প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

ফুঁফে বুফে

ফুঁফে বুফে

ছেলেমেয়ে দেখতে-দেখতে সব ধেড়ে হয়ে গেল। গৃহিণীর আলুলায়িত কেশপাশ হয়ে গেল টিকটিকির ন্যাজ। তার অর্ধেকে ধরে গেল পাক। রোদ পড়লে মনে হয় রুপোর রেখা ঝিলিক মারছে। যৌবনের সেই বিলোল কটাক্ষে অসহায় উদাসীনতা। বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে মেঝেতে হাতের ভর রাখতে হয়। হাঁটতে খিল ভাঙার শব্দ। তেলা গাত্র-ত্বক আর নেই। গোসাপের মতো হয়ে গেছে। একতলা দোতলা করলে কিছুক্ষণ হাপরের মতো হাঁপাতে হয়। সার্জেনের ছুরি দেহের কিছু-কিছু যন্ত্রাংশ বের করে এনেছে। কর্তার বুকে পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেছে বার্ধক্যের কথা। কাশি যেন ক্লাসিক্যাল মিউজিক। একবার শুরু হলে আর থামতে চায় না। চোখের মণি দুটো ছেতরে গেছে। চালসের পূর্ব লক্ষণ। চোখে উঠেছে পুরু লেনসের চশমা। রাতের বেলা পথে বেরোতে ভয় করে। স্মৃতি আর শ্রুতি দুটোই কমে এসেছে। নাম মনে রাখতে পারেন না। আবোল তাবোল বকতে ভালো লাগে। যেকোনও কথা একবারে বুঝতে পারেন না। তিন-চারবার প্রশ্নের পর মাথায় ঢোকে। অল্পেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়।

রাতে বিছানায় পড়া মাত্রই আর ঘুম আসে না। বারতিনেক বাথরুমে ছুটতে হয়। আর এক বছর পরেই চাকরি ছুটি দিয়ে দেবে। তখন ভরসা সঞ্চয়। সঞ্চয়ের খাতায় ভরসা দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। জীবনের প্রয়োজন কমাতে শুরু করেছেন। এক তরকারি ভাত। চাল নিয়ে আর খুঁতখুঁতুনি নেই। চায়ে আর ফ্লেভার আশা করেন না। জামা-কাপড় যা আছে হিসেব করে দেখেছেন, জীবনের বাকি ক’টা দিন চলে যাবে। লোভনীয় কোনও জিনিস কেনার ইচ্ছে হলেও ব্রেক কষে মনকে থামিয়ে দেন। মুখে আর বড়-বড় বোলচাল নেই। মাঝে-মাঝে শ্মশানে বেড়াতে যান। যাওয়ার জায়গাটিকে চিনে রাখার জন্যে, এইখান থেকেই খুলে যাবে পরলোকের অদৃশ্য পথ। দেশের কতই না উন্নতি হচ্ছে সর্ব দিকে। শ্মশানেরও আধুনিকীকরণ! পুরানো শ্মশান ফেঁড়ে ফেলে সে এক এলাহি কাণ্ড। বিশাল বৈদ্যুতিক চুল্লি বসে গেছে। চক-মেলানো ঝকঝকে নতুন বাড়ি। বহুতল। মোজাইক মেঝেতে এমন পালিশ যে পা হড়কে যায়। একটা পাশ দিয়ে চলে গেছে গড়ানে সেতু গঙ্গা পর্যন্ত। নতুন ঘাট হয়েছে বাহারি। দিগবিদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে দেখার জন্যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। বাবা তার বাচ্চাটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘বাবু এর নাম মহাশ্মশান। এই দ্যাখো ইলেকট্রিক চুল্লি। এই ঢুকল, পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে বেরিয়ে এল ছাই হয়ে। এখানে একদিন আমি আসব, তুমি আসবে, সব্বাই আসবে।’ শিশুটি অমনি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘কী মজা! তুমি কবে আসবে বাবা, আমি বেশ দেখব।’ ছেলের কথায় এতটুকু আহত না হয়ে পিতা বললেন, ‘দিন ফুরোলেই আসব বাবা। এখন দেখছ জ্যান্ত মানুষ, তখন দেখবে ছাই মানুষ। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে।’ মানুষের মন এখন খুব শক্ত হয়ে গেছে। সেন্টিমেন্টের বালাই নেই কী শিশুর, কী বৃদ্ধর! আপনজন মারা গেছে। একটু কান্নাকাটি না করলে খারাপ দেখায়। পকেট থেকে ছোট্ট ছাঁচি পেঁয়াজ বার করে নখ দিয়ে খুঁটে চোখে লাগিয়েই গলায় সুর তুলল, ‘ও গো, তুমি কোথায় গেলে গো! প্রাচীন শ্মশান আধুনিক অঙ্গরাগে প্রমোদ ভ্রমণের জায়গা।

পেছন দিকে চিতার ব্যবস্থাও আছে। যাদের হাতে অঢেল সময় তারা তিরিশ মণ কাঠ চড়িয়ে সারারাত ধরে দাহ করুক। ব্যস্ত মানুষ তো এমনিতেই সবসময় বলছে, ‘তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো, অফিসের দেরি হয়ে গেল। চার্টার্ড বাস চলে গেল।’ এইবার বলতে শোনা যাবে ‘তাড়াতাড়ি চলো, তাড়াতাড়ি চলো, ঝট করে পুড়িয়েই প্লেন ধরতে হবে, আমার আবার কনফারেন্স আছে।’ যাদের আত্মসম্মান-বোধ আছে তাঁরা দেখেশুনে বলতে শুরু করেছেন, ‘শ্রাদ্ধশান্তি মস্তকমুন্ডন কোনও কিছুর প্রয়োজন নেই বাবা। চাপাবে আর নামাবে। ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেবে জলে। কা তব কান্তা, কস্তে পুত্র। আর নেহাতই যদি ইচ্ছে করে একটা পার্টি দিও, বুফে সিস্টেম। আজকাল তো ফুঁফে আর বুফেরই যুগ পড়েছে। বেশি তকলিফ নিতে যেও না সোনা, ফ্যামিলি টিভি সিরিয়াল মিস করবে।’ ফুঁফে মানে ফেলে দাও ফুঁ মেরে। আর বুফে মানে নেচে-নেচে খাও। হাতে-হাতে প্লেট। প্লেটে খাবার। বললে, ‘পিতৃদেব ফিশফ্রাই, কাটলেটটা ভীষণ পছন্দ করতেন আর সঙ্গে একটু ডাইজেস্টিভ লিকুইড। আর ওইতেই তো শেষ পর্যন্ত গেলেন। লিভারটা ফেল করল। তা সেই ব্যবস্থাই রেখেছি, আত্মার তৃপ্তির জন্য। ধোঁকা, ছানার কালিয়া মানে বিধবা-মেনু বাতিল।’ ‘তা বেশ, তা বেশ’, বলে সবাই গুঁতোগুঁতি করে এগিয়ে গেলেন খাবার টেবিলের দিকে! মানুষ আবার সৌন্দর্য সচেতন হয়েছে। পিতাকে পেঁচার মতো দেখতে ছিল বলে ছবি রাখা হল না। শুধু একটা ফ্রেম। মাঝখানে লাল কালিতে লেখা ওঁ। তাইতেই মালার পর মালা। একটু বেসামাল হয়ে কে যেন চিৎকার করে উঠলেন, ‘হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ অল।’ যাক, ওইতেই হবে। একটা কিছু হলেই হল।

রকমসকম দেখে কর্তা খুব চিন্তিত। উঠতি পায়রারা বিপরীত লিঙ্গের সিটি শুনে সেই দিকেই লাট খাচ্ছেন। বুড়োকে কে আর পাত্তা দেয়! বুড়ো হল চার্টার্ড ব্যাঙ্ক। ওড়ার পেট্রল ফুরোলেই তেড়ে আসে—ড্যাডি, পাপ্পা, ফ্যুয়েল ছাড়ো। ছাড়তে না পারলেই বাড়ি ছাড়া করে দেবে। গলায় গলায় কাড়া-না-কাড়ার ধিনি তাল। গৃহিণী বলবেন, ‘তোমাদের যুগ আর নেই। বুড়ো কর্তার চালে চলতে যেও না, সবাই ঘেন্না করবে। উঠতি বয়েস সব। জগৎটাকে চিনবে না? দেখবে না? তোমার যৌবন আর ওদের যৌবনে অনেক তফাত। তোমার বাবা যখন তোমাকে বলতেন, ‘অ্যায়, ইদিকে আয়’, তুমি অমনি ন্যাজ গুটিয়ে চোরের মতো। তাই তো তোমরা এমন ম্যাদামারা। ছেলেমেয়েদের দেখলে মনেই হয় না তুমি ওদের ফাদার।’ কী স্মার্ট! ওরা ইংরিজি গান শোনে জানো? এঙ্গেল বার্ট, হাম্পার ডিঙ্ক। তোমার তো ‘ওই ম্যাঅ্যা, সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’, আর তা না হলে ‘লোহারই বাঁধনে বেঁধেছে সংসার।’

‘ওদের ফিউচার। কে কাকে ধরে আনছে! কে কার সঙ্গে হাওয়া খেতে যাচ্ছে।’ কর্তা শেষে বলেই ফেললেন। গৃহিণী বললেন, ‘তাতে তোমার কি? তোমার দিন ফুরোলে মানে-মানে বিদায় নেবে। নিজের প্রেস্টিজ নিজের কাছে।’ কর্তা গুটিগুটি বেরিয়ে পড়লেন। নতুন শ্মশানের আজ উদ্বোধন। বড়বাবুরা এসেছেন। খুব লেকচার হচ্ছে। ‘শ্মশানই হল আমাদের সব। মহাতীর্থ। পরম শান্তি এখানেই মেলে। বাইশ হাজার ডিগ্রিতে হাড় পর্যন্ত ট্যালকাম পাউডার করে দিচ্ছি নিমেষে। প্রেসার কুকার আর কি! এরপর আমরা এয়ার কন্ডিশানড শ্মশান করব। পোড়ার সময় বোঝাই যাবে না যে, আমি পুড়ছি। আমরা স্ন্যাক বার করব। মৃত্যুকে আমরা এমন মোলায়েম করে দেব যে কেউ আর মরতে ভয় পাবে না। বন্ধুগণ, উদ্বোধন উপলক্ষে আজ থেকে তিন দিন ফ্রি অফ কষ্ট সৎকার। আসুন দলে-দলে আসুন। এই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করুন।’

কে একজন বলে উঠল, ‘সঙ্গে একটা স্টেনলেস স্টিলের চামচে ফ্রি।’

1 Comment
Collapse Comments

OSADHARON

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *