নবারুণপ্রফুল্ল শিশির-বিচ্ছুরিত প্রভাত। কিন্তু কখনও দেখা যায় শীতের রৌদ্র-ঝলমল প্রভাতে সূক্ষ্ম কুহেলিকা আসিয়া আকাশ ঝাপসা করিয়া দিয়াছে, সূর্যের প্রসন্নতা অশ্রুবাষ্পের অন্তরালে বিষণ্ণ হইয়া পড়িয়াছে। বিবাহের পর একমাস কাটিয়া গেল; ধীরে ধীরে আদিত্যবাবু এবং পরিবারস্থ সকলেই যেন অনুভব করিলেন, যেমনটি হওয়া উচিত ছিল তেমনটি হয় নাই। কোথায় যেন খুঁত রহিয়া গিয়াছে।
কিন্তু কী খুঁত, কোথায় খুঁত? আদিত্যবাবু উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন, অথচ কাহাকেও প্রশ্ন করিতে পারিলেন না। গৃহিণী বাঁচিয়া থাকিলে প্রশ্ন করিবার প্রয়োজন হইত না, কিন্তু মাতৃহীনা কন্যার মনের কথা জানা যায় কি করিয়া? প্রভাবতীর মুখ দেখিয়া কিছু অনুমান করা যায় না। সে আগের মতোই সাংসারিক ও বৈষয়িক কাজকর্ম পরিদর্শন করে; পূজার ঘরের সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন নিজের হাতে করে, বৃহৎ পরিবারের কোথায় কি ঘটিতেছে কিছুই তাহার চক্ষু এড়ায় না। তবু, আদিত্যবাবু যাহা দেখিতে পান না, পরিবারের অন্য কাহারও চোখে তাহা চকিতের জন্য ধরা পড়িয়া যায়। প্রভাবতীর মনের চারিধারে যেন সূক্ষ্ম কুয়াশার জাল পড়িয়া গিয়াছে, যাহা পূর্বে অতিশয় স্পষ্ট নিঃসংশয় ছিল তাহা আবছায়া হইয়া গিয়াছে; সূর্যের চোখে চালশে পড়িয়াছে।
ওদিকে জামাই নবগোপালের জীবনের বাহ্য অংশ বেশ বিধিবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। সে সকালবেলা দারোয়ানের সঙ্গে বেড়াইতে বাহির হয়, ফিরিয়া আসিয়া দপ্তরে শ্বশুরের কাছে বসে; বেলা হইলে নিজের মহলে অন্তর্হিত হইয়া যায়। বৈকালে আবার বেড়াইতে বাহির হয়, ফিরিয়া শ্বশুরের কাছে বসে। শ্বশুর বুঝিতে পারেন ছেলেটি অতি শান্ত ও সুশীল। তাহার বুদ্ধির ধার হয়তো খুব বেশী নাই, কিন্তু ধীরতা আছে। জামাইয়ের আভ্যন্তরিক জীবনের চিত্র কিন্তু আদিত্যবাবু কল্পনা করিতে পারেন না। নিজের মেয়েকেও তিনি চেনেন, জামাইকেও অল্প-বিস্তর চিনিয়াছেন, কিন্তু তবু মেয়ে-জামাইয়ের সম্মিলিত জীবন সম্বন্ধে কিছুই ধারণা করিতে পারিতেছেন না।
অনির্দিষ্ট উদ্বেগের মধ্যে ছয় মাস কাটিয়া গেল। তারপর একদিন আদিত্যবাবু নিভৃতে ময়নাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ময়না প্রভাবতীর দাসী ও নিত্য সহচরী। সে বালবিধবা, কিন্তু জীবনের ভিত্তিস্থানীয় গোপন সত্যগুলি তাহার অপরিচিত নয়।
আদিত্যবাবু ময়নাকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না, ঘুরাইয়া ফিরাইয়া প্রশ্ন করিলেন, ময়নাও ঘুরাইয়া ফিরাইয়া উত্তর দিল। কিছুই পরিষ্কার হইল না, বরং আদিত্যবাবুর সংশয় আরও বাড়িয়া গেল।
কিন্তু এ প্রসঙ্গ লইয়া নায়েব-মোক্তারের সহিত আলোচনা করা চলে না। আদিত্যবাবু মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিলেন। অবশেষে তাঁহার মনে পড়িয়া গেল ডাক্তার সুরেন দাসের কথা। কলিকাতার বড় ডাক্তার, আদিত্যবাবুর বাল্যবন্ধু। যেমন হৃদয়বান তেমনি ঠোঁটকাটা। আদিত্যবাবু কাহাকেও কিছু না বলিয়া কলিকাতায় গেলেন।
পরদিন রামপুরে নায়েবের কাছে টেলিগ্রাম আসিল—প্রভাবতী ও নবগোপালকে পাঠাইয়া দাও। প্রভাবতী ও নবগোপাল কলিকাতায় গেল।
ডাক্তার সুরেন দাস কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া তাহাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিলেন। তারপর আদিত্যবাবুকে আড়ালে বলিলেন—‘মেয়ের আবার বিয়ে দাও। এ বিয়ে বিয়েই নয়।’
পক্ষাঘাতগ্রস্থ মন লইয়া আদিত্যবাবু গৃহে ফিরিলেন। প্রভাবতী এবং নবগোপালও ফিরিল। প্রভাবতীর মনের কুয়াশা আর নাই, এর সূর্যালোক সমস্ত অস্পষ্টতা দূর করিয়া দিয়াছে।
দুই দিন আদিত্যবাবু কাহারও সহিত কথা বলিলেন না। কন্যার আবার বিবাহ দেওয়া দূরের কথা, মাতৃজারবৎ একথা কাহাকেও বলিবার নয়। মান-সম্ভ্রম বংশ-গৌরব সব ধূলিসাৎ হইয়াছে, মেয়েকে ঘিরিয়া যে নন্দনকানন রচনা করিয়াছিলেন তাহা ভস্মীভূত হইয়াছে। সব থাকিতে তাঁহার কিছু নাই, তিনি সর্বস্বান্ত হইয়াছেন।
তৃতীয় দিন সকালবেলা আদিত্যবাবু চুপি চুপি প্রভাবতীর মহলে গেলেন। প্রভাবতী এই সময় পূজার ঘরে থাকে।
প্রভাবতীর মহলে চার-পাঁচটি ঘর, তার মধ্যে দুটি শয়নকক্ষ, একটি বসিবার ঘর। নবগোপাল চেয়ারে বসিয়া মাসিক পত্রিকা পড়িতেছিল, শ্বশুরকে আসিতে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
আদিত্যবাবু জামাইয়ের মুখের পানে তাকাইতে পারিলেন না, লজ্জায় তাঁহার দৃষ্টি মাটি ছাড়িয়া উঠিল না। তিনি অবরুদ্ধ স্বরে বলিলেন—‘তুমি এমন কাজ কেন করলে?’
নবগোপাল উত্তর দিল না; নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
‘এমন করে আমার সর্বনাশ করলে!’
এবারও নবগোপাল নিরুত্তর রহিল। পাশের ঘরে ময়না আসবাব ঝাড়ামোছা করিতেছিল, সে একবার দ্বার দিয়া উঁকি মারিল, তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া সরিয়া গেল।
আদিত্যবাবুও আর কিছু না বলিয়া ফিরিয়া চলিলেন। কিছু বলিয়া লাভ কি? তিনি নিয়তির জালে জড়াইয়া পড়িয়াছেন, গলা ফাটাইয়া চিৎকার করিলেও মুক্তি নাই। শত বৎসর পূর্বে তাঁহার প্রপিতামহের আমলে এরূপ ব্যাপার ঘটিলে তিনি হয়তো জামাইকে কাটিয়া নদীতে ভাসাইয়া দিতেন। কিন্তু তাহাতেই বা কি লাভ হইত? কন্যার সুখ সৌভাগ্য বাড়িত না; বংশের মুখ উজ্জ্বল হইত না।
শ্বশুর প্রস্থান করিবার পর নবগোপাল আবার উপবেশন করিল; ঘরের চারিদিকে একবার মন্থর দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর মাসিক পত্রিকা তুলিয়া লইল।
দিন কাটিতে লাগিল, দিনের পর দিন। প্রভাবতীকে দেখিয়া অনুমান করা যায় না তাহার মনের মধ্যে কী হইতেছে। তাহার শান্ত সহাস্য দৃঢ়তার অন্তরালে হয়তো ব্যর্থ অভীপ্সার আগুন চাপা আছে, কিন্তু বাহিরে কেহ তাহা দেখিতে পায় না।
তারপর হঠাৎ একদিন আদিত্যবাবু মারা গেলেন। যেন অদৃষ্টের দুর্নিবার আঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া পলায়ন করিলেন। তাঁহার শরীর ভিতরে ভিতরে নির্জীব হইয়া পড়িয়াছিল, বাঁচিবার স্পৃহাও ছিল না। বুকে ঠাণ্ডা লাগাইয়া কয়েক দিনের জ্বরে তিনি ইহসংসার ত্যাগ করিলেন।
প্রভাবতী জমিদারীর সর্বেসবা অধিকারিণী হইল। কিন্তু এই সৌভাগ্যের জন্য সে লালায়িত ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর সে চারদিন শয্যা ছাড়িয়া উঠিল না। পরে স্নান করিয়া সংযতভাবে পিতার চতুর্থী ক্রিয়া সম্পন্ন করিল।
জমিদার-সংসার পূর্বের মতোই চলিতে লাগিল। গৃহে আদিত্যবাবুর স্থান শূন্য হইল বটে, কিন্তু সেজন্য কাজের কোনও ব্যাঘাত হইল না। নবগোপাল শ্বশুরের স্থান অধিকার করিবার চেষ্টা করিল না, যেমন নির্লিপ্ত ছিল তেমনি রহিল। নায়েব প্রভাবতীর সহিত পরামর্শ করিয়া কাজ চালাইতে লাগিলেন।
তারপর যত দিন যাইতে লাগিল প্রভাবতীর স্বভাব তত পরিবর্তিত হইতে লাগিল। হঠাৎ কোনও পরিবর্তন ঘটিল না, ধীরে অলক্ষিতে ঘটিল। আগে তাহার চরিত্রে দৃঢ়তা ছিল, কর্কশতা ছিল না; কথায় শাসন ছিল, তাড়না ছিল না; দৃষ্টিতে গাম্ভীর্য ছিল, ছিদ্রান্বেষিতা ছিল না। এখন ক্রমে ক্রমে তাহার স্বভাব তীক্ষ্ণ কণ্টক সমাকুল হইয়া উঠিল। সেই সঙ্গে শুচিবাই দেখা দিল। পরিচরবর্গ তাহাকে সম্ভ্রম করিত, এখন ভয় করিয়া চলিতে লাগিল।
তাহার দেহও অদৃশ্য রিপুর আক্রমণ হইতে অক্ষত রহিল না। বিবাহের সময় তাহার রূপ ছিল সদ্য ফোটা গোলাপ ফুলের মতো, লাবণ্যের শিশিরে সারা অঙ্গ ঝলমল করিত। ক্রমে শিশির শুকাইয়া আসিল। সেই সঙ্গে একটা স্নায়বিক রোগ দেখা দিল, হঠাৎ কাজ করিতে করিতে অজ্ঞান হইয়া পড়িত। আবার জ্ঞান হইলে যেন কিছুই হয় নাই, এমনিভাবে কাজে মন দিত। কেহ ডাক্তার ডাকার প্রস্তাব করিলে অগ্নিশিখার মতো জ্বলিয়া উঠিত।
আদিত্যবাবুর মৃত্যুর পর দুই বছর কাটিয়া গেল। তপঃকৃশ দেহমন লইয়া প্রভাবতী উনিশ বছরে পদার্পণ করিল।
নবগোপালের জ্বর হইতেছিল। ম্যালেরিয়া জ্বর, আসিবার সময় শীত করিয়া হাত-পা কামড়াইত। স্থানীয় ডাক্তার কুইনিন দিতেছিলেন।
বিকালবেলা নবগোপালের সাগু তৈরি হইল কি না দেখিবার জন্য প্রভাবতী রান্নাঘরের দিকে যাইতেছিল, ময়না আসিয়া খাটো গলায় বলিল—‘দিদিমণি, জামাইবাবুর বোধ হয় আবার জ্বর আসছে।’
প্রভাবতী থমকিয়া দাঁড়াইল—‘কি করে জানলি?’
ময়না সঙ্কুচিত স্বরে বলিল—‘আমি ঘরে গিছলাম, দেখলাম শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, বড্ড হাত-পা কামড়াচ্ছে, একটু টিপে দিলে আরাম হয়।’
প্রভাবতী কিছুক্ষণ ময়নার দিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল—‘তা টিপে দিলি না কেন?’
ময়না লজ্জিত মুখে চুপ করিয়া রহিল, প্রভাবতী তখন বলিল—‘আচ্ছা তুই সাবু নিয়ে আয়, আমি দেখছি।’
নবগোপাল নিজ শয়নকক্ষে একটা বিলাতি কম্বল গায়ে দিয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া শুইয়া ছিল, প্রভাবতী খাটের পাশে গিয়া দাঁড়াইল। নবগোপাল একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—‘আজ আবার জ্বর আসছে।’
প্রভাবতী নরম সুরে বলিল—‘হাতু-পা কামড়াচ্ছে? আমি টিপে দেব?
নবগোপাল ব্যস্ত ও বিব্রত হইয়া উলিল—‘না, না, তুমি কেন? সদর থেকে একটা চাকরকে ডেকে পাঠালেই তো হয়।’
‘তার দরকার নেই। আমি দিচ্ছি।’
প্রভাবতী খাটে উঠিয়া বসিয়া নবগোপালের গা-হাত টিপিয়া দিতে লাগিল। নবগোপাল আড়ষ্ট হইয়া শুইয়া রহিল।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর প্রভাবতী বলিল—‘ডাক্তারটা হয়েছে হতচ্ছাড়া। কম্বুলে ডাক্তার আর কত ভাল হবে। এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি, তাকে? জ্বর সারাতে হয় সারাক নইলে বিদেয় হোক।’
ইতিমধ্যে নবগোপালের কাঁপুনি বাড়িয়াছিল, সে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল—‘এখন ডাক্তার ডেকে কী হবে? জ্বরটা ছাড়ুক—’ বলিয়া মাথার উপর কম্বল চাপা দিল।
প্রভাবতী উঠিয়া গিয়া নিজের ঘর হইতে আর একটা কম্বল আনিয়া নবগোপালের গায়ে চাপা দিল। বলিল—‘আসুক ডাক্তার, নিজের চোখে দেখুক। ম্যালেরিয়া সারাতে পারে না।’ এই সময় ময়না সাগুর বাটি লইয়া প্রবেশ করিলে প্রভাবতী বলিল—‘ময়না, সাগু রাখ। সদরে গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনতে বল। ডাক্তার এসে বসে থাকুক, জ্বর ছাড়লে ওষুধ দিয়ে তবে যাবে।’
অতঃপর ধমক খাইয়া ডাক্তার এমন ঔষধ দিল যে আর জ্বর আসিল না। নবগোপাল ক্রমে সুস্থ হইয়া উঠিল। গ্রাম্য ডাক্তার সাধারণত একটু হাতে রাখিয়া চিকিৎসা করে; এক দিনে জ্বর ছাড়িয়া গেলে জ্বরের লঘুতাই প্রমাণ হয়, ডাক্তারের কেরামতি প্রমাণ হয় না।
ইহার কয়েকদিন পরে সকালবেলা প্রভাবতী নায়েবকে ডাকিয়া পাঠাইল। নায়েব আসিয়া দেখিলেন প্রভাবতী নিজের শয়নঘরের মেঝেয় বসিয়া পান সাজিতেছে। প্রভাবতী নিজে বেশী পান খায় না, কিন্তু নবগোপাল পান দোক্তা খায়; ইহা তাহার একমাত্র ব্যসন। প্রভাবতী নিজের হাতে স্বামীর পান সাজে।
নায়েব প্রভাবতীর সম্মুখে আসনে বসিলেন। প্রভাবতী তাঁহার পানে চোখ না তুলিয়া বলিল—‘কাকা, ওঁর জন্যে একজন খাস-বেয়ারা রাখব ভাবছি। আপনি কি বলেন?’
নায়েব কিছুক্ষণ প্রভাবতীর নতনেত্র মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। এ বংশের সাবেক প্রথা, অন্দরের সকল কাজ, এমন কি পুরুষদের পরিচর্যা পর্যন্ত, ঝি-চাকরানী করিবে। আদিত্যবাবুরও খাস-বেয়ারা ছিল না। নায়েব কথাটা মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিয়া বলিলেন—‘বেশ তো মা, তুমি যখন দরকার মনে করছ তখন রাখলেই হল। এ বংশে অবশ্য—’
‘সে আমি জানি। কিন্তু দরকার হলে নিয়ম বদলাতে হয়।’
‘তা তো বটেই। আমি লোক দেখছি।’ একটু থামিয়া বলিলেন—‘একটা লোক ক’দিন থেকে চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করছে—’
প্রভাবতী মুখ তুলিল—‘কি রকম লোক? ’
নায়েব বলিলেন—‘দেখে তো ভালই মনে হয়। ভদ্দর চেহারা, চালচলন ভাল, বলছিল কলকাতায় কোন্ ব্যারিস্টারের বাড়িতে বেয়ারার কাজ করেছে।’
‘তবে বোধ হয় পারবে।’
‘আপাতত ওকেই রেখে দেখা যাক। যদি না পারে তখন অন্য লোক দেখলেই হবে।’ নায়েব উঠিলেন—‘লোকটা এই সময় আসে। আজ থেকেই বহাল করে নিই, কি বল?’
প্রভাবতী বলিল—‘তাকে একবার অন্দরে পাঠিয়ে দেবেন। আমি আগে একবার দেখতে চাই।’
‘বেশ।’ নায়েব চলিয়া গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে ময়না ছুটিতে ছুটিতে ঘরে প্রবেশ করিল। ‘দিদিমণি—’ বলিয়া ঘাড় ফিরাইয়া পিছন দিকে ইশারা করিল। তাহার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।
প্রভাবতী অপ্রসন্ন চোখ তুলিয়া দেখিল দ্বারের কাছে উমেদার ভৃত্য আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ, ছিটের কামিজ পরা ছিমছাম চেহারা। মুখে চোখে বুদ্ধির সংযম। সে নত হইয়া জোড়া হাত কপালে ঠেকাইল।
প্রভাবতী তাহাকে এক নজর দেখিয়া পানের খিলি মুড়িতে মুড়িতে ধীর স্বরে বলিল—তোমার নাম কি?
‘আজ্ঞে মোহন।’
‘কি কাজ করতে হবে শুনেছ?’
‘আজ্ঞে নায়েববাবু বলেছেন।’
‘পারবে।’
‘আজ্ঞে পারব।’
‘বাবুকে তেল মাখানো, দরকার হলে হাত-পা টিপে দেওয়া, এসব করতে হবে।’
‘আজ্ঞে করব।’
প্রভাবতী তখন ময়নাকে বলিল—‘ময়না, ওকে কোণের ঘরটা দেখিয়ে দে, ঐ ঘরে ও থাকবে। আর বাবুর কাছে নিয়ে যা।’
মহলের এক কোণে লম্বা বারান্দার অন্য প্রান্তে একটি ঘর অব্যবহৃত পড়িয়া ছিল, ময়না মোহনকে সঙ্গে লইয়া ঘর দেখাইয়া দিল, তারপর নবগোপালের ঘরে লইয়া গেল।
খাস-বেয়ারা দেখিয়া নবগোপাল হাঁ-না কিছুই বলিল না। খুশি হইল কিনা তাহাও বোঝা গেল না। কয়েক মিনিট পরে ময়না মোহনকে নবগোপালের ঘরে রাখিয়া ফিরিয়া আসিলে প্রভাবতী বলিল—‘ময়না, বাকী পানগুলো সেজে ডাবায় ভরে রাখ, আমার স্নানের সময় হল।’
প্রভাবতীর শয়নকক্ষের লাগাও স্নানের ঘর, সে স্নানের ঘরে প্রবেশ করিল। ময়না পান সাজিতে বসিল।
আজ ময়নার মন চঞ্চল, ইন্দ্রিয়গুলিও অত্যন্ত সজাগ। পান সাজা শেষ করিয়া সে বাটা ভরিয়া নবগোপালের ঘরে রাখিয়া আসিল। দেখিল নূতন চাকর নবগোপালের মাথায় তেল মাখাইয়া দিতেছে।
প্রভাবতীর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া সে ঘরের এটা ওটা নাড়িয়া চাড়িয়া আঁচল দিয়া আয়নাটা মুছিবার ছুতায় নিজের মুখ দেখিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার সারা দেহে যেন ছট্ফটানি ধরিয়াছে। তারপর সে অনুভব করিল, স্নানের ঘর হইতে কোনও সাড়া শব্দ আসিতেছে না।
কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠিত চক্ষে স্নানঘরের দ্বারের পানে চাহিয়া থাকিয়া ময়না সন্তর্পণে গিয়া দ্বার ঠেলিল। দেখিল প্রভাবতী অজ্ঞান হইয়া ভিজা মেঝের উপর পড়িয়া আছে। তাহার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা দেখিয়া মনে হয় স্নান আরম্ভ করিবার পূর্বেই সে মূর্ছা গিয়াছে।
ময়না চেঁচামেচি করিল না, প্রভাবতীর পাশে ঝুঁকিয়া তাহার মুখে জলের ছিটা দিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে প্রভাবতীর জ্ঞান হইল। সে উঠিয়া বসিয়া বস্ত্রাদি সম্বরণ করিতে করিতে বলিল—‘হয়েছে, তুই এবার নিজের কাজে যা। কাউকে কিছু বলবার দরকার নেই।’
নূতন ভৃত্য মোহন যে অতিশয় কর্ম-নিপুন লোক এবং সব দিক দিয়া বাঞ্ছনীয় তাহা প্রমাণ হইতে অধিক বিলম্ব হইল না। সে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দেখিলে ভদ্রলোক বলিয়া ভ্রম হয়, কিন্তু সে যত্নপূর্বক নিজেকে ভৃত্য পর্যায়ে আবদ্ধ করিয়া রাখে; খাটো করিয়া কাপড় পরে, মাথায় টেরি কাটে না। তাহার সবচেয়ে বড় গুণ সে অযথা কথা বলে না, মুখে প্রফুল্ল গাম্ভীর্য লইয়া আপন মনে কাজ করিয়া যায়। ময়না যখন গায়ে পড়িয়া তাহার সহিত কথা বলিতে যায়, সে সংক্ষেপে উত্তর দেয়, মাখামাখির চেষ্টা করে না।
ময়নাকে লইয়াই গোলযোগ বাধিল।
ময়না মেয়েটা এমন কিছু ন্যাকা-বোকা নয়, তাহার পালিশ করা কালে শরীরে বেশ খানিকটা স্বছ সহজ বুদ্ধি ছিল। কিন্তু মোহন আসার পর হইতে তাহার বুদ্ধি-সুদ্ধি যেন জোয়ারের জলে ভাসিয়া গিয়াছিল। বিশেষত অবস্থাগতিকে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছিল ইচ্ছা থাকিলেও সান্নিধ্য বর্জন করিবার উপায় ছিল না।
সকল দিকেই প্রভাবতীর দৃষ্টি বড় তীক্ষ, ময়নার রসবিহ্বলতা তাহার চক্ষু এড়ায় নাই। একদিন সে ধমক দিয়া বলিল—‘হয়েছে কি তোর? অমন ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? কাজকর্ম কিছু নেই?’
ময়না ভয় পাইয়া তাড়াতাড়ি প্রভাবতীর সম্মুখ হইতে সরিয়া গেল।
এইভাবে, মোহন নিযুক্ত হইবার পর মাসখানেক কাটিল। গ্রীষ্মকাল আসিল। আকাশে যেমন অলক্ষিতে বাষ্প সঞ্চিত হইয়া কালবৈশাখীর ভূমিকা রচনা করে, তেমনি জমিদার পরিবারের শত কর্ম-বহুলতার অন্তরালে ধীরে ধীরে উষ্ণতার স্বচ্ছ মেঘ সঞ্চিত হইতে লাগিল।
বৈশাখ মাসের শেষের দিকে এক সকালে প্রভাবতী দ্বিতলের জানালায় দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া ছিল। রাত্রে গরমে ভাল ঘুম হয় নাই, উত্তপ্ত মুখের উপর সকালবেলাকার স্নিগ্ধ বাতাস মন্দ লাগিতেছিল না। কিন্তু এই স্নিগ্ধতা ক্রমে দ্বিপ্রহরের খর প্রদাহে পরিণত হইবে, এই শঙ্কা তাহার মনের সঙ্গে জড়াইয়া জড়াইয়া তাহার জীবনটাকেই দুর্বহ করিয়া তুলিতেছিল; মনে প্রশ্ন জাগিতেছিল, আরম্ভে এতটুকু সরসতা দিয়া ভগবান মানুষকে সারা জীবনের জন্য দুস্তর মরুভূমির শুষ্কতার মধ্যে ঠেলিয়া দিয়াছেন কেন?
—‘মা, কালীপুরের ভবনাথ চৌধুরী মশায় তাঁর ছোট ছেলেকে নেমন্তন্ন করতে পাঠিয়েছেন!’
প্রভাবতী দিবাস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিল, দেখিল নায়ের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
‘কিসের নেমন্তন্ন?’
নায়েব বলিলেন—‘চৌধুরী মশায়ের প্রথম নাতির অন্নপ্রাশন, খুব ঘটা করেছেন। বলে পাঠিয়েছেন, তোমাকে যেতেই হবে।’
প্রভাবতীর মুখখানা সাদা হইয়া গেল। চৌধুরী মশায় পাশের গ্রামের জমিদার, আদিত্যবাবুর সহিত বিশেয হৃদ্যতা ছিল। দেড় বছর আগে তিনি বড় ছেলের বিবাহ দিয়াছিলেন; এখন নাতির। অন্নপ্রাশন।
প্রভাবতী রুদ্ধস্বরে বলিল—‘আমি যেতে পারব না কাকা।’
নায়েব বলিলেন—‘কিন্তু সেটা কি উচিত হবে। আগ্রহ করে নিজের ছেলেকে নেমন্তন্ন করতে পাঠিয়েছেন—যদি না যাও ক্ষুন্ন হবে। লোক-লৌকিকতাও রাখা দরকার।’
প্রভাবতী জানালার দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল, বলিল—‘বলে দেবেন আমার শরীর খারাপ, যেতে পারব না। আর, ছেলের জন্য রূপোর ঝিনুক-বাটি পাঠাতে হবে তার ব্যবস্থা করুন।’
নায়েব মহাশয় কিছুক্ষণ ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া গেলেন।
জানালার বাহিরে বাতাস ক্রমে উষ্ণ হইয়া উঠিতেছিল। প্রভাবতীর দুই চক্ষু জ্বালা করিয়া জলে ভরিয়া উঠিল। সে আঁচলে চোখ মুছিয়া পালঙ্কে আসিয়া বসিল। ধরা-ধরা গলা পরিষ্কার করিয়া ডাকিল—‘ময়না!’
ময়নার সাড়া না পাইয়া প্রভাবতী বিরক্ত বিস্ফারিত চক্ষে দ্বারের পানে চাহিল। ময়না সর্বদা কাছে কাছে থাকে, একেবারের বেশী দু’বার তাহাকে ডাকিতে হয় না। প্রভাতী উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিল।
লম্বা বারান্দার অপর প্রান্তে মোহনের ঘর। ময়না দ্বারের চৌকাঠে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ঘরের ভিতরে চাহিয়া আছে।
প্রভাবতী নিঃশব্দ পদে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, তবু ময়না জানিতে পারিল না। মোহন ঘরের মেঝেয় মাদুর পাতিয়া নবগোপালের একখানা শান্তিপুরী ধুতি চুনট করিতেছে, ময়না তন্ময় সম্মোহিত হইয়া তাহাই দেখিতেছে।
এতক্ষণ প্রভাবতীর মনে যে অবরুদ্ধ বাষ্প তাল পাকাইতেছিল এই ছিদ্রপথে তাহা বাহির হইয়া আসিল। সে তীব্রস্বরে বলিল—‘ময়না! কি হচ্ছে তোর এখানে? ডাকলে শুনতে পাও না!’
ময়না চমকিয়া প্রভাবতীকে দেখিয়া যেন কেঁচো হইয়া গেল—‘দিদিমণি, তুমি ডেকেছিলে? আমি—আমি শুনতে পাইনি।’
দাঁতে দাঁত চাপিয়া প্রভাবতী বলিল—‘শুনতে পাওনি। এসো এদিকে একবার, ভাল করে শোনাচ্ছি।’
সে ফিরিয়া চলিল, ময়না শঙ্কিত শীর্ণ মুখে তার পিছনে চলিল। মোহন প্রভাবতীর স্বর শুনিয়া চকিতে মুখ তুলিয়াছিল, আবার ঘাড় হেঁট করিয়া কাজে মন দিল।
ময়নাকে লইয়া প্রভাবতী নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিল, প্রজ্বলিত চক্ষে চাহিয়া বলিল—‘ভেবেছিস কি তুই? সাপের পাঁচ-পা দেখেছিস?’
ময়না ক্রন্দনোন্মুখ ভয়ার্ত মুখে দাঁড়াইয়া রহিল। প্রভাবতী বলিল—‘ভেবেছিস আমার চোখ নেই, কিছু দেখতে পাই না! মোহনের সঙ্গে তোর কী? খুলে বল্ হতভাগী, নইলে ঝেঁটিয়ে তোর বিষ ঝাড়ব।’
ময়না প্রভাবতীর পায়ের উপর আছড়াইয়া পড়িল, কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল—‘আমি কোনও পাপ করিনি দিদিমণি, তোমার পা ছুঁয়ে বলছি।’
প্রভাবতী পা সরাইয়া লইয়া বলিল—‘হয়েছে, আর ন্যাকামি করতে হবে না। আমি সব বুঝি। তোকেও ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় করব, ওকেও বিদেয় করব। আমার বাড়িতে ওসব চলবে না।’
‘আমার কোনও দোষ নেই দিদিমণি!’
‘তোর দোষ নেই! সব দোষ তোর। তুই না বিধবা! তোর মাথা মুড়িয়ে গাঁ থেকে দূর করে দেব। নষ্টামির আর জায়গা পাস্নি।’
ভয়ে দিশাহারা হইয়া ময়না প্রভাবতীর পায়ে মাথা কুটিতে লাগিল—‘আমার দোষ নেই—আমার দোষ নেই—মা কালীর দিব্যি—বাবা তারকনাথের দিব্যি। আমি কিছু করিনি—ওই আমাকে ডেকেছে—’
‘কি বললি—তোকে ডেকেছে?’
‘হ্যাঁ, আজ রাত্তিরে ওর ঘরে যেতে বলেছে।’
প্রভাবতী ক্ষণেকের জন্য হতবাক হইয়া গেল, তারপর গর্জিয়া উঠিল—‘তাই বুঝি সকাল থেকে ওর দোরে ধর্না দিয়েছিস! হারামজাদি, তোকে আঁশ বঁটিতে কুটব আমি, কুটে কুকুর দিয়ে খাওয়াব।’
ময়না মাথা কুটিতে কুটিতে বলিল—‘তাই কর দিদিমণি, তাই কর, আমার সব জ্বালা জুড়োক।’
প্রভাবতী কিছুক্ষণ অঙ্গারচঞ্চু মেলিয়া ময়নার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর তাহার নড়া ধরিয়া তুলিয়া স্নানঘরের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতে যাইতে বলিল—‘আজ সারাদিন সারারাত ঘরে বন্ধ থাকবি তুই, খেতে পাবি না। আর মোহনের ব্যবস্থাও আমি করছি।’ ময়নাকে সে স্নানঘরে ঠেলিয়া দিয়া বাহির হইতে শিকল টানিয়া দিল।
নিজের শয্যাপার্শ্বে ফিরিয়া আসিয়া সে কয়েক মিনিট গুম হইয়া বসিয়া রহিল, তারপর শুইয়া পড়িল। কিছুক্ষণের জন্য তাহার সংজ্ঞা রহিল না।
জ্ঞান হইবার পরও প্রভাবতী শয্যায় পড়িয়া রহিল, উঠিল না। দ্বিপ্রহরে খাইবার ডাক আসিলে সে বলিয়া পাঠাইল—‘আমার শরীর খারাপ, কিছু খাব না। ময়নাও খাবে না।’
নবগোপাল আহারাদি সম্পন্ন করিয়া প্রভাবতীর খাটের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, শান্তকণ্ঠে বলিল—‘শরীর খারাপ হয়েছে? ডাক্তারকে খবর পাঠাব?’
‘দরকার নেই’ বলিয়া প্রভাবতী পাশ ফিরিয়া শুইল।
নবগোপাল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া লঘুপদে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।
নিঃসঙ্গ দ্বিপ্রহর ক্রমে পশ্চিমে গড়াইয়া পড়িল। হঠাৎ অসহ্য গরম কাটিয়া শন্ শন্ বাতাস বহিল, আকাশের কোণ হইতে রাশি রাশি কালো মেঘ ছুটিয়া আসিয়া আকাশ দখল করিয়া বসিল। ঝম্ ঝম্ ঝর্ ঝর্ বৃষ্টি আরম্ভ হইল।
প্রভাবতী উঠিয়া জানালা খুলিয়া দিল। প্রবল বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ছাট তাহার মুখ ভিজাইয়া দিল, বুকের কাপড় ভিজাইয়া দিল। সে ঊর্ধ্বে মেঘের পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
ক্রমে দিন শেষ হইয়া রাত্রি আসিল, ঝড়-বৃষ্টি থামিল। আকাশে বাতাসে স্নিগ্ধ শীতলতা, ধরণীর বুকে তৃষ্ণা নিবৃত্তির পরিপূর্ণ তৃপ্তি। প্রভাবতী আবার শয্যায় গিয়া শয়ন করিল। শুষ্ক দহমান অন্তর লইয়া পড়িয়া রহিল। সৃষ্টির মধ্যে সেই যেন শুধু সৃষ্টিছাড়া।
দাসী ঘরে আলো দিতে আসিল। প্রভাবতী একবার চোখ খুলিয়া আবার চোখ বুজিল, বলিল—‘আলো দরকার নেই, নিয়ে যা।’
দ্বিপ্রহর রাত্রি। বাড়িতে কোথাও আলো নাই, শব্দ নাই। নিশীথিনী যেন সর্বাঙ্গে শীতলতার চন্দন-প্রলেপ মাখিয়া গভীর নিদ্রায় অভিভূত।
অন্ধকার ঘরে প্রভাবতী শয্যায় উঠিয়া বসিল; কিছুক্ষণ কান পাতিয়া রহিল। তারপর নিঃশব্দে উঠিয়া নবগোপালের ঘরে উঁকি মারিল। নবগোপালের ঘরে ক্ষীণ নৈশ-দীপ জ্বলিতেছে। নবগোপাল শয্যায় নিদ্রামগ্ন। তাহার অল্প অল্প নাক ডাকিতেছে।
ফিরিয়া আসিয়া প্রভাবতী নিজের স্নানঘরের বদ্ধ দ্বারে কান লাগাইয়া শুনিল। শব্দ নাই। তখন সে সন্তর্পণে বাহিরের দ্বার খুলিয়া বারান্দায় বাহির হইল। বারান্দার অপর প্রান্তে একটা ঘর। নিঃশব্দ পদে বারান্দা অতিক্রম করিয়া সে দ্বারের গায়ে হাত রাখিল। দ্বার ভেজানো ছিল, আস্তে আস্তে খুলিয়া গেল।
প্রভাবতী দীপহীন কক্ষে প্রবেশ করিল।…
পরদিন প্রাতঃকালে প্রভাবতী শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিল, স্নানঘরের দ্বার খুলিয়া দেখিল ময়না মাটিতে পড়িয়া ঘুমাইতেছে। তাহাকে জাগাইয়া দিয়া সদয়কণ্ঠে বলিল—‘যা—এবার নীচে যা!’
ময়না চলিয়া গেলে প্রভাবতী স্নান করিল। তারপর পানের বাটা লইয়া পান সাজিতে বসিল।
নায়েব আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইলেন। ‘কাল না কি মা তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল?’
প্রভাবতী মুখ না তুলিয়া বলিল—‘এমন কিছু নয়, আজ ভাল আছি। কাকা, ওই নতুন চাকরটাকে আজই বিদেয় করে দেবেন।’
নায়েব বলিলেন—‘কাকে—মোহনকে? কিন্তু কাজকর্ম তো ভালই করছে শুনছি।’
প্রভাবতী বলিল—‘আমি ভেবে দেখলুম, অন্দরে মহলে পুরুষ চাকর না রাখাই ভাল। ওকে পুরো মাসের মাইনে দিয়ে বিদেয় করে দেবেন। বলবেন যেন আমার জমিদারীর এলাকা ছেড়ে চলে যায়।’
কাহিনী শেষ করিয়া ভুবনবাবু ঐশ টিপ নস্য লইলেন এবং চকিত সজল নেত্রে চারিদিকে চাহিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘নবগোপাল কবে মারা গেল?’
ভুবনবাবু বলিলেন—‘এই তো বছর দুই আগে। লোকটা ভারি অমায়িক ছিল, ছেলেকে খুব আদর করত।’
প্রশ্ন করিলাম—‘আপনি ছাড়া একথা কে কে জানে?’
ভুবনবাবু বলিলেন—‘সবাই জানে আবার কেউ জানে না। বড় ঘরের বড় কথা।’
২১ ফাল্গুন ১৩৬০