প্রাণের লণ্ঠনে চৈতন্যের আলো
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সঙ্কল্প করেছেন, তিনি নরলীলা সমাপ্ত করে উৎসে ফিরে যাবেন। চোখের সামনে দেখছেন, বিপ্রশাপে যদুবংশ ধ্বংস হচ্ছে। লৌহমুষল সমুদ্রগর্ভে। কালে সেই মুষল থেকে হবে বাণ। ব্যাধের ভ্রমে প্রভু বাণবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাবেন। সবই জানেন, পারেন; কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা নেই। কারণ, কাজ শেষ। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : “ময়া নিষ্পাদিত হ্যত্র দেবকার্যমশেষতঃ।/যদর্থমবতীর্ণোহহমংশেন ব্রহ্মণার্থিতঃ।।”—আমি সন্তুষ্ট। ব্রহ্মার অনুরোধে যে-উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অংশাবতার বলরামের সঙ্গে এই সংসারে অবতীর্ণ হয়েছিলাম, দেবগণের অভিপ্রেত ভূভারহরণরূপ সেই কাজ আমি সম্পূর্ণ সম্পাদন করেছি। আমি তৃপ্ত। ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অভ্যুত্থান এবম্বিধ সন্ধিক্ষণে আমার অবতাররূপে অবতরণ। পাপ ধ্বংস করেছি, অনাগত কালের হাতে সব সমর্পণ করে আমার প্রয়াণ। আমিও নিহত হব।
ছায়ার মতো সদাসঙ্গী উদ্ধব বড় কাতর হয়েছেন। কেমন করে সহ্য করবেন এই চিরবিচ্ছেদ। কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছেন : “নাহং তবাঘ্ৰিকমলং ক্ষণাধর্মপি কেশব।/ত্যক্তং সমুৎসহে নাথ স্বধাম নয় মামপি।।”—হে কেশব, আমি সামান্য সময়ের জন্যও তোমার চরণকমল ছেড়ে দূরে থাকার সাহস পাই না। হে প্ৰভু, তুমি আমাকেও তোমার স্বধামে নিয়ে চল।
সে তো হওয়ার নয়, উদ্ধব! আমার অবর্তমানেও তোমাকে থাকতে হবে। কাল পূর্ণ করে যেতে হবে—কালের এই নিয়ম। উদ্ধব তখন অনুরোধ করছেন : “প্রভু! বলে যাও, তোমার অবর্তমানে আমি কিভাবে থাকব। মনকে কিভাবে সংযত, সংযুত করব!” ভগবান তখন উপদেশ দিচ্ছেন : “ত্বং তু সর্বং পরিত্যজ্য স্নেহং স্বজনবন্ধুষু।/ময্যাবেশ্য মনঃ সম্যক্ সমদৃগ্ বিচরস্ব গাম্।।”- শব্দাদি বিষয় থেকে মন তুলে নাও, আত্মীয়স্বজনের প্রতি মমতা ত্যাগ কর। সমদৃক্ অর্থাৎ সমদর্শী হও। সমদর্শী মানে, জগতের সমস্ত কিছু ব্রহ্ম হতে অভিন্ন—এই বোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তারপর, মনঃ ময়ি সম্যক্ আবেশ্য— মনকে সর্বতোভাবে আমার চিন্তায় নিবিষ্ট রাখ।
উদ্ধব তখন চিরকালের মানুষের এক চিরসংশয় ব্যক্ত করলেন—প্ৰভু! সমদৃক্ হওয়া কি সহজ কথা? এই সংসারে ভাল আর মন্দ মিলেমিশে আছে। যেখানে নিৰ্গুণ বা নির্দোষ কোন বস্তু বা ব্যাপার নেই, সেখানে সমদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে বিচরণ করা কিভাবে সম্ভব হতে পারে!
এ-প্রশ্ন একা উদ্ধবের নয়, এ-প্রশ্ন আমাদেরও। সমদর্শী হওয়া কি সহজ কথা! ভগবান তখন বলছেন—উদ্ধব! তুমি তো তোমার জগৎকে তোমার ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখছ, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিচার করছ। তারা যেমন বোঝাচ্ছে সেইরকম বুঝছ। “যদিদং মনসা বাচা চক্ষুৰ্ভাং শ্রবণাদিভিঃ।/নশ্বরং গৃহ্যমাণঞ্চ বিদ্ধি মায়া-মনোময়ম্।।”–এই যাকিছু মনের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা এবং চক্ষু কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত হয়, সেসবই মনের দ্বারা কল্পিত। অতএব উদ্ধব, সেসবই মায়াময় এবং নশ্বর বলে জানবে। শুধু জানাতেই শেষ নয়, তোমাকে সাধন করতে হবে; যেমন, ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত কর, তোমাকে বাঁদর নাচালেই নাচবে না, তারপর চিত্তকে একাগ্র করে এই বিস্তৃত জগৎকে নিজের আত্মায় দর্শন কর—”তস্মাদ্ যুক্তেন্দ্রিয়গ্রামো যুক্তচিত্ত ইদং জগৎ।/আত্মনীক্ষস্ব বিততমাত্মানং ময্যধীশ্বরে।।”—নিজেকে সবকিছুর অধিপতি ব্রহ্মস্বরূপ আমার মধ্যে দর্শন কর।
দুটো পথ, সংযম ও একাগ্র ধ্যান। এর ফলে কি হবে? মায়া সরে যাবে। শল্যচিকিৎসায় ছানি অপসৃত হবে, তখন দেখবে তুমি নেই, তিনিই আছেন। তিনি তুমি হয়ে বসে আছেন। “ঘট ঘটমে লেটা।” ধ্যান থেকে ধারণা আসবে।
উপনিষদের কথা—”তত্ত্বমসি।” তৎ ত্বম অসি। ‘তৎ’ অর্থাৎ ব্ৰহ্ম, ‘ত্বম’ মানে তুমি জীব। ‘অসি’ অর্থাৎ হও। তুমি ব্রহ্ম হও। বড় কঠিন অনুশীলন! ধারণাতেই আসে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমাতেই প্রকাশিত! জগৎ মায়া। যা ভয়ঙ্করভাবে আছে বলে মনে হচ্ছে, সেটা স্বপ্ন। দীর্ঘ একটা স্বপ্ন। এই যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে সাবান মেখে দাড়ি কামাচ্ছি, এটা স্বপ্ন। কেটে গেছে, ওষুধ লাগাচ্ছি, এটা স্বপ্ন। রোজ অফিসে গিয়ে চেয়ারে বসে কাজ করি, এটাও নিত্য স্বপ্ন। এই দেহ, এটা মায়া। চিমটি কাটলে লাগে, ওটা ভুল। চিমটিও নেই, লাগাও নেই। আমিও তো নেই। আমি জন্মাইনি, আমি মরিওনি। বাড়ি করেছি, নেমপ্লেটে নাম লিখেছি। এ হলো, যে নেই তার বাড়ি, তার নাম। লকারে যত সেভিংস সার্টিফিকেট, ব্যাঙ্কের পাসবই—ওসব মায়া, কাগজ মাত্র। পোড়া দড়ির ছাই লম্বা হয়ে দড়ির মতোই পড়ে আছে। হাত দিয়ে তুলতে গেলেই সব ভুস। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, বন্ধুবান্ধব যাবতীয় সম্পর্ক স্বপ্ন। স্বপ্নে বাঘ দেখছি, স্বপ্নে পরিবার সোহাগ করছে, হেঁচকি তুলে মরে যাচ্ছি, স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠছি।
প্রবোধানন্দ সরস্বতী অদ্বৈত সন্ন্যাসী ছিলেন। পরে মহাপ্রভুর কাছে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। বেদান্তমতে ব্রহ্ম ও জীব অভেদ। দুই বিভু। তাই মহাবাক্য ‘তত্ত্বমসি’। এই তৎ ও ত্বম্ সমান বিভক্তি, কর্মধারয় সমাস। প্রবোধানন্দের মহা সংশয়। প্রবোধানন্দ মহাপ্রভুকে প্রশ্ন করছেন, ‘তত্ত্বমসি’ মাথায় ঢুকছে না। জীব অণু! অণু কেমন করে ব্রহ্ম হবে? বিন্দু কোন্ আক্কেলে বলে, আমি সিন্ধু। মহাপ্রভু বলেছিলেন, এ তো সোজা! কর্মধারয় সমাসে না ভেবে, ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস করলেই তো সব সংশয়ের অবসান–তস্য তুম্ অসি, সেই তত্ত্বমসি-ই হবে। তুমি তাঁর অণু, তুমি তাঁর দাস।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ আসায় আধুনিক মানুষের ধর্মের যাবতীয় শুকনো ধাঁধা ও কচকচি থেকে মুক্তি হলো। ঠাকুর জানতেন বিজ্ঞান আরো গাঢ় হবে, টেকনোলজির চূড়ান্ত হবে, সন্ন্যাস আশ্রম টলমল হবে, মানুষ ভোগের সংসারে আচারের আমের মতো জরে থাকবে। ধর্মটাও টেকনোলজির কল্যাণে মেকানিক্যাল হয়ে যাবে, ক্যাসেটে আরতি হবে, প্রদীপের বদলে টুনিবাল্ব জ্বলবে, শাঁখে ফুঁ লিক করে ফুঁসফুঁস করবে, পৌঁ আর বেরবে না। দেবদেবীরা বুফে সিস্টেমে নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন। বারোয়ারিতে প্রতিমার চেয়ে প্যান্ডেলের এলাহি চেকনাই ক্রমশ বাড়বে। চন্দননগরের আলোর কেরামতিতে ডাইনোসর গলা দোলাবে। জানতেন তিনি। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, তত্ত্বমসি, মায়াবাদ প্রভৃতি কথা অলৌকিক শোনাবে। মানুষ আকাশের ঈশ্বর ছেড়ে কাম-কাঞ্চনের পিছনে ছুটবে। ভূমার চেয়ে ভূমি মূল্যবান হবে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে সাধনার ভেলকি দেখাতে আসেননি। কখনো কোন সিদ্ধাই হঠাৎ প্রকাশিত হলে ‘ও কিছু নয়’ বলে উড়িয়ে দিতেন। গ্রাম্য গালাগাল দিয়ে বলতেন, সিদ্ধাই হলো ধামাপোঁদো বেশ্যার বিষ্ঠা ত্যাগ। তিনি গুরুও হতে আসেননি। এসেছিলেন চিরকালের মানুষের চিরবন্ধু হতে। শাস্ত্র, যুক্তি, তর্ক নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। জোরের ধর্ম, তর্কের ধর্ম, ন্যায়ের ধর্ম, ইলাইট ধর্ম, শুকনো ধর্ম—সব টান মেরে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে মায়ার ব্যাখ্যা করলেন, কাম আর কাঞ্চন।
তুমি সত্য, তোমার দেহ সত্য, জগৎ, জীবিকা, পরিবার পরিজন সব সত্য। প্রবল ইন্দ্রিয় সত্য, ভোগ সত্য, আত্মিক লড়াই সত্য, দারিদ্র্য সত্য, প্রাচুর্য সত্য, খল, লোচ্চা, শয়তান, সাধু—সব সত্য। জ্ঞান সত্য, বিজ্ঞান সত্য, জড় সত্য, চিত্ত সত্য। জগৎ ঠিক যেমনটি দেখছ, তেমনই সত্য। তোমার সংস্কার, তোমার প্রবণতাও সত্য। বাস্তব জগৎ বাস্তবিকই আছে। জন্ম আছে, মৃত্যুও আছে। অধঃ, ঊর্ধ্বে আছে। বুদ্ধির স্তরভেদ আছে, আধারের বড় ছোট আছে। হজমশক্তি বিভিন্ন। যার পেটে যেমন সয়, মাছের রান্না ও পরিবেশন সেইভাবেই হবে। ধর্ম মানে ‘ড্রিল’ নয়, ধর্ম মানে টান। ধর্ম মানে সৎ, সুন্দর, চৈতন্যময় জীবনের আহ্বান। স্বজনে নির্জনতার সন্ধান, প্রকৃত বন্ধুর সন্ধান। নিরাকার আকাশ অথবা সাকার কোন প্রেমঘন মূর্তি—উভয়ই সত্য। সাত্ত্বিকের সংসার কোঁদলে ভরা আশ্রমের চেয়ে ভাল। ঘৃণ্য-দুখচেটে, তেলচিটে, লক্ষ্মীছাড়ার সংসার নয়; শুকনো সন্ন্যাস নয়, রসেবশের জীবনই জীবন। অস্ত্র হলো বিচার। জয় করতে হবে ভয়। আসক্তিই ভয়ের কারণ। আকাঙ্ক্ষা ধিকিধিকি আগুন। আসকারা পেলেই যা বাড়ে—কাম, বিষয়তৃষ্ণা, আলস্য, অহঙ্কার। বিচার হলো সেই স্পন্দন যা বিবেকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে। বিবেক সেই অমোঘ যুক্তি দেয়, এগিয়ে দেখ। জীবনের পাওনা ক্রমেই বাড়বে। অনিত্য থেকে নিত্যের দিকে নিয়ে যাবে, বিষয়ানন্দ থেকে দিব্যানন্দে। মৃত্যুকে স্মরণ কর। রোজ একবার ভাব—আজ আছি কাল নেই। কাঠবিড়ালির মতো কোটরে বাদাম কার জন্য সঞ্চয় করছ? জ্ঞান ও বিদ্যাকে দু-খণ্ড কর। জীবিকার জন্য ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। জীবনকে সহজ করার জন্য যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রয়োজন আছে। “খালি পেটে ধর্ম হয় না।” পেটবৈরাগী কাশী থেকে পরিবারকে চিঠি লেখে— গেরুয়া গঙ্গায় ভাসাইলাম, চাকুরি পাইয়াছি, বাসা ঠিক করিয়া তোমাকে শীঘ্রই লইয়া আসিব। আগে সংসার কর, একটু একটু ভোগ কর। স্বদারা-সহবাস অনুমোদিত, সংসার কর্তব্য, বিবাহ দশবিধ সংস্কারের এক সংস্কার। এধারটা দেখে নিয়ে জ্ঞানের অপর খণ্ডটি বের কর। চিনি থেকে বালি সরাও, দুধ থেকে জল। অনিত্য থেকে নিত্যকে বের কর। বৈরাগ্যে শান দাও। দেনাপাওনার ক্ষুদ্র সংস্কারকে চূর্ণ করে মহাকালের প্রান্তরে বেরিয়ে এস। অহং আমি-কে দাস আমি কর, জ্ঞানদাস—থাক শালা দাস আমি হয়ে, তস্য তুম্ অসি, তত্ত্বমসি। শরণাগত, কিন্তু ফোস ছাড়লে চলবে না। তুমিই তোমার গুরু। আত্মাই আত্মার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। নিজেকে তৈরি কর, বানাও। ভক্তির ময়ান দিয়ে সংযমে ঠাস, সঙ্কল্পের আঁচে ফেল, দেবভোগ্য হও। সংসারের সব খিটকেল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। মৃত্যু নয়—মুক্তির আনন্দে, শবরূপী জীবনের ওপর তুমি নাচবে মহাকালীর মতো। প্রাণের লণ্ঠনে জ্বাল চৈতন্যের আলো। এই হলেন আমার ঠাকুর!