পোড়োবাড়ি
(ক)
বাড়িওয়ালা বললে, ‘‘হাঁ মশাই, দাঙ্গার পর থেকেই আমার এই বাড়িখানা খালি পড়ে আছে। এ অঞ্চলে আর কোনো হাঙ্গামা নেই, অথচ এমন চমৎকার বাড়ি, তবু লোকে এখনো কেন যে এখানে বাস করতে ভয় পায়, আমি তা বুঝে উঠতে পারি না।’’
আমি বললুম, ‘‘বাড়িখানা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি মিথ্যা ভয় পাবার লোক নই, আর আমার কাছে বন্দুক আছে। কিন্তু আপনি কত ভাড়া চান।’’
—‘‘বেশি নয়, মাত্র পঞ্চাশ টাকা। এ বাড়ির জন্যে আগে আমি একশো পঁচিশ টাকা ভাড়া পেতুম। কিন্তু একে এখন দিন-কাল খারাপ, তার উপরে বাড়িখানার সুনাম আবার আমি ফিরিয়ে আনতে চাই। তাই আপাতত পঞ্চাশ টাকা করে পেলেও আমি খুশি হব।’’
আমি বললুম, ‘‘তাই সই।’’
লক্ষ করলুম, বাড়িওয়ালা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে। ভাড়া কম হোক, এই পোড়োবাড়ির জন্যে অবশেষে একজন ভাড়াটিয়া যে জুটল, এইটেই সে সৌভাগ্য বলে মনে করলে। লোকটার দেহ হাড়জিরজিরে, আর কথা কইতে কইতে সে ক্রমাগত হাঁপাচ্ছিল—পুরাতন হাঁপানির রোগীর মতো! কিন্তু তার চোখ দুটো এমন উজ্জ্বল যে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন জ্বলন্ত! আমার হাতে চাবির গোছা দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ও লাঠি ঠক-ঠক করতে করতে সে চলে গেল। বাঁচলুম,—কেন জানি না, তাকে দেখে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল! যেন সে কোনো ভাবী অমঙ্গলের অগ্রদূত।
(খ)
এতদিন বিহারে ছিল আমার কর্মস্থল, এখন হঠাৎ বদলি হয়েছি কলকাতায়। পরিবারবর্গকে আপাতত বিহারে রেখেই, আমার বিহারি বেয়ারা রামসহায়কে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেছি বাসাবাড়ির খোঁজে।
ভাড়া পেলুম মনের মতো বাসা। ‘ফ্লোরে’র উপর দিব্য দোতলা বাড়ি, নীচে চারখানা ও উপরে দু-খানা ঘর, তার উপরে আছে রান্না ও ভাঁড়ার ঘর। সংসারে মানুষ বলতে আমি, আমার স্ত্রী ও দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, সুতরাং এই বাড়িতেই আমাদের বেশ কুলিয়ে যাবে।
গেল বারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এখানে নাকি চরমে উঠেছিল। এই বাড়িতে যারা বাস করত, তাদের কেউ কেউ মারা পড়ে, কেউ কেউ পালিয়ে যায়, আজ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে বাড়িখানা পোড়ো হয়ে আছে।
বাড়িখানা শহরের উপকণ্ঠে। এর আশেপাশে ছিল কয়েকটা বস্তি; দাঙ্গার সময়ে মারামারি, লুঠতরাজ ও অগ্নিকাণ্ডের ফলে সেগুলোর অস্তিত্ব প্রায় লোপ পেতে বসেছে! আজও সেখানে বসতি নেই, দেখা যায় কেবল জনশূন্য ধ্বংসাবশেষ! তাই প্রায় আধপোয়া পথ পার না হলে এখানে কোনো প্রতিবেশীর মুখ দেখবার উপায় নেই। কিন্তু সেজন্যে বিশেষ মাথা ঘামালুম না, কারণ আমি নিজে কুনো মানুষ, আমার পক্ষে প্রতিবেশীরা অনেক সময়ে বিরক্তিদায়ক।
ভৃত্য রামসহায় অনেক বিহারির মতো বেশ ভালো বাংলা বলতে পারত। আমি তাকে ‘রাম’ বলে ডাকি।
বললুম, ‘‘রাম, আজকের মতো তুমি বাড়ির দোতলাটা সাফ করে রাখো। আজই সন্ধ্যার আগে রাত কাটাবার জন্যে জিনিসপত্তর নিয়ে আমরা এই বাড়িতে এসে উঠব।’’
রাম বললে, ‘‘যে আজ্ঞে হুজুর!’’
ভাবতে লাগলুম, বাড়িখানা আমি ভাড়া নিতে রাজি শুনে বাড়িওয়ালার উজ্জ্বল চোখদুটো অমন আরো বেশি জ্বল-জ্বল করে উঠল কেন? তা কি আনন্দে? না তার অন্য কোনো রহস্যময় কারণ আছে?
এ প্রশ্নের উত্তর পেলুম সেই রাত্রেই।
(গ)
বলেছি, বাড়ির দোতলায় মাত্র দু-খানা ঘর। একখানা পশ্চিম দিকে, আর একখানা দক্ষিণ দিকে। ঘর দু-খানা বেশ বড়সড়।
বাড়িতে এসে যখন উঠলুম, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। স্থির করলুম, নিদ্রাদেবীর আরাধনার পক্ষে দক্ষিণের ঘরই প্রশস্ত।
নির্জন পল্লি, নিরালা সন্ধ্যা, নিস্তব্ধ বাড়ি। নিজেদের পদধ্বনি চারিদিককে প্রতিধ্বনিত করে তুলল—ঠিক যেন আরো কেউ কেউ পদচালনা করছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে! অনেক দিনের খাঁ-খাঁ-করা পোড়োবাড়ি, এরকম ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক। এই মিথ্যা ভ্রমটা মনের ভিতর থেকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু পারলুম না,—বারবার তবু মনে হতে লাগল, এ বাড়িতে আমরা ছাড়া আরো কাদের অস্তিত্ব আছে। এখনো তারা অদৃশ্য বটে, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে দৃশ্যমান।
এমন ধারণার কোনো অর্থ হয় না। আমি ভীরু নই, ভূত মানি না, ভূতের গল্প শুনেছি কিন্তু ভূত কখনো দেখিনি। এবং দেখব বলে বিশ্বাসও করি না। হয়তো মানুষের মনের উপর কাজ করে কোনো কোনো স্থান-কালের বিশেষত্ব। অসম্ভবকেও মনে হয় সম্ভবপর।
নির্বাচিত ঘরে ঢুকে পড়লুম এক মুশকিলে। দক্ষিণ দিকের জানলা খুলে দিতেই মন উঠল শিউরে—পেলুম যেন কোনো গলিত মৃতদেহের দুর্গন্ধ!
নাকে কাপড়চাপা দিয়ে উঁকি মারলুম জানলার বাইরে। নীচেই রয়েছে পচা জলে ভরা একটা খানা এবং তারপরেই খানিকটা জমির উপরে ভাঙাচোরা, লণ্ড-ভণ্ড, জনহীন বস্তি। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই।
বললুম, ‘‘রাম, ওই খানার ধারে নিশ্চয় কোনো মরা কুকুর-বিড়ালের পচা দেহ পড়ে আছে। এই দারুণ গ্রীষ্মে দক্ষিণের জানলা বন্ধ করে তো এ ঘরে থাকা যাবে না। চল পশ্চিম দিকের ঘরে যাই।’’
রাম বললে, ‘‘তাই চলুন।’’
পশ্চিমের ঘরে হাওয়া কম হলেও দুর্গন্ধ নেই। কিন্তু অসুবিধায় পড়লুম আর এক কারণে। ‘সুইচ’ টেপাটিপি করেও আলো জ্বালতে পারলুম না। ইলেকট্রিকের তার কোথাও খারাপ হয়ে গিয়েছে।
নাচার হয়ে রামকে বললুম, ‘‘তুমি বাজার থেকে বাতি কিনে আনো। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে দি, তারপর কাল সকালে উঠে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।’’
(ঘ)
বাতি নিবিয়ে, কেমন একটা অহেতুকি অশান্তির ভাব মনের মধ্যে নিয়ে শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করলুম। শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু তন্দ্রাঘোরেও মনে হয়েছিল, ঘরের ভিতরে কারা যেন নীরবে আনাগোনা করছে।
কতক্ষণ পরে জানি না, আমার ঘুম ভেঙে গেল আচমকা। আমার মুখের উপরে পড়ল যেন কার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস!
আমি কি স্বপ্নলোকে বাস করছি? কিন্তু পর-মুহূর্তেই অনুভব করলুম, ঠিক পাশেই আমার গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে শুয়ে আছে আর একটি জীবের দেহ। কোমল, রোমশ, জীবন্ত দেহ! স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ! সেই সঙ্গে পেলুম একটা জান্তব গন্ধ!
ধড়মড় করে উঠে বসে এক লাফে বিছানার বাইরে গিয়ে পড়লুম এবং পর-মুহূর্তে আচম্বিতে দপ করে জ্বলে উঠল ঘরের বৈদ্যুতিক আলো!
কিন্তু তখন আলো-জ্বালার ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করলে না, কারণ সর্বপ্রথমেই আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল বিছানার দিকে।
কে ওখানে, কী ওখানে শুয়ে আছে? কিন্তু কী আশ্চর্য, বিছানার উপরে কেউ তো নেই!
কেবল বিছানার উপর নয়, আমার বিস্ফারিত চক্ষু সমস্ত ঘরখানা আতিপাতি করে খুঁজেও সন্দেহজনক বা ভয়াবহ কোনো-কিছুই আবিষ্কার করতে পারলে না!
এ কি ভ্রম? এ কি দুঃস্বপ্ন? কিন্তু তাই যদি হবে, তবে বারবার ‘সুইচ’ নাড়াচাড়া করে বহু চেষ্টার পরেও যে আলো জ্বালতে পারিনি, সেটা হঠাৎ এখন আপনা-আপনি জ্বলে উঠল কেমন করে?
এগিয়ে ‘সুইচ’ তুলে দিলুম। কিন্তু চেষ্টা করেও যে আলো জ্বালতে পারিনি, এখন চেষ্টা করে তাকে আর নেবাতেও পারলুম না!
সবই অস্বাভাবিক ব্যাপার! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে রামের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলুম। সে শুয়েছিল দরজার বাইরে বারান্দার উপরে। আমার চিৎকার শুনে ভিতরে ছুটে এল হন্তদন্তের মতো।
উত্তেজিত স্বরে বললুম, ‘‘রাম, এতক্ষণ আমার বিছানার উপরে কে শুয়ে ছিল! তারপর চেয়ে দেখ, ঘরের আলোটা আপনা-আপনি জ্বলে উঠেছে!’’
আমার মুখের পানে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রামসহায় থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বোবা মূর্তির মতো! সে বেশি ভয় পেয়েছে, না বেশি হতভম্ব হয়েছে, বোঝা গেল না।
আবার বিছানার দিকে চেয়েই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল! ও আবার কী ব্যাপার?
বিছানার চাদরের উপরে রয়েছে কতগুলো কাদামাখা পদচিহ্ন! দেখতে অনেকটা বিড়ালের থাবার মতো, কিন্তু সেগুলো বিড়ালের থাবার চেয়ে অনেক বড়!
আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলুম, ‘‘হলপ করে বলতে পারি, আধ মিনিট আগেও ওই থাবার দাগগুলো ওখানে ছিল না!’’
আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে রামসহায় বললে, ‘‘হুজুর! বাইরে চলে আসুন!’’
বাইরেই চলে এলুম—একেবারে বাড়ির বাইরে। শেষ রাতটা কাটল রাস্তার ধারে রোয়াকের উপরে।
(ঙ)
সকালে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। সব কথা খুলে বললুম।
বাড়িওয়ালা হাঁপের টান সামলাতে সামলাতে হাসবার চেষ্টা করে বললে, ‘‘মিছেই ভয় পেয়েছেন। ঘরের ভিতরে ভাম এসেছিল। পাশের খানায় ভাম থাকে।’’
—‘‘কিন্তু সে বন্ধ ঘরের ভিতরে এল কেমন করে?’’
—‘‘জানলা দিয়ে।’’
—‘‘ভাম কখনো একতলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে উঠতে পারে?’’
—‘‘দোতলায় যখন উঠেছে, নিশ্চয়ই পারে।’’
—‘‘ধরলুম তাই। কিন্তু ভাম যখন ঘরের ভিতরে নেই, তখন তার পায়ের চিহ্ন বিছানার উপরে পড়ল কেন?’’
—‘‘আপনি ভুল দেখেছেন। পায়ের চিহ্ন আগে থাকতেই বিছানার উপরে ছিল।’’
—‘‘আর ইলেকট্রিক লাইটের ব্যাপারটা?’’
—‘‘তারের ভিতর গলদ থাকলে অমন ব্যাপার মাঝে মাঝে হয়। আপনি পাখা চলে, আপনি আলো জ্বলে। মশাই, আজই আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, আপনার কোনো ভাবনা নেই!’’
দেখছি, বাড়িওয়ালার ওজরের অভাব নেই। শুকনো হাসি হেসে বললুম, ‘‘না, আমার আর কোনো ভাবনাই নেই। কারণ, আজকেই আমি অন্য বাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়ব।’’
___