ফকিরচাঁদের ফৌতি ব্যবসা
চোখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা নামিয়ে গুলি-গুলি চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করলেন পুলিশ কাকা।
তারপর চেরা-চেরা গলায় শুধোলেন–হঠাৎ কী মনে করে?
কাষ্ঠ হেসে বললাম, পুলিশের গোয়েন্দাগিরি…
এমন সময়ে হাঁচি এল কাকার। এই এক ব্যায়রাম তাঁর সাইনাসাইটিস। দক্ষ পুলিশ কর্মচারী ছিলেন ব্রিটিশ আমলে। সাব ইন্সপেক্টরের পদ থেকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার হয়েছিলেন। বড়লাটের হাত থেকে সোনার মেডেল নিয়েছেন। দোষ একদম ছিল না। পান-তামাক বিড়ি-সিগারেট-চা-কফি-নস্যি কোনও নেশা নেই।
দোষের মধ্যে ওই হাঁচি আর নাক ঝাড়া।
হচ্চো করে হাঁচতেই আমি থেমে গেলাম। তারপর বললাম, নিয়ে কিছু…
হ্যাঁচ্চো! গল্প লেখবার…
হ্যাঁচ্চো! ফরমাশ এসেছে।
ফোঁৎ-ফোঁৎ! এবার শুরু হল নাকঝাড়া।
আমি আবার গোড়া থেকে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছি, উনি হাত তুলে নিরস্ত করলেন। রুমালের পাট খুলে নাক ঝাড়লেন, এবং পাট মুড়ে রেখে আমার দিকে ফের গুলি-গুলি চোখে তাকালেন।
বক্রসুরে বললেন, শুনেছি। পুলিশ আবার গোয়েন্দাগিরি করে নাকি?
নার্ভাস হয়ে গেলাম। চিরকাল হয়েছি। পুলিশ কাকার স্বভাব রুক্ষ, চেহারা রুক্ষ, কথাবার্তাও রুক্ষ। চুল ছাঁটেন মল্লবীরের মতো। সামনের দিকে তিন বর্গইঞ্চি পরিমিতো স্থানে ইঞ্চিখানেক লম্বা কয়েকগাছা পাকা চুল–বাকি মাথা ক্লিপ দিয়ে মুড়িয়ে ছাঁটা। গড়ুর পাখির ঠোঁটের মতন বেঁকানো নাক, পুরু ওষ্ঠ এবং দৃঢ় চিবুকের মধ্যে কঠোর মনোবল, ধীশক্তি এবং একগুঁয়েমির লক্ষণ। সন্দেহ কুটিল চাহনি সারা জীবন ক্রিমিন্যাল ঘেঁটে কাউকেই যেন আর বিশ্বাস করেন না।
জোর করে হেসে বললাম, আগে ইন্ডিয়ান পুলিশ জার্নাল বেরোত–আপনারা রিটায়ার করলেন–সে সবও বন্ধ হয়ে গেল। তাই…
ওষুধ ধরল। সাদা চুলভরতি বুকে হাত বুলোতে-বুলোতে কাকা বললেন, কে আর বলবে? ক্যালকাটা পুলিশ জার্নালও যদি একটা থাকত–
কথাটা অসমাপ্ত রাখলেন কাকা। নত-চক্ষে কি যেন ভাবলেন। তারপর ভ্রুকুটি-ঘন চোখ তুলে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন আমাকে–যেন মনে-মনে তৌল করলেন আমার অন্তরের অভিপ্রায়। অবশেষে বললেন স্বভাবকর্কশ গলায়, আমাদের কালে ফোরেনসিক সায়েন্সের এত রমরমা ছিল না। সায়েন্টিফিক ডিটেকশন যখন শুরু হয়নি, যখন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের ওপর আমরা বেশি গুরুত্ব দিতাম–তখনকার একটা কেস মনে আছে।
আমি নড়েচড়ে বসলাম।
কেসটা স্রেফ সারকন্সট্যানসিয়াল এভিডেন্সের ওপর খাড়া করেছিলাম। কিস্ এভিডেন্স পাইনি–প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না।
প্রমাণ?
তাও ছিল না। ছিল শুধু একটা সূত্র। খুব সামান্য। বাকিটা ব্যাক ক্যালকুলেশান করে মনে মনে কল্পনা করেছিলাম।
পুলিশ কাকা অঙ্কে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন এম. এস. সি. পরীক্ষায়–ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পিছুহটা অঙ্কতে রপ্ত থাকবেন বইকী। কিন্তু
জিগ্যেস করলাম, কোর্টে কেস টিকেছিল?
বলেই বুঝলাম ভুল করেছি। নির্দয় চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন পুলিশ কাকা। তারপর প্রচণ্ড শব্দে নাক ঝাড়লেন গুনে-গুনে তিনবার। রুমালটা পাট করে রেখে কর্কশকণ্ঠে বললেন, ফাঁসি হয়ে গিয়েছিল ফকিরচাঁদ, ফকিরলাল আর শ্রীশচন্দ্রের লাটে উঠেছিল ফৌতি ব্যবসা।
আমি কিছুক্ষণ কাঠ হয়ে বসে রইলাম। তারপর শুধোলাম ভীরুকণ্ঠে, ফৌতি ব্যবসা কী?
মার্বেল-চোখে এক পশলা তাচ্ছিল্য বর্ষণ করলেন কাকা। একটা উদগত হাঁচিকে সংবরণ করে নিয়ে বললেন ঠোঁট বেঁকিয়ে, মড়া…ডেড বডি নিয়ে কারবার।
.
তখন বডি স্ন্যাচারদের স্বর্ণযুগ।
সোনা-দানা-মণিমুক্তো নয়–স্রেফ লাশ লুঠ করেও দু-পয়সা পিটছে একদল লোক।
কলেজ হাসপাতালের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে দারুণ চাহিদা রয়েছে মরা মানুষের। মড়াপিছু দেড়শো থেকে দুশো টাকা। মড়া কেটে জ্ঞানার্জন করতে চায় ছাত্ররা। অত মড়া হাসপাতাল থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। চালান আসত বাইরে থেকে।
ক্রমে ক্রমে মড়া চালান একটা ব্যবসায়ে দাঁড়িয়ে গেল। জোগান দিতে লাগল কলকারখানার কুলিমজুর এবং অন্যান্য গরিবরা আত্মীয়স্বজন মরলে চিতায় তোলবার বা গোর দেওয়ার খরচও যাদের নেই। মড়ার দালালদের হাতে মড়া চালান দিয়ে সে খরচ তো বাঁচছেই উপরন্তু দু-পয়সা আসছে।
আরও একটা পথে ডেড বডি জোগাড় করত দালালরা কবর খুঁড়ে!
অর্থাৎ মড়া চুরি। রাত বিরেতে এরা কবরখানায় দিত হানা। কেউ জানতেও পারত না– মাটির তলা থেকে সদ্য মরা মানুষটা চালান আসত কলেজ হাসপাতালের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে।
ডেড বডি বিক্রি আইনের চোখে দোষনীয় নয়। কিন্তু গোরস্থানের লাশ লুঠ বেআইনি।
যে ব্যবসায়ে লাভ বেশি, বদলোক সেখানে জুটবেই–লাভের অংশ আরও বাড়ানোর ফিকিরে দু-ভাবে তা সম্ভব।
ডেড বডি সংগ্রহের খরচ আরও কমিয়ে দিয়ে।
অথবা, একেবারে না খরচ করে!
কি দরকার খামোকা দালালদের পেছনে টাকা খরচ করার? ডেড বডি যে কিনতেই হবে, এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। গোরস্থান থেকে লুঠ করারই বা দরকার কী? তাতেও অনেক খরচ, অনেক হাঙ্গামা।
সব খরচের সাশ্রয় সম্ভব একটিমাত্র পন্থায়।
মড়া বানিয়ে নেওয়া।
ডেড বডি জোগাড় করার ঝক্কি অনেক–কিন্তু মড়া তৈরি করার কোনও ঝক্কি নেই। বাউন্ডুলে, ভবঘুরে, ভিখিরে অনেকেই আছে। এদের ঠিকানা নেই। নিখোঁজ হলে কারও মাথাব্যথাও নেই। মরলেও কিছু এসে যায় না। বডি পিছু গড়ে দেড়শো টাকা নীট লাভ করো।
অতীব লাভজনক ব্যবসা। কিন্তু হুঁশিয়ারি প্রয়োজন। বডি দেখে যেন সন্দেহ না হয় যে আনন্যাচারাল ডেথ।
ফৌতি ব্যবসার বিপদ এইখানেই।
.
শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ।
গিরধরলাল টুলে বসে পা দোলাচ্ছে। দেবী চামুণ্ডার পদতলে নিক্ষিপ্ত অসুরের মতন মাংসপুষ্ট বপু। মিশমিশে কালো। চোখ দুটি ঘোর রক্তবর্ণ। নগ্ন গা। কটি দেশে ক্ষীণ বস্ত্রাবরণ।
গিরধর পূর্বজন্মে শুম্ভ অথবা নিশুম্ভ ছিল বোধ হয়। ইহজন্মে সে একাধারে ডোম ও মুদ্দোফরাশ। জাতিতে চণ্ডাল।
গিরধর বিপত্নীক। অতিকোপনা বউয়ের সঙ্গে বছর দুই ঘর করেই নিষ্কৃতি পেয়েছে–ও পথ আর মাড়ায়নি। কিন্তু দেবী ধান্যেশ্বরীর সেবা চলে নিয়মিত। আর তার সঙ্গে দেবী সূর্যমুখীর প্রসাদে সে তুরীয় আনন্দে আছে।
টুলে বসে বিড়ি টানতে-টানতে সেই কথাই ভাবছিল গিরধর।
কালরাতের মৌজ এখনও কাটেনি। উপরি পয়সা হাতে এলে এটু ফুর্তি না করে পারে না সে।
হাসপাতালের স্টুডেনবাবুরা দিলদরাজ। শুধু মুখে খোশামুদ নয়, হাতে সিকি-আধুলি গুঁজে দিয়ে যায় বায়নাস্বরূপ। বডির বায়না।
ডেড বডি জোগাড় কি চাট্টিখানি কথা? তাকে অবশ্য কিছুই করতে হয় না। দালালরাই বড়ি পৌঁছে দিয়ে যায় ঘরে। কম দামে কিনে চড়া দামে বেচে দেয় গিরধর। তাকেই সব করতে হয়। মড়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও কেনাবেচার সময়ে কোনও ডাক্তারবাবুই থাকেন না।
খোলা দরজায় উঁকি মারল দুটি মুণ্ড। একজনের মুখ তরতরে, চোখেমুখে কথা কয়। অপরজনের চোখ পাচার চোখের মতন বকুটিল, টেপা-ঠোঁট, শুকনো মুখ।
বিড়িটা দাঁতে কামড়ে বললে গিরধর, ফিকির-ফকির যে! এত সকালে?
চৌকাঠ পেরিয়ে এল তারা। তরতরে মুখ যার, সে বেশ ঢ্যাঙা, ডিগডিগে। পেচক-চক্ষু গাঁট্টাগোট্টা। প্রথম জন ফকিরচাঁদ, দ্বিতীয় জন ফিকিরলাল। দুজনেই লাশ চালানি। গিরধরলালের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়।
ফকিরচাঁদ হেসে বললে, মাল আছে।
হাত নেড়ে গিরধরলাল বললে, দরকার নেই। কাল একটা পেয়েছি।
একটু দমে গেল ফকির। কিন্তু ফিকিরের মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না।
ফকিরচাঁদ বললে, সস্তায় দিব। লিয়ে লাও।
অর্থাৎ সস্তায় কিনে কাঠের বাক্সের মধ্যে বরফচাপা দিয়ে রাখলেই হবে। স্টুডেনবাবুরা কালকেই বডি চাইবে।
বিড়ি কামড়েই বলল গিরধর, কত?
সোয়া-শ।
যা, ভাগ।
কত দিবি বলবি তো?
সত্তর।
শেষ পর্যন্ত রফা হল নব্বই টাকায়। বডি আনতে চলে গেল ফিকির আর ফকির। মনে মনে হিসেব করে দেখল গিরধর। একদিনেই ষাট টাকা লাভ। সূর্যমুখীর নাকছাবির খরচটা তো উঠে গেল।
ঘণ্টা তিনেক পরে ফিরে এল ফিকির আর ফকির। সঙ্গে আরও দুই ব্যক্তি। মাথায় করে এনেছে একটা ঝকা। চারজনে ধরাধরি করে মেঝেতে নামাল ঝাঁকাটা।
ঝাঁকার মধ্যে একটা মুখবাঁধা বস্তা। মুখের দড়ি খুলে দিল ফিকির আর ফকির। বস্তার পেছনের কোণ দুটো ধরল শক্ত মুঠোয়। তারপর হ্যাঁচকা টানে বস্তা উপুড় করে দিল মেঝের ওপর।
ধপ করে বস্তার মধ্যে থেকে ছিটকে এল একটা কিশোর বালকের প্রাণহীন দেহ।
চোখ কুঁচকে বস্তা উপুড় করার ধরনটা দেখছিল গিরধরলাল। মানুষে মরে গেলেও এইভাবে কেউ তাকে ছুঁড়ে ফেলে না। ডেড বডি নিয়ে এত হেলাফেলা বড় বেশি দৃষ্টিকটু।
এবার চোখ ফিরল বডির দিকে।
এবং ফেরাতে পারল না বেশ কিছুক্ষণ।
ছেলেটি সুদর্শন। বছর চোদ্দো-পনেরো বয়স। গায়ের রং তামাটে। কিন্তু নাকমুখ বেশ ধারালো। মৃত্যু এখনও তার সতেজ লাবণ্য কেড়ে নিতে পারেনি। বাঁ-রগটা সামান্য কেটে গেছে এবং রক্ত ক্ষরণের দাগ রয়েছে।
অনিমেষে চেয়ে রইল গিরধর। বিড়িটা ধরা রইল দাঁতের ফাঁকে। ভুলে গেল টানতে। কোথায় যেন একটা খুঁত রয়েছে ধরতে পারছে না সে।
স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই তো মনে হচ্ছে। বল প্রয়োগের এতটুকু চিহ্ন নেই…অথচ কোথায় যেন একটা গলদ রয়েছে… ।
…না! ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হবে না। মনে খটকা যখন লেগেছে…
বিড়িটা নামিয়ে গিরধর বললে, তা হলে নব্বইতে রাজি তো?
আরে হা হা, চোখেমুখে কথা কয়ে উঠল ফিকির।
দাঁড়া, টাকা নিয়ে আসি ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে।
তোর কাছে নেই?
না। দাঁত বার করে হাসল গিরধর। কাল রাত্তিরে উড়িয়ে দিয়েছি। দাঁড়া, আসছি।
অ্যানাটমির ডিমন্সট্রেটর ডক্টর রক্ষিতকে এক নিশ্বাসে আপন সন্দেহের কথা বিবৃত করল গিরধর। ডক্টর রক্ষিত প্রবীণ, বিচক্ষণ এবং বহুদর্শী। ভূকুঞ্চিত ললাটে শুনলেন গিরধরের সন্দেহের কাহিনি। টাটকা বডি, চোট লাগেনি কোথাও–অথচ খটকা লেগেছে শুনে এলেন ওর সঙ্গে।
মেঝের ওপর আঁকা, আঁকার পাশে শুন্য বস্তা এবং গতায়ু বালকের দেহসুষমার পানে ক্ষণেক চাইলেন ডাক্তার। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন ফিকির আর ফকিরের নির্ভীক মুখচ্ছবি। হেঁট হয়ে ডেড বডির হাত-পা তুলে নেড়ে আড়ষ্টতা পরখ করলেন, চোখের পাতা টেনে অক্ষি-তারকা লক্ষ করলেন।
লাশের ওপর চোখ রেখে সহজ গলায় জিগ্যেস করলেন, কত দিতে হবে?
নব্বই, জবাব দিল ফকিরচাঁদ।
দাঁড়াও–আনছি টাকা, বলে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। পেছনের দরজা দিয়ে মর্গের বাইরে গিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা হাজির হলেন থানায়।
থানার ছোট দারোগা একনাথ রায় নিবিষ্ট চিত্তে শুনলেন ডক্টর রক্ষিতের সন্দেহ কাহিনি। সামনের দিকের খানকয়েক চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে-চালাতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধু একটা প্রশ্নই করলেন, গিরধরলালের কথা বাদ দিন। আপনার সন্দেহ হল কেন?
পাঁচটি কারণে। মুখটা ফোলাফোলা, চোখ দুটোয় রক্তজমা, দেহটা টাটকা আর হাত-পা আড়ষ্ট।
সূচীতীক্ষ্ণ চেয়ে রইলেন পুলিশকাকা একনাথ রায়। ঈষৎ ঝুঁকে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, পঞ্চম কারণটা বললেন না তো?
সেটা আপনি নিজে দেখবেন। দেখলেই বুঝবেন।
চোখে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল একনাথ রায়ের। ঘণ্টা বাজিয়ে সেপাইকে ডাকলেন। ডাক্তারকে বললেন, আপনি গিয়ে ওদেরকে আটকে রাখুন। আমি আসছি।
থানা থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে এসে পেছনের দরজা দিয়ে সটান ডিসেক্টিং রুমে ঢুকলেন ডক্টর রক্ষিত। ঢুকেই লক্ষ করলেন, ঘরের আবহাওয়া পালটে গিয়েছে।
চঞ্চল হয়েছে ফকির আর ঘনঘন আঙুল মটকাচ্ছে ফিকির। অন্য দুই ব্যক্তি আঁকা নিয়ে উশখুশ করছে যাওয়ার জন্যে।
এক লহমার মধ্যেই ডক্টর রক্ষিত উপলব্ধি করলেন, তার অবর্তমানে বেস কিছু বলেছে গিরধরলাল।
কিন্তু নিরতিশয় চতুর তিনি। তাই কিছুই যেন লক্ষ করেননি, এমনিভাবে বললেন ফকিরচাঁদকে, বড় মুশকিলে পড়লাম।
চকিত চাহনি নিক্ষেপ করল ফকিরচাঁদ।
কিন্তু উত্থান পতন নেই ডাক্তারের কণ্ঠে। বললেন, একশো টাকার নোট ছাড়া কিছুই নেই। ভাঙাতে পাঠিয়েছি রামলক্ষ্মণকে।
ফিকির ঠোঁটটা কামড়ে ধরেই ছেড়ে দিল–বলল শুষ্ককণ্ঠে, দশটা টাকা আমার কাছেই ছিল।
–তাই নাকি? দেখো দিকি, খামোকা দাঁড় করিয়ে রাখলাম। থাগ্নে, রামলক্ষ্মণ এসে পড়বে এখুনি।
গিরধর জানল না–ডাক্তারবাবু এই অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ ফাঁড়ি ঘুরে এসেছেন। মুখগোঁজ করে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ফাঁক পেয়ে বলে উঠল, ডাগদর সাব, ফকির বলছে ছালা থেকে ফেলতে গিয়ে রগ কেটে গেছে লাশের
ঠিকই বলছি, তেড়ে উঠল ফরিকচাঁদ।
আহা, তাতে হয়েছে কী? ডাক্তার যেন বড় বিড়ম্বিত বোধ করলেন ফকির-গিরধরের ঝগড়ায়। বললেন, রগটা সামান্য কেটেছে বই তো নয়।
কিন্তু–গিরধর নাছোড়বান্দা।
তুই থাম, ধমকে উঠলেন ডক্টর রক্ষিত।
থতমত খেল গিরধর। ডক্টর রক্ষিতের মহৎ গুণ–তিনি রাগতে জানেন না–মোটেই গলা চড়ান না। মাটির মানুষ। অথচ এমন তেড়ে উঠলেন–বিশেষ করে বাইরের লোকের সামনে..
মনে বড় লাগল গিরধরের। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
ফিকির আর ফকির গিরধরলালের তাড়না দেখেও হৃষ্ট হয়নি। চকিত দৃষ্টি বিনিময় ঘটল দুজনের মধ্যে। ফিকির গলা ঝাড়া দিয়ে বললে, বড্ড তাড়া ছিল। আজ আসি, ডাক্তারবাবু–
ডক্টর রক্ষিত তো অবাক, সে কি রে! টাকা না নিয়ে যাবি কোথায়?…রামলক্ষ্মণকে বলিহারি যাই। নোট ভাঙাতে ট্যাকশালে গেল নাকি? ও বাবা গিরধর দেখ না গিয়ে গেল কোথায়?
গিরধরলাল অগ্রসর হওয়ার আগেই ফিকির-ফকির দরজার দিকে এগোল। যেতে-যেতে বললে ফিকির, আজ বড্ড তাড়া আছে স্যার। কাল আসবখন।
উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ডক্টর রক্ষিত। কিন্তু পরক্ষণেই বসে পড়লেন।
একনাথ রায় কখন জানি আবির্ভূত হয়েছেন নিঃশব্দে–আখাম্বা চেহারার পাহারালাকে নিয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন।
মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিল ফিকির-ফকির এবং আঁকামুটে দুজন। সবার আগে সংযত হল ফিকির। পেচকচক্ষু সঙ্কুচিত করে হিসহিসিয়ে উঠল, এ কী! পুলিশ কেন!
একনাথ রায় জবাব দিলেন না। ধীরেসুস্থে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন ডেড বডির পাশে। ক্ষণকাল স্থির নেত্রে কি দেখলেন।
তারপরই ঘুরে দাঁড়িয়ে হুকুম দিলেন কাঠ-চেরা গলায়, লাগাও হাতকড়া।–মার্ডার!
.
এই পর্যন্ত বলে পুলিশ কাকা বাড়ি কাঁপিয়ে খানিকক্ষণ হাঁচলেন। আমি তড়বড় করে জিগ্যেস করলাম, কি দেখে বুঝলেন মার্ডার?
একনাথ বললেন নীরসকণ্ঠে, এই সহজ জিনিসটাও মাথায় এল না? গিরধর পর্যন্ত ধরে ফেলেছিল!
.
ময়নাতদন্ত রিপোর্টটা আসতেই বারবার অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়লেন একনাথ রায়। তারপর উঠে দাঁড়ালেন সশব্দে। ঘরময় পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। অনেক ভাবলেন। কুল কিনারা পেলেন না।
নিরেট রহস্য! ছিদ্র কোথাও নেই। বড় আশা ছিল, পোস্ট মর্টেম হলেই মৃত্যুর কারণ ধরা পড়বে। সেই রিপোর্টের বশে চারটেকে চালান দেবেন।
কিন্তু ময়নাতদন্তে কিসসু ধরা পড়েনি। ছেলেটা নাকি মরবার সময়ে বেশ সুস্থ ছিল এবং কোনও অসুখবিসুখে ভোগেনি। মৃত্যুর কোনও কারণ আবিষ্কার করতে পারেননি ডাক্তাররা। পারেননি বলেই অনুমান করছেন মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, রগটা খানিকটা কেটে গেছে ঠিকই। কিন্তু তার জন্যে মৃত্যু হতে পারে না। অথচ আর কোথাও চোট লাগার চিহ্ন নেই।
কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নন একনাথ। যে চারজনকে ঢুকিয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজন মার্কামারা বডি-স্ন্যাচার। বডি-স্ন্যাচারদের আসল কারবার কি, দেশশুদ্ধ লোক জানে। সুতরাং খুনি তারাই।
কিন্তু জুরী তো তা শুনবে না। অমুক লোক অবশ্যই হত্যাকারী বললে ধোপে টিকবে না– প্রমাণ চাই।
অথচ এক কণা প্রমাণও হাতে নেই।
অনেক চিন্তার পর অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে এলেন একনাথ রায়। প্রমাণ ব্যাতিরেকে খুনের চার্জ আনা আদৌ উচিত হবে কিনা, সে পরামর্শ দিতে পারবেন একজনই–থানাদার উমানাথ ভদ্র।
উমানাথ কুশাগ্রবুদ্ধি পুলিশ অফিসার। সঙ্কট মুহূর্তে সুসম পরামর্শদাতা হিসাবে সুনাম আছে। বয়েসে প্রৌঢ়–কিন্তু এখনও খাটতে পারেন প্রচণ্ড খাটাতেও পারেন তেমনি। কৌতুকপ্রিয়। কিন্তু কাজের সময়ে তিনি অন্য মানুষ। তখন অটল গাম্ভীর্য এবং প্রখর ব্যক্তিত্বে সমাচ্ছন্ন। দেখে মনেই হয় না অবসর সময়ে সহকর্মীদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করতে তিনি অদ্বিতীয়।
একনাথ ঘরে ঢুকতে ফাইল থেকে চোখ তুললেন উমানাথ ভদ্র। বললেন, কী সংবাদ বৎস?
কেস আছে।
কী কেস?
সংক্ষেপে রহস্যের জটাজাল বিবৃত করলেন একনাথ রায়।
শিবনেত্র হয়ে সব শুনলেন উমানাথ। শুনতে-শুনতে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন।
নিমীলিত নয়নে কিছুক্ষণ একনাথ রায়ের পানে চেয়ে আস্তে-আস্তে বললেন, না, প্রমাণ ছাড়া খুনের চার্জ আনা যাবে না। আসামিদের ছেড়ে দিতে হবে।
চোখে-চোখে চেয়ে আছেন একনাথ রায়। উমানাথও চোখ ফেরালেন না। একরোখা একনাথের অভিপ্রায় তিনি উপলব্ধি করেছেন।
বললেন ধীরকণ্ঠে, কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে প্রমাণ নেই? প্রমাণ খোঁজবার কী-কী চেষ্টা করেছ বলো তো?
হঠাৎ একনাথের মনে পড়ল ময়নাতদন্তের রিপোর্টের একটি লাইন। ডাক্তাররা লিখেছেন, মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নাকি বত্রিশপাটি দাঁত উৎপাটন করে নেওয়া হয়েছে ছেলেটির।
ছোট্ট সূত্র। কিন্তু আঁধারে আলো। তদন্ত শুরু করা যেতে পারে।
.
দিন কয়েক উদয়াস্ত খাটলেন একনাথ রায় এই সূত্র ধরে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, যেদিন লাশ বিক্রি করতে হাসপাতালে আসে ফিকির আর ফকির, তার আগের দিন বেলেঘাটার একটা তাড়িখানায় তাড়ি খাচ্ছিল ওরা তিনজন–ফিকির, ফকির আর সেই মুটে দুজনের একজন। নাম তার শ্রীশচন্দ্র। রুমালমোড়া একরাশ দাঁত টেবিলে রেখেছিল ফকির। সাফ করছিল মদ খেতে খেতে।
পরবর্তী খবর পাওয়া গেল বৌবাজারের একটা হাতুড়ে চিনা ডেনটিস্টের কাছে। সেইদিনই রাতে অনেকগুলো দাঁত ফকির সেখানে বিক্রি করেছে।
কিন্তু তারপর? ছেলেটাকে যে মার্ডার করা হয়েছে, তার প্রমাণ কই?
লৌহ মনোবলেও চিড় ধরল এবার। নিরাশ হয়ে বসে রইলেন একনাথ অফিস টেবিলে। প্রমাণ নেই! ফিকির-ফকিরের অপরাধ সপ্রমাণ করার কোনও উপাদান তার হাতে নেই। সেকালে মরা মানুষের দাঁত বিক্রি কোনও অপরাধ নয়।
হেনকালে পাহারালা রামশঙ্কর সবুট স্যালুট করল ঘরে ঢুকে।
সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন একনাথ রায়।
রামশঙ্কর এই কদিন বিস্তর মেহনত করেছে এই কেসে।
রামশঙ্কর নিবেদন করল যে তাড়িখানায় বসে ফিকির এবং ফকির তাড়ি খেয়েছিল, ফকিরচাঁদের বাসা নাকি তার অনতিদুরে। বেলেঘাটার খালপাড়ে।
–তাতে কী হল? শুষ্ক কণ্ঠে শুধোলেন একনাথ রায়।
–উহ্ মোকান সার্চ করনে সে কুছ তো মিলেগা।
কথাটা আগে মাথায় আসেনি একনাথ রায়ের। বিস্মিত হলেন সেজন্যে। তারপর ভেবে দেখলেন, লাভ কী? নিধন-চিহ্ন নিহত ব্যক্তির দেহতেই থাকে। সে দেহ কাটাছেঁড়া করে দেখা হয়েছে। বাড়ি দেখে কী হবে?
যাই হোক, পাহারালা রামশঙ্করের কাঁধে অপর্ণ করলেন সেই দায়িত্ব–গুরুত্বহীন বলেই।
রামশঙ্কর ফিরে এসে তার মনোমত রিপোর্টই দিল। লাশ-লুঠেরাদের ঘরে কোদাল-গাঁইতি শাবল উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যায়নি। মার্ডার কেসে অকাট্য প্রমাণ হওয়ার মতো কিসসু চোখে পড়েনি।
.
কিন্তু ছেলেটি কে?
বসে-বসে সেই কথাই ভাবছিলেন একনাথ। তার গায়ের রং তামাটে, মুখ চোখ সুদর্শন। ফিকির এবং ফকিরের খপ্পরে সে পড়ল কীভাবে? নিবাস কোথায় তার?
এবার একনাথ রায় মনস্থ করলেন–তিনি নিজেই বেরোবেন।
কোয়ার্টারে গেলেন আধ ঘণ্টার জন্যে। কাবার্ড খুলে বার করলেন ছদ্মবেশ ধারণের সরঞ্জাম। দশ-বারো জোড়া বিভিন্ন আকৃতির পাদুকা থেকে বেছে নিলেন মোটর-টায়ার থেকে তৈরি ছেঁড়া চটিজুতো। মলিন ধুতি আর রং-সিমেন্ট মাখা সার্ট নির্বাচন করলেন হ্যাঁঙারে ঝোলানো ছেঁড়াখোঁড়া বেশভূষার মধ্যে থেকে। একনাথ রাস্তায় নেমে এলেন দিন মজুরের ছদ্মবেশে। ফটকে দণ্ডায়মান কনস্টেবল মুচকি হাসল এবং সবুট স্যালুট ঠুকল মজুরবেশী পুলিশ কাকাকে।
বেলেঘাটা খালের ঠিক ধারে ছোট্ট ভাটিখানাটি সন্ধের পর থেকেই জমজমাট হয়ে ওঠে দিনমজুর আর কারখানা শ্রমিকদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
একনাথ ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে এসে বসলেন ভাটিখানায়। তিনি নেশা করেন না। অথচ নেশার ভান করলেন এক ভঁড় তাড়ি সামনে রেখে। ঝিমোতে লাগলেন কৃত্রিম নেশার ঝেকে কান আর চোখ রইল সজাগ।
গতকাল পুলিশ হানা দিয়েছিল তাড়িখানায়। সঙ্গে রামশঙ্করও ছিল। ফকিরচাঁদ এবং ফিকিরলাল নাকি পুলিপোলাও খাচ্ছে থানা হাজতে খুনের চার্জে। তাড়িখানা সরগরম সেই প্রসঙ্গ নিয়ে।
লাও বাবা, হেঁচকি তুলতে তুলতে বলছিল একজন ধুনুরি।
কেন খুন হল, তা তো বলবি।
কে আবার, সেই ছোঁড়াটা, চানা চিবুতে চিবুতে বলল কয়লাওলা মিশির।
কৌ ছোকরা?
উত্তীর্ণ হলেন একনাথ। সংগৃহীত টুকরোটাকরা তথ্যগুলি থেকে ধীরে-ধীরে নিহত বালকের বৃত্তান্ত পূর্ণ রূপ নিল।
ছেলেটার নাম আবদুল। থাকতো রাজাবাজারের বস্তিতে। অনাথ। সাদা ইঁদুরের খেলা দেখাত পথেঘাটে। ফিকিরর্চাদের বাড়িতে এই সেদিন তাকে ঢুকতে দেখা গেছে। তখন তার মাথায় লাল রঙের ফেজ টুপি ছিল। কবে?–যেদিন লাশ নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল ফকিরচঁদ, তার আগের দিন–
আরও কিছুক্ষণ বসে রইলেন একনাথ রায়। তারপর তাড়ির ভাড় হাতে নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন খাল পাড়ে। ভাড়টা খালের জলে ছুঁড়ে দিয়ে অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।
নিচ্ছিদ্র ষড়যন্ত্র। আবদুলকে ফকিরচাঁদই ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছে বাড়ির মধ্যে খুনও করেছে। কিন্তু কীভাবে? ডাক্তাররাও তা বলতে পারেনি।
.
পরের দিন সকালবেলা উমানাথ ভদ্র তলব করলেন একনাথ রায়কে।
একনাথ স্যালুট করে বসলেন সামনের চেয়ারে।
উমানাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁকে দেখলেন।
পেনসিল দিয়ে টেবিলের ওপর টকটক শব্দ করে শুধোলেন অবশেষে, ফকিরচাঁদ আর ফিকিরলালের কেস কবে?
আগামী পরশু।
খুনের চার্জ আনবার প্রমাণ পেয়েছ?
না।
রিপোর্ট দাও–মুখে।
একনাথ রায় অল্প কথায় বললেন কীভাবে পদে-পদে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। বললেন, ডেনটিস্টের কথা, রামশঙ্করকে দিয়ে ফকির-ফিকিরের বাড়ি তল্লাশির কথা এবং সবশেষে ভাটিখানায় অভিযানের কথা।
তিনবার তিন পথে তদন্ত পরিচালনা করেছেন–তিনবারই অন্তে শূন্য লাভ করেছেন।
শুনতে-শুনতে উমানাথ থমথমে মুখে শুধু বললেন, ছিঃ একনাথ! তুমি জমাদারকে দিয়ে খানাতল্লাশি করেছ?
কিন্তু স্যার, সে কিছুই পায়নি।
তর্ক করো না। তুমি কি চাও রামশঙ্কর কাল থেকে তোমার চেয়ারে বসুক?যাও।
আরক্তমুখে বেরিয়ে এলেন একনাথ রায়। ঘরে বসে টেবিলে মাথা গুঁজে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ধীরে-ধীরে আত্মস্থ হলেন। উমানাথ ভদ্র তাঁর উপকারই করেছেন। পুরস্কারের সঙ্গে তিরস্কারেরও প্রয়োজন।
.
আধঘণ্টার মধ্যে লোকজন নিয়ে বেলেঘাটার হাজির হলেন একনাথ রায়।
খালের পশ্চিম পাড়ে ভাটিখানা। তার একশো গজ দূরে ফকিরর্চাদের বাড়ি। পেছন দিকে খানিকটা বাগান। তারপর মস্ত পুকুর। রেললাইন চোখে পড়ে বাগানে দাঁড়ালে।
বাড়িটার সামনের দিকের দেওয়াল ইটের তিন দিকের দেওয়াল দরমা আর মাটির। কুলুঙ্গীর আকারে অতি ছোট জানলা। ছাদ লাল টালির। হেঁট হয়ে না ঢুকলে দরজায় মাথা ঠুকে যায়।
বাড়ির সদর দরজা থেকে প্রতি ইঞ্চি জায়গা দেখতে-দেখতে ভেতরে প্রবেশ করলেন একনাথ রায়। দেওয়ালে চোরা কুলুঙ্গী আছে কিনা পরখ করলেন, মেঝের নিচে পাতালকুঠরি আছে কিনা যাচাই করলেন, রান্নাঘরের উনুনের ছাই ঘাঁটলেন, মাচার জিনিসপত্র সব নামিয়ে আনলেন। খাঁটিয়া ঠুকে দেখলেন। একটিমাত্র টিনের তরঙ্গ খুলে জিনিসপত্র লাটঘাট করে ফেললেন।
রামশঙ্করকে হুকুম দিলেন–যা কিছু পাওয়া গেল তার ফর্দ বানাতে।
নিজে টহল দিয়ে এলেন বাগানে। উঁকি মারলেন কোণের কুয়োর ভেতরে। গাছপালাগুলো অযত্নবর্ধিত। সামান্য একফালি জমিতে আবর্জনার ভঁই। ভাঙা ক্যানেস্তারা আর হাবিজাবি জিনিস ছড়ানো। কুয়োর পর কাটাগাছের বেড়া। তারপর পুকুর।
এসে দাঁড়ালেন বাড়ির মধ্যে। একখানাই ঘর। পাশে রান্নাঘর। কলতলা খোলা উঠোনে।
কোথাও আবদুল হত্যার কোনও সূত্র নেই।
অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইলেন মাচা থেকে নামানো পাঁচমিশেলী জিনিসের দিকে। কোদাল, খোন্তা, শাবল, ছেঁড়া ন্যাকড়া, অনেকগুলো খালি বোতল, একটা টুপি…
চোখ সরাতে পারলেন না একনাথ রায়।
ফেজ টুপি! লাল রঙের! এইরকম টুপি মাথায় আবদুলকে দেখা গিয়েছিল ফকিরচাঁদের বাড়ি ঢুকতে!…
ভেতরে-ভেতরে নতুন উৎসাহ, নতুন উত্তেজনা অনুভব করলেন একনাথ। পাওয়া গেছে…একটা প্রমাণ অন্তত পাওয়া গেছে…আবদুল যে ফকিরদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল সে প্রমাণ পাওয়া। গেছে।
তারপর? খুন হল কীভাবে? পরে ভাবা যাবেখন। দেখা যাক, মাচার জঞ্জালের মধ্যে আর কি আছে।
নতজানু হয়ে নিজেই আবর্জনা হাঁটকাতে শুরু করলেন একনাথ রায়।
এবার পেলেন একটা হাফপ্যান্ট।
ছোট ছেলের নীল হাফপ্যান্ট। রক্তাক্ত। প্যান্টে কালচে রক্ত চামাটি ধরে রয়েছে।
নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন একনাথ রায়। রক্তমাখা প্যান্ট। আবদুলেরও হতে পারে। কিন্তু আবদুলের গা থেকে এত রক্তপাত ঘটল কোন ক্ষত মুখে? রগ সামান্য কেটে গিয়েছিল–এত রক্ত রগ থেকে বেরোয়নি। তবে?
একটা ঘোর সন্দেহ দেখা দিল মনে।
আবদুল ছাড়াও এ বাড়িতে খুন হয়েছে আরও একটি ছেলে–এ প্যান্ট তার!
পুলিশ ফাঁড়ি।
একনাথ রায়ের ঘর। টেবিলে সাজানো লাল ফেজ টুপি, আর রক্তমাখা নীল প্যান্ট।
রাইটার জমাদার খাতা-পেনসিল নিয়ে তৈরি। চেয়ারে এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একনাথ।
ঘরে ঢুকল ফকিরচাঁদ। থানাহাজতের জামাই আদরে এই কদিনেই মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তরতরে চনমনে ভাবটা যায়নি। চোখের মধ্যে ভয়ডরের লেশমাত্র নেই।
ঘরে পা দিয়েই টেবিলের দিকে তাকাল ফকিরচাঁদ। চোখের তারা ঈষৎ বিস্ফারিত হয়েই স্বাভাবিক হয়ে গেল। জিনিস দুটি এ-স্থানে সে আশা করেনি।
কর্কশকণ্ঠে শুধোলেন একনাথ রায়, চিনতে পারছ?
আজ্ঞে? ফকিরচঁদ যেন শুনতেই পায়নি।
টুপি আর প্যান্ট কার?
কী করে বলব বলুন।
তোমার ঘরের মাচায় ছিল, আর তুমিই জানো না?
মাচায় অনেক জিনিসই আছে–ভাড়া নেওয়ার সময়ে মাচায় উঠে দেখিনি।
সজোরে অধর দংশন করলেন একনাথ রায়। জেরা করলেন আরও কিছুক্ষণ–কিন্তু বৃথাই।
গেল ফকিরচাঁদ–এল ফিকিরলাল। তার মুখভাব আরও ভাবলেশহীন। চোখের তারকা অতিশয় স্থির। বিস্ফারিত হতেই জানে না।
তারপর এল শ্রীশচন্দ্র জিজ্ঞাসাবাদ করে শুধু একটা খবরই পাওয়া গেল তার কাছে। শ্রীশচন্দ্র থাকে ফকিরচাঁদের লাগোয়া বাসায়। ফকিরদের মতো টালির বাড়ি। পেছনে বাগান।
চতুর্থজনের নাম পচা। পেশায় আঁকামুটে।
রাইটার জমাদারকে বিদায় দিয়ে সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন একনাথ রায়। মানসচক্ষে দেখতে পেলেন পাশাপাশি দুটি বাড়ি ফকিরচাঁদের আর শ্রীশচন্দ্রের। একটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা হয়েছে–আর একটি…
কিন্তু বৃথা হল খানতল্লাশি। শ্রীশচন্দ্রের বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।
যথা সময়ে আসামিদের নিয়ে আদালতে হাজির হলেন একনাথ রায়। আরও তদন্ত সাপেক্ষে সময় প্রার্থনা করলেন। হাকিম তা মঞ্জুর করলেন–কিন্তু বেকসুর খালাস করে দিলেন পচাকে। কারণ সে পেশায় ঝকামুটে। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, শেয়ালদা স্টেশন থেকে ফকিরচাঁদ তাকে নিয়ে এসেছিল বস্তা বইবার জন্যে।
ফিকির, ফকির আর শ্রীশচন্দ্রকে নিয়ে থানায় ফিরলেন একনাথ রায়।
উমানাথ ভদ্র আর তাকে তলব করেননি। উনিও দেখা করেননি। দেখা করার মতো মুখ নেই।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল একনাথ রায়ের। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা কথা উদ্ভাসিত হল মনে।
সটান উঠে বসলেন একনাথ। তখনও তিনি অবিবাহিত।
মানসচক্ষে দেখলেন পাশাপাশি দুটি বাড়ি–পেছনে বাগান। বাড়ি দুটি খুঁটিয়ে দেখেছেন– দেখেননি কেবল বাগানের মাটি।
বাকি রাত না ঘুমিয়ে কাটালেন তিনি। ভোররাতেই থানায় গিয়ে লোকজন জড়ো করে হানা দিলেন বেলেঘাটার। কয়েক ফুট মাটি কুপিয়ে ফেললেন দুটি বাগানেই।
শ্রীশচন্দ্রের বাগানের জঞ্জালের গাদার নিচে আলগা মাটির তলায় পাওয়া গেল একটা সাদা শাড়ি আর সায়া। সায়ার মাঝখান থেকে টেনে ছেঁড়া–যেন গিঁট খুলতে তর সয়নি ছিঁড়ে খোলা হয়েছে–আর ফকিরদের বাগানে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেল একটা খয়েরি হাফ প্যান্ট, একটা কালো ইজের এবং একটা ধুতি আর ফতুয়া।
বেলা আড়াইটেয় শেষ হল খোঁড়াখুঁড়ি পর্ব। চড়া রোদে দাঁড়িয়ে একনাথ রায় উপলব্ধি করলেন সেই নির্মম সত্য।
মোট ছটি খুন হয়েছে এই দুটি বাড়িতে। লাল ফেজ টুপি, নীল প্যান্ট, কালো ইজের, খয়েরি প্যান্ট, সায়া-শাড়ি এবং ধুতি-ফতুয়া সেই হতভাগ্যদেরই পরিধেয়!
আচ্ছন্নচিত্তে রোদে দাঁড়িয়ে রইলেন একনাথ রায়। মর্মস্পর্শী সত্যটা উদঘাটিত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হল। আবদুল হত্যার রহস্য এখনও অমীমাংসিত লাশ পাওয়া গেছে, ডাক্তাররা ব্যবচ্ছেদ করেছেন কিন্তু হত্যার উপকরণ এবং পদ্ধতি এখনও অজ্ঞাত।
এমতাবস্থায় আরও পাঁচটি নিখোঁজ লাশ এবং সেই সম্পর্কিত তদন্তভার কাঁধে এসে চাপল।
হুঁশ ফিরল রামশঙ্করের ডাকে, হুজুর!
চোখ তুললেন একনাথ রায়। চোখ জ্বালা করছে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, চল।
বুকের ওপর চিবুক গুঁজে থানায় ফিরলেন। সমস্ত রাস্তায় মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল এক চিন্তা। ফকিরচাঁদ নিশ্চয় মন্ত্রপ্রয়োগে ছটি মানুষকে বধ করেনি। পাঁচটি লাশ বিনা বাধায় বিক্রি করেছে–ডাক্তারদের চোখে ধুলো দিয়ে। ষষ্ঠ লাশটিও অনুরূপভাবে খণ্ড-খণ্ড হত। রগটা সামান্য কেটে গিয়েছিল বলে হল না।
কিন্তু তার মন্ত্রগুপ্তি কী?
থানার সিঁড়ি দিয়ে নতমস্তকে উঠতে গিয়ে নজরে পড়ল এক জোড়া জুতো। ওপরধাপে দাঁড়িয়ে আছেন উমানাথ ভদ্র।
চোখ তুললেন একনাথ রায়। উমানাথ গম্ভীর চোখে চেয়ে আছেন তাঁর পানে–মুখ গম্ভীর।
তিরস্কৃত হওয়ার পর থেকে আর থানাদারের চৌকাঠ মাড়াযনি একনাথ রায়। পণ করেছিলেন রহস্যের মীমাংসাসূত্র আবিষ্কার না করা পর্যন্ত ঘরে ঢুকবেন না।
উমানাথ তা উপলব্ধি করেই যেন পথরোধ করে দাঁড়িয়েছেন।
বললেন ভরাট গলায়, ঘরে এসো।
রাতে ঘুম নেই, সকাল থেকে চড়া রোদে মাথা মুখ ঝলসে গিয়েছে, মনে চরম নৈরাশ্য; এই মুহূর্তে উধ্বতন অফিসার স্নেহক্ষরিত কণ্ঠে আমন্ত্রণ জানালে মানুষের মনে আবেগের আলোড়ন উপস্থিত হবেই। একনাথ রায় বাহ্যত রুক্ষ কিন্তু ভাবালুতার অতীত তিনি নন। তাই একটা পুঁটলি ঠেলে উঠল গলার কাছে। মাথা হেঁট করে বস-এর পেছন পেছন গেলেন তার কক্ষে ঢুকলেন।
হাতের ইঙ্গিতে একনাথকে চেয়ারে বসালেন উমানাথ। টেবিল ঘুরে গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। পেছনে হেলান দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে নিরীক্ষণ করলেন একনাথ রায়ের নিদ্রাহীন উৎকণ্ঠাক্লিষ্ট মুখ।
মন্থর কণ্ঠে বললেন, একনাথ, আমার সেদিনকার রূঢ়তা মনে রেখো না। আজ কী পেলে?
একনাথ সংক্ষেপে গুটি কয়েক কথায় প্রতিবেদন পেশ করলেন।
গালে হাত দিয়ে শুনলেন উমানাথ। বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু সঙ্কুচিত হয়ে এল শেষের দিকে নাসিকারন্ধ্র ঈষৎ স্ফীত হল হাফপ্যান্ট ইত্যাদি উদ্ধারের কাহিনি এবং মর্মস্পশী অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্তটা শুনে।
চোখ ফিরিয়ে চেয়ে রইলেন জানলা দিয়ে। একটা সিগারেট ধরালেন। মৃদু টান দিতে লাগলেন। মনে-মনে পর্যালোচনা করলেন সহকর্মীর অভিযান কাহিনি।
অবশেষে সিগারেটের দগ্ধাংশ ছাইদানীতে গুঁজে দিয়ে ফের তাকালেন ঘাড় বেঁকিয়ে।
বললেন, কুয়োটা দেখেছ?
একনাথ রায় আশা করেছিলেন নতুন পদনিদের্শ। কুয়ো দেখার কথা তিনি বলতে ভুল করেননি। তবু কেন সেই প্রশ্ন?
বললেন গাঢ় কণ্ঠে, দেখেছি।
কীভাবে দেখেছ?
ওপর থেকে ঝুঁকে। জল ছাড়া কিছু নেই।
আঃ! বলতে-বলতে রক্ত জমে উঠল উমানাথের ফরসা মুখে, জলের তলায় কী আছে দেখোনি কেন?
বিদ্রোহীকণ্ঠে একনাথ রায় বললেন, তা হলে তো পাশের পুকুরটার তলাতেও দেখতে হয়।
শক্তচোখে চাইলেন উমানাথ, একনাথ, বেলেঘাটার পুকুরের জলে জেলে জাল ফ্যালে, লুকোনোর পক্ষে তাই বাড়ির পাশের পুকুর নিরাপদ নয়। কিন্তু জেলে কি কুয়োতে জাল ফেলে?
আস্তে-আস্তে খাড়া হয়ে বসলেন একনাথ রায়। অনিবার্য সিদ্ধান্তটা নিমেষমধ্যে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ল মাথার মধ্যে।
আমাকে মাপ করবেন স্যার। এখুনি যাচ্ছি।
.
ফিরলেন বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পর।
লোকজন ডেকে জল ঘেঁচেছেন কুয়োর। স্নান হয়নি, আহারও হয়নি। নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করেছেন।
কাজ হয়েছে উমানাথের তাড়নায়। তিরস্কারের পুরস্কার পেয়েছেন হাতে-হাতে। রোদ ঝলসানো উপবাসক্লিষ্ট কালো মুখেও তাই হাসির ঝলক ফুটেছে। বেশ কয়েকদিন পরে মনটা হালকা হয়েছে। দু-হাত পেছনে রেখে দাঁড়ালেন বস-এর সামনে।
স্নেহাস্পদর সহাস্য মুখ দেখে কৌতুক কটাক্ষ হানলেন উমানাথ।
কি হে, রাজ্য আর রাজকন্যে দুটোই জয় করে এলে নাকি?
আজ্ঞে না, সে রকম কিছু পাইনি।
তবে কি পেলে? আর একটা লাশ?
আজ্ঞে, তাও না।
তা হলে? মণিমাণিক্য সোনাদানা?
প্রায় সেইরকমই।–দামের দিক দিয়ে।
বলো কী! দেখাও তোমার সাগরহেঁচা মাণিক।
পেছন থেকে হাতজোড়া সামনে নিয়ে এলেন। একনাথ রায়। বললেন, এইটা।
জিনিসটা একটা লেডিজ শাল। কালো রঙের।
কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইলেন উমানাথ। তারপর বললেন সবিস্ময়ে, মেয়েদের শাল। কিন্তু এর দাম হিরে জহরতের সমান হল কী করে?
আমার কাছে তাই।
চোখ চকচকর করল উমানাথের, মার্ডারের মেথড পেয়েছ?
আজ্ঞে।
এই শালটাই সেই মেথড?
বলতে পারেন।
হেঁয়ালি রাখো, একনাথ, ঈষৎ গলা চড়িয়ে বললেন উমানাথ। কি জেনেছ বলো।
আজ্ঞে, যা জেনেছি, তা আপনার সামনেই রয়েছে। শাল-টাই শেষ পর্যন্ত শাল দিল ফকিরচাঁদকে।
একনাথ!
আপনি ভাবুন। আমি যা বলবার আদালতে বলব। বলে, সবিনয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন একনাথ।
উমানাথ ভদ্র উপলব্ধি করলেন শুধু চ্যালেঞ্জ নয়–এই কদিনের রুক্ষ আচরণের পালটা জবাব দিয়ে গেলেন তার সুযোগ্য শিষ্য।
.
পরের দিন উমানাথ নিজেই উপস্থিত হলেন একনাথের অফিসকক্ষে। শিষ্যটি তখন ঘাড় হেঁট করে নোট লিখছেন খাতায়। পদশব্দে মুখ তুললেন এবং গাত্রোত্থান করলেন।
কতদূর এগোলে? জিজ্ঞাসা করলেন উমানাথ।
আজ্ঞে, আপনাকে একটা টিপস দিতে পারি।
কি রকম? তরল কণ্ঠ উমানাথের।
শাল-টা যার, সায়া-শাড়িও তার। একই স্ত্রীলোকের। নাম তার মহাকালী। পেশায় পতিতা। মাস দেড়েক সে ঘরে ফেরেনি। কিন্তু শালটা দেখেই ভাটিখানার মালিক চিনতে পেরেছিল। মার্কামারা শাল।
আর কিছু? নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন উমানাথ।
ঠোঁট টিপে বললেন একনাথ, আজ্ঞে না।
বড় কঠিন ঠাঁই, মনে-মনে বললেন উমানাথ।
একনাথ বস-এর মুখ দেখে মনের ভাব অনুধাবন করলেন। সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, হুকুম করলে কিন্তু আমি বলতে বাধ্য।
আত্মসম্মানে লাগল উমানাথের। বললেন, না থাক। দেখি আমি ভেবে।
কিন্তু অনেক ভেবেও কালো শাল থেকে হত্যার মেথড বার করতে পারলেন না।
.
আদালত প্রাঙ্গণ। সেদিন লোক হয়েছে খুব।
ফকির-ফিকিরের ফৌতি ব্যবসার কাহিনি পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে–সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবীন পুলিশ অফিসার একনাথ রায়ের নাম।
আদালতে তাই আজ এত ভিড়। কেউ বলছে ফকির জন্মান্তরিত ঠগী সর্দার আমীর আলি। মা ভবানীর প্রসাদ নিয়ে পথিকদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে পথে পুঁতে রাখত। এ জন্মে সে মায়ের প্রসাদে স্রেফ মন্ত্রের জোরে নরহত্যা করছে–বাঘা পুলিশ আর দুদে ডাক্তাররাও অপারগ হয়েছে হত্যার পদ্ধতি নির্ণয় করতে। কেউ বলছে তার চাইতেও লোমহর্ষক কাহিনি। ফকির-ফিকির যুগ্মভাবে নাকি হাজারখানেক হত্যা করেছে কলির ভীষ্ম একনাথ রায় আসরে অবতীর্ণ না হলে ছেলেপুলেরা কেউ নিরাপদ না। ইত্যাদি, ইত্যাদি…
সংক্ষেপে, সারা শহরে টি-টি পড়ে গিয়েছে ফৌতি ব্যবসা নিয়ে।
উৎকণ্ঠা চরমে উঠল একনাথ রায় প্রবেশ করতেই। হাতে একটা কাঠের বাক্স। ক্যাশবাক্স বলেই মনে হল। ডালার আংটা ধরে ঝুলিয়ে আনলেন এবং আসন গ্রহণ করলেন কাঠগড়ার সামনে।
জোড়া-জোড়া চোখ ছানাবড়ার আকারে স্থির হয়ে রইল বাক্সটার ওপর। কী আছে ভেতরে? ফকির ফিকিরের অজ্ঞাত রহস্য নিশ্চয় মনুষ্যবধের অভিনব উপকরণ।
বিচারপতি প্রবেশ করলেন মঞ্চে। জুরীরা বসলেন যে যার আসনে। শুরু হল সওয়াল জবাব। যথা সময়ে ডাক পড়ল একনাথ রায়ের।
বাক্সটা হাতে নিয়ে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন একনাথ রায়। কাঠগড়ার সামনেই পেশকার পান্নাবাবুর টেবিল। বাক্সটা সেই টেবিলে রাখলেন।
পান্নাবাবুকে বললেন, একটা কাগজ দেবেন?
কাগজ এগিয়ে দিলেন পান্নাবাবু। ঝর্ণা কলম বার করে কাগজে কি লিখলেন একনাথ রায়। পেশকারের হাতে দিয়ে বললেন, ধর্মাবতারের টেবিলে রাখুন।
নীরবে হুকুম তামিল করলেন পান্নাবাবু। ধর্মাবতার কাগজ খণ্ডতে চোখ বুলোলেন। নিবিড় বিস্ময় ঘনীভূত হল চোখে। হুকুম দিলেন, ফকিরচাঁদ, ফিকিরলাল আর শ্রীশচন্দ্রকে বিপরীত দিকের কাঠগড়ায় হাজির রাখা হোক।
একনাথ রায় বাগাড়ম্বর করলেন না। মামলার সংক্ষিপ্তসার গুছিয়ে বললেন। সবশেষে বললেন, এই নরমেধ যজ্ঞের হোতা তিনজন–ফরিকচাঁদ, ফিকিরলাল এবং শ্রীশচন্দ্র। কিন্তু প্রমাণ নেই। আমি একটি খুনের দৃশ্য আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করব। দেখে বিচার করুন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই বলে এই কশাইদের লোকালয়ে ছেড়ে দিয়ে এতগুলি নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন করা উচিত হবে কিনা।
সামনের আসনে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে তদগতচিত্তে সহকর্মীর ভাষণ শুনছিলেন উমানাথ। এখন আড়চোখে তাকালেন বিপরীত কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান তিন আসামির দিকে।
এতক্ষণ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়েছিল তিনজনে। একনাথের শেষ কথায় ঈষৎ উদ্বেগ উপস্থিত হল তিনজোড়া চোখে।
একনাথ কাঠের বাক্সের ডালা খুললেন। একটা কাঁচের গেলাস রাখলেন কাঠগড়ায় চওড়া রেলিংয়ের ওপর। একটা বেতের রিঙ আটকে দিলেন গেলাসের মাথায়। রিঙ থেকে উঠেছে দুটো খাড়াই কাঠি–দুটো কাঠির মধ্যে আড়াআড়িভাবে আর একটা কাঠি দিয়ে জোড়া। শেষোক্ত কাঠির মাঝখান থেকে একটা টোয়াইন সুতো ঝুলছে গেলাসের তলদেশ পর্যন্ত।
এক বোতল জল বার করলেন বাক্স থেকে। জল ঢাললেন গেলাসে–বেশি না–দেড়ইঞ্চি পরিমাণ।
এবার বেরোল একটা দু-ইঞ্চি লম্বা কাঁচের পুতুল। দু-হাত বুকে জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।
সবশেষে বার করলেন একফালি কালো কাপড়–প্রস্থে দু-আঙুল, দৈর্ঘ্যে এক আঙুল।
সবকটি বস্ত কাঠের রেলিংয়ে সাজিয়ে রেখে আদালত কক্ষের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন একনাথ রায়। ঘর ভরতি লোক রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে আছে তাঁর পানে।
দম নিয়ে শুরু করলেন একনাথ, ধর্মাবতার, আমি শুধু একজনের খুনের দৃশ্য এখানে দেখাবো। নাম তার মহাকালী। বৃত্তিতে পতিতা। গায়ে কালো শাল দিয়ে খদ্দের খুঁজতে বেরোত রাস্তাঘাটে– কল-কারখানার আশে-পাশে। বয়স তিরিশ।
ধরুন, এই পুতুলটা সেই মহাকালী। আর এই কালো কাপড়টা তার কালো শাল। শালটা পুতুলের কাঁধে জড়িয়ে দিলাম আপনাদের সামনে।
দেড়মাস আগে খদ্দের ধরতে বেরিয়েছিল মহাকালী। ফকির-ফিকির-শ্ৰীশ তাকে নিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। কিছু খাইয়ে বেহুঁশ করে ফেলল। তারপর পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিল কুয়োর মধ্যে এইভাবে… বলতে-বলতে টোয়াইন সুতোর প্রান্ত কাঁচের পুতুলের পায়ে বেঁধে গেলাসের মধ্যে নামিয়ে দিলেন একনাথ রায় পুতুলটাকে উলটো করে। মাথা রইল নিচের দিকে। কঁধ পর্যন্ত ডুবে রইল জলের মধ্যে। কালো কাপড়টা তলিয়ে গেল গ্লাসের তলদেশে।
সুতো ছেড়ে দিয়ে সটান ফিকির-ফকির-শ্রীশচন্দ্রের পানে চাইলেন একনাথ রায়। ধর্মাবতার তার আগেই সূকুটি করে চেয়েছিলেন সেইদিকে।
আদালতশুদ্ধ লোক দেখলছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে তিন আসামির একদা বেপরোয়া মুখ। এমনকী ফিকিরলালের পেচকচক্ষুর তারকাতেও ভয়ের কাপন অতিশয় প্রকট।
জুরীরাও দেখলেন সেই দৃশ্য। দৃষ্টি বিনিময় করলেন পরস্পরের সঙ্গে।
এতক্ষণে বোঝা গেল, নাটকের প্রারম্ভে একনাথ এই কথাই লিখে জানিয়েছিলেন বিচারপতিকে,
চোখ রাখুন তিন আসামির ওপর। মনের পাপ মুখের অগোচর থাকবে না!
এবং এই প্রতিক্রিয়া যাতে প্রমারস্বরূপ গ্রাহ্য হয়, তাই এত গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন। এই কদিন।
এখন, নাটকীয় প্রস্তাবনা দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন, অনুমান তাঁর অভ্রান্ত। উপসংহার টানলেন আরও কম কথায়।
বললেন আসামিদের ওপর চোখ রেখে, বেশ কিছুক্ষণ জলে চুবিয়ে রেখে মেরে ফেলা হল মহাকালীকে। বেহুঁশ করার জন্যে যা কিছু খাওয়ানো হয়েছিল–বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। শরীরের বাইরে কোথাও আঁচড়ের দাগ রইল না–ভেতরেও জল ঢুকল না–বেহুঁশ ছিল বলে মহাকালী ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে পারেনি। কিন্তু মি লর্ড, আবদুল তা করেছিল। তাই কুয়োর গায়ে লেগে রগটা সামান্য কেটে গিয়েছিল। মানুষ বেঁচে থাকলেই হার্ট রক্ত পাম্প করে মরে গেলে করে না। রগের কাটা দিয়ে তাই রক্ত বেরিয়েছিল আবদুলের মৃত্যুর আগে রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখেই বুঝেছিলাম, আবদুল লড়ে মরেছে।
একটু থেমে দম নিলেন একনাথ রায়। গেলাসটা মাথার ওপর তুলে বললেন, আপনারা দেখুন, কালো কাপড়টা জলের তলায় পড়ে। পুতুলটাকে মাথা নিচের দিকে করে না ডোবালে কিন্তু কাপড়টা খসে পড়ত না। কুয়োর তলায় কালো শাল দেখে তাই আমি ব্যাক ক্যালকুলেশান করে বাকিটা অনুমান করেছিলাম। বাগানে পাওয়া গেল শাড়ি আর শায়া–শালটা কুয়োর তলায় কেন?–স্ত্রীলোকটিকে মাথা নিচু করে চুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে।
থামলেন একনাথ রায়।
এক ঘর লোকের সামনে কুকীর্তির পুনরাভিনয় দেখে মনের আগল ভেঙে পড়েছিল তিন আসামির।
জেরার মুখে স্বীকার করল ফকিরচাঁদ, হ্যাঁ, একনাথ রায়ের কথা বর্ণে-বর্ণে সত্যি। মহাকালী বারবনিতা। মদ খেত। তাড়ির সঙ্গে আফিং খাওয়াতেই দশ মিনিটেই নেতিয়ে পড়েছিল। পায়ে দড়ি বেঁধে মুখ নিচের দিকে করে কুয়োর ঝুলিয়ে দিতে পাকস্থলীর আফিং বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে জলের ওপর দেখা গিয়েছিল শুধু কয়েকটা বুদবুদ। আধঘণ্টা রাখতে হয়েছিল এইভাবে। আরও খুন হয়েছে একই পন্থায়।
ছটফট করেছিল আবদুল। তাই কুয়োর গায়ে লেগে কেটে গিয়েছিল রগটা। কিন্তু মৃত্যুর পর যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়, তা জানা ছিল না বলেই মিধ্যে বলতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল গিরধরলালের কাছে।
কাহিনি শেষ করে ফোঁৎ-ফোঁৎ নাকঝাড়া শব্দের ফাঁকে-ফাঁকে পুলিশকাকা বললেন, এই ছোট্ট ব্যাপারটা..তোর ঘিলুতেও…ধরা পড়েনি..অথচ তুই লিখিস…গোয়েন্দা গল্প।
নীরস ব্যঙ্গ নীরবে হজম করে বাড়ি এসেই লিখে ফেললাম গল্পটা।
* বেতার-জগৎ পত্রিকায় প্রকাশিত (৪৬ বর্ষ, ১৯ সংখ্যা)।