কুকুর শেয়াল
এক-একটি রোগের যেমন এক-একরকম লক্ষণ আছে। সেইরকম বড়লোক হওয়ারও লক্ষণ আছে। মানুষ যখন হঠাৎ বড়লোক হয়, তখন বোঝা যায় লোকটির পয়সা হয়েছে। আমি আমার পরম রসিক ঠাকুর রামকৃষ্ণের উদ্ধৃতি না দিয়ে থাকতে পারছি না। কী সাংঘাতিক ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও রসবোধ। তিনি একদিন ভক্তদের কথায়-কথায় বলছেন, এক-একটি উপাধি হয় আর জীবের স্বভাব বদলে যায়। যে কালাপেড়ে কাপড় পরে আছে অমনি দেখবে তার নিধুর টপ্পার তান এসে জোটে, আর তাসখেলা, বেড়াতে যাওয়ার সময় হাতে ছড়ি। এই সব এসে জোটে। রোগা লোকও যদি বুট জুতো পরে সে অমনি শিস দিতে আরম্ভ করে । সিঁড়ি ওঠবার সময় সাহেবদের মতো লাফিয়ে উঠতে থাকে। মানুষের হাতে যদি কলম থাকে, এমনি কলমের গুণ যে সে অমনি একটা কাগজটাগজ পেলেই তার ওপর ফ্যাসফ্যাস করে টান দিতে থাকবে।
টাকাও একটি বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হলেই মানুষ আর-একরকম হয়ে যায়, সে মানুষ থাকে না।
এখানে একজন ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বাহিরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে আমরা কোন্নগরে গেছলুম। হৃদে সঙ্গে ছিল। নৌকা থেকে যেই নামছি, দেখি সেই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে বসে আছে। বোধহয় হাওয়া খাচ্ছিল। আমাদের দেখে বলছে, কী ঠাকুর। বলি—আছ কেমন? তার কথার স্বর শুনে আমি হৃদেকে বললুম, ওরে হৃদে। এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা। হৃদে হাসতে লাগল।
একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিছিল। তখন ব্যাংটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে আমায় ডিঙিয়ে যাস। টাকার এত অহঙ্কার!
আমার পাড়ার এক ভদ্রলোকের হঠাৎ খুব পয়সা হল। প্রথমেই পালটে গেল তার হাঁটার ধরন। বুক চিতিয়ে ঘাড় শক্ত করে, হাত মুঠো করে যেন মার্চ করছেন। সিলভার টনিকের কী গুণ! পরিচিত কাউকে দেখলেই বলেন, এই যে। এর বেশি আর কথা খরচ করেন না। দেখতে-দেখতে চেহারায় একটা চেকনাই এল। পেটটা হয়ে গেল বড়। পেটের সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞানও খুব বেড়ে গেল। সর্ব বিষয়ে জ্ঞান। ক্রিকেটর জ্ঞান, ফুটবলের জ্ঞান, রাজনীতির জ্ঞান, কূটনীতির জ্ঞান। জ্ঞানের একেবারে মহাসিন্ধু। সিন্দুকও বলা যেতে পারে।
আমি ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে দীর্ঘকাল গৃহশিক্ষক ছিলাম। তাঁর একমাত্র কন্যাটিকে পড়াবার সৌভাগ্য হয়েছিল। যখন আমাদের মতোই মধ্যবিত্ত ছিলেন, তখন বাড়ির পরিবেশ ছিল শান্ত। মেয়েটি মন দিয়ে লেখাপড়া করত। পয়সা হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটি ক্রমশই আদুরি হতে লাগল। পড়াবার সময় কেবলই কানে হাত দিয়ে দুল ঠিক করে, চুলগুলোকে টেনে এনে কখনও কপালে ফেলে, কখনও আবার কপাল থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। থেকে থেকে উঠে গিয়ে আয়নায় মুখ দেখে আসে। এরপর মাথায় চাপল ইলেকট্রনিকসের ভূত। সে আর অন্য কথা বলেই না। তার মাথায় কেবল, ভি. সি. আর, আকাই স্টিরিও সিস্টেম, কালার টিভি, রিমোট কন্ট্রোল। পড়ার টেবিলে ভিডিয়ো ফিল্ম গাইড। পাঁজা পাঁজা ইংরেজি গানের রেকর্ড চলে এল। অষ্টপ্রহণ ঢিসুম ঢিসুম শব্দে তিষ্ঠানো দায়। আমি পড়াব কী? শেষে সেই আমাকে পড়িয়ে দেয়। শেখাতে থাকে বিলিতি সেন্টের নাম। স্টিরিয়োর কারিকুরি। ভি. সি. আর.-এর কেরামতি। আমি গোলা লোক, হাঁ করে শুনি আর ঢোঁক গিলি। ভদ্রলোক আগে মাস্টারমশাই বলে সম্বোধন করতেন, এখন মশাই বাদ চলে গেছে। মাঝেমধ্যে মুখোমুখি হয়ে গেলে বলেন, এসো যে মাস্টার, কেমন হচ্ছে-টচ্ছে। আর এডুকেশানের তো বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিলেন মশাই। অতকালের ইউনিভারসিটি লাটে উঠে গেল?
ভদ্রলোক জীবনে ইউনিভারসিটির চৌহদ্দি মাড়াননি। ইউনিভারসিটির শোকে কাতর। এরপর তিনি সব ভুলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন একটা কুকুর কেনার জন্যে। কুকুর হল স্ট্যাটাস সিম্বল। আমাকে জিগ্যেস করলেন, মাস্টার, কী কুকুর কেনা যায়? গ্রেট ডেন? পেরিয়ার সাউন্ট? ডোবারম্যান? গোল্ডেন রিট্রিভার? আইরিশ সেটার? পোমেরেরিয়ান? আমি পমেটমের নাম শুনেছি। ছেলেবেলায় বড়লোকদের মাথায় মাখতে দেখেছি। পোমেরেরিয়ান কি রে বাবা। বললুম, আমার জ্ঞান নেড়িকুকুর পর্যন্ত। বিলিতি কুকুরের কি বুঝি, বলুন?
কুকুর এসে গেল। এতটুকু একটা কেলে মতো বাচ্ছা। ছুঁচলো মুক। গায়ে বুরুশের মতো লোম। কুকুর এল। বিছানা এল। কুকুরের ডাক্তার এল। হরেক রকম ওষুধ এল। ছানা এল। কিমা এল। কলা এল। সোয়াবিন এল। মানে সে এক এলাহি ব্যাপার। কুকুর সর্বক্ষণ কাঁউকাঁউ করে চিবোবে বলে সলিড রবারের হাড় এল। কুকুরের পেছনেই ডেলি একশো টাকা। আর আমার মাইনেও একশো টাকা।
শেষে যা হল, কুকুরের বয়েস তিনমাস হয়ে গেল। তবু ডাকে না কেন? কে বললেন, একস্পার্ট ডাকুন, স্পিচ থেরাপির প্রয়োজন। ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, মাস্টার কুকুরও বোবা হয়।
এইবার সেই ঘটনাটি ঘটল, একদিন সন্ধের মুখে কুকুর আকাশের দিকে মুখ তুলে কচিকচি গলায় ডেকে উঠল, হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, কেয়া হুয়া। বাড়িতে শোরগোল, পেডিগ্রিড অ্যালসেশিয়ান ডেকেছে। বাড়ির রাঁধুনি গ্রামের মেয়ে। সে বললে, ‘এ কী! এ তো শেয়ালের ডাক। সর্বনাশ হয়ে গেল, তিন হাজার টাকায় ভদ্রলোককে গছিয়ে গেছে একটি খ্যাঁক শেয়ালের বাচ্চা।