প্রশ্ন নিয়েই প্রশ্ন
হরিদাস সংসারের যত গুপ্ত কথা ফাঁস করে দিতে পারে, বটতলার বই করে হাটে ঘাটে হেঁকে হেঁকে ছড়িয়ে দিতে পারে। স্বামীর সঙ্গে তার মায়ের কী ফুসুর ফুসুর হল কান খাড়া করে শুনে বউ রাত বারোটার পর স্বামীকে ফোড়ন দিয়ে সাঁতলাতে পারে। মিলিটারি সিক্রেট ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এইবার ফাঁসের তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন প্রশ্নপত্র।
টাঁকশালে টাকা আর ছাপাখানায় প্রশ্নপত্র একই রকম নিরাপত্তায় ছাপা হয়, এমন কথা আমরা আমাদের পরীক্ষাঘেরা যন্ত্রণাময় জীবনে শুনে এসেছি। এমন কথাও শুনেছি, বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে ভাসমান কোনও জাহাজে প্রশ্নপত্র ছেপে সাবমেরিনে করে কূলে পাঠানো হত, সেখান থেকে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লায়ের কেবল টানেল ধরে ভিক্টোরিয়া হাউসের পশ্চিমের একটা ম্যানহোল ফুঁড়ে ভুস করে ফুটপাথে। সেখান থেকে ছদ্মবেশি গোয়েন্দারা স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিতেন পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক পনেরো মিনিট আগে। তাঁরা কেউ গেট দিয়ে ঢুকতেন না। রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে সোজা দোতলায় হেডমাস্টার মশায়ের ঘরে। আর ওদিকে জাহাজে, কম্পোজিটার, প্রিন্টার উভয়কেই ডেক থেকে ঠেলে সমুদ্রে বিসর্জন। হাত, পা, দেহ, স্মৃতি, শ্রুতি সব হাঙরের পেটে। নাও, কে আউট করবে করো। হাঙরের কোনও ভাষা নেই।
আর এক পণ্ডিত বলেছিলেন, অতটা নয়, প্রশ্ন ছাপা হয় ফোর্ট উইলিয়ামের সাতশো ফুট গভীরে, একটা বাংকারে। সব পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের ওইখানেই আটকে রাখা হয় জামাই আদরে।
প্রশ্ন করেছিলুম, এর মধ্যে আবার আসামি আসে কোথা থেকে! এ কি খুনের মামলা? উত্তর হল, পেপার সেটার, মডারেটার, কম্পোজিটার, প্রিন্টার সকলেই খুনি। সরাসরি ছাত্রবধ না করলেও, পরোক্ষে করেন। ট্যান্টামাউন্ট টু মার্ডার। সকলেরই উদ্দেশ্য, নিরীহ মানবসন্তানদের ফ্ল্যাট করে দাও। কেন্দ্রে কেন্দ্রে হাহাকার। ঘরে ঘরে অরন্ধন। আমাদের কালে ঘাতক ছিল অঙ্ক। অঙ্কের পরীক্ষার আগের দিন বাড়ির আবহাওয়া—কেউ যেন মৃত্যুশয্যায়। ডাক্তার বলে গেছেন, ছত্রিশ ঘণ্টার আগে বলা যাচ্ছে না, রোগী টাঁসবে না টিঁকে যাবে। সারা বাড়িতে শোকের ছায়া। আজ অঙ্ক পরীক্ষা। জীবন নাটকের শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্য যেন! শয়ে শয়ে বলির পাঁঠা চলেছে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে। কপালে দইয়ের ফোঁটা। কারও কারও আবার ফোঁটার ওপর মন্ত্রপূত চাল একটি। পেছনে পেছনে আসছেন অভিভাবক মন্ত্র পড়তে পড়তে। বিপত্তারিণী মন্ত্র—প্রথমেই অ্যালজেব্রা দিয়ে কুড়িটা নম্বর ব্লক করে ফেলবে। তারপর জ্যামিতির দিকে থিওরেমটা মেরে দেবে। একস্ট্রার ধারে কাছে যেয়ো না। এ মাথা সে মাথা নয়। তারপর ঝটাঝট এরিথমেটিক। সিমপ্লেফিকেশান শিউর শট, রুল অফ থ্রি, প্র্যাকটিস। ষাট পাকা করে অর্থাৎ প্রবীণ হয়ে ওই ডেঞ্জার জোনে ঢুকো, যেখানে পড়ে আছে ফুটো চৌবাচ্চা, সেই বাঁদর অথবা বদমাইশ শামুক, পাশাপাশি ট্রেন, এক কাঁটা ঘড়ি। পরীক্ষা কেন্দ্র যেন হাসপাতালের এমার্জেন্সি। ভেতরে অস্ত্রোপচার চলছে। বাইরে উৎকণ্ঠিত আত্মীয়স্বজন। এপাশে ওপাশে কাঁদিকাঁদি ডাব। সেকালের পরীক্ষার্থীকে যতটা পারা যায় ডাব আর দইয়ের ওপর ফেলে রাখা হত। ডিম আর কলা অস্পৃশ্য। জানা জিনিস ভুল করিয়ে দেয়। স্রেফ সাত্বিক আহার। ভগবচ্চিন্তা। আমপল্লব গোঁজা ঘট। সিন্ধেশ্বরী কালীতলায় পুরোহিতের প্রশ্ন—বলুন, গোত্র বলুন, কাশ্যপ গোত্রস্য হাবুলস্য পরীক্ষাপাশ কামনয়া দক্ষিণামিদং রজতমূল্যং—এই নিন, মায়ের অর্ঘ্য। লকলকে একটি জবা মদে চুর হয়ে থাকার মতো সিঁদুরে চুর।
—ঠাকুর মশাই হাবলাকে খাইয়ে দেব?
—খাওয়াবেন কি! বুকপকেটে রেখে দেবেন। এ কি আইসিএস না কি। এ আপনার বুকের বাইরে বসেই কাজ করবে। আইসিএস হলে সামান্য নুন আর একটু আদা দিয়ে চিবিয়ে খাবে। তারপর কালে, মানে কাল যখন আরও কিছুটা এগোল, সাহস সামান্য বাড়ল, তখন হত কী, ইটে মোড়া একটা প্রশ্নপত্র ধপাস করে রাস্তায় এসে পড়ল। প্রস্তুত সমাজসেবীর দল ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ছুটল। অভিজ্ঞ দাদারা গলির গলি তস্য গলির রকে। ছাঁট কাগজে উত্তর। ঝটাঘট কপি। স্কুলের সবচেয়ে দুর্বল অংশ বাথরুমের চাল ফুঁড়ে উত্তরের প্রবেশ। কুশলী, টোকা ট্রেনড পরীক্ষার্থীদের ঊরুতে প্রতিষ্ঠা। ধরা পড়লে খতম, না পড়লে উত্তরণ।
এরপর কাল একটু বেশি সাহসী হল, বেঞ্চিতে ভোজালি পুঁতে বই ফেলে টোকা। ইনভিজিলেটারকে পরিষ্কার বলে দেওয়া হল, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিলে আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। বদলাবদলি স্যার। তিনি ঢোঁক গিলে বাধ্যবালকের মতো বললেন, বুঝেছি বাবা। আমাদের কালে পরীক্ষার্থীরা কাঁপত। উলটে গেল জমানা। এখন কর্তৃপক্ষরা কাঁপেন। এখন তো আর ভবিষ্যত কেরানিরা পরীক্ষা দিচ্ছে না। এঁরা সব আগামী দিনের নেতা। রাজনীতি ছাড়া আর কোনও জীবিকা তো থাকবে না এই মহান দেশে। যদি থাকে, সে বিল গেটসের।
ব্যাপারটা হেড স্যারের হাত থেকে গেল পুলিশের হাতে। সাঁজোয়া বাহিনী নেমে গেল। দূরে হরি নাম সংকীর্তন। লাউড স্পিকারে কীর্তন, রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা। সখি গো! দাও দাও বলে দাও, সরল করে দাও বলে, উত্তরটা কত! কখনও এক কখনও শূন্য। এবারটা শূন্য রাধে, রাধে শূন্য। এ কায়দাও কেঁচে গেল। আইন বড় কড়া।
আমাদের কালে একটা জিনিস উঁকি ঝুঁকি মারছিল, একালের বৃহত্তর ফাঁস নয়, একটু যেন ফাঁসফাঁস ভাব, এমন হাঁসফাঁস নয়, সেটি হল ইন্টেলিজেন্ট সাজেসান। কোনও বাঘা মাস্টারমশাই সেটি তৈরি করে অন্তরঙ্গ ছাত্রদের দিতেন। হাত ঘুরতে ঘুরতে সেই এলাকার ছাত্রদের হাতে চলে যেত। কখনও বেশ মিলত, কখনও ফ্লপ। জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনার মতো। লেগে গেল তো গেল! লাগে তাক, না লাগে তুক। তবে তখনও ছেলেরা পড়ছে। পড়াটাই প্রধান, সাজেসান ভিটামিনের মতো। দশ-বারোটা মিলে গেল, কানাঘুসো আলোচনা হত। বঞ্চিত ছাত্ররা একটু আন্দোলন মতো করার চেষ্টা করত। জমত না। কারণ তখনও মাথার রাজনীতি পায়ের দিকে নামেনি। এখন যেমন সারা শরীরেই সার্কুলেসান।
প্রশ্ন হল, এখন কী করা যায়! কাগজওয়ালা তো ঘুমোতে দেবেন না। একটা কিছু পেলে হয়। নিউজ, ফলো আপ, ইন্টারভিউ, চিঠি। যেন মাতাহারি ফেঁসে গেছে। যুদ্ধতথ্য পাচার হয়ে গেছে। গ্রেট এসপিয়নেজ। আদিগঙ্গার পাশ থেকে না কাঁসাইয়ের কূল থেকে। গভীর রাতে ওই সুন্দরী, রমণী কে? বন পথে! শালবনের পাতা কুড়ুনি কী কুড়োচ্ছিল। শেষ রাতে সার্কুলার রোডের ওই কালো অ্যাম্বাসাডার। জনকল্যাণ কোচিং-এর চশমাপরা ওই বাবুটির সমৃদ্ধির উৎস!
জ্ঞানী মানুষ বললেন, প্রশ্ন ফাঁসলেই বা কী, না ফাঁসলেই বা কী! আগে কম্পার্টমেন্টালের জন্যে জোড়া সিন্নি হত। প্রথম বিভাগ জমির একফুট ওপর দিয়ে হাঁটত। বি এ লালবাজারে গিয়ে পাথরে নাম লেখাত। একালে সাত লেটার দড়ি খোঁজে।
সে যাই হোক, এমন হবে কেন? জবাব চাই, জবাব দাও।
এক কাজ করা যাক, স্যাটিলাইটে বসে পেপার সেট করা হোক। সেই প্রশ্ন চ্যানেল বেয়ে টিভি স্ক্রিনে। এইবার দ্যাখো আর লেখো। আর পেপারসেটারদের কী হবে! আমেরিকা যবে নামাবে তবে নামাবে। চিরকাল থেকে গেলেই বা কী! কার্ল য়ুং বলেছেন, পৃথিবীতে ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই গোপনীয় হতে পারে না। একজন জানলেও জানা হয়ে গেল।
সেই রাজার শিং। নাপিত চুল কাটতে এল। চুলের তলায় জোড়া শিং। শোনো হাজাম, যা দেখলে দেখলে, বললেই শূলে চড়বে। বভ্যম হাজামের পেট ফুলছে। এমন একটা গোপন খবর, কারোকে বলা যাবে না! গভীর জঙ্গলে বৃদ্ধ নিমগাছ। হাজাম সেই গাছকে বলছে শুনা! রাজাজিকা দো শিং। ব্যাস, পেট হালকা। এইবার সেই নিমগাছ কাটা হল। তৈরি হল সেতার, খঞ্জনির কাঠি আর ঢোল। এক বাদ্যদল তিনটে যন্ত্রই কিনল। রাজবাড়িতে গাওনা। রাজাজি সিংহাসনে! সেতার বাজছে, সবাই শুনেছে, রাজাসিকা দো শিং! খঞ্জনি বাজছে, কিন্নেকহা, কিন্নেকহা! ঢোলে হাত পড়া মাত্রই বোল, বভ্যম হাজাম নে কহা, আরে রে বভ্যম হাজাম নে কহা। তারপর শূল। প্রশ্নপত্রে যেন সেই রাজার জোড়া শিং!