1 of 2

পালানো যায় না – বনফুল

পালানো যায় না – বনফুল

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সমস্ত প্রকৃতি যেন রুদ্ধশ্বাসে প্রলয়ের প্রতীক্ষা করছে। শাখাপ্রশাখাময় একটা বিদ্যুৎ আকাশকে দীর্ণ—বিদীর্ণ করে দেবার পরই প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাত হল। তারপর আবার সব চুপচাপ। তারপরই সোঁ সোঁ শব্দ করে ঝড় এল। কামান—গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হল যেন। সোনাটুপি গ্রামের প্রান্তে যে অরণ্যটা আছে তার গাছগুলো হাহাকার করতে লাগল। অরণ্যের পাশেই প্রকাণ্ড প্রান্তর। দুটো শেয়াল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মাঠের উপর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। কাক—বক উড়তে লাগল বিভ্রান্ত হয়ে। তারপর বৃষ্টি নামল। মেশ মুষলধারে। ঝড়—বৃষ্টি দুটোই সমানে চলতে লাগল। অন্ধকারও ঘনিয়ে এল ক্রমশ। গাছের ডালপালা ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাঠে। মনে হল মৃত সৈনিকের দল আছড়ে আছড়ে পড়ছে যেন। ঝড়—বৃষ্টি আর অরণ্য মিলে শব্দেরও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করল একটা। কখনো মনে হচ্ছিল কেউ যেন অট্টহাস্য করছে, পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল কাঁদছে। আর্তনাদের সঙ্গে খিকখিক হাসি, হাসির সঙ্গে হাততালি, হাততালির সঙ্গে ডম্বরু নিনাদ যে পরিবেশ সৃষ্টি করল তা আতঙ্কজনক। এতক্ষণ কোনো মানুষ দেখা যায়নি। কিন্তু এইবার দেখা গেল। বনোয়ারি বেরুল জঙ্গল থেকে। ছুটে বেরুল। যেন পালাচ্ছে। অদ্ভুত তার চেহারা। মুখময় গোঁফ—দাড়ি। মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি। কাঁধে প্রকাণ্ড বোঁচকা। হাতে ব্যাগ। ফুল প্যান্টের উপর লম্বা ঝোলা কোট পরেছে একটা, পায়ে বুট জুতো। মাঠের মধ্যে পড়ে সে ছুটতে লাগল আর মাঝে মাঝে পিছু ফিরে চাইতে লাগল। তার পিছনে কেউ ছুটছিল না, কিন্তু বনোয়ারির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তার যেন আশঙ্কা হচ্ছে কেউ তাড়া করে আসছে তাকে পিছুপিছু। মাঠের অপরপ্রান্তে ঘর ছিল একটা। পোড়ো—বাড়ি। বনোয়ারি সেইদিকে দৌড়তে লাগল।

… পোড়ো—বাড়িটা নীলকুঠি ছিল এককালে। এখন ওটা স্থানীয় জমিদারের সম্পত্তি। জমিদার কলিকাতায় থাকেন, সুতরাং বাড়িটা পোড়ো—বাড়িই হয়ে গেছে। কিন্তু সেকালের বাড়ি রেকতার গাঁথুনি, একেবারে পড়ে যায়নি। দেয়ালগুলো খাড়া আছে। কপাট—জানালাগুলোও আছে। পশ্চিমদিকের ঘরের কপাট—জানালা চোরে খুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু উত্তরদিকের ঘরটা, দক্ষিণদিকের ঘরটা আর পূর্বদিকের ঘরটা ঠিক আছে। পূর্বদিকের ঘরটাই বড়ো। ‘হলে’র মতো। তার সামনে একটা চওড়া বারান্দা। বারান্দার উত্তরে আর দক্ষিণে ঘর।

বনোয়ারি ছুটতে ছুটতে এসে পূর্বদিকের ঘরের সামনের চওড়া বারান্দাতে উঠে হাঁপাতে লাগল। আর একবার পিছু ফিরে চেয়ে দেখল, তারপর ঢুকে পড়ল পূর্বদিকের বড়ো ঘরটাতে। ঢুকেই ঘরের কপাট বন্ধ করে তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে ঝড়—বৃষ্টির তুমুল গর্জন হচ্ছিল, কিন্তু বনোয়ারি তা শুনছিল না, সে শোনবার চেষ্টা করছিল, কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কিনা। গত সাত দিন ধরে সে ওই পায়ের শব্দটাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। সোনাটুপির জঙ্গলে ঢোকবার পর সে শব্দটা শুনতে পায়নি। কিন্তু জঙ্গল থেকে বেরিয়েই সে ছপ ছপ শব্দ শুনেছিল। নির্ঘাত শুনেছিল, তার ভুল হয়নি। কিন্তু একবার মাত্রই শুনেছিল, আর শোনেনি। সে আশা করবার চেষ্টা করছিল, তবে কি হাড়গিলা তাকে রেহাই দিলে?

খুট খুট করে শব্দ হল বারান্দায়। চমকে উঠে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে রইল বনোয়ারি, তার শরীরের সমস্ত পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর শব্দ শোনা গেল না। কেবল ঝড়—জলের দাপাদাপি, আর কোনো শব্দ নেই। অনেকক্ষণ কান পেতে রইল বনোয়ারি, ছরছর করে জল পড়ছে বারান্দায়, আর কোনো শব্দ নেই। ছাগলের ডাকের মতো ওটা কি শোনা যাচ্ছে? এই ঝড়ে—বৃষ্টিতে কারও ছাগল মাঠে বেরিয়ে পড়েছে নাকি! কিন্তু একটা ছাগল তো নয়। অনেক ছাগলের ডাক। তারপর বনোয়ারি বুঝতে পারল ব্যাং ডাকছে। আরও মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর তার মনে হল সমস্ত রাত তো কপাটে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।

ভিতরে ঢুকে সে পিঠের বোঁচকা আর ব্যাগটা নামিয়ে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে খুলে গেল কপাটটা আর ছপ ছপ ছপ ছপ শব্দও হল একটা বাইরে। বনোয়ারি দৌড়ে গিয়ে কপাটটা বন্ধ করে দিলে আবার। আবার কপাটে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

হাড়গিলার চেহারাটা স্পষ্ট ফুটে উঠল তার মনে। ওর আসল নাম দনদন। ভালো নাম ছিল দনুজারি। কিন্তু তার চেহারার জন্যে সবাই ওকে হাড়গিলা বলে ডাকত। হাড়গিলার মতোই দেখতে। লম্বা লিকলিকে, কোমরের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত এক সরলরেখায় নয়। দু—বার বেঁকেছে। কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত একটা বাঁক, হঠাৎ মনে হয় কুঁজো (এই বাঁকটার উপরই ছুরি মেরেছিল বনোয়ারি), আর দ্বিতীয় বাঁকটা ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত। কিন্তু এ বাঁকটা উলটো রকম। লম্বা ঘাড়টা ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে আর গলার দিকটা বেরিয়ে পড়েছে সামনের দিকে। মনে হয় কেউ যেন ওর ঘাড়ে লাথি মেরে সামনের দিকে বাঁকিয়ে দিয়েছে গলাটা। গলাটা অসম্ভব লম্বাও। সাঁকিটাও বেশ উঁচু। খাঁড়ার মতো নাকের সঙ্গে সেটা যেন পাল্লা দিয়ে বড়ো হয়েছে। গায়ের রং ফরসা, ঠিক ফরসা নয়, হলদে। কপাল উঁচু, চোখ দুটো কটা, মনে হয় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ভুরু নেই। চোখমুখে কেমন যেন একটা বকের ভাব। এরকম লোক যে কি করে ঝুমকোর মতো মেয়েকে পটাতে পেরেছিল, তা বনোয়ারি বুঝতে পারেনি। হাড়গিলা অবশ্য ঝুমকোর প্রেমে পড়েনি, সে ঝুমকোর সঙ্গে ভাব করেছিল তার গয়না আর গিনিগুলো হাতাবার জন্যে, কিন্তু ঝুমকো তো পড়েছিল। তা না পড়লে ভিতরের অত খবর কি হাড়গিলা জানতে পারত? সে কোন বাক্সে গিনিগুলো রাখত, আলমারির কোনখানটায় তার গয়নাগুলো আছে সব কি বলত হাড়গিলাকে? ভালো না বাসলে বলত না। হাড়গিলাই বনোয়ারিকে নিয়ে গিয়েছিল ঝুমকোর কাছে। একা তো অতবড়ো জোয়ান মেয়েকে খুন করা যায় না, একজন সহকারী চাই। আর হাড়গিলা ছোরাছুরি বা গোলাগুলির পক্ষপাতী ছিল না। সে বলত ও সব বড়ো গোলমেলে জিনিস, ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকে। তার চেয়ে টুঁটি টিপে শেষ করে দেওয়াই নিরাপদ। বনোয়ারি জাপটে ধরেছিল ঝুমকোকে, আর হাড়গিলে টুঁটি টিপেছিল….বনোয়ারির চিন্তাধারা বিঘ্নিত হল। বারান্দায় কে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। মট করে একটা শব্দ হল….ঠিক এমনি শব্দ ঝুমকোর গলা থেকেও বেরিয়েছিল।

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বনোয়ারি। তারপর হঠাৎ তার মনে পড়ল তার পকেটে টর্চ আছে। তার ঝোলার মধ্যে লণ্ঠনও আছে একটা। টর্চটা ভিতরের পকেটে ছিল। খুব বেশি ভেজেনি। জ্বালা গেল। জ্বেলেই নিশ্চিত হল বনোয়ারি। কপাটে খিল, ছিটকিনি দুই আছে। তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দিল দুটোই। তারপর ঝোলাটার ভিতর থেকে লণ্ঠনটা বার করল। আলাদা একটা বোতলে কেরোসিন তেলও ছিল। গত পনেরো দিন থেকে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কত অজানা জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে, আরও কত রাত কাটাতে হবে তার ঠিক নেই, তাই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি, বিশেষ লণ্ঠন আর কেরোসিন তেল, টর্চ, দেশলাই আর মোমবাতি সে সংগ্রহ করে রেখেছে। কপাট বন্ধ করে সে লণ্ঠন, তেলের শিশি বার করলে, টর্চের আলো জ্বেলে জ্বেলে। দেশলাইটা খুঁজে বার করতে একটু দেরি হল। নানাবিধ কাপড়—জামার জটিলতায় হারিয়ে গিয়েছিল। সব বার করে ফেললে সে বোঁচকাটা থেকে। অনেক রকম কাপড়—জামা ছিল। প্যান্ট, হাফ—প্যান্ট, ঝোলা—পাজামা, ধুতি, শার্ট, কোট, হাওয়াই—শার্ট হরেক রকমের, রঙিন চশমা দু—তিন জোড়া। বৃষ্টিতে সমস্ত ভিজে গিয়েছিল। বনোয়ারি ক্রমাগত পোশাক বদলে বদলে বেড়াচ্ছিল। তার ধারণা হয়েছিল পুলিশ তো বটেই হাড়গিলার প্রেতাত্মাও পোশাক বদল করলে বোধ হয় তাকে চিনতে পারবে না। যদিও সে বারবার নিজের সঙ্গে তর্ক করছিল যে ভূতটূত সব কুসংস্কার, মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না, কিন্তু তবু সে সাবধানতা অবলম্বন করতে ছাড়েনি। তার্কিক বনোয়ারির পিছনে বসে আর একজন কানে কানে বলছিল—সাবধানের বিনাশ নেই। তুমি একটা শব্দ যখন শুনেছ, তা যাই হোক, সাবধান হও। বনোয়ারি ক্রমাগত পালাচ্ছিল আর পোশাক বদলাচ্ছিল। কখনো সাহেবি পোশাক, কখনো পেশোয়ারি, কখনো পাঞ্জাবি, কখনো মিলিটারি। চোখে কখনো গগলস, কখনো সাদা চশমা, কখনো নীল…ভিজে কাপড়—জামার মধ্যে দেশলাইটা পাওয়া গেল অবশেষ। একদম ভিজে গেছে। টর্চের আলোতেই তাড়াতাড়ি লণ্ঠনে তেল ভরে ফেলল সে। টর্চের আলোটাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল। টর্চটা নিবিয়ে রেখে দিল। একটু আলোর সম্বল রাখা ভালো। দেশলাইটা জ্বলবে কি? বড্ড ভিজে গেছে। তবু সে চেষ্টা করতে ছাড়ল না। একটা, দুটো, তিনটে, চারটে একটা কাঠিও জ্বলল না। আবার শুরু করল সে। খচ খচ খচ খচ খচ খচ, অন্ধকারে শব্দটা অদ্ভুত শোনাতে লাগল, কেউ যেন হাঁচছে। হাঁচছে? না, হাসছে? পাগলের মতো কাঠির পর কাঠি ঘষতে লাগল বনোয়ারি। একটাও জ্বলল না। সব কাঠি ফুরিয়ে গেল। টর্চটা জ্বেলে ছড়ানো কাঠিগুলোর দিকে সভয়ে চেয়ে রইল সে। টর্চের আলোটাও বেশ লাল হয়ে গেছে। আর বেশিক্ষণ টিকবে না। আবার নিবিয়ে দিলে টর্চটা।

চতুর্দিক কাঁপিয়ে বজ্র পড়ল একটা। মনে হল এই বাড়িতেই পড়ল। থর থর করে কেঁপে উঠল বাড়িটা। বনোয়ারির মনে হল—সমস্ত রাত অন্ধকারে কি করে কাটাব এখানে? আলোটা যদি জ্বালাতে পারতুম! আলো থাকলে কারও পরোয়া করতাম না। হঠাৎ ডান দিকে খিক খিক খিক খিক করে শব্দ হল। তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল বনোয়ারি! ঠিক যেন ব্যঙ্গ করে কে হাসল। যে দিক থেকে হাসিটা এল টর্চটা জ্বেলে সেই দিকে দেখল চেয়ে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, এইবার দেখতে পেল একটা খোলা জানালা রয়েছে, ওদিকের দেয়ালে। এগিয়ে গেল সে—দিকে। টর্চ ফেলে দেখল বাইরের বারান্দায় দু—তিনটে শেয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরাই খ্যাক খ্যাক শব্দ করছে সম্ভবত। ফিরে এল আবার। টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর গোঁফ—দাড়িগুলো খুলে ফেললে। জলে ভিজে পরচুলাগুলো থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছিল একটা। তারপর ব্যাগের ভিতর হাত পুরে একটা পাঁউরুটি বার করে ছিঁড়েছিঁড়ে খেতে লাগল। খুব খিদে পেয়েছিল। ভাগ্যে পাঁউরুটিটা সঙ্গে এনেছিল! খেতে খেতে নিজের মনেই নিজের সঙ্গেই কথা শুরু করে দিল। নিজের কণ্ঠস্বরই যেন সঙ্গী হল তার সেই নির্জন অন্ধকার ঘরে। ‘হাড়গিলে এ তুই কী করলি বল তো! তোর সঙ্গে কথা ছিল তুই আধা—আধি বখরা দিবি আমাকে। ছিল না? কিন্তু মাত্র কুড়িটি টাকা দিয়ে আমাকে তুই বিদেয় করে দিলি কোন আক্কেলে? আমি কি কুলি? আমি সাপটে না ধরলে তুই ওর গলা টিপতে পারতিস? আর আমাকেই কলা দেখালি। কেমন মজাটা টের পাইয়ে দিলুম। ছুরির একটি ঘায়ে তো কাৎ হয়ে পড়লি। আমার সঙ্গে চালাকি! গয়না, গিনি সব পুঁতে রেখে এসেছি। পুলিশ ঘুণাক্ষরে জানতে পারবে না। দিন কতক গা ঢাকা দিয়ে ফিরে যাব আবার।’

বাইরে আবার ছপ ছপ শব্দ শোনা গেল, তার সঙ্গে সেই খিক খিক হাসি।

‘আঃ, শেয়ালগুলো জ্বালালে তো! হাড়গিলে, তুই ভাবছিস আমি ভূতের ভয়ে কাঁপছি? মোটেও না। তুই শেষ হয়ে গেছিস। তোকে আর ভয় নেই। লণ্ঠনটা জ্বালাতে পারলে কারো পরোয়া করতাম না। অন্ধকারে বলেই গাটা ছমছম করছে—’

টক করে একটা শব্দ হল।

মেঝেতে কী যেন পড়ল একটা ওপর থেকে।

টর্চটা মুঠোয় চেপে ধরে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বনোয়ারি। তারপর জ্বালল টর্চটা। যা দেখলে তাতে তার মুখটা ‘হাঁ হয়ে গেল একটু। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে পড়বার মতন হল। মেঝের মাঝখানে একটা দেশলায়ের বাক্স পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তুলে নিলে সেটাকে। শুকনো খটখটে নতুন দেশলাই একবাক্স, দু—দিকের কাগজ পর্যন্ত ঠিক আছে। কোত্থেকে এল এটা? কে দিলে? টর্চটা ছাতের ওপর ফেলে দেখবার চেষ্টা করল একটু। কিচ্ছু দেখা গেল না। খিক খিক হাসিটা আবার শোনা গেল বাইরে। আর সঙ্গে সঙ্গে টর্চটা নিভে গেল। তার ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বনোয়ারি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে তুলে নিলে দেশলাইটা। প্রথম কাঠিটাই জ্বলে উঠল।

লণ্ঠনটা জ্বেলে বেশ করে গুছিয়ে বসেছিল বনোয়ারি। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধ্বনি, আকাশের গুরু গুরু শব্দ আর ঝড়ের তাণ্ডব চলছিল। আর তার মধ্যে মাঝে মাঝে সেই ছপ ছপ ছপ ছপ শব্দ আর খিক খিক হাসি। এইটেই শুনছিল বনোয়ারি একাগ্র হয়ে। শেয়ালগুলো ওরকম করছে? তাই নিশ্চয়। এই বিশ্বাসেই অনড় হয়ে বসেছিল সে। কিন্তু একটু পরেই এ বিশ্বাস আর টিকল না। খিক খিক শব্দটা কানের খুব কাছে শোনা গেল। নিশ্বাসের স্পর্শও যেন গালে লাগল। আর মনে হতে লাগল ঘরের ভিতরেই যেন কে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

‘চোপরাও, খবরদার—’

টপ করে ব্যাগ থেকে ছোরাটা বার করে চিৎকার করে উঠল বনোয়ারি। শব্দটা থেমে গেল। নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত করে বসে রইল সে। অনেকক্ষণ কোনো শব্দ হল না। তারপর হঠাৎ সে দেখতে পেল ঘরের কোণে ছায়ামূর্তির মতো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে একটা। ঠিক যেন হাড়গিলার ছায়া পড়েছে। বোঁ করে ছোরাটা সেই দিকে ছুড়ে দিলে সে। ছায়াটা সট করে যেন ওপরের দিকে মিলিয়ে গেল, আর ছোরাটা গেঁথে গেল দেওয়ালে। বনোয়ারি উঠে গেল দেওয়াল থেকে ছোরাটা খুলে নেবার জন্যে। কিন্তু পারলে না। ছোরাটা দেওয়ালে এমন গেঁথে বসে গিয়েছিল যে খোলা গেল না। টানাটানি ধস্তাধস্তির চরম করল বনোয়ারি, কিন্তু কিছুতেই তুলে নিতে পারলে না ছোরাটা। মনে হল ভিতর থেকে ছোরাটাকে কে যেন শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছোরাটা ছেড়ে দিয়ে একদৃষ্টে তার দিকে সভয়ে চেয়ে রইল বনোয়ারি। ছোরার বাঁটটা কাঁপতে লাগল, বনোয়ারির মনে হল যেন বলছে—না, না, পারবে না। ছেড়ে দাও। ঠিক এই সময়ে খিক খিক হাসিটা আবার কানের পাশে শুনতে পেল সে। লাফিয়ে সরে গেল একধারে। খানিকক্ষণ চেয়ে রইল ছোরাটার দিকে। আর একবার চেষ্টা করল, দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণে টানতে লাগল। টানতে টানতে হঠাৎ হাত ফসকে গেল তার, দড়াম করে নিজেই পড়ে গেল মেঝের ওপর। ছোরার বাঁটটা দুলে দুলে বলতে লাগল— না, না না, না। আর সঙ্গে সঙ্গে খিক খিক হাসি। মেঝে থেকে উঠে কপাট খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল বনোয়ারি বাইরে। দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে তার কাপড়চোপড় উড়িয়ে ছড়িয়ে দিলে ঘরের মেঝের চারদিকে। লণ্ঠনের শিখাটা কাঁপতে লাগল, কিন্তু নিবল না। তার আগেই বনোয়ারি ঘরে বসে ঢুকল প্রকাণ্ড লম্বা একটা গাছের ডাল টানতে টানতে।

‘পিটিয়ে লম্বা করে দেব হারামজাদাকে—’ উচ্চকণ্ঠে এই স্বগতোক্তি করে কপাটটা আবার ভালো করে বন্ধ করে দিলে সে। তারপর লম্বা ডালটা রাখল একধারে। কাপড়চোপড়গুলো গুছিয়ে বোঁচকায় পুরে ফেলল। তারপর ঘরের মাঝখানে গুম হয়ে বসে রইল ভ্রুকুঞ্চিত করে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। কোনো সাড়া—শব্দ নেই। ক্রমশ ঘুম পেতে লাগল তার। ঢুলতে লাগল। হঠাৎ চমকে উঠল একবার। মনে হল ঘরের আর একটা কোণে ফিসফিস করে কথা কইছে যেন কারা। লম্বা ডালটা তুলে তেড়ে গেল সেদিকে। কেউ নেই। তারপর তার মনে হল সমস্ত দিনের ক্লান্তিতে তার মাথা বেঠিক হয়ে গেছে বোধ হয় তাই ও—সব আজগুবি জিনিস দেখছে আর শুনছে। একটু ঘুমুলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভূত? হুঁঃ, যত সব বাজে কথা। বোঁচকাটা মাথায় দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে মেঝের উপর। চোখ বুঁজে রইল খানিকক্ষণ। কিন্তু ঘুম এল না। তবু চোখ বুজে রইল। তারপর একটা অদ্ভুত ছোট্ট শব্দ হল। চু—চু—চু। বনোয়ারি চোখ খুলে দেখলে ছাতের ওপর থেকে কালো মতন কী একটা ঝুলছে। ঝুল নাকি? পুরোনো বাড়িতে ঝুল থাকা অসম্ভব নয়। একদৃষ্টে চেয়ে রইল সে দিকে। মনে হতে লাগল ক্রমশ সেটা বড়ো হচ্ছে। নীচের দিকে লম্বা হচ্ছে। সাপ নয় তো? বনোয়ারি উঠে সেই লম্বা ডালটা তুলে সেটার নাগাল পাবার চেষ্টা করতে লাগল। ডালটা খুব লম্বা, নাগাল অনায়াসেই পাওয়া যেত। কিন্তু ওটা ক্রমশ সরে সরে যেতে লাগল। আর ক্রমশ লম্বা হয়ে নামতে লাগল মেঝের দিকে। বনোয়ারি শেষে পাগলের মতো ঘোরাতে লাগল ডালটা। তারপর অপ্রত্যাশিত এক কাণ্ড হল। হঠাৎ কে যেন পিছন দিক থেকে জাপটে ধরল তাকে। নরম দুটো হাত, ঠিক যেন মেয়েমানুষের হাত, পিঠের ওপর স্তনের স্পর্শও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কিছু। বনোয়ারির হাত থেকে ডালটা পড়ে গেল। আর ছাত থেকে সেই কালো বস্তাটা নামতে লাগল ক্রমশ। বনোয়ারি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল সে দিকে। দেখতে দেখতে সেটা তার চোখের সামনে নেমে এল। বনোয়ারি দেখলে সেটা ঝুল নয়, সাপও নয়, আঙুল একটা, বিরাট মোটা রোমশ আঙুল, প্রকাণ্ড নখ রয়েছে রাতে। আঙুলটা মেঝের কাছে আসতেই চড়াৎ করে শব্দ হল একটা, মেঝেটা ফেটে গেল। সেই ফাটলের ভিতর থেকে বেরুল হাড়গিলার মুণ্ডটা।

‘কে, বনোয়ারি এসো, এসো, ভয় পাচ্ছ কেন। ঝুমকো এবার ছেড়ে দাও ওকে। ও আসবে এবার। ঝুমকো আমার গলাটাকে কামড়ে ছ্যাতরাখ্যাতরা করে দিয়েছে একেবারে। দেখতে পাচ্ছ?’

বনোয়ারি দেখতে পেয়েছিল। হাড়গিলার গলার সাঁকিটা নেই, তার জায়গায় একটা গর্ত। গর্তের ভিতর দিয়ে মেরুদণ্ডের হাড় দেখা যাচ্ছে।

‘ঝুমকো ছেড়ে দাও ওকে। ও এইবার আসবে। বনু এসো—’

অদৃশ্য হাতের বন্ধন শিথিল হয়ে গেল। অদৃশ্য এবার দৃশ্যও হল। বনোয়ারি ঘাড় ফিরিয়ে এবার দেখতে পেল ঝুমকো দাঁড়িয়ে আছে। তার ঘাড়টা ওদিকে বেঁকে গেছে, জিবটা বেরিয়ে ঝুলছে, মুখময় ফেনা, চুলগুলো এলোমেলো। তারপর বনোয়ারি অনুভব করল হাড়গিলা তার হাত থরে টানছে আর ঝুমকো ঠেলছে তাকে পিছন থেকে। বনোয়ারি গর্তে ঢুকে পড়ল।

ফেরারি আসামি বনোয়ারির মৃতদেহ সাতদিন পরে পুলিশ আবিষ্কার করল ওই ঘরের মধ্যে। মৃতদেহটি ঘরের মেঝেতে একটা ফাটলের মধ্যে আটকে ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *