পুরুষ
ছোটকাকা বার বার করে বোঝাচ্ছিলেন খোকনকে।
–চুপ করে বসে থাকবে। উঠবে না, ছটফট করবে না। শ্যামবাজারের মোড়টা পার হলেই কন্ডাক্টরকে বলবে, আমি হাতিবাগানের মোড়ে নামব। বাস একেবারে থেমে গেলে সামনের দিকে মুখ করে তারপর নামবে। চারদিকে দেখে-শুনে রাস্তা পার হবে। তারপর ডানদিক ধরে গ্রে স্ট্রিট দিয়ে এগিয়ে গেলেই ছোটমাসিমার বাড়ি। ফুটপাথ থেকে কখনও নামবে না, আর
অধৈর্য হয়ে মাথা নেড়ে জবাব দিল খোকন :
–জানি–জানি। কতবার তো গেছি তোমাদের সঙ্গে।
–হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে গেছ। কিন্তু আজ যাচ্ছ একা। এই প্রথম একা পাঠাচ্ছি তোমাকে। লক্ষ্মী ছেলে হলে কোনও ভাবনা ছিল না। কিন্তু তুমি যেরকম চুলবুলে–
–না কাকা, তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমি সব চিনি।
–ছাই চেনো। যা যা বললাম, সব ঠিকভাবে করবে। আর গিয়েই ছোটমাসিকে বলবে আমাদের ডাক্তারবাবুর বাড়িতে একটা টেলিফোন করে দিতে। তা হলেই আমরা খবর পেয়ে যাব।
–আচ্ছা–আচ্ছা। আবার জোরে জোরে মাথা নেড়ে দিল খোকন, আর ভাবছিল, কতক্ষণে কাকার কাছ থেকে নিস্তার পাবে। বেশিক্ষণ দেরি করতে হল না। বাস এসে পড়ল।
উঠে পড়ো চটপট। ফাঁকাই তো আছে দেখছি। হ্যান্ডেলটা ভাল করে চেপে ধরো। সোজা ভেতরে গিয়ে-বসেছ? আচ্ছা ঠিক আছে। কাকা জানলার কাছে চলে এসেছেন; যা বলেছি সব মনে থাকে যেন। হাতিবাগানের মোড়ে নেমে গ্রে স্ট্রিট। আর পৌঁছেই একটা : টেলিফোন
বাস ছাড়ল। পেছন থেকে শেষবার শোনা গেল : টেলিফোন কিন্তু
আঃ–এইবার নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। এইবার খোকন একা। কাকা নেই, বাবা নেই–মা, দিদি কেউ নেই। খোকন এখন নিজেই নিজের অভিভাবক। পকেট থেকে পয়সা বার করবে, গুনে গুনে দেবে কন্ডাক্টরকে, গম্ভীর গলায় বললে : হাতিবাগানের মোড়। টিকিটটা নিয়ে মাথা নেড়ে বলবে : আচ্ছা ঠিক আছে
খোকন ছেলেমানুষ নয়। তেরো বছর তার বয়েস–এবার ক্লাস এইটে উঠেছে। স্কুলের নতুন বেয়ারাটা তাকে আপনি বলে। ক্লাসের টিমে সে ক্রিকেট খেলে। বল ছুঁড়তে-ছুঁড়তে বলে, এইবার একটি ফাস্ট বল দিচ্ছেন ট্রুম্যান, এইবার গুপ্তে চমৎকারভাবে স্পিন করলেন
কিন্তু বাড়িতে?
ছেলেমানুষ–ছেলেমানুষ–ছেলেমানুষ! শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায়। কিন্তু একথাও তো ঠিক যে, এখনও খোকন মার কাছে ছাড়া শুতে পারে না। বড় দেওয়াল-ঘড়িটায় চাবি দেওয়া দূরে থাক–হাত দিয়ে ছুঁতেও পারে না এখনও, সিঁড়ির নীচে কয়লার ঘরটায় সন্ধের পর কিসের যেন কালো কালো ছায়া দেখে, একটু বেশি রাতে একা ছাতে যেতে বললে তার পা ব্যথা করতে থাকে।
কিন্তু এসব তো রাতের কথা। তা ছাড়া আর বছরখানেকের মধ্যেই সে দেওয়াল-ঘড়িটার চাবি দেওয়ার মতো লম্বা হতে পারবে। তাই বলে এই সকালে দক্ষিণেশ্বর থেকে হাতিবাগানে তাকে পাঠাতে সকলের এত ভয় কেন? দিনে খোকন কোনও কিছুর পরোয়া করে না। সব চেনে, সব দেখতে পায়, কয়লার ঘরের ভেতরে পর্যন্ত গিয়ে বেড়ালের বাচ্চাগুলোকে নাড়াচাড়া করে আসে। যতক্ষণ রোদের আলো জেগে আছে, ততক্ষণ খোকন আর ছেলেমানুষ নয়।
তবু আরও একটু বড় হওয়ার দরকার। আর-একটুখানি বড় না হলে
ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা টফি বের করলে খোকন। চমৎকার লাগছে। মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে বাস। দু-একটা নতুন বাড়ি উঠেছে এদিকে ওদিকে, তাছাড়া ছোট-ছোট ঝোপ, আর অনেক দূর পর্যন্ত ধানের খেত। কাল রাতে খুব খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেছে, শাদা জল চিকচিক করছে খেতের ভেতরে হাওয়ায় সবুজ ধানের ঢেউ খেলছে। রাস্তার ধারের গাছ থেকে দুটো পাখি উড়ে গেল একসঙ্গে বুলবুলি।
এই বাসটা যদি পথ ভুল করে? যদি কলকাতার দিকে না গিয়ে অন্য দিকে, অন্য যে-কোনও দিকে চলতে থাকে খেয়াল-খুশিতে? অনেকক্ষণ ধরে? মাঠের পর মাঠ পাড়ি দিয়ে বনের ভেতর দিয়ে, নদীর ধার দিয়ে চলতেই থাকে? তারপর বেলা গড়িয়ে গেলে হঠাৎ বাসটা থামিয়ে ড্রাইভার বলে, এই যাঃ, ভারি ভুল হয়ে গেছে হাতিবাগান না গিয়ে আমরা যে সোজা মধুপুরে চলে এসেছি!
হুঁ, রাস্তা ভুল করে মধুপুরে যাওয়াই ভাল। অন্য জায়গা খোকন চেনে না। মধুপুরে পিসিমার বাড়ি। কত মাঠ, কত ফুল, কত খেলবার জায়য়া। তারপর সেখানে আছে পিসতুতো ভাই টোকন। বয়সে তারই সমানতার সঙ্গে খুব ভাব। দুজনে মিলে মনের
আনন্দে ব্যাডমিন্টন খেলা যায়।
আর এদিকে?
পকেট থেকে আর-একটা টফি বের করে খোকন তার মোড়কটা ছাড়াতে লাগল। এদিকে বাড়িতে তো দারুণ গণ্ডগোল! ছোটমাসিমার বাড়ি থেকে কোনও খবর না পেয়ে কাকা নিজেই ডাক্তারবাবুর দোকান দিয়ে হ্যালো হ্যালো বলে ফোন করবেন। মাসিমা বলবেন, না তো–খোকন তো আসেনি! মা তো তক্ষুনি কান্না জুড়বেন, বাবা কাকা একবার যাবেন থানায়, একবার হাসপাতালে-তারপর খবরের কাগজে যেমন সবাই দেয়, তেমনি বিজ্ঞাপন দেবেন : নিরুদ্দেশ। ডাকনাম খোকন, ভাল নাম শুভাশিস রায়চৌধুরী। বয়স তেরো বছর, ফরসা, উচ্চতা
আচ্ছা, সে কতটা উঁচু? খোকন মনে করবার চেটা করতে লাগল।
সে যাক। সেকথা কাকাই বুঝবে। তারপর নীচে লিখে দেবে : খোকন রাগ কোরো না। এবার নিশ্চয় তোমাকে ক্রিকেট ব্যাট কিনে দেওয়া হবে। শিগগির ফিরে এসো-তোমার মা শয্যাগত। মেজদি ছোড়দি রাতদিন কাঁদছে। ঠিকানা জানালে
আর খবরের কাগজে সেই বিজ্ঞাপন দেখে পিসিমা বলবে : করেছিস কী—ও খোকন? না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস মধুপুরে?
খোকন তখন টোকনের সঙ্গে ক্যারাম খেলছে। হেসে বলবে : বা-রে, আমি কি ইচ্ছে করে চলে এসেছি নাকি? বাসটাই তো ভুল করে কলকাতায় না গিয়ে এখানে চলে এল। আমি কী করব।
পিসিমা বলবেন, সর্বনাশ! তা হলে তো এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম
খোকনের স্বপ্নটা হোঁচট খেল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে দাঁড়াল বাসটা।
না–পথ ভুল করেনি। সেই চেনা রাস্তা ধরে–সেই একভাবে ঠিক চলে এসেছে। ধানের খেত-বন-নদী–কোথাও কিছুই নেই। গাড়ি বরানগরে এসে দাঁড়িয়েছে।
কলকাতাতেই যেতে হবে খোকনকে। সেই হাতিবাগানের মোড়ে–সেই ছোট-মাসিমার বাড়িতে। খোকনের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। এতক্ষণ বাসে ভিড় ছিল না–এইবারে অনেক লোক উঠল। গাড়ির ভেতর চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। কে যেন বলছে : গঙ্গাজল। গঙ্গাজলের ঘটিটা কোথায় গেল? আর একজন চেঁচাচ্ছে : দেখিস এবার মোহনবাগানই লিগ নেবে। আমি বলছি, তুই লিখে রাখ–
বাস আবার চলছে। মধুপুর নেই, সেই মাঠটা কোথাও নেই–সেই খেলবার জায়গাও নেই। দুধারে বাড়ির সার ঘন হয়ে উঠেছে। এক জায়গায় একরাশ কাদা জমেছে, কতগুলো মোষ গড়াগড়ি করছে সেখানে। একটু পরেই বাস কলকাতায় পৌঁছুবে–তারপর গ্রে স্ট্রিট, তারপর ছোটমাসিমার বাড়ি।
খোকন যদি আর-একটু বড় হত, তা হলে হাতিবাগান নয়–আরও দূরে একা নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারত। যেতে পারত বালিগঞ্জে–পটলমামাদের বাড়িতে। পটলমামা অবাক হয়ে বলবেন :কী রে–একাই চলে এলি এত দূরে?
খোকন মাথা নেড়ে বলত : কেন–পারি না নাকি? এখনও আমি বড় হইনি বুঝি?
পটলমামা বলতেন : তাই তো দেখছি! এখন একেবারে জেন্টলম্যান! আর খোকন বলা চলবে না বলতে হবে শুভাশিসবাবু।
–একটা পয়সা দেবেন বাবু? বাস থেমেছে।
হাত বাড়িয়েছে ভিখারির ছেলে।
গরিবকে একটা নয়া পয়সা দিয়ে যান রাজাবাবু
বাবু রাজাবাবু। নিজেকে ভারি সম্মানিত মনে হয় খোকনের। এতদিন ওকথাটা বাবা শুনেছে, কাকা শুনেছে। আজ ও খোকনকেই সম্বোধন করছে ওই বলে। খোকনকেই–আর কাউকেই নয়।
ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে একটা পাঁচ নয়া পয়সা ঠেকল। পাঁচ নয়া পয়সা? তা হোক।
বাস চলে–আবার ঝিম আসে খোকনের। এখনও অনেক বড় হতে হবে, অনেক বড় হওয়া বাকি আছে তার। কয়লার ঘরে সন্ধের পর কাঁদের ছায়া দোলে–অনেক রাতে একলা ছাতের ওপর কারা যেন ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে যায়, বাইরের বাদাম গাছটায় প্যাঁচা ডাকলে খোকন এখনও মায়ের বুকের কাছে সরে আসে। ক্রিকেট খেলার সময় ফ্র্যাঙ্ক ওরেল হলে কী হয়–এখনও খোকনের বড় হতে অনেক দেরি আছে।
আচ্ছা বাসটা কেন পথ ভুল ধরে মধুপুরে চলে যায় না?
–লেডিজ সিট–লেডিজ সিট
চিড়িয়া মোড়। খোকনের ঝিমুনি ভাঙে। কন্ডাক্টর আলতোভাবে ছোঁয়া দিলে খোকনের পিঠে। পাশে পিসিমার মতো বয়সের একটি মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন ভুরু কুঁচকে। কাঁধে লম্বা একটা ঝোলানো ব্যাগ, চোখে ভ্রূকুটি।
পাশের জায়গাটা দেখিয়ে খোকন বললে, বসুন না—
ভদ্রমহিলা মোটা গলায় বললেন, লেডিজ সিট ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এক মুহূর্তে কী যে বুঝল খোকন নিজেই জানে না। চট করে উঠে পড়ল–তারপর একেবারে সামনে গিয়ে অনেক কষ্টে আঁকড়ে ধরল রডটা। হঠাৎ তার মনে হল, সে অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক বড়।
একজন ভদ্রলোক বললেন, এসো খোকা–এখানে জায়গা আছে।
খোকা! না। খোকন জবাব দিলে না।
হাতিবাগানের মোড়ে সে নামবে না–যাবে না ছোটমাসিমার বাড়িতে। এই বাসে চড়ে সে আরও অনেক দূরে চলে যাবে। বালিগঞ্জে, ডায়মন্ডহারবারে–মধুপুরে। আর তার ভয় নেউ–আর কাউকে সে ভয় করবে না। খোকন অনুভব করতে লাগল, আজ–এক্ষুনি সে অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছে, ওই ঢ্যাঙা কন্ডাক্টারটার মাথা ছাড়িয়েও আরও এক হাত ওপরে।