1 of 2

ফিরোজা নিয়ে ফেরেববাজি। শার্লক হোমস

স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
ফিরোজা নিয়ে ফেরেববাজি। শার্লক হোমস

আগের রাতে খুব বরফ পড়েছিল লন্ডনে। বরফ জমা রাস্তার ওপর দিয়ে তুর্কি নাচ নাচতে

নাচতে এক ভদ্রলোক এলেন শার্লক হোমসের আস্তানায়।

কাল রাতে তার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।

কী সর্বনাশ? শুধোল হোমস।

বেরিল-মুকুটের নাম শুনেছেন তো? জাতীয় সম্পত্তি বললেই চলে। উনচল্লিশটা অমূল্য বেরিল রত্ন আছে তাতে। একটা রত্ন হারালেও জোড়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাল রাতে মুকুট থেকে খোয়া গেছে তিন-তিনটে রত্ন।

কী করে?

আমি ব্যাঙ্কার। আমার নাম আলেকজান্ডার হোল্ডার। গতকাল মুকুটটা বন্ধক রেখে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড নিয়ে গেলেন মুকুটের মালিক কথা রইল চারদিন পর ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। ব্যাঙ্ক লুঠ আকছার হচ্ছে বলে মুকুটটা আমি বাড়ি নিয়ে এলাম। দেরাজে রাখলাম। রাত্রে খেতে বসে আমার অপোগণ্ড ছেলে আর্থার আর মা লক্ষ্মী ভাই-ঝি মেরীকে বললাম মুকুটের কথা। সুন্দরী ঝি লুসী হয়তো বাইরে থেকে সে কথা শুনেছিল। হাসতে-হাসতে আর্থার অবিশ্যি বলেছিল গুদোমের তাকে রাখা চাবি দিয়ে দেরাজ নাকি খোলা যায়। ও নিজে খুলেছে ছেলেবেলায়।

আর্থার মামরা ছেলে। আর বিয়ে করিনি। আদর দিয়ে নিজেই তার মাথা খেয়েছি। এখন ক্লাবে গিয়ে অনেক কাপ্তেন বন্ধু পাকড়েছে। যখন-তখন টাকা চায়। জুয়ো খেলতেও শিখেছে। স্যার জর্জ বার্নওয়েল ওর বড় দোস্ত। অতি পাজি নচ্ছার লোক। প্রায় বাড়ি আসে। আর্থার ওর খপ্পর থেকে বেরোতে পারছে না। সে ছাড়া বাড়িতে অন্য কেউ আসে না।

মেরীর বাপ-মা নেই। আমার কাছেই মানুষ। বড় ভালো মেয়ে। দু-দুবার আর্থার ওকে বিয়ের প্রস্তাব জানিয়েছে। রাজি হয়নি মেরী। হলে এই সর্বনাশ হত না। আর্থারকে ভালো করতে পারে কেবল সে-ই।

ঝিয়েরা সব পুরোনো লোক। আলাদা থাকে। লুসীই নতুন। কাজের মেয়ে। কিন্তু রূপসি বলে অনেক ভোমরাকে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।

কাল রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আর্থার এসে ফের দুশো পাউন্ড চাইল। হাঁকিয়ে দিলাম। মুখ কালো করে চলে গেল বটে কিন্তু পথে বসিয়ে গেল আমাকে।

শুতে যাওয়ার আগে আমি নিজে সারা বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিচে নেমে দেখলাম জানলা খুলে দাঁড়িয়ে আছে মেরী। আমাকে দেখেই পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে বললে, লুসী ফের রাস্তায় বেরিয়েছিল। ওকে একটু বকা দরকার।

মাঝরাতে দড়াম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল আমার। পাশের ঘরে খসখস আওয়াজ শুনে এসে দেখি আর্থার মুকুট ভাঙবার চেষ্টা করছে দেরাজের সামনে দাঁড়িয়ে। খালি পা। পরনে নাইট ড্রেস। চোর-চোর করে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার চিৎকারে আর্থার ভীষণ রেগে উঠল। মুকুট কেড়ে নিয়ে দেখলাম, কোণটা ভাঙা। তিনটে বেরিল রত্ন উধাও। চিৎকার শুনে মেরি ছুটে এসেই অজ্ঞান হয়ে গেল কোণ ভাঙা রত্নমুকুট দেখে।

পুলিশ ডেকে আর্থারকে ধরিয়ে দিলাম। আর্থার কিন্তু রেগেমেগে যেন আমাকেই মারতে এল। রত্ন তিনটে কোথায় কিছুতেই বলল না। পুলিশও বলছে, রত্ন উদ্ধার তাদের ক্ষমতায় কুলোবে না। মিস্টার হোমস, আমাকে বাঁচান।

শার্লক হোমস সব শুনে অদ্ভুত কথা বলে বসল, আর্থার বেঁকা মুকুটকে সোজা করবার চেষ্টা করেনি তো?

শুনে তো ব্যাঙ্কারমশায় রেগে কঁই, কী! আপনি আমার বকাটে ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন?

আচ্ছা আর বলব না। চলুন আপনার বাড়ি যাওয়া যাক।

যাওয়ার পথে গুম হয়ে বসে রইল হোমস। ব্যাঙ্কারের বাড়ি পৌঁছে পকেট থেকে বার করল মস্ত একটা আতস কাঁচ। যে জানলার সামনে মেরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন ব্যাঙ্কার তার গোবরাট আর ফ্রেম দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর নেমে গেল বাড়ির পাশে আস্তাবলের সামনেকার সরু গলিটায়। পুলিশ নাকি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেছে–বাইরে উঁকিও মারেনি।

ওয়াটসন রইল বাড়ির মধ্যে। কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকল মেরী। মুখ অতি বিষণ্ণ। ব্যাঙ্কারকে বললে মিনতি করে, আর্থার নির্দোষ। ওকে ছাড়িয়ে আনুন। কিন্তু ব্যাঙ্কার কোনও কথাতেই কান দিলেন না। এমন সময়ে বুট থেকে বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এল শার্লক হোমস। মেরীকে দেখে জিগ্যেস করল, লুসী রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যার সঙ্গে কথা বলছিল তার একটা পা কাঠের তৈরি, তাই না? শুনে হেসে ফেলল মেরী–হ্যাঁ। তরকারিওলার একটা পা কাঠেরই বটে হোমস কিন্তু হাসল না।

গেল ওপরে। গুদোম ঘরের তাকে রাখা চাবি দিয়ে দেরাজ খুলে রত্নমুকুট হাতে নিয়ে বললে ব্যাঙ্কারকে, মশায় আপনি এর আরেকটা কোণ ভাঙতে পারবেন? আঁতকে উঠলেন ব্যাঙ্কার। হোমস ততক্ষণে গায়ের জোর দিয়ে কোণ ভাঙতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কিন্তু না পেরে বললে, দেখলেন তো? যদিও বা কেউ ভাঙতে পারে এমন জোর আওয়াজ হবে যে পাশের ঘর থেকে ঠিকই শুনতে পাবেন।

তাহলে? ঢোঁক গিলে বললেন ব্যাঙ্কার।

আপনার ছেলে আর যাই হোক চোর নয়। বলে ভদ্রলোককে ফের রাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল হোমস। যাওয়ার আগে বলে গেল, কাল সকাল নটায় আসবেন বাসায়।

বেকার স্ট্রিটে ফিরেই হোস ছদ্মবেশ ধরল। লোফারের ছদ্মবেশ। বেরিয়ে গেল শিস দিতে দিতে। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসে একজোড়া বুট ওয়াটসনের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে আবার নামল রাস্তায়। সারারাত বাইরে থেকে ফিরল পরের দিন ভোরে।

নটার সময়ে ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক আসতেই হোমস বললে, এক-একটা বেরিল রত্নের জন্যে হাজার পাউন্ড দিতে রাজি?

দশ হাজার দেব।

অত চাই না। এই নিন কলম। চেক বার করুন। লিখুন চার হাজার পাউন্ড–আমার পারিশ্রমিক সমেত। বাঃ, উঠে গিয়ে দেরাজ খুলে রত্নমুকুটের ভাঙা কোণটা এনে ব্যাঙ্কারের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললে, খুশি?

আলেকজান্ডার হোল্ডারের তখন হয়ে এসেছে। দু-চোখ প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কি! হোস কি তুকতাক জানে?

গম্ভীর কণ্ঠে বললে হোমস, আর একটা ঋণশোধ বাকি রইল আপনার।

খপ করে চেক-বই তুলে নিয়ে বললেন ব্যাঙ্কার, বলুন কত পাউন্ড?

পাউন্ড নয়–ক্ষমা চাইতে হবে। আপনার ছেলের কাছে। আর্থার ছিল বলেই রত্নমুকুট ফিরে পেয়েছেন। নইলে পুরোটাই যেত। দুশো পাউন্ড না চেয়ে পায়নি বেচারি। ঘুম আসছিল না রাত্রে। এমন সময়ে শুনল বাড়ি থেকে জানলা-পথে পাচার হয়ে গেল রত্নমুকুট। দেখে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বেদম ঠেঙিয়ে চোরের হাত থেকে ছিনিয়ে আনে রত্নমুকুট। চোরের মাথা ফেটে যায় ওর মারে হাতের মধ্যে থাকে শুধু মুকুটের ভাঙা কোণ। জানলা দিয়ে বাড়ি ঢুকে দড়াম করে পাল্লা বন্ধ করে দোতলায় উঠে ভাঙা মুকুটের কোণ সিধে করার চেষ্টা করছিল আর্থার–আপনি তাকে চোর বলায় আর মুখ খোলেনি।

কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?

দেখলাম গলির বরফে জুতো পরে কে যেন পায়চারি করেছে–আর একজন খালি পায়ে সেই দাগ মাড়িয়ে গিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেখলাম জুতো পায়ে লোকটা দৌড়ে পালিয়েছে রক্তের ফোঁটা পড়তে পড়তে গেছে। গোবরাট পরীক্ষা করে দেখলাম আর্থার জানলা দিয়েই লাফিয়ে নেমেছিল। তাই ছদ্মবেশে চোরের বাড়ি গিয়ে চাকরের সঙ্গে ভাব জমিয়ে মনিবের একজোড়া বুট জোগাড় করলাম। আপনার গলিতে এসে পায়ের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম। ফিরে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করলাম চোরকে। এমনিতেই তার মাথা ফেটেছিল। তারপর আমার রিভলভার দেখে উগড়ে দিল রত্নের হদিশ। বিক্রি করেছিল ছশ পাউন্ডে–আমি কিনে নিলাম হাজার পাউন্ডে।

কিন্তু চোর কে? কে রত্নমুকুট পাচার করেছিল তার হাতে? রাগে ফেটে পড়লেন ব্যাঙ্কার।

আপনি কিন্তু ধরে ফেলেছেন–তাই না?

.

গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান

রাত্রে দরজা বন্ধ করতে এসে কাকে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন আলেকজান্ডার হোল্ডার?–মেরীকে। ভাঙা মুকুট দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল কে?–মেরী।

বাড়িতে কেউ আসে না একজন ছাড়া। কী তার নাম? স্যার জর্জ বার্নওয়েল। পাজি নচ্ছার বদমাস।

সরলা মেরী পটে গিয়েছিল এই বদমাসের মিষ্টি বচনে। শুতে যাওয়ার আগে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণের মানুষকে জানিয়েছিল রত্নমুকুটের বৃত্তান্ত। শুনেই প্রেয়সীর কাছে মুকুট ভিক্ষা করেছিল স্যার জর্জ।

মেয়েরা সব পারে–প্রেমে পড়লে। সুতরাং কাকামণিকে পথে বসাতে দ্বিধা করল না মেরী। গভীর রাতে মুকুট এনে তুলে দিল পরমপ্রিয়কে। ওপর থেকে আর্থার দেখল, স্তম্ভিত হল, কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি হারাল না। খামোকা চোর বদনাম শুনেও ফাঁসিয়ে দিল না মেরীকে।

কিন্তু মেরী কোথায়? কর্মফল ভোগ করতে পালিয়েছে স্যার জর্জের সঙ্গে।

* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৩৮২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *