বড়মামার স্বপ্ন
বড়মামাকে কে না জানে? আমার বড়মামা।
আমি চিনি। আমার মেজোমামা চেনেন। আমার মাসিমা চেনেন। সারা গ্রামের মানুষ আমার বড়মামাকে চেনেন। বড় ডাক্তার। ভীষণ উদার। অসম্ভব খেয়ালি।
রোজ সকালে এই বাড়ির দোতলার বড় ঘরে চায়ের আসর বসে। মেজোমামাকে ডাকতে হয় না। ভোরে ওঠেন। প্রথম পাখির প্রথম ডাক শুনতেই হবে তাঁকে। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা। এইটাই তার জীবনের প্রতিজ্ঞা, যেমন নন্দ বংশ ধ্বংস না করে, চাণক্য বলেছিলেন, শিখা বাঁধব না। মেজোমামার অনেক রকম প্রতিজ্ঞা। সকালে চা খাবার আগে আধঘণ্টা খালি পায়ে ঘাসের ওপর বেড়াবেন। অবশ্যই বেড়াবেন। পৃথিবী উলটে গেলেও। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর দশ মিনিট হাঁটু মুড়ে বসবেন। একবার পড়ে গিয়ে ডান হাঁটুতে ভীষণ চোট পেয়েছিলেন। পা মোড়ার উপায় নেই। আমাকে রোজ রাতে খাবার পর মেজোমামার সামনে পা মুড়ে বজ্রাসনে বসে থাকতে হত আধঘণ্টা। সে যে কী সাংঘাতিক কষ্ট!
একদিন ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করেছিলুম, ‘মেজোমামা এইভাবে বসলে কি হয়?’ বলেছিলেন, ‘এর নাম বজ্রাসন। খাবার পরেই আধঘণ্টা এই ভাবে বসলে সব হজম হয়।’
‘তা এতে তো আমার হজম হচ্ছে। আপনার কী হচ্ছে?’ ‘শুনিস নি? সংস্কৃতে বলে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং। গন্ধ শুঁকলে অর্ধেক খাওয়া হয়। তেমনি দর্শন করলেও অর্ধেক উপকার। এইভাবে বসে চুল আঁচড়ালে, চুল বাড়ে। জীবনে কখনও টাক পড়ে না।’
‘আপনার যে টাক পড়ছে মেজোমামা?’
‘ও তো পুরনো টাক। নতুন করে আর পড়ছে কী?’
এই আমার মেজোমামা। শরীরের জন্যে কী না করেন! পালোয়ান রেখে কুস্তি শিখতে গিয়ে এমন ঘাড় মটকে গেল যে, হাসপাতালে পড়ে রইলেন মাসখানেক। বড়মামা বলেন, ‘ওর কপালে নাচছে অপঘাতে মৃত্যু।’
মাসিমা সব দেখেশুনে বলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক রকম পাগল আছে। পাগল ভালো করো মা। আর তো পারা যায় না। সকাল থেকে পাতা বেটে বেটে, আমার জীবন গেল। কুলে খাঁড়া, থানকুনি, গাঁদাল, জবাফুল।’
বড়মামা আগে বেশ ভোরেই উঠতেন। একেবারে শেষ রাতে। ঘড়ি না দেখলে মনে হবে মাঝরাত। আকাশে প্যাট প্যাট করে এক আকাশ তারা। উঠে ব্যায়াম না বেড়ানো কোনও কিছুই করতেন না। বিছানায় চুপ করে বসে থাকতেন আধঘণ্টা। তারপর আবার শুয়ে পড়তেন ধপাস করে। এরপর কখন উঠবেন, কারুর ক্ষমতা নেই বলে।
একদিন জিগ্যেস করেছিলুম, ‘আপনি কেন ওই রকম করেন?’
বলেছিলেন, ‘ভাঙা ঘুম জোড়া লাগাই। উঠে আবার শুয়ে পড়ার মজা জানিস? জানলে আর প্রশ্ন করতিস না।’
এখন বড়মামা আর ওই সব কায়দা করেন না। টানা ভোঁস ভোঁস ঘুম। ডেকে ডেকে সবাই বিরক্ত হয়ে যান। আমি ডাকছি, মাসি ডাকছেন, বড়মামার ছ-ছটা বিভিন্ন জাতের কুকুর একসঙ্গে ডাকছে। বড়মামার ঘুম আর ভাঙে না কিছুতেই।
মাসিমা একদিন বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘বড়দা তোমার তো এই রকম কুম্ভকর্ণ মার্কা ঘুম ছিল না। একটু ডাক্তার-বদ্যি দেখাও না!’
‘হাসালি পাগলি। আমি নিজেই ডাক্তার। আর কয়েক বছর বাদেই ওয়ার্লড-ফেমাস হয়ে যাব। আমি ডাক্তার দেখাতে যাব কোন দুঃখে রে!’
একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বড়মামা আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন, ‘বোস, প্রাইভেট টক আছে।’
সব প্রাইভেট টক আমার সঙ্গে। যতক্ষণ ডাক্তার সাংঘাতিক ডাক্তার। চেম্বার থেকে চলে আসার পর অন্য মানুষ। তখন আমরা দু’জনে প্রাণের বন্ধু। মাসি বলেন, আমি নাকি বড়মামার অপ-সেক্রেটারি। যত অপকর্মের প্ল্যান প্রথমে বড়মামার মাথায় খেলে, আর আমার সাহায্যে সেই সব পরিণত হয় কাজে। তা না হলে কার মাথায় এসেছিল গরুকে ছানার জল খাওয়ালে পেট থেকে সোজা ছানা বেরিয়ে আসবে। কার মাথায় এসেছিল গোটাকতক কাক ধরে সাদা রঙ করে দিলে কাকাতুয়া হবে। কার মাথায় এসেছিল বাড়ি থেকে চেম্বার পর্যন্ত দেশলাইয়ের খোলের টেলিফোন চালু করবে!
ছাদের যে দিকটায় তুলসী মঞ্চ, সেইখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসালেন। আমি ভাবলুম বর্ষাকাল, হয়তো কোনও বাগানে মাছ ধরতে যাবার পরিকল্পনা হবে। বলবেন, মাসি আর মেজো যেন জানতে না পারে। তার কারণ নাটাগড়ের এক বাগানে মাছ ধরতে গিয়ে, মাছের হাতে আমরা দু’জনেই মারা পড়ছিলুম। সে এক কাণ্ড। ছিপে এত বড় একটা মাছ পড়ল যে একটানে বড়মামা হড়কে পুকুরে। আমি পা ধরে টানার চেষ্টা করতে গিয়ে আমিও জলে। সেই কথা কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে গেল। তারপর থেকে মাছধরার কথা উঠলেই সবাই মারতে আসেন।
বড়মামা বসলেন আমার পাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দুনিয়াটা একটা রহস্য। ওই যে আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ—’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। আজকাল আকাশে তারা ছাড়াও অনেক কিছু দেখা যায়। নীল আলো। লাল আলো। পৃথিবীর মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গলে যাচ্ছে, শুক্রে যাচ্ছে। তারার পাশাপাশি মানুষের পাঠানো গ্রহ-উপগ্রহ উড়ছে আকাশে।
‘হ্যাঁ শোন? তোর সাহায্য চাই।’
‘কী বড়মামা?’
‘আমি রোজ রাতে আজকাল ভালো ভালো স্বপ্ন দেখি। অসাধারণ সব স্বপ্ন। জানিস তো স্বপ্নে মানুষ অনেক কিছু পায়। লেখক গল্পের প্লট পায়। বিজ্ঞানী ফর্মুলা পায়। রুগি ওষুধ পায়। স্বপ্ন মানুষকে দিতে আসে। আমার কী হচ্ছে জানিস, যেই ঘুম ভাঙছে সব ভুলে যাচ্ছি। সেদিন আমি ক্যানসারের ওষুধ পেয়েও হারালুম।’
‘কিছুতেই মনে রাখতে পারছেন না।’
‘মনে রাখার কী উপায় আছে! ভোর হতে না হতেই, দাদা চা, মামা চা, মামা চা, দাদা চা, ধড়মড় ধড়মড়, সব ভুল হয়ে গেল। ঠিক ভুল নয়। গুলিয়ে গেল সব। এই চা। চা-ই বাঙালি জাতির সর্বনাশের কারণ। সাধে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধি চায়ের নাম শুনলে খেপে যেতেন। এই তো গবেষকরা বলছেন, বেশি চিনি খেলে ডাকাতি করতে ইচ্ছে করে।’
প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলুম। আমি তো ভীষণ চিনি খাই। চুরি করে মুঠো মুঠো টিন খালি।
‘তা আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? আপনার হয়ে স্বপ্ন দেখে!’
‘গাধার মতো কথা বলিসনি। আমার স্বপ্ন তুই দেখবি কী করে! তোর স্বপ্ন আমি দেখব কী করে? যার যার স্বপ্ন তার তার স্বপ্ন।’
‘তাহলে আমি কী করব?’
‘রোজ ভোরবেলা তুই আমাকে আগলাবি। চা চা করে কেউ যেন না আমাকে ডিসটার্ব করে। তোর হাতে থাকবে খাতা আর কলম। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করবি। কেমন?’
‘তারপর?’
‘তারপর আমাকে আস্তে আস্তে জাগাবি। মানুষকে কী ভাবে জাগাতে হয় জানিস?’
‘বড়মামা, বড়মামা বলে চেল্লাব।’
‘তোর মাথা? পায়ের বুড়ো আঙুল ধরবি।’
‘কার আমার?’
‘আরে গাধা, আমার, আমার!’
‘আমারই তো বললুম।’
‘তোর আমার আর আমার আমার এক হল রে? জানবি চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না রে!’
‘বুঝেছি, বুঝেছি, আপনার দু’পায়ের দুটো বুড়ো আঙুল ধরব। ধরে?’
‘ধরে অল্প একটু মোচড়াবি জলের কলের মতো। আমি চোখ চাইব। সঙ্গে সঙ্গে তুই রেডি হবি। নোট নেবার জন্যে। আমি গড় গড় করে স্বপ্ন বলে যাব।’
‘কী মজা বড়মামা! দারুণ হবে।’
‘দারুণ। দারুণ। কাউকে বলবি না। এমন কি মেজোকেও না। তোর মাসিকে তো নয়ই।’
প্রথম দিন ভোরবেলা যেমন কথা ছিল ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করলুম। তারপর বড়মামা পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে আস্তে মোচড় মারলুম দু’বার। পা টেনে নিলেন। ঘুম ভাঙল না। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। প্রায় নাক ডাকার মতো। পা আবার সোজা হল। এবারে একটু জোরে মোড় মারতেই মারলেন শট। যেন পেনাল্টি থেকে টাইব্রেকার গোল দিচ্ছেন। আমি ছিটকে এসে পড়লুম ডিভানে।
ঠেলেঠুলে উঠলুম। এবার আমার নিজস্ব কায়দা। একটা কাগজের টুকরো সরু করে পাকিয়ে এ-নাকে একবার ও-নাকে একবার। ফোঁস ফোঁস করে উপুড় হয়ে শুলেন। হয়ে গেল। বড়মামার নাক আমার হাতছাড়া। কানে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে, পিঠে গোটা দুই কিল মেরে বসে রইলুম হতাশ হয়ে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না? এবার দেখি নাকও ডাকতে শুরু করেছে। শেষে মাথায় বুদ্ধি এল। কাতুকুতু দিলে কেমন হয়। যাঁহাতক কাতুকুতু দেওয়া বড়মামা সোজা উঠে বসলেন, চোখ জবাফুলের মতো লাল।
ধমকের সুরে বললেন, ‘কী চাই কী চাই তোমার? সাত সকালেই অসভ্যতা করছ?’ আমি একটুও ভয় পেলুম না। জানি তো, ঘুম ভাঙার পর মানুষ বেশ কিছুক্ষণ সব ভুলে যায়। একটু পরে সব আবার মনে পড়ে। মেজোমামা বলেন, ঘুম হল কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যু।
আমি চিৎকার করে বললুম, ‘স্বপ্ন চাই। স্বপ্ন।’
বড়মামা সোজা বিছানা থেকে উঠলেন। দরজা খুললেন। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দিয়ে, দরজা দিয়ে দিলে। আমি হাঁ হয়ে গেলুম। নীচে নেমে আসতেই মাসিমা বললেন, ‘কী রে! বড়মামাকে ডাক। চা যে পান্তাভাত হয়ে গেল।’
বললুম ‘পারব না।’
মাসিমা আমার মুখের দিকে তাকালেন, ‘কেন গো অপ-সেক্রেটারি। আজ এমন বেসুরো কেন?’
বড়মামার ব্যবহারে আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। বড়মামা যদিও বারণ করেছিলেন, মাসিকে একেবারেই বলবি না। তবু সব বলে ফেললুম। মাসিমা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বড়দার ঘুম তো বিখ্যাত রে! খাট থেকে টেনে ফেলে দে, মেঝেতে পড়ে ঘুমোবে। সেখান থেকে টানতে টানতে বারান্দায়, সেখানে ঘুমোবে। জানিস তুই, বড়দা একদিন ছেলেবেলায় পাঁচিলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওই যে আমাদের পেছনের বাগানে বড় সীমানা পাঁচিল, প্রায় ছ-সাত ফুট উঁচু, আম জাম লিচু গাছের ডালপালায় দেখাই যায় না, ওর ওপর উঠে চিত হয়ে শুয়ে বড়দা মনের আনন্দে ঘুমোচ্ছে।’
‘কেন মাসিমা? এর ওপর কেউ ঘুমোয়! অত সরু পাঁচিল! পাশ ফিরলেই তো পড়ে যেতে পারে?’
‘ছেলেবেলায় তো ভীষণ দুষ্টু ছিল। কী একটা করেছিল। ও হ্যাঁ, মায়ের সেলাইয়ের কল থেকে কাঁচি বের করে আমার চুল কেটে দিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘তারপর মা ধরে পিঠে গুমগুম কিল।’
‘তারপর?’
‘কোথায় চলে গেল? খোঁজ খোঁজ। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কান্নাকাটি। শেষে দেখা গেল, তাও আমরা দেখিনি। পাঁচিলের ও-পাশে বোসেদের পুকুর। পুকুরে স্নান করতে এসে কুসুম দেখলে একটা ঠ্যাং ঝুলছে, আর একটা হাত ঝুলছে। এমন বোকা মেয়ে, ও ভেবেছে পাঁচিলে লোকে কাপড় জামা মেলে দেয় তো, সেইরকম হাত আর পা শুকোতে দিয়েছে। তারপর হঠাৎ ওর মনে হয়েছে, তা কী করে হয়! তখন ভেবেছে ভূত। দে ছুট। বাড়ি গিয়ে মাকে বলেছে। সবাই ছুটে আসছে। এমন সময় দাদা পাশ ফিরতে গিয়ে ঝপাং করে জলে।’
সেদিন আটটার সময় বড়মামা উঠলেন। তাও উঠলেন কেন, পুবের জানালা খোলা ছিল। মুখে রোদ পড়েছে। চড়া রোদ। জামগাছের ডালে বসে কাক ডেকেছে খা খা করে।
একটু পরেই খোঁজ পড়ল আমার। ঘুম ঘুম চোখে বললেন, ‘কী করলি। ছি ছি। তোকে এত করে বললুম। জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেল। বড় স্বপ্নটা ভোর পাঁচটা নাগাদ শেষ হয়েছিল মনে হয়। তোকে আমি কি বলেছিলুম ঠিক পাঁচটা পাঁচে আমাকে ঠেলে তুলবি। আর গড়গড় করে বলে যাব। গুরুজনের একটা কথাও কি শুনতে নেই রে! বড় মাছের পেছন পেছন ছোট ছোট মাছ ঘোরে। ওই বড় স্বপ্নর পেছন পেছন এসে গেল কুঁচো স্বপ্ন! ঘুম ভাঙল কি স্বপ্ন দেখতে দেখতে জানিস? ওই মেজো, বাগানে কুস্তি করছে কিংকং-এর সঙ্গে। কিংকং এক লাথি মারল, মেজো ছিটকে গিয়ে পড়ল গোবরের গাদায়। সেখান থেকে বেড়ালের মতো ঘাড় ধরে তুলে একেবারে আখড়ার বাইরে। এই সব স্বপ্ন দেখার জন্যে আমি ঘুমোই? বল তুই? কী সময় নষ্ট, তাই না!’
‘বড়মামা, স্বপ্নে যাঁকে আপনি মেজোমামা ভেবেছেন, সে হল আমি। আমাকেই আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কিংকং হয়ে লাথি ঝেড়েছেন। তারপর কিংকং হয়ে ঘাড় ধরে দরজা খুলে বাইরে বের করে দিয়েছেন। বড়মামা আমার ভীষণ দুঃখ হয়েছে। অভিমান হয়েছে। রাগ হয়েছে।’
‘অ্যাঁ, তাই নাকি রে। ছি ছি! তোর লেগেছে?’
‘হ্যাঁ, লেগেছে বই কী! অমন আচমকা লাথি খেয়ে ছিটকে পড়লুম ডিভানে। তারপর ঘাড় ধরেছিলেন, কী ভীষণ ব্যথা।’
সোফায় বসে বসে বড়মামা অনেকক্ষণ ছি ছি করলেন। বললেন, ‘কিছু মনে করিস নি। ঘুমোলে আমার জ্ঞান থাকে না রে।’
যাক আমার অনেক লাভ হল। বড়মামা সেদিন খুব খাওয়ালেন। ভালো একটা কলম কিনে দিলেন।
রাতে ঠিক হল, ভোরবেলা বড়মামাকে আর পায়ের দিক থেকে নয়, মাথার দিক থেকে জাগাবার চেষ্টা করব। কিছুই না, নাকটাকে দু-আঙুলে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ চেপে রাখলেই চোখ খুলবেন, তখন আমি ধীরে ধীরে মাথার চুলে, চুল তেমন নেই, টাকে হাত বুলোব।
ভোর ঠিক পাঁচটা পাঁচ। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে, বড়মামার মাথার সামনে এসে দাঁড়ালুম। ভোঁস ভোঁস ঘুম। মেজোমামা ঠিকই বলেছেন, এই ভোঁস ভোঁস ঘুমে স্বপ্ন আসে না। স্বপ্ন রুপোলি ইলিশের মতো, হালকা ঘুমে পিঠ ভাসিয়ে বেড়ায়।
আমার আঙুল বড়মামার নাক টিপে ধরার জন্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। গুরুজনের নাক টিপে ধরার সাহস নেই। কী করা যাবে, গুরুজনের আদেশ যেমন। হাত এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। প্রায় এসে গেছে নাকের নাগালের কাছে। এইবার। এইবার।
হঠাৎ বড়মামা, গোঁ গোঁ করে শব্দ শুরু করলেন। সারা মুখের মাংসপেশী থির থির করে নাচছে। চোখ খুলছেন, চোখ বোজাচ্ছেন। আমার হাত পেছিয়ে আসছে ভয়ে। বড়মামা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছেন।
ঠিক এই অবস্থায় আমাকে কী করতে হবে? সে-কথা তো আমাকে বলেননি। আমি অবাক হয়ে দেখছি। বড়মামা শিশুর মতো উঁ উঁ করে কাঁদছেন। এত কাঁদছেন যে আমার দুঃখ হচ্ছে। আমার নিজেরই কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। স্বপ্নে নিশ্চয়ই কিছু ভেঙে ফেলেছেন। আর মাসিমা মনে হয় খুব ধমকাচ্ছেন।
হঠাৎ বড়মামার ঘুম কেউ যেন এক ধাক্কায় ভাঙিয়ে দিল। সারা শরীর কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। কান্না বন্ধ। ধীরে ধীরে চোখ মেললেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে খাতা বাগিয়ে ধরে বললুম, ‘বলুন বড়মামা। বলুন কী দেখলেন?’
বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নামলেন। পা দিয়ে চটি জোড়া খুঁজলেন। পেলেন না। সোজা দাঁড়িয়ে উঠে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।
আমি বললুম, ‘বড়মামা, স্বপ্ন?’
শুনেও শুনতে পেলেন না।
দরজা খুলে বারান্দা। সিঁড়ি দিয়ে নীচে।
আমি ছুটে গিয়ে মেজোমামা আর মাসিমাকে সব বললুম। মেজোমামা বেরিয়ে এলেন। বড়মামা ততক্ষণে বাগানে চলে গেছেন।
বাগানের উত্তরকোণে, শেষ মাথায়, সেকালের ঘর। থাকে না কেউ। প্রায় ভেঙে এসেছে। বহুকাল আগে শুনেছি এ বাড়ির ছোটরা ওখানে খেলা করত। বড়মামা সেইখানে গিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। একবার এ-দিকে একবার ও-দিকে। মেজোমামা পেছন থেকে খুব মিষ্টি গলায় বললেন, ‘কী খুঁজছ?’
‘আরে এখানে একটা বাচ্চা ছেলে বসে কাঁদছিল। বলছিল হারিয়ে গেছি। বহুদিন ধরে সে চেষ্টা করছে ঘরে ফেরার। কোথায় গেল বল তো মেজো?’
মেজোমামা হাসলেন, ‘বড়দা, যাকে খুঁজছ তাকে আর পাবে না।’
‘কেন, কেন, এই তো ছিল?’
‘যাকে খুঁজছ, সে তোমারই ছেলেবেলা। ছেলেবেলাকে কি আর পাওয়া যায় দাদা? ছেলেবেলা মাঝে মাঝে স্বপ্নে এসে কাঁদিয়ে দিয়ে যায়।’