পূর্ণিমা
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল—ফাগুন মাসের পূর্ণিমার চাঁদ; কলিকাতা শহরের অসমতল মস্তকের উপর অজস্র কিরণজাল ঢালিয়া দিতেছিল। এই ফাগুন পূর্ণিমার চাঁদ সামান্য নয়; যুগে যুগে কত কবি ইহার মহিমা কীর্তন করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং এই মহিমা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।.
সদর রাস্তা ও গলির মোড়ের উপর একটি বাড়ি। তাহার ত্রিতলের একটি ঘরে বাড়ির কর্তা মুরারি চাটুয্যে খাটের উপর হাঁটু তুলিয়া এবং মুখ বিকৃত করিয়া শুইয়া ছিলেন। রাত্রি আন্দাজ সাড়ে ন’টা। চাঁদ আকাশের জ্যোৎস্না-পিছল পথে পথে বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠিয়াছে।
মুরারি চাটুয্যের হাঁটুর মধ্যে চিড়িক্ মারিতেছিল। তিনিও হঠাৎ চিড়িক্ মারিয়া ডাকিয়া উঠিলেন, ‘গিনি—ওরে গিনি—’
কন্যা হেমাঙ্গিনী আসিয়া দাঁড়াইল।
‘কি বাবা?’
চাটুয্যে বলিলেন, ‘আমার খাবার ঘরেই দিয়ে যাবি। আজ নামতে পারব না।’
গিনি বলিল, ‘বাতের ব্যথা বেড়েছে বুঝি?’
‘হুঁ। আর শোন্, কবিরাজি তেল আর একটু আগুন করে নিয়ে আয়, সেঁক দিতে হবে।’
গিনি বলিল, ‘আচ্ছা। আজ পূর্ণিমা কিনা, তাই বাতের ব্যথা চাগাড় দিয়েছে।’
চাটুয্যে দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিলেন, ‘পূর্ণিমার নিকুচি করেছে।’
গিনি সেঁকের ব্যবস্থা করিতে গেল। তাহার মনে পড়িল, দু’বছর আগে এই ফাগুন পূর্ণিমার রাত্রে তাহার বিবাহ হইয়াছিল। তারপর ছয় মাস কাটিল না, সব ফুরাইয়া গেল। কেবল সুদীর্ঘ শুষ্ক ভবিষ্যৎ পড়িয়া রহিল। গিনির মর্মতল মথিত করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। ফাগুন পূর্ণিমা!
রান্নাঘরে গিয়া গিনি মালসায় আগুন তুলিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় তাহার দাদা জীবু দ্বারের কাছে আসিয়া দাড়াইল। জীবুর চেহারা রোগা লম্বা, মাথাটাও লম্বাটে ধরনের, চোখ দুটো জ্বল্জ্বলে। তাহার গায়ে চাদর জড়ানো রহিয়াছে, চাদরের ভিতর দুই হাত বুকের উপর আবদ্ধ।
জীবু বলিল, ‘গিনি, আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রাখিস। আমি বেরুচ্ছি—’
গিনির বুকের ভিতর ছাঁৎ করিয়া উঠিল, এত রাত্রে বেরুচ্ছ!’
‘হ্যাঁ’—জীবু চলিয়া গেল।
গিনি শঙ্কিত চক্ষে চাহিয়া রহিল। আজ পূর্ণিমা।
বাড়ি হইতে ফুটপাথে নামিয়া জীবু দেখিল, সম্মুখেই চাঁদ। সে বড় বড় দাঁত বাহির করিয়া হাসিল, তারপর আপন মনে চলিতে আরম্ভ করিল। চাদরের মধ্যে হাতের মুঠিতে যে-বস্তুটি শক্ত করিয়া ধরা আছে তাহা যেন হাতের উত্তাপে গরম হইয়া উঠিতেছে।
কিছুদূর চলিয়া জীবু থমকিয়া দাঁড়াইল। ফুটপাথের পাশেই একটা খোলা জানালা, ভিতর হইতে আলো আসিতেছে। জীবু গলা বাড়াইয়া জানালার ভিতর উঁকি মারিল, ডাকিল, ‘ও মহীদা—’
ঘরের মধ্যে একটি লোক টেবিলের সম্মুখে বসিয়াছিল, সে আঠয়া আসিয়া জানালার সম্মুখে দাঁড়াইল।
‘কে, জীবু নাকি? কি খবর হে?’
জীবু বলিল, ‘ভারি সুন্দর চাঁদ উঠেছে, চল না মহীদা, বেড়াতে যাবে।’
মহী বলিল, ‘এত রাত্রে বেড়াতে? পাগল নাকি?’
জীবু মিনতি করিয়া বলিল, ‘চল না মহীদা, এমন চাঁদের আলো—’
‘আমি যাব না ভাই, তুমি যাও—’ বলিয়া মহী জানলা বন্ধ করিয়া দিল। জ্বল্জ্বলে চোখ লইয়া জীবু কিছুক্ষণ বদ্ধ জানালার বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর আবার চলিতে আরম্ভ করিল।
ঘরের ভিতর মহী আসিয়া আবার টেবিলের সম্মুখে বসিল। জীবুর সহিত রাত্রে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইবার পাগলামি তাহার নাই বটে, কিন্তু জীবুর কথাগুলা তাহার কানে বাজিতে লাগিল—ভারি সুন্দর চাঁদ উঠেছে…এমন চাঁদের আলো—
মহী একজন কবি। এবং প্রেমিকও বটে। তাহার ত্রিশ বছর বয়স এবং সচ্ছল অবস্থা সত্ত্বেও সে বিবাহ করে নাই; কারণ বারেন্দ্র শ্রেণীর হইয়া সে একটি রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ কন্যাকে ভালবাসিয়াছিল।
যাহাকে সে ভালবাসিয়াছিল তাহার কী রূপ—যেন সর্বাঙ্গ দিয়া জ্যোতি ফাটিয়া পড়ে। পাড়া সম্পর্কে মহী তাহার বাড়িতে যাতায়াত করিত, কদাচ দু’ একটা কথাও বলিত; কিন্তু মহী বড় মুখচোরা, তাহার মনের কথা ঘুণাক্ষরে প্রকাশ পায় নাই। উশীরের মতো তাহার অন্তরের সমস্ত সৌরভ শিকড়ে গিয়া আশ্রয় লইয়াছিল এবং তাহাকে মধ্যম শ্রেণীর একটি কবি করিয়া তুলিয়াছিল।
দুই বছর আগে মেয়েটির বিবাহ হইয়াছিল, তারপর নবোঢ়া বধূ স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু ছয় মাস যাইতে না যাইতে সে বিধবা হইয়া আবার পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিল।… লোকে বলে বিষকন্যা ঐ রকম হয়, তাহাদের কেহ ভোগ করিতে পারে না…বিষকন্যা কি সত্য—না কবিকল্পনা? যদি কল্পনাই হয় তবে তাহার মধ্যে তীব্র কবিত্বের ঝাঁঝ আছে—
মহীর মাথার মধ্যেও কবিতা ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। সে জানালা খুলিয়া একবার বাহিরে তাকাইল। সম্মুখেই পূর্ণিমার চাঁদ, জ্যোৎস্নায় চারিদিক ভাসিয়া যাইতেছে—
মহী ফিরিয়া আসিয়া কবিতা লিখিতে বসিল।..
—চাঁদের আলোয় তোমারে দেখিনি কভু
মনে হয় তুমি আরও সুন্দর হবে।
বিদ্যুৎ শিখা নবনীপিণ্ড হয়ে
জমাট বাঁধিয়া রবে।
কবিতা যখন শেষ হইল তখন চাঁদ মাথার উপর উঠিয়াছে, কলিকাতা শহর নিশুতি।
কিন্তু কবিতা লিখিয়া মহীব হৃদয়াবেগ সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয় নাই; তাহার উপর ঘুম চটিয়া গিয়াছে। সে ভাবিতে লাগিল, অনেকদিন গিনিকে দেখিনি…আজ এই চাঁদ্নি আলোতে সে যদি একবার জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়..উন্মনা হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে…আমি রাস্তা থেকে চুপি চুপি দেখে ফিরে আসব।….
সম্ভাবনা কম, বুঝিয়াও মহী রাস্তায় বাহির হইল। সে হঠকারী নয়—কিন্তু আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ—
জীবু অনেক রাস্তা ঘুরিয়া আবার নিজের পাড়ায় ফিরিয়াছিল। তাহার মাথার মধ্যে মাদকতার ফেনা গাঁজিয়া উঠিতেছিল। একটা মানুষকে নিরিবিলি পাওয়া যায় না? যতক্ষণ পথে মানুষ ছিল জীবু সতর্কভাবে তাহাদের নিরীক্ষণ করিয়াছে, কিন্তু কাহাকেও একলা পায় নাই। তাহার বুকের মধ্যে মত্ততা গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টি ঘোলা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তবু সে আত্মসম্বরণ করিয়াছে; চাদরের আড়ালে মুঠোর ভিতর যে বস্তুটি দৃঢ়বদ্ধ আছে তাহা তপ্ত হইয়া যেন হাতের তেলো পুড়াইয়া দিতেছে। মহীকে জীবু ডাকিয়াছিল, সে যদি আসিত—
পথ একেবারে নির্জন হইয়া গিয়াছে, দোকান-পাট বন্ধ। নিজের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া জীবু থমকিয়া দাঁড়াইল। চাঁদের আলোয় একটা মানুষ তাহার বাড়ির সম্মুখে ঘোরাঘুরি করিতেছে। একটা মানুষ—দ্বিতীয় কেহ নাই। জীবুর চোখদুটা ধক্ধক্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।
জীবু পাগল। অন্য সময় সে সহজ মানুষ, কিন্তু পূর্ণিমা তিথিতে তাহার সুপ্ত পাগলামি সাপের মত মাথা তুলিয়া দাঁড়ায়, রক্তের মধ্যে হত্যার বীজাণু ছুটাছুটি করে! আজ পূর্ণিমা!
জীবু ছায়া আশ্রয় করিয়া অতি সন্তর্পণে লোকটার দিকে অগ্রসর হইল। কাছে আসিয়া চিনিতে পারিল—মহী! মহী তাহার বাড়ির উল্টা দিকের ফুটপাথে পায়চারি করিতেছে, তাহার দৃষ্টি ঊর্ধ্বে নিবদ্ধ। জীবু শ্বাপদের মতো দন্ত বাহির করিয়া নিঃশব্দে আরও আগে বাড়িল। মহী এতরাত্রে এখানে কি করিতেছে এ প্রশ্ন তাহার মনে আসিল না। তাহার চিন্তা, শিকার না ফস্কায়!
তারপর চিতা বাঘের মতো লাফ দিয়া মহীর ঘাড়ে পড়িল। তাহার হাতের ছুরিটা জ্যোৎস্নায় চমকিয়া উঠিল, তারপর মহীর গলায় প্রবেশ করিল। মহী বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া পড়িয়া গেল। তাহার কণ্ঠ হইতে উদ্গলিত রক্ত ফুটপাথের উপর ধারা রচনা করিয়া গড়াইতে লাগিল।
জীবু আর সেখানে দাঁড়াইল না। তাহার মাথার গরম নামিয়া গিয়াছে। সে তীরবেগে ছুটিয়া নিজের বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িল।
মহীর মৃতদেহ ফুটপাথের উপর সারারাত্রি পড়িয়া রহিল, কেহ দেখিল না। কেবল আকাশে ফাগুন পূর্ণিমার চাঁদ হাসিতে লাগিল।
২০ ফাল্গুন ১৩৫৪