1 of 2

প্রথমাদের জন্য

প্রথমাদের জন্য

হাজারিবাগ রোড স্টেশনে শীতের রাতের বম্বে মেল দাঁড়িয়েছিল।

সব ক-টা জানালার খড়খড়ি ওঠানো। দু-একজন অধ্যবসায়ী চা-ওয়ালা ভাঁড় ভরতি ট্রে নিয়ে ‘চায়ে—চায়ে গরম। গরম চা—য়ে!’ বলে প্ল্যাটফর্মের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে যাচ্ছিল। ওভারব্রিজের নীচে চায়ের স্টলের পাশে আগুনের ধারে কুন্ডলী পাকিয়ে দুটো কুকুর শুয়েছিল। একজন টহলদারি পুলিশ, খাকি ওভারকোটের কভারটা কান অবধি তুলে দিয়ে রাইফেলটা ওভারব্রিজে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দু-হাতের পাতা ঘষে নিল। তার পর একটা বিড়ি ধরাল।

অরু ট্রেন থেকে নেমে শালটা ভালো করে জহরকোটের ওপরে মুড়ে নিল। ডাকল, কুলি। আওয়াজ বেরোবার আগে মুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া বেরোল। ঠাণ্ডাটা এবার বড়ো জোর পড়েছে এ অঞ্চলে। অবশ্য অরু বোধ হয় দশ বছর বাদে হাজারিবাগে এল। সেই আগে যখন শিকারে আসত ছাত্রাবস্থায় ও চাকরিতে ঢোকার পর প্রথম প্রথম। তার পর আর আসা হয়নি এদিকে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসে বড়ো ভুল করেছে।

হাজারিবাগ শহরের বাসটা স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়েছিল। কুলি না থাকায় স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে অরু ওভারব্রিজ পেরিয়ে এসে বাসে উঠল। তার পর নেমে গিয়ে চায়ের স্টলে দাঁড়িয়ে পর পর দু-কাপ চা খেল।

ইতিমধ্যে বম্বে মেলের পেছনের লাল আলো স্টেশন ছেড়ে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল।

চায়ের স্টলে ওরা গল্প করছিল যে সারিয়াতে গতকাল দুজন লোক মারা গেছে ঠাণ্ডায়। গয়াতে নাকি পাঁচজন লোক মারা গেছে এ সপ্তাহে।

অনেকক্ষণ অরু আগুনে হাত সেঁকল।

দেখতে দেখতে গোমোর দিক থেকে কী একটা ডাউনের গাড়ি এসে গেল। ঘুমন্ত প্ল্যাটফর্ম আবার জেগে উঠল। সে গাড়ির প্যাসেঞ্জাররা ওভারব্রিজ বেয়ে নামতে না নামতে বাসের ড্রাইভার ও কনডাক্টর গিয়ে বাসে উঠল। একটু পরেই প্যাসেঞ্জার ও মালে বোঝাই করা বাস শীতের শেষরাতের নির্জন নিষ্ঠুর রাস্তায় হেডলাইট জ্বেলে ছুটে চলল।

বাইরের শীতার্ত অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। কিছু শোনাও যায় না। বাসের ভেতরটাও অন্ধকার। যাত্রীরা বেশিরভাগ মোটা কম্বল মুড়ে সিটের ওপর পা তুলে ঘুমে বিভোর। পেছনের সিট থেকে একটা দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা মাঝে মাঝে ককিয়ে কেঁদে উঠতে লাগল।

অরু ড্রাইভারের পেছনে বসেছিল। উইণ্ডস্ক্রিন দিয়ে আলোকিত রাস্তার যতটুকু দেখা যায় সেদিকে চেয়ে বসে অরু নানান কথা ভাবতে লাগল। মন হয়তো অনেক সময় ভাবতে চায়, কিন্তু পরিবেশ তাকে ভাবতে দেয় না। কখনো হয়তো পরিবেশ মনকে ভাবুক করে তোলে, কিন্তু মন তখন এত ক্লান্ত ও বিক্ষিপ্ত থাকে যে ভাবা যায় না। এখন ভাবার সময়। শুধু ভাবার সময়।

রুদ্র অরুকে হাওড়ায় তুলে দিতে এসেছিল। একথা-সেকথার পর, যখন হলুদ বাতি জ্বলে গেছে তখন রুদ্র বলল, কেন যাচ্ছিস? গিয়ে কি তুই কিছু ফিরে পাবি? যা হারিয়ে যায়, তার কিছুমাত্র?

অরু মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, জানি না রে, সত্যি জানি না কেন যাচ্ছি।

রুদ্র বলেছিল, ও যেতে বলেছিল বলেই কি যাচ্ছিস?

অরু এবার হেসে বলেছিল, বিশ্বাস কর, তোকে সত্যিই বললাম, আমি জানি না কেন যাচ্ছি। আসলে অরু এখনও জানে না ও কেন যাচ্ছে প্রথমার কাছে। ওর এতদিন পরে হঠাৎ এই আসার কোনো মানে ও নিজেই খুঁজে পায়নি নিজের কাছে। প্রথমা তো ক-বারই বলেছে, একবার আসবেন, সত্যি একবার আসবেন। খুব খুশি হব, দেখবেন কত আদর করব আপনাকে।

আর কেউ না জানুক, অরু জানে যে জীবনে যা হারিয়ে যায় সে আর ফিরে পাওয়া যায় না। হয়তো কেউই চায় না তবু বেদনা জেগে থাকে যাদের হৃদয় থাকে তাদের হৃদয়ে। সমস্ত কিছু পেয়েও একজনকে না-পাওয়ার বেদনা, সমস্ত প্রাপ্তিকে মিথ্যা করে অনুক্ষণ তার সমস্ত হৃদয় আচ্ছন্ন করে থাকে। একজন পুরুষের সব যশ, সব অর্থ, সব সাম্রাজ্য ম্লান করে তার সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরের ওপরের আকাশে একজনের মুখ, একজনের হাসি, একজনের চোখের উজ্জ্বলতা ঝিলিক মেরে যায়। তখন কেন জানি না, মনে হয় সব মিথ্যা, সব ফাঁকি, সব পাওয়া তার বৃথা হয়ে গেল।

এ ভাবনা শুধু পুরুষের জন্যে। মেয়েরা এ ভাবনার কোনো দাম দেয় না। ওরা এমন গভীরভাবে ভাবতে শেখেনি। জীবনের একটা সময় অবধি ওরা দু-হাত দিয়ে শরীরটাকে আড়াল করে রাখে, শরীরে হাত ছোঁওয়াতে গেলে বলে, না, না, না। তার পর সমাজ এবং সংস্কারের বশে সে যাকে পতিরূপে বরণ করে, তাকে তার অদেয় যা ছিল তা উজাড় করে দেয়। একদিন যা দুর্মূল্য ছিল তা সেদিন সস্তা হয়ে যায়। একদিন যা মহার্ঘ ছিল, দৈনন্দিনতার কলুষ পরশে তা অতিবাজে ও মূল্যহীন হয়ে যায়। বিয়ের পর মেয়েরা তাদের ঘর, তাদের চুল বাঁধার আয়না, তাদের স্বামী, তাদের শ্বশুর-শাশুড়ি দেওর-ননদ, তার স্বামীর কুকুর, এসবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। শরীর ও শারীরিক সম্পর্কের দেওয়াল পেরিয়ে দূরে—অনেক দূরে পালিয়ে এসে তারা কখনো নিজেদের, নিজেদের পুরোনো পরিবেশ, নিজেদের অবিবাহিত দিনের স্বাধীন বোধগুলিকে যাচাই করে দেখতে পায় না, বা দেখে না। তারা যেমন করে তাদের পুরোনো জীবন, তাদের পুরোনো ভালোবাসা, তাদের ভালোলাগা, খারাপলাগাকে হারিয়ে ফেলে—তেমন করে কোনো পুরুষ কখনো তা হারায় না।

সত্যিকারের কোনো পুরুষ কোনো মেয়েকে সত্যিকারের ভালোবাসলে তাকে কখনো ভোলে না, তাকে কখনো ভুলতে পারে না। আর পারে না বলেই, এত ফিরে ফিরে আসা। কিছু পাওয়ার নেই, কিছু চাইবার নেই, কিছু বলার নেই জেনেও স্ত্রীর কাছ থেকে পালিয়ে ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে পালিয়ে নিজের কাছ থেকেও পালিয়ে এসে একজনকে শুধু একবার দেখার জন্যে, তার চোখে চোখ রেখে শুধু কিছুক্ষণ নি:সঙ্গে বসে থাকার জন্যে এতদূর এই শীতের নিষ্ঠুর রাতে আসা।

রুদ্র বলেছিল কাজটা ভালো করলি না। প্রথমার স্বামী হাজারিবাগ শহরের খুব বড়ো পুলিশ অফিসার। পুলিশের বড়োকর্তার স্ত্রীর প্রেমিক হলে, সে প্রেমিকের যথেষ্ট দুঃসাহসী হওয়া দরকার।

অরু কথাটা শুনে হেসেছিল। বলেছিল, আমি তো তার ঘরে চুরি করতে যাচ্ছি না। সে যদি মানুষ হয়, তবে অন্য একজন মানুষকে বুঝবে। তা ছাড়া তার কোনো সুখে তো বিঘ্ন ঘটাতে যাচ্ছি না আমি। বিঘ্ন ঘটাতে পারত একমাত্র প্রথমা। কিন্তু প্রথমারা কখনো তাদের স্বামীদের সুখে বিঘ্ন ঘটায় না। তারা চার দেওয়ালের মধ্যে নিদারুণ সুখে আবদ্ধ দ্বিপদ প্রাণী। সুখের ঘরের বাইরে, স্বামীর সোহাগের বাইরে তাদের আর কিছু চাইবার নেই। স্বামীর বাড়ি গাড়ি বেয়ারা আর্দালির সম্মানই তাদের একমাত্র সম্মান। এর বাইরের সমস্ত সম্মান, সমস্ত চাওয়া তাদের কাছে মূল্যহীন। তাদের সুখের স্বার্থপরতার গন্ডি ছেড়ে বাইরে এসে তারা কাউকে কখনো কিছু দেয়নি প্রতিদানে। তা কেবল ছেলেরাই দিতে পারে। যত ত্যাগ যত দুঃখ—সব ছেলেরাই সহ্য করে।

এই বাবদে ওরা, প্রথমারা, বরাবর অরুদের কাছে হেরে গেছে। বোধ হয়, বরাবর হেরে যাবে।

বাসটা দেখতে দেখতে জি টি রোডে এসে পড়ল, সারিয়ায়। তখনও রাত্তির। দোকান-টোকান তখনও বন্ধ। হেডলাইট জ্বেলে দোতলা বাড়ির সমান উঁচু ট্রাকগুলো তখনও সারি বেঁধে চলেছে তাদের দূরের যাত্রায়।

কনডাক্টর দু-বার চেঁচাল—সারিয়া, সারিয়া!

একজন প্যাসেঞ্জার কম্বল থেকে মুখ বের করে কান খাড়া করে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সারিয়ায় কেউ নামার নেই।

বাসটা আর একটু পরই হাজারিবাগের লালমাটি সবুজ শালবনের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে যাবে হাজারিবাগ শহরের দিকে।

পুবের আকাশে একটু একটু করে লালের ছোপ ধরছে। কুয়াশা কেটে গেছে। ধীরে ধীরে শিশিরেভেজা জঙ্গল আর লালমাটি পথের কালো পিচের দু-পাশে পরিষ্কার হচ্ছে।

মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে বাসটা এসে টাটিঝারিয়ায় দাঁড়াল। পন্ডিতজির দোকানে। কালোজাম, নিমকি এবং চা এখানে সকলে খায়। তার পর পাশের দোকান থেকে পান।

ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। সূর্য ওঠা যে কী দারুণ ব্যাপার তা আমরা রোজ বুঝতে পারি না। অন্ধকার রাতের যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তার গ্লানি, অবিশ্বাসের দম-বন্ধ কষ্ট, সমস্ত মিথ্যা করে দিয়ে সূর্যটা এমনভাবে চরাচর উদ্ভাসিত করে, সমস্ত বিশ্ব হাজার পাখির চিকন ডাকে ভরে দিয়ে, মানুষ-মানুষীর মিষ্টি গলার স্বর রিনরিন করে বাজিয়ে কী করে যে ওঠে, অরু ভেবে পায় না।

সূর্যোদয়ের আগেই ও রোজ কেন ঘুম থেকে ওঠে না?

এখন আর ওর মনে কোনো ভয় নেই; কোনো দ্বিধা নেই। অরু জানে যে ও এক দারুণ তীর্থযাত্রায় চলেছে; চলেছে এক আনন্দ সংগমে। এই নিরানন্দময় জীবনে, রোজকার একঘেয়েমি জীবনে, একজনের মুখ, একজনের চোখ, একজনের নরম হাত যে কী দারুণ এক সূর্যালোকিত প্রাপ্তির পরশ আনে, তা যে জানে, সে-ই জানে।

অরুর ভীষণ খুশি খুশি লাগল। কলকাতা থেকে আসার সময়ে প্রথমা যা যা খাবার খেতে ভালোবাসত ও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ফ্লুরির চিজ স্ট্রট, গিরীশ ঘোষের সন্দেশ এবং এম্পায়ার স্টোর্স থেকে নেওয়া সসেজ। ও জানে, এতদিন বাদে ওকে দেখে প্রথমা দারুণ খুশি হবে, বলবে, আপনি ভারি খারাপ, একটা খবর দিয়ে এলেন না। স্টেশনে গাড়ি পাঠাতাম। এই ঠাণ্ডায় শীতের রাতে এতখানি পথ বাসে এলেন?

অরু জবাবে কী বলবে মনে মনে তাও ভেবে নিল। বলবে, যখন তোমার কাছে থাকি না, তখন তোমার জন্যে যে কত কষ্ট তার খোঁজ রাখো? তোমার জন্যে প্রতিমুহূর্তে কত কষ্ট পাই, তার তুমি কী জানো! যখন কাছে এলাম, তখনই বুঝি সামান্য সামান্য কষ্টগুলোচোখে পড়ে তোমার?

এর জবাবে ব্যক্তিত্ব-সম্পন্না স্বল্পভাষী প্রথমা হয়তো কিছু বলবে না। হয়তো চুপ করে থাকবে মুখ নীচু করে। হয়তো বলবে, আমার বিরুদ্ধে যা বক্তব্য, যা অভিযোগ, সব শুনব। আগে চান করতে চলুন। রাত জেগে এতদূর পথ এসেছেন।

কথার পর কথা, তার পরে আরও যন্ত্রণার কথা। অরু শালগাছতলায় দাঁড়িয়ে এখন উষ্ণ রোদে পিঠ দিয়ে মনে মনে বহুবছর পরে প্রথমার সঙ্গে অনেক কথা বলছিল। এমন সময়ে পন্ডিতজির দোকানের ছেলেটা এসে বলল, চায়ে সাহাব। হাত বাড়িয়ে চা ও শালপাতায় মোড়া নিমকি নিল অরু। তার পর চা খেতে খেতে আবার প্রথমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল মনে মনে। এমন সময়ে ওর মাথা থেকে একটা লম্বা রুপোলি চুল খসে শালপাতার ঠোঙায় পড়ল। চমকে উঠল অরু। আজ ভোরের সূর্য নতুন হলেও ওর জীবনের সূর্য দ্বিপ্রহরে—হঠাৎ মনে পড়ে গেল অরুর। আজ আট-ন-বছর হয়ে গেছে প্রথমার বিয়ে হয়েছে। ওর বিয়েও প্রায় বছর পাঁচেক হল। কী এক পাগলামিতে ভর করে মাথাময় রুপোলি চুলের রেশ নিয়ে আজ কেন যে এমন করে ও প্রথমার কাছে আসতে গেল, ও ভেবে পেল না। কিছুতেই ভেবে পেল না। একটু আগে সূর্য ওঠায় ওর খুব ভালো লাগছিল। এখন এক-আকাশ আলোর নীচে দাঁড়িয়ে ওর ভীষণ লজ্জা করতে লাগল।

কিন্তু এখন আপাতত ভাবার আর সময় নেই। বাসটা ছাড়বে। ওর স্যুটকেস বাসের মাথায় আছে। ও তাড়াতাড়ি আবার নিজের সিটে বসে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট ধরিয়ে আবার ভাবনার লাটাই ধরে প্রচন্ড হাওয়ার মুখে দু-হাতে সুতো ছাড়তে লাগল।

একসময়ে বাসটা সত্যি সত্যিই হাজারিবাগ শহরে ঢুকল। অরু বাস-স্ট্যাণ্ডে না গিয়ে কোররার মোড়ে নেমে পড়ল। প্রথমার চিঠিতে জেনেছিল যে, সাহেবের বাংলো সার্কিট হাউসের কাছাকাছি। কোররার মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে ক্যানহারী পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জাস্টিস মল্লিকের বাড়ির পাশ বেয়ে যে নির্জন পথটা সার্কিট হাউসের দিকে চলে গেছে, সেই পথে রোদ্দুর পোয়াতে পোয়াতে সাইকেলরিকশায় চেপে চলে যাবে বলে মনস্থ করল অরু।

দু-ধারে খোয়াই। লাল মাটি। ডান দিকে ক্যানহারি পাহাড়ের চড়াই ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে গেছে। শালের চারাগাছ। দূরে দূরে বাড়ির সীমানার মধ্যে ইউক্যালিপটাস গাছের চিকন শরীর আর উজ্জ্বল পাতা সকালের রোদে ঝিলমিল করছে। একঝাঁক টিয়াপাখি মাথার ওপর দিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে উড়ে গেল।

বেশ লাগছে অরুর। প্রথমার সঙ্গে এ রাস্তায় আসন্ন সন্ধ্যায় পাশাপাশি অনেক হেঁটেছিল অরু। তখন জীবনে এত স্বেচ্ছাকৃত ও মূল্যহীন দায় ও দায়িত্ব ছিল না। পাখির ডাক, রোদের গন্ধ, আকাশের রং এবং যে পাশে ছিল, তার চোখের গভীরে তাকাবার মতো অনেক অলস অবসর ছিল। তখন তাদের কারোরই বিয়ে হয়নি। পরস্ত্রীকে ভালোবাসার মতো কোনো হাস্যকর পাপবোধ তার মনকে সেদিন আচ্ছন্ন করেনি। তারা সেদিন মুক্ত ছিল। সমাজের সাঁড়াশি এমনভাবে দৈব প্রক্রিয়ায় তাদের ওপর চেপে বসেনি। তখনও ভারি ভালো ছিল দিনগুলো ; সেসব দিন।

দূর থেকে সাহেবের বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। বাংলোর গেটে একজন রাইফেলধারী পুলিশ। ভেতরে একটি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। সামনের কম্পাউণ্ডে একটি তাঁবু খাটানো—শামিয়ানার মতো। সাহেব শীতের দুপুরে বসে টুকিটাকি কাজ করেন বোধ হয়।

গেটের পুলিশ, বাঙালিবাবু দেখে জিজ্ঞাসা না করেই ছেড়ে দিল। তা ছাড়া অরুর চেহারাতে এমন অভদ্রতা বা অকৌলীন্যের কোনো ছাপ ছিল না যে গেটের পুলিশ আটকে দেবে তাকে। সাইকেলরিকশাটা পোর্টিকোতে ঢুকতেই অরুর ভীষণ অস্বস্তি লাগতে লাগল। প্রথমার স্বামীর সঙ্গে প্রথম দেখা হলে কী বলে ও পরিচয় দেবে? প্রথমার কাছে ওর কথা কি শুনে থাকবেন এবং বছরে একটি দুটি চিঠি উনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। ভদ্রলোকের কি গোঁফ আছে? ভদ্রলোক কি কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্তের মতো পাইপ খান? ভদ্রলোককে কখনো দেখেনি অরু, ওঁর ডেজিগনেশানও ঠিক জানে না, তবে শুনেছে যে, পুলিশ অথচ এমন ভদ্রলোক নাকি আর হয় না। অরু মনে মনে ঠিক করে ফেলল, সে বেশ সপ্রতিভভাবেই ভদ্রলোককে বলবে, কেমন আছেন? প্রথমা কোথায়?

ভদ্রলোক বলবেন, আপনাকে তো ঠিক…

অরু বলবে, আমি অরু, অরিন্দম বোস, হিন্দুস্থান পার্কের।

পরক্ষণেই ভদ্রলোক—আরে, আসুন আসুন, এমনভাবে না বলে-কয়ে, কোনো মানে হয়! ইত্যাদি বলে অরুকে ভেতরে নিয়ে যাবেন।

মফসসলের পুলিশ সাহেবের বাড়ি, সুতরাং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ফার্নিচার এবং কার্পেটের সমারোহ নিশ্চয়ই থাকবে। অরু গিয়ে মোটা নরম সোফায় বসবে।

প্রথমাকে খবর দেওয়া হবে।

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করবেন, কোন গাড়িতে এল অরু, কোনো কাজে এসেছে কি না, তার পর চা আনতে বলবেন খুব তাড়াতাড়ি। তার পর প্রথমাকে আসবার জন্যে তাড়া দেবেন। প্রথমা আসবে। এসে বলবে, ওমা, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। অরুদা আপনি? আমার কী সৌভাগ্য!

অরু লজ্জার হাসি হাসবে, বলবে, এই তোমাদের দেখতে এলাম, গয়াতে এসেছিলাম একটা কাজে (মিথ্যা কথা বলবে), আজই চলে যাব।

প্রথমা বলবে, ইশ ছাড়ছি আর কী? এসেছেন যখন সাত দিন থেকে যেতে হবে।

অরু বুঝতে পারল না কেন, কিন্তু ওর মন বলল, হয়তো সত্যিই সাতদিন থেকে যেতে হবে। অরুকে খুব যত্ন করবে প্রথমা, ওর স্ত্রীর ছেলে-মেয়ের খবর জিজ্ঞেস করবে, ও যা যা খেতে ভালোবাসে সব রেঁধে খাওয়াবে, হাজারিবাগের সিনেমায় ‘যব যব পেয়ার মিলে’ দেখতে নিয়ে যাবে, ওর ছেলের পেটের অসুখের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করবে, ওর স্বামীর দারুণ খাটুনির কথা উদাহরণ দিয়ে বোঝাবে—কিন্তু কখনো একবারও চুপ করে হয়তো অরুর সামনে একমিনিটের জন্যেও বসবে না। ভুল করেও অরুর হাতে আগের মতো তার নরম উষ্ণ হাত রাখবে না। পাছে তার স্বামী-নিবেদিত পবিত্র শরীর অপবিত্র হয়ে যায়। যদি বা রাখেও, হাতে অচল আধুলি রাখলে যেমন মনে হয়, অরুর হয়তো আজ তেমন মনে হবে।

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে যে এত কথা ভাবা যায় এর আগে অরু কখনো জানত না। রিকশায় ও যে বসেছিল তো বসেই রইল। প্রথমার স্বামী ওকে রিসিভ করতে এলেন না, প্রথমা দৌড়ে এল না, শুধু ওর পেছনে কাঁকরের ওপর একটা বুটের শব্দ শুনে ওর স্বপ্ন ভাঙল।

গেটের প্রহরীটিই এসে বলল, সাব, মেমসাব তো পাঁচবাজি চলা গ্যয়ে।

কাঁহা? অরু ঘাড় ঘুরিয়ে শুধোল।

ঝুমরিতিলাইয়া।

কব লোটেঙ্গে?

আজহি লোটেঙ্গে সামকো।

বাংলোর ওপাশ থেকে একটি বর্ষীয়সী আয়া প্যারাম্বুলেটর ঠেলতে ঠেলতে এদিকে এসেই অরুকে দেখতে পেয়ে বলল ওমা অরুদাদাবাবু না?

অরু সাইকেলরিকশা থেকে নামল। মীনাদি অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। প্রথমার ছোটোবেলা থেকে ও প্রথমার সঙ্গে। অরু বলল, কেমন আছ মীনাদি?

মীনাদি ফোকলা দাঁতে হাসল। বলল, তোমারই যদি চুলে পাক ধরে তো কেমন থাকতে পারি বুঝতেই পারছ। তা তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন দাদাবাবু, চলো, ভেতরে চলো।

অরু ইতস্তত করল একটু—বলল, ওরা কেউ নেই?

আরে ওরা কেউ নেই, আমি তো আছি। চলো চলো, ভেতরে চলো। ওরা এসে যাবে সন্ধের মধ্যে।

অরু বলল, তুমি এগোও, আমি স্যুটকেসটা নিয়ে আসছি।

রিকশাওয়ালাকে পয়সা দেওয়ার সময়ে অরু তাকে জিজ্ঞেস করল, কলকাতায় ফেরার গাড়ি কখন কখন আছে? সে বলল শিয়ালদা-পাঠানকোট ধরার বাস একটু পরে ছেড়ে যাবে। ট্যাক্সি করে গেলে ঘণ্টা দুয়েক পরে বেরোলে হবে। আবার সেই রাতের গাড়ি আছে।

অরু কী ভাবল একটু। তার পর বলল, আমার শিয়ালদা-পাঠানকোটই ধরতে হবে, তুমি ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘুরে এসো।

মীনাদি অরুকে গেস্টরুমের মতো একটা ঘরে নিয়ে গেল। বলল, অতিথি এলে এ-ঘরেই তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত হয়। তুমি আরাম করো, আমি চা-টার কথা বলছি।

অরু বলল, মীনাদি, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকব না।

ওমা, সে কী কথা?

না, আমি গয়াতে এসেছিলাম একটা কাজে, ভাবলাম প্রথমাকে অনেকদিন দেখিনি, দেখে যাই।

তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এসেই চলে যাবে? প্রথমা এসে যে আমার ওপর রাগ করবে, বলবে তোমাকে জোর করলাম না কেন?

অরু হাসল। বলল, সেজন্য ভেবো না, প্রমা নিজে জোর করলেও বোধ হয় থাকা সম্ভব হত না। আমি চিঠি লিখে রেখে যাব যে, তুমি আদরের ত্রুটি করোনি।

হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে অরু বলল, বলো মীনাদি, তোমার দিদিমণির সব গল্প বলো। এইটি কি ছোটোছেলে? মুখটা বুঝি বাবার মতো হয়েছে?

মীনাদি বলল, হ্যাঁ, দু-ছেলের মুখই বাবার মতো।

অরু মনে মনে প্রথমার দুটি ছেলের প্রতিই বিরক্ত হল। তার চেয়ে ওর যদি একটি মেয়ে থাকত—যার মুখ প্রথমার মতো, যার চাউনি প্রথমার মতো, তবে তাকে একটু কোলে নিত, আদর করত। এ জীবনে প্রথমাকে হারাতে হল বলে অন্তত প্রথমার সেই নরম ছোটো বুদবুদতোলা আধো-আধো কথা-বলা টুকুরোটুকুকে নিয়ে ক্ষণিকের জন্যে খুশি হত।

অরুকে চুপ করে থাকতে দেখে মীনাদি বলল, চলো, দাদাবাবু, তোমাকে বাড়িটা দেখিয়ে আনি।

অরু বলল, চলো।

এই হচ্ছে জামাইবাবুর অফিস-ঘর, বসবার ঘরটাও এবারে চলো ভালো করে দেখাই। বসবার ঘরে প্রথমার এবং প্রথমার স্বামীর বড়ো ছবি। একটি আলাদা ছবি ওর স্বামীর—একপাশে গলায় পুলিশ মেডেল ঝুলিয়ে—জিপগাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে আছে। ইদানীংকার কোনো ছবি নেই প্রথমার। মীনাদি শোবার ঘর ঘুরিয়ে দেখাল। শোবার ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। মীনাদি বলল, এ বাড়ির বাথরুমগুলো দারুণ—দেখবে একটা? বলেই সম্পূর্ণ নির্দোষ আনন্দে মীনাদি বাথরুমের দরজা খুলে অরুকে সগর্বে তাতে ঢোকাল। অরু দেখল, যাবার আগে ওরা চান করে গেছে। প্রথমার ছাড়া শাড়ি, শায়া, ভেতরের জামা—সব একপাশে ডার্টি-লিনেন বক্সের ওপরে জমা করা। গিজারটা থেকে তখনও টুপ টুপ করে গরম জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। প্রথমার সদ্য ছেড়ে-যাওয়া, তার শরীরের উষ্ণতায় এখনও উষ্ণ সেই স্তূপীকৃত শাড়ি-জামার দিকে তাকিয়ে অরু তার পুরোনো প্রথমার একমাত্র উষ্ণ স্মৃতি দেখতে পেল।

মীনাদি বলল, জামাইবাবু খুব হই-হই করতে ভালোবাসে। সপ্তাহে দুটি করে হিন্দি ছবি দেখে, খুব পান খেতে ভালোবাসে; খাওয়াতেও। দিদিমণি তো একেবারে বদলে গেছে—কী হই-হই যে করে। এই অবধি বলে মীনাদি বলল, চলো দাদাবাবু, তোমাকে রান্নাঘরটা দেখিয়ে আনি।

রান্নাঘরে ঢুকেই অরুর চোখ রান্নাঘরের জানালায় একটা পরিচিত জিনিসে থমকে গেল। চমকে উঠল। মীনাদিকে শুধোল, ওটা ওখানে কী মীনাদি?

মীনাদি এগিয়ে গিয়ে ধুলো-মাখা আধছেঁড়া বইটা তুলে নিয়ে বলল, কেন বলো তো? এ তো একটা বই। সেদিন বিকেলে কারেন্ট ফেল করেছিল, জামাইবাবুর চায়ের সময় উতরে গেল—দিদিমণি-জামাইবাবুর খুব শখ, রোজ সকাল-বিকেল চা-টা ওই মাঠের তাঁবুতে চেয়ার-টেবলে খান। দিদিমণির খাটের নীচে এই বইটা অনেকদিন থেকে ধুলোয় পড়েছিল। তাই আমি এইটে জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি চায়ের জল করতে বলে দিলাম বাবুর্চিকে। কাঠের উনুন তো চট করে ধরবে না।

অরু আধছেঁড়া ধুলো-পড়া বইটা হাতে তুলে নিল। অরুর চশমাটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল।

মীনাদি বলল, কী হল দাদাবাবু? এটা কি কোনো দামি বই? তাড়াতাড়ি কি ভুল করে এটা জ্বালাতে বললাম? দামি হলে দিদিমণি অমন করে ধুলোয় ফেলে রাখল কেন?

অরু হাসল, হেসে বইটা আবার জানালার তাকে রেখে দিল। বলল, না না, দামি বই নয়। এর কোনোই দাম নেই। তা ছাড়া দিদিমণিও ধুলোতেই ফেলে রেখেছিলেন।

মীনাদির পেছন পেছন যে-ঘরে ওর স্যুটকেস ছিল সে-ঘরে ফিরে আসতে আসতে অরু পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমাটা এবার মুছল।

যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তখন লেখক বলে অরুর বেশ একটু নাম হয়েছিল। এইটেই ওর প্রথম বই। এ বই প্রথমাকে ও উৎসর্গ করেছিল। এর জন্যে তার স্ত্রী তাকে আজও খোঁটা দেয়, বলে আমরা তো প্রথমা হতে পারলাম না তোমার কাছে। বরাবর যেমন নামে দ্বিতীয়া তেমন দ্বিতীয়াই রয়ে গেলাম। বইটির পাঁচ কপি প্রথমার বিয়ের সময়ে অরু প্রথমাকে দিয়েছিল।

প্রথমাই বলেছিল, একটা বই যদি হারিয়ে ফেলি—আপনি আমাকে পাঁচটা বই দেবেন। বুড়োবয়েস অবধি যত্ন করে রাখব। পুরোনো দিনের স্মৃতি। দিন হয়তো পুরোনো হবে, কিন্তু দেখবেন, স্মৃতি কখনো পুরোনো হবে না।

অরু হেসেছিল। বলেছিল, দেখব।

ও এখানে কেন এল? অরুর খুব হাসি পেল। মনে পড়ে গেল আজ ওর মেজোশালির বিয়ের সম্বন্ধের জন্যে কয়েকজন ভদ্রমহিলা-ভদ্রলোক ওর শ্বশুর-বাড়িতে আসবেন। ওর স্ত্রী দ্বিতীয়া বার বার কাল বলেছিল, আজ তোমার কি না-গেলেই নয়? অরু গম্ভীর মুখে বলেছিল, না:, যেতেই হবে, অফিসের কাজ—বোঝো না কেন? দিন সাতেকের আগে ফিরতে পারব না। গয়ায় যখন যাচ্ছিই, তোমার মামার পিন্ডিটাও দিয়ে আসব।

দ্বিতীয়া রাগ করে বলেছিল, আমার পিন্ডি দিতে যেয়ো। আমার মামা তোমার পিন্ডিদানের অপেক্ষায় বেলগাছে বসে নেই। তা ছাড়া তুমি পিন্ডি দেবার কে? পিসতুতো জামাই কখনো কারো পিন্ডি দেয়, এমন তো শুনিনি।

অরু নীরবে এই বেফাঁস মিথ্যা কথার তিরস্কার সহ্য করেছিল।

এখন পুরো ব্যাপারটা ভেবেই কেমন একটা শূন্যতা লাগছে। দুঃখও লাগছে। প্রথমাকে একবার দেখতে আসার এই হঠাৎ অদম্য কৌতূহলটাকে নিবৃত্ত করতে পারলে প্রথমা চিরদিনের মতো তার জীবন থেকে এমন করে হারিয়ে যেত না। এমন ঘৃণার মধ্যে হারাত না।

ঘরে পৌঁছে, অরু স্যুটকেস খুলে প্রথমার জন্যে যা যা এনেছিল, সব মীনাদির হাতে তুলে দিল। তার পর কলম বের করে, কাগজ চেয়ে নিয়ে লিখল:

হাজারিবাগ,

১২। ১২

প্রথমা,

তোমাকে এবং তোমাদের দেখতে এসেছিলাম। আসলে তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল। তোমার অবর্তমানে মীনাদির হাত ধরে তোমাকে দেখে গেলাম। তোমার সুখের সংসার দেখে গেলাম।

তুমি আমার প্রীতি জেনো। তোমার অদেখা স্বামীকে নমস্কার জানিয়ো।

ইতি—অরিন্দম।

রিকশাওয়ালা সময়মতো এসেছিল।

এখন রিকশাটা ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ডের দিকে চলেছে। কাছারির মধ্যের রাস্তাটা দারুণ। দু-ধারে বড়ো বড়ো গাছ। মধ্যে কাঁচা কিন্তু সমান লালমাটির রাস্তা। শীতের সকালের রোদ গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে চলমান অরুর গায়ে এসে পড়ছে।

শেয়ারের ট্যাক্সি। ট্যাক্সিতে উঠতে যাবে এমন সময়ে একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে এবং সতেরো-আঠেরো বছরের ছিপছিপে সুন্দরী মেয়ে এসে ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সামনের সিটে বসল। ওরা তিনজনের টিকিট কাটল—যাতে ওরা সামনে নিরিবিলিতে দুজনের গায়ে গায়ে লেগে বসতে পারে।

ছেলেটির হাতে দুটি কবিতার বই, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা—মেয়েটির হাতেও কীসব বই-খাতা।

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল। সামনের ছেলে-মেয়ে দুটি যে পাশাপাশি বসে আছে, পাশাপাশি বসে দু-ঘণ্টার পথ যাবে—এই আনন্দেই ওরা শিউরে শিউরে উঠছিল। অরু ওদের কথা শুনে বুঝল যে, ওরা হাজারিবাগ রোড স্টেশনে কাউকে আনতে যাচ্ছে।

হাওয়াতে মেয়েটির চুল উড়ছিল। ছেলেটি ফিসফিস করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলছিল। ওদের দেখে অরুর ওর নিজের আর প্রথমার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বার বার—আর ভীষণ খারাপ লাগছিল।

দ্রুত-ধাবমান ট্যাক্সিতে বসে নিজের কাঁচা-পাকা চুলে হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে অরু ঝকঝকে রোদভরা আকাশে তাকিয়ে নিজেকে শুধোল—আমাদের সব সুগন্ধি সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কেন? আমাদের ফুরিয়ে না গিয়ে উপায় নেই বলে, না আমরা আমাদের নতুন রাখতে জানি না বলে?

এরা সবাই-ই কি প্রথমা, নাকি দ্বিতীয়া?

নাকি অদ্বিতীয়ারাও আছে? আছে কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *