1 of 2

প্রহরী – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

প্রহরী – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

বেওয়ারিশ কুকুর। রাস্তার কোনও অকুলীন নেড়ির অন্যতম সন্তান। ওর ভাইবোনেরা যখন রোঁয়া উঠে শুকিয়ে মরে গেছে, কিংবা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে দিব্যগতি লাভ করেছে, তখন কোন্ মন্ত্রে জোয়ান আর তাজা হয়ে বেড়ে উঠেছে ভুলুয়া।

এত জায়গা থাকতে বেছে বেছে কেন যে এই রাস্তার মাথায় সে বাসা নিয়েছে, সেকথা শুধু ভুলুয়াই জানে। দিনের বেলা ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়—স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করে। কিন্তু সন্ধে হলেই এখানে এসে বসে পড়ে প্রহরীর মতো। তখন চেনা মানুষকেও বেশ শব্দ-সাড়া করে গলিতে ঢুকতে হয়—অচেনা হলে তো পরিত্রাহি অবস্থা। ভুলুয়ার জন্যেই চোর ঢুকতে পায় না রাস্তায়।

ভুলুয়া নাম ওকে কে দিয়েছিল, কেউ জানে না। কিন্তু এক মুঠো ভাত নিয়ে ভুলুয়া বলে ডাক দিলেই ছুটে আসে হাঁপাতে হাঁপাতে। বড় বড় জিভ বের করে খায়, মলিন সাদা ল্যাজটা আনন্দে পটপট করে দোলে, কেমন ভিজে ভিজে চোখ মেলে তাকায় সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে। খাওয়া হলে নিজের চারদিকে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে পটকট করে গোটাকয়েক এঁটুলি ধরে পিঠ থেকে; তারপরেই কী যেন একটা জরুরি কাজ তার মনে পড়ে যায়—‘ভৌ’ করে একটা চাপা ডাক দিয়ে ছুটে যায় সদর রাস্তার দিকে।

ভুলুয়ার ওপর পাড়ার কারও রাগ নেই—এতদিন মন্দিরারও ছিল না। কিন্তু কাল মাঠের পুলের পাশে, শেষ কথাগুলো বলা হয়ে গেলে, যখন সাইকেলে দ্রুত প্যাডল করে শিশুগাছগুলোর আড়ালে অদৃশ্য হয়েছিল ননিগোপাল, আর পুলের রেলিং ধরে নীচের বদ্ধ খানিক কালো জলের দিকে তাকিয়ে নিজের রক্তে ঝড়ের ডাক শুনছিল মন্দিরা, তখন হঠাৎ তার ভুলুয়ার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

ভুল হয়ে গেছে—সাংঘাতিক ভুল। ভুলুয়ার কথা ননিগোপালকে বলা হয়নি।

ননিগোপাল সর্বসাকুল্যে তাদের বাড়িতে দিন দশেক এসেছে। তাও বিকেলের দিকে—সন্ধ্যার পরে নয়। ভুলুয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। কিন্তু রাত একটার পর যে মুহূর্তে ননিগোপাল তাদের গলিতে পা দেবে, তৎক্ষণাৎ—তৎক্ষণাৎ যা ঘটবে, তা কল্পনা করবার দরকার নেই। মন্দিরা তা বিলক্ষণ জানে। তিন মাস আগে খবর না দিয়েই বাগচিদের জামাই এসেছিল রাত এগারোটার ট্রেনে। সে বেচারিকে শেষ পর্যন্ত একটা পানাপুকুরের মাঝখান থেকে উদ্ধার করতে হয়েছিল।

মনের সমস্ত রোমাঞ্চকর উন্মাদনা একটা কুৎসিত বাস্তব আতঙ্কে রূপায়িত হল মন্দিরার। রাত একটার পরে রাস্তার অচেনা ননিগোপালকে দেখে ভুলুয়া যে তাণ্ডব জুড়ে দেবে—সেটা ভাবতেও মন্দিরার রক্ত জল হয়ে এল। উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে হবে ননিগোপালকে। ধরা পড়াও আশ্চর্য নয়। তারপর?

ঘরে এসে আলো জ্বেলে টেবিলে বসল মন্দিরা। পড়বার জন্যে নয়—সেই চিঠিখানা তাকে লিখে রাখতে হবে এ-বেলাই। গুছিয়েই লিখতে হবে একটু। বাবা দুঃখ পাবেন, মা হয়তো বিছানা নেবেন কিছুদিনের জন্যে। ভাবতেও বুকের মধ্যে টান পড়ে মন্দিরার। একবারের জন্যে মনে হয়, থাক— এভাবে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে লাভ নেই। পড়বে, পরীক্ষা দেবে—স্কুল ছেড়ে ভর্তি হবে কলেজে, প্রফেসার হবে মেজদির মতো। ননিগোপালকে সে ভুলে যাবে চিরদিনের মতো।

কিন্তু ননিগোপালকে ভুলে যাওয়া! অসম্ভব। তার আগে আত্মহত্যা করবে মন্দিরা। ননিগোপালকে ছেড়ে একদিনও সে যে বাঁচতে পারবে না, একথা সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে গেছে তার কাছে।

ঝকঝকে শ্যামবর্ণ চেহারা—চোখে-মুখে পরিচ্ছন্ন বুদ্ধির ছাপ। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু ছেলে—ভাগ্যের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে বিহারের এই শহরে এসে পড়েছে। প্রথম পরিচয়েই বাবা আকৃষ্ট হলেন।

—এখন আর চট করে কী করতে পারি তোমার জন্যে? দু-চারদিন অপেক্ষা করো, দেখি কী হয়। আপাতত আমার মেয়েকে একটু পড়িয়ে-উড়িয়ে দাও, গোটা ত্রিশেক টাকা হাত-খরচা দেব।

ননিগোপাল তৎক্ষণাৎ বাবার পায়ের ধুলো নিজের মাথায় বুলিয়ে নিলে। ধরা গলায় বললে, কী আর বলব, আপনার দয়া চিরদিন আমার মনে থাকবে।

তা মনে রাখল বইকি ননিগোপাল। তৃতীয় দিনেই পড়ানো ভুলে গিয়ে সে মন্দিরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, চতুর্থ দিনে হাত চেপে ধরল তার। পঞ্চম দিনে মন্দিরা আর হাত ছাড়িয়ে নিতে পারল না।

কাকিমার চোখ তো মানুষের নয়—সে যেন শেয়ালের দৃষ্টি। ষষ্ঠ দিনে সব ধরা পড়ল তাঁর কাছে। সপ্তম দিন থেকে বাড়িতে শুরু হল গুঞ্জন। নবম দিনে সেটা বাবার কানে গেল। তারপর দশম দিনে তিনি ননিগোপালকে নিজের সেরেস্তায় ডাকলেন।

আসন্ন ঝড় বুঝতে পেরে দোতলার ছাদে পালিয়ে গেল মন্দিরা, মুখ লুকোলো চিলেকোঠার ঘরে। কিন্তু বার-লাইব্রেরির প্রেসিডেন্ট বাবা নিজের মর্যাদা নষ্ট হতে দিলেন না। পুরো মাসের টাকাটাই ননিগোপালের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, তোমার আর আসবার দরকার নেই। নিজের মেয়েকে আমিই কোচ করব এর পর থেকে।

ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে মন্দিরা দেখছিল বড় রাস্তার মোড়ে মাথা নিচু করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ননিগোপাল। এত দূর থেকে আশ্চর্যরকমের বেঁটে আর সংক্ষিপ্ত মনে হচ্ছিল তাকে।

বাড়ি থেকে চলে গেল ননিগোপাল, কিন্তু মন থেকে গেল না। সেখানে দিনের পর দিন সে তিলে তিলে ‘মহতো মহীয়ান’ হয়ে উঠতে লাগল। আর পড়ার টেবিলে বসে প্রত্যেকটি অসহ্য সন্ধ্যায় মন্দিরার মনে হতে লাগল, পৃথিবীতে একমাত্র ননিগোপালের জন্যেই তার সৃষ্টি হয়েছে। ননিগোপালকে না পাওয়া গেলে তার জীবনের কোনও অর্থ নেই।

তারপর অনেকগুলো নাটকীয় অধ্যায়। চোরের মতো অনেক দেখাশুনো। স্কুলের একটি বন্ধুর সাহায্যে টুকরো টুকরো চিঠির আদান-প্রদান।

টিউশনটা যাওয়ার পরে ননিগোপাল অবশ্য বসে ছিল না—ছোটখাটো কী সব ব্যবসা সে শুরু করে দিয়েছিল। কিছুদিন আগে সে খবর দিয়েছে কলকাতায় একটা ভদ্ররকমের চাকরি জুটে গেছে তার। এইবার অতএব পুলের ধারে সেই বিকেল। দুজনের মুখেই বিকেলের রোদের রঙ। হাওয়ার মতো চাপা ফিসফিসানি। রাত একটার পরে আমি আসব। একটা পঁয়ত্রিশে কলকাতার ট্রেন। তুমি তৈরি থেকো।

মনের মধ্যে অনেক আগে থেকেই তৈরি ছিল মন্দিরা—সায় দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। তারপরে রোদটা হঠাৎ ফুঁ-দেওয়া মোমবাতির মতো নিবে গেলে, পুলের নীচে বদ্ধ জলটা আরও কালো হয়ে গেলে আর দূরে শিশুগাছগুলোর আড়ালে ননিগোপালের সাইকেলটা অদৃশ্য হয়ে গেলে, নিজের রক্তে ঝড়ের ডাক শুনতে শুনতে ভুলুয়ার কথা মনে পড়ে গেল মন্দিরার।

এই গলির বিনিদ্র প্রহরী ভুলুয়া। রাত ন’টার পরে একটি অচেনা মানুষেরও এখানে পা বাড়ানো অসম্ভব।

নিজের হাতে কতদিন ভুলুয়াকে ভাত খেতে দিয়েছে মন্দিরা। ওর গা-টা অত নোংরা না হলে দু-একদিন এক আধবার হাত বুলিয়ে দিতেও আপত্তি ছিল না। আজ অসহ্য জ্বালার সঙ্গে মনে হচ্ছে, খানিকটা বিষ যদি সে কোথাও পেত, তাহলে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে—

কিন্তু কোথায় বিষ পাবে সে—দেবেই বা কে! তার ওপর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা সময় আছে হাতে। দাঁতে দাঁত চেপে টেবিলের সামনে নিশ্চল হয়ে বসে রইল মন্দিরা।

এত কুকুর মরে এখানে ওখানে, ভুলুয়া কি অমর? প্রতি বছর ডোমেরা মস্ত মস্ত লাঠি দিয়ে রাস্তার কুকুর পিটিয়ে মারে—ভুলুয়াকে কেন ছেড়ে দেয় তারা?

আজ আর কোনও উপায় নেই। ননিগোপাল আসবে—ঝড়-বৃষ্টি হলেও সে আসবে। ভুলুয়া যদি অন্য কোনও দিকে থাকে তবেই রক্ষা। কিন্তু সে আশাই বা করা যাবে কী করে? এই তিন বছর ধরে প্রত্যেক রাতে সে ভুলুয়ার সতর্ক পাহারা টের পেয়েছে, শুনেছে তার গম্ভীর-গভীর গলার নির্ঘোষ। ঝড়-বৃষ্টি কেন, মহাপ্রলয় হয়ে গেলেও তাকে সে পাহারা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না।

নিরুপায় ক্ষোভে টেবিলের ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে রইল মন্দিৱা। ভুল হয়ে গেল—ভারী ভুল হয়ে গেল। অন্য যে-কোনও ব্যবস্থা ভেবে দেখতে বলা উচিত ছিল ননিগোপালকে। কিন্তু আর উপায় নেই এখন।

তারপর আস্তে আস্তে একটা অসম্ভব আশা মনের মধ্যে ছড়াতে লাগল তার। বলা যায় না—কিছুই বলা যায় না। একটা রাত ভুলুয়ারও ভুল হতে পারে। মন্দিরার অবস্থা বুঝে ভগবান দয়া করতে পারেন একটা রাতের জন্যে। রাস্তায় যে-কোনও সময় মোটর চাপা পড়ে মরে যেতে পারে ভুয়া। বলা যায় না—কিছুই বলা যায় না।

কাগজ টেনে নিয়ে মন্দিরা লিখতে লাগল: ‘মা, আমায় ক্ষমা কোরো। ননীদার অবস্থা খারাপ, তার জাত আলাদা। তাই তার সঙ্গে আমার মিলন তোমরা চাও না। কিন্তু মা—’

প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পর পর চারখানা কাগজ নষ্ট করে চিঠি শেষ করল মন্দিরা। লিখতে লিখতে কলম থমকে গেল কয়েকবার, মনে হল নাঃ, থাক। চোখের জলে অনেকবার ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টি। তবু, চিঠি শেষ করল মন্দিরা, না করে তার উপায় ছিল না।

বাইরের হল ঘরে ঢং ঢং করে ঘড়ি বাজতে মন্দির চমকে উঠল। মাত্র ন’টা এখন। আরও চার ঘণ্টা বাকি।

পরদিন সকালে যখন চায়ের টেবিলে এসে বসল মন্দিরা, তখন এক সঙ্গে সবাই তার দিকে তাকালেন।

মা সভয়ে বললেন, একি চেহারা তোর মনু? রাতে জ্বর হয়েছিল নাকি?

—হুঁ।—সংক্ষেপে জবাব দিয়ে মন্দিরা একটা চেয়ারে ঘাড় গুঁজে বসে পড়ল।

বাবা বললেন, যা গরম পড়েছিল কাল রাতে, হিট ফিভার হওয়া অসম্ভব নয়।

মন্দিরা কোনও জবাব দিল না। নিজের ওপরে অসহ্য ঘৃণায় তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে এখন। জ্বর! কাল সারা রাত যে তীব্রতম যন্ত্রণায় সে জ্বলেছে—তার সঙ্গে কোনও জ্বরের তুলনা চলে! নিজের ঘরে কড়িকাঠের আংটায় ফাঁস দিয়েও সে আত্মহত্যা করতে পারেনি—ছাদে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে চেয়েছে—সাহস হয়নি! শুধু সারা রাত সমস্ত শরীর ধিকি ধিকি চিতার আগুনে পুড়েছে তার—ভুলুয়া যতবার ডেকেছে, ততবারই যেন এক-একটা ছোরাব ঘা এসে বিধেছে তার বুকের ভেতরে।

যা আশঙ্কা করেছিল ঠিক তা-ই ঘটেছে।

রাত একটার সময় গলিতে অমানুষিক চিৎকার উঠেছিল ভুলুয়ার। সে চিৎকারের অর্থ জলের মতো সহজ। তারপর রাস্তার দিকে দ্রুত ছুটে গেল ভুলুয়া—যেন কাকে তাড়া করে গেল। তারপর আধ ঘণ্টা ধরে তার উদ্দাম আর্তনাদ—যেন বিরাট একটা বীরকীর্তি করেছে সে।

বিছানায় পাথর হয়ে পড়ে ছিল মন্দিরা। যা ঘটবার তা-ই ঘটে গেছে। একটা বাজল, দুটো বাজল, তিনটে বাজল। জানালার বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে কোনও শিস দেওয়ার শব্দ পাওয়া গেল না— ভুলুয়ার তাড়া খেয়ে আর ফিরল না ননিগোপাল।

কাল রাতেই তো কলকাতায় চলে যাওয়ার কথা ছিল ননিগোপালের। চলে গেছে? মন্দিরাকে ফেলেই? অসম্ভব—কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারে না মন্দিরা। আর বিশ্বাস করতে পারে না বলেই কাল রাত্রে সে আত্মহত্যা করতে পারেনি। আশা আছে—এখনও আশা আছে। না হয় দিনের বেলাতেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বে এক ফাঁকে। নইলে রাত্রের অন্ধকারে ভুলুয়াকে একটা রুটি বা যা-হোক কিছু ঘুষ দিয়েই সে নিজে গিয়ে হাজির হবে স্টেশনে। এত সহজেই সে ননিগোপালকে ছাড়তে পারবে না—ননিগোপালই কি পারবে?

মা বললেন, জ্বরটা ছেড়েছে তো এখন?

মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল মন্দিরা। চুমুক দিলে ঠাণ্ডা বিস্বাদ চায়ের পেয়ালায়। চোখের কোণে আবার জল নেমে আসতে চাইছে। একটা আগুনের চরকি ঘুরছে মাথার ভেতরে।

এমন সময় ঘরে ঢুকলেন কাকা। দাঁতন নিয়ে যথাসময়ে বেরিয়েছিলেন প্রাতভ্রমণে। এসেই সচিৎকারে ঘোষণা করলেন: দাদা, তোমার সেই ননিগোপালের কাণ্ড শুনেছ?

যেন গুলি লাগল মন্দিরার বুকে। রক্ত থেমে গেল শরীরের—কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল মুখ।

কাকা বললেন, ওর সব ব্যবসা জোচ্চুরি। মারোয়াড়িদের কী-সব সাপ্লাই দেবে বলে হাজার আটেক টাকা নিয়েছিল। সে-সব টাকা বেমালুম মেরে দিয়ে কাল রাতে হাওয়া হয়ে গেছে।

মন্দিরার সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি লাগল একটা। কাঁপা অবশ আঙুলে টেবিলের একটা কোনা আঁকড়ে ধরল সে। এই মুহুর্তে সবাই কি তাকিয়ে আছে তার দিকে? কাকা-বাবা-মা-কাকিমা-সবাই?

বাবার স্বর যেন অনেক দূর থেকে শোনা গেল: আমি আগেই এমনি একটা আন্দাজ করেছিলাম।

আবার কাকার উচ্ছলিত কণ্ঠ কানে এল: আরও খবর আছে। লোকটা একটা পাক্কা স্কাউন্ড্রেল। এখানে আসবার আগে পুরুলিয়ায় গিয়ে এক ভদ্রলোকের মেয়েকে বিয়ে করেছিল। বিয়ের পরেই মেয়েটাকে ফেলে তার গয়নাগুলো নিয়ে চম্পট দেয়। তারা থানায় খবর দিয়েছিলেন, আজ সকালেই পুলিশ ওকে ট্রেস করেছে। কিন্তু ননিগোপাল, ওরফে কল্যাণকুমার—

হুড়মুড় করে একটা আকস্মিক শব্দে সবাই চমকে উঠলেন। চেয়ার থেকে নীচে পড়ে গেছে মন্দিরা—সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়েছে।

জ্বর ছাড়ল আট দিন পরে। আরও চারদিন পরে ভোরের আলোয় স্কুলের দিকে চলল মন্দিরা। গরমের সময়ে এ-সব অঞ্চলে মর্নিং স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা।

শুধু জ্বরই ছাড়েনি মন্দিরার-চূড়ান্ত সর্বনাশ ছেড়ে গেছে তাকে। কোথায় তাকে নিয়ে যেত ননিগোপাল কে জানে! কোন নরকের মধ্যে—কোন্ ভয়ঙ্কর পরিণামে! বাঁচিয়েছে, ভুলুয়াই তাকে বাঁচিয়েছে।

কাল রাতেও ভুলুয়ার ডাক শুনেছে মন্দিরা। সেই সজাগ—অতন্দ্র পাহারা। ননিগোপালের মতো কাউকে সে এ-পাড়ায় ঢুকতে দেবে না। শুধু মন্দিরাকে নয়—আরও কতজনকে সে বাঁচিয়েছে, কতজনকে সে বাঁচাবে।

একদিন ভুলুয়াকে বিষ দিতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। আজ প্রকাণ্ড একখানা পাঁউরুটি মোড়কে করে নিয়েছে সে। রাস্তার মোড়েই পাওয়া যাবে ভুলুয়াকে। ধুলোর ভেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে রাত্রি জাগরণের ঘুমটা হয়তো পুষিয়ে নিচ্ছে এখন।

ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলল মন্দিরা।

ভুলুয়াকে পাওয়া গেল রাস্তার মোড়েই। কিন্তু মাত্র দু মিনিট আগেই ডোমের প্রকাণ্ড লাঠিতে মাথাটা ছাতু হয়ে গেছে তার। পথের মধ্যে তার দেহটা অন্তিম আক্ষেপে লুটোপুটি খাচ্ছে তখনও। দূরে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রসাদের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডোম, তার হাতের লাঠিটা রক্ত মাখা। মিউনিসিপ্যালিটির হুকুম হয়েছে রাস্তার কুকুর সাফ করবার—এক-একটা মারলে আট আনা।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মন্দিরা। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর অতলান্ত অন্ধকার। আঁকড়ে ধরবার মতো একটা টেবিলের আশ্রয়ও এবার তার ছিল না।

৭ নভেম্বর ১৯৫৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *