দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

পুজো, না, বিচিত্রানুষ্ঠান

পুজো, না, বিচিত্রানুষ্ঠান

সপার্যদ তিনি আসছেন, সিংহবাহিনী। এপাশে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক মা লক্ষ্মী, অন্য পাশে বিশ্ববিদ্যালয়—মা সরস্বতী। শুন্ডধারী চেম্বার অফ কমার্স গণেশবাবা, অদূরেই মায়ের পেন্টাগন কার্ত্তিক। সিংহ হলেন মায়ের রয়্যাল সিম্বল। অসুরটিকেও সঙ্গে করে এনেছেন। এই অসুর মায়ের মতোই অমর। কিছুতেই মরে না। মরার পরই বেঁচে ওঠে। মায়ের সঙ্গেই স্বর্গে চলে যায়। আমাদের পলিটিক্যাল লিডারদের মতো। বাইরে যত ইজমের ফাটাফাটি , ভেতরে-ভেতরে সব হলায়-গলায়। একই টেবিলে খানাপিনা। আঁতাত। রামমন্দির, বাবরি মসজিদ বাইরে। মুষ্টিযোদ্ধার হ্যান্ডগ্লাভসের মতো। আসল ব্যাপার হল নকআউট টুর্নামেন্ট। পলিটিক্যাল রিং ফাইট। দেবতা আর দানব উভয়েরই সহ অবস্থান। হিন্দি ছবির হিরো আর ভিলেন। পালা, তা না হলে জমে কী করে! আরও আছে, আমাদের দেশের দারিদ্যের উপমা। চিরকালটাই শুনে যাব, ডেভালাপিং কান্ট্রি। ডেভালাপড হবে না কোনওদিন। অসুরের মতো দারিদ্র্যের চির-অবস্থান। অশিক্ষা, কুসংস্কার, বিভেদ, বিদ্বেষ—এই হল আমাদের চালচিত্র। তার সামনে যাবতীয় ট্যাবলো। নীতির হাত ধরে দুর্নীতি। পুলিশের সঙ্গে মাস্তানের করমর্দন। আদালতের করিডরে খুনির অট্টহাসি। সব দেশেরই এক হাল। সর্বত্রই অসঙ্গতির চিত্র। ইরাকে যুদ্ধ হবে, আমেরিকার অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠবে। খ্রিশ্চান দুনিয়ার সিম্বল হল ত্রুশবিদ্ধ যিশু। সেখানে অসুর নিধন নয়, খোদ অবতারই নির্দয় নিষ্ঠুরতার বলি। যন্ত্রণাই সেখানে দেবতা। বিশ্বাসের লড়াই, মতের লড়াই, সাদা-কালোর লড়াই। হোয়াইট ইজ গড, ব্ল্যাক ইজ স্যাটান। কালো অসুরকে মারবে সাদা ঈশ্বর।

কবেই বা আমরা ধর্মকে সেইভাবে মেনেছি। আমরা কেউই সেই অর্থে গোঁড়া ধার্মিক নই। গোঁড়ারা কখনও ধার্মিক হতে পারে না। শব্দটা সোনার পাথরবাটির মতোই অবাস্তব। গোঁড়ামি ধর্ম নয়, অধর্ম। পাপ। সেই আমরা কারা? এই শহরের মানুষ যারা। অষ্টাদশ শতক থেকে যারা ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যতেক সংগ্রামের সাক্ষী হতে পেরেছে। যে-দেশে স্বামী বিবেকানন্দ সরবে বলতে পেরেছিলেন :

‘হিন্দুধর্মের ন্যায় আর কোনও ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরিব পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোনও ধর্ম এরূপ করে না। ভগবান আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, ইহাতে ধর্মের কোনও দোষ নাই। তবে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত আত্মভিমানী কতকগুলি ভণ্ড ‘পারমার্থিক ও ব্যবহারিক’ নামক মত দ্বারা সর্বপ্রকার অত্যাচারের আসুরিক যন্ত্র ক্রমাগত আবিষ্কার করিতেছে।

‘আমরা এখন বৈদান্তিকও নই, পৌরাণিকও নই, তান্ত্রিকও নই, আমরা এখন কেবল, ‘ছুঁৎমার্গী’, আমাদের ধর্ম এখন রান্নাঘরে। ভাতের হাঁড়ি আমাদের ঈশ্বর, আর ধর্মমত ‘আমায় ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না, আমি মহাপবিত্র’! যদি আমাদের দেশে আর এক শতাব্দী ধরিয়া এই ভাবে চলে, তবে আমাদের প্রত্যেককেই পাগলাগারদে যাইতে হইবে।”

সেই শহরের মানুষ আমরা। ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিতরা সহসা আমাদের ব্যবহার করতে পারবে না। আমাদের সবচেয়ে বড় পুজো দুর্গাপুজাকে আমরা বলি দুর্গোৎসব। ব্যক্তিমানুষের নাটমন্দির থেকে কলির এই রাজসূয় যজ্ঞকে তুলে এনে জনতার মুক্তমন্দিরে স্থাপন করেছি। সেই সার্বজনীন আয়োজন অবারিত-দ্বার। যত না পুজো, তার চেয়ে বেশি উৎসবের মেজাজ। রাজ্য জুড়ে এক হইহই ব্যাপার। সাজ-সাজ রব। খরচের অনুপাত এইরকম, প্রতিমা যদি এক টাকা হয়, প্যান্ডেল দশ হাজার টাকা। পুরোহিত সিকির সিকি টাকা। ফলমূলাদি এক পয়সা। বিশাল এলাকা জুড়ে রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে মাইক-বিদীর্ণ পরিবেশে মানুষের গুলতানি। তার আগে ব্যাবসার বাজার সরগরম। মানুষ ভালো পরবে, সাজবে গুজবে, মাখবে মাখাবে, চার-পাঁচ দিন ঠেসেঠুসে খাবে। বিবিধ ভারতী চৌপর দিন চেল্লাবে। কৃত্রিম গলায় ঘোষিকা জাতিকে আহ্বান জানাবেন চলে আসুন গড়িয়াহাটের মোড়ে, সব সমস্যার সমাধান ওইখানে। বাড়িতে-বাড়িতে চলমান বিক্রেতাদের হানা বাড়বে। শাড়ির ফলাও প্রদর্শনী। বাঘ যেমন মানুষ দেখলে খেপে যায়, রমণীরা সেইরকম রমণীয় শাড়ি দেখলে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেন। সংসারের স্টিয়ারিং-এ টাই-রড কেটে যায়। কর্তারা একটু বেশি টকেটিভ হয়ে ওঠেন। দুশ্চিন্তার এঁড়ে বাছুর টাকের বিচরণভূমি থেকে আরও কয়েক গাছা চুলের ঘাস মুড়িয়ে খেয়ে যায়। গৃহিণীরা খোন্তাখুন্তি ফেলে সাময়িক হলেও প্রেম ফিরে পান। পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আহা খেপছ কেন? বছরের এই একটি বার!’ দরজিরা শেষ মুহূর্তের খদ্দেরকে বলছেন, ‘এতদিন কি ঘুমোচ্ছিলেন স্যার। রেখে দিন দেওয়ালির সময় পরবেন।’ সারারাত কল চলছে দরজির দোকানে। তলায় এক সার, দোতলার মাচায় আর এক সার। মাঝরাতের রেডিয়োয় দূরের কোনও স্টেশানের মিঠে গজল। দরজিদের অনেকেই ভিন্ন ধর্মের; কিন্তু এই তো সময়! পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার দেবী এসেছেন সপরিবারে। তাঁর অন্য শক্তির পরিচয় না পেলেও তাঁর কন্যা লক্ষ্মী এই সময় অভাজনদের কিছু দিয়ে যান। দেবী নিজেই বুঝে গেছেন অসুরনিধন সম্ভব নয়। রক্তবীজের ঝাড়। প্রেম যুগে যুগের মতো অসুর যুগে-যুগে। পুজোর প্রধান দিক হল গণেশ আর লক্ষ্মীর আঁতাত। শহরের পথেঘাটে যান-চলাচল এক মাস আগেই বেড়ে যায়। রাজপথের প্রেম চোপড়া হল লরি। সেই লরির সংখ্যা বেড়ে যাবে চর্তুগুণ। রাস্তায় তাদের দেয়লা। ভিনপ্রদেশের মাল ঢুকছে পুজোর বাজার ক্যাপচার করতে। মসলিন থেকে মোরোব্বা সবই আসছে। নামকরা মার্কেটে মাছির মতো মানুষের গিজিমিজি। গায়ে গায়ে, পায়ে পায়ে গুঁতোগুঁতি। বোতল পানি, টিকলি রোল খুব উড়বে। পকেট-কাটা যন্ত্র নিয়ে ভারলাঘবকারী কারিগররা পাশে-পাশে ঘুরবে। নন্দিনীর মাথা ধরবে, শ্যামলের অ্যাসিড। পুজোর আগে বন্যা আসবে। পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিগবাজি খাবে। ঘনঘন লোডশেডিং। বোনাসের কাজিয়া। স্পেশ্যাল ট্রেন, টিকিটের জন্যে লাঠালাঠি। বাঙালি ব্যায়ামবীরের দাপাদাপি। এক ধরনের মত্ততা। কলকাতার তিনশোর স্মরণীয় অবদান জঞ্জালের ভ্যাট। যত্রতত্র অবস্থান। ফুরফুরে সুবাস। রাস্তায় গর্তের সুন্দরী টোল। পথ-বিপণির আড়ালে সুদৃশ্য দোকান। সেকালের রাজারা অশ্বমেধ করতেন। ছেড়ে দিতেন অশ্বমেধের ঘোড়া। হিম্মত থাকে আটকাও। এই অশ্বমেধের ঘোড়া চাঁদা পার্টি। মহল্লা দাপিয়ে ঘুরবে। তেড়ে যাবে রাজপথে। গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়। প্রতিবাদে পটল তোলার ব্যবস্থা। প্রশাসনের একটাই পয়েন্ট—জুলুম হলে জানান। জানাতে হবে। তাঁরা নিজেরা জানবেন না। জানালেই জান যাবে।

ছোট বাজেট, বড় বাজেট। সবরকম বাজেটেই পুজো হবে। পুজোটা উপলক্ষ মাত্র। আসলে মাতন। আচার, অনুষ্ঠান কড়া নিয়মে মানা হয় না। দেবী রুষ্ট হবেন, এমন ভীতিও নেই। সন্তুষ্ট হলেই বা তিনি করবেনটা কি? টাকার দাম বাড়াতে পারবেন? জিনিসের দাম কমাতে পারবেন? ভারতের টুকরো হওয়ার প্রবণতাকে কাবু করতে পারবেন? পারবেন স্বার্থান্বেষী শক্তিকে কাহিল করতে? নেতাদের দস্যুপনা ও মাস্তানদের মাস্তানী বন্ধ করার ক্ষমতা আছে তাঁর? নেই। তাহলে এসো মা, ফিল্মিগানের সঙ্গে ট্যাঙ্গো নাচো, দেখাও তোমার ব্রেক ড্যান্স। আমাদের অকৃত্রিম সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তা হল ওই ধুনুচি নৃত্য। কোনও কোনও প্যাভিলিয়নে হবে। একদল ঢাকি প্রথামতো আসবেন। বাজাবার অবকাশ নেই। বসে-বসে ঢুলবেন। কোনও এক কর্মকর্তা হঠাৎ মনে করবেন, বসে-বসে পয়সা নেবে? অ্যায়, বাজাও, বাজাও। কাহিল বাদক ঢাকে বোল তুলবেন, ট্যাংটা টাটা, ট্যাংটা টাটা, ল্যাংটা করে ছাড়লি মা। নড়তে চড়তে বড়ই কষ্ট, অনাহারেই থাকি মা। উত্তেজিত হয়ে আসরে নেমে এলেন হাবুল দাস। যাবতীয় ফিল্মি নৃত্য পাঞ্চ করে শুরু হবে তাঁর ধুনুচি নৃত্য। ডেয়ো পিঁপড়ের মতো নিতম্ব-নর্তন। গানও চলবে। ইলু, ইলু। গানেতে, ঢাকেতে, চণ্ডীর সশ্লোকের ফোড়নে, রবীন্দ্রসংগীতের প্রলেপে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। গ্রেট কালচার কম্পাউন্ড। সেকালের ডাক্তারের লাল-নীল মিকশ্চারের চেয়েও জটিল। ভাবনা-চিন্তার পক্ষাঘাত। শুধু অ্যাকশান।

কট্টর ধর্ম এর কোথাও নেই। একটা প্রথা। বাড়তে-বাড়তে, পল্লবিত হতে-হতে বিশাল এক জাতীয় উৎসব। দুর্গাপুজা না বলে দুর্গা-নাইট বললেও আপত্তি নেই। পাড়াগাঁর পুজো যেমন তেমন, রিয়েল পুজো ক্যালকাটায়। পাড়ার প্রাচীন বারোয়ারির শ্যাওলা-ধরা বিষণ্ণ চেহারা। খোলা জায়গাজমি মানুষের বসবাস দখল করে নিয়েছে। চাঁদা তোলার কর্মীর অভাব। যাঁরা শের-এ-হিন্দ, কোপ-এক্সপার্ট, তাঁদের ফেবারিট মা কালী। খোলা নর্দমার ধারে কাঠের পাঠাতন। তার ওপর সপরিবারে মা দুর্গা সমাসীন। সামনে একটি পুঁচকে ঘট। ছড়ানো ছেটানো কিছু ফুল, বেলপাতা। মাটির পিলসুজে মাটির প্রদীপ কখন নিবে গেছে। ধূপ-ধুনোর সুবাস নয়, খোলা নর্দমার পচা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। গণেশের ইঁদুর জ্যান্ত হয়ে মায়ের চাঁদমালা ধরে টানাটানি করছে। মাঝরাতের আলোর বৃত্তে পাক খাচ্ছে কয়েকটা পোকা। ঝাঁক-ঝাঁক মশা সাপোর্টার খুঁজছে। একপাশে একটা নেড়ি হতাশ হয়ে শুয়ে আছে। মায়ের পাটাতনের তলা থেকে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা এক পাগল হ্যাহ্যা করে বেরিয়ে এল, হাতে একটা মালসা। গেয়ে উঠল গান শ্মশানে জাগিছে জননী, সন্তানে দিতে কোল। পুজোর কেনাবেচায় পাড়ার দোকান যেমন মার খায়, সেইরকম মার খায় পাড়ার পুজো। কোনও গ্ল্যামার নেই। বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা আসেন ঠুকঠুক করে। প্রণাম ঠুকে প্রার্থনা জানান, কবে নেবে মা। আজকাল আবার হাউসিং এস্টেট হয়েছে। সেখানে একটা কেন, একাধিক পুজো হতে পারে। দেবী দুর্গা আবার দলাদলির প্রিজাইডিং ডিটি। কর্মকর্তারা উদ্বোধনের জন্যে সাহিত্যিক ধরতে বেরোবেন। সংবর্ধনায় টোপ ফেলবেন। রেডিমেড মানপত্র গেঁঠে লাঠি-জড়ানো কিনতেই পাওয়া যায়। তার ওপর স্তুতিকর্ম করে সাহিত্যের অপকর্মকারীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। একটা মালা, টিনের ট্রে, একগজ ব্যান্ডেজ অর্থাৎ উত্তরীয়, ছোট্ট একটা নারকোল, এক বাক্স মেঠাই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো হবেই। মায়েদের প্রবল উৎসাহে প্রথম শিক্ষার্থিনী গলা সাধবে। আবৃত্তি ইদানীং উচ্চ সংস্কৃতির ধূপের ধোঁয়া প্রগতিশীল কবিতায় মানুষের সংগ্রামের যন্ত্রণা। আবৃত্তিকারীর মুখচোখ দুমড়ে মুচড়ে কবিতার চেয়েও কষ্ট দেবে শ্রোতাদের। কিশোর কণ্ঠ, লতাকণ্ঠী, মুকেশ, রফির প্রেতস্বরের অধিকারীরা রাতের ঘুম কেড়ে নেবেন। দেবী আমাদের কন্যা উমা। ঢাল, তরোয়াল, সিংহসামন্ত, দেবী পুরাণ এই সব বুঝি না আমরা। ‘এসেছে শরৎ’ গেয়ে আগমনী জানাও আবাহন গিরিদুহিতাকে। প্রকৃতি পলাতক। শিশির, শেফালির বিলাসিতা প্রশ্রয় দেবে না যান্ত্রিক সভ্যতা, চড়া আলো, কড়া গান, এলোমেলো চলন-বলন, কয়েকদিনের আত্মীয়-স্বজনের মিলন। রেষারেষি, কাজিয়া, ঝগড়া, তাজিয়া তোলা থাক কয়েক দিবস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *