বজরা
বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
পঞ্চাশ বছর আগে হলে দেখা যেত এই বজরাখানারই গমক কত! ঝাড়লণ্ঠনের নিচে ফরাস বিছিয়ে সারেঙ্গীর উপর ছড় টানতো বড়ে মিঞা হারমোনিয়মের বেলো ছেড়ে দিয়ে ফাঁক বুঝে আতরমাখা পান তুলে নিত প্রেমচাঁদ আর রুপোর থালা সামনে মেলে ধরে রূপসী বাঈজীর মাতাল করা গান শুনতে শুনতে মেজকর্তা চেঁচিয়ে উঠতেন—কেয়াবাত কেয়াবাত ফুলবাই মেরি জান। হাঁ হে ওস্তাদ, অমন মিইয়ে পড়ছ কেন? সরাব টরাব ছোঁও না, শেষটায় বেলাইন পাকড়ে বসলে–আঁ? তারপর টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে যেত হাসির লহরা… কোমরে কানি গোঁজা ক্ষুদে ক্ষুদে জানোয়ারগুলো গেমোবনের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত— মেজকর্তা চলেছেন।
সেই মেজকর্তাও নেই, বজরাখানার ঠাকঠমকও ঘুচে এসেছে। গলুইয়ের সামনে পেতলের কাজ করা সিংহমূর্তিটা চটা উঠে তেকোণা বল্লমের ফলার মত আজও উঁচিয়ে আছে। কাঠের গায়ে সোনার জলের কাজ করা নগ্ন নারী চিত্রগুলোকে আজ আর বলে না দিলে চিনবার উপায় নেই। বজরাখানার সর্বাঙ্গ ছেয়ে আছে অজস্র এবড়ো খেবড়ো চলটায় রক্তদুষ্ট কোন রুগীর মত যেন।
আনন্দ চাটুয্যে বললেন, কত আর শুনবো বলতে বলতে এক মহাভারত হয়ে যায় কি ছিল আর কি হল। বাঈজী আর সরাব, সরাব আর বাঈজী। এক নম্বর ঘেরির ঠিক মুখটায় কতবার যে লাস টেনে বার করল পুলিস কে অত লিখেজুখে রাখে পড়ে পাওয়া বাপের সম্পত্তিতে মেজকর্তা ফুর্তি করেই কাটিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু লছমীবিবির বিষ-চক্করে ফেঁসে গেলেন শেষটায়। সেইটাই হল তাঁর কাল। তিন-তিনটে খুনখারাবি করে লটকে গেলেন পুলিসের জালে। শুনতে পাই একা টমাস দারোগাই পঞ্চাশ হাজার রূপোর চাকতি খেয়েছিলা। রাঘব বোয়াল থেকে কৈ খলসে সবাইকে আক্কেলসেলামী দিয়ে জাল ছিঁড়ে মেজকর্তা বেরুলেনা কিন্তু সেই বেরুনোই তাঁর শেষ বেরুনো। কেউ কেউ বলে, মেজকর্তা সন্ন্যাস নিয়েছেন, কেউ বলে সোনা দলুইয়ের বল্লমের খোঁচায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
সোনা দলুই কে?
বজরাখানা দুলে দুলে চলছিল। ভারি গমকী চালে। হ্যারিকেন উসকে দিয়ে আনন্দ চাটুয্যে হাঁক দিলেন, ও বিপিন, তেল ভরিসনি হ্যারিকেনে? নবাব চৌকিদার হয়েছিস দেখছি। হারামজাদা, তেল ভরে দে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বিপিন চৌকিদার।
হ্যাঁ, সোনা দলুই! আরে মাস্টার সে অনেক কথা! সোনা দলুইয়ের বাপ ছিল এ তল্লাটে জবরদস্ত লেঠেলা লুঠের মাল বেচে আটশ টাকা নগদ ঢেলে সোনার কালীমূর্তি বানিয়েছিল। কে বানিয়েছিল জানো? বৌবাজারের হীরেন কর্মকার। সে অনেক আগের কথা। কেউ কেউ বলে, প্রথম পুজোয় নাকি নরবলি দিয়েছিল লোকটা। অত না হোক, লোকটার ক্ষমতা ছিল। সারা তল্লাট কাঁপত ওর ভয়ে আটটি রাখনি পুষে কলকাতার ব্র্যান্ডি-হুইস্কি আনিয়ে লোকটার শেষ দিনগুলো ভালোভাবেই কাটছিল, কিন্তু বুড়ো হাড়ে কি যে নেশা লাগল, নজর পড়ল মেজকর্তার বাঈজী লছমীবিবির ওপর
বাঘের খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে বাঘের মুখ থেকে খাবার টেনে আনা সইবে কেন? বুড়ো গুম হল। সাত দিন পরে লাস যখন ভাসল, তখন আর কেউ না চিনুক সোনা দলুই চিনেছিল ঠিক। বাপকা বেটা
বুকের পাটা ছিল একখানা।
বিপিন চৌকিদার আলো দিয়ে গেল। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে রুপো-বাঁধানো সাবেকী কালের গঙ্গড়ায় গুড়ুক গুড়ুক করে কয়েকটা টান দিলেন আনন্দ চাটুয্যে
বাইরে আলকাতরার মত গাঢ় অন্ধকার। ভূতে পাওয়া স্তব্ধ দু’পাশের গেমোবন। নদীর জল বজরার গা চাটতে চাটতে চলেছে। আকাশের তারার মত জোনাকিগুলো চিকমিক করে জ্বলছে। আর নিভছে। কত রাত? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম, সবে সাতটা।
কিছুদিনের মধ্যেই মেজকর্তার বড় ছেলে বিলেত থেকে ফিরলেন আনন্দ চাটুয্যে আবার টানলেন গল্পটা আশ্চর্য! বরানগরের বাগানবাড়িতে ফুলের জলসা বসল না। বজরা ভাসিয়ে বাঈজী নিয়ে গোলাপজলের হোলি খেলল না শ্রীমান চঞ্চল বসুরায়। রায় ফ্যামেলির হীরের টুকরো ছেলে। চঞ্চল বললে কেউ চিনবে না, সবাই ওঁকে ডাকত বড়সাহেব। বিলিতি বিলিতি গন্ধ থাকত এই ডাকটায়।
লঞ্চ সিন্ডিকেট তখন সবে হয়েছে। তিনটে স্পীডবোট কিনে ফেললেন বড়সাহেব। মাছ ধরার তদারকে লাগিয়ে দিলেন নিজে এসে ধান কাটার দু’চার মাস এই আবাদে পড়ে থাকতেন দু’হাতে টাকা ছড়িয়ে প্রজারঞ্জন করতেন। সরাব ছুঁতে কেউ আমরা দেখিনি ওঁকে। কিন্তু
গড়্গড়ায় আবার দুটো টান দিলেন আনন্দ চাটুয্যে। আগুন চলকে উঠল কলকেয়। হালের ঘর্ষণে মিহি সুরে শব্দ উঠছে একটা। আর সঙ্গে সঙ্গে চারটে দাঁড়ের ভারি ভারি শব্দ, ঝপ ঝপ— ঝপ ঝপা তাকিয়ে দেখলাম আনন্দ চাটুয্যে এখন শুধু ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টই নন, এ আনন্দ চাটুয্যের রূপ আলাদা।
পঞ্চাশ বছর আগেও এমনি করে শব্দ হত দাঁড়ের। আজও সেই একই শব্দ। বিরামহীন সময়ের তালে তাল দিয়ে চলেছে। বোধহয় এই শব্দটার সঙ্গেই তাল রাখতে পারেননি মেজকর্তা। হার স্বীকার করে পালিয়ে গেছেন বড়সাহেবা পালিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বসুরায় ফ্যামেলির সম্রাটকুলা জমা আছে, জমি আছে, কি নেই তবে? বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। আজ এসেছে পি-ইউ-বি আনন্দ চাটুয্যের মরসুম। কিছু কিছু আমি আগে শুনেছিলাম বলেই গল্পটা আমার কাছে অসত্য মনে হচ্ছিল না।
কি হে মাস্টার, অমন গুম মেরে গেলে কেন? ভাল লাগছে না বুঝি? ওরে বনশী, রাত ভোর করবি নাকি? জোরে জোরে টান!
না না, বেশ লাগছে, তারপর বলুন।
বেশ লাগবেই। আবাদের ইতিহাস কেউ যদি লিখত নাম করে ফেলতা যাক, শোন। বড়সাহেবের কীর্তিটাই শোন। ভালোই গুছিয়েগাছিয়ে বসেছিলেন বড়সাহেবা দুটো টিউবওয়েল বসালেনা ঢেঁড়া পিটিয়ে লোভ দেখিয়ে হাটখোলাটাও বসালেন। লেখালেখি করে লঞ্চ আনলেন কুমিরখালির রাস্তায়। এ রাস্তায় না হলে লঞ্চ আসে! ঘাটা দিয়ে দিয়ে লঞ্চ কোম্পানি পাততাড়ি গোটাতো কবে, কিন্তু বড়সাহেবের নজরানাই টিকিয়ে রাখল শেষতক।
সেই বড়সাহেবও সাপের লেজে পা দিয়ে বসলেন একদিন। হীরা প্রধানের বউটার দিকে নজর ফেললেন। বউটাও ছিল অপরূপা প্রধানের ঘরে কি করে যে অমন গোলাপ ফুল ফুটেছিল কে জানো সাবান তেল গায়ে পড়লে না জানি কি হত। বউটাকে ছিনিয়ে এনে কাছারিবাড়িতে তুললেন বড়সাহেব।
তারপর দিন দুই পেরুতে না পেরুতে রক্তারক্তি কাণ্ড বোষ্টমপাড়ার পুব দিকের চকে ঘোড়া নিয়ে বড়সাহেব বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ঘোড়াসমেত উলটে পড়লেন মই না দেওয়া মাটির ডেলায়।
কিন্তু কি জানো মাস্টার, ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার ছেলে বড়সাহেব ছিলেন না। এ সেই হীরা প্রধানেরই কারবার। লোকটা তলে তলে গ্রামটাকে উসকে রেখেছিল।
বড়সাহেবের বুড়ো মা রাণীবিবি খবর পেয়ে ছুটে এলেন। বড়সাহেবকে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। তারপর থেকে কলকাতার সিংহাসনে বসে রাজকার্যের ভার নিলেন রাণীবিবি। লেঠেল নিয়ে নায়েব গোমস্তাই দেখাশুনো করতে লাগল জমিদারী।
আর এই জানোয়ারগুলিরও গোঁ বলিহারি। যা ভাববে তা করবেই। তবে আমার কাছে, বুঝলে মাস্টার, ঢিট হয়ে গেছে ব্যাটারা। সকালবেলা বিষ্ণু নাপিতের কাণ্ডখানা দেখলে তো, এক মুঠো ধান চুরির দায়ে কি মারটাই না খেল বিপিনের হাতে! আমি ছিলাম সামনে, ব্যাটা চুপ যাবার বেলা পায়ের ধুলো জিভে ছোঁয়াতেও ভুলল না। মার খেয়ে খেয়ে এখন ওদের শুয়োরের গোঁ কমেছে। দু’দিন থাকো সব দেখবে মাস্টার, সব দেখাবো।
কথায় কথায় কখন যেন নিজের প্রসঙ্গে এসে পড়েছিলেন আনন্দ চাটুয্যো সামলে নিয়ে হেসে উঠলেন হাসিতেই তাঁর ব্যক্ত হয়ে উঠল আর এক অধ্যায়। ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করি, তারপর?
তার আগেই আনন্দ চাটুয্যে শুরু করলেন, হ্যাঁ, যা বলছিলাম—
বলতে বলতে আবার তিনি থামলেন। রুপোর পাতমোড়া নলে টান দিয়ে বুঝলেন আগুন নিভে গেছে কলকেয়া ইতিহাসের স্তূপীকৃত জঞ্জালের মধ্যে হারিয়েই গিয়েছিলেন আনন্দ চাটুয্যে। চিৎকার করে উঠলেন, এই শালা শুয়ার বিপিন, তামাক দিয়ে যা।
বিপিন ভেতরে ঢুকল।
টং হয়ে ঘুমুচ্ছিলি বুঝি? সামলে না চলতে পারিস তো গিলিস কেন অতো, শুয়ার কোথাকার!
আমি বললাম, বজরার কি হল বলুন?
হ্যাঁ বজরা। কি বলব মাস্টার, এই যে জানোয়ারগুলো দেখছ–বিপিন তার পোকায় খাওয়া দাঁতগুলি বের করে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল, এগুলোর স্বভাবই হয়ে গেছে বিটকেলে ধরনের কেবল ঠুকঠুক, কোথায় মদের আড্ডা, কোথায় খানকির বাড়ি। আর বলো না মাস্টার, মেজাজ খিচড়ে দিয়ে যায়।
বজরাখানা ককিয়ে ককিয়ে চলেছে।
পি-ইউ-বি আনন্দ চাটুয্যে আবার শুরু করলেন, হ্যাঁ, বজরাখানার আদর বড়সাহেবও কম করেননি। ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে বন্দুক নাচাতে নাচাতে বজরা চলত সুন্দরবনের দিকে। বজরাতেই। রান্না হত, কলকাতার খানসামার হাতের রান্না, মানিক-জোড়ের তুলতুলে মাংস পোলাওয়া। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। বড়সাহেব কলকাতার মিস্ত্রি এনে বার দু’তিন সারাইও করলেন বজরাটা বছর বছর গাব খাওয়ালেনা বাপের শখের বজরা, ছেলে তার অসম্মান করেনি কোনদিন করবার কথা নয় ওদেরা
তারপর?
হয়ত আনন্দ চাটুয্যে আরও অনেক কথাই বলতেনা বজরাটাকে কেন্দ্র করে কয়েক পুরুষের চটকদার ইতিবৃত্ত। কিন্তু একটা ঝাঁকি দিয়ে বজরাটা থেমে গেল।
কোথায় এলাম রে বিপিন?
অন্ধকারের মধ্যে ভাল করে নজরে আসে না। বড় নদী ছাড়িয়ে একটা খালের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি বোধহয়।
বিপিন বলল, বউকাটার মুখে
বউকাটা খাল! নামটা শুনলেই বইয়ে পড়া উপন্যাসের মত মনে হয়। জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে খালটাকে ভাল করে নজরে আসে না। দু’পারে বসতি, কিছু কিছু জঙ্গল আর ক্ষেত—শাক, আলু, তরমুজ, রবিশস্যের হবে হয়ত।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল বিপিন। বউকাটার মুখে এলাম বড়বাবু।
তা থামলি কেন? বড়বাবু অর্থাৎ আনন্দ চাটুয্যে প্রশ্ন করলেন আমিরী চালে, এসেছে বুঝি শুয়ারটা?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখা করতে চায়।
দেখা করে কি করবে? না না, ভাগিয়ে দে হারামজাদাকে। যত সব ন্যাকা চৈতন।
বজরায় উঠে পড়েছে বড়বাবু।
উঠে পড়েছে, তবে আর কি, নাচি! আচ্ছা ডাক শালাকে।
বিপিন চলে গেল। আনন্দ চাটুয্যে বললেন, লোকটাকে দেখে রেখো মাস্টার।
পাথুরে কয়লার মত কালো বিরাট লোকটা বজরার মধ্যে ঢুকল। তারপর টানটান হয়ে বড়বাবুর পায়ে হাত ছুঁইয়ে গড় করল।
চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে বয়সেরা শ্লথ শিরাগুলো যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে লোকটাকে। গায়ে একটা আধ-ময়লা ফতুয়া পরনে দেশী তাঁতিদের হাতে বোনা ধুতি। কিন্তু চোখদুটো দেখলে চমকে উঠতে হয়। অস্বাভাবিক কাচের গুলির মত টকটকে লাল রংয়ের গন্ধটাও পাচ্ছিল।ম
লোকটা বাদী না আসামী বোঝা দায়।
কি চাস বল? আনন্দ চাটুয্যে কথার ঝাঁজে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
আপনি মা বাপ বড়বাবু। চিরকাল ছেলের দিকে তাকিয়েছেন, আজ আমার—বলতে বলতে লোকটা পাকা অভিনেতার মত কেঁদেই ফেলল।
বাইরে অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে রইলাম।
কান্নাকাটি ছেড়ে নথিপত্র কি এনেছিস দেখা এক একটা কাণ্ড করে বসবি, আর মাপও চাইবি সাতখুনের আবাদে আর টিকতে দিবি না দেখছি। বুঝলে মাস্টার, পি-ইউ-বি হয়ে এক দিকদারিতেই পড়েছি।
দিকদারিটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন না আনন্দ চাটুয্যে। লোকটা ড্যাবড্যাবে চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। বড় অস্বস্তিকর সেই চাউনি।
আবাদ পত্তনের ইতিহাস ক’দিনেরই বা হবে ষাট-সত্তর, বড়জোর একশ-দেড়শ বসুরায়ের আবাদ একশ’র ওপারে যায়নি। দানা বাঁধা উপনিবেশ তারও কমা পঞ্চাশ ষাট কি আরো কিছু বেশি অর্থাৎ পুরুষ দুই কেটে গেছে মাত্র। কিন্তু কি বিস্ময় এই আবাদের মাটিতে এক হাতে নদীকে দাবিয়ে রেখেছে আবাদের মানুষ, আর এক হাতে কচলে চলেছে খুন-রাহাজানি, জমিজমার দাঙ্গা, মদ মেয়েমানুষ অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে থেকে বারবার আমার সে কথাই মনে হচ্ছিল এই আবাদে মেজকর্তা টিকলেন না, বড়সাহেব পালিয়ে গেলেন, দুর্ভেদ্য লোহার প্রাচীর গড়েও রাণীবিবির হয়রানির একশেষ নায়েব-গোমস্তা, লেঠেল, থানা-পুলিস অনেক হল, পি-ইউ-বি হল, তবু যেন কি হচ্ছে না।
আমি চমকে উঠেছিলাম। বজরাখানা ভারিক্কি চালে দুলেদুলে চলছিল আবার। বউকাটা খালের জল ক্লান্তিতে যেন নীরব হয়ে ঘুমুচ্ছিলা নাকের ডগায় চশমা তুলে বড়বাবু খুঁটে খুঁটে দেখছিলেন। আর সেই লোকটার দু’চোখজোড়া অস্বাভাবিক ভয় আর আকুতি ছড়িয়ে আছে।
এমন সময় ভূত দেখার মত আমি চমকে উঠলাম। খালের পারে বড় বড় কয়েকটা ঝোপওয়ালা গাছের ফাঁকে দুটো নিশ্চল মূর্তি যেন এদিকেই তাকিয়ে আছে। বোধহয় দেখছে— পি-ইউ-বি চলেছেন। এই বজরায় বাঈজীর আসর দেখে ওরা বুঝত, মেজকর্তা চলেছেন, এলোপাতাড়ি বন্দুকের ফুটফাট শব্দ শুনে ওরা বুঝত, বড়সাহেবের বজরা বজরাটা ওদের কাছে যেন চিরকালের বিস্ময়।
কিন্তু লোকদুটো অমন ঠুকঠুক করে চলেছে কেন? গা ঢেকে ঢেকে? বজরাটাকে লক্ষ্য করে করে?
কি হে মাস্টার, অতো কি খুঁজছ অন্ধকারের মধ্যে, কাউকে দেখেছ নাকি? যেন আনন্দ চাটুয্যে জানতেন কেউ এখন বজরা লক্ষ্য করতে করতে এগোবে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, দু’জন লোক মনে হচ্ছে, বুঝতে পারছি না তো!
হেঁ হেঁ হেঁ। রাশভারি আমিরী হাসি হাসতে হাসতে বড়বাবু বললেন, কি নাম রে হরিশ?
হরিশ অর্থাৎ সেই বুড়ো লোকটা বলল, বাতাসী আর বুনো।
হ্যাঁ, বুনো সর্দার আর বাতাসী। এই কেসটার বাদী।
বাদী? বাদী কেন অমন আত্মগোপন করে চলবে? অবাক লাগল ঘটনাটা। বড়বাবু বললেন, যাও না, ছাদের উপর বসে লক্ষ্য করগে, অনেক কিছুই আরো দেখতে পাবো আমি এই কাজটুকু সেরে ফেলি। রিপোর্টটা ভেবেচিন্তে করতে হবে বড় গোলমেলে হে মাস্টার। ফিরব।র পথে সব বলবা
হাঁপ ছেড়ে বজরার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আহ, ভারি মিষ্টি বাতাস।
আট দাঁড়ের বজরা। চার দাঁড়ে টানছে। পাটাতনের উপর পা ছড়িয়ে বসে কালো কালো মূর্তিগুলো তালে তালে দাঁড় ফেলছে জলে। আর সঙ্গে সঙ্গে শব্দ হচ্ছে হাপুস হাপুস।
বিপিন চৌকিদার বজরার ছাদের উপর বসে বিড়ি ফুঁকছিল আয়েসে আমাকে সতরঞ্জি পেতে বসতে দিল। বসুন মাস্টারবাবু, বসুনা উঠে বসলাম।
বউকাটা খালের যে ইতিহাস বিপিন বলল তাতে চমকে উঠতে হয়। খালটা কেটেছিল সোনা দলুই বাপের মতন রাখনি পোষে নি সোনা। বে’ করেছিল একটাই। বাঁজা বউ বাপের কুকীর্তির প্রায়শ্চিত্ত হল যেন বউটা মানসিক করল সোনা, পুজো দিল, কলকাতার ব্যান্ডপার্টি এনে পঁচিশ হাত লম্বা কালী গড়ে তিন রাত উপোস করে জব্বর পুজো। পুজোর শেষে আদেশ পেল সোনা এক ছেলের মায়ের, না না এয়োতি লক্ষ্মীমন্ত বউ হওয়া চাই, এক ছেলের মায়ের রক্ত মাটিতে ছুঁইয়ে দশ মাইল লম্বা পঁচিশ হাত চওড়া খাল কাটা চাই। তাই করল সোনা। পুলিশ বলল, খুনখারাবি হয়নি। লোকে বলে, বউকাটা খালা খালটা আজ ছড়িয়ে গেছে পঞ্চাশ হাত। অপুত্রক বউরা আজো এর মাটি ছুঁয়ে আকুলিবিকুলি হয়ে কাঁদে। খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবগাহন করে। বউকাটা খালের মিষ্টি জলে একটু একটু করে নোনা জল মেশে।
হাল টানছিল বিশাই। বলল, সোনা দলুই এখানে তার অঢেল সম্পত্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছিল। এখনো এই খালের নিচে মাটি খাবলালে সোনার ঘড়া পাওয়া যায়।
বনশী দাঁড় থামিয়ে বলল, সোনার সিন্দুক উঠেছিল একবার। থানার বড় দারোগা সিন্দুকটা কলকাতা চালান করেন। তাছাড়া হাতাখুন্তি কড়াই নজর রাখলেই পাওয়া যায়। তবে কেউ ওসব ছোঁয় না।
লোকদুটোকে আবার দেখা গেল। গর্জন গাছের ফাঁকে টুক করে আবার দুটো ক্ষুদে দৈত্য গা ঢাকা দিলা
বিপিন বলল, ওরাই বাদী।
বাদী, তবে পালিয়ে বেড়ায় কেন?
পালানো নয় মাস্টারবাবু, তক্কে তক্কে আছে। হরিশ উঠেছে বজরায়, কি জানি কেসটা কি হয়ে যায়, তাই ভয়।
তা ওরাই তো দেখা করতে পারতো আগে।
হেঁ হেঁ মাস্টারবাবু, নেড়ে ন্যাংটার বুদ্ধি। চাষাভুষো লোক, মাটিই চেনো আঁটঘাট জানবে কোত্থেকে। কেস করতে হয় দিল করে, এখন বুঝছে তার ঠেলা।
ভাগচাষের খামার নিয়ে কেস নয়। কেস ভিটে উচ্ছেদের।
জিজ্ঞেস করলাম, হরিশ লোকটা কেমন হে?
হরিশ? বিপিন আর একটা বিড়ি ধরাবার জন্য দেশলাই খুঁজতে লাগল। বিশাই ট্যাঁক থেকে দেশলাই ছুঁড়ে দিয়ে বলল, একটা টান দিও বিপিনদা। সেই থেকে তুমি তিনটে ফুঁকলে।
বিপিন বকল, চল না হরিশের বাড়ি, সিগ্রেট ফুকবি। আজ সিগ্রেট ছড়াবে। হ্যাঁ হরিশ, কে জানেন মাস্টারবাবু, এই কেসের আসামী। টাকার কুমিরা ওর বাড়ি দেখলেই তা বুঝবেন চৌহদ্দির চারদিকে খামার। গোলা আছে ছোটয়-বড়য় অনেকগুলি। গোয়াল আছে পরপর তিন সার। তাছাড়া আম কাঁঠাল তেঁতুল অজস্র। এক একটা গাছে হেসে খেলে কয়েক চিতা সাজিয়ে ফেলা যায়। লেখালেখি করে হরিশ হালে বন্দুক পর্যন্ত আনিয়েছে। টিউব-কল পুঁতেছে গোটাকয়েক। আত্মীয়কুটুমও কম নেই হরিশের। এবেলা ওবেলা মিলে শ’আড়াই পাত পড়ে। কলকেয় তামুক পোড়ে দু’দশ সের তো বটেই।
এত ধনী!
অথচ লেখাপড়া না শিখেও কলমবাজি করেই খেয়ে যাচ্ছে হরিশ।
সে কি হে মুখর আবার কলমবাজি।
এঁজ্ঞে, বি এ পাশ মুহুরি আছে ওর। উকিল আছে আলিপুরে। হরিশকে দেখলে সবাই কাজ ফেলে দিয়ে বলে, হরিশ যে, আবার কি হল?
হরিশেরই কাজ করে সবার প্রথম।
বিপিন আরো বলতে যাচ্ছিল। বিশাই বলল, এই মোড়টা পেরুলেই হরিশের ঘাট।
চকিতে সেই লোকদুটো আর একবার বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
জমাটবাঁধা অন্ধকার ভেদ করে কয়েকটা লণ্ঠন এসে জমা হল ঘাটে। আর সেই সঙ্গে বেশ কিছু লোকের গলার স্বর।
দাঁড়ের ফেঁসোগুলি খুলে ফেলতে লাগল মাঝিরা।
তরতর করে জল কেটে তবু এগিয়ে চলেছে বজরাখানা। হাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক ঘাটের গায়ে এনে হাঁক দিল বিশাই, ঘাট ধর, ঘাট ধরা
ঘাট ধরল বনশী বজরার গতি আটকাবার চেষ্টা করল দু বাহুর জোরে যেন মাহুত তার বিরাট হাতিকে হাঁটু গেড়ে বসবার আদেশ করছে। তাজ নামাও, সম্রাট নামবেন!
সম্রাট আনন্দ চাটুয্যের ভারি গামবুট শোনা গেল। পাটাতনের উপর শব্দ হল গুরুগম্ভীর।
সবার আগে বেরুল হরিশ। সাবেকী কালের ফরাসখানা বিছিয়ে দিল পাটাতনের উপর। ভেতর থেকে তাকিয়াদুটো এনে তার উপর পেতে দিল লখা। বিপিন ত্রস্ত হয়ে কেবল ভেতর বার করছে। কোথাও কোন ত্রুটি হয়ে যাচ্ছে কি না কে জানো তাকিয়ে দেখলাম, অদূরেই সেই দুর্গের মতো বাড়ি হরিশের বাড়ি বেশ সম্পন্ন এত বড় বাড়ি এ অঞ্চলে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মেটে দেওয়ালে নানা রংয়ের চিত্রিবিচিত্রি। এত দূর থেকে ভালো নজরে আসে না, তবু বুঝতে কষ্ট হয় না ওগুলো নিশ্চয়ই ফুল লতাপাতাই হবে। মামলাবাজ হরিশের বুকের মধ্যে লতাপাতারও একটু স্থান আছে, ভাবতে বেশ লাগে।
বিরাট উঠোনের ঠিক মাঝখানে তুলসীমঞ্চ। তারই একপাশে খড় বেরিয়ে পড়া মকর মূর্তিখানা দেখা যাচ্ছে। এটাই বোধহয় হরিশের বাইরের বাড়ি
আনন্দ চাটুয্যে বজরার ভেতর থেকে বাইরে এলেন। তারপর হাঁক দিলেন, কি হে মাস্টার, এস। বস এখেনো
তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসলেন উনি। আমিও সংকুচিত হয়ে বসলাম। লোকগুলো বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, দেখলাম।
ঘাট থেকে কেউ কেউ উঠে এল বজরায়। তারপর কথার জঞ্জালের মধ্যে কোনটা সত্য কোনটা। অসত্য খোঁজাখুঁজি চলতে লাগল। সেই আশ্চর্য বিচারশালা।
আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম সেই তক্কে তক্কে থাকা লোকদুটোকে।
কিছুক্ষণের জন্য হরিশ উধাও হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে আনন্দ চাটুয্যের পা ছুঁয়ে বলল, বড়বাবু, আমার মেয়ের অনেক দিনের সাধ—
বাকিটা যেন বুঝিয়ে দিতে হয় না। বড়বাবু অর্থাৎ আনন্দ চাটুয্যে বললেন, কোথায়? নিয়ে আয়।
অল্প বয়স মাথায় ঘোমটা টেনে কাঁপতে কাঁপতে এল। হরিশের মেয়ে। হরিশ বলল, কুমুদিনী। শ্বশুরঘর থেকে ফিরেছে, মাসখানেক থাকবে।
কুমুদিনী পা ছুঁয়ে প্রণাম করল আনন্দ চাটুয্যের।
কল্যাণ হোক।
দু’থালা ভর্তি শাকআলু আর কাটা ফল এল এল কাচের গেলাসে চা।
হরিশ বলল, কুমুদিনী কিছু প্রণামী দিতে চায় বড়বাবু।
না না, প্রণামী কি হবে।
আনন্দ চাটুয্যে তাকালেন আমার দিকে। আমি সেই তক্কে তক্কে থাকা লোকদুটোকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। নাহ ধারেকাছে নেই ওরা। কোথায় যেন অন্ধকারের ভিড়ের মধ্যে হারিয়েই গেছে। হুইস্কির বোতলটা আঁচলের ভাঁজ থেকে ধীরে ধীরে বার করল কুমুদিনী ঘোমটাটা খোঁপায় এসে আটকে পড়েছে ওরা ফাঁপা নাকের পাটায় নথটা হ্যারিকেনের আলোয় চিকচিক করে উঠল। মনে হল যেন একটা তক্ষক ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে সামনে সুডৌল হাত মেলে বোতলটা এগিয়ে দিতে গিয়েছিল কুমুদিনী।
আনন্দ চাটুয্যে আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হেসে বললেন, দেখলে তো মাস্টার। শালারা ভাবছে আমিও বুঝি পুলিস দারোগার মতই মদ খাই। ওষুধ হিসেবে কবে একটু খেতে দেখেছে। তা ও হরিশ, রাত বাড়ছে, ফিরতে দিবি না বুঝি, ভেবেছিস কি তোরা?
এঁজ্ঞে! হাত কচলাতে কচলাতে হরিশ বলে, এস গো কুমুদা বাবুর রাত বাড়িয়ো না।
হ্যারিকেন নাচাতে নাচাতে কুমুদিনী বজরা থেকে ঘাটে নামল। ঘাট থেকে পারে। তারপর মেঠোপথ ধরে সটান দুৰ্গটার দিকে।
আবার বজরা ছাড়ল। গুণ টেনে এগিয়ে নিয়ে চলল বজরাকে আরো কয়েকশ’ গজ ভিতরে।
এখানে ঘাট নেই। গ্রামের শেষ প্রান্ত। বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাদীর কি নাম যেন হরিশ? কিছুতেই মনে থাকে না!
হরিশবলল, বুনো সর্দার আর বাতাসী।
বুনো আর বাতাসীকে এবার দেখলাম। নিজের ভিটের উপর দাঁড়িয়ে ছোট্ট গোল পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরটা ভেঙে তছনছ হয়ে আছে একপাশে।
মনে হ’ল বর্বরতার চূড়ান্ত সাক্ষ্য।
আমরা পৌঁছুতেই বজরায় লাফিয়ে উঠল মেয়ে মরদে,—এ জমি আমার বাবা ওদের দিস নি বাবা। কোথায় দাঁড়াব গো-বাবা
হরিশের হাতে একটা হ্যারিকেন দুলছিল বজরার দুলুনিতে দৈত্যের মত ওর বিরাট ছায়াটা কাঁপতে লাগল বউ-কাটা খালের জলে।
জরিপ করা হল চৌহদ্দিা খাতায় অনেক কিছু টোকা হল। সব কাজ চুকিয়ে বজরা ছাড়তে ছাড়তে রাতও হল অনেক। হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম রাত দশটা।
আনন্দ চাটুয্যে বললেন, ভিতরে গিয়ে কাজ নেই, এখানেই বসি কি বল মাস্টার? গড়াড়ায় গুড়ুক গুড়ুক করে টান দিতে লাগলেন তারপর।
আচ্ছা, কি বুঝলে বল তো? দেখলে তো আসামীর চোট কতটা! এদেশে সব হয়। মেজকর্তাই বল, আর বড়সাহেবই বল কিংবা তোমার রাণীবিবিই হোক না, কারো ক্ষমতা নেই এদেশে সুবিচার করার। এই হরিশকে দেখলে তো, কেমন জাল দলিল তৈরি করে সামলে নিচ্ছে, ভাব দেখি!
সে কি! আপনি বাদীকেই শাস্তি দেবেন? দলিল-পরচা নকল করা আসামীকে ঝুলিয়ে দিন।
দিয়ে লাভ? তোমাদের মাথায় অত ঢুকবে না মাস্টার। তোমরা এ লাইনে নেহাত ছেলেমানুষ। আমি না হয় বাদীকে জিতিয়ে দিলাম আমার ইউনিয়ন বোর্ডের কোর্টে, কিন্তু হরিশ আমায় কলা দেখিয়ে উপরে যাবে লাভ নেই।
তাহলে অত খেলাবারই বা কী দরকার ছিল?
হরিশের কথা বলছ?বড় মাছ না খেলালে ওঠে না!
বজরাখানা এগিয়ে চলেছে বড়নদীর দিকে। দাঁড়ের ভারি ভারি শব্দে বাতাস ঘুলিয়ে উঠছে। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল রসাল আঙুলের ছবি-আঁকা লেবেলের সেই মদের বোতলটা পাটাতনের উপর বজরার দুলুনির সঙ্গে ধীরে ধীরে দুলছে।
বজরার গমকটাই শুধু কমেছে, আর মানুষগুলি! মনে হল, মানুষগুলি ঠিকই আছে, সেই আগের মতো। অবিকল সেই পুরনো মানুষের মতো সবাই রয়ে গেছে।
মন্দ নয়