বড়মামার বাইক
বড়মামা সকাল থেকেই পেয়ারের কুকুর লাকির ওপর ভীষণ রেগে গেছেন। পাশের ঘর থেকে শুনছি আমরা, চা-বিস্কুট খেতে খেতে হচ্ছে, ‘বেরিয়ে যাও ইডিয়েট বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। তোমার মুখ দেখতে চাই না জানোয়ার, রাসকেল, একটা বিস্কুট আমার দেওয়া ডিউটি, এই নাও। গেট আউট, গেট আউট। না না, ডোন্ট টাচ মাই বডি। উঁহু উঁহু, আদর নয়, আদর নয়। যাও, যাও। মোহন! মোহন! ইডিয়েট মোহন!’
মেজোমামা আর আমি এ ঘরে বসে, চা খেতে খেতে গল্প করছিলুম। মেজোমামা আমাকে আবিসিনিয়ার কাফ্রীদের গল্প বলছিলেন। এমনভাবে বলছিলেন যে এইমাত্র ঘুরে এলেন। কথা বলতে বলতে মেজোমামার খুব হাত পা নাড়ার অভ্যাস। দুবার কাপ উলটে যাবার মতো হয়েছিল। গল্পের গভীরে ঢুকে গেলে তখন আর কাপ ডিশের খেয়াল থাকে না। বড়মামা যখন পাশের ঘরে থেকে ‘মোহন মোহন’ করে চিৎকার করছেন মেজোমামা তখন বর্শার ফলায় মানুষের মুন্ডু গেঁধে নাচাচ্ছেন। বড়মামার চিৎকারে ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন। গল্প বলার মেজাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বললেন, ‘বলে এসো তো, মোহন মারা গেছে। আর বলে এসো ডোন্ট শাউট।’
মেজোমামার হাত থেকে ছাড়া পাবার সবচেয়ে বড় সুযোগ। সকালবেলাই সারা ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিয়ে ছেড়ে দেবেন। মাঝে মাঝে উটকো প্রশ্ন করে আমার জ্ঞান পরীক্ষা করবেন। না পারলেই মিনিটখানেক ছি ছি শব্দ করে বললেন, ‘যাও, এনসাইক্লোপিডিয়ার ছ ভল্যুমটা নিয়ে এসো, নিয়ে এসো বারো, কি সাত। প্রত্যেকবার টুলে উঠে-উঠে ভারী-ভারী বই পাড়ো, ধুলো ঝাড়ো। আর পাতার পর পাতা রিডিং পড়ো। গরমের ছুটিতে মামার বাড়িতে কি এই জন্যে আসা। এসেছি বাগানের আম, জাম, জামরুল, ফলসা খেতে।
বড়মামার ঘরের দরজার সামনে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ভেতরের দৃশ্যটা দেখার মতো। দরজার পর্দাটা একপাশে সরানো। জানলার কাছের ছোট টেবিলে দরজার দিকে পিছন ফিরে বড়মামা বসে আছেন। টকটকে লাল সিল্কের লুঙ্গি। গায়ে ধবধবে সাদা স্যান্ডা গেঞ্জি। পৈতেটা দেখা যাচ্ছে। পৈতের সঙ্গে বাঁধা চাবি কোমরের কাছে দুলছে। ফর্সা চেহারা। চওড়া পিঠ। নধর মাংসর দুটো হাত।
চেয়ারের হাতলের ওপর সামনের দুটো পা তুলে দিয়ে লাকি লাল মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সারা গা-ভর্তি সাদা-সাদা বড়-বড় লোম। মুখটা ভারি মিষ্টি। ঝুমকো-ঝুমকো লোমের ভেতর থেকে চকচকে দুটো চোখ উঁকি মারছে। লাকি চেষ্টা করছে বড়মামার সঙ্গে ভাব করতে। মুখটাকে ছুঁচলো করে ফোঁস ফোঁস করে শুঁকছে। মাঝে মাঝে জিভ বের করে বড়মামার হাতের ওপর দিকটা চুক চুক করে চেটে দিচ্ছে। লাকি যত কাছাকাছি সরে আসার চেষ্টা করছে, বড়মামা ততই শরীরটাকে ডানদিকে মুচরে মুখ ঘুরিয়ে বোঝাতে চাইছেন, লাকির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। আর ডানদিকে ঘোরানো সেই মুখ অনবরত চিৎকার করে চলেছে, ‘মোহন, মোহন’।
আমি ঘরে ঢুকতেই লাকি নেমে পড়ল। মুখ নিচু করে আমার কাছে এসে ফোঁস ফোঁস করে বার কতক আমাকে শুঁকে, বুকের ওপর দুটো পা তুলে জিভ বের করে হ্যা হ্যা করল কিছুক্ষণ। বড়মামা তখনও মুখ ঘুরিয়ে আছেন। কুকুরের মুখ দেখবেন না। বড়মামা ভেবেছেন, মোহন এসেছে। বেশ রেগেই বললেন, ‘কোথায় থাকিস রাস্কেল! ইডিয়েটটাকে ঘর থেকে বের করে দে। বলে দে, আমার সঙ্গে ওর আর কোনো সম্পর্ক নেই। কোনও সম্পর্ক নেই।’
‘কেন বড়মামা?’
আমার গলা পেয়ে বড়মামা খুব লজ্জা পেয়ে ঘুরে বসলেন। হাসতে গিয়েও হাসলেন না। হাসলেই লাকি দেখে ফেলবে। মুখটাকে বেশ চেষ্টা করে গম্ভীর রেখেই বললেন, ‘ও, তুমি! আমি ভেবেছিলুম মোহনানন্দ। সকাল থেকে তিনি কোথায় আনন্দ করতে গেলেন?’
লাকিটা এমন করছিল, মাথায় হাত রেখে একটু আদর না করে পারলুম না। বড়মামা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘ওর সঙ্গে একদম মিশবে না। একেবারে বখে গেছে। উচ্ছন্নে গেছে।’
‘কেন বড়মামা?’
‘ওকেই জিগ্যেস করো।’
সে আবার কী! ওকে জিগ্যেস করব কী! বড়মামার কুকুর কথা বলে নাকি!
‘ও কী করে বলবে বড়মামা! ও কি কথা বলতে পারে!’
‘সব পারে, সব পারে, ওর মতো পাকা সব পারে! শুনবে ওর কীর্তি? অকৃতজ্ঞতায় ও মানুষের ওপর যায়, এমন কি, তোমার মেজোমামাকেও ছাড়িয়ে যায়!’
আবার মেজোমামাকে ধরে টানাটানি কেন! মেজোতে বড়তে ভাবও যেমন, ঝগড়া তেমন। গতকাল রাতে খেতে বসে আম নিয়ে ঝগড়ার জের চলেছে বুঝলাম। বড়মামা কবে নাকি গোলাপখাস বলে নার্সারি থেকে একটা আমগাছ খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে বাগানে বসিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিরাজউদ্দৌলার বাগানেই খালি এই আম হত, এইবার হবে সুধাংশু মুকুজ্যের বাগানে। সেই গাছে এবছর প্রথম আম ধরেছে। আর সেই আম খাওয়া হচ্ছিল কাল রাতে। মেজোমামা ঘন দুধে আম চটকে এক চুমুক খেয়েই, ব্যাল্যাব্যাম বলে মুখের একটা শব্দ করে বাটিটা নামিয়ে রেখেই বললেন, ‘বড়দা, এই তোমার গোলাপখাস, এর নাম তেঁতুলখাস। দুধটাই নষ্ট হয়ে গেল। কী ক্ষতিই যে হল! দুধ না খেলে আমার আবার সকালে ভীষণ অসুবিধে হয়।’
বড়মামা ততক্ষণে আমটা চেখেছেন। বড়মামার মুখের চেহারাও ভীষণ করুণ। কিন্তু মেজোর কাছে হেরে গেলে চলবে না। বললেন, ‘জীবনে রিয়েল গোলাপখাস তো খাসনি। সে খেয়েছি আমরা। গোলাপখাস একটু টকমিষ্টিই হয়! তবেই না তার টেস্ট। তোর মতো নাবালকের বোম্বাই-টোম্বাই খাওয়া উচিত।’
রাত এগারোটা পর্যন্ত এঁটো হাতে দু’ভাইয়ে আম নিয়ে খুব দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল। শেষে সিদ্ধান্ত হল, বড়মামার গাছ বড়মামারই থাক। মেজোমামা ল্যাংড়াই খাবেন। গোলাপ ফুল ভদ্রলোকে হয়তো সহ্য করতে পারে, তবে গোলাপখাস ভদ্রলোকের আম নয়। শিশুরা খেতে পারে, কারণ শিশু আর ছাগল একই জাতের জিনিস।
বড়মামা লাকির অকৃতজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মেজোমামার সঙ্গে তুলনা করলেন। করে বললেন, ‘কুকুর কখনও মানুষ হয় না, বুঝেছ? মানুষ কিন্তু কুকুর হতে পারে।’
কথাটা শুনে কিনা জানি না, লাকি বারকতক ভেউ ভেউ করে উঠল। বড়মামা বললেন, ‘ওকে চুপ করতে বলো। এখানে কাজের কথা হচ্ছে।’
আমাকে বলতে হল না। বুদ্ধিমান কুকুর নিজেই বুঝতে পেরেছে। সামনের থাবায় মুখ রেখে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বড়মামা আড়চোখে একবার দেখে আবার শুরু করলেন, ‘মাসে কুড়ি টাকার বিস্কুট। সত্তর টাকার মাংস। পঞ্চাশ টাকার দুধ। তিন কৌটো পাউডার। পঁচিশ টাকার ওষুধ। পনেরো টাকার সাবান। সব, সব ভস্মে ঘি ঢালা। সেই অকৃতজ্ঞ কুকুর আজ আমাকে অপমান করেছে। নিজেরই ভাই অপমান করলে সহ্য হয়, প্রতিবেশী লাথি মারলেও হজম করে নিতে হয়। নিজের কুকুর অপমান করলে সহ্য হয় না। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।’
বড়মামা লাকির দিকে সামান্য ঝুঁকে বেশ জোরে জোরে বলে উঠলেন, ‘বুঝেছিস? আত্মহত্যা, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। না, নো, নো, ন্যাজ নাড়লে আমি আর ভুলছি না। তোমার ন্যাজের খেলা আমার জানা হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। নো সম্পর্ক।’
লাকি সামনের থাবায় সেইভাবে মুখ রেখে, চোখ বুজিয়ে বুজিয়ে, পটাক পটাক করে ন্যাজ নাড়ছে।
এতক্ষণ অনেক কথা হল, বড়মামার রাগের কারণটা কিন্তু বোঝা গেল না। কাল রাতে শুতে যাবার আগে আম নিয়ে মেজোমামার সঙ্গে রাগারাগি হয়ে যাবার পর খোলা বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে, কুকুরকে পেটের ওপর ফেলে বড়মামা যেসব কথা বলছিলেন তার কিছু কিছু তো এখনও মনে আছে। বুরুশ বোলানো হচ্ছে কুকুরের লোমে, আর কথা হচ্ছে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি বুঝেছি, তুই এবার একদিন মানুষের মতো কথা বলবি। হ্যাঁ হ্যাঁ, মানুষের চেয়ে তুই ফার, ফার, ফার, ফার বেটার। অ্যাই কী হচ্ছে কী, নাল লেগে যাচ্ছে না মুখে! উঁহু, উঁহু আর না, আর না। দেখি পেটের দিকটা চিত হও, চিত হও। কী হল, কাতুকুতু লাগছে?’
সেই কুকুর কী এমন করল। এই সাতসকালে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে? মেজোমামা ওদিকে হাঁকাহাঁকি শুরু করেছেন। ‘কী হল হে তোমার! এখানে জ্ঞানের কথা হচ্ছে, ভালো লাগবে কেন! গিয়ে পড়লে কুকুরের খপ্পরে।’
বড়মামার কপালটা একটু কুঁচকে গেল। আমাকে বললেন, ‘জিগ্যেস করো তো কুকুর কি জ্ঞানের জগতের বাইরে। দর্শনশাস্ত্রটাই জ্ঞান, প্রাণী-তত্ত্বটা জ্ঞান নয়, ফেলনা জিনিস? জিগ্যেস করো তো পৃথিবীতে কত রকমের কুকুর আছে, জানে কিনা! ওর জ্ঞানের দৌড় জানা আছে। পৃথিবীটাই জানা হল না, উনি ঈশ্বর ভগবান এই সব নিয়ে ভেবে ভেবে মরে গেলেন।’
দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললুম, ‘এখুনি আসছি মেজোমামা।’
‘ধ্যাত! তোর আঠার মাসে বছর। আসতে আসতেই আমার কলেজ যাবার সময় হয়ে যাবে। ভেবেছিলুম, পৃথিবীর একটা পার্ট শেষ করে যাব।’
কথা শেষ করেই মেজোমামা, ‘মোহন, মোহন’ করে চেঁচাতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে বড়মামারও মনে পড়ল মোহনের কথা। দুজনেই তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘মোহন, মোহন!’
লাকিটা বকুনি-টকুনি খেয়ে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল। চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে পড়ে, ছোট্ট একটা ডন মেরেই বড়মামার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বার কতক ভেউ ভেউ করে, রাস্তার দিকের জানালায় পা দুটো তুলে দাঁড়াল।
আমি এক কদম এগিয়ে ব্যাপারটা দেখে নিলুম। কেন কুকুরটা ওরকম করছে! সামনের বাড়ির বারান্দায় ঠিক লাকির মতো আর একটা কুকুর এ জানলার দিকে তাকিয়ে আছে আর পুটুক পুটুক ন্যাজ নাড়ছে। ও কুকুরটা কিন্তু এটার মতো কেঁউ কেঁউ করছে না বা পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করছে না। দেখলেই মনে হয় কুকুরটা একটু দুষ্টু ধরনের। আমার বন্ধু অরুণের মতো। পড়ার ঘরে বেশ মন দিয়ে হয়ত পড়তে বসেছি, বাইরের জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখে একটুও কথা নেই। মুচকি মুচকি হাসি, স্থির দৃষ্টি। চোখের পাতা নাচিয়ে যা বলার বলে গেল—বইপত্তর মুড়ে উঠে আয়, পড়ার সময় অনেক পাবি, এমন সকাল পাবি কোথায়! অমনি, এই লাকির মতোই মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগল। বাইরের চুপচাপ লাকি ভেতরের বন্দী লাকিকে ডাকছে।
‘আজ সকাল থেকে তুমি এই করছ।’ বড়মামার তর্জন-গর্জন থামেই না দেখি। ‘সকালেই আমি তোমাকে ভালো কথায় বুঝিয়েছি, বাইরে যাওয়া চলবে না, বাইরের কুকুরের সঙ্গে মেশা চলবে না। বাগান আছে, তুমি বাগানে ঘোরো, ছাদ আছে, ছাদে কাঠের বল নিয়ে খেলো। আমি যতক্ষণ আছি আমার সঙ্গে ঘোরো, খেলা করো, কিন্তু মিত্তিরদের বাড়ির ওই নোংরা কুকুর দেখে তোমার মাথা খারাপ করা চলবে না। ওরা আমাদের তিন পুরুষের শত্রু।’
‘এই যে মোহন,’ বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন। ফিরে দেখলুম, মোহন মেজোমামার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে। ‘ফার্স্ট আমি ডেকেছি, তুই আগে আমার কাছে আসবি!’
মেজোমামা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘ফার্স্ট সেকেন্ডের কী আছে রে। তুই আগে আমার ওষুধ তৈরি করে দিয়ে তারপর যেখানে যেতে হয় যাবি!’
বড়মামা বললেন, ‘বা হে বাঃ; খলে ঘষে ঘষে তোমার কবিরাজি ওষুধ তৈরি করে ও সকালটা কাটিয়ে দিক, ওদিকে আমি বসে থাকি হাঁ করে। কুকুরের জন্য কিমা না আনলে ও দুপুরে খাবে কী, উপোস করে থাকবে!’
‘কিমা! কুকুরের কিমা!’ মেজোমামা এমনভাবে হাসলেন যেন বড়মামা অদ্ভুত উদ্ভট কোনও কথা বলছেন। তারপর বড়মামার চোখের সামনে আঙ্গুল নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন, ‘জানো না রাস্তায় সব গাড়ির আগে যায় অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার বিগ্রেড। এমার্জেন্সি, বুঝেছ, এমার্জেন্সি। যা মোহন, প্রথমে ঘষবি দারুহরিদ্রা, তাতে দিবি গোলঞ্চর জল, বড়িটাকে ১৫ মিনিট খলে ঘষবি মধু দিয়ে, তারপর সব এনে হাজির করবি আমার টেবিলে। চলো ভাগনে!’
আমি কিছু প্রতিবাদ করার আগে মেজোমামা আমাকে প্রায় হাতে হাতকড়া লাগাবার মতো করে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন, ‘মূর্খ হয়ে থাকতে চাস। জানিস, পৃথিবীতে কত কী শেখার আছে! এক জীবনে মানুষ সব পারে না।’ আমি বললুম, ‘তাই তো হাঁসের মতো দুধ আর জল থেকে শুধু জলটা তুলে নিতে চাই।’
‘উলটে গেল হে, উলটে গেল’, কথা বলতে-বলতে মেজোমামা আলমারি খুলে একটা বুলওয়ার্কার বের করলেন, ‘বুঝেছ, যার মাথার কাজ করে তাদের একটু করে ব্যায়াম করা উচিত।’ মেজোমামা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বুলওয়ার্কার টানতে লাগলেন। যতটা না টানছেন তার চেয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন।
একটা মোটর সাইকেল সশব্দে বাড়ির সীমানা থেকে উল্কার মতো বেরিয়ে গেল। বড়মামা এমনিই খুব জোরে চালান, আজ আবার রেগে আছেন। নিজেই বেরিয়ে পড়েছেন দেড় মাইল দূরের বাজার থেকে কিমা কেনার জন্যে। জাফরের দোকান ছাড়া মাংস কেনা চলবে না। তা না হলে কাছাকাছি আরও একটা দোকান ছিল।
দু’মামা আর এক মাসির কাণ্ডকারখানা চলেছে এ-বাড়িতে। বড়মামা ডাক্তার। মেজোমামা প্রফেসর। মাসি সকালের স্কুলের টীচার। বাড়িতে গরু আছে, পাখি আছে, কুকুর আছে, বাগান আছে, একগাদা কাজের লোক আছে। মাঝেমাঝেই বড়মামা মেজোমামার লড়াই আছে, গলায় গলায় ভাব আছে। নেই কেবল মামিমা। বুড়ি দিদিমা ছেলেদের ওপর রাগ করে কাশীবাসী।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল বড়মামা ফিরছেন না। স্নানের পর গায়ে পাউডার মাখতে মাখতে মেজোমামা বললেন, ‘বাব্বা! বড়বাবু কি ব্যারাকপুর থেকে খিদিরপুর গেলেন কুকুরের কিমা কিনতে! কুকুর কুকুর করেই ডাক্তারবাবু কাবু হয়ে গেলেন। তুমিই বলো, ওষুধ আগে না কুকুর আগে।’
কী আর বলব, চুপ করে শুনছি। ছবির বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, মাসি এসে গেলে তবু আর এক দফা মুখরোচক খাবারদাবার জুটত।
মেজোমামার জামাকাপড় পরা হয়ে গেল। জানলা দিয়ে উত্তরদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাবালে দেখছি। উঁহু ভালো ঠেকছে না হে। এতক্ষণ দেরি হবার তো কথা নয়। বাবু রেগেমেগে যেভাবে বেরিয়ে গেলেন। এসব রাস্তায় অত জোড়ে গাড়ি চালানো কি ঠিক! না ফিরলে বেরোতেই পারছি না। এদিকে প্রথম ক্লাসের সময় হয়ে এল। লঞ্চে করে গঙ্গা পেরোতেই তো আধঘণ্টা লেগে যাবে।’
হঠাৎ দূরে মোটর বাইকের শব্দ হল। ভীষণ বেগে আসছে। আমরা জানলার কাছে সরে এলুম। মেজোমামা বললেন, মনে হচ্ছে বড়বাবু!’ হ্যাঁ বড়মামাই। লাল ঝকঝকে মোটর সাইকেল। পরনে লাল লুঙ্গি। গায়ে গোলগলা গেরুয়া গেঞ্জি। উল্কার বেগে বড়মামা বাড়ির সামনে দিয়ে পশ্চিমে বেরিয়ে গেলেন। মাথার ঝাঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়ছে নটরাজের জটার মতো। বড়মামার দশহাত পেছনে ব্যারাকপুরের বিখ্যাত ভোলা। সেও খ্যাড়াখ্যাট খ্যাড়াখ্যাট করতে করতে বেরিয়ে গেল। ভোলা হল ইয়া তাগড়া এক ষাঁড়। বাজার অঞ্চলে ভোলার ভক্ত সংখ্যা কম নয়।
মেজোমামা বললেন, ‘সেরেছে! বড়বাবুকে দেখছি গঙ্গার জলে না ফেলে দেয়। একে ভোলা, তায় লাল মোটর বাইক, তার ওপর লাল লুঙ্গি, তার ওপর ওই পিলে-ফাটানো শব্দ। কে বাঁচাবে বড়বাবুকে!’
মেজোমামা চিন্তিত মুখে ঘর থেকে রাস্তার দিকের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। আমি পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। বলতে কী, দারুণ মজাই লাগছিল। রেসটা বেশ জমেছে! বড়মামা হারেন, কি ভোলা হারে! রাস্তাটা সামনে গিয়ে গোল একটা প্যাঁচ মেরে আবার ফিরে এসেছে। বেশ জটিল ট্র্যাক। বড়মামা ঘুরে আসছেন, এবার বেগ আরও বেশি। ভোলার স্পীডও যেন বেড়ে গেছে। ভোলা রেগে গেছে, বড়মামাকে হারাতে পারছে না কিছুতেই।
বাড়ির সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতে যেতে বড়মামা চিৎকার করে বললেন, ‘শান্তি, ষাঁড়টাকে কোনোরকমে গ্যারেজ করে দে।’
মেজোমামা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কী করে ষাঁড় গ্যারেজ করি বলো তো। ষাঁড় তো আর গাড়ি নয়!’ দুজনে নেমে রাস্তার পাশে এলুম। কাজের লোকজন কাজ ফেলে এসেছে। মোহনের নানা প্ল্যান। সে একটা লাঠি এনেছে। ষাঁড়কে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেবে। অতই সহজ! নিজেই ছিটকে পড়বে নর্দমায়! মজা দেখার জন্যে আশপাশের বাড়ির জানলা দরজায় বড় ছোট মুখ। মিত্তিরদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি কিশোর হুইসিল বাজাচ্ছে।
বড়মামা ওদিককার গোল রাস্তা দিয়ে আবার এদিকে তীরবেগে আসছেন। পেছনে ল্যাজ তুলে ভোলা। এদিকে প্রথম রাস্তায় যাবার সময় বড়মামা বললেন, ‘একটা কিছু কর, তেল ফুরিয়ে আসছে। আর পরছি না।’ বড়মামা আসতেই মিত্তিরদের বাড়ির ছেলেটা ফুরর ফুরর করে বাঁশি বাজাল। সমস্ত জমায়েত পাশে দাঁড়িয়ে হো হো করে উঠল।
পশ্চিমের দিক থেকে বড়মামা আবার আসছেন। বড়মামা বেশ ক্লান্ত, বিব্রত। বড়মামা বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর থেকে আমাদের পাশ দিয়ে তীরবেগে সাদা মতো কী একটা রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ল—বড়মামার কুকুর লাকি। ভয়ে আমরা চোখ বুজে ফেলেছি। দু’গজ দূরে বিশাল ভোলা লাফাতে লাফাতে আসছে। লাকি একলাফে ভোলার মুখের ওপর লাফিয়ে উঠল। ভোলার চোখ চাপা পড়ে গেছে, লাকি নাক কামড়ে ধরেছে। ভোলা এক ঝটকা মেরে লাকিকে ফেলতে ফেলতেই বড়মামা ঘুরে এসেছেন। মোহন কাঠি বাগিয়ে তেড়ে গেছে। এইবার উলটো রেস—ভোলা ছুটছে আগে, বড়মামা তাড়া করে পেছনে।
আমরা দৌড়ে গেলুম লাকির কাছে। একটা বাড়ির রকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। যে মেজোমামা কুকুর দেখলে দশ হাত দূরে পালান, সেই মেজোমামা কলেজে যাবার ধবধবে পোশাকে লাকিকে কোলে তুলে নিয়েছে। চোখ দুটো ছলছলে। ভোলাকে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে, বড়মামা ফিরে এসে বাইকটাকে কোনোরকমে ফেলে রেখে, ধরা গলায় ‘লাকি লাকি’ করছেন। মাসিও এসে গেছেন।
দেখতে দেখতে বাড়ি হাসপাতাল। বড়মামার বন্ধু পশু-চিকিৎসক ডাক্তার বরাট এসে গেছেন। দুই মামারই বারেবারে এক প্রশ্ন, ‘বাঁচবে তো, বাঁচবে তো!’ বরাট বলছেন, ‘বেশ একটু শক লেগেছে। সারতে সময় লাগবে কয়েক দিন। আমি ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলুম।’
সন্ধেবেলা লাকি বড়মামার নরম বিছানায় পাখার তলায় ঘুমোচ্ছে। মাসি চিঁড়ে ভাজছেন। মেজোমামা ইজিচেয়ারে বসে বিশাল মোটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। মুখটা খুব বিষণ্ণ। মাঝে-মাঝে পিট-পিট করে লাকির দিকে তাকাচ্ছেন। বড়মামা দুপুর থেকে লাকির পাশে সিস্টারের মতো বসে আছেন।
হঠাৎ বড়মামা বললেন, ‘বুঝলি শান্তি! রাগ চণ্ডাল!’
মেজোমামা বললেন, ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমরা দুজনেই ভীষণ রাগী।’
বড়মামা বললেন, ‘বাবা ভীষণ রাগী ছিলেন।’
মেজোমামা বললেন, ‘মা-ও তা-ই। বরং বেশিই ছিল।’
বড়মামা বললেন, ‘আসছে বার কুকুর হয়ে জন্মাব।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমিও। লাকিকে দেখে আজ আমার জ্ঞান হল।’
বড়মামা মেজোমামার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হাত মেলা।’ দু’মামার করমর্দন, আর ঠিক সেই সময়ে সারাদিন পরে লাকি প্রথম দু’বার শব্দ করল—ভুক, ভুক! সঙ্গে সঙ্গে দু’মামার উল্লাসের চিৎকার, ‘লাকি, লাকি!’
লাকি বিছানার ওপর লাফিয়ে উঠে ডাক ছাড়ল, ‘ভৌ—ঔ—’।