প্রেমের মদ, বিয়ের ভিনিগার
পৃথিবীতে একজনই প্রেমিক ছিলেন, তিনি সাজাহান। যুদ্ধুটুদ্ধ তেমন করলেন না। দিগ্বিজয়ের ধার ধারলেন না। সাংঘাতিক একটা তাজমহল তৈরি করে জেলখানায় পচে মরলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের কলম থেকে অসাধারণ একটি কবিতা আদায় করে নিলেন। বাংলার দুই বিখ্যাত নাট্যকার দু-খানা নাটক লিখে ফেললেন। আর এই সেদিন পর্যন্ত অহীন্দ্র চৌধুরী ও ঠাকুরদাস মিত্র কলকাতার রঙ্গমঞ্চে রাতের পর রাত হাহাকার করে গেলেন।
আর একজন রাজাও অবশ্য ইতিহাস করে গেছেন। ইংলন্ডের অষ্টম এডওয়ার্ড। ১৯৩৬ সালে সিংহাসন ছেড়ে দিলেন। আমেরিকান মহিলা ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করবেন বলে। সিম্পসন এর আগে দু-বার বিবাহ করেছিলেন। অবশ্যই প্রেম করে। সে প্রেম টেঁকেনি। সিংহাসনত্যাগী রাজার গলায় মালা দিয়ে এই মধ্যবয়সী মহিলা অবশেষে শান্ত হলেন।
ইতিহাসে আর এক ডিউকের উল্লেখ পাওয়া যায়, নরম্যান্ডির ডিউক রবার্ট। একদিন দিবা-দ্বিপ্রহরে ডিউক ঘোড়ায় চেপে তাঁর রাজধানী ফ্যালেইসের দিকে চলেছেন। পথের পাশে এক স্রোতের ধারে একটি মেয়ে কাপড় কাচছে। মেয়েটি এক চর্মকারের কন্যা, নাম আরলেট। ডিউক প্রেমে পড়ে গেলেন। আরলেটকে সেই অবস্থাতেই ঘোড়ায় তুলে নিয়ে চলে গেলেন নিজের দুর্গে। ডিউকের স্ত্রী ছিলেন। সুন্দরী। বড় বংশের মেয়ে। হলে কি হবে। বাংলার প্রবাদ আছে, যাকে দেখে মজে মন, কি বা হাড়ি কি বা ডোম। শচীনদেব বর্মনের সেই গান—’প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ ঢেউ দিল, ঢেউ দিল রে আকুল হিয়ার দুকুল বুঝি ভাঙল রে!’ ডিউক আরলেটের প্রেমে হাবুডুবু। জন্মালেন উইলিয়াম। বিখ্যাত বীর, উইলিয়াম দি কনকারার। পৃথিবী প্রেমের জয়গান গাইলেও জারজ-সন্তানকে আজও গ্রহণ করতে শিখল না। বাস্টার্ড বলে নাক বাঁকায়। ঘৃণায় উইলিয়াম অনেক ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে বড় হয়ে, আলেঁসঁ নগর অবরোধ করলেন, তখন কারাবাসীরা তাঁর শক্তি বুঝতে না পেরে ব্যঙ্গ করে দেয়ালে-দেয়ালে চামড়া ঝুলিয়ে দিয়ে চিৎকার শুরু করল, ‘চর্মকারের জন্যে চামড়া।’ উইলিয়াম এই ব্যঙ্গের জবাব দিলেন তরোয়ালের মুখে। সারা শহরের মানুষকে কচুকাটা করে ছেড়ে দিলেন।
আমাদের রামী-চণ্ডীদাস কবি ছিলেন, তাই বাঁচোয়া। শুধু গান আর চাঁদের আলোর ইতিহাস। রাজা মহারাজা হলে কি হত জানি না। প্রেম আর প্রেমের ফল দু’রাস্তায় চলে।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং যখন পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেন, তখন বড় লোক ছাড়া কারুর সাধ্য ছিল না হাত বাড়াবার। এখন পেনিসিলিন ঘরে-ঘরে। সেই রকম প্রেম যখন মার্কেটে প্রথম বেরলো তখন সকলে সেই প্রেম-সায়রে ঝাঁপ দিতে পারেনি। অনেক বাধা ছিল। সমাজের চোখ-রাঙানি ছিল। কেউ প্রেম করছে শুনলে লোকে এমন ভাব করত যেন তার মায়ের দয়া হয়েছে। পাড়ায় গেজেট বসে যেত। আমার ছেলেবেলায় পাড়ার এক দাদা, পাড়ারই এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিলেন। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পর পাড়ার মাতব্বররা এক রবিবারের সকালে সেই দাদাকে ধরে প্রথমে মাথার আধখানা চুল কামিয়ে দিলেন। তারপর গালে চুনকালি মাখিয়ে, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরালেন। আর মেয়ের বাবা তিন দিনের মধ্যে দোজপক্ষের এক পাত্র জুটিয়ে মেয়েকে প্রায় জলে ফেলে দিলেন।
সে যুগ আর নেই। যুগ অনেক এগিয়ে গেছে। যুবক-যুবতিরা এখন নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই তৈরি করছেন। প্রেম এখন জেনারেল নলেজের মতো। না করাটাই গাঁইয়ার লক্ষণ। উত্তর কলকাতার একটা পার্ক আছে বিখ্যাত এক মানুষের নামে। সেই পার্কের চলতি নাম এখন বৃন্দাবন পার্ক। লাভার্স লেন। গাঁজাপার্কের মতো। সেখানে গাছের তলায়-তলায় হৃদয়ের লেনদেন হয়। সিসটেমটাও খুব সুন্দর। অনেকটা রেস্তোরাঁর মতো। চট করে ঢোকা যায় না। কিউ দিতে হয়। কর্মকর্তারা বলবেন, যাও ছ’নম্বর টেবিল খালি হওয়ার মতো, ছ’নম্বর গাছতলা খালি হয়েছে। অদৃশ্য মিটার আছে। ঘণ্টা হিসেবে চার্জ। এই গাছতলার কটা প্রেম পেকে সংসারের চাতালে ফেটে পড়ে, সে হিসেব নেই।
কলকাতার খুব কাছে গ্রাম-গ্রাম একটা জায়গায় খোলা একটা মাঠের পাশ দিয়ে লম্বা একটা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তায় প্রতিদিন সন্ধের সময় ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে কারফিউ জারি হয়। পাড়ার ছেলেরাই জারি করে।
সাইরেন বাজাবার মতো তিনবার হুইশল বাজে। দুম করে একটা পটকা ফাটে। ল্যাম্পপোস্টে দু-একটা যা আলো জ্বলে পটাপট নিবে যায়। এই দু’ঘণ্টার জন্যে পাড়ার কারুর বাড়ির বাইরে পা দেবার নিয়ম নেই। পান বিড়ির দোকানে এক ভদ্রলোক দেশলাই কিনতে এসে ঘড়ি দেখছেন আর তাড়া দিচ্ছেন। ‘জলদি ভাই, জলদি। এখুনি কারফিউ হয়ে যাবে।’
ভদ্রলোকের বাড়ি ওই রাস্তায়। দু’ঘণ্টা পরে আবার ‘অল ক্লিয়ারে’র বাঁশি না বাজলে ওই পথে হাঁটা যাবে না। বা গেলেও এমন সব দৃশ্য চোখে পড়বে যা বয়স্ক মানুষের পক্ষে গুরুপাক। ত্রৈলোক্যবাবু অনেক আগে লিখেছিলেন, সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে এক একটা মশার আকার-আকৃতি প্রায় চড়াইপাখির মতো। বাদা অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ভাই ও আমার লোক, ওর রক্ত আমিই শুষবো। তোমার লোক হল ওই দ্বিতীয়টা। সেই রকম পাড়ার ছেলেরাও প্রেমিক হিসেবে মার্কা হয়ে যায়। ও চঞ্চলার, সে শ্যামলীর, তুমি মানসীর। স্বামীজী বলেছিলেন, বলো, জন্ম হইতেই আমরা মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত। সেই বলি কি এ বলি! হায় উলটো বুঝলি রাম। মেয়ে-স্কুলের ছুটির পর রাস্তায় সাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ওপাশ থেকে, এপাশ থেকে, সেপাশ থেকে ছুঁচো বাজির মতো সাইকলের সে কি র্যালা। মেয়েদের সে কি হাসি! উলটে-উলটে পড়ছে। সাইকেলারোহী ডনজুয়ানদের পোশাকও একেবারে বাঁধাধরা। প্রেমের জার্সি। গাঢ় রঙের চোঙা প্যান্ট, হালকা রঙের বুকখোলা পাঞ্জাবি। যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনার ছেলেটি কি করে মশাই?’ উত্তর হবে, ‘প্রেম করে’। এই ‘এলডোরাডো’তে ছেলেদের আর কি আছে, প্রেম ছাড়া! শ্রীচৈতন্য থেকে স্বামীজী সকলেই বলে গেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ সে প্রেম, কি প্রেম, কেমন প্রেম অত বিচারে কি প্রয়োজন! আর প্রেম হল লেগে থাকার ব্যাপার, ভেরি এনগেজিং সাবজেকট। এক ধরনেরসাধনা। ধৈর্য বাড়ায়। পাশ থেকে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার বাক্যালাপ শুনলে বোঝা যায়, অমন বোকা-বোকা কথা স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ বলতেও পারে না, সহ্যও করতে পারে না। আসল কথা তো একটাই। কথামালার সেই একটা কথা হারিয়ে বসে আছে।
এই ধরনের কথোপকথন দু-একবার শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মধুর অভিজ্ঞতা :
প্রেমিকা : (দাঁতে ঘাস কাটতে কাটতে) জানো, মেজো বউদি না সন্দেহ করেছে।
প্রেমিক : (প্রেমিকার হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে-করতে) কী করে বুঝলে?
প্রেমিকা : আমি যখন তোমার কাছে আসব বলে বেরোচ্ছি না, তখন বলছে,
কি ঠাকুঝ্যি খুব উড়ছ, তাই না! তাও তো আমি কিছুই সাজিনি।
প্রেমিক : তোমাকে না সাজলেই ভালো দেখায়। কী সুন্দর!
প্রেমিকা : যাও, সুন্দর না ছাই। আমি বলে দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছি। আমার চেয়ে কত সুন্দরী তুমি পাবে!
প্রেমিক : আমার জন্যে তুমি এক পিসই তৈরি হয়েছ। জানো তো শ্যামল বলছিল, বিশু, তুই আজকাল কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিস।
প্রেমিকা : কোন শ্যামল? ওই হ্যাংলা মতো ছেলেটা ! ব্যাড়ব্যাড় করে বকে!
প্রেমিক : ধুস, ও তো জগা! শ্যামলকে তুমি দ্যাখোনি। দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।
প্রেমিকা : আমার মাথা ঘুরে গিয়ে দরকার নেই। আমার এই একটা ভূতেই জীবন আলো।
প্রেমিক : এই, সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাসো?
প্রেমিকা : (বুকে মাথা রেখে) কি তোমার মনে হয়! তুমি আমার একমাত্র হনুমান! এই শ্যামলের কেউ নেই?
প্রেমিক : কেন থাকবে না! সবাই আছে। বাবা, মা, ভাই, বোন।
প্রেমিকা : দূর গাধা, আমার মতো কেউ নেই!
প্রেমিক : তুমি যখন আমাকে গাধা, হনুমান বলো না! কি মিষ্টি শোনায়! কি মিষ্টি, কি মিষ্টি! শ্যামল প্রেম…টেম বোঝে না। ব্যাটা মহা সেকেলে। আর সময় কোথায়? সি এ করছে। পাশ করেই বাবার ফার্মে বসে যাবে।
প্রেমিকা : আর তুমি কী করছ?
প্রেমিক : আমি তুমি করছি।
প্রেমিকা : আমাকে একেবারে উদ্ধার করে দিচ্ছ। কবে বিয়ে করবে?
প্রেমিক : মাড়োয়ারীদের মতো কথা বোলো না তো! ভাও কেতনা, ভাও কেতনা!
প্রেমিকা : একটা কিছু করবে তো! দুম করে বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিলে তখন কী করবে?
প্রেমিক : আত্মহত্যা! বিষ খাব, বিষ।
প্রেমিকা : এই, সত্যি তুমি আত্মহত্যা করবে! বলো না গো!
প্রেমিক : তোমার জন্যে আমি সব করতে পারি।
প্রেমিকা : কেবল পারো না একটা চাকরি জোটাতে। শ্যামলের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবে?
প্রেমিক : কেন ঝুলে পড়বে?
প্রেমিকা : দ্যাখো মনটাকে ছোট কোরো না। ঝুলে পড়ার হলে, আমার দাদার বন্ধুর গলায় কোন কালে ঝুলে পড়তুম। জানো, তার একটা লাল মারুতি গাড়ি আছে।
প্রেমিক : অ, তাই আমাকে তিনদিন দাঁড় করিয়ে রেখে এলে না।
প্রেমিকা : বললুম না, আমার জ্বর হয়েছিল। বিশ্বাস হল না!
প্রেমিক : আগে হয়েছিল, এখন আর হচ্ছে না।
প্রেমিকা : আমার গলার কাছে হাত দিয়ে দ্যাখো, এখনও একটু-একটু জ্বর আছে। মাইরি বলছি, অন গড।
ছেলেটি এরপর এমন ভাবে মেয়েটির জ্বর পরীক্ষা করতে লাগল, ইডেনে রাত নেমে এলেও আর বসা গেল না।
এই হল প্রেমের প্রথম পর্ব। যেসব প্রেম প্রথম পর্ব পেরিয়ে দ্বিতীয় পর্বের দিকে গড়ায়, তার তৃতীয় পর্বটা সুখের হয় না। যেমন, একটি সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে লম্বা-চওড়া একটি ছেলের প্রেমে পড়ে গেল। ছেলেটি অশিক্ষিত। সামান্য একটা চাকরি করত। আর মাঝে-মাঝে খুব রংচঙে পোশাক পরে পাড়ার ক্লাবে বিগড্রাম বাজাত। তখন তাকে রূপকথার নায়কের মতো দেখাত। সেই ড্রামারের দুর্বার আকর্ষণে মেয়েটি একদিন শিক্ষা, সংস্কৃতি, বংশ-মর্যাদার পাঁচিল টপকে ছেলেটির গলায় মালা পরিয়ে দিল। একে বলে প্রেমের ম্যালেরিয়া। হিস্টিরিয়াও বলা চলে। কেঁপে এল অনেকটা তড়কার মতো। হুঁ হুঁ করে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি। তারপর। দ্বিতীয় পর্বে কী হবে? অনেকটা লটারির মতো। ছেলেবেলায় আমি একটা খেলা বড়দের খেলতে দেখেছিলাম, কোথায় ঠিক মনে নেই। যতদূর মনে হয় মধুপুরে। দেওয়ালের গায়ে একটা গোঁজ পোঁতা, দূর থেকে একটা টুপি ছুঁড়ে সেই গোঁজে আটকে দিতে হবে।
খেলাটার নাম ছিল, ‘টু পেগ এ হ্যাট।’ প্রেমের বিয়ে হল ওই টুপি ছোঁড়ার খেলা। সংসারের গোঁজে আটকাল তো আটকাল, নয়তো পড়ে গেল মাটিতে। ‘টু মিস দি পেগ।’ আমার এই গল্পের মেয়েটির প্রেমের টুপি গোঁজ-ভ্রষ্ট হল। নিজের পরিবার-পরিজনেরা বাড়ি ঢোকা বন্ধ করে দিলে। অবশ্য কারণও ছিল। ভাইয়েরা এই মওকায় বাপের সম্পত্তির পুরোটাই হাতিয়ে নিলে। দেখেশুনে বোনের বিয়ে দিতে হলে, পঞ্চাশ, ষাট ব্যাঙ্ক ব্যালেনস থেকে ঝরে যেত। ব্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে বেরিয়ে ভালোই হয়েছে। ওদিকে ব্যান্ডমাস্টারকে মেয়েটির যদিও বা প্রেমের পেন্ট মেরে সহ্য হল, অসহ্য হয়ে উঠল তার ঘর-সংসার, অসহনীয় মনে হল তার আনকালচারড বাবা-মাকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রেমের রং ফিকে হয়ে গেল। সংসারের কুইনিন বটিকায় প্রেমের ম্যালেরিয়া ঘাম দিয়ে ছেড়ে গেল। ব্যান্ডমাস্টার শেষে ব্যান্ডের বদলে বউকে ধরে পেটাতে আরম্ভ করল। মাঝেমধ্যে থানাপুলিশও হতে লাগল। শেষে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল প্রতিবেশীর সমস্যা।
সব ক্ষেত্রেই যে এতটা আশাভঙ্গের কারণ হবে তা নয়। অসম জুটির এমন সমস্যা হতেই পারে। তবে সমাজের ওপর-তলায় ঘটনা খুব একটা সুখের হয় না। এসব নিয়ে আমরা তেমন মাথা ঘামাই না। সমীক্ষাটমীক্ষাও হয় না। কে কাকে বিয়ে করল, কেমন করে করল, কেন ফাটল ধরল, ব্যক্তিগত, পরিবারগত ব্যাপার। আমরা বুঝি প্যাঁপোর প্যাঁপোর নিমন্ত্রণ, খাওয়াদাওয়া, এক সন্ধ্যার হল্লাগুল্লা। তারপর যার ম্যাও সে সামলাক। তবে কাগজের কল্যাণে নানা খবর তো উড়ে আসে। যেমন শিল্পীদের প্রেমজ বিয়ে না এদেশে, না বিদেশে, ধোপে ঢেঁকে না। উদাহরণ, এলিজাবেথ টেলার কতবার যে বিয়ে করেছেন নিজেরই মনে নেই। রিটা হেওয়ার্থ মোট পাঁচবার বিয়ে করেছিলেন। পঞ্চস্বামীর একজন ছিলেন, প্রিনস আলিখান। এর আগে বিয়ে করেছিলেন অরসান ওয়েলসকে। অবশেষে যা হয়। বোতল, বার্ধক্য, বুদ্ধিভ্রংশ, মৃত্যু।
বিদেশের কথা থাক। জন্মালে যেমন মরতে হয়, ওদেশ বিয়ে করলে তেমনি ডিভোর্স করতে হয়। আমাদের দেশেও সেই হাওয়া বইছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নামকরা হলে ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকি। যাঁরা নামকরা নন অথচ ওপরতলা, কি মধ্যতলার চরিত্র, তাঁরাও প্রেমের পিরিয়ডে এক রকম, বিয়ে পরে আর একরকম।
কারণ খুব সাধারণ। যখন প্রেম চলেছে তখন সবই সুন্দর। মধুবাতা ঋতায়তে, মধুক্ষরন্তি সিন্ধব। লাভ ইজ ব্লাইন্ড। প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, এ কথা আমরা শুনেছি। স্যামুয়েল জনসন ভারী সুন্দর বলেছিলেন, ‘Love is the wisdom of the fool and the folly of the wise. বাংলা করব না, করলে মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে। দাঁত একটু উঁচু, চোখ সামান্য টেরা, গাল ঈষৎ ভাঙা, প্রগলভ, দামড়ার মতো চালচলন, নাক থ্যাবড়া। প্রেমের সময় এসব চোখে পড়ে না। বিয়ের পর, পার্ক থেকে খাটে উঠলে অস্ফুট ‘বলহরি’ শোনা যায়। যতক্ষণ প্রেম ততক্ষণ ব্যাপারটা ফুরফুরে। তুমি আমার আমি তোমার। বিয়ের পর নানা সম্পর্কের ভিড় চারপাশে। নানা জনের নানা চাহিদা। কর্তব্যের মালা গাঁথা। তখন গাছতলায় পাশাপাশি বসে বাদাম-ভাঙা গল্প নয়, ভূমিকাপালন। প্রেমের এই দ্বিতীয় পর্বে চতুর্দিকে কষ্টিপাথর ছড়ানো। অনবরত ঘষামাজা। সমস্যাটা মেয়েদেরই বেশি। মেয়েদেরই নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে আসতে হয়। খাপ খাইয়ে নেওয়ার কথাটা তাদের দিকেই ওঠে। তারাই হোঁচট খায় বেশি। ছেলেদের মানসিকতা বড় চটুল। অজানাকে জানা হয়ে গেলে তারা আবার বিজয় অভিযানে বেরোতে চায়। প্রেমে দুজনের সম্পর্ক থাকে সমান সমান। প্রায়শই ছেলেরা তখন অতিমাত্রায় নরম থাকে। অনেক সময় ভিখিরির মতো নতজানু। নিজের আসল চেহারাটা ঢেকে রেখে এগিয়ে আসে প্রার্থীর মতো। গানেই তো আছে, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি।’ ছাঁদনাতলা থেকে বউ হয়ে প্রেমিকা যেই ছেঁচতলায় এল প্রেমিক স্বামী তখন প্রভু। সংস্কার যাবে কোথায়? মেয়েদের ক্ষেত্রে সেইটা একটা বড় রকমের আঘাত। আগে তার পায়ে যে মাথা ঘষতো, এখন তার পায়ে মাথা ঘষতে হবে। সম্পর্কের এই রূপান্তর ভূমিকম্পের মতো। কল্পনার প্রাসাদ ভেঙে চুরে চুরমার। সমারসেট মম ‘দি সামিং আপ’—এ সুন্দর একটি কথা বলেছেন, It takes two to make a love affair and a man’s meat is too often a woman’s poison. এখন প্রশ্ন হল প্রেমই বা কি? বিবাহই বা কি! নি:স্বার্থ প্রেম বলে কিছু আছে কি? বিখ্যাত রসিক জেরোম কে জেরোম, ‘দি আইডল থটস অফ এন আইডল ফেলো’তে লিখছেন, প্রেম হল হামের মতো। প্রত্যেকেরই একবার করে হবে। আর হামের মজা হল, একবার হলে আর দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর ‘ট্রু লাভ’ প্রকৃত প্রেম সম্পর্কে ১৬৬৫ সালে লা রকিফাউলকড যা বলে গেছেন তার আর জুড়ি নেই, True love is like ghosts, which everybody talks about and few have seen. প্রকৃত প্রেম হল ভূতের মতো। সবাই বলে, কিন্তু দ্যাখেনি কেউ।
জ্ঞানী মানুষের উপদেশ, যাকে প্রেম করবে তাকে বিয়ে করবে না। স্বার্থের সংসারে প্রেম পুড়ে যায়। যে প্রেম বিয়ের পরেও বেঁচে থাকবে সে প্রেম আমরা শিখিনি। বিখ্যাত মনস্তত্ববিদ এরিখ ফ্রম, ‘দি আর্ট অফ লিভিং’-এ যা শেখাতে চেয়েছেন তা আমাদের দ্বারা জীবনেও হবে না। তিনি বলেছেন, Immature love says : ‘I love you because I need you’, Mature love says : ‘I need you because I love you’.
কাঁচা প্রেম বলবে : ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ আমি তোমাকে চাই।’ পাকা প্রেম বলবে, ‘আমি তোমাকে চাই কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
একটা গল্প মনে পড়ছে। অ্যারিস্টটলের এক ছাত্র প্রেমে একবারে হাবুডুবু। ছুটে এল গুরুর পরামর্শ নেওয়ার জন্যে, বিয়ে করবে কী করবে না! অ্যারিস্টটল বললেন, ‘শোনো ছোকরা, যদি মনে হয় বিয়ে না করলেই নয়, তাহলে করে ফ্যালো। যদি সুখের হয় খুবই ভালো। যদি না হয়, তাহলে দু:খের কিছুই নেই। তুমি আমার মতো দার্শনিক হবে।’
গর্কি তাঁর ‘দি লোয়ার ডেফথস’—এ লিখে গেছেন, ‘মেয়েরা যখন বিয়ে করে সেটা কেমন জানো? শীতকালে বরফের চাদরে একটা গর্তে লাফ মারার মতো। একবারই করে আর মনে রাখে সারা জীবন।’
তাহলে সেই বিখ্যাত জার্মান প্রবাদটি মনে রাখা ভালো :
The bachelor is a peacock, the engaged man a lion, and the married man a Jackass. আইবুড়ো হল ময়ূর, প্রেমিক হল সিংহ, বিয়ের পর দামড়াগাধা। ‘চোখ খোলা রেখে বিয়ে করবে আর বিয়ের পর আধবোজা চোখে সারাজীবন কাটাবার চেষ্টা করবে।’ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের এই নির্দেশ কে পালন করবে? ফলে প্রেমের মদ হয়ে দাঁড়াবে বিয়ের ভিনিগার!
SUNDOR