উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

বড়মামার দাঁত

বড়মামার দাঁত

এক

বড়মামার সাত সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মেজাজ তেমন সুবিধের নয়। এই সময় কেউ সুপ্রভাত বললে, খ্যাঁক করে উঠবেন। পেয়ারের কুকুর লাকি, সুপ্রভাত জানাবার জন্যে সোফা থেকে নেমে এল তড়াক করে। এতদিন কুকুরের সঙ্গে থেকে কুকুরের ভাষা বুঝতে শিখে গেছি। কুকুরের ভাষা ল্যাজে। মুখ দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে যা বেরায় তার কোনও মানে নেই। মানুষ যখন ঢেঁকুর তোলে তার কোনও মানে থাকে? একটাই মানে, পেট খুব ভরে গেছে। কুকুর কথা বলে ল্যাজে।

লাকি সামনের দু’পা তুলে ধেই ধেই করে নাচছে, আর পুটুক পুটুক ল্যাজ নেড়ে বলছে—সুপ্রভাত, সুপ্রভাত।

বড়মামা লাকিকে ইংরেজিতে এক ধমক লাগালন, স্টপ দ্যাট নুইসেনস। বলেই মনে পড়ল জীবজন্তুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে নেই, তারা মানুষ নয়, ছাত্র নয়, কর্মচারী নয়। সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করলেন, সরি, সরি লাকি। লাকি চক চক করে হাত চেটে দিয়ে জানিয়ে দিলে, ক্ষমা করলুম।

বড়মামার ভুরু কুঁচকে আছে। আমার দিকে তাকালেন। এমন মুখ এর আগে আমি আর কখনও দেখিনি। বেশ ঘাবড়ে গেলুম। এ মুখ প্রধান শিক্ষকের হতে পারে, আমার বড়মামার কখনোই নয়।

বড়মামা বললেন, হ্যাঁ, তুমি আমার একটা উপকার করতে পারবে?

—বলুন।

—ওই সাজিটা নাও।

—ফুল তুলতে হবে?

—ব্যস্ত হয়ো না। ওয়েট। কি করতে হবে, আমিই তো বলব।

—না, সাজিতে তো ফুলই তোলে। তাই?

—বড়মামা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, তা হলে, তাই তোলো, আমার উপকার তোমাকে আর করতে হবে না।

—আচ্ছা, বলুন, কি করতে হবে?

—এক সাজি কচি কচি পেয়ারাপাতা তুলে নিয়ে এসো।

—ছাগলকে খাওয়াবেন বড় মামা?

—আবার প্রশ্ন!

বড়দের কথাবার্তা বোঝা দায়। এই বলবেন, যতক্ষণ না বুঝবে ততক্ষণ প্রশ্ন করবে। প্রশ্নের খোঁচা মেরে মেরে সব কিছু জেনে নেবার চেষ্টা করবে। এই তো তোমাদের জানার বয়েস। আবার একবারের বেশি দুবার প্রশ্ন করলেই রেগে কাঁই।

এক সাজি পেয়ারাপাতা এনে বড়মামার টেবিলে রাখলুম। আমার কাজ আমি করেছি। লাকি এসে পরিদর্শন করে গেল। কুরুরের সঙ্গে বসবাস করে আমি নিজেও একটা কুকুর হয়ে গেছি। অগৌরবের নয়, গৌরবের কুকুর। কুকুরের বোঝা আমিও বুঝি। কুকুর চোখ দিয়ে দেখে না, দেখে নাক দিয়ে। আমাদের বোধশক্তি যেমন মাথায়, কুকুরের বোধশক্তি তেমনি নাকে। নাক দিয়ে পাতা দেখে কুকুর সরে গেল, লক্ষ্মী মেয়ের মতো।

বড়মামা চোখ বুজিয়ে ভুরু কুঁচকে বসেছিলেন। পাতা এসেছে শুনে, চোখ খুললেন। বেলপাতায় শিবপুজো হয়। পেয়ারাপাতায় কি পুজো, কি জানি! মুখের যা চেহারা, প্রশ্ন করে জানার সাহস আর নেই।

বড়মামা টেবিলে একটা খবরের কাগজ বিছোলেন, তারপর মুঠো মুঠো পেয়ারা পাতা মুখে পুরে, চোখ বুজিয়ে চিবোতে শুরু করলেন। এ আবার কি ধরনের আয়ুর্বেদিক ব্রেকফাস্ট! চিবোনো পাতা ফেলতে লাগলেন কাগজে। লাকি পাশের চেয়ারে প্রসাদের লোভে এসে বসেছিল। অবাক হয়ে, বড়মামার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। লাকি বিস্কুট বোঝে, মাংস বোঝে, এমন সাত্ত্বিক আহার দেখে হাসি পাচ্ছে। মুখ দেখেই বুঝতে পারছি! বড়মামা বাগানের শামুকের মতো চিবিয়ে, চিবোনো পাতার একটা স্তূপ তৈরি করে ফেলেছেন।

লাকি ভৌ করে প্রশ্ন করলে, এ তোমার ইচ্ছেটা কি?

হঠাৎ বড়মামার কোঁচকানো ভুরু সমান হয়ে গেল। মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ ওঠার মতো, মুখে একটা হাসির ভাব খেলতে লাগল। যাক বাবা, বড়মামা এতক্ষণ পরে ফিরে আসছেন তাহলে!

চোখ খুলে বললেন, ‘গোইং গোইং গান। চলে গেছে।’ প্রশ্ন করার সাহস ফিরে এল। ‘কি হয়েছিল বড়মামা? গলায় মাছের কাঁটা ফুটেছিল?’

—না।

—তা হলে শুঁয়াপোকা?

—আজ্ঞে না। দাঁতের যন্ত্রণায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। জব্দ করে ফেলেছি। ভেষজের কি গুণ দেখেছিস? আমি ডাক্তারি ছেড়ে এবার কবিরাজি ধরব। চরক সুশ্রুত। অ্যালোপ্যাথি বোগাস! কাল থেকে আমি মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খেয়েছি। কিছুই হল না। পেয়ারা পাতার গুণ দেখ। দিশি দাওয়াই। বসবাস গাছে। তোরা সব সাহেব, বিলিতি বিলিতি করেই হেদিয়ে গেলি! আঃ মুখটা একেবারে ফ্রেস হয়ে গেল! মুখে যেন দুধের দাঁত ফিরে এলো।

মাসিমা চা নিয়ে এলেন।

বড়মামা বললেন, ‘এই নে তোর জন্যে কিছু বাঁচিয়ে রেখেছি।’

—কি আবার বাঁচালে?

—পেয়ারা পাতা। তোর দাঁত কন কন করছে না?

—শুধু শুধু দাঁত কন কন করবে কেন?

—বলা যায় না কুসি, করতেও পারে। কথায় বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। চিবিয়ে রাখ, চিবিয়ে রাখ। ভবিষ্যৎ ভেবে মানুষের কাজ করা উচিত।

চায়ের কাপ রেখে মাসিমা চলে গেলেন। বড়মামার সারাদিনের সব উপদেশ পালন করতে হলে পাগল হয়ে যাবার সম্ভবনাই বেশি।

বড়মামা চায়ে চুমুক দিয়ে মুখটা কেমন যেন করলেন। আর একর চুমুক খেয়ে বললেন, যার সঙ্গে যে জিনিস। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটটাই চলে। পেয়ারা পাতার সঙ্গে চা তেমন জমে না। গাছে গাছে কি শত্রুতা দেখ। চা-ও গাছ, পেয়ারা-ও গাছ, দু’জনে তেমন মিল নেই। সব মানুষের স্বভাব পেয়ে যাচ্ছে।

ধবাচুড়ো পড়ে বড়মামা মিলের হাসপাতালে চলে গেলেন। যে ক’টা পাতা বেঁচেছিল, যাবার সময় পকেটে পুরে নিয়ে গেলেন। বলা যায় না, আবার যদি কন কন করে। দাঁত নাকি মানুষের চেয়েও অপরাধপ্রবণ। সারা জীবনে অনেক পাপ কাজ করে। পাঁঠা চিবোয়, মুরগীর ঠ্যাং ভাঙে, মাছের জীবন নাশ করে। দাঁতের সব কাজই হল নাশকতামূলক। একটাও গঠনমূলক কাজের দৃষ্টান্ত নেই। সারাজীবন খিঁচিয়ে গেল, চিবিয়ে গেল, কামড়ে গেল। আর পাপের বেতন কি?

উত্তরে বললুম, মৃত্যু।

—রাইট। তাই মানুষের আগে দাঁত যায়।

নটার সময় বড়মামা গেলেন। খেল শুরু হল, বেলা এগারোটা থেকে।

প্রথমে এলেন এক ভোজপুরী হিন্দুস্থানী। বিশাল চেহারা। স্যাণ্ডো গেঞ্জি। বুকের ওপর পেতলের পদক। বাজখাঁই গলা। গলা শুনে মাসিমা ভয়ে দরজার আড়াল থেকে বললেন, ‘কি চাই?’

—হ্যাঁ, লিজিয়ে, বলে দৈত্যের মতো লোকটি কাঁধ থেকে একগাদা ডালপালা উঠনে ফেললেন। ‘ডাগদার বাবুকে লিয়ে দাঁতন। কোঠারি আছে, কোঠারি?’

লোকটির গলা বড়মামার ছটা কুকুরের ছ’রকম ডাকে ভালো করে শোনা যাচ্ছে না। মেজোমামা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে; বারবার জিগ্যেস করছেন, ‘কি হল কি, ডাকাত পড়েছে। কি হল কি, ডাকাত পড়েছে?’

আমরা যত বার বলছি, ‘না না দাঁতন এসেছে,’ কিছুতেই শুনতে পাচ্ছেন না। অনেক কষ্টে শোনানো গেল। তখন বললেন, ‘বসতে বলো, বসতে বলো।’

কোঠারি কি জিনিস মাসিমার মাথায় ঢুকছে না। কোঠারি তো অবাঙালীদের একটা পদবী। কোঠারি এ বাড়িতে আসবেন কেন। বড়মামার মিলের ম্যানেজারের নাম কোঠারি হতে পারে।

মাসিমা বললেন, ‘কোঠারি সায়েব মনে হয় মিলে আছেন।’

—নেহি, নেহি কাটনেকা কোঠারি।’

—ওঃ হোঃ কাটারি।

লোকটা কাটারি নিয়ে বসে গেলেন নিম দাঁতন কাটতে। ছটা কুকুর চিল্লে কাবু হয়ে গেল। তিনটে বিরক্ত হয়ে তিন দিকে শুয়ে পড়ল, হাত পা ছড়িয়ে।

পাতা ছাড়িয়ে সাইজ করে কেটেকুটে, বাণ্ডিল বেঁধে, মাল বুঝিয়ে দিয়ে লোকটি উঠে পড়লেন। হাতে ঘড়ি, কাঁধে তোয়ালে। একটা দাঁতন চিবোতে চিবোতে বাগানের রাস্তায় পড়ে বিকট সুরে গান ধরলেন, ‘আরে এ রাম ভজুয়ারে।’ দাঁতনমুখে সে এক বিকট গান। ঘুমন্ত কুকুর তিনটে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, আবার চেল্লাতে শুরু করল।

আধঘণ্টা পরে ফেজ মাথায় এক ভদ্রলোক এলেন। মুখে চাপা দাড়ি, গায়ে চিকনের পাঞ্জাবি। তিনি এলেন স্কুটার চেপে। পেছনে একগাদা ডালপালা।

আমাকে দেখে বললেন, ‘হাঁ, লিজিয়ে জনাব, ইয়ে ডকটর সাবকে লিয়ে।’ দোতলায় মেজোমামাকে দেখে বললেন, ‘সালাম আলেকুম প্রফেসার সাব।’

একের পর এক আসতে লাগল, গাবভ্যারেণ্ডা, আসশ্যাওড়া, নিসিন্দা। উঠোনে একটা জঙ্গল তৈরি হয়ে গেল। মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কি রে কুসি? আজ কি বনমহোৎসব?’

—না, মেজদা, বড়বাবুর দাঁতের যন্ত্রণা, এসব হল রুগীদের ভেট। বড়দাকে তো চেন! যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে তাকেই হয়তো বলছে, দাঁতের যন্ত্রণায় কি করা যায় বল তো?

—তা ডেনটিস্টের কাছে যাচ্ছে না কেন? দাঁতের যন্ত্রণায় একমাত্র দাওয়াই উপড়ে ফেলা।

—দাঁড়াও, অতই সোজা! বড়দাকে চেন না। কবিরাজি হবে, হাকিমি হবে, টোটকা হবে, সন্ন্যাসী ধরবে, তন্ত্র হবে, তারপর একদিন উপড়ে আসবে। উনি তো ধাপে ধাপে উঠবেন।

মেজোমামা বললেন, ‘ওকে চিনিস না, ভীতুর ডিম। কাটা ছেঁড়া নিপাতন উৎপাটনের নাম শুনলেই বড়বাবু কাত। নিজের শরীরে ওসব চলবে না, সব চলুক পরের শরীরে।’

লাকি এসে একটা নিসিন্দের ডাল সামনের দুপায়ে চেপে ধরে হাড়ের মতো চিবোতে শুরু করলো।

দুই

বড়মামার দাঁতের অবস্থা ভীষণ শোচনীয়। ঠান্ডা জল সহ্য হচ্ছে না, গরম জলও নয়। কেবল বলছেন, বডি টেমপারেচার। মাসিমা গরম আর ঠান্ডা, ঠান্ডা আর গরম করতে করতে পাগল হয়ে গেলেন।

খিঁচুড়ি ছাড়া অন্য কোনও খাদ্য দাঁত নিচ্ছে না।

বসার ঘরে উপদেষ্টারা বড়মামাকে ঘিরে বসেছেন। তাঁদের চা চলছে, বিস্কুট চলছে, পাঁপড় চলছে। বড়মামা শুধু দেখে যাচ্ছেন আর শুনে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে দাঁতের গোড়ায় ক্লোভ অয়েল ঠুসছেন। অক্ষয়বাবু বললেন, ‘ওতে কিছু হবে না ডাক্তার। দাওয়াই আছে আমার বড় বউমার কাছে, দাঁড়াও এনে দি এক দলা।’

রামবাবু বললেন, ‘জিনিসটা কি শুনি?’

—তামাকের মাজন।

—ও, গুড়াকু। অতি বাজে জিনিস। ডাক্তার খবরদার, ওর কথা শুনো না। একবার ধরেছ কি মরেছ।

—হ্যাঁ, তুমি সব জেনে বসে আছ? মেয়েরা ব্যবহার করছে।

—সে তো মাতঙ্গিনী হাজরা গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। তোমার বউমা বীরাঙ্গনা হতে পারে, সবাই তো আর বীর নয়।

দু’জনে ঝটাপটি বাধে আর কি, বড়মামা উহু, উহু করে উঠলেন।

বসাকবাবু পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করে বললেন, ‘ডাক্তার গোড়ায় এক টিপ টিপে ধরো। একেবারে অব্যর্থ। আমাদের সাধন কি কষ্টই না পাচ্ছিল! সারা ঘরে কেঁউ কেঁউ করে ঘুরছে আর বলছে, এর চেয়ে আত্মহত্যা করা ভালো। পকেট থেকে এই ডিবে বের করে বললুম, এক টিপ লাগাও, চেপে ধরো দাঁতের গোড়ায়। দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল, এ যে র-অ। বাঘের নাকে গুঁজে দিলে জঙ্গল ছেড়ে পালাবে। পরের দিন দেখি কি, মোল্লারচকের সাধন মাংসের দোকানে লাইন দিয়েছে। আমাকে দেখেই ছুটে এসে পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, ‘মামাবাবু, আপনি ধন্বন্তরি।’

অক্ষয়বাবু বললেন, ‘ডাক্তার, তুমি একবার কর্নেল বিশ্বাসকে দেখাও।’

বসাকবাবু বললেন, ‘সে হাত আর নেই, বয়েস হয়ে গেছে। দেখাতে হলে বোসই বেস্ট। সিকসটিতে আমার আক্কেল দাঁত এক ছুরির খোঁচায় এমন করে দিলে, বেরিয়ে এল, যেন খোল থেকে শামুক বেরলো।’

রামবাবু বললেন, ‘এটা কত সাল? এইটটি টু। বাইশ বছর আগের হাত আর এখনকার হাত!’

অক্ষয়বাবু বললেন, গুপ্তকে দেখাও। ছোকরার যেমন গুণ্ডার মতো চেহারা তেমনি অসুরের মতো শক্তি। একটানে শেকড়বাকড় সব উপড়ে আনবে।’

বসাকবাবু বললেন, ‘পয়সা খরচ করে গুপ্তর কাছে যাবার কি দরকার, গুপে গুণ্ডার কাছে গেলেই হয়। দু-চারটে গদ্দরত্বম গরম কথা হল ফি। এক ঘুষিতে গোটা ছয়েক ঝরিয়ে দেবে।’

সিদ্ধান্তে আসার আগেই সভা ভেঙে গেল।

বড়মামা কুঁই কুঁই করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। লাকিও চলল, পেছন পেছন ল্যাজ নাড়তে নাড়তে। ল্যাজের ভাষা, ‘কি করতে পারি, কি করতে পারি।’

তিন

রাত আটটা নাগাদ অবস্থা চরমে উঠল।

দাঁতের গোড়া থেকে মন ঘোরাবার জন্যে, বড়মামা প্রথমে চালালেন স্টিরিও রেকর্ডপ্লেয়ার। প্রথমে শ্যামাসঙ্গীত। হল না। অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ। পরপর এলেন, চলে গেলেন। টপপা খেয়াল হান মানল। যাত্রাপালা, নটী বিনোদিনী। ওষুধ ধরল না। রাগপ্রধান, কিচ্ছু হল না। এল ইংরিজি, অ্যাবা, ভেনচারম রনগডউইল ওসিবিসা বনি এম। কিছুতেই হল না। টিভিতে বাংলাদেশ।

মেজোমামা এসে বললেন, ‘নিউক্লিয়ার অ্যাটাক ছাড়া ও মন ঘুরবে না। যা বলি শোনো। আমার সঙ্গে ডক্টর পালের কাছে চলো। কোনও ভয় নেই।’

মাসিমা বললেন, ‘আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে। বাচ্চা ছেলেও দাঁত তোলাতে ভয় পায় না।’

মেজোমামা বললেন, ‘তোলার কথা আসছে কেন? তোলার হলে তুলবে, না হলে ওষুধ দেবে।’

শিশুকে যেভাবে ভোলায়, সেইভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে বড়মামাকে ডক্টর পালের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হল। পেছনে সাহস যোগাতে যোগাতে চললুম আমরা। মেজোমামা মাঝে মাঝে গীতার শ্লোকে আবৃত্তি করতে লাগলেন। শরীর হল আত্মার পোশাক। আত্মা এমন এক বস্তু, জলে গলে না, আগুনে পোড়ে না, অস্ত্রে কাটা যায় না। গুপে গুণ্ডা কিছু করতে পারে না। দাঁত আত্মা নয়। দাঁত হল পোশাকেরই একটা অংশ। দু’চারটে গেলে কিছু এসে যায় না। শেষ বয়েসে দাঁত পড়ে যাবেই। ঠাকুরদার পড়েছিল, বাবা পড়েছিল, মায়ের পড়েছিল, আমাদেরও পড়বে। দাঁত কখনও আপনার জন হয় না। হলে যন্ত্রণা দিত না। ভাগনে যেমন কখনও আপনার হয় না, দাঁতও সেইরকম।

আমাকে আর প্রতিবাদ করতে হল না। মাসিমা-ই এগিয়ে এলেন, ‘মেজদা কথা যখন বলবে, একটু ভেবেচিন্তে, বুঝেসুঝে বলবে।’

—কেন, কেন? অন্যায়টা আমি কি বলেছি? আমি শাস্ত্রের কথাই বলেছি। জন, জামাই, ভাগনা তিন নয় আপনা।

—ওটা জন নয়, যম।

—তুই আমার চেয়ে বেশি জানিস? জন মানে তৃতীয় ব্যক্তি, থার্ডপার্সন।

—আজ্ঞে না, ওটা যম।

—আজ্ঞে না ওটা জন।

সারাটা পথ জনে আর যমে জমজমাট লড়াই চলল।

ডক্টর পালের চেম্বার একেবারে ভর ভরাট। কাঁচের শো-কেসে তিনপাটি দাঁত, হাসছে না খিঁচিয়ে আছে বলা শক্ত। দাঁত একবারে মুখের বাইরে বেরিয়ে এলে তার ভাব আর ভাষা বোঝা যায়।

বড়মামা গাড়ি থেকে নেমে চেম্বারের সিঁড়িতে পা রাখতেই ডাঃ পাল অ্যাপ্রন পরে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘আরে ডাক্তার এসো, ডাক্তার এসো, কি সৌভাগ্য আমার।’

লম্বা চওড়া, বিশাল চেহারা। আমেরিকার বাস্কেটবল প্লেয়ারদের মতো চিউয়িংগাম চিবোচ্ছেন। হাতে এত লোম, মনে হচ্ছে ভাল্লুকের হাত।

বড়মামা ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘দাঁত নিয়ে বড় কষ্ট পাচ্ছি ডাক্তার।’

—আরে এ তো এক সেকেন্ডের ব্যাপার, ধরব আর টকাস করে তুলে দোব।

বড়মামা থেমে পড়লেন। করুণ গলায় ডাকলেন, ‘কুসি, এই দ্যাখ, কি বলছে?’ মেজোমামা সাহস দিলেন, ‘আরে উনি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। তুললেই হল? আমরা আছি না।’

কোণের দিক থেকে গালফুলো এক রুগী নাকিসুরে ডাকলেন, ‘ডাঁকতাঁর বাবু।’

ডাঃ পাল ডাকে কোনও সাড়া দিলেন না।

আমরা সদলে তাঁর ভেতরের চেম্বারে ঢুকে পড়লুম। দাঁত তোলার চেয়ারে বেল্ট বেঁধে একজনকে ফেলে রেখেছেন। বড়মামাকে সাধারণ একটা চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ‘হাঁ করো, দেখি কি অবস্থা করে এনেছ? আমাদের কাছে তো সব শেষের সময় হরিনাম করতে আসে।’

বড়মামা হাঁ করলেন। ডাঃ পাল টর্চের আলো ফেলে, লোহার একটা স্টিক দিয়ে দাঁত বাজাতে আরম্ভ করলেন। দাঁত যদি জলতরঙ্গ হত, এতক্ষণে শুরু হয়ে যেত কনসার্ট। রসগ্রহণ করলেও দাঁত বড় নীরস।

বড়মামা হঠাৎ একসময় বাঘের মতো আর্তনাদ করে উঠলেন, আঁউ।

‘আ, হিয়ার ইজ দি কালপ্রিট। ব্যাটা, তুমি কোণে বসে কেরামতি দেখাচ্ছ। তোর একদিন কি আমার একদিন।’

ভারী ওজন তোলার আগে মানুষ যেভাবে জোর নিঃশ্বাস নেয়, ডঃ পাল বুক চিতিয়ে সেইভাবে নিঃশ্বাস নিলেন। বড়মামা করুণ মুখে আমাদের দিকে তাকালেন।

আমরা সমস্বরে বললুম, ‘কোনও ভয় নেই!’

—তোমার ভয় করছে ডাক্তার! তা হলে দ্যাখো।

হাতে একটা যন্ত্র নিয়ে চেয়ারের লোকটির দিকে তেড়ে গেলেন। পেছন দিকে থেকোঁর মাথাটা চেয়ার-এর উঁচু হেডরেস্টে ঠেসে ধরে, মুখে যন্ত্র পুরে ডালাখোলা বাকসের মতো হাঁ করিয়ে দিলেন। পাশের ট্রে থেকে চকচকে সাঁড়াশির মতো একটা যন্ত্র হাতে নিয়ে দাঁত চেপে ধরলেন। কড়াক করে একটা শব্দ হল।

বড়মামা শিউরে উঠে চোখ বুজলেন। কড়মড় মড়ড় শব্দ হতে লাগল আর ডাক্তার রেগে রেগে বলতে লাগলেন, সব শেষ সময়ে এসে মরবে, আসবে একেবারে বারোটা বাজিয়ে।

প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টান মারলেন। লোকটির শরীর টান টান হয়ে গেল। সাঁড়াশির মুখে ধরা বর্শার ফলার মতো দাঁতের অংশ আকাশের দিকে তুলে ধরে বললেন, ‘শত্রুর শেষ রাখতে নেই।’

দাঁতটা ঠকাস করে একটা ডিশে ফেলে দিয়ে, মুখে ফ্যাঁসফোঁস করে খানিকটা ওষুধ স্প্রে করে দিয়ে চেয়ার থেকে লোকটিকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি সামনে কুঁজো হয়ে, টলতে টলতে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

ডঃ পাল বললেন, ‘কি বুঝলে ডাক্তার?’

বড়মামা চোখ ঢেকে বললেন—উঁ।

—এ সব আমাদের কাছে জল ভাত। দাঁত একটা জিনিস! ধরো আর ফেলো। নাউ, কাম হিয়ার।

বড়মামার চোখমুখ ছাইবর্ণ। আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পরীক্ষা-টরিক্ষা করে ডাক্তার পাল বসলেন।

‘দাঁড়াও, একটা ইনজেকশান দিয়ে ব্যাথাটা আগে কমাই। দাঁতটার অবস্থা তেমন ভালো নয় হে। ভেতর ভেতর বেশ বিগড়ে বসে আছে।’

মাড়ির পাশে পাশে পুটপুট করে কয়েকবার ছুঁচ ফুঁড়লেন ডাক্তারবাবু। ইনজেকশানেও বড়মামার ভয়। সিঁটিয়ে আছেন।

ইনজেকশান শেষ হতেই বড়মামা বললেন, ‘চলি তা হলে?’

—ব্যস্ত হচ্ছ কেন ডাক্তার! একটু বসে যাও। সারারাত কষ্ট পাওয়ার চেয়ে দু’দশ মিনিট বসে যাওয়া ভালো। তুমি ওই ডেক চেয়ারে বোসো।

বড়মামা বললেন। ডাঃ পাল চেয়ারে টেনে আনলেন এক মহিলাকে। সেই এক ব্যাপার। দাঁত আর দাঁতের মালিককে ধমক ধামক চলল। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। মুখে যন্ত্র পোরা। ডাক্তারবাবু সাট করে এক টান মেরেই ইস ইস করে উঠলেন। তারপর ভদ্রমহিলার দাঁতের সারি থেকে এক হ্যাঁচকা টানে আর একটা দাঁত তুলে আনলেন।

মহিলা ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বুঝলে ডাক্তার, অ্যানেসথেসিয়ার এই দোষ, যার তুলছি সেও বোঝে না কি তুলছি, যে তুলছে সেও বোঝে না কি তুলছে! ইস, মহিলার একটা ভালো দাঁত টেনে তুলে দিয়েছি।’

বড়মামা বললেন, ‘আমি এবারে উঠি ডাক্তার।’

‘উঠবে, উঠবে। জিভ দিয়ে দ্যাখো তো দাঁতের চারপাশটা বেশ অসাড় হয়েছে কি না!’

বড়মামা বললেন, ‘জিভ নাড়াতে পারছি না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে ভালো আর কি হবে?’

—তাই নাকি! কই দেখি, চেয়ারে একবার বোসো দেখি, একটু রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট করে দি। অসাড়ে ভালো হলে তো হবে না, সাড়ে ভালো হতে হবে তো।

বড়মামা চেয়ারে বসলেন।

মেজোমামা আর মাসিমা দু’জনে ফিস ফিস করলেন। কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে। চোখে চোখে আঙ্গুলের ইশারায় কোন একটা পরিকল্পনা পাকা হতে চলেছে। এর মধ্যে একজন কিছুই জানে না, বাকি সবাই জানে। ঘরের বাতাস উৎকণ্ঠায় থম থম করছে। যে কোনও মুহূর্তে একটা খুন হবে। মানুষ নয়। খুন হবে একটা দাঁত। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বড়মামা, পালান।

ডঃ পাল বললেন, ‘দেখি হাঁ কর তো ডাক্তার!’

বড়মামা হাঁ করলেন।

আমার চোখ ডাক্তার পালকে অনুসরণ করছে। তাঁর ডান হাতটা ধীরে ধীরে দাঁত তোলা সাঁড়াশির দিকে সরছে। অনর্গল কথা বলে চলেছেন, বড়মামাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে। ধীরে ধীরে সাঁড়াশিটা হাতে তুলে নিলেন। বড়মামাকে মাথার পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবেন হঠাৎ!

উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সাঁড়াশি উঠতে উঠতে বড়মামার ঘাড় পর্যন্ত উঠেছে।

আর পারলুম না। ‘বড়মামা, সাবধান!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলুম।

আমার চিৎকার, আর দাঁত তুলে দেবার আতঙ্কে, বড়মামা একেবারে জেমস বণ্ডের মতো হয়ে গেলেন। চেয়ার চরকিপাক খেল। কি হচ্ছে বোঝার আগে বড়মামা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে সুইংডোর ঠেলে একেবারে রাস্তায়।

বড়মামা ছুটছেন, দু’হাত পেছনে আমি ছুটছি। আমাদের পেছনে ধর ধর করে ছুটে আসছেন সাঁড়াশি হাতে ডেনটিস্ট, মেজোমামা, কয়েকজন পেশেন্ট। প্রাণভয়ের দৌড়ের সঙ্গে মিলখা সিংও পাল্লা দিতে পারবেন না।

বাজার এলাকা ছাড়িয়ে, হাইওয়ে পেরিয়ে আমরা শুকচরে ঢুকে পড়েছি। পেছন থেকে গাড়ির শব্দ, হেডলাইটের আলো ভেসে এল। বড়মামা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘আমার গাড়ি চেপে আমাকেই ধরতে আসছে। কুইক, নেমে পড়ো ওই মাঠের ঝোপে।

সাপের ভয় নেই, ব্যাঙের ভয় নেই। আমরা দুজনে ঝোপের মধ্যে। ওপরের রাস্তা দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল বড়মামার গাড়ি। বড়মামা, ফিস ফিস করে বললেন, ‘তুই আমাকে বাঁচালি। মেজোকে বলিস, ভাগনেই একমাত্র আপনজন।’

বড়মামা, ‘আপনার দাঁত?’

‘দাঁত? দাঁত এখন মুখ ছেড়ে মাথায় উঠে গেছে রে!’

2 Comments
Collapse Comments

বড়মামার দাঁত গল্পটি মিসিং, দয়া করে সংশোধণ করলে খুশি হব।

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) December 6, 2024 at 8:28 pm

ধন্যবাদ ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য। ঠিক করে দেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *