পিন্টুর দাদু
পিন্টুর আপসোস এইখানেই। তার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই দাদু আছে, কিন্তু কই, তাদের কেউই তো তার নিজের দাদুর মতো নয়। রাজুর দাদুকে সে দেখেছে নিজে হাতে লাল আর বেগুনি কাগজের ফিতে পর পর জুড়ে রাজুর ঘুড়ির জন্য লম্বা ল্যাজ তৈরি করে দিতে। স্বপন আর সুদীপের দাদু—যাঁর টকটকে রং, গালভরা হাসি আর ধপ্ধপে সাদা দাড়িগোঁফ দেখলেই পিন্টুর ফাদার ক্রিসমাসের কথা মনে পড়ে যায়—তিনি কী দারুণ মজার মজার ছড়া লেখেন। একটা ছড়া স্বপনের কাছ থেকে শুনে শুনে পিন্টুর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল; এখনও বেশ কয়েক লাইন মনে আছে—
লন্ডন ম্যাড্রিড সানফ্রানসিস্কো
আকবর হুমায়ূন হর্ষ কণিষ্ক
অ্যান্ডিজ কিলিমাঞ্জারো ফুজিয়ামা
তেনজিং ন্যানসেন ভাস্কো-ডা-গামা
রিগা লিমা পেরু চিলি চুংকিং কঙ্গো
হ্যানিবল তুঘলক তৈমুরলঙ্গ…
কী মজার ছড়া!—এক লাইন ভূগোল, এক লাইন ইতিহাস। আর ছড়া যে শুধু লেখেন তা নয়; তাতে সুর দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে পাড়ার ছেলেদের ডেকে শোনান।
এ ছাড়া সন্তুর দাদু—যাঁকে দেখতে ঠিক হ-য-ব-র-ল-র উদোর মতো—তিনি মোমবাতির আলোয় দেয়ালে নিজের হাতে ছায়া ফেলে দারুণ শ্যাডোগ্রাফি দেখান; অতীনের দাদু ফাটাফাটি রকম ভাল শিকারের গল্প করেন; সুবুর দাদু সাবানজলে কী জানি একটা মিশিয়ে আশ্চর্য রকম মজবুত বুদবুদ তৈরি করেন। একবার তাঁর তৈরি একটা পাঁচ নম্বর ফুটবলের সাইজের বুদবুদকে পিন্টু সাতবার মাটিতে পড়ে লাফিয়ে তারপর ফাটতে দেখেছিল।
পিন্টু অনেকবার এইসব ভেবেছে, আর নিজের দাদুর সঙ্গে এদের দাদুর তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
একটা গালভরা নাম আছে অবিশ্যি পিন্টুর দাদুর—ত্রিদিবেন্দ্রনারায়ণ গুহ মজুমদার। নামের পর আবার অনেকগুলো ইংরিজি অক্ষর আর কমা-ফুলস্টপ। সেগুলো সব নাকি দাদুর পাওয়া ডিগ্রি। মা-বাবার কাছে পিন্টু শুনেছে যে দাদুর মতো বিদ্বান তোক শুধু বাঙলাদেশে কেন, ভারতবর্ষেই কম আছে। দাদু নাকি বারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। তাঁর পড়াশুনার জন্য বাড়ি থেকে প্রায় খরচই দিতে হয়নি, কারণ তাঁর মতো এত বৃত্তি নাকি খুব কম ছাত্ৰই পেয়েছে। তা ছাড়া সোনা রুপোর মেডেল যে কত আছে তার তো হিসেবই নেই। আর আছে নানান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া মানপত্র, যেগুলো দাদুর ঘরের দেয়ালের সব ফাঁক ভরিয়ে দিয়েছে। যদিও দাদু সব বিষয়েই পণ্ডিত, যে বিষয়টা তাঁর সবচেয়ে ভাল করে জানা, সেটাকে বলে দর্শন। এই দর্শন নিয়ে দাদুর লেখা একটি ইংরেজি বই বেরিয়েছে দু’বছর আগে। পিন্টু দেখেছে সেটায় ৭৭২ পৃষ্ঠা, আর তার দাম পঁয়ষট্টি টাকা।
কিন্তু এত জ্ঞান, এত বিদ্যা হলেই কি মানুষকে এত গোমড়া আর এত থমথমে হতে হবে? পিন্টুর বন্ধুদের মধ্যে তো এটা একটা ঠাট্টারই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। —‘হ্যাঁরে, আজ তোর দাদু হেসেছেন?’—এ প্রশ্নটা যে পিন্টুকে কতবার শুনতে হয়েছে! উত্তরে সে যদি হ্যাঁ বলে, তা হলে সেটা হবে মিথ্যে কথা; কারণ পিন্টুর এই আট বছরে এমন একটা দিনও মনে পড়ে না যেদিন সে দাদুকে হাসতে দেখেছে। তবে এও ঠিক, যে ধমক-ধামক করা বা গলা তুলে কথা বলা, এগুলোও দাদু বিশেষ করেন না। সেটার সুযোগও বাড়ির লোকে দেয় না, কারণ সবাই জানে যে দাদুর পান থেকে চুনটি খসলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। পিন্টু মার কাছে শুনেছে যে সে যখন জন্মায়নি তখন জগন্নাথ ধোপা একবার নাকি দাদুর পাঞ্জাবিতে ভুল করে বেশি মাড় দিয়ে ফেলেছিল। তাতে দাদু তাঁর কাঁঠাল কাঠের লাঠি দিয়ে প্রথম জগন্নাথকে পেটান, তারপর তার গাধাটাকে পেটান। গাধাটা কী দোষ করল সেটা আর কারুর জিগ্যেস করার সাহস হয়নি।
পিন্টু নিজে গত বছর বাড়ির বাইরের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলতে গিয়ে দাদুর ঘরের জানলার একটা কাচ ভেঙে দেয়। দাদু তখন সারাদিনের লেখাপড়ার কাজের পর বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে শবাসনে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই সময় গুলিটা কাচ ভেঙে ঘরের ভিতরে এসে পড়ে। দাদু গুলি হাতে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। পিন্টুর হাতেই ডাণ্ডা, তাই দাদুর বুঝতে বাকি থাকে না কার কীর্তি এই কাচ ভাঙা। দাদু চোখ রাঙাননি, ধমক দেননি, এমন কী একটি কথাও বলেননি পিন্টুকে।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলে পর মা পিন্টুকে ডেকে বললেন, ‘ডান্ডাটা দে। ওটা থাকবে দাদুর ঘরে। আর সাতদিন তোর সব খেলা বন্ধ।’
পিন্টুর চোখে জল এসে গিয়েছিল। সাতদিন খেলা বন্ধের চেয়েও বেশি আপসোস হয়েছিল ডান্ডা-গুলিটার জন্য। বিশেষ করে গুলিটা। শ্রীনিবাস কী সুন্দর করে দা দিয়ে ছুঁচোলো করে কেটে দিয়েছিল দুটো দিক। এত ভাল গুলি এ তল্লাটে আর কারুর নেই।
অথচ পিন্টু জানে যে দাদু ছেলেবেলায় এরকম ছিলেন না। বাড়িতে একটা অনেক দিনের পুরোনো বিলিতি ফোটো অ্যালবাম আছে, যার মোটা মোটা পাতার পাশগুলোতে সোনার জল লাগানো। সেই অ্যালবামে দাদুর একটা ছবি আছে বাষট্টি বছর আগে তোলা। তখন দাদুর পিন্টুরই বয়স। তাতে দাদুর পরনে হাফ প্যান্ট, মুখে হাসি, আর হাতে একটি হকি স্টিক। তাঁর তখনকার চেহারার সঙ্গে পিন্টুর নিজের চেহারার আশ্চর্য মিল সেটা পিন্টু বেশ বুঝতে পারে। সেই হাসিখুশি খেলুড়ে খোকা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এমন হয়ে গেল কী করে?
দাদু যে সবসময় পিন্টুদের বাড়িতেই থাকেন তা নয়। পিন্টুর জ্যাঠামশাই আসামে জঙ্গল বিভাগে বড় চাকরি করেন; তাঁর একটা চমৎকার বাংলো আছে জঙ্গলের ভিতরে। দাদু মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থেকে আসেন মাস খানেক করে। যাবার সময় সুটকেস বোঝাই বই আর খাতা নেন সঙ্গে, আর যখন ফেরেন তখন খাতাগুলো লেখায় ভরে যায়।
যে সময়টা তিনি থাকেন না, সে সময়টা বাড়ির চেহারাই পালটে যায়। পিন্টুর দিদি রেডিওতে সিনেমার গান শোনে, দাদা হপ্তায় দুটো করে ফাইটিং-এর ছবি দেখে, বাবার চুরুট খাওয়া বেড়ে যায়, আর মা দুপুর হলেই পাড়ার সদু মাসি-লক্ষ্মীমাসিদের ডেকে এনে দিব্যি খোশ মেজাজে তাস খেলেন আর আড্ডা দেন।
দাদু ফিরে এলেই অবিশ্যি আবার যেই কে সেই।
কিন্তু এবার হল একটু অন্যরকম।
এক মাসের জন্য দাদু গিয়েছিলেন আসামে তাঁর বড় ছেলের কাছে! পিন্টু মা বাবার সঙ্গে এক ঘরে শোয়; দাদু ফেরার দু’দিন আগে মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গিয়ে পিন্টু শোনে মা বাবা দাদুকে নিয়ে কথা বলছেন। পিন্টু মটকা মেরে পড়ে থেকে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা শুনল, কিন্তু বাবা অনেক শক্ত শক্ত ইংরিজি কথা ব্যবহার করাতে অনেক কিছুই বুঝতে পারল না। তবে এইটুকু বুঝল যে দাদুর কী একটা অসুখ করেছে।
দু’দিন বাদে অসুখ নিয়েই ফিরলেন দাদু। বাবার সঙ্গে ডাঃ রুদ্র স্টেশনে গেলেন দাদুকে আনতে। বাবার অ্যাম্বাসাডর গাড়িতেই দাদু ফিরলেন, আর তাঁকে গাড়ি থেকে ধরে নামালেন বাবা আর ডাঃ রুদ্র। তারপর ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায়, বারান্দা থেকে বৈঠকখানায়, বৈঠকখানা থেকে দোতলার সিঁড়ি, আর সিঁড়ি উঠে দাদুর ঘরে নিয়ে তাঁর বিছানায় তাঁকে শুইয়ে দিলেন। পিন্টু ঘরের দরজায় দাড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিল, এমন সময় মা এসে তার মাথায় হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘এখানে না, নীচে যাও।’
‘দাদুর কী হয়েছে মা?’ পিন্টু না জিগ্যেস করে পারল না।
‘অসুখ’, বললেন মা।
অথচ পিন্টুর দেখে মনে হয়নি দাদুর কোনও অসুখ হয়েছে। অবিশ্যি এটা ঠিকই যে দাদুকে এইভাবে পরের কাঁধে ভর করতে কোনওদিন দেখেনি পিন্টু। তা হলে কি পায়ে কোনও চোট পেয়েছেন? জেঠুর বাংলোর বাইরে যদি একা হাঁটতে বেরিয়ে থাকেন দাদু, তা হলে জঙ্গলের মধ্যে খানাখন্দে পড়ে চোট পাওয়া কিছুই আশ্চর্য না। কিংবা যদি সাপ-টাপ বা বিছে-টিছে কামড়ে থাকে, তা হলেও অবিশ্যি অসুখ হতে পারে।
তিন দিন এইভাবে কেটে গেল। পিন্টুর শোবার ঘর এক তলায়, দাদুর ঘরের ঠিক নীচে। পিন্টুকে উপরে যেতে দেওয়া হয় না, কাজেই দাদুর অসুখ কেমন যাচ্ছে সেটা জানার উপায় নেই। দিদি বা দাদা থাকলে হয়তো জানা যেত, কিন্তু দিদি কলকাতার হস্টেলে, আর দাদা তার বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে রানিখেত। গতকাল রাত্রে পিন্টু দাদুর ঘরে একটা কাঁসার গেলাস কিম্বা বাটি মেঝেতে পড়ার শব্দ পেয়েছে, আর আজ সকালে ধুপধাপ শব্দ শুনে মনে হয়েছে দাদু হাঁটছেন। তা হলে আর দাদুর এমন কী অসুখ?
দুপুরে পিন্টু আর থাকতে পারল না। মা দাদুকে ওষুধ খাইয়ে নীচে নেমে এসেছেন কিছুক্ষণ হল, আর বাবা চলে গেছেন কোর্টে। আজ বিকেল থেকে একজন নার্স আসবে সে কথা পিন্টু জানে, কিন্তু এখন দাদুর ঘরে আর কেউ নেই।
বুকের মধ্যে একটা ধুকপুকুনির সঙ্গে সঙ্গে পিন্টু বুঝতে পারল যে তাকে একবার দোতলায় গিয়ে দাদুর ঘরে উঁকি দিতেই হবে। শুধু তাই না; দাদু যদি ঘুমোন, তা হলে তাকে ঢুকতে হবে, আর ঢুকে তার ডান্ডা আর গুলিটা খুঁজে বার করে আনতে হবে। দাদু যখন থাকেন না তখন তাঁর ঘর তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ থাকে, তাই ওঘর থেকে কিছু বার করে আনার উপায় থাকে না।
দোতলায় উঠতে পিন্টুর যে একটু ভয়-ভয় করছিল না তা নয়; তবে অসুস্থ দাদু আর তেমন কী করতে পারেন এই ভেবে মনে খানিকটা সাহস পেয়ে উনিশ ধাপ সিঁড়ি উঠে পা টিপে টিপে সে দাদুর ঘরের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। প্যাসেজের বাঁয়ে ঘরের দরজা, আর সামনে আট-দশ পা এগিয়ে ছাতের দরজা।
কোনও শব্দ নেই ঘরে। যে গন্ধটা পাচ্ছে পিন্টু সেটা ওর খুব চেনা আর প্রিয় গন্ধ। পুরোনো বইয়ের গন্ধ। দু’হাজার পুরোনো বই আছে দাদুর ঘরে।
পিন্টু নিশ্বাস বন্ধ করে গলাটা বাড়িয়ে দিল।
দাদুর খাট খালি।
তবে কি দাদু পিছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন?
পিন্টু তার ডান পা-টা বাড়িয়ে দিল চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢোকার জন্য। পা-টা চৌকাঠের ওদিকের মেঝেতে পৌছবার আগেই একটা শব্দ এল তার কানে।
খটাং, খটাং, খটাং!
পিন্টু চমকে পেছিয়ে আসতেই আরেকটা শব্দ—
‘কূ-ই ই ই!’
পিন্টুর চোখ চলে গেল ছাতের দরজার দিকে। দরজার পাশ দিয়ে একটা মুখ উঁকি মারছে।
দাদুর মুখ। এ মুখ পিন্টু এর আগে কখনও দেখেনি। সারা মুখ হাসিতে উজ্জ্বল, চোখের চাহনি দুষ্টুমিতে ভরা।
পিন্টু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে মুখের দিকে।
তারপর দাদুর ডান হাতটা বেরিয়ে এল দরজার পাশ দিয়ে।
পিন্টু দেখল সে হাতে ধরা তার ডাংগুলির ডান্ডা।
এবার দাদু পিন্টুকে আসবার জন্য ইশারা করে দরজা থেকে সরে গেলেন। পিন্টু ছাতের দিকে এগিয়ে গেল।
বেশ বড় ভোলা ছাত, ছাতের মাঝখানে রাখা শ্রীনিবাসের তৈরি কাঠের গুলি।
দাদু পিন্টুর দিকে চেয়ে একবার হেসে হাতের ডান্ডাটা গুলির দিকে তাগ করে মারলেন—খটাং!
গুলিতে লাগল না ডাণ্ডা। তারপর আবার মারতেই গুলির ঠিক মোক্ষম জায়গায় বাড়ি লেগে সেটা বাঁই বাঁই করে ঘুরতে ঘুরতে ছাতের চার হাত উপরে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দাদু চালালেন ডাণ্ডা।
ডাণ্ডার বাড়ি লেগে গুলিটা ছাতের পঞ্চাশ হাত পশ্চিমে সুপুরি গাছটার মাথার উপর দিয়ে সন্তুদের বাড়ির দিকে সাঁ করে চলে গেল উড়ন তুবড়ির মতো। তারপরেই শুরু হল দাদুর খিলখিলে হাসির সঙ্গে হাততালি আর লাফানি।
পিন্টু ছাত থেকে নীচে নেমে এল।
মা-কে ঘটনাটা বলতে মা বললেন ওটাই নাকি দাদুর অসুখ। এরকম অসুখ নাকি মাঝে মাঝে বুড়োদের হয়; তারা আর বুড়ো থাকে না, খোকা হয়ে যায়।
যাই হোক, পিন্টু আজ প্রথম তার বন্ধুদের বলতে পারবে যে সে তার দাদুকে প্রাণখুলে হাসতে দেখেছে।