1 of 2

পুজোসংখ্যা

পুজোসংখ্যা

১৪০৭-এর পুজোর আগে

বাবু ফোন।

কে করেছেন?

বলছেন, বৈদ্যনাথবাবু!

বাঁটু বলল।

কোন বৈদ্যনাথবাবু?

বাঁটু বলাবাহুল্য নিরুত্তর রইল।

সে এ-বাড়িতে খুব বেশিদিন হল বহাল হয়নি। তবু গৃহস্বামীর ব্যাখ্যাহীন স্বভাবের সঙ্গে ভালোরকমই পরিচিত হয়েছে। কোন বৈদ্যনাথবাবু ফোন করেছেন, তা তার আদৌ জানার কথা নয়, কিন্তু সেকথা তখন পতনবাবুকে বললে প্রলয় উপস্থিত হবে যে, একথা সে জানে। অতএব বাঁটু মুখ নীচু করে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মেঝেতে ঘষতে লাগল।

টেবিলের ওপর বাঁ-হাতটা একটি ছোটো বালিশের ওপরে রেখে, জীবনে কখনো টেনিসের র‌্যাকেট হাতে না ধরেও টেনিস খেলার রিস্ট-ব্যাণ্ড ডান হাতের কবজিতে পরে, এক মস্ত দৈনিক কাগজের মস্ত লেখক পতন সেন, নিবিষ্টমনে পুজোসংখ্যার লেখা লিখতে খুব ব্যস্ত থাকা অবস্থাতেই বললেন, ছেলে না মেয়ে? কে রে বাঁটু?

বাঁটু এবার একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, বৈদ্যনাথ যখন, তখন ছেলেই হবেন হয়তো।

তোর পাকামি করতে হবে না। সাহিত্যিকের বাড়ি কাজ করে নিজেই এখন সাহিত্যিক হয়ে গেছেন! কোন বৈদ্যনাথ জিজ্ঞেস কর। তপন ক্যাটারারের মালিক নন তো? হলে, বলে দে যে, বিয়ের তারিখ পিছিয়ে গেছে।

কার বিয়ে বাবু? দাদাবাবুর?

আঃ! আমার বন্ধুর মেয়ের। বলে দে, বৈদ্যনাথবাবুকে যে, পরে আমি নিজেই যোগাযোগ করব।

বাঁটু ফিরে গিয়ে আবার ঘুরে এল। বলল, কী একটা কাগজ থেকে ফোন করছেন।

তুই দিনকে দিন রামছাগল হচ্ছিস। কাগজের নামটা জিজ্ঞেস করে আয়। যা:। আমাকে বিরক্ত করিস না। আমি এখন লিখছি। লেখা যে কী কঠিন কাজ তা কি বুঝিস? নাকি চেষ্টা করলেও বুঝবি কখনো?

আমি কী করে বুঝব বাবু? আমি কি এম এ পাস দিয়েছি?

আরে ছাগল। এম এ পাস দিলে বৈয়াকরণ হওয়া যায়, ভাইস চ্যান্সেলর হওয়া যায়, লেখক হওয়া যায় না। বুঝেছিস?

হুঁ।

যা, যা বললাম, তাই গিয়ে বল। আমাকে বিরক্ত করিস না। আমার হার্পিস হয়েছে।

তার পর ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললেন, হার্পিস মানে জানিস?

না বাবু, হার্পিস মানে জানি না। তবে…

ইডিয়ট।

চলে গেল বটে কিন্তু একটু পরেই বাঁটু ফিরে এল, হাতে কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে। বলল, ভীষণ দরকার বললেন, তাই নিয়ে এনু।

এটা দিয়ে তোর মাথায় মেরে তোর মাথা ফাটাব। ইডিয়ট।

ফোনটা অন করা আছে।

বিরক্ত গলাতে বাঁটু বলল নৈর্ব্যক্তিকভাবে।

পতনবাবু কর্ডলেস ফোনটা হাতে নিয়ে বললেন, হ্যাল্লো।

ওদিক থেকে অতিবিনয়ী গলার স্বর ভেসে এল, আপনি পতনবাবু বলছেন?

আর কোন বাবু বলবেন? আপনি তাকেই তো চাইছেন? নাকি? যদি উত্থানবাবুকে চান, তাহলে ছেড়ে দিন।

আজ্ঞে না।

কী, আজ্ঞে না?

আজ্ঞে আমি বৈদ্যনাথবাবু বলছি, ‘পুজোর কাগজ’ থেকে। পতনবাবু, আমি জানি, এখন আপনার কী অবস্থা। কিন্তু আগামী সপ্তাহের মধ্যে লেখাটি না পেলে, আমার নতুন চাকরিটি যাবে।

তার আমি কী করব? আমি তো এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ খুলে বসিনি।

বলেই, পতনবাবু লাইটার ভেইন-এ বললেন, ওঃ বৈদ্যনাথবাবু। ওঃ আমার এই সেবকটিকে নিয়ে পারি না আর। বলছে, এই বৈদ্যনাথবাবু কি বৈদ্যনাথধামের বৈদ্যনাথবাবু?

যাকগে, বলুন বৈদ্যনাথবাবু।

আমি আর কী বলব? আপনি বলুন।

তার পর বললেন, বৈদ্যনাথধামের বৈদ্যনাথটি কে বলুন তো?

কে?

পতনবাবু বললেন, বিখ্যাত লেখক।

বৈদ্যনাথবাবু স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে গেলেন। আর কোনো মন্তব্য করলেন না। এখন লেখা পাওয়াই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনোভাবেই লেখককে চটানো চলবে না।

দেব। কথা যখন দিয়েছি তখন অবশ্যই দেব। আমার নিজের প্রাণ বিপন্ন। তবে মাথায় এলেই হয়ে যাবে। মাথাটার এখন এমনই অবস্থা যে, কিছু ভাববার অবস্থাই নেই। মাথা বলে যে কিছু ছিল তাই মনে পড়ছে না এখন।

তা ছাড়া, কাগজ নিয়েও তো চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে শুনলাম। আপনাদের সম্পাদক নাকি ইস্তফা দিয়েছেন?

বৈদ্যনাথবাবু মিনমিন করে বললেন, পতনবাবুকে খুশি করার জন্য।

তাতে কী? সম্পাদক মে কাম, সম্পাদক মে গো, বাট ‘পরিবেশ’ গোজ অন ফর এভার। আমাদের গোষ্ঠীর অনেকই কাগজ। একটা-দুটো ম্যাগাজিন উঠে গেলেও কিছুমাত্র যায় আসে না। তবে হ্যাঁ! আমার ওপরে কিছু দায়দায়িত্ব তো পড়েইছে। লেখার কাজ আর সম্পাদনার কাজ একসঙ্গে চালানো মুশকিল।

মুশকিল বলে মুশকিল! খুবই মুশকিল।

আপনার দায়দায়িত্বের কথা কি আর আমরা জানি না পতনবাবু? তবে আপনার তো অন্য কোথাও লেখার স্বাধীনতা নেই। এই ক্রীতদাসগিরির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন না কেন আপনারা?

হা:! বিদ্রোহ-বিপ্লব এসব হচ্ছে, হা-ভাতেদের জন্যে। নেই-বাবুদের জন্যে। আমাদের মালিকেরা যা-মাইনে দেন, আমাদের যা-স্ট্যাটাস তার কি কোনো তুলনা আছে? তার ওপরে মালিকেরা যাঁদের জিনিয়াস বলে মনে করেন, তাঁদের মানসম্মানের তো কথাই নেই।

যেমন আপনাকে করেন। হেঁ: হেঁ:।

বদ্যিনাথবাবু বললেন।

আমরা তো স্বাধীন পাখি, ইচ্ছে হলে অফিস যাই, ইচ্ছে না হলে যাই না। সর্দি হলে বেলভিউতে নিয়ে গিয়ে রাখেন। ঢাউস ঢাউস গাড়ি চাপতে দেন। পাড়ার লোকে ‘হাঁ’ করে চেয়ে থাকে। মেয়ের বিয়ের সময়ে মোটা খামে কড়কড়ে পাঁচ-শো টাকার নোটের বাণ্ডিল দেন।

তাও আমরা কোন দুঃখে দশটা কাগজে লিখে মরতে যাব! বিপ্লব-বিদ্রোহই বা করতে যাব কেন? ওঁরা একটা উপন্যাসে যে-টাকা দেন পুজোতে, অন্য পাঁচটা কাগজে লিখেও তা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, ক্ষমতা! রিভিউ-এর সুবিধা। অনুবাদের সুবিধা! প্রতিরাতে উঠতি-লেখক বা যশপ্রার্থীদের পয়সাতে মাল খাওয়া। বর্বরস্য ধনক্ষয় করা। হা:। হা:। আমাদের কাগজে কারো দুটি লেখা বেরোলেই তিনি আপসে লেখক হয়ে যান। তা তিনি ক্রিটিকই হোন কি, তিমিমাছ বিশেষজ্ঞ অথবা গণ্ডার-শিকারি। আমাদের কাগজ সাহিত্যিক কবি ছাড়াও, যে গায়ক বা গায়িকা-নৃত্যশিল্পী-চিত্রকরকে ব্যাক করেন তিনিই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। আমাদের মালিকদের মতো এমন সুপন্ডিত, মহান, সর্বজ্ঞ মানুষ আপনি সমসাময়িক বঙ্গভূমে আর কোথায় পাবেন মশায়? আপনাদের সম্পাদকদের মতো সম্পাদকও কি পাবেন?

তা অবশ্যই পাব না।

বদ্যিনাথবাবু বললেন।

মালিকেরা তো অর্থনীতি থেকে সমরনীতি, কুচিপুড়ি থেকে ভারতনাট্যম, পুরাতনি বাংলা গান থেকে জীবনমুখী গান, অয়েল-পেন্টিং থেকে টেম্পারা, কোলাজ থেকে ওয়াশ, ক্লাসিক্যাল থেকে রবীন্দ্রসংগীত সবই বোঝেন।

এবারের ‘পরিবেশ’-এর পুজোসংখ্যাতে, যে-উপন্যাসটি লিখলেন আপনি তার নাম কী ঠিক করেছেন পতনবাবু?

হ্যাঁ। ঠিক করব-না? উপন্যাস লিখতে হলে তিনটি জিনিস আগেই ঠিক করে নিতে হয়। তিনটি মোস্ট ভাইটাল ব্যাপার।

কী, কী, সেগুলি?

একনম্বর, উপন্যাসের নাম, দু-নম্বর, উপন্যাসের টেক-অফফ আর তিন নম্বর, উপন্যাসের ল্যাণ্ডিং।

এবছরের উপন্যাসের নাম কী দিলেন?

‘ও পাগল, ও ছাগল!’ ভালো হয়নি?

বদ্যিনাথবাবু বললেন, বা:!

মনে মনে বললেন, ছাগলে, ছাগলের কথা ভালো জানবে না তো কি বাঘে জানবে?

মুখে বললেন, কিন্তু পতনবাবু, আজকাল অনেকেই বলেন, আপনাদের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাড়া আর থাকেটা কী?

আরে মশাই! তবু তো লোকে পড়ে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে তো পড়েই যাচ্ছে—পি সি সরকারের ও-য়া-টার অফ ইণ্ডিয়ারই মতো, পড়ে যাচ্ছে নিরবধি। থামাথামি নেই। ‘অভ্যেস’ হয়ে গেছে পুরুষানুক্রমে। না পড়ে নিস্তার নেই। সকালে বাথরুম….

বৈদ্যনাথবাবু বললেন, তা ঠিক।

তার পর মনে মনে বললেন, পড়বেই তো। পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয়, ঊর্ধ্বলোকে কে আর কবে পড়েছে! তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’-এর সুশোভন মাতাল বলে যায়নি কি একথা?

বৈদ্যনাথবাবুর আবার বললেন, আপনাদের ‘পরিবেশ’ দৈনিক কাগজ সকালে না-পড়ে আগের রাতে টেলিফোন-মার্কা ইসবগুল খেলে নাকি অনেক বেশি এফেক্ট হয় শুনতে পাই। পয়সার সাশ্রয় হয়।

হা:, ওসব দুর্জনের আর অযোগ্যের ঈর্ষার কথা বদ্যিনাথবাবু। আমরা যা ছাপব বাঙালির বাপ তাই পড়বে। আমরা যা দাম ধার্য করব, বাঙালি চাঁদমুখ করে তাই কিনবে। দেখেন না, আমাদের মালিকেরা প্রতিবছর প্রত্যেকটি পুজোসংখ্যার দাম দশ টাকা করে বাড়িয়ে যাচ্ছেন তবু কাগজ ধাঁই ধাঁই করে বিক্রি হচ্ছে। কী আত্মবিশ্বাস! হা:!

কিন্তু নিন্দুকেরা যে বলেন, আপনারা শুধু বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্যেই বিশেষ সংখ্যাগুলি বের করেন। কাগজ ছাপেনও অন্য কাগজের তুলনাতে অনেক কম। এই করে বিজ্ঞাপনদাতাদের পকেট কাটেন। আর বোকা জনগণকে দেখান, কী ডিম্যাণ্ড, আপনাদের কাগজের। অচিরেই সব শেষ। আসলে, যা ছাপেন,তাই তো বিক্রি হয় না। হকারেরা হায়। হায়! করে প্রচুর ডিসকাউণ্ড দিয়েও, ফুটপাথে ডাঁই করে রেখেও, সব বেচে শেষ করতে পারে না। একথা আপনাদের মালিকেরা কি জানেন?

জানবেন না কেন?

নাও জানতে পারেন।

কেন একথা বলছেন?

বলছি, কারণ, তাঁরা তো কাচের ঘরে বাস করেন। তাঁদের চোখ আর কান তো তাঁদের নিজেদের নয়। কিছু অসৎ, কুচক্রী, দুষ্ট ও নষ্ট চরিত্রের মোসাহেব পরিবেষ্টিত হয়েই থাকেন তাঁরা। মোসাহেবরা চাঁদ দেখালেই চাঁদ দেখতে পান তাঁরা, চন্দ্রগ্রহণ দেখালেই গ্রহণ দেখেন। আপনাদের মালিকেরা তাঁদের পকেটে টাকা এলেই খুশি। তাঁদের সম্বন্ধে শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন বাঙালিরা কী ধারণা পোষণ করেন তা কি তাঁরা জানেন? বা কখনো জানতে চান? ‘আপন গন্ধে ফিরি বনে বনে কস্তুরী মৃগসম’ হয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়ান। যাঁরা অন্ধ ও কালা তাঁদের হস্তীদর্শন ওইরকমই হয়। তাঁরা সত্যি কথা জানার জন্যে একটি মার্কেট সার্ভেও তো করালে পারেন,সত্যিই স্বাধীন এজেন্সি দিয়ে। তাঁদের কাগজের পোষা কুকুর-বেড়াল লেখকদের জনপ্রিয়তা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু আর বাইরের লেখকদের কতটুকু তাও তো তাঁরা জানতে চাইলে জানতে পারেন।

বা: বদ্যিনাথবাবু, আপনার লেখা বুঝি ‘পরিবেশ’ ছাপেনি? তাই কি এত রাগ?

আমি কখনো সেখানে লেখা পাঠাইনি। যাকগে, আমার ওসবের দরকার কী? আপনার লেখাটা কবে পাব তাই বলুন।

আমার কাগজ সম্বন্ধে এতক্ষণ অনেকই যা-তা বললেন, তা, আমার লেখাটা আপনার কাগজে না ছাপলে কী হয়?

আসলে হয় না কিছুই। লেখা যা লিখবেন তা তো জানাই, আমাদের আসলে আপনার নামটা দরকার। বাঙালি তো লেখা পড়ে না, নাম পড়ে। তাই দরকার।

তার পর বললেন, আমার নিজের কিছুই হয় না। তবে মালিকে মালিকে তো বিশেষ তফাত নেই, থাকেও না। লেখা না পেলে, আমার মালিকের রাগ হবে। পতনবাবু, আপনারা কে কত বড়ো লেখক, তার বিচার করবে বাঙালি-পাঠক। অবশ্যই করবে একদিন। আজ আর কাল। কিন্তু আপনাদের নামগুলো মোটামোটা অক্ষরে বিজ্ঞাপনে বছরের পর বছর ছেপেই তো আপনাদের ‘লেখক’ করেছে ‘পরিবেশ’। যেমন, আপনাদের মালিকেরা বোদ্ধা, তেমনিই বোদ্ধা জনসাধারণের একাংশ। জনসাধারণের যে-অংশ ছাপার অক্ষরে যাই ছেপে বেরোয় তাই ধ্রবসত্য বলে মেনে নেয়, তারাই আপনাদের গোষ্ঠীতে যাঁরাই লেখেন তাঁদেরই ‘মস্ত লেখক’ বলে মেনে নেয়। নিজেদের বিচারক্ষমতা থাকলে কেউ কি বিজ্ঞাপনকে ধ্রবতারা করে?

না বদ্যিনাথবাবু, আমার মেজাজ খারাপ করে দিলেন আপনি। আপনাকে আমি এ বছর লেখা দেব না।

ছি:। ছি:। আমি তো দূতমাত্র। আমার ওপরে রাগ করা, বাংলা সাহিত্যজগতে আপনার মতো একজন মহারথীর কি সাজে? আসলে বুঝতে পারি যে টেলিফোনে-টেলিফোনে আপনি বিব্রত হয়ে রয়েছেন। একটা আনসারিং মেশিন লাগান নইলে বউদিকে বলুন-না, ফোনগুলো উনিই ধরবেন।

আরে। তিনি বাড়ি থাকলে আর অসুবিধার কী ছিল? তিনি তো গেছেন আমার শালির বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজোতে।

কোথায়?

ডিহি-শ্রীরামপুরে।

পতনবাবু, আপনি তো ধর্ম অথবা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তবে বউদি যে….

তাতে কী?

জ্যোতিবাবুর স্ত্রী কি তাঁর ছোটোবোনের বাড়িতে কালীপুজো করেন না, প্রতিবছর? সকলের মানসিকতা তো একরকম হয় না। তা ছাড়া এসব ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন। আমি আর আমার স্ত্রী তো একই ব্যক্তি নই। আমার স্ত্রী নীলের উপোস করেন, ‘পুণ্যিপুকুর’ ব্রত।

তা আপনার পুত্রও তো এই দুটো মাস ফোনটা ধরতে পারেন।

আরে বদ্যিনাথবাবু। আপনি কি আমার জ্যাঠামশাই না লোকাল গার্জেন। কী করব না করব, সবই আপনি বলে দেবেন? আপনি দেখছি কোনো খবরই রাখেন না। সে তো জাপানেই সেটল করেছে। জাপানি বউ। ‘মিৎসুবিশি’তে কাজ করে।

তবে আর এত খাটেন কেন? টাকার তো দরকার নেই আপনার। ‘পরিবেশ’ থেকে যা-মাইনে পান তাই তো প্রচুর আপনাদের পক্ষে।

হা:। মানুষ কি টাকার জন্যে কাজ করে বলে ধারণা আপনার? মানুষ কাজ করে,কাজের নেশাতে। একটু মাছ ধরার নেশা ছিল তাও ছেড়ে দিতে হল, ওই লেখার নেশার জন্য।

আমার লেখাটা পতনবাবু। লেখাটার কী হবে? প্লিজ আমাকে দয়া করুন।

পরের হপ্তাতে একটা ফোন করুন।

পরের হপ্তাতে পাব তো?

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা অবশ্যই করব।

বদ্যিনাথবাবু ফোন ছেড়ে দিতেই পতনবাবু হাঁক দিলেন, বাঁটু—! এই কর্ডলেসটা নিয়ে গিয়ে ক্র্যাডল-এ রাখ। তার পর স্বগতোক্তি করলেন, বড়ো বাড় বেড়েছে শালার। ছোটো মুখে বড়ো কথা। ‘পরিবেশ’-এর সমালোচনা করে। ঘাড়ে ক-টা মাথা! দেব না লেখা আমি। পরের হপ্তাতে ফোন করলে বলে দিবি যে, লেখা দিতে পারব না। বুঝলি?

হ্যাঁ বাবু।

১৪০৮-এর পুজোর আগে

বদ্যিনাথবাবু আছেন কি? এটা কি ‘পুজোর কাগজ’-এর অফিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কে বলছেন?

আপনি কে?

আমি তপন।

তপন কে?

আপনি আমাকে চিনবেন না।

পতনবাবু ভাবলেন, আশ্চর্য! পতনকে সকলেই চেনে আর তপনকে কেউই চেনে না।

বদ্যিনাথবাবু আছেন কি?

আছেন। কিন্তু তিনি একটু প্রেসে গেছেন নীচে। পুজোর সংখ্যার পাতা ছাড়া শুরু হয়ে গেছে তো।

একটু ডেকে দেওয়া যাবে-না?

অসম্ভব।

কর্ডলেস ফোন নেই?

আছে। কিন্তু প্রেসে নিয়ে যাওয়ার অর্ডার নেই।

বদ্যিনাথবাবুর মোবাইল ফোন নেই?

আছে। কিন্তু নাম্বর দেওয়া বারণ আছে। আপনি কে বলছেন?

গলায় গুরুগাম্ভীর্য এনে অথরিটির সঙ্গে বললেন পতনবাবু, আমি পতন সেন বলছি।

কোন পতন সেন?

ক-টা পতন সেন আছে কলকাতায়? আপনি কে বলছেন?

আজ্ঞে আমি এখানে পুল-টুল কারেক্ট করি।

লেখার পুল?

হ্যাঁ।

সাহিত্য সম্পর্কিত পুল?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রিসিভার থেকে মুখটা একটু সরিয়ে প্রুফ রিডার তপনবাবু বললেন, কে রে বাবা! ফৌজদারি উকিলের মতো জেরা করছে!

সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন আর পতন সেন-এর নাম শোনেননি? পতনবাবু অত্যন্ত উষ্মার সঙ্গে বললেন।

না, মানে ও। আপনি কি ‘পরিবেশ’-এ, গল্প উপন্যাস লিখতেন?

এবারের পতন সেনের গলাতে পুরো আত্মপ্রত্যয় ফিরে এল। বললেন, তাই বলুন।

বলেই, একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট না ধরালে কনফিডেন্স পান না। ‘যাক’।

বললেন, ভাগ্যিস নামটা চিনতে পারলেন। তা, বদ্যিনাথবাবুকে একটু খবর কি দেওয়া যায় না, এখন তো আপনি আমার পুরো পরিচয় জানলেন।

একটু ধরে থাকুন তাহলে।

বেশ।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তপন ফিরে এসে বললেন, পতনবাবু, বদ্যিনাথবাবু ভীষণইব্যস্ত আছেন এবং ব্যস্ত থাকবেন আজকে সারাটা দিন। ফর্মা ছাড়ছেন উনি। আগামীকাল তো পনেরোই আগস্ট। পরশু আপনি ফোন করতে পারেন বারোটার পরে।

বাড়ির নাম্বরটা কি দেবেন? মানে, ফোন নাম্বার? আগামীকাল তাহলে কথা বলে নিতাম।

ওঁর বাড়ির নাম্বার দেওয়া মানা। উনি নিজেও তো একটু-আধটু লেখালেখি করেন, আর ছুটির দিন সময়ও তেমন পান না। তাই নাম্বার দেওয়া মানা। উনি তো এবারে উপন্যাস লিখছেন পুজোতে।

‘পুজোর কাগজ’-এ?

হ্যাঁ।

এই একবছরে ‘পুজোর কাগজ’-এর সার্কুলেশন অনেকই বেড়েছে। লোকে ভালোবেসে পড়েছে।

তপন নামক অচেনা মানুষটিকে খুশি করার জন্যে বললেন পতনবাবু।

ঠিক আছে।

বলেই, পতনবাবুর সার্টিফিকেট সিল করে দিলেন তপনবাবু।

ষোলোই আগস্ট বারোটার পরে পতনবাবু ফোন করলেন বদ্যিনাথবাবুকে ‘পুজোর কাগজ’-এর অফিসে।

হ্যালো।

বদ্যিনাথবাবু?

কথা বলছি।

বলছেন? আমি পতন, পতন সেন।

হ্যাঁ। বলুন পতনবাবু।

ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বদ্যিনাথবাবু। পরশু তো আপনি ফোন করেছিলেন, না? ব্যস্ত ছিলাম খুব। মনে করেননি তো কিছু?

না না, আমি নিজেও তো কাগজ চালিয়েছি একসময়। ব্যস্ততার রকম আমি জানি।

কেন ফোন করেছিলেন বলুন পতনবাবু।

এবারে তো লেখা চাইলেন না আপনি।

ওসব তো ঠিক করেন আমাদের মালিকপক্ষ। এবারের পুজোর লেখকদের তালিকা গতপুজোর পরেই ঠিক হয়ে গেছিল। তা ছাড়া আপনার কাছ থেকে তো গল্পই চাইতেন ওঁরা প্রত্যেকবার। গতবার তো আপনি শেষপর্যন্ত দিলেন না। খুব বিপদেই পড়েছিলাম আমরা। হয়তো তাই-ই ওরা এবারে চায়নি।

আপনি নাকি উপন্যাস লিখছেন এবারে?

তাই তো কথা আছে। আমি আবার লেখক! চাকরি করি, তাই আজ্ঞা হলে আজ্ঞা পালন করতে হয়ই।

‘পুজোর কাগজ’, ‘পরিবেশ’-এর মতো বড়ো কাগজ নয়। অতিছোটো কাগজ। তবে এবার তো শুনছি কুড়ি হাজার দেবে।

কুড়ি হাজার! বলেন কী?

হ্যাঁ। গতবারে পনেরো ছিল। এঁরা সাহিত্যিকদের প্রকৃতই সম্মান করেন। উপন্যাসকে ‘মোটা মাল’ বলেন না।

‘পরিবেশ’ কত দিত আপনাদের?

পঁচিশ। বহুদিন হল একই রেট।

পতনবাবু বললেন।

‘দিনকাল’ শুনছি ত্রিশ দিচ্ছে কাউকে কাউকে।

হতে পারে। তবে ‘পরিবেশ’ ইচ্ছে করলে একলাখও দিতে পারে। দেওয়াই তো উচিত। কারণ, ‘পরিবেশ’ যাঁকে লিখতে বলে সুধন্য করে তিনি তো অন্যত্র লিখতে পারেন না। TABOO! কেন লিখতে দেয় না, তা তাঁরাই জানে। একলাখ করে দিয়ে তার পর অন্য কোনো কাগজে না লেখার ফতোয়া জারি করলে তাও মানে হয় একটা। তবে, মনে হয়, একথা ‘পরিবেশ’-এর মালিকেরা বলেন, ‘বেশি লিখলে লেখা খারাপ হয়ে যায়। কম লিখুন লেখকেরা, বহুত ভালো লিখুন। তাঁদের ধারণা এমনই যে, টাকার অঙ্ক বা উপন্যাসের সংখ্যাই যেন, লেখার প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক বা নিয়ামক।

তার পর বদ্যিনাথ বললেন, ‘পরিবেশ’-এ একলাইন না লিখেও তো দরবেশ ঘোষরায় সব মিলিয়ে লক্ষাধিক টাকা পান পুজোর সময়।

পতনবাবু বললেন, তাই? দরবেশ এত পায়?

পাবেন না কেন? উনি তো সত্যিই জনপ্রিয়। কোনো বড়ো গোষ্ঠীর চাপরাশ ছাড়াই উনি জনপ্রিয়। সেটা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে। পুজোসংখ্যাতে লেখার আয় তো বড়ো কথা নয়, ওঁকে ওর প্রকাশকেরা তো প্রতিমাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা On Account Royalty দেন।

তার পর বললেন, আপনি লিখছেন না, এবারের ‘পরিবেশ’-এ?

না।

লিখতে বলেনি। তা ছাড়া,আমি তো রিটায়ারও করেছি।

সে কী? গোবিন্দবাবু, নরেশবাবু এঁরাও তো রিটায়ার করেছেন বহু দিন আগে কিন্তু এখনও তো এক্সটেনশনেই আছেন। আপনাকে এক্সটেনশন দিল না? তা ছাড়া রিটায়ারমেন্ট-এর সঙ্গে লেখার কী সম্পর্ক? লেখকেরা কি ঘোড়ার জকি?

না:।

উষ্মার সঙ্গে বললেন, পতনবাবু।

তার পর বললেন, ওদের ইচ্ছা হলে দেন, নইলে দেন না, সবই ব্যক্তিগত মর্জি।

গতবারে ‘পরিবেশ’-এ আপনার লেখা উপন্যাস ‘ও পাগল! ও ছাগল!’ বই হয়ে বেরিয়েছে।

হ্যাঁ। তা বেরিয়েছে।

কারা বের করল?

রায়-ব্যানার্জি।

প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি?

আঃ। সে তো রায়-ত্রিবেদী। কী যা-তা বলেন।

সরি। মাথার ঠিক নেই আমার।

এডিশন হয়েছে? ‘ও পাগল! ও ছাগল’-এর?

একবছরেই? সবে তো বইমেলাতে বেরোল।

দরবেশবাবুর তো হয়। একবছরে, হাজার আড়াই-তিন তো বিক্রি হয়ই। প্রায় সব বই-ই।

বাজে কথা বলে দরবেশ। তা ছাড়া, বই বিক্রি কি লেখকের একমাত্র মাপ? পঞ্জিকাও তো বিক্রি হয়। ‘পরিবেশ’ গোষ্ঠীর বিকৃত রুচির রগরগে সব ম্যাগাজিনও। তাতে কী যায় আসে। সাহিত্য বোঝে ক-জন?

আমি ওর রয়্যালটি স্টেটমেন্ট দেখেছি। বদ্যিনাথবাবু বললেন। তারপর বললেন, দরবেশ OUTSPOKEN অবশ্যই, SHORT TEMPERED-ও বটে। কিন্তু অসৎ কখনো নয়। ওঁকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি।

ও নিজেই নিজের অনেক বই কেনে। সেলস ট্যাক্স-অফিসার তো।—অ্যাসেসিদের দিয়ে কেনায়।

তাই? জানতাম না তো একথা।

বদ্যিনাথবাবু বললেন কে জানে? এসব পরাভূতের ঈর্ষাও হতে পারে। তার পর বললেন, আপনি এবারে কোথায় কোথায় লিখলেন?

কোথাওই না।

ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলেরই জন্যে।

ড্যাম ইয়োর ঈশ্বর।

ও সরি। ভুলেই গেছিলাম যে ঈশ্বরে আপনার অ্যালার্জি। যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে। নিজের পছন্দসই একটি বড়ো বই লিখুন। সময় নিয়ে। যাকে বলে ইন ইয়োর ওন সুইট টাইম। এখন তো প্রকাশকদের কাছে শুনি যে, বড়ো বইয়েরই চাহিদা বেশি।

শোনেন? ‘মোটা মাল’ লিখতে বলছেন?

পতনবাবু বললেন।

না, তা নয়। ভালো জিনিস লিখতে বলছি। যা, পরে ক্লাসিক হবে। বইয়ের আয়তন দিয়ে বইয়ের ভালো তো কখনোই বিবেচিত হয়নি। অশিক্ষিত প্রকাশকেরা যাই বলুন না কেন।

তা একদিন আসুন-না পতনবাবু, আমার পুজোর ঝামেলা কাটলে। ফোনে কি আর গল্প হয়? ব্যস্তও আছি এই সময়ে। গল্প করা যাবে, তেলেভাজা মুড়ি খেতে খেতে।

কবে আসব?

সেপ্টেম্বরের পনেরো তারিখের পর। পুজোসংখ্যা বেরিয়ে যাক।

ও।

একটু চুপ করে থেকে মনমরা পতনবাবু বললেন, আপনার কাগজে ধারাবাহিকের সুযোগ কি আছে?

সেসবও মালিকপক্ষই ঠিক করেন। একদিন আসুন, মালিকদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। কথা বলিয়ে দেব।

না না, তার আর দরকার নেই। মালিকপক্ষ অনেক হয়েছে।

কেন কী হল? এত তিক্ততা কীসের? আপনাদের মালিকরা তো সব দেবতুল্য মানুষ। আপনার কাছেও তাই-ই শুনেছি।

মালিকেরা কর্মচারীদের চাকরবাকরই মনে করেন। সে চাকর সাহিত্যিকই হোন, কি কবি। বাইরে যে ছদ্ম-বিনয়টা দেখান তাঁরা, সেটাও অহমিকারই এক ধরনের প্রকাশ। ‘পরিবেশ’ কাগজে আত্মসম্মান নিয়ে, মাথা উঁচু করে, মানুষের মতো চাকরি করা যাবে না। যার ‘মেরুদন্ড’ আছে তার পক্ষে ওই বিকৃতরুচি, ভন্ড, দাম্ভিক,অর্থান্ধ ও ক্ষমতান্ধদের চাকরি করা সম্ভব নয়।

এত বছর পরে, এক্সটেনশন না-পাওয়াতেই কি এইরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল?

না না, তা বলছেন কেন? ভুল বুঝেছিলাম আগে।

তার পর আবার বললেন পতনবাবু, ক্যাপিটালিস্টদের মোডাস-অপারাণ্ডি কি জানেন?

কী?

আপনার যদি পাঁচ হাজারের যোগ্যতা থাকে,তাহলে আপনাকে কুড়ি হাজার দেবে। প্রতিবছর মাইনে, পার্কস সব বাড়াতে থাকবে। তার পর একসময়ে মাটিতে তাদের পায়ের কাছে থুথু ফেলে বলবে, ‘চাট শালা। থুতু চাট। আমরা বললে, সব বাঙালির বাপ থুথু চাটবে।’

একটু পরে চুপ করে থেকে অশ্রু-ভারাক্রান্ত গলাতে বললেন, বড়ো অপমানিত লেগেছে বদ্যিনাথবাবু। ওইরকম চাকরি করার চেয়ে, না খেয়ে থাকা ভালো।

বদ্যিনাথ বললেন, পতনবাবু, আপনি একজন লেখক। একথা ভুলে যাবেন না। যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন, মেকি সম্মান, মিথ্যে পুরস্কার, যে-অপমানের আপনি ভাগীদার হয়েছেন, তাই জারিত করে নিয়ে আপনি লিখুন। বাঙালির ভবিষ্যৎপ্রজন্মের জন্যে সত্যি কথা লেখা দরকার। Spade-কে Spade বলা দরকার। বাঙালি পাঠককে সাহিত্য ও সংবাদজগতের প্রকৃতস্বরূপ জানানো দরকার।

না না। ‘পরিবেশ’-এর মালিকেরা সব পারে। যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতাতে থাকবার জন্যে ওরা করতে পারে না, এমন কিছু নেই। সুস্থ প্রতিযোগিতাতে ওরা বিশ্বাস করেনি কোনোদিন। গুণ্ডা দিয়ে মারিয়ে দিতে পারে। মিথ্যে বদনাম রটাতে পারে। ওরা নিজেরা ক্ষমতাশীল থাকার জন্য করতে পারে না, এমন কাজ নেই। যেনতেনপ্রকারেণ ওরা ওপরে থাকবেই। ওরাই একা থাকবে। আর কেউই থাকবে না। এই ওদের Motto।

সে তো গেল ওদের কথা। আপনি যদি একজন লেখক হয়েও এই অন্যায় মেনে নেন, এতদিন মেনে নিলেন, তাহলে আপনিই বা কীসের লেখক? ‘পরিবেশ’ তাহলে এত বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে কোন ধরনের কবি-সাহিত্যিক তৈরি করে এল? অথচ তারাই শুনি বাংলা ও বাঙালির লোকাল গার্জেন।

পতনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বদ্যিনাথবাবু, ওরা চাকর তৈরিতে বড়োই দর। চাকর ছাড়া কিছুই তৈরি করতে পারেনি ‘পরিবেশ’ নামক কাগজটি এত বছরে। আমি লিখব, সত্যিই লিখব একটি বড়ো বই। তার নাম দেব ‘চাকর গড়ার কারিগর’। ওদের হাঁড়ির খবর আমার মতো বেশি মানুষে জানে না। মানুষকে জানানো দরকার।

ভারী, কম্পমান গলাতে কথা ক-টি বলেই টেলিফোন ডিসকানেক্ট করে দিলেন পতন সেন।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে অনেকক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বদ্যিনাথবাবু। ‘মুক্তধারা’র ধনঞ্জয় বৈরাগীর কথা মনে পড়ল ওর।

ওরে তোর শিকল আমায়বিকল করবে নাতোর মারে মরম মরবে না।

মনে পড়ল, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান?’

পটলাকে বললেন, এককাপ চা নিয়ে আসতে। পটলা বেরিয়ে গেলে, জানালা দিয়ে চেয়ে, অন্যমনস্কভাবে পাশের নিমগাছের ডালে বৃষ্টিতে-ভেজা কাকদের অস্ফুট গলার স্বর শুনছিলেন উনি।

বদ্যিনাথবাবুর মনে হল, পতনবাবু যা-বললেন এতক্ষণ তাতে হয়তো মস্ত একটা ফাঁক রয়ে গেছে। উনি পতন সেন অথবা ওঁদের সহকর্মীদের তরফের কথাই শুধু বলে গেলেন। যেসব কর্মচারী বহুদিন মালিকের বশংবদ হয়ে কামধেনুর মতো মালিককে দুইয়ে নেন এবং তাঁর ইচ্ছাপূরণে বাধা ঘটলেই মালিককে রাতারাতি জঞ্জালের পাত্রে নিক্ষেপ করেন, সেইসব কর্মচারীদের নিজেদের চরিত্রেও কম খাদ নেই। যাঁদের মেরুদন্ড বা চরিত্র থাকে না, তাঁদের তা প্রথম দিন থেকেই থাকে না। আর্থিক সাচ্ছল্যর সঙ্গে মেরুদন্ডের কোনো সাযুজ্য নেই, ছিল না। যাঁর মেরুদন্ড ছিল, তিনি কোনোরকম ভয়ের কাছেই কখনো মাথা নোয়াননি। অর্থ-কষ্টর ভয় তো অতিসামান্য ভয়। পৃথিবীতে নিজেই কোনো মানুষ মেরুদন্ড হারাতে না চাইলে অন্য কেউই কোনো মানুষের মেরুদন্ড কেড়ে নিতে পারে না বোধ হয়।—পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে।

বদ্যিনাথবাবু ভাবছিলেন, উনি যদি কখনো এইরকম,মানে, পতন সেন যেরকম বিষয় নিয়ে লিখবেন বলে ভাবছেন,তা নিয়ে লেখেন, তবে তার লেখাতে দু-পক্ষের মহত্ত্ব-নীচতার কথাই থাকবে। কারোকেই WALK-OVER দেবেন না উনি। ফুটবলের মাঠে WALK-OVER চলতে পারে কিন্তু সাহিত্যের মাঠে তা অবশ্যই অচল।

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’। —এই সত্যই চিরসত্য। অন্যায়কারীর যতটা অপরাধ, অন্যায় মান্যকারীরও ঠিক ততটুকুই অপরাধ, তার একটুও কম নয়।

তার পরে,না বলে, মনে মনে বললেন,আপনার জন্যে সত্যিই দুঃখবোধ করি পতনবাবু। কিন্তু কিছুমাত্রই করতে পারি না। আপনাদের মতো মানুষদের জন্য করাটা উচিতও নয়। কারণ, আপনারা মানুষই নন। আপনারা মালিকের LOGO এবং মালিকের LABEL-ই মাত্র। মালিকহীন আপনারা প্রকৃতই বেওয়ারিশ। আপনার মালিকেরা যেমন ভেজাল ঘি দিয়ে ভাজা, আপনারাও তেমনই।

একটা সময় আসছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে যখন ষাঁড়, আপনাদের এবং আপনাদের মালিকদেরও খাবে বড়োবাজারের ফুটপাথে ফেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *