1 of 2

পারিজাত পারিং

পারিজাত পারিং

(এই গল্পর পটভূমি বাস্তব কিন্তু প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক)

আপনাদের এই মণিপুর এবং তার রাজধানী ইম্ফল থেকে স্যুভেনির হিসেবে নিয়ে যাবার মতো কী কী আছে?

মিসেস সেন, তাঁর স্বামীর, সপ্রতিভ, সুদর্শন সাবর্ডিনেট শবর রায়কে শুধোলেন।

গাড়িটা এগিয়ে চলেছিল মণিপুর-বার্মা সীমান্তের দিকে। শবর বসেছিল মিসেস সেনের পাশেই। পেছনের সিটে। মিসেস সেন বয়েসে বোধ হয় শবরের মায়ের চেয়ে একটু ছোটোই হবে।

হাতে ব্যাগ, পানের ডিবে, জর্দার কৌটো, উলের লাছি আরও নানা জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে বসেছেন পালকিতে-বসা জমিদার গৃহিণীরই মতো উনি। কিছু মানুষ থাকেন এরকম। যাঁদের হাতের কাছে সবসময়ই অনেক কিছু না থাকলে তাঁরা ভারি অসহায় বোধ করেন। মিসেস সেনের মতো নারীই নন, এমন অনেক পুরুষও দেখেছে শবর। একটি ছোটো চামড়ার ব্যাগ, সিগারেট, দেশলাই বা লাইটার, কাগজ, টোব্যাকো, বিজনেস-স্ট্যাণ্ডার্ড কাগজ, ট্র্যাশ কোনো ইংরিজি পেপার ব্যাক, এয়ার লাইনস-এর স্ক্যেজুল, রোদ-চশমা, কফির ফ্লাস্ক, ছাতা এসব না থাকলে কী যেন নেই, কী যেন নেই ভাব করেন তাঁরাও।

স্বগতোক্তির মতোই মিসেস সেন বললেন, লাইঝাম্পি অবশ্য একটা নিয়ে নিয়েছি আমি, আপনাদের অফিসের কাছেরই দোকান থাকে। ঠকাল কি না কে জানে!

ঠকালেও কত আর ঠকাবে? তা ছাড়া এখানকার দোকানদারেরা বড়ো শহরের দোকানদারদের মতো ঠগ-জোচ্চোর নয়।

পারিজাত-পারিং নিয়েছেন কি? শবর বলল।

পারিজাত-পারিং?

একটু অবাক হয়ে মিসেস সেন বললেন, সেটা কী বস্তু?

সব চেয়ে নামকরা গয়না, মণিপুরের। সোনার গয়না। দারুণ তার ডিজাইন। পারিজাত-পারিং হচ্ছে মণিপুরি মেয়েদের মধুরতম স্বপ্ন।

শব্দটা আস্তে আস্তে জিভের মধ্যে নকুল দানার মতো ভাঙলেন উনি: পা-রি-জা-ত-পা-রি-w। কিন্তু পাব কোথায়?

ড্রাইভারকে বলবেন। নইলে সাহেবকে বললেই মণিপুরের অফিসের যেকোনো স্টাফ সঙ্গে নিয়ে যাবে আপনাকে ঠিক দোকানে। থংগলবাজারেও দোকান আছে।

দাঁড়ান দাঁড়ান ভাই! লিখে নিই নামটা। পাছে, ভুলে যাই। বলেই, হ্যাণ্ডব্যাগ খুলে নোট-প্যাড বের করে ডটপেন দিয়ে লিখলেন পারিজাত-পারিং। লিখেই বললেন, এতক্ষণে একটা খবরের মতো খবর দিলেন। আমার ননদের মেয়ে রুপোর গয়নার ব্যাবসা করে বাড়িতেই। তার হাতে একবার এ জিনিস পৌঁছোতে পারলে তো পুরো কলকাতার মেয়েরা পারিজাত-পারিং-এর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

গল্পে গল্পে অনেক মাইল চলে এসেছে ওরা। লাং-থাবাল পেরিয়ে ওয়াইথুর, থৌবল, থং-টম এমনকী মিলিটারিদের ডেরা, প্যালেল-ও পেরিয়ে এসেছে।

বা: বা:! এ তো দেখছি ছোটোখাটো হিল স্টেশানের মতোই উঁচু। কী বলেন ভাই? মিসেস সেন বললেন।

যা বলেছেন। শবর বলল।

বলেই, ড্রাইভারকে সাবধান করে দিল উলটো দিক থেকে বাঁকের মুখে হঠাৎ-আসা একটি মিলিটারি ট্রাক সম্বন্ধে।

ওটা কী পড়ে আছে পথের পাশে? জঙ্গলে?

কোনটা?

ওই যে বাঁ-দিকে। দেখতে পাচ্ছ না?

ওটা তো ট্যাঙ্ক।

নেতাজির আইএন-এর ট্যাঙ্ক?

তাও হতে পারে। আবার ব্রিটিশ আর্মিরও হতে পারে। জাপানিদের বোধ হয় হবে না। কত্ত যুগ হয়ে গেল, মার্কা-টার্কা সব উঠে গেছে। আর্মির লোকেরা বললেও বলতে পারেন হয়তো।

নেতাজির আর্মি কি এতদূর অবধি এসেছিল?

এই রে! আমি ঠিক বলতে পারব না। সেকথা সঠিক বলার মতো লোক এখন এখানেও পাওয়া মুশকিল। তবে শুনেছি, সেকেণ্ড ওয়ার্ল্ড-ওয়ারের সময় এই পথ দিয়েই বার্মা থেকে ভারতীয় উদবাস্তুরা সব এসেছিলেন দলে দলে পায়ে হেঁটে। এই পথই কিন্তু চলে গেছে বার্মার ‘তামু’ হয়ে মান্দালয়। মান্দালয় থেকে রেঙ্গুন, এশিয়ান হাইওয়েতে। তামুর দিকেই আমরা যাচ্ছি। তখন এসেছিলেন সর্বস্ব পুঁটুলিতে বেঁধে শরৎচন্দ্রর উপন্যাসের চরিত্রর বাঙালিদেরই মতো নানা শ্রেণির সব বাঙালিরা অবাঙালিরাও, মাড়োয়ারি ব্যাবসাদারেরা। এখনও ইম্ফলে তাঁদের মধ্যে অনেকে রয়ে গেছেন। ইম্ফলে, কোহিমাতে, ডিমাপুরে এবং আসামের নানা জায়গাতেই তখনকার উদবাস্তুরা এখন থিতু হয়েছেন। আমরা যে প্যালেল চেক-পোস্ট পেরিয়ে এলাম না, কিছুক্ষণ আগে, সেটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর শেষ চেক-পোস্ট এখন। বার্মার বর্ডারে।

তাই? তাহলে তো বার্মার খুব কাছাকাছিই চলে এসেছি আমরা!

নিশ্চয়ই!

আমার কিন্তু বেশ শীত করছে এখন। এই ভর-দুপুরেও মার্চের শেষে এত শীত করছে কেন ভাই?

করবেই তো! থেংনোপাল তো সামনেই। প্রায় সাড়ে ছ-হাজার ফিট মতো উঁচু হবে। অত না হলেও কাছাকাছি হবে। শালটাকে ভালো করে জড়িয়ে নিন। তবে থেংনোপাল-এরএকটু পরই আমরা রেস্ট-হাউসে পৌঁছে যাব। সেখানেই তো সাহেব অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে।

আপনি আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন না?

না। আমার এক্ষুনি মোরে যেতে হবে।

মরে যাবেন কী? কী অলক্ষুণে কথা।

শবর হেসে ফেলে বলল, না, না। মরব কেন? জায়গাটার নামই ‘মোরে’। ভারতের শেষ গ্রাম। বার্মার সীমান্তে।

মোরে? জায়গার নাম?

তাই! ইংরিজি বানান অবশ্য MOREH!

ভারি মজার নাম তো!

তা ঠিক।

আপনারা তো কাল ভোরই ফিরে যাবেন থেংনোপাল থেকে? তাই না?

সেরকমই তো কথা আছে। কাল ফিরে ইম্ফলে রেস্ট করব। মন্দির-টন্দির, রাজবাড়ি এসব দেখব। ও হ্যাঁ। পারিজাত-পারিং কিনব।

মণিপুরে আসতে হলে, হয় ঠিক দোলের সময়ে আসতে হবে নয়তো শীতে। ঠিক সময়ে আসেননি আপনারা। দু-বার রাস হয় যে এখানে। দোলের সময়ে তো দেখবারই মতো।

তাই? তা আপনার সাহেব তো কাজ ছাড়া আর কিছুই জানেন না। কোনো রসকষই নেই।

তা ঠিক। সাহেব বড়ো কাজপাগলা মানুষ।

হুঁ!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মিসেস সেন।

কাল ইম্ফল থেকে পরদিন কোথায় যাবেন?

কোহিমা। পথটি কেমন? শুনেছি, পিকচারাস্ক।

ওঃ দারুণ। আমি কাশ্মীরে যাইনি। তবে যাঁরা গেছেন তাঁরা বলেন জম্মু থেকে শ্রীনগরের পথ যেমন সুন্দর এই পথটিও প্রায় তেমনই। অপূর্ব দৃশ্য পথের দু-পাশে।

তাই? বা:! পথে কী কী জায়গা পড়বে? আপনি কি নিজে গেছেন কখনো?

হ্যাঁ নিজে গেছি বই কী। কোহিমা পৌঁছোবার আগে অনেক জায়গাই পড়বে। ঘন জঙ্গলে-ঘেরা পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে আঁকা-বাঁকা পথ। গ্রীষ্মকালেও শীত করবে। উঁচু যে অনেক।

কোহিমা কতদূর? ইম্ফল থেকে?

তা প্রায় শ-আড়াই কিলোমিটার তো হবেই। পুরো রাস্তাতেই ফরেস্ট আর আর্মির চেক-পোস্ট পাবেন। কোয়াগলোটোংবি কাংগকোপকি, মাও, খুজামা, জুকুমা হয়ে তার পর কোহিমা। আমি গেছিলাম বছর দুই আগে। পথের পাশের হাটে হরিণের মাংস বিক্রি হচ্ছিল। কিনেওছিলাম মাও-এর কাছে। কোহিমাতে যে ওয়ার মেমোরিয়াল আছে সেটি নিশ্চয়ই দেখে আসবেন। বেরিয়াল-গ্রাউণ্ডসও। ইম্ফলেরটাও দেখবেন। চোখে জল এসে যায় লেখাগুলো পড়লে! কচি কচি সব ছেলেদের কবর।

তার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, থাকবেন কোথায়, কোহিমাতে?

আমার স্বামীর সঙ্গে নাগাল্যাণ্ডের চিফ মিনিস্টারের আলাপ আছে যে! একসঙ্গে শিকার করেছেন অনেক এক সময়ে। উনিই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।

তাই বুঝি? তবে তো কথাই নেই! কোহিমাতে কিন্তু এখন বেশ ভালো ঠাণ্ডা হবে। পারলে ওখান থেকে মোকোকচুঙ-ও দেখে আসবেন। সাপের মাংস খেতে চান তো খেতে পারেন। কুকুরের মাংসও ওঁরা ভালোবেসে খান।

মোকোকচুঙ! এই নামটা বেশ চেনা লাগছে যেন!

মিসেস সেন বললেন।

লাগতে পারে। কাগজে দেখেছেন।

গাড়িটা থেংনোপাল থেকে লোকাচোর পথ ছেড়ে দিয়ে খুব খাড়া একটি চড়াই পথ উঠতে লাগল।

শবর বলল, খুব ভালো লাগল আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কাটিয়ে। জানি না, আবার দেখা হবে কি না কখনো!

কেন হবে না? আপনি ছেলেমানুষ। আমিই কবে টুপ করে মরে যাব। কলকাতায় এলে অবশ্যই আসছেন কিন্তু আমার বাড়িতে। এই রাখুন আমার একটা কার্ড। বাড়ির ঠিকানা ও ফোন-নাম্বার আছে। না এলে, সত্যিই রাগ করব কিন্তু।

শবর হেসে বলল, কলকাতায় গেলে, নিশ্চয়ই যাব।

গাড়িটা রেস্ট-হাউসে পৌঁছোলে শবর গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে মিসেস সেনকে নামাল। সেনসাহেব গাড়ির শব্দ শুনে বারান্দাতে বেরিয়ে এলেন। মুখে পাইপ। একটি রং জ্বলে-যাওয়া ছাই-রঙা স্যুট পরা। পুরোনো দিনের টুটালের টাই। বেশির ভাগ বাঙালিকেই স্যুট পরলে মানায় না। কিন্তু সেনসাহেবকে স্যুট পরলে পাক্কা সাহেবের মতো দেখায়।

শবরকে দেখেই বললেন, আরে! মিস্টার রায়। গুড আফটারনুন। আসুন, আসুন।

মেমসাহেব বললেন, ওঁকে তুমি আবার ‘আপনি আজ্ঞে’ করছ কেন? আমাদের খোকার চেয়েও বয়েসে ছোটো হবেন তো। লাঞ্চ খেয়ে যান না উনি আমাদের সঙ্গে।

সেনসাহেব নীরব চোখে মৃদু ভৎর্সনা মাখিয়ে অফিসের সম্পর্কে ব্যক্তিগত প্রলেপ লাগাতে মিসেস সেনকে বারণ করে বললেন, তা হলেও উনি তো খোকা নন! কী বলেন মিস্টার রায়? লাঞ্চ তো খেয়ে যেতেই পারেন যদি ওঁর আমাদের সঙ্গে নষ্ট করার মতো সময় থাকে।

চলি স্যার। আমাকে মোরে যেতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। মেনি থ্যাঙ্কস ফর দ্য অফার।

শবর সঙ্গে সঙ্গেই বলল।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য ফেভার ডান মি. রায়। মিসেস সেন ইজ নট সাপোজড ট্যু ইউজ অ্যান অফিশিয়াল কার।

সকলেই তো করে স্যার। তা ছাড়া উনি তো আমার সঙ্গেই ট্র্যাভেল করছিলেন। শবর হেসে বলল।

সকলে আর আমি তো এক নই মি. রায়।

সেটা ঠিক স্যার। আমরা জানি।

বলল, শবর।

মনে মনে বলল, সকলে অবশ্য শবর রায়ও নয়।

আর ইউ শিয়োর দ্যাট ইউ ডোন্ট হ্যাভ টাইম ফর ইভিন আ কাপ অফ টি?

ইয়েস স্যার। অ্যাবসলুটলি শিয়োর। চলি, বলে মিসেস সেনের দিকে তাকাল ও। আসি স্যার। বলেই গাড়িতে উঠল। ড্রাইভারও নেমে দাঁড়িয়েছিল। সেনসাহেবকে স্যালুট করে সেও ড্রাইভিং সিট-এ উঠল। তার পর গাড়ি স্টার্ট করে উতরাইটা সাবধানে পার করে বড়োরাস্তায় পড়েই গাড়ির মুখ ঘোরাল মোরের দিকে।

মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস সেন বারান্দায় দাঁড়িয়েই ছিলেন। গিন্নি বললেন, ভারি ভালো ছেলেটি। ভদ্র, হ্যাণ্ডসাম, ওয়েল-বিহেভড। আমাদের খুকির সঙ্গে খুব মানাত কিন্তু। বুঝলে। ওর বাবা-মা থাকেন কোথায়?

সেনসাহেব বললেন, বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। ও ছেলে তোমার স্পয়েল্ট খুকিতে আদৌ ইন্টারেস্টেড হবে না। ও ইণ্ডিয়ান কাস্টমস-এর ওয়ান অফ দ্য ব্রাইটেস্ট বয়েজ। ওকে আমি বম্বেতে ট্রান্সফার করে দেব মাস দুই বাদে।

আহা! কলকাতায় নয় কেন?

ওর ভালোর জন্যে। তা ছাড়া তোমার খুকির নাকটিও তো বড়ির মতো। তোমার নাক হুবহু বসানো। কোনো বোকা-খোকার সঙ্গে প্রেম করতে বলো মেয়েকে, সম্বন্ধ করে বিয়ে দিতে তোমার কাল-ঘাম ছুটে যাবে।

ছি:! নিজের মেয়ের সম্বন্ধে কেউ এমনভাবে কথা বলে?

কার মেয়ে তা তুমিই জানো। আমার তো পদবিটামাত্র। মায়েরা ছাড়া এই গোপন কথা তো কোনো বাবারই জানার কথা নয়।

তুমি একটা যা তা!

কথা ঘুরিয়ে মিস্টার সেন বললেন, দিস ইয়াং বয় হ্যাজ আ লং ওয়ে টু গো। আমার বয়েসে ও বোর্ড অফ ইনডায়রেক্ট ট্যাক্সেসের চেয়ারম্যানও হয়ে যেতে পারে।

আমাদের দত্তসাহেবের মতো বলছ?

মিসেস সেন বিস্ময়াভূত গলায় বললেন।

বলেই বললেন, দেখো না একটু চেষ্টা-চরিত্র করে!

ওর ওপরে নজর দিয়ো না। তোমার খুকির জন্যে কলকাতারই কোনো বসে-খাওয়া, বাবার সম্পত্তিওয়ালা আলুভাতে লালু-খোকা দেখো। যা করে মানুষ করেছ মেয়েকে! ছ্যা:! একগেলাস জলও তো গড়িয়ে খেতে শেখাওনি।

তা শেখাইনি, দরকার হবে না বলে। কিন্তু মেয়ে আমার গুণের আধার।

তা ঠিক! মালথাস সেদ্ধ করলে যদি ভাত বেরোত আর শেক্সপিয়র গোলালে মাংসের ঝোল তাহলে…

এখানে এসেও তোমার সেই একইকথা? ছি:।

ওক্কে। বলব না। চা খাবে? না, লাঞ্চ?

লাঞ্চ। একটু পরে। আমি বরং এই চেয়ারটাতে বসি।

চেয়ারে বসতেই চেয়ারটা একদিকে ঢলে পড়ল।

মিস্টার সেন অন্য একটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, রিয়ালি, তোমার মতো আনস্টেবল ইকুইলিব্রায়াম দেখিনি আমি।

মিসেস সেন মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন।

চলো, বিকেলে তোমাকে মোরেতে নিয়ে যাব।

গাড়ি কোথায়?

পাঠিয়েছি একটু। এখুনি এসে যাবে।

মিস্টার সেন এসব বিষয়ে ভীষণ কড়া। নিজের পয়সায় গাড়ি-ভাড়া করে এনেছেন। ডিপার্টমেন্টের অনেকে বলেন, পাগলা সেন। অনেকে তাঁর কড়াকড়ির কারণে অবশ্য ‘খচরা’ সেন বলেও ডাকে।

কোথায় পাঠিয়েছ? গাড়ি?

এখানে একটা ‘লোকাল-ব্রু’ পাওয়া যায়। বুঝেছ। দারুণ! এই শীতে, এই জায়গায়; এই তুমি, হুঁ হুঁ হুঁ…

হাবলা! দিনে দিনে যত বয়েস বাড়ছে ততই তুমি একটা মোদো হয়ে উঠছ। বিচ্ছিরি! হঠাৎই ভীষণ রেগে উঠে মিসেস সেন বললেন।

মিস্টার সেন মিসেস সেনের বাক্যবাণে অভ্যস্ত ছিলেন। বুদ্ধিমান পুরুষ স্ত্রীলোকের কথার উত্তর করেন না। নিজের স্ত্রীর কথার তো নয়ই! কিছু না বলে, চুপ করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে নীচে চেয়ে রইলেন তিনি গাড়ির খোঁজে।

মনে মনে বললেন, গিন্নি গো! পঞ্চাশ পেরুনোর পরই অবল পুরুষের নিজেকে পরমবলশালী বলে ভ্রম হতে থাকে এবং তখনই অন্য ‘ম’-তে আসক্ত হতে চায় তারা। এই ‘ম’-তে দোষ নিয়ো না কোনো। আসলে বাঙালি স্ত্রীদের স্বামীদের খারাপত্বর ‘রেঞ্জ’ সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। ভেরি স্যাড।

সাদা-রঙা অ্যাম্বাসাডারটা উঠে আসছিল খাড়া পথ বেয়ে। রেস্ট হাউসের দিকে। মিস্টার সেন চেয়ে রইলেন।

গাড়িটা এলে, সেনসাহেব বারান্দায় বসে একটি তেপায়া পাশে টেনে নিয়ে অ্যাশট্রেতে পাইপটা রেখে বেয়ারাকে গ্লাস আনতে বললেন। তার পর বোতলটা থেকে একটু পানীয় সোজা ঢাললেন মুখে। মনে মনে বললেন, সাংঘাতিক জিনিস। গিন্নিকে একটু খাওয়াতে পারলে কাত করা যেত।

খাবে নাকি? এক সিপ?

মরে গেলেও না।

ওই একই ডায়লগ। কী বারান্দায়! কী বিছানায়! সত্যি! নতুনত্বের প্রতি এমন অনীহা বাঙালি মহিলাদের মতো আর কারোরই নেই।

সেনসাহেব আবার বললেন মনে মনে।

মিসেস সেন বললেন, আমি কিন্তু শবরের কথাই ভাবছি।

ভাবো। ভাবনাতে দোষ নেই তো কোনো।

ইয়ার্কি কোরো না। আমি খুকির কথা ভাবছি। শবরের সঙ্গে…

অমন চরিত্রবান চমৎকার ব্রাইট ছেলে।

চরিত্র বলতে তুমি কী বোঝো?

যে যুবক মেয়েদের দিকে তাকায় না।

বা:! চমৎকার! মহিলাদের ব্যাপারে ও কিন্তু খুব খোলামেলা।

খোলামেলা মানে?

খোলামেলা।

বলেই, আরেক চুমুক খেলেন সেনসাহেব। বেয়ারা গ্লাস দিয়ে গেছিল।

তুমিও তো সৎ। কড়া। তা বলে তুমি তো আর কখনো এ জীবনে আমি ছাড়া দ্বিতীয় রমণীতে আসক্ত হওনি।

সেনসাহেব আরেক চুমুক খেয়ে মনে মনে বললেন, ভাবছ তাই।

কী? কথা বলছ না যে।

সত্যিকথার পিঠে কথা বলে সত্যকে জোলো করতে চাই না আমি এই জিনিসে জল মেশাবারই মতো।

শবর সম্বন্ধে না জেনে কথা বলছ কেন?

না জেনে বলছি না। সাবোর্ডিনেটসদের সম্বন্ধে জানাই আমার কাজ।

দেখো! শবরের ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস কি না বলো?

খুবই সিরিয়াস। এবং কনসার্নডও। ওর সম্বন্ধে আমি এইমুহূর্তে যতখানি কনসার্নড তা আর কারোর জন্যেই নয়। এমনকী তোমার জন্যেও নয়। আমার মণিপুরে ট্যুরে আসার কারণও ওই শবরই। হি ইজ ইন ডেঞ্জার। গ্রেভ পার্সোনাল ডেঞ্জার। ওর দুর্বলতার জন্যেই ও মরবে একদিন। ওর ওপরওয়ালা, ইণ্ডিয়ান এবং বার্মিজ পুলিশের কিছু লোক, চোরাচালানকারীদের দোর্দন্ডপ্রতাপ দল এরা সবাই একসঙ্গে হাত মেলালে ওকে আমিও বাঁচাতে পারি না। আজ বিকেলে ‘মোরে’তে গিয়ে ওর কাজের জায়গা ভালো করে দেখে ওকে আলাদা করে ডেকে সাবধান করে দিয়ে যাব। এই সময়ে, এই ভারতবর্ষে; একজন অসহায় একলা যুবতীর সতীত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেয়েও একজন তরুণ সরকারি কর্মচারীর সততা বাঁচিয়ে রাখা অনেকই বেশি কঠিন। একথা আমার মতো ভালো করে কেউই জানে না। জেনো। এত প্রলোভন, নষ্ট হয়ে যাওয়ার এত এবং এতরকম পৌনঃপুনিক সুযোগ মুনি-ঋষি ছাড়া কারোর পক্ষেই অবহেলা করা সহজ নয়। শবররা কী করবে? এই সিস্টেমটাই এমন হয়ে গেছে যে, এখানে সততাকে ছিন্নভিন্ন করে ছুড়ে ফেলে দেয়, অসততার চক্রর সততসঞ্চারমান কনভেয়র বেল্ট।

আজ অনেস্টির ‘বুঁদির কেল্লা’ রক্ষা করা বড়োই কঠিন কাজ।



থেংনোপাল-এর ঘাট থেকে নেমে যাচ্ছিল শবরের গাড়িটা। থেংনোপাল ছ-হাজার দু-তিনশো ফিট উঁচু। আর ভারতের সীমান্তের শেষ গ্রাম মোরে। সমতলে। ঘুরে ঘুরে নামছিল গাড়িটা। দু-পাশে পাহাড় জঙ্গল। কানের মধ্যে দপদপ করছে।

প্রায় নেমে এসেছে ঘাটটি। দূর থেকে লোকাচো নদীটা দেখা যাচ্ছে। এবারে তার ওপরের ব্রিজ পেরুল গাড়ি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মোরেতে পৌঁছে যাবে। বাইশ-তেইশ কিলোমিটার পথ আর। মোরের পরেই একফালি নো-ম্যানস ল্যাণ্ড। ঘন জঙ্গলের মধ্যে। তার পরেই ছোট্ট নদী। তার ওপর ব্রিটিশ আমলে মিলিটারিদের বানানো লোহার ব্রিজ আছে। সেই ব্রিজ পেরিয়ে নো-ম্যানস ল্যাণ্ডের আরও একটু এলাকা পেরিয়েই বার্মার সীমান্তের প্রথম গ্রাম। নাম, ‘তামু’। ছোট্ট প্যাগোডা। নাইলনের স্বচ্ছ ব্লাউজ পরা ফুলের মতো বার্মিজ মেয়েরা প্যাগোডার সামনে। ছোট্ট বাজার। একটা অন্য দেশ। মোরে থেকে দু-হাত বাড়ালেই। দেশের পরে অন্য দেশ তারও পরে অন্য। এই করেই পৃথিবী। মোরের ভারতীয় পুলিশ আর কাস্টমস অফিসারদের এবং বাসিন্দাদের, ‘তামু’তে যেতে কোনো বাধা নেই, বার্মার দিকের তামু থেকে ভারতে আসতেও কোনো বাধা নেই। স্থানীয় লোকেরা সকলেই সকলকে চেনে। এরা গিয়ে তামু থেকে সস্তায় লুঙ্গি কিনে নিয়ে আসে। তামাক বা কাঠের কাঁকই। আর ওরা এসে সস্তায় আণ্ডা-মুরগি কিনে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের আইনকানুন, রাষ্ট্রনীতি, সংবিধান এসবই কাগুজে জিনিস। এক দেশের মানুষের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের সব জায়গাতেই ভাব। বিশেষ করে পাশাপাশি দেশের। ঝগড়া বাধায় যারা, তারা আড়ালে থাকে, দলিল, দস্তাবেজ দুর্বোধ্য এক কারণের ঘেরে। তাদের দেখা যায় না। দিল্লির সঙ্গে রেঙ্গুনের কীরকম সম্পর্ক তাতে কোনো দিনই ‘মোরে’ অথবা ‘তামু’তে আসে যায়নি কিছুই। ‘তামু’ আর ‘মোরে’র মানুষেরা নিজেদের একটি নদীর দু-পারে অবস্থিত দুটি গ্রামের মানুষ বলেই জানে। এরা ওদের ভাষা জানে, ওরা এদের।

আজ রাধা রাতে নেমন্তন্ন করেছে শবরকে। রাধা, ইবোচবা সিং-এর মেয়ে। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে মোরেতে আর নেই। হয়তো তামুতেও নেই। ইংরিজি-টিংরিজি জানে না রাধা। বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ জানে। প্রচন্ড ঝাল দিয়ে মণিপুরি কায়দায় মাছ রাঁধে। আর ভাত। আর্মির রাম খুব সস্তা। প্যালেলে বন্ধু থাকলেই সহজে পাওয়া যায়। জীবনীশক্তিরই মতো শবরের কামও প্রবল। কাম প্রশমিত না হলে ওর মনে স্ফূর্তি থাকে না; বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়। এ ব্যাপারে ওর কোনো অপরাধবোধ নেই।

মোরেতে পৌঁছোল গাড়ি। কাস্টমস-এর অফিসে। হাতের কাজ সব শেষ করতে হবে। বেলা প্রায় তিনটে বাজে। তারপর কোয়ার্টারে গিয়ে ভালো করে চান করবে। গরম পড়ে গেছে এখন বেশ এখানে। তার ওপর আদ্রতা থাকায় বড়োই ঘাম হয়। চান-টান করে একটি বার্মিজ লুঙ্গির ওপরে আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে ও যাবে রাধাদের বাড়ি। বিরাট বিরাট প্রাগৈতিহাসিক সেগুন বনের মাঝে বেড়া-দেওয়া ছোট্ট বাড়ি। কলা গাছ, জবা গাছ, রঙ্গন, শিউলি, টগর আরও কত কী গাছ। রাধার মা নেই। বাবা ব্যাবসা করেন। যখন যা পান। প্রয়োজন বেশি নেই বলে মানুষটার টাকার লোভও নেই। যা আনেন তাতে বাপ-মেয়ের হেসে-খেলে চলে যায়।

টেবিলের কাগজপত্র নাড়তে চাড়তে হঠাৎ একটা খামে চোখ পড়ল শবরের। আঁকাবাঁকা অক্ষরে ইংরিজিতে ওর নাম লেখা। কিন্তু কোনো স্ট্যাম্প নেই তার ওপর। কোনো স্থানীয় লোক তার নাম লিখে ডাকবাক্সে ফেলে গেছে। খামটা ছিঁড়তেই দেখল, বাঁকাচোরা অক্ষরে কেউ লিখেছে,

Not Go Radha Denger, Your Friend.

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল চিঠির দিকে। বোঝবার চেষ্টা করল কে লিখতে পারে এ চিঠি এবং তার আসল উদ্দেশ্য কী?

কিছুদিন থেকেই মোরের আকাশে-বাতাসে একটি গুজব শুনেছে শবর যে, ইবোচবা সিং ইম্ফলের থংগলবাজারের সদর-রাস্তাতে নাকি দোতলা বাড়ি ও দোকানঘর কিনেছেন। ওঁর সঙ্গে মণিপুরের সবচেয়ে বড়ো চোরাচালানকারী দলের যোগসাজস ঘটেছে নাকি সম্প্রতি। আগে এই পথে নানারকম কৃষিদ্রব্যই শুধু যেত-আসত। আফিংও। যা মণিপুরে পাওয়া যায় না বা যার দাম বেশি, তা আসত বার্মা থেকে এবং বার্মাতে যেত সেইভাবেই। হিরে ও সোনাও যাওয়া-আসা করত এক সময়। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে বদলে গেছে রকমসকম। হাশিস, হেরোইন, গ্রাস ইত্যাদি আসছে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারেই যা ঘটার ঘটে। এ ঘটনা কিছু আশ্চর্য বা নতুন নয়। বাংলাদেশের সব সীমান্তে, পাকিস্তানের সীমান্তে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সারাদেশে, সে কলকাতা বম্বে যেখানেই হোক না কেন, কিছু মানুষ হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে বড়োলোকও হয়ে গেছে। তাদের রুজির অবশ্য এক বা একাধিক উৎস আছে। ছোটোখাটো কোনো দোকান, বা ব্যাবসা। অথচ সেই উৎসের প্রকৃত রোজগারের দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায় যে সেটা শুধুই লোকদেখানো। ওইটুকু উৎস থেকে এত রোজগার করা অসম্ভব। আর সমাজে এখন টাকাই যেহেতু একমাত্র প্রার্থিত বস্তু; সম্মানের, খ্যাতির, প্রতিপত্তির তাই এইসব লোক অতিসহজেই সমাজের মধ্যমণিও হয়ে উঠেছে। যদি বা কারো সন্দেহও জাগছে মনে, সে ভুলেও তার উল্লেখ করছে না খুন হয়ে যাবার ভয়ে।

‘DENGER’ শব্দটা নিয়ে ভাবছিল শবর। অনেক ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে এই শব্দটি। মানে, DANGER।

কিন্তু আজই যে রাধার জন্যে একটা পারিজাত-পারিং কিনে এনেছে শবর! লিভ-পে এবং ইনক্রিমেন্টের ব্যাক-পে একসঙ্গে পেয়েছিল। মাকে অর্ধেকটা মানি-অর্ডার করে পাঠিয়েছে ইম্ফল থেকে। আর অর্ধেকটা দিয়ে এই পারিজাত-পারিং। পাঁচ হাজার দাম নিয়েছে। পারিজাত-পারিং ভারী গয়না নয়। পাতলা। কিন্তু তার কারুকার্যই তার সৌন্দর্য। ইউরোপের মেয়েদের একটি পিঙ্ক-কোট দিলে যতখানি খুশি হয় তারা, মণিপুরের মেয়েরাও পারিজাত-পারিং পেলে ঠিক ততখানিই খুশি হয়। তা ছাড়া কিছু না দিতেই যে রাধা অনেকই দিয়েছে তাকে। অযাচিতভাবে।

রাধাদের বাড়ির পেছনে যে জমির মালিকানা কোনো দেশেরই নয়, যা ঈশ্বরের; সেই জমির মধ্যেই হাতির কানের মতো বড়ো বড়ো পাতাওয়ালা প্রাচীন সব সেগুন গাছকে সাক্ষী রেখে নরম ঘাসের মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে রাধা তার থোড়ের মতো ঊরু মেলে দিয়েছে শবরের জন্য চুঁয়ে-চুঁয়ে আসা চাঁদের আলোর মধ্যে। মাঝারি বাতাবিলেবুর গড়নের লজ্জাবতীর স্তবক-মোড়া পেলব স্তনদুটি তীব্র আমন্ত্রণ জানিয়েছে শবরকে। লেবুপাতার গন্ধ পেয়েছে ও তাতে। নীচে চাপ-চাপ নরম সবুজ আধো-অন্ধকার ঘাসের ঘনতার গভীরে চাঁদের আলোর মধ্যে লাজুক জোনাকির মতো হঠাৎ জ্বলে-ওঠা রাধার চোখদুটি মাঝে মাঝেই চমকে দিয়েছে শবরকে। চোখের ভাষা পড়েছে। নির্ভুল। রাধার স্নিগ্ধ শরীরী-নদী বেয়ে দেশ-দেশান্তরের সীমানা পেরিয়ে ভেসে গেছে শবর একাধিক রাতে রাধা নাম অস্ফুটে উচ্চারণ করতে করতে। জীবনে অনেক ও অনেকরকমই আনন্দরই শরিক হয়েছে শবর কিন্তু এই না-মানুষের দেশের এই শবরী তাকে যে তীব্র সুখমিশ্রিত স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে তা সে কোথাওই পায়নি। এ নো-ম্যানস ল্যাণ্ড-এর বনভূমির চাঁদোয়ার নীচের বাসভূমিতে রাধার সঙ্গে বহুবার মিলিত হয়ে ও যেন দেশ-কালের সব সীমানা পেরিয়ে সারাপৃথিবীর প্রেমিকেরই প্রতিভূ হয়ে গেছে।

কুলা সিং বললেন, পরশু রাতের রেইডের রেজাল্ট জানেন স্যার?

না। কত ছিল তা জানি। আমরাই তো ওজন করে পুলিশ গার্ড দিয়ে পাঠালাম। কেন? তার মার্কেট ভ্যালু কত বলছে হেডকোয়ার্টার?

দু-কোটি টাকা। কালকের রাতের হিন্দি আর ইংরিজি নিউজ-এ দেখিয়েছে তো। ফোনে শুনলাম।

কী? দেখিয়েছে কী?

ওই সিজড-মাল আর আমাদের সাহেবকে। রাত দুটোর সময়ে পুলিশের হেল্প ছাড়া বলতে গেলে একাই রিভলভার হাতে ওদের ধরলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনিই। আর টিভিতে এলেন সাহেব।

হাসল শবর। বলল, ওই তো নিয়ম! পার্কিনসনস ল’ পড়েননি কুলা? আপনাকে দেব পড়তে। যে সাবোর্ডিনেট নিজে আড়ালে থেকে নিজের ক্রেডিট হাসিমুখে তার সাহেবের বলে চালিয়ে দেয় তারই তো উন্নতি হয় তরতর করে। না করলেই সমূহ বিপদ।

তা হতে পারে। কিন্তু তা করলেও বিপদের হাত থেকে বাঁচা নাও যেতে পারে। তবে আপনার হবে কি না তা বলা যায় না। আপনি তো সাহেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কাজ করছেন। রাত দুটোর সময় রিভলভার হাতে গিয়ে আপনি যে ওই মাল আটকে ছিলেন তাতে সাহেব যে কতখানি খুশি হয়েছেন আর কতখানি দুখি তাতে সন্দেহ আছে। এখানে রায় সাহেব, আপনার আমি ছাড়া কিন্তু আর কোনো বন্ধু নেই। একথা জানবেন। রিভলভারটা সব সময়ে লোড করে নিজের কোমরে রাখবেন। সবসময়ে। শোবার সময়েও।

শবর একটা সিগারেট ধরিয়ে আরেকটা কুলা সিংকে দিয়ে বলল, বলুন না কেন, কোনো মেয়ের বুকে ওঠার সময়ও ন্যাংটো কোমরে রিভলভার বেঁধে ওঠা উচিত আমার।

তাই-ই উচিত। কুলা সিং বললেন।

তার পর সিগারেটের ধোঁওয়া উড়িয়ে বললেন, আপনি আমার অফিসার স্যার কিন্তু অভিজ্ঞতায় এবং বয়েসে আপনি আমার চেয়ে অনেকই ছোটো। একটা কথা বলব?

কী?

খুব সাবধানে থাকবেন। আপনার খুব বিপদ।

তাই তো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেসে কোয়ালিফাই করেও তা না নিয়ে এই সার্ভিসে এলাম। এখানে না পেলে, পুলিশে যেতাম। যেসব কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, প্রাণের ভয় নেই, সমাজের বাজে মানুষদের শাসন করে পায়ের তলায় রাখার সুযোগ নেই; সেই চাকরি করে আনন্দই নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে গেলে আরও ভালো হত কিন্তু এমন সর্বক্ষণের ঝুঁকি থাকত না তাতে।

কুলা সিং চুপ করে থাকলেন। সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখলেন। কথা বললেন না কোনো।

কী হল? মিস্টার সিং?

আজকের এদেশের সমাজের চেহারাটা জানতে হবে আপনার। একা শবর রায়ে কুলোবে না স্যার। দেশের এখন লক্ষ লক্ষ শবর রায়ের প্রয়োজন। বড়ো দুর্দিন দেশের। আপনি একা কী করবেন?

বলেই বললেন, আমি যাব এবার তামুর দিকে। গাছকাটা নিয়ে গন্ডগোল হয়েছে বারোটার সময়ে। আমাদের দিকের দুটি গোটা সেগুন শেষরাতে এক বার্মিজ ঠিকাদারের কাবাড়িরা কেটে নিয়ে গেছে।

আচ্ছা?

কুলা সিং যেতে যেতেও টিনের চাল আর ইটের দেওয়ালের অফিসের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পড়ে কী যেন শুনলেন উৎকর্ণ হয়ে। তার পর শবরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দিন ভালো নয় আজ। শেষবিকেলে দাঁড়কাক অলক্ষুণে ডাক ডাকছে। যাই তাড়াতাড়ি।

বলেই, তাঁর মোটরসাইকেলে উঠে পড়লেন।

শবর দেখল কুলা সিং-এর মোটরবাইক কিন্তু তামুর দিকে গেল না। থেংনোপাল-এর রাস্তার দিকে গেল। সেদিকে চেয়ে ভাবনাতে ডুবে গেল শবর। কুলা শিগগিরই রিটায়ার করবেন। বড়ো সংসার। সব সময়ে চিন্তাতে থাকেন। মাথার গোলমালের মতো হয়ে গেছে। ভারি সৎ অফিসার। আজকাল অধিকাংশ সৎ সরকারি অফিসারের মাথার গোলমাল। ইনফ্লেশান সকলের মাথাই চিবিয়ে খাচ্ছে। বিশেষ করে যাঁরা রিটায়ার করার মুখে।

চিঠিপত্র, অফিসের কাগজপত্র সব দেখে-টেখে শবর গিয়ে নিজের জিপে উঠল।নিজেই চালায়। গাড়িটা হেডকোয়ার্টার্সের। জিপটা মেরামতিতে ছিল। আজই কারখানার লোক দিয়ে গেল।



কলকাতায় গেছিল গতশীতে। কাস্টমস হাউসে ভালো পারফিউম ছিল বিক্রির জন্যে। ফাউনটেইন পেন। উজ্জ্বলদা ছিলেন তখন। দিল্লি থেকে এসেছিলেন। উজ্জ্বলদা অবশ্য এখন শবরের চেয়ে অনেক ওপরে কাজ করেন। চেয়ারম্যানের খুব প্রিয়পাত্র। উজ্জ্বলদাই বউদির জন্যে কিনেছিলেন পারফিউম। বললেন, তুইও কিনে ফেল একটা করে। গার্ল-ফ্রেণ্ডের জন্যে।

শবর বলেছিল, আমার কি একজন গার্লফ্রেণ্ড? টাকা ধার দাও তো পুরো স্টকটাই কিনে নিই।

উজ্জ্বলদা হেসেছিলেন।

বলেছিলেন, তোর সম্বন্ধে নানারকম রিপোর্ট আসছে দিল্লিতে।

ভিজিলেন্সের?

ধ্যুৎ। নারী-ঘটিত। সত্যি নাকি?

নর এবং নারী কাছাকাছি থাকলেই ঘটনা ঘটে। আমার অফিশিয়াল পারফরমেন্স ঠিক-ঠাক আছে তো? তাতে কোনো কমপ্লেন না থাকলেই হল।

ফাস্টক্লাস!

তবেই হল।

সেই পারফিউমই মেখেছে শবর আজ চান করে উঠে। পাঞ্জাবিতে, বুকের চুলে, কানের লতিতে, নাভিমূলে। রাধাকে দেয়নি। রাধার গায়ে সবসময়ই চন্দনের গন্ধ। বৃন্দাবনের রাধারই মতো! সব সময়েই সে সুগন্ধি।

ঢাকা-খোলা জিপে বসে আস্তে আস্তে হাওয়া খেতে খেতে গিয়ে পৌঁছেছে শবর রাধাদের বাড়ি। আজ পূর্ণিমা নয়। তবে ত্রয়োদশী-চতুর্দশী হবে। অন্ধকার হয়ে গেছে পৌনে একঘণ্টা মতো। চাঁদ উঠেছে। পথের পাশের কাঁঠাল পাতায় আলো চিকচিক করছে। আমের বোল আর কাঁঠালের মুচির গন্ধে ম ম করছে মোরের নবীনা রাত।

ইবোচবা সিং-এর বাড়ি একটু নির্জনে। মানুষটা শবরের প্রতি অত্যন্ত কনসিডারেট। শবর লক্ষ করেছে যে, যেদিনই ও রাধার কাছে আসে সেদিনই তিনি বাড়ি থাকেন না। অন্তত যে সময়ে শবর আসে। যখন খেতে বসে ওরা রাত দশটা নাগাদ তখনই ফিরে আসেন উনি। একসঙ্গে বসে খান। তামুতে আজ কী ঘটল তার গল্প করেন। গেজেট এখানকার।

জিপের আওয়াজ শুনেই রাধা দৌড়ে এল বারান্দায়।

রাধা! দেখো তোমার জন্যে কী এনেছি। শবর বলল মণিপুরিতে।

কী?

পারিজাত-পারিং।

সত্যি!

কিছু মানুষ থাকে সংসারে, যদিও সংখ্যায় তারা বড়োই কম, যারা দিতে জানে। আবার কিছু মানুষ থাকে, যারা সংখ্যায় আরও কম; তারা নিতেও জানে। তা একটি চুমুই হোক, কি ঘাসফুল, কি পারিজাত-পারিং! ঘাসফুলকেও তার নেওয়ার গুণে অগ্নিশিখা করে তোলবার ক্ষমতা রাখে তারা। রাধা সেই জাতেরই মেয়ে। কিছু পেলে তো খুশি সকলেই হয়, কিন্তু খুশি যে হয়েছে, তা বোঝাতে পারে না বেশির ভাগ মানুষই। রাধা তাদের মতো আদৌ নয়। রাধা বলল, পরিয়ে দাও আমাকে।

শবর বলল, এখানে নয়। নদীপারে চলো।

মনে মনে বলল, ঈশ্বরের রাজত্বে, সেই সেগুন ছায়ার ঘাসবনে, যে জমিকে কোনো মানুষ, কোনো দেশ তার ‘নিজের’ বলে দাবি করতে পারবে না; সেই তৃণভূমিতে।

রাধা কথা বলল না, বলল, কী দেখছ আমার চোখে? চলো যাই।

চলো।

এ পর্যন্ত রাধা কখনো শবরের কথার পিঠে কথা বলেনি। একটিও না। কোনোদিন। শবরের কোনো সাধ, কোনো ইচ্ছে বা কোনো খুশির পথে বিঘ্ন হয়নি। যা-ই যখন চেয়েছে, যেমন করে চেয়েছে শবর, দিয়েছে রাধা। শবরের মধ্যে লীন হবার জন্যেই যেন ও জন্মেছিল। শবরের সুখই যেন তার সুখ। আর শবরের সুখকেই যেন দশগুণ বাড়িয়ে নিয়ে প্রতিফলিত করত রাধা তার চোখে-মুখে-ত্বকে। ভালোলাগায়, ভালোবাসায় চকচক করে উঠত তখন ওর সমস্ত সত্তা। শবর বুঝতে পারত যে, যারা নিতে না জানে, তারা দিতেও জানে না।

কী রেঁধেছ, আজ? শবর শুধোল আধো-অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে।

তামু থেকে কাঁকড়া এনেছিল বাবা। আর বুনো হাঁস।

বেশি করে ঝাল দিয়েছ তো?

হুঁ। তোমার চেয়েও বেশি করে। হেসে বলল রাধা, রাধাচূড়ার স্তবকের মতো নুয়ে পড়ে।

বলেই, শবরের হাত জড়িয়ে ধরল। ওর স্তনের ছোঁয়া লাগল শবরের বাহুতে। গা শিরশির করে উঠল শবরের।

প্রত্যেক নারীর কাছেই কতগুলো গুলিভরা রিভলভার যে থাকে তা ওরা নিজেরাই জানে না। অনেক গুলি থাকলেও তার একটিও ব্যবহার করে না অনেকেই সারাজীবনে।

সেটাই আক্ষেপের। ভাবল, শবর।

দেখতে দেখতে সেগুনবনে এসে পৌঁছোল ওরা। একটি প্রাচীন গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে রাম-এর পাঁইট বের করল ও। বলল, খাবে তুমি?

যদি তুমি বলো। রাধা বলল। তুমি বললে, বিষও খেতে পারি।

ছিপিটা খুলে প্রথমে রাধাকেই দিল।

রাধার মুখ বিকৃত হয়ে গেল কিন্তু শবরের খুশির জন্যেই সে খেল।

রাধাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে নিজে একচুমুক দিয়ে বলল, পারিজাত-পারিং পরাব তোমাকে।

তার পর শবর এক এক করে সব সুতো খুলে নিল রাধার চাঁদমাখা মসৃণ শরীর থেকে। দাঁড়িয়ে উঠে, পারিজাত-পারিংটা পরিয়ে দিল গলায়।

রাধা বলল, আজ দোলপূর্ণিমা হলে বেশ হত না? আমি বেশ রাধা হতাম, তুমি কৃষ্ণ।

আমি তো তোমার কৃষ্ণই!

তাই তো! কিন্তু আমি অন্য দিকে চেয়ে আছি, তুমিও আমার মতো করো নিজেকে।

হাসল শবর। রাধার ভাষার কারিকুরি দেখে খুশি হল। একই কথা অনেক ভাবে বলতে পারে তাই তো ওরা মানুষ। মনে মনে বলল, শবর।

শবর নিরাবরণ হলে রাধাকে বলল, এসো। আশ্লেষে মন্থর বাতাসে সেগুনপাতার ফিসফিসানির মধ্যে, অদূরের চাঁদ-ঝলকানো শীর্ণ নদীর মৃদু ছলছলানির শব্দের মধ্যে, চাঁদের আলোয় রাধার গলা আর স্তনসন্ধির শোভা হয়ে ফুটে-থাকা পারিজাত-পারিং-এর মধ্যে সেই অস্ফুটে বলা ‘এসো’ শব্দটি হিরে-ফুল হয়ে ঝড়ে পড়ল ঘাসে।

রাধা নরম চাপ চাপ ঘাসের ওপরে শুয়ে পড়ল। বিদেশি হাওয়া এল বার্মা থেকে নদীর ওপর দিয়ে। এলোমেলো হল চুল। ও কিছু বলল অস্ফুটে।

ঘাস বলল, এসো। চাঁদ বলল, এসো। নদী বলল, এসো। সেগুনবনের ছায়া বলল, এসো।

পৃথিবীটা খুব বাজে জায়গা। অধিকাংশ মানুষই খারাপ, চোর, বদমাইশ, চোরাচালানকারী। তবুও এই পৃথিবী খুব ভালো। এই জমিটুকু তো খুবই ভালো। যার ওপর কারোর মালিকানা নেই। রাধার এই শরীরটুকুও খুব ভালো যার ওপরে শবর ছাড়া আর কারোর মালিকানা নেই। ভাবল শবর।

শবরের চোখ রাধার গলার পারিজাত-পারিং-এর দিকে। চাঁদের আলোয় সোনার বিন্দুগুলি জোনাকির মতো সবুজ হয়ে জ্বলছে।

শবর নীচু হবে, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে কে যেন গুলি করল তাকে। রাধার শরীরের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। ওকে ছুড়ে ফেলে দিল রাধা।

কবিরা যাই বলুন না কেন; জীবন, প্রেমিকের চেয়েও প্রিয়।

লাফিয়ে উঠে ভয়ার্ত চিৎকারে সেগুনবন ভরিয়ে দিয়ে নিজের জামাকাপড় হাতে তুলে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল রাধা দিগবিদিক শূন্য হয়ে বাড়ির দিকে, চুল উড়িয়ে। আর একটি মানুষ, অন্ধকারে তাকে চিনতে পারল না শবর; স্যুট-পরা একটি মানুষ, বুট-পরা পায়ের লাথিতে শবরকে উলটে দিল। দিয়েই আবার গুলি করল বুকে।

তার পাশে আরও একটা মানুষ উঠে এল। সে বলল, আপনার হাত কিন্তু দারুণ স্যার। গ্লাভসটা খুলে ফেলুন এবারে। ওই রিভলভারটা আমাকে দিন। ওটা তো আপনার সার্ভিস রিভলভার নয়। চোরাই।

তখনই হঠাৎ কে যেন বলল, হ্যাণ্ডস আপ। ওই লোকগুলো হাত তুলে ঘুরে দাঁড়াল। শবরের মনে হল বহুদূর থেকে কুলা সিং-এর গলা শুনল। সেনসাহেবের গলাও কি?

কুলা সিং বললেন, আমাদের বড়ো দেরি হয়ে গেল স্যার।

ওর দেশকে শবর রাধার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবেসেছিল। কেউ কি সেকথা বুঝবে?

শবর তখনও মরেনি। কিন্তু বুঝতে পারছিল যে একটু পরেই মরবে। বড়ো কষ্ট! রক্তে সমস্ত শরীর ভিজে চ্যাটচ্যাটে হয়ে গেছে। জোর করে শেষবারের মতো চোখ খুলল ও। সারামস্তিষ্ক-ভরা তারা। ঝিকমিক করছে। দিগন্তব্যাপী চাঁদভাসি আকাশে যেন রাধার গ্রীবা আর স্তনের মাঝে দুলতে থাকা পারিজাত-পারিংটিই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *